বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শন ও বাঙালির রাষ্ট্রসাধনা : ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

শামসুজ্জামান খান

বাঙালি একটি সংকর জনগোষ্ঠী। প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলয়েড, ভোটচীন, নেগ্রিটো, সেমেটিক, আর্য ইত্যাদি নানা নরগোষ্ঠী বাঙ্গালা অঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। বিবিধ জাতিগোষ্ঠীর একই ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাসের ফলে তাদের মধ্যে সখ্য, সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সাধারণ জীবনযাত্রার ধরন গড়ে উঠতে থাকে। আড়াই-তিন হাজার বছর আগের এ-সময়কে ইতিহাসে প্রত্নবাংলা হিসেবে আখ্যাত করা হয়। তখন বাংলা ও বাঙালি নৃগোষ্ঠী সৃজ্যমান (formative stage) একটা পর্যায়ে ছিল। জাতিসত্তা গঠনের মূল উপাদান অর্থাৎ একটি সাধারণ (common) ভাষা তখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। প্রত্নবাংলার ভাষা বাঙ্গালা অহমিয়া, উড়িয়া এবং মূলপূর্ব-প্রান্তীয় কথ্যভাষা অবহট্ঠ হতে উদ্ভূত। সেই ভাষায় ভাবের আদান-প্রদানের স্তরে ছিল এই জনগোষ্ঠীর অবস্থান। সেই অবস্থায় বাংলা এবং বাঙালি জাতিসত্তা একটি বিশিষ্ট আদল পেতে শুরু করে হাজারখানেক বছর আগে। আর সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে।

একটি সাধারণ, সংহত ও সর্বজনীন ভাষা ছাড়া কোনো জাতি গড়ে ওঠে না। বঙ্গদেশে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। প্রাচীন অনার্য-অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ইত্যাদি ভাষার বহু কিছু ছেড়ে দিয়ে নব্যভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য বা পূর্বাংশ অর্থাৎ বঙ্গ কামরূপ বাংলা সাধারণ ভাষায় (common language) রূপান্তরিত হয়। ফলে উড়িয়া, বিহারি, অহমিয়া ও বাঙ্গালার সমন্বয়ে প্রত্নবাংলা গঠিত হয়। এভাবেই বাঙালি জাতিসত্তা গঠনের প্রাথমিক স্তরটি সম্পন্ন হয়।

জাতি গঠনের অন্য সমস্যার একটা জটিল দিকও ছিল। কারণ, এসব আদিম জনগোষ্ঠী নানা আচার-বিশ্বাস-সংস্কার-ধর্মমত এবং সাধনপন্থায় বিশ্বাসী ছিল। এদের রক্তধারা ও সাংস্কৃতিক বোধ-বিশ্বাস, উপকরণও ছিল বহু বিচিত্র। এত বিচিত্র জীবনযাত্রা ও ঐতিহ্যের মানবগোষ্ঠীর সাধারণ জীবনপদ্ধতি নির্ধারণ এবং সেই যাপিত জীবনধারাকে সচল করার লক্ষ্যে যে কোনো অলঙ্ঘনীয় বিরোধ বা বাধার সৃষ্টি হয়নি বা সর্বব্যাপী দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিবর্তে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশে সমন্বিত জীবনধারা বিকশিত হয়েছে সেটিই আমাদের পূর্বপুরুষদের বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। জীবনযাত্রায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সমৃদ্ধির জন্য এ-ধরনের গ্রহণক্ষম ও মিলেমিশে বাস করার বোধ আমাদের প্রাচীন বংশধরদের এক অসামান্য কীর্তি। 

আদি বা প্রত্ন-বাঙালির ধর্ম-দর্শন, ঐতিহ্য ও সামাজিক জীবনযাত্রায় কিছু কিছু পার্থক্য এমনকি বিপরীতধর্মিতা থাকা সত্ত্বেও সমন্বয়ের একটি ধারাই বাঙালির জাতিগঠনের রূপ নিতে থাকে। এক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতে (বাংলায়) পঞ্চম শতকের দিকে মৌলিক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনটি ঘটে। সেটি রাজারাজড়া বা রাজবংশের পরিবর্তন নয় – তা ছিল কৃষিভিত্তিক গ্রাম-সমাজের উদ্ভাবন।  বাঙালির আদি ইতিহাসের সূচনা এভাবে হয়েছে বলেই ইতিহাস থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অসাধারণ গ্রহণক্ষমতা, পরমতসহিষ্ণুতা, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বিভিন্ন কৌম সমাজের মত-পথ-পন্থার গ্রহণ-বর্জন-সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে আমাদের এ-অঞ্চলের নানা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ধীরে ধীরে যে সমাজ, সংস্কৃতি ও বাস্তব জীবনযাত্রা গড়ে তুলেছে তাকেই বাঙালি জীবন বলে ইতিহাসে আখ্যাত করা হয়েছে। অষ্টম শতকের পাল আমলকে এই জীবনের কিছুটা সংহত সূচনা বলে মনে করা হয়। পাল আমলে  শিল্প-সংস্কৃতি-ভাস্কর্য-চিত্রকলার যে অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল তাও বোধহয় নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সমন্বিত চিন্তনেরই ফল। শুধু শিল্প, সংস্কৃতি নয়, রাজনৈতিক জীবনধারায়ও এই কাল এক নতুন মাত্রা যোগ করে। আমাদের এই উপমহাদেশে প্রাচীনকালেই জনগণের দ্বারা শাসক নির্বাচনের এক ইতিহাসেরও পরিচয় পাওয়া যায় এই সময়ে। অষ্টম শতকের পাল আমলে (অনু. ৭৫০-১১৬১) জনসাধারণ মিলিত হয়ে গোপাল নামে এক সৎ-সজ্জন-প্রজ্ঞাবান-প্রগাঢ় বৌদ্ধ যোদ্ধাকে তাদের রাজা নির্বাচন করে। এখানে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা বিবেচনা করে দেখতে পারি। প্রথম কথা হলো, সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যায় তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন; কিন্তু এই শিবভক্ত রাজার রাজত্বের শেষেই তৎকালীন বঙ্গদেশে মাৎস্যন্যায় অর্থাৎ অরাজক অবস্থা দৃষ্ট হয়। সেই অরাজক অবস্থায় শাসন পরিচালনায় বিবিধ বিষয়ে তর্ক-তদন্ত-বিচার-বিবেচনা নিশ্চয়ই অনেক হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় কী বিহিত করা যায় সেকালের সাধারণ মানুষ তার এক ধরনের জনসমর্থনমূলক যে-পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পেরেছিলেন সেটি বিশ্বের গণতন্ত্রের ইতিহাসেরও এক নিদর্শন হিসেবে গণ্য হতে পারে। বৌদ্ধ পাল রাজারা মূলত বাংলার বরেন্দ্র অঞ্চলের হলেও তাঁদের সাম্রাজ্য মগধ অর্থাৎ বর্তমান বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

