রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার রেনেসাঁস

চতুর্দশ শতাব্দীতে ইতালিতে রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী জুড়ে রেনেসাঁসের ঢেউ আছড়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। রেনেসাঁসের বহুমাত্রিক ইতিবাচকতা থাকলেও যেটি মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে রেনেসাঁসকে চিহ্নিত করে সেটি হলো মানবমুখিনতা বা মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এর আগে ধর্মীয় সংস্কার, দৈব বা অলৌকিকের ওপর ভিত্তি করে মানুষের চিন্তাজগৎ আবর্তিত হতো। রেনেসাঁসের আলো সেই বদ্ধ দুয়ারে সজোরে ধাক্কা দেয়। শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান তথা সৃজনশীল ও মননশীলতার জগতে যুগান্তর এনে দেয় রেনেসাঁস।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে অসাধারণ বাঁক বদলকারী রেনেসাঁস সংঘটনের নেপথ্যে কয়েকজন অনন্যসাধারণ মনীষীর অবদান ক্রিয়াশীল ছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কীর্তিমান দুজন হলেন ফ্রান্সেসকো পেত্রার্কা (১৩০৪-৭৪) ও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯)। রেনেসাঁসের প্রভাবে সেক্যুলার বা ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত ঘটে। কুসংস্কারের বদলে যুক্তিবাদ, অন্ধবিশ^াসের পরিবর্তে বিজ্ঞানমনস্কতা মানুষের চিত্তলোকের মুক্তি ঘটায়। উনিশ শতকে তৎকালীন ভারতবর্ষে রাজা রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দের মতো মনীষীর আবির্ভাবে বাংলার চিন্তা ও কর্মজগতে অভূতপূর্ব আলোড়ন তৈরি হয়। সমাজবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদগণ এই আলোড়নকে অভিহিত করেছেন ‘বাংলার রেনেসাঁস’ হিসেবে। যদিও এটি রেনেসাঁস কি না এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। তবু এ-কথা অনস্বীকার্য যে, সেই সময় সমগ্র ভারতবর্ষে শতাব্দীব্যাপী বাঙালি মনীষার দ্যুতিময় উপস্থিতি দেশবাসীকে অন্ধকার থেকে আলোকরেখায় উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছিল।

বুর্খহার্ট তাঁর রেনেসাঁস সংক্রান্ত বিখ্যাত বইয়ে রেনেসাঁসকে ব্যক্তিপ্রতিভার বিস্ফোরণের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উনিশ শতকের ভারতীয় রেনেসাঁসেও ব্যক্তিপ্রতিভার বিস্ফোরণের দেখা মেলে। রামমোহন রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত শতাব্দীব্যাপী ইতিহাসে বাংলায় যে উজ্জ্বল প্রতিভার মিছিল দৃশ্যমান এর তুলনা সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর নেই। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে, শিক্ষাদীক্ষায়, নারী-উন্নয়নে, মানবসেবায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্মেষে, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতে, আধুনিক ধ্যান-ধারণায়, সর্বোপরি স্বাধীনতা আন্দোলনে এমন বহুমুখী জাগরণ আর কখনো দেখা যায়নি ভারতবর্ষে। ‘এমন অল্পকালের মধ্যে ভারতের মাত্র একটি জাতির (বাঙালির) মধ্যে যত মনস্বীর, যত কর্মীর, যত ভাবুকের, যত শিল্পী ও সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে, ভারতের ইতিহাসেও আর ঘটেনি, অশোকের কালে নয়, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে নয়, মোগল রাজত্বে-আকবরের দিনেও নয়, বৈষ্ণব আন্দোলনের বাঙলায়ও নয়।’ গোপাল হালদারের এই উক্তিতে কোনো আতিশয্য নেই।

