সুব্রত কুমার দাস
১২৮০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা ভারত সংস্কারক ছিল সেকালে উচ্চমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী। প্রতি শুক্রবার কলকাতা থেকে প্রকাশিত সে-পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪০-১৯০৭)। পত্রিকাটিতে সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতো তিনটি ভিন্ন শিরোনামে। ভারত এবং ইউরোপের বাইরে বাকি বিশ্বের সংবাদ প্রকাশিত হতো ‘বিবিধ’ শিরোনামে। ‘বিবিধ’তে কখনো কখনো এক-দুই লাইনের সংবাদ পাওয়া গেছে, যার কেন্দ্র ছিল জাপান। যেমন ১২৮১ বঙ্গাব্দের ৯ শ্রাবণ ছাপা হয়েছিল ‘জাপানের দূতগণ সম্প্রতি পৃথিবীর চতুর্দ্দিক বেস্টন করিয়া আসিয়াছেন, জাপান গবর্ণমেন্ট দ্বারা তাহাদিগের ভ্রমণ বৃত্তান্ত শীঘ্র প্রকাশিত হইবে’ (পৃ ১৭৯)। পত্রিকাটির দ্বিতীয় বর্ষে অর্থাৎ ১৮৭৪ সালে জাপান নিয়ে অন্তত দুবার তুলনায় বড় প্রবন্ধ পাওয়া যায়। একবার সূচিতেই এসেছিল ‘চিন ও জাপানের বল পরীক্ষা’। আর অন্যটি হলো ১২৮১ বঙ্গাব্দে ১৬ জ্যৈষ্ঠ প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ভারতবর্ষ ও জাপান’। অসাধারণ সে প্রতিবেদনটির লেখকের নাম উল্লেখ ছিল না। সেটির মূল বিষয় ছিল অতীত কালের ভারত ও জাপানের একটি প্রতিতুলনা। প্রতিবেদকের মতে, জাপানের ওপরে ভারতের ঐতিহাসিক প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এক পৃষ্ঠা দেড় কলাম বিস্তৃত সে-প্রবন্ধটি জাপানের অতীত চিত্রটি স্পষ্ট করতে সমর্থ ছিল।
ভারত সংস্কারক পত্রিকার প্রসঙ্গ এ-কারণে যে, ১৯১৬ সালে প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) জাপানযাত্রার পাঁচ দশক আগে থেকেই জাপান নিয়ে সেকালের বৃহৎ বাংলা অঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় জাপানবিষয়ক সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশক থেকেই জাপানে বাঙালিদের যাওয়া এবং জাপান বিষয়ে বই প্রকাশও লক্ষ করার মতো। ১৯১৯ সালে জাপান-যাত্রী প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে জাপান বিষয়ে অন্তত আটটি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯০৪ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ নিয়ে ১৯১০ সালে প্রকাশিত নলিনীবালা ভঞ্জ চৌধুরানী-রচিত বই রুশ-জাপান যুদ্ধের ইতিহাস রীতিমতো বিস্ময় জাগায়। ১৯০৬ সালে জাপান গিয়েছিলেন যে বিপুলসংখ্যক বাঙালি তাঁদের মধ্যে দুজনের প্রথম বই ছাপা হয়েছিল ১৯১০ সালে। তাঁরা হলেন যশোরের মন্মথনাথ ঘোষ (১৮৮২-১৯৪৪) আর কলকাতার ছেলে সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮২-?)। মন্মথনাথ লিখেছিলেন জাপান-প্রবাস আর সুরেশচন্দ্র লিখেছিলেন জাপান। এছাড়াও ওই বছরে আরো একজন বাঙালি জাপান সফর করেন যাঁর লেখা বইয়ের নাম পৃথিবী-ভ্রমণ। এর অনেক পরে ঢাকার মেয়ে বাঙালি হরিপ্রভা মল্লিক (১৮৯০-১৯৭২) জাপানি স্বামী উয়েমেন তাকেদার সাথে জাপান গিয়েছিলেন ১৯১২ সালে। ১৯১৫ সালে হরিপ্রভার বঙ্গমহিলার জাপানযাত্রা প্রকাশ পেয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯১৫ সালে মন্মথনাথ আরো দুটো গ্রন্থ প্রকাশ করেন যেগুলো হলো নব্য জাপান ও সুপ্ত জাপান। কিন্তু সেসবেরও বহু আগে ১৮৫৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল জেপান নামে এক গ্রন্থ।
জেপান গ্রন্থটি প্রকৃতপক্ষে একটি অনুবাদ গ্রন্থ। মধুসূদন মুখোপাধ্যায় এ-অনুবাদ কাজটি করেন। অনুবাদকের মূল আশ্রয় ছিল ১৮৫৮ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত Narrative of the Expedition of an American Squadron to the Chinese Seas and Japan নামে একটি বই। আমেরিকার নাবিক মেথিউ পেরি ১৮৫৩ সালে জাপান গমনের পর সেখানকার বিবরণ আমেরিকার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে সে-বিবরণাদির গ্রন্থিতরূপ তিন খণ্ডের এই বই।
জাপানবিষয়ক বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের সে-ধারা জাপান-যাত্রী প্রকাশিত হওয়ার পরেও প্রবলভাবে অব্যাহত ছিল। জাপান বিষয়ে রচিত অধিকাংশ গ্রন্থই, স্বভাবসিদ্ধভাবে, ভ্রমণকাহিনিমূলক। জাপানের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে সত্যিকারভাবে রচিত গবেষণা গ্রন্থও একেবারে দুর্লভ নয়। রবীন্দ্রনাথের জাপানযাত্রার পূর্বেই জাপানি শিল্পী-সাহিত্যিকদের শান্তিনিকেতনে আগমন সূর্যোদয়ের দেশটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট উৎসাহী করে তোলে। কয়েকবার উদ্যোগ গ্রহণ করার পর তাঁর সে-উৎসাহ সফলতার মুখ দেখে ১৯১৬ সালে। এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের জাপান-গমন দেশটির মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল অভূতপূর্ব আলোড়ন। ১৯১৬, ১৯২৪ ও ১৯২৯ সালে জাপান ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ যেসব বক্তৃতা দেন তার গ্রন্থরূপ ঞধষশং রহ ঔধঢ়ধহ ছাপার ব্যাপারে জীবদ্দশাতেই কবির ইচ্ছা থাকলেও তার প্রকাশ ঘটেছে সম্প্রতি – ২০০৭ সালে।
জাপান-যাত্রী বাংলা ভাষায় জাপান বিষয়ে একটি মাইলফলক রচনা, যদিও এ-প্রসঙ্গে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই গ্রন্থটির পরমাদরের পেছনে কবির বৈশ্বিক পরিচিতি ভূমিকা রেখেছিল। কেননা সত্যিকার অর্থে জাপানের ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক-পৌরাণিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় ও শিক্ষাগত চিত্র সম্পর্কে জ্ঞানের প্রশ্নে অন্য গ্রন্থকারদের অধিকতর সুলিখিত ও তথ্যবহুল বই একেবারে যে ছিল না, এমনটি নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে জাপানি দার্শনিক ওকাকুরা তেনশিনের (১৮৬২-১৯১৩) সংযোগের ভেতর দিয়ে জাপান-বাংলা সাহিত্যিক-দার্শনিক যোগাযোগের মাইলফলক সূচিত হয়েছিল। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত তেনশিনের গ্রন্থ দি বুক অব টি ‘এক এশিয়া’র দার্শনিক ভিত্তি। ১৯০২ সালে প্রথমবারের মতো ভারত ভ্রমণকালেই তেনশিনের সঙ্গে যোগাযোগ ও নৈকট্য ঘটেছিল বাঙালি জাতির তৎকালীন অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের, যাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) অন্যতম। যদিও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার জাপান ভ্রমণের পূর্বেই তেনশিনের মৃত্যু হয় এবং ১৯২৪ সালে তিনি তেনশিনের ‘এশিয়া ইজ ওয়ান’ দর্শনের বিরোধিতাও করেন, সম্ভবত এ-কারণে যে, রবীন্দ্রনাথ ততদিনে ‘এক এশিয়া’র পরিবর্তে ‘এক বিশ্ব’ দর্শনে নিজেকে উপনীত করেছেন। তেনশিনের সঙ্গে বাঙালি মহিলা কবি প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৭১-১৯৩৫) যে-সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ১৯১২ সালে কলকাতায় তেনশিনের দ্বিতীয়বার ভ্রমণকালে পত্রপ্রেমে রূপ নেয়। জাপানের গেইশা রমণীদের জীবন নিয়ে প্রিয়ম্বদা রচনা