অন্যদিকে শক্তিশালী রাজতন্ত্র যে টেকসই ব্যবস্থা নয় এবং তাতে সাধারণ মানুষের কল্যাণের নিশ্চয়তা নেই – এই বোধ থেকেও হয়তো গণতান্ত্রিক পন্থায় একজন সাধারণ এবং সৎ মানুষকেই রাজা নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ-ঘটনা থেকে ইতিহাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়? শিক্ষা তো এটাই যে, বিশেষ কোনো ধর্ম (সেকালের শৈবধর্ম – একালে অন্য যে-কোনো ধর্ম) বা প্রচণ্ড শক্তিশালী রাজতন্ত্র জনগণের সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারে না। বিকল্পপন্থা অর্থাৎ সংলাপ, বিচার-বিশ্লেষণ এবং সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই সম্প্রদায়গত বিশ্বাস এবং জাতিগত ধ্যান-ধারণাকে ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত পর্যায়ে স্থিত রেখেই সাধারণ মানুষের সমবেত প্রয়াসে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা সমীচীন। শুধু সেভাবেই সুষ্ঠু ও মানবকল্যাণধর্মী টেকসই রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব।

পাল রাজাদের রাজত্বকালের গুরুত্ব বাংলার ইতিহাসে অনস্বীকার্য। ইতিপূর্বে আমরা তাদের আমলের শিল্প-সংস্কৃতি-চিত্রকলা-ভাস্কর্যের অসামান্য বিকাশের কথা বলেছি। কিন্তু আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁদের বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপালের (৭৭৫-৮১২) আমলে ঘটে; যথা বাংলা ভাষার উৎপত্তি এবং বাংলায় একটি আঞ্চলিক অর্থনীতির উদ্ভব। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। তাদের চারশো বছরের রাজত্বকালে ধর্মীয় নির্যাতনের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু দশম-একাদশ শতকে দক্ষিণ ভারতের (কর্নাটক) সেন রাজারা তাদের আমলে সংস্কৃত ভাষা ও শাস্ত্রীয় ধর্ম-দর্শনের বিকাশের দিকেই অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েন। তাদের আত্যন্তিক ধর্মবোধ অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য যে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল তার প্রমাণ – বাংলা সাহিত্যের আদি কবি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আর সেজন্যেই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ মাত্র শতাধিক বছর আগে নেপালের রাজদরবার থেকে উদ্ধার করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

সেন রাজাদের ধর্মীয় উগ্র শাসনের পরবর্তীকালে প্রায় দুশো বছরকে যে বাংলার ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয় তা সৃষ্টির দায়ভার ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু সেন রাজা এবং ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকের মুসলিম বহিরাগত বিজয়ীদের ধর্মীয় উন্মত্ততায় ধ্বংস ও হত্যালীলার ওপরেই বর্তায়। তবে বাংলাদেশ চিরকালই সমন্বয়বাদী; সংস্কৃতি ও মানস ক্ষেত্রের বিকাশ এবং মূল উৎপাদন ব্যবস্থা অর্থাৎ কৃষি উদ্ভাবনে নানা মত-পথ-পন্থা-কাল্ট এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে জাতিসত্তাগত যে-বিকাশ ঘটেছে তাতে শুধু অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্য জাতিসত্তাগত (প্রবাসী আর্য ব্রাহ্মণরা) উপাদানই নয়, ধর্ম-দর্শন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বৌদ্ধতান্ত্রিক ও জৈন ধর্মাবলম্বী সাধক, নাথযোগী, বাউল-সুফি, বৈষ্ণব এবং মারেফতি-মুর্শিদির অনুসারী কবিয়াল-বয়াতিসহ গ্রামীণ ভাবুক-চিন্তকেরাই এদেশে এক জীবনঘনিষ্ঠ সমন্বয়বাদী মানবিক জীবনধারা গড়ে তুলেছেন।

বাংলা অঞ্চল দূরবর্তী প্রান্তিক অবস্থান ও ভূ-প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণে চিরকালই দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন থেকে স্বাধীন থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ায় তাদের এই সাধনা উত্তর ভারতীয় আর্য-ভাবধারার কঠিন শাস্ত্রগত অনুশাসন নির্ভরতার পরিবর্তে বাংলার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত মানবপন্থী (humanist) সাধনায় পরিণত হয়েছে। এই মানবপন্থী সাধনাকে বাংলার লোককবি বলেছেন : ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ এই সাধনা হৃদয়সংবেদী। বাঙালি জাতিসত্তাই গড়ে উঠেছে স্থানীয় নানা ধর্ম-উপধর্ম, আচার-বিশ্বাস-কাল্ট ও মতাদর্শের মিশ্রণের মাধ্যমে। ফলে যে-দেশজ চিন্তা-চেতনা ও দর্শনে বাঙালির বাঙালিত্ব বা যে দেশগত-সত্তা, তার ভিত্তি পরমতসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় সহনশীলতা। সেজন্যই প্রাচীনকাল থেকে বহুত্ববাদী জীবন, বহু মত-পথ-পন্থার মিশ্রণে গঠিত সমন্বিত জীবনবোধই বাঙালিত্ব। এই সমন্বয়বাদিতা ছাড়া বাঙালি সত্তা তৈরি হওয়া সম্ভব ছিল না। তবে মনে রাখতে হবে, বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতা পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজমের মতো বস্তুতান্ত্রিক নয় – আগেই যেমনটি বলেছি, হৃদয়সংবেদী অর্থাৎ মরমি। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন – ‘মানবপন্থী বাংলাদেশ প্রাচীনকালেও ভারতের শাস্ত্রপন্থী সমাজ নেতাদের কাছে নিন্দনীয় ছিল। তীর্থযাত্রা ছাড়া এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো।’ রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের সমর্থন পাই ত্রয়োদশ শতকে করা মার্কো পোলোর বক্তব্যে। মার্কো পোলো বলেছেন : “Bangla a place he had apparently heard of from his Muslim informants, and which he understood as being a region distinct from India, for he described it as tolerably close to India and its people as wretched Idolater, who spoke a peculiar language.” তার মানে বাংলাদেশ চিরদিনই শাস্ত্রগত সংস্কারমুক্ত।

