হালিমা খাতুন আমাদের সাহিত্যের, আমাদের ভাষার ইতিহাসের, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে, সর্বোপরি দেশের জীবনযুদ্ধে যোদ্ধা নারীদের সারিতে এক উজ্জ্বল নাম। ১৯৫২-এর ভাষা-আন্দোলনে যে চারজন নারী প্রথম রাজপথে অংশ নিয়েছিলেন হালিমা খাতুন তাঁদের একজন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারা ভাঙার সেই দিনটির বর্ণনা পাই এই বইয়ে। তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আরেকবার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রে যোগ দেন। এর পর থেকে তিনি
শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্তর দশকের শেষের দিকে জাতিসংঘের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে নেপালের শিক্ষা কার্যক্রমের মূলধারা রচনায় নারীর অংশগ্রহণের বিষয়ে বিস্তর ভূমিকা রাখেন। এর আগে ১৯৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলরাডো থেকে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় পিএইচ.ডি অর্জন করেন।
এটুকু বর্ণনাতে হালিমা খাতুনের কৃতিত্ব অপূর্ণ থাকে। তাঁর প্রধান কৃতিত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশের সাহিত্যজগৎ হয়তো এখনো উদাসীন। হালিমা খাতুনের সাহিত্যজীবন একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন; কিন্তু আমরা তার হদিস জানি না। শিক্ষা কার্যক্রম গবেষণায় এই নারী-বুদ্ধিজীবী মৌলিক শিশুসাহিত্য ছাড়াও শিশুদের পাঠ্যবই, শিশুদের পঠন-পাঠন, শিক্ষাদান প্রণালি – এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। শিশুদের মনস্তত্ত্ব আত্মস্থ করে সাহিত্য রচনার ধারা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তাঁর প্রথম বই সোনা পুতুলের বিয়ে। দ্বিতীয় বই হরিণের চশমা-ও প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি। তারপর ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় পাখির ছানা। এই বইটি তৎকালীন শিশুসাহিত্যের জগতে ছিল এক অনন্য সংযোজন। এর কাহিনি এরকম : পাখি-মা বাসায় বসে ডিমে তা দিচ্ছিল। হঠাৎ ডিমটা লাফ দিলো দেখে মা-পাখি তার বাচ্চার জন্য খাবার আনতে উড়ে গেল। একটু পরেই ডিম থেকে বাচ্চা এক লাফে বেরিয়ে মাকে খুঁজতে লাগল। তার সঙ্গে মুরগি, কুকুর, বিড়াল, হাতি অনেকের দেখা হলো। তাদের সবাইকে শিশুপাখি একে একে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আমার মা? জীবজন্তুরা সবাই একে একে জানাল, না, তারা কেউ পাখিটির মা নয়। অবশেষে পাখির ছানা ঘুরতে ঘুরতে তার মায়ের দেখা পেল – এই তো আমার মা।
নির্বাচিত কতগুলো শব্দ নিয়ে ছড়াটি রচনা করা হয়েছিল। যারা পড়তে পারে না তারাও শুনে শুনে মুখস্থ করতে পারে। সত্তর দশকের অনেক শিশুর কাছে এটি এখনো শৈশব-স্মরণ।
কিন্তু হালিমা খাতুনের এসব কৃতিত্বের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণের আরেকটা মিথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষকদের কাছে ব্যাপক অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের নারীজীবনের একটি ব্যতিক্রমী আলেখ্য তিনি তাঁর জীবন দিয়ে রচনা করেছেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী – মেঘের ওপারে আকাশ। অসীম এক আক্ষেপ নিয়ে বইটি রচনা করেছেন তিনি। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘এ জঞ্জাল ভেসে যাবে অজানার টানে অস্থান ছেড়ে যথাস্থানে। এই যেমন আমি! কী দরকার ছিল আমার মায়ের অষ্টম সন্তান হয়ে পৃথিবীতে আসার? তাও দ্রাবিড়-দ্রাবিড় চেহারা আর সেই বর্ণের খাঁটি গাত্রবর্ণ। তারপর বিদ্যা-বুদ্ধিতে একেবারেই মিডিওকার। … ছোটবলায় মা বকলে হলদে পাখি হয়ে উড়ে যাবার প্রবল ইচ্ছা, আকাশে মেঘের ওপারে কী আছে তা দেখার প্রবল বাসনা। অযথা নয় কি?’
