বুড়ো নিমাই পণ্ডিত জীবন থেকে, সংসার থেকে বড় চুপি চুপি পালিয়ে যাচ্ছেন। সারা জীবনের লজ্জা, পাপ এদের কাছ থেকে নির্বাসন না নিয়ে নিমাই পণ্ডিতের আর কোনো উপায় ছিল না। বড় সাধের সংসার, গ্রাম, পাঠশালা এদের কাছে নিমাই পণ্ডিতের প্রচুর দেনা হয়ে গেছে, যা এ-জীবনে শোধ হওয়ার নয়। কোনো জীবনেও হয়তো শোধ হওয়ার নয়। অতএব জীবনের এসব লজ্জা থেকে নিমাই পণ্ডিতকে পালিয়ে যেতে হয় সংসার-গ্রাম ছেড়ে, কাউকে না জানিয়ে বড় চুপি চুপি।
তখনো ভোরের কাক ডাকেনি। এখানে-ওখানে ইতস্তত অন্ধকার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। নিমাই পণ্ডিত সেই অন্ধকারে স্টেশনের সড়ক ধরে যথাসম্ভব দ্রুত হাঁটছিলেন। একটা কাপড়ের পোঁটলা বগলে চেপে সামনের দিকে এমন ঝুঁকে হাঁটছেন, লজ্জার ভারে যেন আরো বেশি কুঁজো হয়ে গেছেন নিমাই পণ্ডিত। এই যে অন্ধকারে চুপিচুপি পলায়ন, শহরমুখী প্রথম ট্রেন ধরার আপ্রাণ চেষ্টা, নিমাই পণ্ডিতকে আরো বিমর্ষ, লজ্জা-ক্লান্ত করে তুলছিল।
কিন্তু এই ভোরে কিংবা তারও আগে মাটির সস্তানেরা লাঙল-বলদ নিয়ে জমি চষতে বেরিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কারো নজরে এলো – একজন, তার সঙ্গে লাঙল-বলদ নেই, এই অন্ধকারে চোরের মতো পালিয়ে যাচ্ছেন। তখন সে বলদ জোড়া হেট্-হেট্ করে তাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে হাঁক ছাড়ে, কেডা যায় গো? এই সাত বিহানে কোনে চললে?
চমকে উঠে ক্ষণিক থমকে দাঁড়ান নিমাই পণ্ডিত। ধরা পড়ে গেলেন বুঝি! সারা জীবনের লজ্জা থেকে তিনি যে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন তা বুঝি আর হলো না। যেন চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছেন নিমাই পণ্ডিত, এ-ডাকে সাড়া দিতে তাই এত লজ্জা, সংকোচ।
বলদ জোড়া দ্রুত তাড়িয়ে কাছে এসে সম্ভ্রমে একটু সরে দাঁড়ায় লোকটি, আদাব, পণ্ডিত মশাই।
আরে, কাদের মিয়া না? কথা বলতে পেরে যেন নিমাই পণ্ডিত বেঁচে গেলেন।
তোর ছাওয়ালরে ইস্কুলে পাঠাস না ক্যানে? স্বস্তির নিশ^াস ফেলছেন নিমাই পণ্ডিত। তিনি যেন পলাতক কেউ নন, জীবনের মাঝে আবার ফিরে আসতে পেরেছেন। সবার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে আবার পাঠশালায় গিয়ে বসেছেন।
আমাগো আবার পড়ালেহা! – যুগের হাওয়া এমনি যে পড়ালেখা শেখা যে বোকামি এই বোধ কাদের মিয়ারও হয়েছে।
তাদের গ্রামের কত ছেলেই তো পাশ করে শহরের সাহেব বনে গেছে। বছরে একবার কি দুবার যখন গ্রামে আসে, তাদের দেখে চোখ টাটায়। তাদের বাপ-চাচারা এখনো জমিতে লাঙল বায়। ছেলের ভবিষ্যৎ এমনি উচ্চাকাক্সক্ষায় জড়িয়ে পড়লে কোথায় যেন প্রচণ্ড একটা বাধা আছে, যা কাদের মিয়ার মতো লোকেরা প্রকাশ করতে পারে না।