কঠিন সাম্প্রদায়িকতার মুক্ততাই বাংলার বিশ্বদর্শনের মৌলিক সত্য।

আধুনিককালে পাশ্চাত্য বিশ্বে জাতিরাষ্ট্রের মৌল রাষ্ট্রনীতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে সেক্যুলারিজম। অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সে সেক্যুলারিজম, ভিন্ন আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য লাভ করে। রাজকীয় স্বৈরাচার এবং যাজক সম্প্রদায়ের অনাচারও ছিল তার মূলে। অন্যদিকে মধ্যযুগের ইউরোপের তিক্ত ধর্মীয় হানাহানি ও ধর্মযুদ্ধের (crusade) বিনাশী অভিজ্ঞতার মধ্য থেকেই রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছিল সুচিন্তাপ্রসূত এই সেক্যুলারিজম। তবে তার মূলে ছিল প্রাচীন গ্রিকদের চিন্তাধারার প্রভাব। গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগোরাস বলেছিলেন, ‘Man is the measure of all things’ – Protagoras. ফলে রেনেসাঁস ও আলোকায়ন, রাজনৈতিক গণতন্ত্রায়ন, শিল্পবিপ্লব, এই মতের প্রজনন জাতিরাষ্ট্রের ধর্মই হয়ে ওঠে – আমরা যাকে বলি, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা পাশ্চাত্য অভিধায় ‘সেক্যুলারিজম’। এই সেক্যুলারিজমের সৃষ্টিতে দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তক মিল, কোঁত, কান্ট, হেগেল, রুশো, ভলতেয়ারের অবদান বিরাট। তাঁদের প্রভাবে ইউরোপের ফরাসি দেশে, ইতালিতে এবং পরে পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি, আধুনিক গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি অপরিহার্য সত্তায় পরিণত হয়। ঠিক সেই অর্থে যুক্তরাজ্যে গণতন্ত্রের চরম বিকাশ ঘটলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে সেক্যুলারিজম সেখানে প্রাধিকার পায়নি। সেখানে রাজাকে বিশেষ ধর্মের হতে হয়, এবং রাজার ধর্মই হয় প্রজার ধর্ম ও রাষ্ট্রধর্ম। তাই বলা যায়, পাশ্চাত্যের নবজাগরণের প্রভাবে ঊনবিংশ শতকের ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু উচ্চবিত্তের প্রধানত খাজনাজীবী মানুষের সীমিত একটি অংশের মধ্যে নবচেতনার সূত্রপাত হয়েছিল। একে পাশ্চাত্য Renaissance শব্দে আখ্যাত যায় না। ওই রেনেসাঁসের পটভূমি বাংলা বা ভারতে ছিল না। মৌলিক প্রভেদ ছিল দুয়ে। বাংলা/ ভারত ছিল উপনিবেশ, ঔপনিবেশিক শাসকেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে শক্তপোক্ত সামন্ততন্ত্র কায়েম করেছিল বাংলায়। পাশ্চাত্যে সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ করে শিল্পবিপ্লব ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে আলোকায়ন যুগের (Age of Enlightenment) সৃষ্টি করা হয়েছিল। তবেই তা হয়েছিল রেনেসাঁস। অতএব বঙ্গীয় রেনেসাঁস অপনাম মাত্র (misnomer)। কতক শিক্ষিত, চিন্তাচেতনায় অগ্রসর বাঙালি মুসলমানের অবদানকে তারা গণ্য করেনি বা অবজ্ঞা করেছে। তাছাড়া তাদের নবজাগরণের প্রয়াস গ্রামবাংলার বিপুল বিশাল অঞ্চলকে স্পর্শ করেনি। গ্রামবাংলায় পাশ্চাত্য রেনেসাঁস-প্রভাবিত একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের তথাকথিত জাগরণের চেয়েও শক্তিশালী যে অসাম্প্রদায়িক তথা সমন্বিত সংস্কৃতি ও জীবনধারা বিশাল বাংলায় গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে ছিল গ্রামাঞ্চলের বাউল, বৈষ্ণব, সুফি সাধক, নাথযোগী, তান্ত্রিক, বৌদ্ধ-জৈনদের অবদান। তারাই আমাদের এই বঙ্গীয় বদ্বীপে পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণু এবং সহাবস্থানের নীতিতে অভ্যস্ত এক মানবিক বাঙালি জীবনদর্শন গড়ে তোলেন।

রাষ্ট্রপরিচালনায় বহু মত-পথ-গোত্র ও ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। ভারতবর্ষে শাসন করতে এসে মুসলিম শাসকরা এ-বিষয়টি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেই ইসলামি রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিবর্তে জাহানদারি অর্থাৎ ইহজাগতিক তথা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র শাসননীতির উদ্ভাবন করেন। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে বহু আগে থেকেই নানা ধর্মমতের সহাবস্থান থাকলেও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইহজাগতিক অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তক মুসলিম শাসকরাই। এ-বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় মুসলিম ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারানির ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে লেখা তিনখানা বইয়ে। বইগুলোর নাম : তারিখ-ই ফিরোজশাহী, ফতোয়া-ই জাহানদারি এবং শাফিয়া-ই-নাট-ই আহমদি। তারিখ-ই ফিরোজশাহীতে বারানি দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছেন : ‘আমার প্রভু ইলতুৎমিশ বলতেন যে, সুলতানের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস (দ্বীনদারি) মেনে রাষ্ট্রশাসন করা সম্ভব নয়; ধর্মবিশ্বাস রক্ষা (দ্বীনপানাহি) করতে পারাই তার জন্য যথেষ্ট।’ সুলতানের ঘোষিত আদর্শ ছিল ‘ন্যায়বিচার’। মধ্যযুগের ভারতে ন্যায়বিচারের অর্থ ছিল : ‘সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা অর্থাৎ ধর্মনির্বিশেষে সকলের অধিকার রক্ষা; সমাজ বা ধর্মসম্প্রদায়ের এক অংশ যেন অন্য অংশের ওপর আধিপত্য না করে এমন ব্যবস্থা।’ বারানি আলাউদ্দিন খলজির (১২৯৬-১৩১৬) মত উদ্ধৃত করে বলেন, ‘শরিয়তে কী লেখা আছে, তার পরোয়া না করে রাষ্ট্রের স্বার্থে যা করা উচিত বলে মনে করবেন, সুলতানের তাই করা উচিত।’ একেই বলা হয়েছে ‘জাহানদারি’ বা ইহজাগতিকতা অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা। রাজ্য বিস্তার, ভিন্ন ধর্মের জনগোষ্ঠীর সমর্থন লাভ ও শাসন পরিচালনার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া অন্য কোনো লাগসই বিকল্প তাঁরা খুঁজে পাননি। এমনকি রাজা ও প্রজা উভয়ই মুসলমান এমন দেশেও ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল অপরিহার্য রাষ্ট্রনীতি। উদাহরণ, মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ। ধর্মনিরপেক্ষতার ফলে সমাজ-সংস্কৃতি ও সভ্যতার অগ্রগতি আর শিল্প-সংস্কৃতির অপূর্ব বিকাশ ঘটে এবং ধর্মান্ধতা এমনকি আত্যন্তিক ধর্মপ্রবণতার ফলেও সামাজিক মানবিক সৌহার্দ্যরে বিপর্যয় ও সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটে থাকে।

আমাদের উপর্যুক্ত আলোচনার বক্তব্য আরো স্পষ্ট হবে বাংলায় সুলতানি আমলের ইতিহাসের দিকে তাকালে। দিল্লির মতো বাংলার সুলতানরাও ছিলেন বিদেশি, বিভাষী ও বিধর্মী। তবে তাঁরা শাসক হলেও শাসিতের দেশে নিজ ধর্মের প্রয়োগে জোরজুলুম ও জবরদস্তি করেননি, বরং বাংলা ও বাঙালিকে ভালোবেসে এদেশকে আপন করে নিয়েছিলেন। হোসেন শাহি আমলে বাংলায় এক নব ভাববিপ্লবেরই সূচনা হয়েছিল। একদিকে শ্রীচৈতন্য দেবের হিন্দুধর্মের গণমুখী সংস্কারমূলক ভক্তিবাদী আন্দোলন ও ধর্মীয় ছুৎমার্গমুক্ত মানবপন্থী সাধনধারা; অন্যদিকে মুসলিম মরমি সুফি-সাধকদের অধ্যাত্মচেতনাপ্রসূত মানবতাবাদ বাংলার সামাজিক জীবনে এনেছিল এক নবতর সাংস্কৃতিক উজ্জীবন। এই ভাব-আন্দোলনকেই পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বাংলার নবজাগরণ বলে আখ্যাত করা চলে। কারণ তখনই বাংলার স্বাধীন মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ভারতীয় ইতিহাস পুরাণ দর্শন ও ধ্রুপদী বিষয়াদির অনুবাদের মাধ্যমে এক নবযুগের সূত্রপাত ঘটে। সুলতানদের উদারতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ফলেই মহাভারত ও ভাগবৎ এই প্রথম সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনূদিত হয়। ভাগবৎ অনুবাদ করে মালাধর বসু সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহর কাছ থেকে ‘গুণরাজখান’ উপাধিতে ভূষিত হন।