নিজের সম্পর্কে এই বক্তব্য রাখলেও আমরা জানি তাঁর জীবনের সাফল্যের কথা। হালিমা খাতুনের জীবনী সর্বার্থে ১৯৪৭-পরবর্তী বাংলাদেশের নারীসমাজের ইতিহাসের একটি অংশ। বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত জেলা বাগেরহাটের তৎকালীন শহরতলির একটি গ্রামের কৃষিজীবী বাবার অষ্টম সন্তান হালিমা। তাঁরা ছিলেন সাত বোন। তাঁর বাবা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করে তৎকালীন গুরু (শিক্ষক) ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছিলেন। খুলনা-কলকাতা নাইট ট্রেন ছিল তখন বিখ্যাত এক ট্রেনভ্রমণ। ভাবতে অবাক লাগে, বাগেরহাট থেকে তখন একরাতে কলকাতা যাওয়া যেত। তাই হয়তো বাগেরহাট অর্থনৈতিকভাবে খুব সফল না হলেও এখানে শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় প্রাগ্রসর লোকজনের দেখা পাওয়া যায় এখনো।
হালিমা খাতুনের আত্মজীবনী থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে বইটির পূর্বাপর বিশেষত্বের পরিচিতি দিতে চাই। এখানে হালিমা খাতুনের নিজের বর্ণনাতে তৎকালীন সমাজ-রাজনীতি-নারীদের জীবন – এসব ক্ষেত্রে গত শতাব্দীর চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকের পরিবর্তনের চিত্রগুলো স্বচ্ছভাবে পাওয়া যায়।
(আমাদের বাড়িতে) আর ছিল আমবন, তালবন, নারকেল, সুপারি, বাঁশ-বেত সব গাছপালা আর কিছু ঘরবাড়ি নিয়ে এক সুররিয়ালিস্টিক কারবার।
চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় তখনকার বড় লাট লর্ড লিনলিথগো ও তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন আমাদের স্কুলে।
লেখা শুরু তালপাতায়। কয়লার গুঁড়ো পানিতে গুলে কালি আর সরু কঞ্চির কলম দিয়ে লেখা।
চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে ভর্তি হই বাগেরহাটের মনোমোহিনী গার্লস স্কুলে।
একেবারে নির্ভেজাল মুসলিম গ্রামে থাকি। সেখানে ছিল মাত্র দুজন সরকারি কর্মচারী। একজন এসডিও-এর চাপরাশি, অন্যজন কোর্টের পাংখাপুলার। তরুণীমেয়েদের কলেজে পড়তে তাই নানা বাধা। তারা দল বেঁধে এসে আব্বাকে বলত, ‘মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিন’। আব্বার সহজ উত্তর ছিল, ‘মেয়েকে বিয়ে দিলে যে আর পড়া হবে না।’
১৯৪৭ সালে বাগেরহাট প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে মানবিক বিভাগে ভর্তি হই। আমার বাবার পূর্ণ সমর্থন ছাড়া সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখানে আসা মুসলমান নারী হয়ে সম্ভব ছিল না।
১৯৫১ সালের এক বিকেলে কলকাতার কমলালয় থেকে কেনা এক স্টিলের ট্রাঙ্কে বই, খাতাপত্র, কাপড়চোপড়, চুলে দেবার তেল, জায়নামাজ, কাঠের খড়ম ও অন্যান্য টুকিটাকি নিয়ে রোকেয়া হলের দরজায় গিয়ে নামলাম।
রোকেয়া হলের সেকালের নাম ছিল ওমেন স্টুডেন্ট’স রেসিডেন্স (ডাব্লিউএসআর), যা বর্ধমানের নবাবের বাড়ি ছিল একসময়। সেখানে আমরা তিরিশ জন মেয়ে থাকতাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান টার্নার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ইংরেজি কোথায় শিখেছ? আমি বললাম : গ্রামের পাঠশালায় প্যারীচরণ সরকারের ফার্স্টবুক আর সুন্দরবনের ধারের মানুষ তো আমরা, তাই বাঘ-ভালুকের কাছ থেকে শিখেছি। তিনি হেসে হেসে বললেন, ‘তুমি খুব চালাক।’