করেছিলেন রেণুকা (দ্র. সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, ১ম খণ্ড, কলকাতা, সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণ ১৯৯৪)। ‘দরদি প্রাচ্যবিদ পণ্ডিত কাকুজো ওকাকুরা আমেরিকায় বসে যে-বইটি লেখেন তার স্বল্প পরিসরে বিধৃত রয়েছে গভীর ঐশ্বর্য। পাশ্চাত্য জীবনের পল্লবিত তেজ আর উচ্চকিত প্রদর্শনীর নিজস্ব শৈলীর মধ্যে বসে প্রাচ্যের প্রাচীনে সম্বৃত-গম্ভীর দর্শনের ধারাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক। তাঁর রচনায় মিশে আছে ইতিহাসবোধ, প্রজ্ঞা, শিল্পচেতনা, দেশপ্রেম আর আমাদের অধুনাতন সামূহিক চটুলতার প্রতি এক অভিমান। এ বইয়ে শিল্প, সমাজ আর মানুষের ইতিহাস একাকার হয়ে গেছে দার্শনিক চিন্তার আবহে। ইতিহাসের বন্ধ দরজা খুলে মরমি লেখক আমাদের দেখিয়েছেন কুয়াশাঘেরা এক রহস্যময় সুন্দর উপত্যকায় ছড়ানো মাণিক্যের চমক, ফুলের সৌরভ আর সর্বোপরি সেই স্বাদ যা এক সত্যিকার সোনার কাঠি’ (চা-চরিত, মনফকিরা, কলকাতা, ২০০৬, পৃ ৮)।
প্রথমবার জাপান ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী ছিলেন কিশোর শিল্পী মুকুলচন্দ্র দে (১৮৯৫-১৯৮৯)। ভ্রমণকালের দিনলিপি ও লিখিত পত্রাবলি নিয়ে তাঁর গ্রন্থ জাপান থেকে জোড়াসাঁকো এ-বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যদিও গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৫ সালে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা আমার কথাতেও (১৯৯৫) জাপান ভ্রমণ সময়কাল স্থান পেয়েছে যথেষ্টভাবেই। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে প্রধান যে দুজন বাঙালি লেখক জাপান ভ্রমণ করেন এবং দেশটির ওপর গ্রন্থ প্রকাশ করেন তাঁরা হলেন বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪) এবং অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৯-২০০২)। এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, গুরুসদয় দত্তের (১৮৮২-১৯৪১) স্ত্রী সরোজনলিনী দত্ত (১৮৮৭-১৯২৫) স্বামীর সঙ্গে জাপান ভ্রমণে যান ১৯২০ সালে। তিনি জাপানে বঙ্গনারী শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৮ সালে।
সুরেশচন্দ্র ও মন্মথনাথ ঘোষের পূর্বে অন্য আরেক যে-বাঙালির জাপান গমনের খবর জানা যায় তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের পথে বিবেকানন্দ জাপানে যাত্রাবিরতি করেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার সে-বিরতি নিয়ে স্বামীজি কোনো গ্রন্থ রচনা না করলেও স্বল্পকালের জাপানবাস যে তাঁর মননের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছিল তার নিদর্শন পাওয়া যায় বিবেকানন্দের জীবনীগ্রন্থগুলোতে। ১৮৯৩ সালের ৩১ মে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বিবেকানন্দ পেনিনসুলা জাহাজে বোম্বাই থেকে রওনা দেন। কলম্বো, পেনাং (মালয়), সিঙ্গাপুর, হংকং বন্দরে বিরতি দিয়ে দিয়ে জাহাজটি গিয়ে পৌঁছায় জাপানে। তাঁরা গিয়ে নামেন নাগাসাকি বন্দরে। বিবেকানন্দ নাগাসাকি থেকে কোবে যান। কোবে গিয়ে জাহাজ ছেড়ে দেন তাঁরা। পরে স্থলপথে ইয়োকোহামায় যান – জাপানের মধ্যবর্তী প্রদেশসমূহ দেখার জন্য। সে-যাত্রায় তিনি জাপানের মধ্যপ্রদেশে তিনটি বড় বড় শহর দেখেন : শিল্পশহর ওসাকা, প্রাচীন রাজধানী কিয়োটো এবং বর্তমান রাজধানী টোকিও। ওকাকুরার সঙ্গে বিবেকানন্দের যোগাযোগের কথাও এ-প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। ১৯০১ সালের আগস্টে বিবেকানন্দ জাপান ভ্রমণের আমন্ত্রণ পেলেও স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি সে-আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে দীর্ঘ সাত বছর থাকা তাঁর আমেরিকান বান্ধবী ম্যাকলিয়ডের মাধ্যমে জাপানের সুধীজনেরা বিবেকানন্দকে জাপানে নেওয়ার প্রয়াস চালান। ১৬ জুন (১৯০১) তারিখে তিনি ম্যাকলিয়ডকে লিখেছিলেন যে, ‘ভারত ও জাপানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন সত্যিই অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়।’ এবং সে-প্রেক্ষাপটে ভারতে জাপানি কনসাল একদিন বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করে জাপান ভ্রমণে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান, যদিও সে আমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় তিনি আর পাননি। কঠিন শারীরিক অসুস্থতার কারণে মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন এই মহামানব।
বাংলাভাষায় জাপান বিষয়ে প্রথম মৌলিক গ্রন্থ জাপান প্রবাসের লেখক মন্মথনাথ ঘোষের জন্ম যশোরের মথুরাপুর গ্রামে। ১৯০৫ সালে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় লেখাপড়ায় ইস্তফা টানেন মন্মথনাথ। ১৯০৬ সালে জাপান গিয়ে শিল্পবিষয়ক কাজ শেখেন। দুই বছর পর দেশে ফিরে তৈরি করেন চিরুনি, বোতাম আর মাদুরের কারখানা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংসদ বাঙালি চরিতাভিধানে বলা হয়েছে যে, তিনি সে-কারখানায় মাত্র ৭৫ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করতেন এবং মহিশুরের রাজার হাজার টাকা বেতনের প্রস্তাবও তিনি অস্বীকার করেছিলেন। বাংলাদেশ অঞ্চলে দেয়াশলাই কারখানা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর ছিল অসামান্য ভূমিকা। ১৯৩৩ সালে মন্মথনাথ ঘোষ গৃহশিল্পের উপযোগী কলকব্জা আনার জন্য দ্বিতীয়বার জাপানে যান।
মন্মথনাথ ঘোষের বই থেকে জানা যায়, টোকিও শহরের গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল এবং টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশনে সাবান, পেনসিল, ছাতা, কাচ ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। জাপানের অন্য শহর কোবেতে গিয়ে তিনি শেখেন বোতাম বানানো। কোবেতে ছয় মাস কুছাকারি নামক জনৈক ভারতহিতৈষী জাপানি ভদ্রলোকের বাড়িতে থেকে মন্মথনাথ ঘোষ সেটি বানানো শেখেন। সেটি শেষ করে তিনি শেখেন কৃত্রিম হাতির দাঁত দিয়ে জিনিস বানানো। ওসাকা শহরে গিয়ে তাঁকে এটি শিখতে হয়েছিল। শতাব্দীকাল পূর্বেই ওসাকাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উঁচুমানের একটি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন। সে-সময় জাপানে বিভিন্ন কলেজ ও ইনস্টিটিউটে ভারতীয় ছাত্ররা পড়তে যেত বলে জাপান প্রবাস বই থেকে জানা যায়। সেলুলয়েড শিক্ষা শেষ করার পূর্বে মন্মথনাথ কৃত্রিম চামড়া কারখানার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। একই সঙ্গে ছাতা ও লাঠির বাঁট বানানোও শিখে নেন। পরে তিনি কর্পূর প্রস্তুত ও এর ব্যবহার শেখেন। এছাড়াও পিপারমেন্ট, মেন্থল, সুগন্ধি তেল, কনডেন্সড মিল্ক, সাবান, সোডা ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি বাসাতে একটি ছোটখাটো গবেষণাগার তৈরি করে ফেলেন। আনন্দের বিষয়, মন্মথনাথ দেশে ফিরে তাঁর অধীত জ্ঞানকে কাজে লাগাতে এবং বিতরণ করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নতির ব্যাপারে তাঁর ছিল ঐকান্তিক প্রয়াস।