ইতালির চেয়েও স্বল্প সময়ব্যাপী বিস্তৃত বাংলার রেনেসাঁস সৃজনশীল ও মননশীল প্রতিভার বিচ্ছুরণে শিক্ষিত ভারতবাসী আলোকিত হয়েছিল। রামমোহন রায়কে দিয়ে যে-রেনেসাঁসের সূচনা, রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এর চূড়ান্ত উৎকর্ষ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে এই রেনেসাঁসের অন্যতম স্রষ্টা ও শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। ইতালির রেনেসাঁসের ইতিহাসে পেত্রার্কা ও ভিঞ্চি যে ভূমিকা পালন করেছেন, বাংলার রেনেসাঁসেও রবীন্দ্রনাথ সেই ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণে অসামান্য গতিশীলতা সঞ্চার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন একাধারে ভারতীয় নবোৎপ্রণেনার সুষ্ঠুতম সৃষ্টি ও শ্রেষ্ঠতম স্রষ্টা।’ রেনেসাঁসের অন্যতম দান যুক্তিবাদিতা। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চিন্তা ও যুক্তিবাদী মননের অধিকারী ছিলেন। তিনি  উপলব্ধি করেছিলেন, দৈবের নিকট আত্মসমর্পণের ঐতিহ্যগত ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের বিকাশের পরিপন্থী।

ইতালির রেনেসাঁসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের দৃষ্টিকে অপার্থিব বা দৈব প্রভাব থেকে মুক্ত করে জাগতিক ও মানবিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করা। মধ্যযুগে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল পরলোক, ধর্মসাধনা ও অন্ধবিশ^াসের প্রতি; জাগতিক ও মানবিক চিন্তাধারা তখন উপেক্ষিত হয়েছে, প্রাধান্য পেয়েছে বিষয়বৈরাগ্য ও সন্ন্যাস। রেনেসাঁস এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দেয়। জাগতিক ও মানবমুখিনতার প্রতি নবজাগ্রত এই আগ্রহ ইতিহাসে ‘Humanism’ নামে অভিহিত হয়েছে। ইতালীয় রেনেসাঁসের স্মরণীয় প্রবর্তক পেত্রার্কাকে বলা হয়েছে ‘First of the humanists’। Humanism বা মানবমুখিনতার প্রতি প্রবল আগ্রহ রবীন্দ্রনাথ বরাবরই পোষণ করে এসেছেন। নবজাগরণের গভীর উপলব্ধি ও অঙ্গীকারকে চেতনায় ধারণ করে তিনি মানুষকে সবকিছুর কেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সৌন্দর্যচেতনা, মর্ত্যপ্রেম ও ধর্মবিশ^াস মানবমুখী। ‘প্রভাত-উৎসব’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন – ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি/ জগৎ আসি হেথা করিছে কোলাকুলি/ ধরায় আছে যত, মানুষ শত শত/ আসিছে প্রাণে মোর, হাসিছে গলাগলি।’

কড়ি ও কোমলের যুগে কবির উপলব্ধি – ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ জীবন ও জগতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই অনুরাগ পরবর্তীকালে গভীরতর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’-এর কবি, তিনি ‘বসুন্ধরা’র কবি। ‘মায়াবাদ’ ও ‘বৈরাগ্যসাধন’ কখনো তাঁর চিন্তালোকে ঠাঁই পায়নি – ‘বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়/… ইন্দ্রিয়ের দ্বার/ রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার।/ যে কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে/ তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’

মানবমুখিনতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অসামান্য অঙ্গীকারের পরিচয় রয়েছে সোনার তরী কাব্যের ভূমিকায় – ‘মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা – বিশ^প্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্যসচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা।’

রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি সশ্রদ্ধ অবলোকন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছিল ইতালীয় রেনেসাঁসে। তখন ইতালি প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সংস্কৃতির নিবিড় চর্চায় নিয়োজিত ছিল। রামমোহন বেদান্ত ও উপনিষদ অনুবাদের মধ্য দিয়ে যার সূচনা করেছিলেন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল ও বঙ্কিম তাঁদের অনুবাদমূলক এবং সৃজনশীল গদ্য-পদ্য চর্চার মধ্য দিয়ে যে বিস্মৃতপ্রায় প্রাচীন মনন ও সৌন্দয চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ একে পরিপূর্ণতা দান করেছেন তাঁর জীবনব্যাপী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সাধনার মাধ্যমে। পেত্রার্কা বলেছিলেন, ‘আমি যদি লিভির যুগে জন্ম নিতাম কী ভালোই না হতো।’ প্রায় একই সুরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমি যদি জন্ম নিতেম/ কালিদাসের কালে,/ দৈবে হতেম দশম রত্ন/ নবরত্নের মালে।’ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি বরাবরই অনুরাগ ছিল রবীন্দ্রনাথের। কাব্যে, নাটকে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে প্রাচীন ভারতকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন তা অতুলনীয়। ‘হে অতীত তুমি হৃদয়ে আমার/ কথা কও, কথা কও -’ এটি শুধু কথার কথা নয়, রবীন্দ্রনাথের একান্ত উপলব্ধি।