সব কাজকাম কি সবের লগে সাজে পণ্ডিত মশাই, আপনেই কন? ওসব আমাগো লয়। আমরা চাষাভূষা মানুষ, আমাগো ওসব মানায় না। তারচেয়ে কাজকাম শিখলি পরে খাইয়া-পইরা বাঁচি থাকিতে পারবে। ক্ষ্যাতি-খোলার কামেও আজকাল ভাত নাই। সারা বছর ধরি তো বান-খরা লাগি থাকে।
নিমাই পণ্ডিত কিছু বলছেন না, চুপ করে আছেন। জীবন থেকে সংসার থেকে যে পালিয়ে যাবে, কী মোহে সে জীবনের সমস্যায় ফিরে আসবে? কিন্তু অন্য সময় হলে নিমাই পণ্ডিত হয়তো আর্তনাদ করে উঠতেন, কী কস অ্যাঁ, কোন দুঃখে ছাওয়ালটারে পরের গোলাম বানাবি। খবরদার, ও-কাম করিস না। নিজের জমি ইচ্ছামতো চাষ করি খাবি, না শহরে পাঠাবি গোলামি করতি?
নিমাই পণ্ডিত শব্দহীন মাছের মতো ফ্যাকাসে দৃষ্টি তুলে কাদের মিয়ার সঙ্গে হাঁটছেন। কাদের মিয়া কি বুঝে ফেলেছে তার পলায়নের চাতুরী? তিনি তো জানেন, জীবনের বাঁকে বাঁকে যখন অনেক লজ্জা সঞ্চয় হয়, পূর্ব পুরুষদের পাপের ভারে যখন চলার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, কেবল তখনি পালিয়ে যেতে হয়। ঘৃণার হাত থেকে অপমানের হাত ছাড়িয়ে বাঁচার এছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। শুধু নিমাই পণ্ডিত, কাদের মিয়াই নয়, একদিন সবাইকে ঘৃণার হাত থেকে এমনি করে পালাতে হবে। অতএব, কী বলবেন তিনি?
কাদের মিয়া অবাক না হয়ে পারে না – এ যেন নিমাই পণ্ডিত নন, অন্য কেউ। অন্ধকারে ধূসর কুয়াশায় হাঁটছেন। কিছু পরে হারিয়ে যাবেন, তখন আর চেনা যাবে না।
শহরে যাচ্ছিননি, পণ্ডিত মশায়? সাহায্য আনতি বুঝি? ইবার স্কুলের চালাটা ঠিক করে নিবেন গো। বর্ষাকালে যে পানি পরে বসবার যুগ্যি থাকে না।
এতক্ষণ ধরে এ-প্রশ্নের আশঙ্কাই করছিলেন নিমাই পণ্ডিত। জানেন, প্রচণ্ড একটা মিথ্যে কথা বলতে হবে, হু-হু তা যাতিছি, দোয়া কর। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে প্রতিদিন ছাত্রদের তিনি যে শিখিয়ে এসেছেন, ‘সদা সত্য কথা কহিবে, মিথ্যে বলা মহাপাপ’ – এখন হয়তো সেই সত্যকে অস্বীকার করতে হবে। মিথ্যা কথা কওয়া পাপ নয় রে, সময় সময় মিথ্যা কথা কইতি অয়, বুঝলি – নিমাই পণ্ডিত যেন নতুন করে ছাত্রদের দু-হাত নেড়ে বোঝাচ্ছেন, এতদিন তোমরা যা শিখেছো, সব ভুল। মিথ্যে বলায় পাপ নেই, কখনো কখনো মিথ্যে বলতে হয়। যেমন আমি বলছি। তা না হলে জীবনের পরাজয় থেকে পলায়ন হয়ে ওঠে না, ঘৃণার কাদায় কেঁচোর মতো বাঁচতে হয়।
হ, তা যাতিছি। সংক্ষিপ্ত জবাব সেরে নিমাই পণ্ডিত ছুটে পালালেন। তিনি যে সত্যি তাঁর গ্রাম, সংসার, পাঠশালা ছেড়ে অনির্দিষ্টের পথে পালিয়ে যাচ্ছেন, এ-কথা কাদের মিয়াকে বলা যায় না। বরং এদের দেখলে আশঙ্কা জাগে, তাঁর পলায়ন বুঝি আর হয়ে উঠলো না, এদের মায়ায় তিনি বুঝি আবার আটকা পড়ে যাবেন।