মন্মথনাথ ঘোষ যে-জাহাজে করে জাপান রওনা হয়েছিলেন সেই একই জাহাজে তিনি ছাড়াও আরো পনেরোজন ভারতীয় যুবক রওনা হন, যাঁদের অধিকাংশ ছিলেন আমেরিকাগামী। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরও (১৮৮৮-১৯৬১) ওই একই জাহাজে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজে পুত্রকে জাহাজে তুলে দিতে ঘাটে গিয়েছিলেন বলে প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডে জানিয়েছেন। শান্তিনিকেতন থেকে রথীন্দ্রনাথ ছাড়াও গিয়েছিলেন সন্তোষচন্দ্র (যদিও মন্মথনাথ সন্তোষকুমার বলে উল্লেখ করেছেন) মজুমদার (১৮৮৪-১৯২৬)। প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, ‘রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষচন্দ্র কবে আমেরিকার উদ্দেশে জাপান যাত্রা করেন তা নির্দিষ্ট করে বলার মত উপকরণের অভাব আছে’ (পৃ ২৯১)। জাপান প্রবাস গ্রন্থে লেখক জানিয়েছেন তাঁদের জাহাজ ছেড়েছিল ১ এপ্রিল। পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বাবা জানতে পেলেন যে বিজ্ঞান ও শিল্প বিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশে বাঙালি ছাত্র পাঠাবার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একটি শিক্ষার্থীর দল কিছু দিনের মধ্যে জাপান ও আমেরিকা পারি দিচ্ছে। সন্তোষ ও আমাকে বলে দিলেন এই দলের সঙ্গে যোগ দিতে।’ ১২ মার্চ শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষচন্দ্রকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। অনুশীলন সমিতির কেন্দ্রীয় অফিসে একটি প্রীতি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল বলে জীবনতারা হালদার তাঁর অনুশীলন সমিতির ইতিহাস গ্রন্থে জানিয়েছেন বলে প্রশান্তকুমার লিখেছেন। সে-প্রীতি সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও যোগদান করেন এবং সমিতিকে অভিনন্দন জানান।
সেই যাত্রায় আরো অন্তত তিনজন যে জাপানে গিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক শিল্প শিখতে তা নিশ্চিত। এঁরা হলেন ঢাকার সুরেন্দ্রমোহন বসু (১৮৮২-১৯৪৮), কলকাতার খগেন্দ্রনাথ দাশ (১৮৮৩?-১৯৬৫ : মন্মথনাথ ঘোষ যদিও তাঁর নামের বানান খগেন্দ্রচন্দ্র দাস বলে উল্লেখ করেছেন) এবং বিক্রমপুরের অবনীনাথ মিত্র (১৮৮৮-১৯৬৪)। সুরেন্দ্রমোহন বসু ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ১৯০৫ সালে যোগীন্দ্রচন্দ্র ঘোষ স্কলারশিপ পান এবং দেড় বছর জাপানে থেকে কাপড়ে রং দেওয়ার এবং ছাপার কাজ শেখেন। তিনি পরবর্তীকালে আমেরিকার স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি পাশ করেন। দেশে ফিরে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় গ্রেফতার হন এবং অন্তরীণ অবস্থায় ছোট ল্যাবরেটরিতে ওয়াটারপ্রুফ কাপড় ও ক্যানভাস তৈরির গবেষণায় মগ্ন হন। ১৯২০ সালে কলকাতায় নিজ বাসাতেই বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্ক্স প্রতিষ্ঠা করেন। ডাকব্যাক মার্কা ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্ক্সের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। এদেশে ওয়াটারপ্রুফ তৈরির প্রথম কৃতিত্ব এ-প্রতিষ্ঠানেরই। অন্যজন খগেন্দ্রনাথ দাশ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে এফএ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর জাপান যান। পরবর্তীকালে তিনি আমেরিকায়ও গিয়েছিলেন এবং ফিরে এসে আজকের বিখ্যাত ক্যালকাটা কেমিক্যাল কোম্পানির গোড়াপত্তন করেন। তৃতীয়জন অবনীনাথ মিত্র জাপানে পেন্সিল, সাবান, বিস্কুট, কেক ইত্যাদি তৈরির বিদ্যা শেখেন এবং দেশে ফিরে ১৯০৮ সালে কলকাতায় প্রথম বিস্কুট কারখানা খোলেন। এঁরা সকলেই গিয়েছিলেন Association for the Advancement of Scientific and Industrial Education of India (AASIEI) নামে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে। ১৯০৪ সালে সে-প্রতিষ্ঠানটি সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় যুবকদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। সে-উদ্দেশ্যকে সফল করতে প্রতিষ্ঠানটি মেধাবীদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করতো। যদিও প্রতিষ্ঠানটি তিন-চার বছরও পার করতে পারেনি বিভিন্ন কারণে। ১৯১২ সালের জুনে প্রকাশিত মডার্ন রিভিউর ‘Notes’-G ‘Indian Student in America’-তে বলা হয়েছে J. C Das-এর কথা, যিনি ১৯০৬ সালে দ্বিতীয় ব্যাচে কলকাতা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জাপান যান। সেখানে এক বছরের মতো পড়াশোনা করে তিনি চলে যান আমেরিকাতে। নভেম্বর মাসে প্রকাশিত মডার্ন রিভিউতে রয়েছে আরেকটি ‘Notes’, যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রভাস চন্দ্র প্রামাণিকের কথা। ভাষ্যমতে, তিনি বছর দুয়েক আগে AASIEI-এর উদ্যোগে জাপান যান। তাঁর ছবি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ২৪ বছরের এই যুবক জাপানে ছাতা বানানো কোম্পানিসহ মোট তিনটি কোম্পানিতে প্রশিক্ষণ নেন। এই পাতায় ছাপা হয়েছিল জে সি চৌধুরী নামে আরো একজন শিক্ষার্থীর কথা যাঁর মূল বাড়ি আগরতলা, তিনি গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করে এক পর্যায়ে টোকিওর ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ অব এগ্রিকালচারে যান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর কাল থেকেই জাপান বিষয়ে বাঙালির আগ্রহ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। কাজুজো ওকাকুরা ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে ভারত তথা বাংলা ভ্রমণে এলে বাংলা নিয়ে জাপানিদের আগ্রহও অস্পষ্ট থাকে না। জাপান-বাংলা সম্পর্কের ইতিহাসে সে-সময়টি বেশি যুগান্তকারী হয়ে উঠেছিল বাঙালি ছাত্রদের জাপানে গমনের ভেতর দিয়ে। ১৯০৬ সালে প্রথম যে-দল ছাত্রবৃত্তি নিয়ে জাপান ও আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করে তাঁদের মধ্যে অন্তত চারজনের অভীষ্ট ছিল জাপান। সেখানে শিক্ষা সমাপন করে যখন তাঁরা দেশে ফেরেন ততোদিনে শান্তিনিকেতনে জাপানি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ক্রমবর্ধিষ্ণু। ১৯১০-এর দশকে তাই অধিকাংশ সাময়িক পত্রিকাই আগ্রহী হয়ে ওঠে জাপান প্রাসঙ্গিকতায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপাতে। স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) সম্পাদিত ভারতী পত্রিকাতে সেসবের চূড়ান্ত লক্ষিত হয়। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় (১৮৬৫-১৯৪৩) সম্পাদিত প্রবাসী পত্রিকাতেও দেখা যায় জাপানবিষয়ক রচনা। ১৯১৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) সম্পাদনায় সবুজপত্র প্রকাশিত হলে এতে জাপান প্রসঙ্গ আসতে দেরি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপানযাত্রা পর্যন্ত। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপান থেকে যে পত্রাদি পাঠিয়েছিলেন সেগুলো সবুজপত্রতেই প্রকাশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের আগে আরো যে এক বাঙালি জাপান গিয়েছিলেন এবং জাপান নিয়ে বিপুলাকায় বই লিখেছিলেন তাঁর নাম বিনয়কুমার সরকার (১৮৮৭-১৯৪৯)। বহুভাষী অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার প্রথমবার জাপান যান ১৯১৫ সালের জুন মাসে। সেই যাত্রায় তাঁর জাপানবাস হয়েছিল মাত্র তিন মাস। সেই তিন মাসের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই তিনি লিখেছিলেন নবীন এশিয়ার জন্মদাতা জাপান। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯১৬ সালে চিন থেকে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য জাপান গিয়েছিলেন। অবস্থান করেছিলেন জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। যদিও দ্বিতীয়বারের জাপান-অভিজ্ঞতা তাঁর গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে ৪৮১ পৃষ্ঠার দীর্ঘায়তন এ-গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। বইয়ে রয়েছে জুনজিরো তাকাকুসুর সংগৃহীত জাদুঘরের কথা। এই তাকাকুসুই রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার জাপানে যাওয়ার আগে দু-তিনবার (বিনয়কুমারের ভাষ্যমতে) ভারতে যান এবং শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন (পৃ ৪৮)। কাজুও আজুমা তাঁর জাপান ও রবীন্দ্রনাথ : শতবর্ষের বিনিময় (কলকাতা, ২০০৮) গ্রন্থে জুনজিরো সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, তিনি ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথমবার জাপান ভ্রমণের আগেই শান্তিনিকেতনে কবির সঙ্গে পরিচিত হন এবং কবির জাপান সফরকালে রবীন্দ্র-অভ্যর্থনা কমিটির অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন (পৃ ১৩১)। জাপান-ভারত নিয়ে বিনয়কুমার অনেক বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন, জাপানের প্রায় ৫০০ বিশিষ্টজন জাপান-ভারত পরিষদের সদস্য যাঁদের মধ্যে উপর্যুক্ত তাকাকুসু ছাড়াও আছেন বুনিউ নান্যিও এবং আনেসাকি। সেইচিতাকি নামে এক পত্রিকা সম্পাদকের কথা বলেছেন লেখক যিনি কয়েক বছর পূর্বে ভারতে এসেছিলেন। সেইচিতাকি ভারতে এসেছিলেন অজন্তার শিল্পকর্ম দেখতে এবং তিনি লেখককে সে-শিল্পকর্ম সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনার কথা বলেছিলেন যেগুলো শিল্প-ইতিহাসের যে-কোনো অনুরাগীকে চমকিত করবে। সম্পাদক জানিয়েছিলেন তাঁর পত্রিকা কোক্কা একই সঙ্গে জাপানি ও ইংরেজি ভাষাতে ছাপানো হয়। জাপানি ‘কোক্কা’ শব্দের অর্থ দেশের ফুল বা গৌরব। কোক্কা সে-সময় ভারতে পাঁচ-ছয় কপি পাঠানো হতো। সম্পাদক আরো জানিয়েছিলেন, কোক্কাতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১) এবং নন্দলাল বসুর (১৮৮৩-১৯৬৬) চিত্রকর্মও প্রকাশিত হয়েছিল। কোক্কার একটি সংখ্যায় জর্জ উড্রফের লেখা ‘নব্য ভারতীয় চিত্রকলা’ নামে প্রবন্ধও ছাপা হয়েছিল। তাকির ঘরে নন্দলাল বসুর ‘কৈকেয়ী’ চিত্র টানানো ছিল। বিনয়কুমার জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদ জাপানে বিক্রির ব্যাপারটি। বইয়ের ‘কবি ও সমালোচক য়োনে নোগুচি’ প্রবন্ধটি জাপানি সে লেখক সম্পর্কে অনেক অজানা ধারণা দেয়। বিনয়কুমার নোগুচির সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করেন, দীর্ঘ আলোচনা হয় তাঁদের দুজনের সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে। তাঁদের আলাপে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ দু-তিন মাসের ভেতর জাপান যাবেন এবং সে-বিষয়ে নোগুচির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রযোগাযোগ শুরু হয়েছে (পৃ ১৭১)। লেখক জানিয়েছেন, ‘রবিবাবু জাপানে আসিতেছেন শুনিয়া জাপানের সাহিত্য-সংসারে একটা হৈ চৈ পড়িয়াছে। “সাধনা” গ্রন্থের জাপানী অনুবাদ প্রচারিত হইবামাত্র হাজারে হাজারে বিক্রি হইতেছে। রবিবাবুর ইংরাজী পুস্তকগুলির কাটতিও বাড়িয়াছে। শুনিলাম জাপানীরা “গীতাঞ্জলি” পড়িয়া বেশি রস পায় না। রবিবাবুর কথা প্রায় প্রত্যেক জাপানী দৈনিকে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইতেছে’ (পৃ ওই)।
উল্লিখিত গ্রন্থগুলোর বাইরে বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকাতেও জাপানবিষয়ক লেখালিখির বিস্তর বিবরণ পাওয়া যায়। শিক্ষাবিষয়ক মাসিক পত্রিকা শিক্ষা-পরিচয় পত্রিকার পঞ্চম বর্ষে, ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ ‘জাপানীর মুখে জাপানের কথা’। উমেশচন্দ্র দত্ত-সম্পাদিত বামাবোধিনী পত্রিকার দশম বর্ষে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘জাপানী কুকুর’। পত্রিকাটির ১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ছাপা হয় ‘জাপান কাহিনী : জাপানের কয়েকটি দেশচার’ নামে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। ক্রমপ্রকাশিত সে-প্রবন্ধের লেখক ছিলেন মন্মথনাথ সিংহ। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ভাদ্র-আশ্বিনে সাময়িক প্রসঙ্গতে ‘জাপানে ভারত ছাত্রের সুবিধা’ শিরোনামে একটি সংবাদকণিকা প্রকাশিত হয়। লেখা ছিল, ‘জাপানে যাইবার ২য় শ্রেণীর জাহাজ ভাড়া ২৪০ স্থানে ১৯৪ এবং ৩য় শ্রেণীর ১২০ স্থানে আহারাদি সহিত ৯৫ টাকা মাত্র হইয়াছে। টোকিও নগরে থাকিতে বাস খরচাদির ব্যয় মাসিক ২০ এবং ছাত্র বেতন ৪ টাকা মাত্র। নানা প্রকার যন্ত্র ও শিল্পবিদ্যা শিক্ষার পক্ষে জাপান প্রসস্ত।’
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে সখি নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সে-পত্রিকার ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যায় ‘জাপানী খেলা’ (পৃ ১৪২) শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেটির লেখক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১২৭৯ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত সেকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সাময়িকী বঙ্গদর্শনের নবপর্যায় শুরু হয় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে; সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নবপর্যায়ে প্রকাশিত বঙ্গদর্শনের পঞ্চম বর্ষের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয় বিপিনচন্দ্র পালের (১৮৫৮-১৯৩২) অসাধারণ রাজনৈতিক প্রবন্ধ ‘জাপান ও হিন্দু-আশিয় সাধনা’। ১৩১৭ বঙ্গাব্দে অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় বিপিনচন্দ্র পালের আরেকটি প্রবন্ধ ‘বিলাতে জাপান’। সে-সময় পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শৈলেশচন্দ্র মজুমদার। ১৯১০ সালে লন্ডনে যে-জাপানি উৎসব হয় সেটিতে হতাশ হয়ে বিপিনচন্দ্র পাল এ-প্রবন্ধ লেখেন। লেখকের পূর্ববর্তী রচনাতে স্পষ্ট হচ্ছিল তিনি চেয়েছেন জাপান এশিয়ামুখী হবে; কিন্তু এ-প্রদর্শনীর ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছিল জাপান আরো বেশি করে পশ্চিমামুখী হতে চলেছে। আর সে আশংকারই প্রকাশ বর্তমান প্রবন্ধ।