ভারতবর্ষের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কারণে রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধার সঙ্গে অবলোকন করেছেন গৌতম বুদ্ধের অবদানকে। কালিদাস ও অশোকের মহিমাকীর্তন করেছেন। বেদ ও উপনিষদ তাঁর অন্তর্জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে, মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত তাঁর সৃজনশীলতার গুণে নবরূপ লাভ করেছে। ‘রামায়ণে’র প্রসঙ্গ ও উপাদান, উপকাহিনি ও ভাবগত আবেগ রবীন্দ্রনাথের গদ্যে-পদ্যে রূপায়িত হয়েছে। ‘প্রাচীন সাহিত্য’, ‘সাহিত্যিক’, ‘পরিচয়’, ‘শিক্ষা’, ‘ইতিহাস’, ‘পঞ্চভূত’ প্রভৃতি প্রবন্ধ-গ্রন্থে; ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’ প্রভৃতি গীতিনাট্যে; ‘ভাষা ও ছন্দ’, ‘পতিতা’, ‘অহল্যার প্রতি’, ‘পুরস্কার’, প্রভৃতি কবিতায়; রক্তকরবী নাটকের ভূমিকাংশে এসেছে রামায়ণের প্রসঙ্গ ও উপাদান। ‘মহাভারত’ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ একাধিক কাব্যনাট্য রচনা করেছিলেন – চিত্রাঙ্গদা, বিদায় অভিশাপ, গান্ধারীর আবেদন, নরকবাস, কর্ণ-কুন্তী সংবাদ। রেনেসাঁসের অন্যতম শর্ত ঐতিহ্যের নবায়ন সার্থকভাবে ঘটেছে তাঁর সাহিত্যে। বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিমের কীর্তি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁদের সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে রেনেসাঁসের সর্বোচ্চ পরিণতিতে উপনীত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

চারিত্রপূজা গ্রন্থে রেনেসাঁস পুরুষ হিসেবে রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ভূমিকার মূল্যায়ন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেই মূল্যায়ন এতো প্রাসঙ্গিক যে, পরবর্তীকালের লেখক-গবেষকগণ বারবার রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেছেন। রামমোহন রায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘রামমোহন রায়  যখন ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন তখন এখানে চতুর্দিকে কালরাত্রির অন্ধকার বিরাজ করিতেছিল। আকাশে মৃত্যু বিচরণ করিতেছিল। মিথ্যা ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাঁহাকে সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল।

‘অজ্ঞানের মধ্যে মানুষ যেমন নিরুপায় যেমন অসহায়, এমন আর কোথায়। রামমোহন রায় যখন জাগ্রত হইয়া বঙ্গসমাজের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন তখন বঙ্গসমাজ সেই প্রেতভূমি ছিল। সেই নিশীথে “মাভৈঃ” শব্দ উচ্চারণ করিয়া যিনি একাকী অগ্রসর হইয়াছিলেন, তাহার মাহাত্ম্য আমরা আজিকার এই দিনের আলোকে হয়তো ঠিক অনুভব করিতে পারিব না।

‘কী সংকটের সময়েই তিনি জন্মিয়াছিলেন। তাহার একদিকে হিন্দু সমাজের তটভূমি জীর্ণ হইয়া পড়িতেছিল, আর একদিকে বিদেশীয় সভ্যতা সাগরের প্রচণ্ড বন্যা বিদ্যুৎবেগে অগ্রসর হইতেছিল, রামমোহন তাঁহার অটল মহত্ত্বে মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন।’