বড় বড় পা ফেলে আগের চেয়ে দ্রুত অন্ধকারে পালিয়ে যাচ্ছেন নিমাই পণ্ডিত। কেউ যেন তাঁকে পেছন থেকে তাড়া করেছে, নয়তো সূর্য ওঠার আগে শহরগামী প্রথম ট্রেন ধরতে পারবেন না – এই আশঙ্কায়। কাদের মিয়া থমকে গিয়ে পলায়নপর মূর্তির দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল বুঝি। এরপর হেট্-হেট্ করে বলদ দুটোকে সড়ক থেকে জমিতে নামিয়ে আনে।
সবাই যখন এই জীবন নিয়ে সুখী, অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে তো আছে, অভাব-অভিযোগ কাঁধে নিয়েও মরে যায়নি। তখন নিমাই পণ্ডিত কেন চুপিচুপি পালিয়ে যায়?
বাপ ছিল পুরুত ঠাকুর।
পুজো-অর্চনা আর যজমানি করে সংসার চালাতো। এ-বাড়ি ও-বাড়ির চালটা কলাটা দিয়ে বাপ-ঠাকুর সংসার চালাতে গিয়ে যখন হালে পানি পাচ্ছেন না, তখন এ-বাড়িরই ছেলে নিমাই দুটো পাশ করে গ্রামের একমাত্র পাঠশালার পণ্ডিত বনে গেলেন। পুরুত ঠাকুরের ছেলে পণ্ডিত মশায়, এর চেয়ে বেশি আশাও করা যায় না। বাপ-ঠাকুরদার আশীর্বাদের জোরেই যেন এমনটা হওয়া সম্ভব। অতএব সুখের হাওয়া বইতে শুরু করলো। তখন দিনকাল এমন ছিল না, পণ্ডিতরা বেতন না পেলেও ছাত্রদের কাছ থেকে যে চাল-ডাল-মাছ, তরিতরকারি পেতেন, তা দিয়ে সারা বছর খেয়ে-পরে কিছু উদ্বৃত্ত থেকে যেত। তার ওপর ছিল
পুজো-পার্বণে চাল-ডাল-কাপড় আর সম্মানীর টাকা। সংসারে সুখের হাওয়া বইতে লাগল। পিতা ঠাকুরকে আর সংসার নৌকার হালে পানি মাপতে হয়নি। সারা জীবন দুঃখে, কষ্টে, অনাহারে মানুষ, অতএব সুখের হাওয়া বেশিদিন সহ্য হলো না বাপ-ঠাকুরের। কাঁধে এক অবিবাহিত যুবতী বোন ও ছোট দু-ভাইকে রেখে গেলেন। তখন দিনকাল এমন ছিল না, চিন্তাভাবনার কোনো কারণও দেখা দেয়নি। মায়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এক প্রাচীন কুলীন বামুনের সঙ্গে বোনের বিয়ে হয়ে গেল। সময়টা বোধহয় বসন্তকাল, আর নিমাই পণ্ডিতের বয়স সবে আঠারো ধরেছে। কদিন ধরে পাঠশালার ধারেকাছে একটি যুবতী কোকিল বড় বেশি ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছিল। ছাত্র পড়াতে পড়াতে হঠাৎ আনমনা হয়ে যেতেন, রাতে আশ্চর্য সব স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন নিমাই পণ্ডিত। অতএব মায়ের প্রস্তাবে আপত্তি জানাননি নিমাই পণ্ডিত, বরং বিয়েটা করে বেঁচে গেলেন।
ভগবানের আশীর্বাদে দশ বছরে ছয় সন্তানের মুখ দেখলেন নিমাই পণ্ডিত। তখনো ভাবনাটা শুরু হয়নি। বরং বলা চলে ভগবানের আশীর্বাদ খুশি মনে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তখনো সংসারে সুখের হাওয়া ছিল,