সংস্কৃতি সমন্বয়ের এই নীতি সমন্বয়বাদী বাঙালি জাতিসত্তা গঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে।

শুধু তা-ই নয়, বহিরাগত এই মুসলিম সুলতানেরা বিকাশমান বাঙালি জাতি গঠনে যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন ইতিহাসনিষ্ঠ কোনো বাঙালির তা দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। এ-কথা বলাই বাহুল্য যে, এই জাতিগঠন প্রক্রিয়াটি নৃ-বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হতে শুরু করে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক রিচার্ড ইটন বলেন, “Our First indigenous reference to ‘Bengal’ appears in the mid fourteenth century, when the historian Shamsi Siraj Afif referred to Shams al-Din Ilyas Shah (1342-57) as the Sultan of the Bengalis’ and the ‘king of Benga” – বঙ্গের সুলতান বা রাজা (ফার্সি ভাষায় শাহে বাঙালিয়ান) হিসেবে। ইলিয়াস শাহী বংশ প্রকৃত প্রস্তাবে ইটনের ভাষায় : ‘In reality the emergence of the Independent Ilyas Shahi dynasty represented the political experssion of a long-present cultural autonomy.’ বাঙালি জাতি ও বাঙালিত্ব নিয়ে এক ধরনের গৌরব বোধ করেছেন সুলতানরা। পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের নবাবরাও বাঙালিদের দেশজ উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সুলতানদের প্রবর্তিত ধারাকে আরো গভীরতা দান করেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ও আলীবর্দী খাঁর বেড়াভাসান উৎসব, বাংলার নববর্ষে পুণ্যাহ উৎসবে যোগদান এর প্রমাণ বহন করে। অতএব, বঙ্গদেশে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি নির্মাণে মুসলিম শাসকদের অবদান দিকনির্দেশক।

দিল্লি ও বাংলার সুলতানদের এই প্রয়াসকে একটি গ্রহণযোগ্য ও চলমান ঐতিহাসিক ধারা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েই নেহেরু-মওলানা আজাদ স্বাধীন ভারতে এবং বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন ও তাঁদের সহযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত নবীন গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। উপমহাদেশের ইতিহাস জানতেন বলেই তাঁরা ওই প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেন। তবে নেহেরু ও মওলানা আজাদ শুধু মৌখিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল ভারতের কথা বলেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ড. আম্বেদকর ও তাঁর সহযোগীরা পাঁচ বছর ধরে যে-শাসনতন্ত্র রচনা করেন তার চৎবধসনষব-এ ঝবপঁষধৎরংস এবং ঝড়পরধষরংস ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের এগারো মাসের মাথায় যে-শাসনতন্ত্র (৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২) রচনা করেন তাতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্ভবত এটা দেখেই বাংলাদেশে শাসনতন্ত্রের চার বছর পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে শব্দ দুটি ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় (১৯৭৬)।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের বাংলার পাঠান সুলতান ও নবাবরা বাঙালির মানসপ্রবণতাকে খুব যথার্থভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই সেই স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো বিরূপ ধারণা বা অসূয়া পোষণ না করে বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্য-সংস্কৃতি-পুরাণ এবং বাঙালির আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এতে কেন্দ্রীয় শাসন থেকে দূরে থাকা প্রান্তিক বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ধারার বিকাশে একটি স্বকীয় ধারার সূত্রপাত ঘটে। ফলে বাংলার সুলতানি আমলের দুশো বছরে দেশীয় জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ নানা মত-পথ ও পন্থার বহুত্ববাদী (Pluralistic) সংস্কৃতিধারার মাধ্যমে শাস্ত্রীয় অনুশাসন ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদী নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঙালিকে দূরে রেখে এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টিতে সক্ষম হন। ‘The court also lent vigorous support to Bengali Language and literature. Already in the early fifteenth century, the chinese traveller Ma Huan observed that Bengali was the language in universal use.’ পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে রাজসভা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। সুলতান রুকনউদ্দীন বারবাক শাহ (১৪৫৯-৭৪), মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, এবং যথাক্রমে আলাউদ্দীন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) ও নাসিরউদ্দীন নূসরত শাহর (১৫১৯-১৫৩২) বিপ্রদাসের মনসা বিজয় এবং বিজয় গুপ্তের পদ্মাপুরাণ ও যশোরাজ খানের কৃষ্ণমহল ও পরমেশ্বরের সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করা আংশিক ধ্রুপদী মহাকাব্য মহাভারতে প্রকাশিত হয়। এভাবেই সুলতানরা বাংলা মিডিয়ার মাধ্যমে তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এটা সম্ভব হয় দিল্লি থেকে বাংলার দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কারণে যেমন, তেমনি রাজা গণেশের অভ্যুদয়ের কারণেও।

ইতিহাসের প্রাক-আধুনিক যুগে বাংলার মানুষের এই মানসিক, সামাজিক পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বণিক পুঁজির উদ্গম লক্ষ করি তার সুপ্ত আকাক্সক্ষায় থাকে শাসন ক্ষমতায় তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ব। সেটি সম্ভব রাষ্ট্রগঠনের মধ্যে। সে-উদ্যোগের প্রাথমিক রূপ চোখে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্র গঠনের একটি প্রয়াসের মাধ্যমে। একজন ভাষ্যকার বলেছেন : ‘অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের উপর সুবায় সুবায় নূতন রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিয়াছিল। লক্ষ করলে এইসব রাষ্ট্রে একটি সম্পূর্ণ নূতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব চোখে পড়ে। যুরোপে নূতন বাণিজ্য পথ আবিষ্কারের সঙ্গে এই শ্রেণীর প্রথম সূত্রপাত; অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের কৃপায় এই শ্রেণীটি ইতিমধ্যেই বিশেষ অর্থবান হইয়া উঠিয়াছিল। ইহাদিগকে কেন্দ্র করিয়া নূতন নূতন শহর বন্দর গড়িয়া উঠিল। গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে নিপুণ কারিগর শ্রেণী ও অনিপুণ মজুরের দল সুরাট, হুগলি, সুতানটি ও মুর্শিদাবাদে ভিড় জমাইল। বাংলাদেশে পলাশী যুদ্ধের সমকালে এই শ্রেণীর রূপটি খুব স্পষ্টভাবে নজরে পড়ে। মুঘল সামন্ততন্ত্রের ইতিহাসে যাহা কখনো পড়ে নাই – এই সময় তাহা দেখা যায়। দেখা যায় সামন্ততন্ত্রের কাঠামোর মধ্য হইতে একটি সম্পূর্ণ নূতন শ্রেণী বাড়িয়া উঠিয়াছে। বিলক্ষণ শক্তি সঞ্চয় করিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিনাইয়া নেওয়ার জন্য ‘হাতের লোক’ খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাংকার জগৎ শেঠ, বণিকরাজ উমিচাঁদ, নিমকের একচেটিয়া কারবারী খোজা বাজিদ, ইংরেজ কুঠির সঙ্গে গোপন কারবারে প্রভূত বিত্তশালী ঢাকার ডেপুটি দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ এই নূতন শ্রেণীর প্রতিনিধি। উল্লেখযোগ্য যে, ইহাদের একজন জৈন, একজন নানকপন্থী, একজন মুসলমান, অপরজন বাঙালি হিন্দু অর্থাৎ ইহাদের ঐক্যের ভিত্তি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক। ইহারা আবার বণিক পুঁজির (Mercantile Capital) প্রতিনিধি। আর এই পুঁজিই সর্বদেশে ধনতন্ত্রের অগ্রদূত। এই শ্রেণীর দ্বারা এদেশেও হয়তো বুর্জোয়া বিপ্লবের ভূমিকা রচিত হইত। কিন্তু হইতে পারিল না।