বিদ্যাসাগরকে ‘যথার্থ মানুষ’ হিসেবে উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বিদ্যাসাগর এই অকৃতকীর্তি অকিঞ্চিৎকর বঙ্গসমাজের মধ্যে নিজের চরিত্রকে মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে প্রস্ফূট করিয়া যে এক অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা বাংলার ইতিহাসে অতি বিরল। এত বিরল যে, এক শতাব্দী কাল মধ্যে কেবল আর দুই-একজনের নাম মনে পড়ে। 

‘যিনি লোকাচার রক্ষক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনি লোকাচারের একটি সুদৃঢ় বন্ধন হইতে সমাজকে মুক্ত করিবার জন্য সুকঠোর সংগ্রাম করিলেন এবং সংস্কৃত বিদ্যায় যাহার অধিকারের ইয়ত্তা ছিল না, তিনিই ইংরেজি বিদ্যাকে প্রকৃত প্রস্তাবে স্বদেশের ক্ষেত্রে বদ্ধমূল করিয়া রোপণ করিয়া গেলেন।’

রামমোহন ও বিদ্যাসাগরকে একই বন্ধনীতে রেখে বলেছেন, ‘একদিকে যেমন তাঁহারা ভারতবর্ষীয়, তেমনি অপরদিকে ইউরোপীয় প্রকৃতির সহিত তাঁহাদের চরিত্রের বিস্তর নিকট সাদৃশ্য দেখিতে পাই। বেশভূষায়, আচারে ব্যবহারে তাঁহারা সম্পূর্ণ বাঙালি ছিলেন। স্বজাতীয় শাস্ত্রজ্ঞানে তাঁহাদের সমতুল্য কেহ ছিল না। স্বজাতিকে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের মূল পত্তন তাঁহারাই করিয়া গিয়াছেন – নির্ভীক বলিষ্ঠতা, সত্যচারিতা, লোকহিতৈষা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা এবং আত্মনির্ভরতায় তাঁহারা বিশেষরূপে ইউরোপীয় মহাজনদের সহিত তুলনীয় ছিলেন।’

বাংলার রেনেসাঁসে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক চেতনার আলোকে জীবনকে পরিশ্রুত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন রামমোহন ও  দেবেন্দ্রনাথ। এর পাশাপাশি সেক্যুলার মানবতাবাদের পতাকা বহন করেছিলেন ডিরোজিও, ইয়ং বেঙ্গল, অক্ষয়কুমার দত্ত ও  বিদ্যাসাগর। এই দুই ধারার দূরত্ব মোচন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল বিশ^াসনিষ্ঠ আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে। কিন্তু সেক্যুলার মানবতাবাদের অনুসারীদের তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে বরণ করেছিলেন। এই সমন্বয় অভূতপূর্ব। ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’র কবি ‘ধর্মমোহ’ নামক অবিস্মরণীয় কবিতায় লিখেছেন – ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ সে জন শুধু মারে আর মরে।/ নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,/ ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর/ শ্রদ্ধা করিয়া জ¦ালে বুদ্ধির আলো/ শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।’

বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দের মতো রেনেসাঁস পুরুষদের রচনার কোনো কোনো অংশে স্বদেশ ও স্বধর্ম একাকার হয়ে গিয়েছিল। শশধর তর্কচূড়ামণির ভূমিকায় এরই পথ ধরে হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের উত্থান ঘটে উনিশ শতকের শেষ ভাগে। হিন্দুত্বের অভিমানযুক্ত এই স্বাদেশিকতার আবেগ রবীন্দ্রনাথকে গ্রাস করতে না পারলেও ক্ষণিকের জন্য স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথ বলেই সেই বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি কালান্তর বইয়ে বলেন, ‘ধর্মের মিলেই যে দেশে মানুষকে মিলায়, সে দেশ হতভাগ্য।’ গোরা উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের মোহমুক্তির ফসল। হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্বকে সমার্থক করে রিভাইভ্যালিজমের কল্যাণে যে জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটেছিল, গোরা রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি সেই মোহ থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করলেন। উপন্যাসের উপসংহারে গোরা বলছে – ‘আপনি আমাকে সেই দেবতার মন্ত্র দিন। যিনি হিন্দু মুসলমান খৃস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই – যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না। যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’ এই উপন্যাসে যে সর্বজনীন বিশ^মানবতার দর্শন রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন, ভারততীর্থ যেন এরই কাব্যরূপ।