খাওয়া-পরার ভাবনাটা ছিল না। পাঠশালা আর ছাত্র পড়িয়ে সংসার মন্দ চলছিল না। মাঝে শুধু একবার দুঃখের হাওয়া ধরে গেল। মা হঠাৎ করে একদিন স্বর্গের পথ খুঁজতে বেরিয়ে গেলেন। তা আজ হোক কাল হোক একদিন যেতেনই, কী আর করা। কদিন বিষণ্ন হয়ে রইলেন নিমাই পণ্ডিত, চুপিচুপি কাঁদলেন। মায়ের শোক সন্তানের কাছে একটু নিদারুণ হয়। তারপর শোক ভুলে আবার আগের জীবনে ফিরে গেলেন নিমাই পণ্ডিত। বোন সীতা তিন ছেলেমেয়ের হাত ধরে একদিন সাদা থানে ভাইয়ের সংসারে ফিরে এলো। হাজার হোক আপন বোন, অস্বীকার করেন কি করে? এই দুঃসময়ে যাবেই বা কোথায়? স্ত্রী অনুভার তীব্র অসন্তোষ ও গজগজানির মধ্যেই সীতার ঠাঁই হলো ভাইয়ের সংসারে।
নিমাই পণ্ডিত তখনো ভাবতে শুরু করেননি। ছাত্র পড়িয়ে, মাঝে মাঝে যজমানি করে হালে পানি পেয়েই সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলেন, ধার-কর্জ না করে, গ্রামের পাঁচ-দশজনের আদাব-নমস্কার কুড়িয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন নিমাই পণ্ডিত। কিন্তু লক্ষ্মী যে বড় চঞ্চলা। নিমাই পণ্ডিতদের মতো লোক কদিন বা লক্ষ্মীকে সন্তুষ্ট রাখতে পারেন।
দিনকাল যেন রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে। পাঠশালার বাইরে কখনো দৃষ্টি ফেলেননি নিমাই পণ্ডিত। প্রয়োজন বোধ করেননি। বড় ছেলে নিতাইকে নিজের বিদ্যায় যতটুকু কুলায় শিখিয়ে-পড়িয়ে তিন ক্রোশ দূরে হাই স্কুলে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর চেয়ে বড় কিছু হওয়ার জন্য। দিনকাল পাল্টাচ্ছে, পণ্ডিতি করে যজমানি করে দিন চলা যে দায়, এটুকু জাগতিক বোধ নিমাই পণ্ডিতের হয়েছিল। কষ্ট করে হলেও ছেলেটাকে পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের জাগতিক বোধ বাপের চেয়ে একগুণ বেশি। তিন ক্রোশ পথ হেঁটে স্কুলে পড়ার ঝক্কির চেয়ে তাড়াতাড়ি পয়সা রোজগারের প্রয়োজন বোধ করে নিতাই। অনুভারও সমর্থন ছিল ছেলের পেছনে, নইলে নিতাই এতটা সাহস পেত না। অনুভাও বুঝে নিয়েছে, পণ্ডিতি করে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে চাওয়ার চেয়ে বিড়ি বানিয়ে সপ্তাহে সপ্তাহে তিন টাকা রোজগার করা ঢের ভালো।
নিমাই পণ্ডিত হিসাব করতে বসে যখন জানতে পারেন, নিতাই তিন ক্রোশ পথ হেঁটে স্কুলে যাওয়ার পথে পাকা বিড়ি কারিগর হয়ে গেছে। মুখে ফিল্মের গান গুনগুন করে, নাক দিয়ে গল গল করে বিড়ির ধোঁয়া আকাশে উড়ায়, তখন নিমাই পণ্ডিত আর স্বাভাবিক থাকতে পারেন না। শান্তশিষ্ট নিমাই পণ্ডিত রক্তাক্ত ক্রোধে পাল্টে যেতে থাকেন। কিন্তু অনুভার তর্জন-গর্জনে নিমাই পণ্ডিত চুপসে যান। আক্রোশে চিৎকার করে অনুভা জীবনের যাবতীয় ঘৃণা উগরে দেয়।
– আমার ছাওয়াল চুরি করে না, ডাকাতি করে না, কষ্ট করে টাকা রোজগার করি আনে। তাতে তোমার এতি ফ্যাচং ফ্যাচং কিসের। পড়ালেখা শিখি তোমার মতো পণ্ডিত অবে, বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করি সংসার চালাবে?