‘দেশের মধ্যে সমাজের এই অর্ধবিবর্তিত অর্থনৈতিক শক্তিটির সে সময় ঘুণে ধরা সামন্ততান্ত্রিক শক্তির দ্যূত ক্রীড়া চলিতে ছিল – আমাদের অপার দুর্ভাগ্য যে ঠিক সেই সময় অপর দেশের একটি পূর্ণবিবর্তিত অর্থনৈতিক শক্তি উভয়ের ঘাড়ে ঝাঁপাইয়া পড়িল। এই শক্তিটি ব্রিটিশ বণিকতন্ত্র। বণিকতন্ত্রের একটি মাত্র আঘাতে ঘুণেধরা সামন্ততন্ত্রের কাঠামো পলাশীর মাঠে খান খান হইয়া ভাঙিয়া পড়িল। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিল না। ব্রিটিশ বণিকরাজ বাংলায় সামন্তরাজকে উচ্ছেদ করিল, কিন্তু নিজের গরজে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আপোস করিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাপনাকে দেশে জিয়াইয়া রাখিল। লাভের মধ্যে ভারতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে শুভ লগ্ন ঘনাইয়া আসিতেছিল, তাহা চিরতরে ভ্রষ্ট হইয়া গেল।’

ইংরেজ শাসকরা ভারতের হিন্দু আর মুসলমানের ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে শাসন করার লক্ষ্যে Divide and Rule Polic

চালু করে। এভাবেই তারা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর ভারতবর্ষে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ করে দেয়। তারই বিষময় ফল, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে ভাগ করে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৬-এ ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় বিপুল নিরীহ মানুষের প্রাণহানি, অগণন মানুষের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশ ত্যাগ ও দুঃসহ বাস্তুহারা জীবনগ্রহণ। বাংলার সাধারণ মানুষের মানবপন্থি সাধনা, দিল্লির সুলতানদের রাষ্ট্রনৈতিক দর্শন তথা ইহজাগতিকতা এবং বাংলার সুলতানদের সমন্বিত জীবনবাদী ধারা পরিত্যাগ করে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব গ্রহণ করায় এই বিশাল মানবিক বিপর্যয় ঘটে।

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে পূর্ব বাংলা এবং বর্তমান পাকিস্তান ভূখণ্ড নিয়ে দুই পাকিস্তান (two Independent states) ভিত্তিক আন্দোলনে অংশ নিলেও জিন্নাহর কূটকৌশলে ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হয় অপরাষ্ট্র এক পাকিস্তান। শুধু তাই নয় জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন : ‘Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan’ (২১ মার্চ)। এই কর্তৃত্ববাদী ঘোষণায় পূর্ব বাংলার বাঙালি বুঝতে পারে তারা প্রতারিত হয়েছে। এখন তারা শোষণ-নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের শিকার। তাই ’৪৮ সালেই পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু করে নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তাভিত্তিক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। তরুণ নেতা শেখ মুজিবসহ যুবনেতারা এ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সে-আন্দোলনে বাঙালির সংস্কৃতি ও রাজনীতি একাত্ম হয়ে যায়। ফলে বাংলা ভাষা ও বাঙালির স্বকীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনদর্শন এবং ভূ-প্রকৃতিভিত্তিক জাতিসত্তা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। তখনই প্রকৃত ধার্মিক, বিবেকবান ও ইতিহাসনিষ্ঠ শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতিসত্তার স্বরূপটি নির্ধারণ করে দেন এই ভাষায় : ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন দাগ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে তা ঢাকবার জোটি নেই।’ একই ভাষণে তিনি বলেছেন : ‘আমরা বাংলার হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান এক মিলিত জাতি, আমাদের বাংলা ভাষাও তেমনি এক মিশ্রিত ভাষা।’১০

প্রখ্যাত পণ্ডিত, ধর্মবেত্তা ও দূরদর্শী জাতিতাত্ত্বিক উপর্যুক্ত তাত্ত্বিক সূত্র ধরে নিজেই সংস্কৃতি ক্ষেত্র থেকে বাঙালি জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলন শুরু করেন এই ভাষায় : ‘We educationist should however, emphatically protest, and if necessary should revolt against the fresh imposition of any language other than Bengali as the medium of instruction for East Bengali Students. This imposition will be tantamount to the genocide of East Bengalees.’ (কুমিল্লা শিক্ষক সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ ১৯৫১) ড. শহীদুল্লাহর এই বিপ্লবী দিকনির্দেশক চিন্তাধারাকে মূলসূত্র হিসেবে গ্রহণ করে পূর্ব বাংলার নবপ্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের সক্রিয়বাদীরা (cultural activists) বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৮ ও ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলনের সাংস্কৃতিক পাটাতনের ভিত্তিমূলের ওপর নবধারার ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামের সূত্রপাত। এরই ধারাবাহিকতায় ২৩ বছর ধরে চলে ধর্ম ও সামরিক আমলাতান্ত্রিক পাকিস্তানি অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসন। এই উপনিবেশবিরোধী১১, সামরিক শাসনবিরোধী পূর্ব বাংলার বাঙালির জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চলে ১৯৬০ থেকে বাঙালির জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। ১৯৬১ সালে তিনি ছাত্রলীগের চার শীর্ষ নেতার নেতৃত্বে গঠন করেন স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস। ১৯৬২-এ দেশ ও কৃষ্টি শীর্ষক পাঠ্যবইয়ে বাঙালি জাতিসত্তাবিরোধী তথ্য অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে তাঁর ৬ দফাভিত্তিক পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার কৌশলময় উপস্থাপনা বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামকে গুণগত রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্তরে উন্নীত করে। এই পর্ব থেকেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত জাতীয় নেতায় পরিণত হন শেখ মুজিবুর রহমান।

দুই

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনধারাকে বোঝার জন্য উপর্যুক্ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ছাড়াও সমকালীন আর কোন কোন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উপাদানের রসায়নে তাঁর মানস গঠিত হয়েছিল সে-বিষয়ে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। শেখ মুজিব বেড়ে উঠেছিলেন টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীণ জীবনপ্রবাহের মধ্যে। নদীনালা, নিসর্গ, দুঃখদৈন্যপীড়িত মানুষ, আর নিস্তরঙ্গ সামাজিক জীবনই ছিল তখনকার টুঙ্গিপাড়ার বৈশিষ্ট্য। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গোপালগঞ্জে। পরে পিতার চাকরির বদলির কারণে চলে যেতে হয় মাদারীপুরে।