বিশ^াসনিষ্ঠ আধ্যাত্মিকতার আবরণ ভেদ করে ইহজাগতিক মানবমুখিনতা আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই ঈশ^রের স্থানে অনায়াসে মানুষকে বসিয়ে তিনি বলতে পারেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ^াস হারানো পাপ।’ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘ধর্মমোহের চেয়ে নাস্তিকতা ভালো।’ চতুরঙ্গের জ্যাঠামশাই চরিত্রে নিজের জীবনদর্শনই যেন তুলে ধরেছেন তিনি। বিশে^র নানা ঐশ^র্যময় স্থানে ঘুরে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। রাশিয়ায় তথাকথিত নাস্তিকের দেশে পৌঁছে লিখেছেন, ‘রাশিয়ায় অবশেষে আসা গেল। যা দেখেছি আশ্চর্য ঠেকছে। অন্য কোনো দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই এরা সমান করে জাগিয়ে তুলেছে।’ রেনেসাঁসের চেতনাকে ধারণ করেছিলেন বলেই তিনি মানবতাবাদকে সবার ওপরে ঠাঁই দিয়েছিলেন। উচ্চকণ্ঠে রাশিয়া সম্পর্কে বলেছেন, ‘অথচ সাম্প্রদায়িক ধর্মের মানুষরা এদের অধার্মিক বলে নিন্দা করে। ধর্ম কি কেবল পুঁথির মন্ত্রে, দেবতা কি কেবল মন্দিরের প্রাঙ্গণে। মানুষকে যারা কেবলই ফাঁকি দেয় দেবতা কি তাদের কোনোখানে আছে?’

উনিশ শতকের শেষভাগে হিন্দু রিভ্যাইভ্যালিজমের পাশাপাশি মুসলিম রিভ্যাইভ্যালিজমও দানা বাঁধতে শুরু করে। রিভ্যাইভ্যালিজমের ধারাবাহিক উত্থানের মধ্যে বিজাতীয় প্রণয়ের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক আখ্যান রচনার প্রতিযোগিতা হিন্দু ও মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে শুরু হয়। ভূদেব মুখোপাধ্যায় (অঙ্গুরীয় বিনিময়), বঙ্কিমচন্দ্র (দুর্গেশনন্দিনী, রাজসিংহ) এঁকেছেন হিন্দু-নায়ক ও মুসলিম-নায়িকার প্রণয় কাহিনি; আর মুসলিম-লেখকরা লিখতেন মুসলমান নায়ক ও হিন্দু নায়িকার প্রণয়ের গল্প (স্মরণীয় কায়কোবাদের অশ্রুমালা, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর রায়নন্দিনী প্রভৃতি)। রবীন্দ্রনাথ এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বাইরে দাঁড়িয়ে ‘সতী’তে হিন্দু-নায়িকা (অমা) ও মুসলমান (ফৌজদার) এবং ‘দুরাশা’তে নায়িকা মুসলমান-নবাব নন্দিনী ও নায়ক ব্রাহ্মণ কেশরলালের হৃদয়ধর্মনিষ্ঠ প্রণয়াখ্যান রচনা করলেন – ‘যবন ব্রাহ্মণ/ সে কাহার ভেদ, ধর্মের সে নয়/ অন্তরে অন্তর্যামী সেথা জেগে রয়/ সেথায় সমান দোঁহে।’

হিন্দু রিভ্যাইভ্যালিস্ট ও মুসলিম রিভ্যাইভ্যালিস্টরা যখন স্বজাতিকে পরস্পর-নিরপেক্ষ স্বাতন্ত্র্যের দিকে টান দিচ্ছেন তখন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ভারতীয় সংস্কৃতি হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতি – ‘আমাদের ভারতবর্ষের সংগীত মুসলমানেরও বটে হিন্দুরও বটে, তাহাতে উভয় জাতীয় গুণীরই হাত আছে; যেমন মুসলমান রাজ্যপ্রণালীতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই স্বাধীন ঐক্য ছিল। চিত্র, স্থাপত্য, বস্ত্রবয়ন, সূচিশিল্প, ধাতুদ্রব্য নির্মাণ, দন্তকার্য, নৃত্য, গীত এবং রাজকার্য, মুসলমানের আমলে ইহার কোনোটাই একমাত্র মুসলমান বা হিন্দুর দ্বারা হয় নাই; উভয়ে পাশাপাশি বসিয়া হইয়াছে।’ – বাংলার রেনেসাঁসের ইতিহাস হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের রিভ্যাইভ্যালিস্ট দ্বারা কণ্টকিত হয়েছিল। সেই কাঁটা অপসারণ করে রেনেসাঁসকে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছে দেন রবীন্দ্রনাথ। এভাবেই বাংলার রেনেসাসেঁর ফলবতী ধারাকে দুর্ঘটনার কবল থেকে রক্ষা করেন তিনি।

রেনেসাঁসের প্রকৃতিগত কারণেই নগর ও গ্রামের মধ্যে বিভেদের বীজ রোপিত হয়। এটি যেমন ইতালীয় রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য বাংলার রেনেসাঁসের ক্ষেত্রেও। ইতালীয় রেনেসাঁসের অবিসংবাদিত পুরুষ পেত্রার্কা, ভিঞ্চি বা অন্য কোনো শিল্পী বঞ্চিত-দরিদ্রদের সমর্থনে বিবেকবোধ জাগ্রত রেখেছিলেন কি না তা অনিশ্চিত। বাংলার রেনেসাঁসের শ্রেষ্ঠ শিল্পী রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় বলেছেন – ‘…এই সব মূঢ় মøান মূক মুখে/ দিতে হবে ভাষা; এই সব শান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে/ ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা…’।

ছোটগল্পে, নাটকে, প্রবন্ধেও শোষিত-অবহেলিত প্রান্তজনের অধিকারের বলিষ্ঠ প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ। কালের যাত্রা, রথের রশি, মুক্তধারা ও রক্তকরবী নাটকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীকে আঘাত করে নিপীড়িত জনতার পক্ষ নিয়েছেন। রথযাত্রা নাটকে শুদ্র তথা কৃষক-শ্রমিকদের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর অবিস্মরণীয় – ‘আমরাই তো জোগায়েছি অন্ন, তাই খেয়ে তোমরা বেঁচে আছ। আমরা বুনছি বস্ত্র, তাতেই তোমাদের লজ্জারক্ষা।’ শুধু লেখনীতে নয়, কর্মোদ্যোগের মধ্য দিয়েও দরিদ্র কৃষকদের দুঃখ মোচনের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহ, পতিসরসহ নানা স্থানে তাঁর প্রজাহিতৈষী কর্মযজ্ঞে দরিদ্র মানুষ উপকৃত হয়েছে। উনিশ শতকের নবজাগরণের গৌরবের পাশাপাশি অপূর্ণতা এটি ছিল যে, সমাজের বৃহত্তর জনসাধারণ নবজাগরণের আলোকস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এই সীমাবদ্ধতা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা, কৃষিসহ জনসম্পৃক্ত নানা বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রতিনিয়ত ভেবেছেন, প্রতিষ্ঠান গড়েছেন এবং কর্মীর মতো তা প্রয়োগ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও জনকল্যাণমুখী।