নিমাই পণ্ডিত আক্রোশে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন, চুপ করো বলচি।
ক্যানে, চুপ করবো ক্যান? ভাত দিবার মুরোদ নাই কিল মারার গোসাই! সংসার কি তোমার ভিক্ষার চাল দিয়ি চলে? ছাওয়াল রোজগার না করলি দাঁড়াতি কোতায়? এটুকু ছাওয়াল তোমার চেয়ে বেশি রোজগার করে। পণ্ডিতি ছাড়ি দি বিড়ি বানান শিখোগে।
সহ্য হয় না নিমাই পণ্ডিতের। ধমনির সমস্ত রক্ত ক্রোধে চিৎকার করে উঠতে চায়। ঠিক তখন গিন্নির আদরের ছেলে নিতাই ফিল্মের গান গেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বিজয়ীর মতো। গিন্নি নিতাইকে ডেকে আদর করে কিছু বললে সোহাগে হেসে ওঠে। সব দেখলেন, শুনলেন নিমাই পণ্ডিত। গায়ের মাংস কামড়িয়ে উষ্ণ রক্ত শীতল করতে লাগলেন। কারণ, নতুন করে হিসাব কসতে গিয়ে দেখলেন, দিনকাল সত্যি পাল্টে গেছে। সীতা ও তার তিন ছেলেমেয়ে, তারা স্বামী-স্ত্রীসহ সাত ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর আয়ে সংসার চালানো সত্যি দুঃসাধ্য। নিতাইর রোজগার না থাকলে তিনিও হালে পানি পেতেন না। অতএব দোষটা নিতাইর না, অন্য কারোর।
এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ির জোয়াল টানছে, সুখেই আছে। মাঝে মাঝে শুধু বাপের বাড়ি বেড়াতে এলে একটু গণ্ডগোলে পড়ে যান নিমাই পণ্ডিত। অসময়ে লজ্জার মাথা খেয়ে ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি ছুটতে হয়। চাল ডাল শাকসবজি উপরি যা পাওয়া যায়, তাই লাভ। দোকানে ছুটতে হয় কিছু বাকি সদাইপত্তরের আশায়। তারপর জামাই বাবাজিকে তেল মালিশ করতে ছোটো, ‘বাবাজি যদি বিকেলবেলায় এট্টু সময় হয়, আমি নিজে এসে নিয়ে যাবোনে বাবাজি।’ এরপর থাকে জামাই-সন্তুষ্টির দ্রব্যাদি। নিদেনপক্ষে জামাইর নতুন ধুতি, মেয়ের শাড়ি, নাতি-নাতনিদের জন্য জামাকাপড়। যেখান থেকে পারো জোগাড় করে আনো। না আনতে পারলে জামাই বাবাজি শ্বশুরবাড়ি পদধূলি ফেলবে না। মেয়ে নাতি-নাতনিসহ ছয় মাস শ^শুরবাড়ি ফেলে রাখবে। মেয়ের মুখে মেঘ জমবে, মেয়ের মা ঘনঘন চোখ মুছে বিলাপ করবে, একটা মাত্তর বিটি, তারও এমন পোড়া কপাল। বাপ অয়ে বিটি জামাইকে একটা ধুতি কিনি দিতে পারো না। তার পৌরুষকে বারবার ধিক্কার দিতে থাকলে নিমাই পণ্ডিত আবার হিসাব করতে বসেন। মেয়েকে ছয় মাস রাখার চেয়ে শাড়ি ধুতি দিয়ে বিদায় করাই অনেক লাভ। হিসাবে বুঝতে পারেন দোষ মেয়েজামাইরও না, অন্য কারো।
এর পরের ছেলেটা হাবাগোবা, ওর প্রতি কোনো আশাই রাখেন না নিমাই পণ্ডিত। তার পরেরটা বড়জনের থেকেও একহাত উপরে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে লাউ-কুমড়ো চুরি করে করে হাত বেশ পাকিয়ে ফেলেছে। সংসারে কিছুটা আয় হয়, অতএব মায়ের স্নেহদৃষ্টি রয়েছে ছেলেটার ওপর। নিমাই পণ্ডিতকে কমই তোয়াক্কা করে সে।
এসব লজ্জা নিয়েও তো গ্রামের আর দশজন দিব্বি সংসার করে জীবনযাপন করছেন। জীবন থেকে সংসার থেকে পালানোর আদৌ কোনো ইচ্ছে তাদের নেই। বরং এসব সন্তান নিয়ে মাঝে মাঝে পিতৃত্বের গর্ব করে সন্ধ্যার মজলিসের নায়ক হন। শুধু নিমাই পণ্ডিত কেন একাকী এ লজ্জার হাত থেকে পালাতে চান?
শুধু দিনকালই পাল্টায়নি, মানুষের মনগুলিও যেন রাতারাতি পাল্টে গেছে। আগে নিমাই পণ্ডিতকে গ্রামের লোকজন মান্য করতো। পথে দেখা হলে আদাব-নমস্কার জানাত। এখন দেখা হলে লোকগুলি পালিয়ে যায়। কখন কী চেয়ে বসবে, কে জানে।
নিমাই পণ্ডিত দুঃখ পান। কিছুই করার নেই তার, শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেন। কখনো কেউ মুখোমুখি পড়ে গেলে হাঁক ছাড়েন, আরে বিষ্ণু মণ্ডল যে, কনে চললে?
বিষ্ণু মণ্ডল কোনো কথা বলে না। নিমাই পণ্ডিতের হাত থেকে পালাতে পারলেই যেন বাঁচে। তখন নিমাই পণ্ডিতের গলা কেমন নরম অসহায় হয়ে কাঁপতে থাকে। লজ্জায় অপমানে যেন কেঁদে ফেলবে এমনি স্বরে বলে, তোর ছাওয়ালটারে ইশকুুলে পাঠাসনে ক্যানে? তোর ছাওয়ালের মাথাটা খুব ভালো। পাঠাস রে মণ্ডল, ছাওয়ালটারে ইশকুলে দিস। কোনো পয়সাকড়ি দেওন লাগবে না। যখন যা পারস দিস, আমার কোনো দাবি নাই।
সেসব আর অইবে না, পণ্ডিত মশাই। বিষ্ণু মণ্ডল দাঁত বের করে হাসে। আমার ছাওয়ালরে হেই পাকা ইশকুলে পাঠাইছি। সরকারি ইশকুল, পয়সাকড়ি লাগে না। শুধু বিষ্ণু মণ্ডলই নয়, সবার ছেলেমেয়েই পাকা স্কুলে চলে গেছে। আগে গাঁয়ে কোনো স্কুল ছিল না, এক নিমাই পণ্ডিতের পাঠশালা ছাড়া। এখন গ্রামে বিনে পয়সার স্কুল হয়েছে। পাকা দালান ঘর। কে আর বিনে পয়সার সুন্দর স্কুল ছেড়ে নিমাই পণ্ডিতের বুড়ো পাঠশালায় পড়তে আসবে। তবু নিমাই পণ্ডিত পথে পথে লোক পাকড়াও করেন, ছাত্র খোঁজেন। করুণ মিনতি জানান। লোকেরা হাসে, বিনে পয়সার দালান স্কুল ছেড়ে পচা ছনের স্কুলে পাঠাবে কে তার ছেলেকে?
এরপর একদিন গুম হয়ে ভাবতে বসেন নিমাই পণ্ডিত। হিসাবটা আবার প্রথম থেকে মেলাতে চান। গিন্নি খুব একটা খারাপ কথা বলেনি, নিতাইর মতো বিড়ি বানানো শিখবে কি না। সপ্তাহে সপ্তাহে বেশ কটা টাকা আসত। একবার চুপিচুপি খবর নিয়েছিলেন, নতুন প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হবে কি না। নতুন স্কুলে সবাই নতুন, পুরনো লোকের জায়গা নেই সেখানে।
জীবনের এসব লজ্জা ছাড়াও আরো কিছু লজ্জা নিমাই পণ্ডিত দেনা করেছেন। যার হাত থেকে নিমাই পণ্ডিতকে লুকিয়ে থাকতে হয়। পথ জেনেশুনে সাবধানে চলতে হয়। কখনো বাড়িতে এসে হাঁক দিলে নিমাই পণ্ডিত বুঝে ফেলেন এটা কার গলা। তখন ঘরে থেকেও অদৃশ্য হয়ে যেতে হয়। কিন্তু সংসারে বাস করে সংসারকে চিরকাল ফাঁকি দেওয়া যায় না। একবার না একবার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, তখন নিমাই পণ্ডিত লজ্জায়-অপমানে কেঁচোর মতো কুঁচকে যান। অন্য সময় হলে কথা ছিল, পণ্ডিত মশায়ের সম্মান বুঝে নরম গলায় কথা বলত, আজকাল ওসবকে কমই তোয়াক্কা করে লোকে।
সুশীল দোকান থেকে বেরিয়ে গলাটাকে যথাসম্ভব উঁচুতে চড়িয়ে বলতে আরম্ভ করে, আরে ও পণ্ডিত মশায়, আমাগো তো ছাওয়াল-পাওয়াল নিয়া বাঁচতি অয়। দানসত্তর তো খুলি বসিনি। পূজার পরই টাকা দেবেন কয়ে কাপড় নি গেলেন। বৎসর অতি চল্লো, টাকা দিবার নাম নেই। ভদ্দরলোক অয়ে এমন কচ্ছেন ক্যানে, অ্যাঁ। বলি, টাকা দিবার ইচ্ছা আছেনি? নাকি আপনার বাড়ি থেকে গাই-গরুটা নিয়ে আসবো?
ধরণী দ্বিধা হলে যেন নিমাই পণ্ডিত তার সমস্ত লজ্জা অপমান নিয়ে তলিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু ধরণি তো দ্বিধা হয় না। অতএব নিমাই পণ্ডিতকে চকিতে চারদিকে তাকাতে হয়। লোকজন কৌতূহল নিয়ে তাকাতে শুরু করেছে, এখনি ভিড় জমে যাবে। নিমাই পণ্ডিত তাড়াতাড়ি সুশীলের হাত চেপে ধরেন, সুশীলরে আর কয়টা দিন সময় দে বাপ। তোর টাকা, সত্যি বলছি ভগবানের শপথ করে বলছি, দিয়ে দেব।
ওসব হবে না নে, পণ্ডিত মশাই আপনাকে চিনতি আর বাকি নাই। হয় আমার টাকা শোধ করি যাবেন, নয় বাড়ি বাঁধা দিতি হবে।
অতএব নিমাই পণ্ডিতকে অনির্দিষ্টে পালিয়ে যেতে হয়। জীবনের এসব লজ্জা ছাড়াও পূর্বপুরুষদের ঘৃণা পাপ ঘাড়ে চেপে বসেছে। বড় সাধের সংসার, গ্রাম, পাঠশালা – এসব কিছুই নিমাই পণ্ডিতকে পিছু ফেরাতে পারে না। সমস্ত জীবনের লজ্জা পাপ ঘৃণা শুধু নিমাই পণ্ডিতের একারই প্রাপ্য নয়, অন্য কারো প্রাপ্য; কিন্তু সে যে কে নিমাই পণ্ডিত তা জানেন না।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.