শতবর্ষে বোস সংখ্যায়ন

কানন পুরকায়স্থ

বিজ্ঞানের ইতিহাসে যে-সমস্ত তত্ত্ব মৌলিকতা, গুরুত্ব এবং গভীরতায় বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে বোস সংখ্যায়ন সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৪ সালে এই সংখ্যায়ন ফোটন কণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ১৯২৪-২৫ সালের দিকে বোস সংখ্যায়নকে সাধারণভাবে পরমাণুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন, যাকে আমরা বলি বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন। এ-সম্পর্কে আলোচনার আগে এর ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে প্রথমে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া উচিত বলে মনে করি।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ডাক পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর যোগদান প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে সে-সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক  দেবেন্দ্র মোহন বসু লিখেছেন, ১৯২০ সালের পর থেকে বিজ্ঞান কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগে বিশেষ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। অল্প জায়গার মধ্যে অনেক কৃতী বিজ্ঞানী অথচ ল্যাবরেটরির তেমন সুযোগ নেই এবং যন্ত্রপাতির অভাব। কাজেই উত্তাপ সঞ্চারিত হওয়া অনিবার্য ছিল। কয়েকজন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ায় অবস্থা একটু স্বাভাবিক হলো। সে-সময় প্রথম যে-বিজ্ঞানী চলে গেলেন তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু। সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করলেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদানের পূর্বে দেবেন্দ্রমোহন বসুর কাছ থেকে সত্যেন্দ্রনাথ ম্যাক্স প্ল্যাংকের Treatise on Thermodznamics  বইটি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। এই বই বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণার ধারা পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

এখানে একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি জার্মান বিজ্ঞানী অগাস্ট কার্ল ক্রয়োনিগ ও ক্লাউসিয়াস, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল এবং অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী বোল্টজম্যান অণুর আকৃতি, প্রকৃতি এবং গতি সম্পর্কে কয়েকটি প্রকল্প উপস্থাপন করেন। এ সমস্ত প্রকল্প থেকে অণুতত্ত্ব সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানীরা নানা ধারণা পেতে থাকেন। এই অণুতত্ত্বের ফলে গড়ে ওঠে একদিকে সাংখ্যায়নিক বলবিদ্যা (Statistical mechanics) এবং অন্যদিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা (Quantum mechanics)। ধীরে ধীরে জানা যায়, অণুরা পরমাণু দিয়ে গঠিত। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই পরমাণুরা অংশ নেয় এবং এ পর্যন্ত ১১৮ রকমের পরমাণুর সন্ধান পাওয়া গেছে, যাকে আমরা মৌল হিসেবে চিহ্নিত করি।

গত শতকের গোড়াতে জানা গেল, পরমাণু পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক নয়। তাকেও ভাঙা যায়। এই পরমাণু ইলেকট্রন, প্রোটন,  নিউট্রন ছাড়াও আরো ছোট ছোট কণা দিয়ে গঠিত। কিন্তু গত শতাব্দীতে পদার্থকে অণুর সমষ্টি হিসেবে চিন্তা করে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল তা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের আলোকে সংখ্যায়নিক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিল। এক্ষেত্রে বোল্টজম্যান ও গিবসের গবেষণা উল্লেখযোগ্য। এই গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সে-সময় অনেক বিজ্ঞানী পদার্থ ও আলোর বিকিরণ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যাদি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় যা বোস সংখ্যায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত তা হচ্ছে, কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের বর্ণালির মধ্যে শক্তি-বণ্টন।

বিকিরণের তাপগতিবিদ্যা অনুসারে কৃষ্ণবস্তু একটি কল্পিত বস্তু, যা বলতে বোঝায় একটি ফাঁপা বস্তু, যার ভেতরের দেয়ালগুলি আদর্শ আয়নার মতো সব বিকিরণ-রশ্মির প্রতিফলন ঘটায়, আর এই ভেতরের ফাঁকা জায়গা বিকিরণে পূর্ণ, আর খুব সামান্য কয়েকটি বস্তুকণা যারা এই ভেতরের বিকিরণের সাম্যাবস্থায় আসতে সাহায্য করে। এই বস্তুটির গায়ে এমন একটি সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে, যার ভেতর দিয়ে যে সামান্য পরিমাণ বিকিরণ বাইরে আসে তার প্রভাব ভেতরের সাম্যাবস্থার ওপর নগণ্য। এই ছিদ্র দিয়ে যে বিকিরণ বেরিয়ে আসে তাকে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ বলা হয়।

বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া বিকিরণের বর্ণালি বিভিন্ন হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের বর্ণালিতে শক্তি বণ্টনের সূত্র ও তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা নানা ভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সমস্ত বর্ণালিতে শক্তি বণ্টনের কোনো পূর্ণাঙ্গ সূত্র বের করা সম্ভব হয়নি। রেলে-জিনস (Rayleigh-Jeans) সূত্র দিয়ে বর্ণালির একাংশের ব্যাখ্যা এবং জার্মান বিজ্ঞানী ভিলহেলম ভিন (Wien)-এর সূত্র দিয়ে বর্ণালির অপর অংশের শক্তিবণ্টনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস জিনস্, যিনি গ্যাসের গতিতত্ত্ব এবং জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যায় বিশেষ অবদান রেখেছেন, তিনি এক বিশদ আলোচনার মাধ্যমে দেখান যে, চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে কোনো সংখ্যায়নিক বা অনুরূপ হিসাবের মাধ্যমে সমস্ত বর্ণালির শক্তি বণ্টনের সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়।

১৯০০ সালে জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটিতে ম্যাক্স প্লাঙ্ক আলোর শক্তি এবং স্পন্দন সম্পর্কে একটি নতুন স্বতঃসিদ্ধ উপস্থাপন করেন, তা হলো –

E = Hu

এই স্বতঃসিদ্ধ অনুযায়ী আলোকশক্তি (E) কম্পনসংখ্যা (v) এবং প্ল্যাংক ধ্রুবকের (h) গুণিতক।

এই সমীকরণের তাৎপর্য হচ্ছে – কোনো উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন একক হিসেবে শক্তি নিঃসরিত হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো আলোর বাল্ব থেকে নিঃসরিত আলোকশক্তি হতে পারে ১০০ জুল, ২০০ জুল, ৩০০ জুল ইত্যাদি। এটি কখনো ১০০ জুল, ১৫০ জুল বা ১৮০ জুল, এরকম হবে না। এভাবে চিন্তা করলে উপরের সমীকরণটিকে লেখা যায় –

E = nhu   

যেখানে হ-এর মান হবে ০, ১, ২, ৩ ইত্যাদি।

ম্যাক্স প্লাঙ্কের গণনা অনুযায়ী প্ল্যাংক ধ্রুবক য-এর মান

৬ .৬৩ × ১০-৩৪

এই সমীকরণের মাধ্যমে প্লাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রথম উপস্থাপন করেন। এই সমীকরণ থেকে আমরা দুটি ধারণা পাই। প্রথমত, কোয়ান্টাম ধর্ম অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্কেল-এর ক্ষেত্রে বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, কোয়ান্টাম ধর্ম পরিসংখ্যান সংক্রান্ত। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে যেমন মানুষের ইচ্ছার বাইরে নির্ণায়ক রয়েছে, তেমনি কোয়ান্টাম তত্ত্বেও রয়েছে সম্ভাব্যতার সূত্র বা সংখ্যায়ন। বোল্টজম্যান,  রেলে-জিনস এবং ভিনের ধারণাকে তাঁর প্রস্তাবিত কোয়ান্টাম তত্ত্বে প্রয়োগ করে প্লাঙ্ক বর্ণালির শক্তিবণ্টনের যে-সূত্র উপস্থাপন করেন তা হলো –

এখানে h প্লাঙ্ক ধ্রুবক, k বোল্টজম্যান ধ্রুবক, c আলোর গতি,v আলোর কম্পনসংখ্যা, T তাপমাত্রা।

এই সূত্র থেকেই শুরু হলো সত্যেন্দ্রনাথ বসুর গবেষণা। সত্যেন্দ্রনাথ কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণকে তাপগতীয় সাম্যাবস্থায় বিভিন্ন শক্তির ফোটন কণার সমষ্টি হিসেবে ভাবলেন। কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশে কোনো সমষ্টির প্রকৃতি জানা যায় সংখ্যায়নের হিসাবপদ্ধতি ও যুক্তিকে কাজে লাগিয়ে। গ্যাসীয় অণুদের জন্য যেখানে কণার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে সংখ্যায়ন রচনা হতো, সেখানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু সংখ্যায়ন রচনা করেন কোয়ান্টাম স্তরের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। প্লাঙ্ক সমীকরণের সংগত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু দুটি ধারণার ওপর নির্ভর করলেন :