১৯৩৭-এ পিতার চাকরিতে পুনরায় বদলির সুবাদে শেখ মুজিবুর রহমান মাদারীপুর থেকে চলে আসেন। গোপালগঞ্জে ফিরে এসে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন সেখানকার মিশন হাই স্কুলে। সে-সময়ে তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের স্থানীয় সক্রিয়বাদী নেতা হামিদ মাস্টার। তিনি ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে অনেক বছর কারা-যন্ত্রণা ভোগ করেন। শেখ মুজিবের মাদারীপুর (১৯৩৪) এবং গোপালগঞ্জ (১৯৩৮-৩৯) দুই স্কুলজীবনই তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে হয়। মাদারীপুরে তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষায় (Indoctrination) নেতাজি বসু ও স্বদেশি আন্দোলনের স্থানীয় নেতা অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাস এবং অন্যদের প্রভাব পড়ে। আর গোপালগঞ্জে হামিদ মাস্টারের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শ সে-প্রভাবকে আরো গভীরতা দান করে।

সে সময়ে মাদারীপুরের বিখ্যাত স্বদেশি নেতা ছিলেন অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাস। ইংরেজ সরকার এই বিপ্লবী নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। তিনি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ শীর্ষক একটি কবিতায় তাঁকে মাদারীপুরের ‘মর্দ বীর’ বলে অভিহিত করেন।

কিশোর শেখ মুজিবের জীবনে এ-ঘটনা দুভাবে প্রভাব ফেলেছিল বলে মনে হয়। এক, তাঁর এলাকার বীর নায়ক পূর্ণচন্দ্রের বিপ্লবী জীবন তাঁর মধ্যে এক লোকাল প্রাইডের সৃষ্টি করেছিল; দুই, তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে কবিতা লিখেছিলেন তখনকার বিদ্রোহী তরুণদের আইডল কবি-বিদ্রোহী নজরুল। এই ঘটনাই, কিশোর মুজিবকে উদ্দীপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এতেই শেষ না, সেই কবিতায়ই ছিল পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়ের এক বীজমন্ত্র ‘জয় বাংলা’ (ভাঙ্গার গান, ১৯২৪) শব্দের ব্যবহার। কিশোর মুজিবের মনের গহিনে কি সেই সময় থেকে সোচ্চার উচ্চারণে যথাসময়ে প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়েছিল নজরুলের সেই অমোঘ শব্দযুগল?   নজরুলেরই ওই সময়ের অন্য কবিতায় ব্যবহৃত বাংলাদেশ শব্দটিও কি চিরকালের জন্য তাঁর অন্তরে মুদ্রিত হয়ে গিয়েছিল? আমরা তাই-ই মনে করি। কারণ বাল্যকাল থেকেই নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠ এবং পরবর্তীকালে ১৯৪০ সালে নজরুল, হুমায়ুন কবিরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের নিয়ে ফরিদপুরে ছাত্র সম্মেলন করায় আমাদের মনে এই ধারণা পোক্ত হয়।

মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে বিপ্লবী রাজনীতির ধারায় কিশোর মুজিবের প্রণোদিত হওয়ার পর ১৯৩৮ সালে তাঁর জীবনে আর একটা দিকে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ওই বছরে গোপালগঞ্জে সফরে যান বাংলার হক-লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক ও তাঁর বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী এবং জনপ্রিয় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই সফরে শেখ মুজিবের সাহস ও সপ্রতিভতার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী সম্ভাবনাময় এক নতুন রাজনৈতিক প্রতিভার সন্ধান পান।

নেতৃত্বগুণ ও সংগঠন-প্রতিভাবান এই তরুণকে তিনি বাংলায় মুসলিম লীগ গড়ে তোলা এবং পাকিস্তান আন্দোলনে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে তাঁর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪০-৪১ সালের মধ্যেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরুতে (master) পরিণত হন।                 

সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণের পর শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে তিনি বাংলার মুসলিম ছাত্রলীগকে সক্রিয় ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তরুণ মুজিব মুসলিম লীগ প্রভাবিত বাংলার মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে নতুন করে বিন্যস্ত করতে প্রয়াস পান। রাজনীতিকে আরো মানবিক ও বহুতলস্পর্শী করার জন্য তিনি সংস্কৃতির সঙ্গে এর সমন্বয় সাধন করেন। যেমনটি একটু আগে বলেছি, ১৯৪০ সালে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রলীগের এক আলোচনাসভায় তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ-সাহিত্যিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা হুমায়ুন কবির এবং তখনকার খ্যাতনামা অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁকে আমন্ত্রণ জানান। ফরিদপুরের মুসলিম রক্ষণশীল লীগ নেতারা এতে বাধার সৃষ্টি করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান নতিস্বীকার না করে আমন্ত্রিত অতিথি কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং হুমায়ুন কবিরকে নিয়ে আলোচনাসভাটি সম্পন্ন করেন। রক্ষণশীল অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ এ-সভায় আসেননি এবং মুসলিম লীগ ফরিদপুর শহরে তাদের এ-সভা করতে দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে হুমায়ুন কবিরের ফরিদপুরের বাড়িতে এ-আলোচনাসভা করতে হয়। অতএব, বাঙালি মুসলমানের তৎকালীন প্রবণতা অনুযায়ী মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও শেখ মুজিব যে অসাম্প্রায়িক বাঙালি জাতিসত্তার রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ হারাননি – এই ঘটনা তারই প্রমাণ। পরবর্তীকালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি যখন পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন তখন বাংলার মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিমের রাজনৈতিক ক্লাসে যোগ দিয়ে তাঁর তৈরি করা প্রগতিশীল পার্টি-ঘোষণাপত্র এবং আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বামঘেঁষা জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা লাভ করেন। উল্লেখ্য, এ-সময় তরুণ কর্মীদের অসাম্প্রায়িক গণচেতনা এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে মিল্লাত নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদ সাময়িকী প্রকাশ করা হয়। পত্রিকাটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রগতিশীল মতামতের জন্য বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং উদারতাবাদী হিন্দুদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে-পত্রিকা বিক্রি করতেন। তখনকার বাংলার মুসলিম লীগের নবাব, নাইট, জমিদারদের এলিট রাজনীতির বিপরীতে তৃণমূল ও প্রান্তিক মানুষের রাজনীতির নতুন নেতার আবির্ভাবের এভাবেই সূত্রপাত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলার মুসলিম লীগের পাকিস্তান-পূর্বকালের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের অনুসারী শামসুল হক-শেখ মুজিব সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল গ্রুপটি আধিপত্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক গ্রুপের শুধু উপেক্ষা নয়, তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। ফলে তাঁরা বাধ্য হয়ে নতুন বিরোধী দল হিসেবে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে তোলেন (১৯৪৯)। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের দুই অংশের ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্মকে রাষ্ট্রের মূলভিত্তি করার কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের পরিকল্পনা, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না করে পূর্ব বাংলাকে পঙ্গু করার চক্রান্ত, ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে টালবাহানার আশ্রয়গ্রহণ, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিপীড়ন এবং বঞ্চনা ও তীব্র অর্থনৈতিক শোষণে পূর্ব বাংলার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তরুণ বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭-৪৮ সালের মধ্যেই বিষয়টি উপলব্ধি করেন। এ-বিষয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগে’র কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে (১৯৭৫) তিনি বলেন : ‘আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে।’ এ-বিষয়ে তিনি আরো বিশদভাবে বলেছেন ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে। তাঁর সে-বক্তব্য নিম্নরূপ : ‘১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হল। সেই দিন বুঝতে বাকি রইল না যে, বাংলাদেশকে উপনিবেশ করার জন্য, বাংলার মানুষকে শোষণ করে গোলামে পরিণত করার জন্য তথাকথিত স্বাধীনতা এসেছে। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৪৭ সালে কলকাতার পার্ক রোডের সিরাজউদদৌলা হোস্টেলে এক ঘরোয়া বৈঠক করি। … কলকাতা থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় এলাম। ঢাকায় এসে রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, বাঙালি শেষ হয়ে গেছে। সেই দিন শপথ নিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ১৯৪৭ সালেই হল আমাদের সংগ্রামের সূচনা।’