কৃষি, শিল্প, সংবাদ আদি বিষয়ক সাময়িকী কৃষক প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণে সে-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ছোট্ট সংবাদ ‘জাপান ও ভারতীয় শিল্প’। পত্রিকাটি আষাঢ় ১৩০৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘বিবিধ সংবাদ ও মন্তব্য’তে বিক্রমপুরের মন্মথনাথ দত্তের জাপানযাত্রার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৩০৯-এর চৈত্র মাসে প্রকাশিত কৃষকে ‘জাপানে ধর্ম্ম সমিতি’ শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপা হয় ‘বিবিধ সংবাদ ও মন্তব্য’ অংশে। বলা হয়েছে, ‘জাপানে যে মহা ধর্ম্ম সমিতি বসিবার কথা ছিল, তাহার অধিবেশন কেবল ভারতীয় দর্শকগণের সুবিধার জন্য বিলম্ব করা হইতেছে – ইহা ভারতের গৌরবের কথা’ (পৃ ২৬৭)। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে World Parliament of Religion-এ ভারতীয় চিন্তাবিদ স্বামী বিবেকানন্দের বিপুল সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে জাপানে দার্শনিক তেনশিন ওকাকুরা উদ্যোগ গ্রহণ করেন নিজ দেশে তেমন একটি ধর্ম-সম্মেলন আয়োজনের। ভারত থেকে যাঁদের সে-সম্মেলনে অংশগ্রহণের কথা ছিল তাঁরা সময়স্বল্পতার কথা জানালে সম্মেলন পিছিয়ে দেওয়া হয়। ১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যুর কারণে সম্মেলন আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কৃষকের ৫ম বর্ষে অর্থাৎ ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে (বৈশাখ ১৩১১) প্রকাশিত হয় ‘বস্ত্রশিল্পে জাপান’। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে (বৈশাখ ১৩১০ বঙ্গাব্দ) ‘বিবিধ সংবাদ ও মন্তব্য’তে জাপান-প্রাসঙ্গিকতায় দুটি সংবাদ ছাপা হয় – ‘জীবন কৌচ’ ও ‘চৈতন্য লাইব্রেরি’। ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিবিধ সংবাদ ও মন্তব্য’তে ছাপা হয় ‘জাপানের কৃষি মিশন’ এবং ‘স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার’।
কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, কলকারখানা বিষয়ক মাসিক মহাজনবন্ধ কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। সম্পাদক ছিলেন রাজকৃষ্ণ পাল। প্রথম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা অর্থাৎ ১৩০৮ বঙ্গাব্দে মাঘ মাসে প্রকাশিত হয় ‘জাপানী ভাষা শিক্ষা’ শিরোনামে গুরুত্বপূর্ণ এক প্রবন্ধ। ময়মনসিংহ সাহিত্য সভা থেকে প্রকাশিত শারদাচরণ ঘোষ-সম্পাদিত আরতী পত্রিকার ১৩০৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় ছাপা হয় নিবন্ধ ‘জাপানের বামন বৃক্ষ’। ‘বৈজ্ঞানিকের কুটীর’ শিরোনামের অধীনে আরো একটি সংবাদের সঙ্গে এটিও একটি। প্রতিবেদক শ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ছোট ১৩ লাইনের প্রতিবেদনের বিষয় জাপানে বনসাই গাছ চাষের রহস্য, যেটি লেখকের মতে সেসময় জার্মান একজন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন। গাছের গোড়ায় ক্লোরোফর্ম দিলে সেটি করা সম্ভব। তবে বর্তমানে এটি প্রমাণিত যে, প্রতিবেদকের তথ্য যুক্তিসিদ্ধ ছিল না। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি (১৮৭০-১৯২১) সম্পাদিত সেকালের বিখ্যাত সাময়িকী সাহিত্যতে ১৩০৫ বঙ্গাব্দে (বর্ষ ৯) প্রকাশিত হয় শ্রীপরিব্রাজ-রচিত ‘জাপানের পত্র’। অনুমান হয় সেটি আসলে কোনো লেখকের ছদ্মনাম। পত্রিকাটিতে সে-বছর ‘সহযোগী সাহিত্য’ শিরোনামে সংবাদ অংশে জাপান-প্রাসঙ্গিকতায় যে-দুটি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলো হলো ‘জাপানী মহিলা’ এবং ‘জাপান ও জাপানী’। ‘সমাজনীতি’ শিরোনামের লেখাতে ‘জাপানী মহিলা’ ছাপা হয়। লেখকের নাম ছিল না। শুরুর বাক্যটি হলো : ‘আজকাল জাপান-ভ্রমণ বড় সখের হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’ জানা যায় সে-শখ আমেরিকানদের। কাজের চাপ থেকে রক্ষা পেতে আমেরিকানরা দেশ ভ্রমণে বের হলে লক্ষ্য হয় জাপান ও চিন। চিন যেহেতু বেড়ানোর জন্য সুবিধা নয়, জাপানকেই তারা বেছে নেয়। এরপর লেখাটিতে জাপানের মহিলাদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র, তাঁদের বেশভূষা, শিক্ষাচিত্র ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। ৯ম বর্ষ ২য় সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫) ছাপা হয় ‘জাপান ও জাপানী’। পৌষ, ১৩০৫-তে ছাপা হয় ‘জাপানের পত্র’। ইয়োকোহামা থেকে পত্র পাঠিয়েছেন লেখক। বর্ণনা দিয়েছেন সে-শহরের। শেষে দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন জাপানের স্নানব্যবস্থা নিয়ে। যারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান-যাত্রী পড়েছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে জাপানের স্নানব্যবস্থা নিয়ে কবিগুরুর বিশ্লেষণের কথা। ১৪শ বর্ষে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘জাপানী কাহিনী’ (পৃ ৪৩৬) ও ‘জাপানী পুরোহিতের তিব্বত ভ্রমণ’ (পৃ ৬৯৮)। ১৯০৪ সালে সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘জাপানী বালিকা ও রমণী প্রকৃতি’ নামের নিবন্ধ। ছোট্ট সে-নিবন্ধের মূল উৎস সেন্ট জেন্টস পত্রিকায় প্রকাশিত একজন লেখকের জাপানবিষয়ক বিবরণ। পাশ্চাত্য সে-লেখক বলেছেন যে, জাপানি মেয়েরা বয়োজ্যেষ্ঠদের আদেশ পালনে অভ্যস্ত, একই সঙ্গে তারা পারিবারিক অন্যান্য কাজেও যথেষ্ট দক্ষ হয়ে থাকে। প্রতিবেদক নববিবাহিত জাপানি বধূ তার শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি কীভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে তারও বিবরণ দিয়েছেন। ১৯০৫ সালে ইন্দুমাধব মল্লিকের ‘জাপানী চিত্রকরের চিত্রশালা’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় (পৃ ১৯৫)। একই বছরে ‘জাপানে শিক্ষা’ (পৃ ৫০০) ও ‘জাপানে শ্রমশিল্প’ (পৃ ৪৪৬) নামে দুটি ছোট নিবন্ধ ছাপা হয় ‘সহযোগী সাহিত্য’ অংশে। ১৯০৮ সালে সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘জাপানী কবিতা’ (পৃ ৮৬), মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জাপানী গল্প’ (পৃ ৪৮৪)।