(১) ফোটন কণাগুলি অভিন্ন।

(২) যে-কোনো একটি কোয়ান্টাম স্তরের শক্তির অবস্থায় যেকোনো সংখ্যক ফোটন কণা থাকতে পারে।

এ দুটি ধারণার ভিত্তিতে বিভিন্ন কম্পাঙ্কের বিকিরণে কী পরিমাণ শক্তি আছে তার একটি সূত্র পাওয়া গেল, যা প্লাঙ্কের সূত্রের সঙ্গে মিলে গেল। আর বোস সংখ্যায়নের বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, শুধু কোয়ান্টামবাদের ভিত্তিতে সত্যেন্দ্রনাথ প্লাঙ্কের সূত্র নির্ধারণ করলেন। তাছাড়া কণার সংখ্যার ওপর ভিত্তি না করে কোয়ান্টাম স্তরের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে তিনি সংখ্যায়ন রচনা করেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আগে যেসব আলোচনা হয়েছে তাতে কণা সংখ্যায়ন (particle statistics) প্রাধান্য পেয়েছে; কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের পদ্ধতিতে হিসাব করা হয়েছে অবস্থার সংখ্যায়ন (state statistics)। এখানে বিশদ গাণিতিক ধাপগুলির উল্লেখ না করে শুধু এইটুকু বলা যায় যে,  v এবং v + dv-এর মধ্যে যাদের কম্পন আছে সেসব ফোটন-এর সংখ্যা আমরা বোস সংখ্যায়নের মাধ্যমে গণনা করে পাই নিম্নরূপ :

এখন প্রত্যেক ফোটন-এর শক্তি প্লাঙ্কের সূত্র অনুযায়ী  যা। সুতরাং উপরের সমীকরণকে যা দিয়ে গুণ করলেই প্লাঙ্কের সূত্র পাওয়া যাবে।

আমরা জানি, আইনস্টাইন বোস সংখ্যায়নকে সাধারণীকরণের মাধ্যমে সকল পরমাণুর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন, যা পরবর্তীকালে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন হিসেবে বিজ্ঞানীমহলে স্বীকৃতি লাভ করে। এই সংখ্যায়ন অনুযায়ী র শক্তি স্তরে প্রত্যাশিত কণার সংখ্যা উপরের চার নম্বর সমীকরণের পরিবর্তে নিম্নরূপে লেখা যায় :

এই সমীকরণ র শক্তি  স্তরে কণার সংখ্যা নির্দেশ করছে। এখানে ম হচ্ছে র শক্তি স্তরে অধঃপতিত (degeneracy) হওয়া সংখ্যা, u হচ্ছে রাসায়নিক বিভব যা ফোটনের ক্ষেত্রে শূন্য এবং T হচ্ছে পরম তাপমাত্রা।

এখানে উল্লেখ্য, ঘূর্ণনের দিক থেকে কণাদেরকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যাদের ঘূর্ণনসংখ্যা পূর্ণ সংখ্যা যেমন ০, ১, ২, ৩ ইত্যাদি তাদের বলা হয় বোসন কণা এবং যাদের ঘূর্ণন-সংখ্যা পূর্ণ সংখ্যা নয় যেমন ১/২, ১/৩  ইত্যাদি তাদেরকে বলা হয় ফার্মিয়ন কণা। বোসন কণা বোস সংখ্যায়নকে অনুসরণ করে, কিন্তু ফার্মিয়ন কণা ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়নকে অনুসরণ করে। তাছাড়া বোস সংখ্যায়নের ক্ষেত্রে ফোটন কণা ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে ফোটন কণা অভিন্ন। ভিন্ন দুটি ফোটনের কোয়ান্টাম সংখ্যা এক হলে তাদের মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তাই বোস সংখ্যায়নের ফলাফল অত্যন্ত নির্ভুল ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ ‘Planck’s law and the hypothesis of light quanta’ প্রথম প্রেরণ করেন Philosophical Magazine-এ, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়নি। তারপর ১৯২৪ সালের ৪ঠা জুন একটি পত্রের মাধ্যমে তাঁর গবেষণাপত্র আইনস্টাইনের কাছে পাঠান। সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত। তার পত্রের অনুলিপি চিত্র ১ দ্রষ্টব্য।

চিত্র ১

আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জার্মান পত্রিকা Zeitschrift fur Physik-এ এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এভাবেই আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীমহলে সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্বীকৃতি লাভ করেন।

এখানে উল্লেখ্য, ফোটন ভরশূন্য এবং তাদের আচরণ ব্যাখ্যার জন্য বসু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং অবস্থার সংখ্যায়নের ওপর নির্ভর করেছিলেন। যাদের ভর আছে অর্থাৎ বস্তুকণার ক্ষেত্রে বোস সংখ্যায়নের নিয়ম প্রয়োগ করতে গিয়ে আইনস্টাইন তাত্ত্বিক বিচার করে দেখালেন যে, কোনো বস্তুকে ঠান্ডা করতে করতে চরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছালে বস্তুকণাগুলি যদি বসুর নিয়ম মেনে চলে, তবে সব কণা সবচেয়ে নিচু ধাপের শক্তির অবস্থায় পৌঁছবে। ফলে বস্তুর নানা অচেনা ব্যবহার দেখা যাবে। অনেক গ্যাসকণা এই অবস্থায় পৌঁছালে শক্তি স্তরে যে ঘন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তাকে বলা হলো বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন। ১৯৯৫ সালে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।

নিজের আবিষ্কার সত্যেন্দ্রনাথ বসু কখনো সরাসরি বলতে পারতেন না। এ-বিষয়ে একটি ঘটনার কথা জানা যায়। একবার বিজ্ঞানী ডিরাক তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতায় বেড়াতে আসেন। একদিন সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে একই গাড়িতে তাঁরা কোথাও যাচ্ছেন। সামনের সিটে ড্রাইভার ও সত্যেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর কয়েকজন ছাত্রকে সামনের সিটে উঠতে বললেন। এ-ঘটনা দেখে ডিরাক একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘বেশি ঠাসাঠাসি হবে না?’ সত্যেন্দ্রনাথ পিছন ফিরে বললেন, ‘আমরা বোস সংখ্যায়নে বিশ্বাস করি।’ ডিরাক তখন তাঁর স্ত্রীকে বুঝিয়ে বললেন যে, ‘বোস সংখ্যায়নে মৌল কণাগুলি খুব ঠাসাঠাসি করে থাকে।’ নিজের কাজের কথা সত্যেন্দ্রনাথ এভাবেই রসিকতা করে বলতেন।

বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস সম্পর্কে ভারতের স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের সভাপতি অধ্যাপক এম জি কে মেনন উল্লেখ করেছিলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে বলতে গেলে আমি নিজে কখনোই বুঝতে পারিনি বোসকে কেন নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এ-বিষয়ে আমি অনেক স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি, তাঁরাও একই মত পোষণ করেন। তবে দশক বা শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে গেলে কোনো বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেলেন কি না সেটা তত বড় কথা নয়। তার চেয়েও বড় কথা হলো বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে কি না। তাঁর অবদান সর্বদা পঠিত, আলোচিত এবং ব্যবহৃত হবে কি না। এই শেষের শ্রেণিতে সত্যেন বোসকে ফেলা যায়।’

বিজ্ঞানের ইতিহাসে বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়নের অবদান  ও বোসন কণার নাম কোনোদিন লুপ্ত হওয়ার নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যতদিন আলো থাকবে, ততদিন বিশ্বজুড়ে থাকবে বোসন কণা। সেইসঙ্গে পরমাণুর জগতে চলবে বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা। এই গবেষণায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

সহায়ক তথ্যপঞ্জি

১. কানন পুরকায়স্থ (২০২৩), শূন্যতার স্বরূপ ও অন্যান্য প্রবন্ধ,  বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, পৃ ৪৬-৫০ এবং

১০৮-১০৯।

২. মহাদেব দত্ত (২০০৩), বোস সংখ্যায়ন, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ কলকাতা, পৃ ২৬-৩৪।

৩. Ensher et.al (1995), Observation of Bose-Einstein condensation in a dilute atomic vapour, Science, 269, pp 198-200.