১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলন পূর্ব বাংলার বাঙালির নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা গঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে সবচেয়ে মৌলিক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। আর এই আন্দোলনই ধীরে ধীরে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধু বলেছেন : ‘১৯৪৮ সালের পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানল …। আমরা ভাষার ওপরে এ আঘাত সহ্য করতে পারলাম না। তারই ফলশ্রুতিতে আটচল্লিশ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম হয়। ১১ মার্চ তারিখে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আমরা আন্দোলন শুরু করি। … অন্য কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে একযোগে আমরা শোষকগোষ্ঠীর আঘাতের মোকাবিলা করি।’ ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন : ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আমাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, আমাদের মাতৃভাষার ওপর ও আমার দেশের ওপর যে আঘাত হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মোকাবিলা করতে হবে। সেখানে গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়। … কথা হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি আমি জেলের মধ্যে অনশন-ধর্মঘট করব, আর ২১ তারিখে আন্দোলন শুরু হবে।’

‘বাঙালিত্ব’, ‘বাংলাভাষা’ আর ‘বাংলাদেশ’কে বঙ্গবন্ধু একাত্ম করে দেখতেন। বাংলায় অগণিত জীবনবিনাশী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিক্ত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তিনি বাঙালি জাতির মৌলিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ওই তিনটি সত্তার সুদৃঢ় একাত্মতাকে অপরিহার্য বিবেচনা করেই বলেছিলেন : ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’১২ বঙ্গবন্ধুর উপর্যুক্ত উক্তির মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জনের জীবনপণ সংগ্রামের ইতিহাস নিহিত আছে। অর্থাৎ আমাদের এই ভূখণ্ডের সকল মানুষের মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিভিত্তিক সুদৃঢ় ঐক্য ও রাষ্ট্রনৈতিক বাঙালি জাতি গঠন ও আর্থ-সামাজিক স্বদেশপ্রেমের মধ্যেই নিশ্ছিদ্র সাংস্কৃতিক অগ্রগতির উৎসমুখ খুলে যায়। বাংলার ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আন্তরিক ও মুক্তমনে একটি প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক বাঙালি রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

শেখ মুজিবের সে অনন্য ইতিহাস রচনার কিছু বিশদ বিবরণ এক্ষেত্রে আবশ্যিক। তরুণপ্রাণের আত্মবলিদানের বিনিময়ে ভাষার যুদ্ধে জিতে বাঙালি তার স্বাধীনতা ও ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের মূলপথে এসে দাঁড়ায়। সে-সংগ্রামে মুজিব ছিলেন সক্রিয়বাদী। এর পরবর্তী ধাপের রণসজ্জায়ও মূলনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। লন্ডনের দি অবজারভার পত্রিকায় ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৮ মার্চ যা লেখা হয় তার বঙ্গানুবাদ এ-রকম : ‘১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভার নেপথ্য নায়ক এবং মূল চালিকাশক্তি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর তিন বছর পর পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে গৃহীত আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনার পিছনেও শেখ মুজিবই ছিলেন নেপথ্য নায়ক। ওই জনসভা এবং প্রাদেশিক পরিষদের প্রস্তাবনায় সংক্ষিপ্তভাবে পূর্ববাংলার প্রায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়।’১৩

১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস-বিজয়ে শেখ মুজিব জনগণের মুড কী তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তমূলক খেলারও যে এক ধরনের বিজয় ঘটেছিল তাও তিনি উপলব্ধি করেন। তাই তিনি যুক্তফ্রন্ট করার বিরোধী ছিলেন। কারণ মুসলিম লীগের বাতিল, বিতাড়িত এবং চক্রান্তকারী কিছু লোক এবং নেজামে ইসলামকে নিয়ে তিন দলের যুক্তফ্রন্ট করা পূর্ব বাংলার মূল আন্দোলনকে পিছিয়ে দেবে বলে তিনি ধারণা করেছিলেন।১৪ বাস্তবেও তাই ঘটেছিল। এই যুক্তফ্রন্টের নানা গ্রুপকে নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নানা চক্রান্তের খেলা শুরু করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও তাঁর পরবর্তী শাসকেরা স্বাধীনতা পূর্বকালীন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে পূর্ব বাংলা যে-পশ্চাতভূমিপ্রতিম (Hinterland) অবস্থায় পড়েছিল পাকিস্তান আমলের নতুন ঔপনিবেশিক১৫ শাসনের কবলেও একই অবস্থা হয় পূর্ব বাংলার। সেজন্যেই এই নতুন উপনিবেশ থেকে মুক্তি অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষাটি প্রথমেই জাগ্রত হয় শেখ মুজিবের মনে। খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-চিন্তা ও বাস্তবায়ন-কৌশলের একটা ধারাবাহিকতার ইতিহাস পাওয়া যায়। কৈশোর ও যৌবনের উন্মেষকালে বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সংযোগ এবং পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দীর কাছে শেখা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে তিনি আজকের রাজনীতির পরিভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যে-রোডম্যাপ তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করেন সে-সাফল্যকাহিনি নজিরবিহীন। ইতিপূর্বে আমরা তার কিছু অংশের বয়ান উপস্থিত করেছি। সে-অংশে শেখ সাহেবের কৃতিত্ব একক নয় – সমবেত। কিন্তু ১৯৫০-এর দশকের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর বাংলার স্বাধীনতা-চিন্তা আরো তীক্ষ্ণ, স্বচ্ছ এবং সহজে চিনে নেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠেছে।

আমরা এবার তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়োপযোগী, কৌশলময় ও সাহসী কার্যক্রমের ধারাবাহিক বিবরণ উপস্থাপন করবো। তিনি নিজে এ-সম্পর্কে বলেছেন : ‘আমি জাম্প করার মানুষ নই। আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭-৪৮ সালে। কিন্তু আমি স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছি। আমি ইম্পেসেন্ট হই না। আমি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট নই।’১৬ এবার আমরা তাঁর ‘স্টেপ বাই স্টেপ’ স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়সমূহ অনুসন্ধান করে দেখব :

এক. ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য দলের নাম থেকে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন এবং মুক্তনির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করে দলটিকে ভিন্ন আঙ্গিকে বিন্যস্ত করে বাঙালির জাতিসত্তাগত রণনীতি (ঝঃৎধঃবমু) গ্রহণ করেন। তার কিছু অংশ প্রকাশ্য ও যুক্তিসিদ্ধ যথা –

এক. সংসদীয় সংগ্রাম : পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি বলেন :

১. বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রসঙ্গে : ‘It is a very serious matter for us and here nobody can force us not to speak in our own mother tongue. I will here and now, speak in Bengali and nobody can prevent me from doing that.’ (21st September 1955)

২. বাঙালিত্ব প্রসঙ্গে : ‘We would like to be called ourselves as Bengali.’ (21st September 1955)

৩. বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও তার ঐতিহ্য প্রসঙ্গে : The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. (25st August 1955)