সাউথ বিল্ডিংয়ের পিছন দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে। সারওয়ার মুর্শিদ স্যারের ক্লাসের সময় সেখানে একটা ট্রেন শান্টিং করতো। … অন্য শিক্ষকদের মধ্যে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, আমরণ ছাত্রছাত্রীদের ভালবেসেছেন। … মুনীর চৌধুরী জেল থেকে বেরিয়ে এলে আমাদের পড়াতেন। … সাজ্জাদ স্যার ছিলেন দারুণ বিলেতিয়ানায় অভ্যস্ত। পকেটে তার কাঁটাচামুচ থাকত। … তিনি পড়াতেন ক্যানটারবেরি টেলস, তাঁরই মাধ্যমে জোফ্রে চসারের সঙ্গে বন্ধুত্ব। (সৈয়দ) আলী আশরাফ স্যার বোধ হয় টি এস ইলিয়টের কবিতা পড়াতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি তিনি কিভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উপস্থিত ছিলেন, সাল-তারিখ দিয়ে তিনি তারও উল্লেখ করেছেন :
১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হয় কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক সম্মেলন, সেখানে বিখ্যাত জবানবন্দি নাটকে আমি প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করি। আমার বিপরীতে ছিলেন সেন্টু, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। অন্যদের মধ্যে ছিলেন অর্থনীতির আনিসুর রহমান, নূরজাহান মুরশিদ। সেখানে রমেশ শীল গান করেছিলেন। সুফিয়া কামালও আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
১৯৫৫ সালে খুলনায় সুন্দরবন সংগীত সম্মেলন হয়েছিল। ভারত থেকে অনেক শিল্পী এসেছিলেন, উৎপলা সেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকা থেকে আব্বাসউদ্দিন ও তাঁর ছোট মেয়ে ফেরদৌসী এসেছিলেন। অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলাম আমি। লাল পাড়ের একটা গরদের শাড়ি ছিল। অনেকেই মনে করেছিল আমি ভারত থেকে এসেছি।
খুলনায় আমার এসরাজ বাজানো শুরু হয় সুধীন বাবুর কাছে।
হালিমা খাতুনের একটি বিশেষ সময় কেটেছে বাংলাদেশের প্রথম যুগের রাজনৈতিক আন্দোলনে। ভাষা-আন্দোলনের পর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। পাকিস্তান সৃষ্টির পরের প্রথম দশকে যে নারীরা বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন তার অভিজ্ঞতার খণ্ড খণ্ড বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে :
১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। অধ্যাপক জুবেরী আমার শিক্ষক ছিলেন। … কিন্তু এসে দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ, বিক্ষুব্ধ ঢাকা শহর। এত ক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব করিডোর আর ক্লাসরুমে প্রতিবাদের প্রতীক্ষায় গুমরে গুমরে উঠছে। মাতৃভাষা নিয়ে চলছে ষড়যন্ত্র … ভাষা আন্দোলন আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল।