রেনেসাঁসের অমূল্য বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানমনস্কতা, যা যুক্তির কষ্টিপাথরে সবকিছু যাচাই করতে শেখায়। রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনা একবিংশ শতাব্দীতেও কত প্রাসঙ্গিক তা একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হবে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক বিজ্ঞানশিক্ষক কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নিগৃহীত হন এবং হাজতবাস করেন। তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের স্পষ্টভাবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষা’ সংকলনে লিখেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের সঙ্গে যেখানে শাস্ত্রবাক্যের বিরোধ সেখানে শাস্ত্র আজ পরাভূত, বিজ্ঞান আজ আপন স্বতন্ত্র বেদীতে একেশ^ররূপে প্রতিষ্ঠিত। ভূগোল, ইতিহাস  প্রভৃতি মানুষের অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয় বৈজ্ঞানিক যুক্তি পদ্ধতির অনুগত হয়ে ধর্মশাস্ত্রের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়েছে। বিশে^র সমস্ত জ্ঞাতব্য ও মন্তব্য বিষয় সম্বন্ধে মানুষের জিজ্ঞাসার প্রবণতা আজ বৈজ্ঞানিক। আপ্তবাক্যের মোহ তার কেটে গেছে।’

বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করার জন্য বিজ্ঞানচর্চাকে অনস্বীকার্য মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিশ^পরিচয় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার এক অতুলনীয় দলিল। রবীন্দ্রনাথের শিল্পীসত্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রখর বিজ্ঞানমনস্কতা। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ‘বাকপতি রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের চিত্তে একাধারে অপার্থিব রসানুভূতি ও বস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানের অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়; সেই জন্যই তাহার রচনা ও আলোচনা উভয়ই কল্পনা ও বিজ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল। প্রয়োগনিপুণ শিল্পী বলিয়াই রবীন্দ্রনাথ কেবল অনুভূতি ও আবেগ আশ্রয় করিয়া থাকিতে পারেন নাই, তাহাকে বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দিতে হইয়াছে, তাহাকে বৈজ্ঞানিক হইতে হইয়াছে। বৈজ্ঞানিক বিশ^ন্ধর এবং সঙ্গে সঙ্গে রসানুভূতিজাত কল্পনা ও প্রকাশ শক্তির একত্র সমাবেশ, পৃথিবীতে খুব কমই দেখা গিয়েছে। আধুনিক ইউরোপের সাহিত্য-ক্ষেত্রে এইরূপ মনের প্রকৃষ্ট পরিচয় আমরা পাই জরমান কবি গ্যোতে-তে; আমাদের দেশে রস-রচয়িতাদের মধ্যে এরূপ সর্বন্ধর বৈজ্ঞানিক মন বোধ হয় এক রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই দেখা দিয়েছে।’

রেনেসাঁসের প্রভাবে পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের সংযোগ স্থাপিত হয়। এই সংযোগের সবচেয়ে বড় উদ্যোক্তা রবীন্দ্রনাথ। তাঁর দেশপ্রেমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি স্বদেশ ও বিশ্বকে অভিন্নসূত্রে হৃদয়ে ধারণ করেছেন। জগদীশচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন – ‘সমস্ত পৃথিবীকে আমি আমার দেশ বলে বরণ করে নিয়েছি। … পৃথিবী থেকে যাবার আগে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে আমার আপন সম্বন্ধ অনুভব ও স্বীকার করে যেতে পারলুম এইটেতেই আমি আমার জীবন সার্থক বলে জেনেছি। আমাদের বাংলাদেশের কোণে একটা বিশ^পৃথিবীর হাওয়া উঠেছে এইটে আমাদের সকলের অনুভব করা উচিত। এইখানে রামমোহন রায় সর্বজনীন ধর্মের আলোকে জাগ্রত হয়ে উঠেছিলেন – সেই প্রভাতের আলোকেই বাংলাদেশের নবজাগরণের ঊষালোক। সেই আলোকে যে বিশে^র সুর বেজেছে সেই সুরই আমাদের সুর – সেই সুরই মানব ইতিহাসের আসন্ন ভাবীযুগের সুর। …’

আসন্ন ভাবীযুগের আহ্বান অসামান্য মনীষার কারণে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি যথার্থই বুঝেছিলেন – ‘এ-কথা ভুলিলে চলিবে না, পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনের সিংহদ্বার উদ্ঘাটনের ভার বাঙালির উপরেই পড়েছে।’ উনিশ শতকের বাঙালি মনীষীগণ সেই দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। তবে তাঁদের সকলের ভূমিকাকে ছাপিয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের সাধনা। বাংলার রেনেসাঁসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ তিনি।