৪. পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও বাঙালিদের অধিকার প্রসঙ্গে তিনি বারবার সোচ্চার কণ্ঠে বক্তব্য পেশ করেছেন। করাচিকে এক ইউনিটভুক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করলে ঢাকাকে পাকিস্তানের রাজধানী করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন। কারণ বাংলার পাটের টাকায় করাচিকে রাজধানী শহরের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।

৫. সর্বশেষে বঙ্গবন্ধু ১৯৬১-৬৬-র মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সুস্পষ্ট পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠন। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে যে ৬ দফা প্রদান করেন তা ছিল স্বাধীনতারই কৌশলময় কর্মসূচি। সেটা বুঝেই আইয়ুব খান তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বাংলার মানুষ তাঁকে মুক্ত করে এনেছিল ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে, ভূষিত করেছিল বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতলেও তাঁকে ক্ষমতা না দিয়ে ’৭১-এ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা গণহত্যা চালিয়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে বা পাকিস্তানে নিয়ে গোপন প্রহসনের বিচারে হত্যা করে বাঙালিদের চিরতরে পদানত করে রাখতে চেয়েছিল। বীর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে তাদের সে-স্বপ্নসাধ ব্যর্থ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধু আমাদের উপমহাদেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে যে এক ঐতিহাসিক মৌলিক মানবপন্থি ধারায় বিন্যস্ত করতে চেয়েছিলেন তার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করার মতো দু-একটি উদাহরণ পেশ করছি : “১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে ঢাকার এক সুধী সমাবেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অন্যতম রাষ্ট্রনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার পটভূমি হিসেবে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের মূলব্যাধি চিহ্নিত এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেন : ‘উপমহাদেশের গত কয়েক যুগের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য ও দুর্ভাগ্যের মূল কারণ সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতায় রূপ দেওয়া হয়েছে। এটা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফল। আগে যা ছিল সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে হানাহানি এখন তাই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে হানাহানির রূপ ধারণ করেছে। ভারত বিরোধিতা এই রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার একটা ছদ্ম আবরণ। কয়েক শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং অভিশপ্ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ হিসেবেই স্বাধীন জাতীয়তাবাদী এবং ধর্ম-নিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়। আমরা যদি সকল প্রতিকূলতার মধ্যে সেক্যুলার বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারি, তাহলে এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সফল হবে’।”

১৯৭২ সালেই ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সৈয়দ মুজতবা আলী ও সন্তোষকুমার ঘোষ। সাক্ষাতের সূচনা বক্তব্যে বলেন : ‘উপমহাদেশের এই সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে তার পূর্বাঞ্চলে ধর্মীয় জাতীয়তা দুটিতে বিভক্ত – বাংলার পূর্বাংশের সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তার বিকাশ এবং তার ভিত্তিতে মুজিব নেতৃত্বের অভ্যুদয় দক্ষিণ এশিয়ার এ-অঞ্চলের বিস্ময়।’ সন্তোষকুমার ঘোষ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন : ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজমকে তিনি কী চোখে দেখেন? এই জাতীয়তাকে কি তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সম্পূরক, না বিরোধী বলে ভাবেন?’ বঙ্গবন্ধু জবাব দেন : ‘সেক্যুলার ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপূরক, যেমন ইউরোপের প্রতিটি দেশের মানুষ নিজেদের ইউরোপিয়ান মহাজাতির অন্তর্ভুক্ত বলে ভাবেন। আবার তাদের স্বতন্ত্র জাতীয়তা আছে এবং এই জাতি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নিজ নিজ স্বার্থে যুদ্ধবিগ্রহও হয়। সন্ধি ও শান্তি চুক্তি হয়। সহযোগিতাও থাকে।’ এরপর সৈয়দ মুজতবা আলী জিজ্ঞেস করেন, ‘শেখ সাহেব, আপনার কথা শুনে মনে হয় আপনি বর্তমান ভারতীয় জাতীয়তাকে পুরোপুরি সেক্যুলার মনে করেন না।’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন : ‘না, তা মনে করি না। গান্ধী, জিন্নাহ দুজনেই ‘মডার্ন লিডার’ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের রাজনীতি সেক্যুলার ছিল না। নেহেরু চেষ্টা করেছিলেন ‘সেক্যুলার ইন্ডিয়া’ গড়তে। পুরোপুরি সফল হননি। গান্ধী-জিন্নাহর রাজনীতি দ্বারা উপমহাদেশ এখনো প্রভাবিত। আমরা বাঙালিরা চাচ্ছি সেই বৃত্ত ভাঙতে। পারব কি না জানি না।’ এ পর্যায়ে মুজতবা আলী বলেন : ‘আপনাদের বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি কি কেবল ভূগোল আর ভাষা?’ বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে বলেছিলেন : ‘না, কেবল ভূগোল আর ভাষা হলে তো আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বিহার-উড়িষ্যার অংশবিশেষ দাবি করতাম। সে দাবি আমি করছি না। আমাদের বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি বাংলার সকল ধর্মের, সকল বর্গের মানুষের হাজার বছরের মিলিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির যেমন ছাপ আবহ তেমনি আছে মুসলমানদের সভ্যতা সংস্কৃতির মিশ্রণ। বর্তমান ভারত একটি ‘পলিটিক্যাল ইউনিয়ন’। আর আমরা একটি কালচারাল নেশন। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আমরা বাঙালি। বহুকাল আমাদের একটি নেশন স্টেট ছিল না। সেটি এখন পেয়েছি। সেটি যদি তার সেক্যুলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারি, তাহলে বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বে একটি আধুনিক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেই।’

তথ্যনির্দেশ

১.        ড. সুকুমার সেন : ‘বঙ্গ নামটির অর্থ লইয়া পণ্ডিতেরা আলোচনা করিয়াছেন। কেহ কেহ মনে করেন, নামটির মূলে ছিল চীন-তিব্বতি গোষ্ঠীর কোনো শব্দ। … আড়াই তিন হাজার বছর আগে বাঙ্গালা দেশের বেশির ভাগই জলাভূমি ও জঙ্গল ছিল।’

২.   D.D. Kosamabi, ‘The Basis of Ancient Indian History’ (Journal of the American Oriental Society-75, pp 1, 1955).

৩.   The Rise of Islam and the Bengal Frontier (1204-1760), Richard M Eaton, Oxford University Press, 1994, p 71.

৪.   Ibid, p 41.

৫.   Ibid, p 41..

৬.       পরাধীন রাজ্যের যে দুর্দশা ঘটে, স্বাধীন পাঠানদিগের রাজ্যে বাঙ্গালীর সে দুর্দশা ঘটে নাই। … পাঠান শাসনকালে বাঙ্গালীর মানসিক দীপ্তি অধিকতর উজ্জ্বল হইয়াছিল॥ বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠ কবিদ্বয় এই সময়েই আবির্ভূত, … এই সময়েই চৈতন্যদেব; চৈতন্যদেবের পরগামী অপূর্ব বৈষ্ণব সাহিত্য। পঞ্চদশ ও ষোড়শ খ্রিষ্ট শতাব্দীর মধ্যেই ইহাদিগগের সকলেরই আবির্ভাব। এই দুই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর মানসিক জ্যোতিতে বাঙ্গালার যেরূপ মুখোজ্জ্বল হইয়াছিল, সেরূপ তৎপূর্বে বা তৎপরে আর কখনো হয় নাই।’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, বঙ্কিম রচনাবলী ২য় খণ্ড, পