সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দনজলে।
(‘সেই গল্পটা’, পূর্ণেন্দু পত্রী)
কবে থেকে মানুষের মনে বৃষ্টির প্রভাব পড়ে আছে খানিক সে-ধারণা করা যায় মানুষ যখন প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে বসবাস করত তা থেকে। মানবমনের অনুভবে বৃষ্টি একটা স্থান নিয়ে আছে সবসময়ই। শিল্পী রশীদ আমিন ছাপচিত্রী হলেও তাঁর এবারের প্রদর্শনীর বেশিরভাগ ছবি জলরঙে আঁকা।
পুরো প্রদর্শনীর ছেচল্লিশটি কাজের মধ্যে ত্রিশটিরও বেশি কাজ মেঘ, বৃষ্টি, জল নিয়ে। তাই তো এ-প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘মেঘমল্লার’; ‘ঞযব গড়হংড়ড়হ জধমধ ’। বর্ষাযাপনের ইঙ্গিত অনেক শিল্পীর ক্যানভাসে ইতোমধ্যে আমরা দেখে থাকলেও রশীদ আমিনের ক্যানভাস সাজানো হয়েছে বৃষ্টিকালীন মেঘ, বৃষ্টির জলরাশির ধোয়া, আকাশে জমে থাকা বৃষ্টিস্নাত রং দিয়ে। রশীদ আমিনের বয়ানে – ‘বৃষ্টি তো আমরা সবসময়ই দেখি। এটি আমাদের কাছে এক চেনা অধ্যায়। কিন্তু এবার যখন আমি গ্রামে যাই, দেখি এখানের বৃষ্টি ভিন্ন, টিনের চালের শব্দ, মেঘের চলাচল, গর্জন, শান্ত-সমাহিত এক অঝোর জলধারা।’ বলা যায়, রশীদ আমিন তাঁর অনুভূতিকে মূর্ত করেছেন জলরঙের ধোয়ায়। জলের ধোয়ায় রং ছুটে বেড়ায়। তেমনিভাবে আমিনের ক্যানভাসের রংও ছুটে বেড়ায়।
এখানে বলে রাখা যায় – আমিনের বৃষ্টি কখনো ক্যানভাস জুড়ে উল্লম্ব অথবা আড়াআড়ি রঙের ছোটাছুটি হয়ে দেখা দেয়। বর্ণলেপনের পর রঙের আভা এক রঙের সঙ্গে আরেক রং জড়িয়ে মেঘের আবহ তৈরি করে।
কথা হলো, রশীদ আমিন এই আবেগজাত সৃজনে কেন উৎসাহী হলেন। এর কারণ নানাবিধ – প্রকৃতির সঙ্গে রশীদ বেশ কিছুকাল কাটিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণকালে চীনে অবস্থান করেন বেশ কবছর। পিএইচ.ডি ডিগ্রি গ্রহণের সময় সে-দেশের কুয়াশা, বৃষ্টি, পাহাড় তাঁকে মুগ্ধ করেছে। মুগ্ধতা তাঁর মননে বাসা বেঁধেছে।
তাঁর করা ছাপচিত্রের ধাঁচের সঙ্গে জলরঙের করণ-পদ্ধতি একরকম মনে হয় না। তিনি জলরঙের ধোয়া-পদ্ধতিতে (ওয়াশ) তুলির ব্যবহারে মেঘ, বৃষ্টির ভাষা নির্মাণ করেছেন। শিল্পীর বিবর্তন অগ্রগমন মানেই প্রকৃতির মধ্যে লুক্কায়িত রূপ, ছন্দ ও বিস্ময়ের ক্রম-আবিষ্কার এবং এসবকে সম্মিলিত করে একটি চিত্রভাষা অর্জন। রশীদ আমিনের সতত পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিভিন্ন পথ খোঁজার দিকে আগ্রহী করে তোলে এই প্রকৃতিবন্দনাকে। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।
শিল্পী মনোভাব ব্যক্ত করেন এভাবে – ‘বর্ষা বাঙালির জীবনে অভাবনীয় স্বস্তি নিয়ে আসে আর পৌঁছে দেয় এক অনির্বচনীয় শক্তি। আষাঢ়স্য এ-দিবসগুলোতেই আমাদের যত রোমান্টিকতা। বর্ষার মেঘমালা, সূর্য-মেঘের লুকোচুরি, শীতল হাওয়া, অবিরাম বর্ষণ, এসবই প্রকৃতিতে এক নাটক তৈরি করে, যা শিল্প-সৃজনের এক অভাবনীয় প্রেরণার উৎস। আমরা এ-কথাও বলতে পারি, বর্ষাই হচ্ছে বাঙালির সবচেয়ে বেশি শিল্প-সৃজনে প্রাণিত করার ঋতু।’
রশীদের শিল্পকর্মকে আমরা বলতে পারি একটি আবেগজাত তাৎপর্যপূর্ণ শিল্প। সমসাময়িক জীবনের অনুভূত স্পন্দন থেকে এ শিল্প-সৃজন সম্ভবপর হয়েছে। ‘মেঘমল্লার’ সিরিজের ছবির রঙের বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্যানভাসেই সেপিয়া গ্রিন আর অল্পবিস্তর হলুদের আভা। এ-ছবি মেঘের আড়ালে উঁকি দেওয়া আলো এক মেঘ আর রোদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘মেঘমল্লার-৩’ ছবিতে মেঘ ভেদ করা আলোর আভাস খুঁজে পাওয়া যায়। ‘মেঘমল্লার-৪’ ছবিতে গাঢ় ও হালকা সবুজের প্রাণোচ্ছলতা দেখা যায়। বর্ষায় প্রকৃতিতে মায়াবী সবুজের সমাবেশ দেখা যায়। এ-ছবিতে তেমনি সবুজের দেখা মেলে। ‘মেঘমল্লার-৯’ ছবিটি বলা যায় এ-প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য কাজ। আলট্রামেরিন ব্লুর ওয়াশে তৈরি হওয়া আকাশের সঙ্গে দু-একটি আড়াআড়ি নীল রেখা আকাশের গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘মেঘমল্লার-১১’ ছবিটিও দর্শকদের মধ্যে এক বৃষ্টিমুখর দিনে রোদের ঝলক মনে করায়। জলরঙের কাজ দেখা শেষে আমরা ঘুরে আসি রশীদ আমিনের ছাপচিত্রের
ভুবন থেকে। বিষয় হিসেবে লতাগুল্ম, আকাশের নীল ফর্মের সঙ্গে কালো রেখার আড়াআড়ি বিভাজন দর্শকের দৃষ্টিতে আনন্দ সৃষ্টি করে। আমিনের এচিং
পদ্ধতির কাজগুলোতে কালো রঙের আধিক্য রয়েছে, তাতে দৃষ্টিগ্রাহ্য না হয়ে জমিন থেকে কিছু ফর্ম বিপরীতমুখী হয়েছে মনে হয়।
রশীদ আমিনের প্রিন্ট ছবির ইমেজগুলো চিত্রতলে সম্মিলিতভাবে কোনো গল্পের অবতারণা করে না, বরং বিষণœ রং, আলোছায়ার সংঘাত ও আকৃতির ভাংচুরের মাধ্যমে একটি বিশেষ মানসিক অবস্থা তৈরি করে। প্রদর্শনীর দুটি ধরনের কাজের মাঝে শিল্পীর মননের দুটি অবস্থা প্রকাশ পায়, যা অতিসাম্প্রতিক বিশ্বে চলমান সমাজবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি মনে করলে অত্যুক্তি হবে না।
রাজধানীর শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে গত ৩ আগস্ট শুরু হওয়া এ-প্রদর্শনী শেষ হয় ১৬ আগস্ট।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.