ভারতী পত্রিকায় জাপানবিষয়ক প্রথম লেখা পাওয়া যায় ১৯০৩ সালের এপ্রিল মাসে। লেখক নিজেও ছিলেন একজন জাপানি। নাম শিতোকু হোরী (?-১৯০৩)। সকলের জানা আছে যে, শিতোকু হলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম বিদেশি ছাত্র। এসেছিলেন সংস্কৃত পড়তে, পাঠিয়েছিলেন জাপানি ওকাকুরা নিজেই। তাঁকে নিয়ে বিশ্বকেন্দ্রিক শিক্ষাদানের কেন্দ্র হিসেবে শান্তিনিকেতন সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নটি অনেক বেশি পল্লবিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দুঃখের যে, পাঞ্জাব ভ্রমণে গিয়ে ওই তরুণের অকাল মৃত্যু হয় যে-বছর লেখাটি প্রকাশিত হয় সে-বছরের ডিসেম্বরে। ‘জাপানের সনাতন আদর্শ’ শিরোনামে সে-প্রবন্ধে যুক্ত হয়েছিল সম্পাদক কর্তৃক একটি ভূমিকা। ভূমিকাতে বলা হয়েছিল, ‘এই প্রবন্ধ লেখক জাপানের সম্ভ্রান্ত ফুজিওয়ারা বংশজ শ্রীযুক্ত শিতোকু হোরী কিছুকাল যাবৎ ভারতবর্ষে বাস করিতেছেন। স্বদেশে ইনি শিঙ্কে নামক ধর্মসভার নেতা। হিন্দু শাস্ত্র অনুশীলন করিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার এদেশে আগমন।’ প্রবন্ধটি ভারতীর জন্য লিখিত হলেও তা ছিল ইংরেজি ভাষায় যেখান থেকে বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়। সে-বছরের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবী-রচিত কবিতা ‘জাপানী বীর’। ১৯১০ সালে ভারতীতে জাপানবিষয়ক প্রধান লেখক হলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮)। সে-বছরে তাঁর যেসব রচনা প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলো হলো ‘জাপানে ভিক্ষুক’ (বৈশাখ), ‘জাপানের সভা সমিতি’ (শ্রাবণ), ‘জাপানের শহর’ (কার্তিক, অগ্রহায়ণ), ‘জাপানের সংবাদপত্র’ (মাঘ), ‘জাপানের খেলা’ (ফাল্গুন)। ‘জাপানের শহর’ প্রবন্ধটি দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এটি ছিল সচিত্র প্রবন্ধ। খেলাবিষয়ক প্রবন্ধটিও সচিত্র ছিল।
১৯০৯ সালে ভারতীর সূচিপত্রে জাপান নিয়ে কোনো রচনা ছিল না। ধারণা হয়, জাপান থেকে ফিরে যদুনাথ সরকার তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন এবং ক্রমে ক্রমে সেগুলো ভারতীতে প্রকাশিত হতে থাকে। তিন মাস পর ছাপা হয় ‘জাপানের সভাসমিতি’। সাড়ে তিন পৃষ্ঠার প্রবন্ধ। সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষদের মধ্যে বহুরকমের সমিতির অস্তিত্বের কথাই লেখক জানিয়েছেন প্রবন্ধে। কার্তিক সংখ্যায় ‘জাপানের শহর’ প্রবন্ধটির প্রথম কিস্তি ছাপা হয়। এ-প্রবন্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘ইন্ডিয়ান হাউজের’ কথা। লেখক জানিয়েছেন, রাজপুত্রের প্রাসাদ যেটি কি না আত্তইয়ামা প্যালেস নামে পরিচিত সেটির পাশেই ভারতীয় ছাত্রদের টোকিওস্থ ইন্ডিয়ান হাউজ। দুই মাস পর ছাপা হয় ‘জাপানের সংবাদপত্র’। ৩৪ বর্ষ একাদশ সংখ্যাতে ছাপা হলো ‘জাপানের খেলা’। ক্রীড়ামোদী জাপানিদের কথা বলতে গিয়ে লেখক দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে একজন মি. হারার কথা বলেছেন যিনি ভারতীয় ছাত্রদের পরমবন্ধু। পরের বছর অর্থাৎ ১৩১৮ বঙ্গাব্দে ভারতীতে যদুনাথ সরকার-রচিত জাপানবিষয়ক চারটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। সেগুলো হলো : ‘জাপানী আকৃতি ও প্রকৃতি’, ‘জাপানে অতিথি সৎকার’, ‘জাপানের ধর্ম’, ‘জাপানের সেনা ও নৌবাহিনী’। সে-বছরের তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘জাপানে অতিথি সৎকার’। ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের জীবনী সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্যের অভাবে এটি অস্পষ্ট ঠিক কোনো সালে কত দিনের জন্য তিনি জাপানে অবস্থান করেছিলেন। তবে বোঝা যায় তাঁর জাপানযাত্রা ছিল ডিগ্রি লাভের জন্য এবং আট মাসের বেশি তিনি সেখানে অবস্থান করেন। ‘জাপানের ধর্ম’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল দুই কিস্তিতে। ছবিসহ সে-প্রবন্ধের প্রথম খণ্ড ছাপা হয় আশ্বিন ১৩১৮ সংখ্যায়। সে-বছরের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ছাপা হয় প্রবন্ধটির দ্বিতীয় অংশ। লেখক জাপানে ধর্মের বিকাশ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। এ-পর্যায়ে জানা যায় লেখক জেনারেল কাউন্ট কোদামার শোকযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন। বলে রাখা যেতে পারে যে, কাউন্ট কোদামা মৃত্যুবরণ করেন ১৯০৭ সালে। তা থেকে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে, ১৯০৭ সালে যদুনাথ সরকার জাপানে অবস্থান করছিলেন।
১৩২০ বঙ্গাব্দের ভারতীতে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল জাপান প্রসঙ্গ নিয়ে। একটির রচয়িতা যদুনাথ সরকার। শিরোনাম ‘দাইতোকোরো’। অন্যটি হলো ‘স্বর্গগত শ্রীমদ্ ওকাকুরা’। লিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জাপানি ভাষায় ‘দাইতোকোরো’ অর্থ রান্নাঘর। প্রবন্ধে লেখক যেমন জাপানের রান্নাঘরের বিবরণ দিয়েছেন তেমনি সেখানকার খাদ্যাভ্যাসেরও বর্ণনা দিয়েছেন। কার্তিক সংখ্যায় ছাপা হলো ওকাকুরার মৃত্যুসংবাদ। তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩-১৯৬০)।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন ঘোষ (১৮৪৩-১৯১০) সম্পাদিত বান্ধব পত্রিকায় ১৩১১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘জাপান সম্বন্ধে কএকটি কথা’। লেখক ছিলেন রসিকলাল গুপ্ত। ফরিদপুরের কৃতী সন্তান দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী (১৮৫৪-১৯২০) সম্পাদিত কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নব্যভারত ছিল একটি উচ্চাঙ্গের পত্রিকা। ১২৯০ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত সে-পত্রিকাটি চলেছিল তেতাল্লিশ বছর। পত্রিকাটির ১৩১৩ বঙ্গাব্দে চতুর্বিংশ বর্ষে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তারকনাথ মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘জাপানের অভ্যুদ্বয়’। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রবাসী পত্রিকাটিতে সে-সময় জাপান বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০৮ সালে পত্রিকাটিতে প্রথম জাপান বিষয়ে রচনা প্রকাশিত হয় বলে ধারণা। অনাথবন্ধু সরকার লিখেছিলেন ‘জাপানে ভারতীয় ছাত্রের কত ব্যয় হয়’। সে-লেখার একটি বেনামি প্রতিবাদ একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া ব্রজসুন্দর সান্যাল লিখেছিলেন ‘জাপানের স্ত্রীশিক্ষা’। একই লেখকের ‘জাপানের নারীসমাজ’ও একই বছরে প্রকাশিত হয়। ১৯১১ সালে প্রকাশিত হয় শরৎকুমার রায়ের প্রবন্ধ ‘জাপানের প্রসিদ্ধ বিচারক’। ১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত রচনাটিতে দুটি অংশ ছিল ‘নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ’ এবং ‘সেনাধ্যক্ষ ও বিচারপতি’ – ভাল বিচারপতি নিয়ে জাপানে প্রচারিত দুটি লোকগল্প।