ভাষা আন্দোলন তখন আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে গেছে। একুশের পর ক’দিন ধরে আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিহতদের পরিবার ও আহতদের জন্য চাঁদা তুলতাম। সবার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতায় আশাবাদী হলাম। প্রচার, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, গোপন সভা সবকিছুই অব্যাহত ছিল। লেখাপড়া প্রায় ভেসে গেল আন্দোলনের তোড়ে।
বিশ^বিদ্যালয় ও তার বাইরে ভলান্টিয়ার দিয়ে স্কোয়াড গঠন করে পুরনো ঢাকার শাঁখারিবাজার, ঠাটারিবাজার, সুরিটোলা, শুক্রাবাদ, জিঞ্জিরায় জনগণকে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছি।
আমি তখন ঘোর কমিউনিস্ট। প্রায়ই রাতে মণি সিংহ ও অন্যান্য কমরেড গুরুদের ক্লাসে ডায়লেক্টিস পড়ি। সংগ্রামের জন্য নিজে তৈরি হচ্ছি, অন্যদের তৈরি করছি।
ক্রমে কংগ্রেস ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টির পাঠশালায় ভর্তি হয়েছি। সতীশ পাকড়াশী প্রমুখ আন্দামান-ফেরত বিপ্লবীদের দুরন্ত আকর্ষণে ছুটে গেছি তাদের কর্মশালায়।
হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের কালো নদীকে বাঁধবার জন্য গণনাট্যের গান গেয়েছি :
আয়রে পরাণ ভাই
আয়রে রহিম ভাই
কালো নদীকে বাঁধবি যদি আয় …
আত্মজীবনীতে তাঁর কর্মময় জীবনের অগাধ বিবরণ পাওয়া যায়, কিন্তু নিজের প্রেম-ভালোবাসা কিংবা দাম্পত্য জীবনের কোনো বর্ণনা নেই। অতীত স্মৃতি মুখরিত হয়ে উঠলে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় গভীর কোনো বেদনাময় আবেগ, কোনো ব্যক্তির প্রসঙ্গ।
কিন্তু ১৩২ পৃষ্ঠার আত্মজীবনীর ১২০ পৃষ্ঠায় এসে মাত্র দুই পাতা বরাদ্দ করেছেন তাঁর দাম্পত্যজীবনের বর্ণনায় :
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২/ক ধারা জারি করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। তারই মধ্যে বাজল আমার বিয়ের বাজনা। পাত্র শামসুল হুদা (কানু), পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে একটা মহাবিদ্যালয়ে রাজনীতির অধ্যাপক। থাকে করাচির নওয়াব শাহ কলোনিতে।
১৯৫৫ সালে শুভদৃষ্টির সময় রেডিওতে বেজেছিল, মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দোবো খোঁপায় তারার ফুল। ঠিক তাই হলো, তারা আর গাছের ফুলে বিয়ে সম্পন্ন হল। কনে সাজিয়ে রমনা রেস্ট হাউজে প্রথম রাত, দ্বিতীয় দিনে লাকি ভাবীর বাসায়, উমেশ দত্ত রোডে। তৃতীয় দিনে বর-কনে রওনা হলো করাচি তথা নওয়াব শাহ কলোনির উদ্দেশ্যে।
এ পর্যন্ত কয়েক মাস হালিমা খাতুনের দাম্পত্যজীবনের বর্ণনা কি মধুর! কিন্তু হঠাৎ একটা বিচ্ছেদের পূর্বাভাস পাওয়া যায় :
তখন খুলনা করোনেশন স্কুলে চাকরি করতাম। ছুটি নিলাম এক মাসের। গরমের ছুটিতে আমার স্বামী এলেন। একমাস থাকলেন। তারপর একদিন পিআইএ বিমানে সে করাচি রওনা হলো, আমি থেকে গেলাম এদেশ।
এরপর আত্মজীবনী রচনায় আশ্চর্য সংযমের পরিচয় দিয়েছেন তিনি – জীবনের ভয়ংকর ট্র্যাজেডির বর্ণনা কয়েক লাইনে দিয়েছেন। কোনো আক্ষেপ নেই, জীবনের পরম প্রতারণার শিকার হয়েও কাউকে দোষারোপ করেননি। বরং প্রতারক ভদ্রলোকটিকে ‘অত্যন্ত গুণী মানুষ, বিদ্বান’ বলে বিশেষণে যুক্ত করেছেন।