প্রবাসীতে ১৩২০ বঙ্গাব্দে ‘জাপানের গৃহধর্মনীতি’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত সে-প্রবন্ধটির লেখক ছিলেন কালীমোহন ঘোষ (১৮৮২-১৯৪০)। রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের নিবেদিত সে-শিক্ষকই পরবর্তীকালে কৃতী রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ শান্তিদেব ঘোষের (১৯১০-৯৯) বাবা। জাপানি সভ্যতা যে পাশ্চাত্য সভ্যতার ফল নয়, সে-কথাই তুলে ধরেছেন লেখক প্রবন্ধে। ১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জাপানী উৎসব ও অনুষ্ঠান’ প্রবন্ধটি। ১৯১০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ জাপানের লেখক দীর্ঘ প্রবন্ধটিতে জাপানকে ‘উৎসবের দেশ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। একটি বছরের তারিখের ক্রম অনুযায়ী লেখক একে একে বর্ণনা করেছেন জাপানিদের উৎসবের কথা। পৌষ সংখ্যায় ছাপা হয় সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জাপানী শিষ্টাচার’। প্রবন্ধটিতে ব্যবহৃত পাঁচটি ছবিই ছিল জাপানিদের আদব-কায়দা নিয়ে। ১৩২১ বঙ্গাব্দে প্রবাসীর অগ্রহায়ণ সংখ্যাতে প্রকাশিত হয়েছিল শান্তা চট্টোপাধ্যায়ের (পরবর্তীকালে শান্তা দেবী) প্রবন্ধ ‘জাপানী চুলের গহনা’। প্রবাসী পত্রিকায় ১৯১৬ সালের কার্তিক সংখ্যায় ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’তে ‘জাপানে সংস্কৃতের চর্চা’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে-বছরের কার্তিক সংখ্যা থেকে শুরু হয় জাপানি শ্রমণ একাই কাত্তাগুচির লেখা ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘তিব্বতরাজ্যে তিনবছর’। অনুবাদক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা দেবী (১৮৬৮-১৯৪৩)। প্রবাসীর চার সংখ্যা জুড়ে লেখাটি ছাপা হয়েছিল। কার্তিক সংখ্যাতে ছাপা প্রিয়ম্বদা দেবীর তিনটি কবিতা ‘কল্পতরু’, ‘কামনা’, ‘অন্তীম ইচ্ছা’। তিনটি কবিতার নিচেই প্রথম বন্ধনীতে ‘ওকাকুরা’ শব্দটি লেখা ছিল, অর্থাৎ কবিতা তিনটি জাপানি দার্শনিক ওকাকুরাকে নিবেদিত। উল্লেখ করা যেতে পারে, যখন এ-কবিতা ছাপা হয়েছে তখন ওকাকুরা পরপারে। ভাদ্র সংখ্যায় ছাপা হয় চারুর লেখা ‘জাপানের মূর্ত্তিশিল্প’। ১৯১৬ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ছাপা হয় চারুর লেখা দুটি নিবন্ধ – ‘জাপানের বৌদ্ধধর্ম’ এবং ‘জাপানীদের কর্ম্মনৈপূণ্য’। নিবন্ধ দুটি ‘পঞ্চশষ্য’তে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘জাপানী টিকি’, ‘জাপানের কৌতুকর বিবাহ রীতি’, ‘জাপানের ক্রীড়া কৌতুক’ এবং ‘জাপানী বীরের সাহস পরীক্ষা’ প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে কারো নাম উল্লেখ ছিল না। ১৯১৮ সালে প্রবাসীতে প্রকাশিত হয় ‘জাপানি ব্যঙ্গচিত্র’ এবং ‘জাপানি খেলনার ব্যবসায়’ নামে দুটি রচনা। ‘পঞ্চশষ্য’ কলামে অন্তর্ভুক্ত ছিল লেখা দুটি। লেখকের নাম ছিল না। শেষে ছিল ‘শ’। যেমনটি ‘জাপানী চুলের গহনা’তেও ছিল। তবে সেবার সূচিপত্র দেখে স্পষ্ট হওয়া গিয়েছিল লেখিকার নাম। কিন্তু ১৩২৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় সূচিপত্রে লেখিকার নাম ছিল না। ‘শ’ থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে, এটিও শান্তা দেবীর লেখা। কলকাতা থেকে প্রকাশিত যোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়-সম্পাদিত ‘মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ও সমালোচনী’ আলোচনার ৯ম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (বৈশাখ ১৩১২) ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হয় ‘জাপান মহিলার পতিব্রত্য’ প্রবন্ধটি। লেখাটি সম্পাদকের নিজের। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হয় রাধারঞ্জন দে-রচিত ‘জাপানী নীতি’ প্রবন্ধ। যোগীন্দ্রনাথ কুণ্ডু-সম্পাদিত কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা কুশদহের ২য় বর্ষে অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ‘জাপানী মহিলা’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ৮ম বর্ষে তারা প্রকাশ করে ‘জাপানে রবীন্দ্রনাথ’। দুটি প্রবন্ধই অন্য পত্রিকা থেকে গৃহীত ছিল। প্রথমটি ছিল ধর্ম্ম ও কর্ম্ম পত্রিকা থেকে, অপরপক্ষে দ্বিতীয়টি ছিল সঞ্জীবনী পত্রিকা থেকে। দ্বিতীয় প্রবন্ধের বিষয় ছিল ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে জাপানে ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ যেসব বক্তৃতা করেছিলেন সেগুলোর সারসংক্ষেপ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত সরযুবালা দত্ত (১৮৮০-১৯৬৩) সম্পাদিত এবং হেমেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক প্রকাশিত ভারত-মহিলা পত্রিকার অনেক সংখ্যাতেই জাপানবিষয়ক রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১২ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় কালীমোহন ঘোষের ‘জাপানের গৃহধর্মনীতি’ প্রবন্ধটিতে প্রকাশিত হয়েছিল, যেটি পরবর্তীকালে প্রবাসীতে ১৩২০ বঙ্গাব্দে ছাপা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ভারত-মহিলা পত্রিকাতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল ঢাকার ব্রাহ্ম কন্যা গৃহবধূ হরিপ্রভা মল্লিকের জাপান ভ্রমণ বিবরণের প্রথম খসড়াগুলো। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) সম্পাদিত মহিলা পত্রিকাটির ত্রয়োদশ বর্ষে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে দুই কিস্তিতে ছাপা হয় ‘জাপানের বৃত্তান্ত’। শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধটিতে লেখকের নাম ছিল না। ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত কালীপ্রসন্ন সরকার দেববর্মা-সম্পাদিত আর্য্য-কায়স্থ-প্রতিভা পত্রিকায় যশোহরের মন্মথনাথ ঘোষ-রচিত তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সে-পত্রিকার ১০ম বর্ষের ১০ সংখ্যায় (১৯১৭ সাল) প্রকাশিত ‘বিবিধ প্রসঙ্গে’র একটি সংবাদে মন্মথনাথ ঘোষ সম্পৃক্ত ছিলেন। যশোরে চিরুনি, বোতাম ও মাদুর কারখানা নিয়ে নির্মিত সে-সংবাদে বলা হয়েছে যে, কোম্পানিটিতে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে মন্মথনাথ ঘোষ সুপারিন্টেডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি লর্ড কারমাইকেল সে-কারখানা দেখতে সস্ত্রীক-সপরিষদ এসেছিলেন। চিরুনি বানানোর উপাদান সেলুলয়েড আগে জার্মানি থেকে এলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তা মন্মথনাথের কোম্পানিতেই তৈরি হচ্ছিল। মাদুর প্রস্তুতের উপাদান মাদুরের গাছ কোম্পানির পার্শ¦বর্তী এলাকায় লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কর্পূরের বীজও জাপান থেকে এনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুরেনচণ্ডী দত্ত-সম্পাদিত মাসিক অবসর পত্রিকার ৫ম বর্ষে ১৯০৯ সালে (আশ্বিন-কার্তিক ১৩১৫ বঙ্গাব্দ) ছাপা হয় মনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রুষ-জাপান যুদ্ধের একটি চিত্র’ প্রবন্ধ। পত্রিকাটি ৯ম বর্ষে ১৯১৩ সালে শ্যামলাল গোস্বামীর ‘জাপানের শিক্ষা’ ছাপা হয়। অবিনাশচন্দ্র মজুমদার-সম্পাদিত মাসিক প্রতিভা ঢাকা-সাহিত্য-পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হতো। ১৯১১ সালে শুরু সে-পত্রিকার ২য় বর্ষ থেকে হেমনলিনী রায়ের অনুবাদে একটি জাপানি উপন্যাস নামি-কোর তৃতীয় পরিচ্ছেদ প্রকাশ দেখা যায়। মূল লেখক ছিলেন কেনজিরো তোকুতোমি (Kenjiro Tokutomi)। শিশুতোষ পত্রিকা বালক ছিল সেকালের প্রতিষ্ঠিত একটি সাময়িকী। ১৯১১ সালে শুরু সে-পত্রিকায় ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্পাদক হিসেবে ছিলেন সি এস প্যাটারসন, ডব্লিউ অ্যালেকজান্ডার ও ললিতলোচন দত্ত। ৭ম বর্ষে সে-পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয় বিমলাক্ষ চট্টোপাধ্যায়ের ‘হাশিকিরাজু’। সেটি আসলে এক ধরনের কাগজের নাম, যা জাপানে তৈরি হতো। তুঁতগাছের তন্তু থেকে তৈরি সে-কাগজ ছিল যথেষ্ট শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। আগুনেও সে-কাগজ পুড়ত না। জাপানে সে-কাগজের ছিল বহুল ব্যবহার। হাশিকিরাজু কাগজের ব্যবহার ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক পৃষ্ঠার প্রবন্ধ ছিল এটি। সে-কালে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘সচিত্র মাসিক পত্র ও সমালোচন’ সৌরভ বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। সৌরভের প্রথম বর্ষেই জাপান নিয়ে দুই কিস্তিতে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখক ছিলেন যদুনাথ সরকার। দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা অর্থাৎ কার্তিক মাসে প্রকাশিত হয় পূর্বোক্ত যদুনাথ সরকারের লেখা আরো একটি প্রবন্ধ ‘জাপানে সাহিত্যচর্চা’। পত্রিকাটির তৃতীয় বর্ষে (কার্তিক ১৩২১) ‘বৈদেশিক’ অংশে অনেক ছোট প্রতিবেদনের একটি হলো ‘জাপানের সেক্ষপিয়ার’ (শেক্সপিয়র বানানটি তখন ‘ক্ষ’ দিয়ে লেখা হতো। অনেক পত্রিকাতেই ‘সেক্ষপিয়ার’ ব্যবহার চোখে পড়েছে)। জাপানি নাট্যকার চিকামাৎসু মনজিমন (Chikamatsu Monzaemon ১৬৫৩-১৭২৫)। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই লেখক জাপানিদের কাছে ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের (১৫৬৪-১৬১৬) মতো জনপ্রিয় ছিলেন। অবিনাশচন্দ্র রায় ছিলেন সে-সংবাদের প্রতিবেদক। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ পত্রিকাটির ১১শ বর্ষে গৌরচন্দ্রনাথ প্রকাশ করেন ‘জাপানী শিক্ষা’।
ঐতিহাসিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৮৩-১৯৬৫) সম্পাদিত বিক্রমপুর পত্রিকাটি ১৩২০ বঙ্গাব্দ থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করে। সে-পত্রিকার পঞ্চম বর্ষে (১৩২৪ বঙ্গাব্দ) বৈশাখ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘জাপানের কথা’। লেখক ছিলেন মুকুলচন্দ্র দে। সে-লেখাতে যেমন এসেছে রবীন্দ্রনাথের কথা তেমনি জাপানিদের শিল্পচর্চার কথাও উঠে এসেছে। জ্যৈষ্ঠ সংখ্যাতেও ছাপা হয় মুকুলচন্দ্রের লেখাটি। লেখাটি থেকে জাপানে রবীন্দ্রনাথের বিপুল প্রভাবের একটি মনোজ্ঞ চিত্র পাওয়া যায়। ১৯১৪ সালে জলধর সেন (১৮৬১-১৯৩৯) ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ (১৮৬৯-১৯৪০) সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষে প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জাপানের অভ্যন্তরীণ অবস্থা’। পত্রিকাটির দ্বিতীয় বর্ষের ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় পান্নালাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তরুণ জাপান’। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হয় বিনয়কুমার সরকার-রচিত উনিশ পৃষ্ঠা দীর্ঘ ‘জাপানের দিল্লী’। সপ্তম বর্ষে অর্থাৎ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় একগুচ্ছ জাপানবিষয়ক রচনা। এগুলোরও লেখক ছিলেন বিনয়কুমার। কলকাতা থেকে প্রকাশিত অর্চ্চনায় ১৯১৬ (পৌষ ১৩২২ বঙ্গাব্দ) ও ১৯১৭ (ভাদ্র ১৩২৪ বঙ্গাব্দ) খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় যতীন্দ্রনাথ সোমের ‘জাপান-ভ্রমণ বিবরণ’। কেশবচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সে-পত্রিকায় এ-রচনাটি লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা – স্থান জাপানের কোবে বন্দর। মানসী পত্রিকার সপ্তম বর্ষে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় জাপানি দার্শনিক ওকাকুরা তেনশিনের The Book of Tea গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ। ‘চা গ্রন্থ’ শিরোনামে সে-রচনার অনুবাদক ছিলেন প্রিয়ম্বদা দেবী।
এবার আসছি মডার্ন রিভিউ প্রসঙ্গে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে পত্রিকাটিতে জাপান নিয়ে অনেক রচনা প্রকাশিত হয়। সেগুলোর ভাষা ইংরেজি হলেও লেখকদের অধিকাংশ ছিলেন বাঙালি। সে-কারণে সে-রচনাগুলোর ওপর সামান্য আলোকপাত আমাদের সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় Modern Review পত্রিকায় ‘Notes’ অংশে ‘Students trained Abroad’ শিরোনামে যে-সংবাদকণিকা ছাপা হয়েছিল তাতে দুজন শিক্ষার্থীর একজন হলেন জাপানপ্রবাসী।AASIEI নামের সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রেরিত সুরেন্দ্রনাথ বোস জাপান যান ১৯০৭ সালে। সেখানে তোহোকু ইমপোরিয়াল ইউনিভার্সিটি কলেজ অব এগ্রিকালচারে তিনি ভর্তি হন অ্যাগ্রোনমি বিভাগে। দুই বছর ট্রেনিং করার পর তিনি অতিরিক্ত এক বছর জাপানে থেকে দেশটির বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন এবং কৃষিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যান। অক্টোবর সংখ্যায় ছাপা হয় সতীশচন্দ্র বসুর প্রবন্ধ ‘Female Education in Japan and in the United States of America’। সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ছাপা হয় লালা লাজপত রাওয়ের প্রবন্ধ ‘Education in Japan’। লাজপত বাঙালি না হলেও ছিলেন ভারতীয় এবং বাঙালি স্বদেশিদের সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় যোগাযোগ। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর সংখ্যায় ‘Current Literature : English and American Magazine’ নামে যে-প্রতিবেদন ছাপা হয় সেটির একটি অংশের উপশিরোনাম হলো ‘The Japanese Peril’। Contemporary পত্রিকায় নেহাল সিংয়ের লেখা ‘Asia for the Japanese’ নিয়ে। ‘Two Old Capital of Japan’ প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর সংখ্যায়। লেখক ছিলেন সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একশ বছর পূর্বে বাংলাভাষী অঞ্চল থেকে প্রকাশিত এসব গ্রন্থ এবং খুচরো খুচরো সংবাদের পেছনে রয়ে গেছে অনেক অনুষঙ্গ। সেগুলোকে একটি সূত্রে বাঁধতে পারলে বাঙালির জাপানচর্চার ইতিহাস অধিক আলোয় উদ্ভাসিত হবে, সন্দেহ নেই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.