আমাদের যোগাযোগ চলল আকাশ পথে, পত্রালাপের মাধ্যমে।
আমার স্বামী কানু অত্যন্ত গুণী মানুষ, বিদ্বান। কিন্তু আমার সাথে তার জীবনাচারণে, দর্শনে মিল হলো না। তার বনলতাকে সে কোন দিন ভুলতে পারেনি। মনের সেই মন্দির কলুষিত হলো, আমার প্রতি ঘৃণায়। কয়েক সপ্তাহ ছিলাম। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। একদিন প্লেনের একটা টিকিট হাতে দিয়ে ড্রাইভার দিয়ে এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দেয়া হল। সেই শেষ।
কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ পেলো সন্তানের অস্তিত্ব। … ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কমরেড কেজি মোস্তফা এবং সাবেয়া মোস্তফার বাসায় উঠি। যথা সময়ে আমার মেয়ে প্রজ্ঞা লাবণীর জন্ম হয় বাংলাবাজার ম্যাটার্নিটিতে।
তারপরে তাঁর জীবনতরী বেয়ে যাওয়ার ইতিহাসে কোন দুঃখ কষ্টের বর্ণনা নেই। কোন হৃদয়াবেগ, কোনো শূন্যতাবোধের বয়ান নেই, কোন দীর্ঘশ্বাস নেই। জননী হয়ে এক কন্যার সার্বিক অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন সারাজীবন।
কিন্তু বুকের অলিন্দ থেকে একটা রোমান্টিক আর্তিকে তিনি কী দুঃসহ বেদনায় একটা শ্লেষাত্মক হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবেশন করেছেন।
এই ভাবে জীবন নদী মহাকালের পাথর কেটে কেটে সমতলে চলছিল। … রামপুরার জমিতে ধান চাষ, ইউনিভার্সিটির আবাসের ছাদে ধান শুকানো, কত কি সমাজসেবা, বন্ধু সংঘ, সমবায় সমিতি, সেলাই, রান্না-বাজার চলেছে একই সাথে। বিয়ের প্রস্তাব এসেছে অনেক, কন্যার কথা ভেবে তাতে কান দিইনি। তবে, ‘মন দেওয়া নেওয়া অনেক করিনি, অনেক মরিনি হাজার মরণে’ – সে কথা হলফ করে বলতে পারি না।
বইটি যে খুব সুলিখিত তা দাবি করা যাবে না – বৃদ্ধ বয়সে ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগে তিনি বইটির কাজ শেষ করেছিলেন। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০২৪ সালে প্রকাশিত বইটি আরেকটু যত্ন নিয়ে সম্পাদনা করলে ভালো হতো। কয়েকবার একই বিষয়ের পুনরুক্তি হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে নবীন পাঠকদের জন্য যে টিকাভাষ্য প্রয়োজন ছিল, তা দেওয়া হয়নি, অথচ বইটি একটি কালের মহামূল্যবান দলিল। বাংলাদেশের নারীর ব্যক্তিত্বময় আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি ধারাবাহিক বিবরণ।
১৯৪৭-পরবর্তী – বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশের ব্যাখ্যা করতে হলে এরকম বইয়ের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। তখন যেন এই বইগুলো রেফারেন্স হিসেবে গবেষকদের কাছে থাকে।
এছাড়া হালিমা খাতুনের ছড়ার বইগুলো শুধু সংকলন করলেই হবে না, এর শিক্ষা-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার বলে মনে হয়। কারণ ছড়ার বইগুলো তিনি শিশুদের একটি বিশেষ শিক্ষণ-প্রণালির প্রায়োগিক কাঠামো তৈরি করার জন্যই রচনা করেছিলেন। নইলে পাখির ছানার মতো ছড়াগুলোর প্রকৃত রস আস্বাদন থেকে আমাদের শিশুরা বঞ্চিত থাকবে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.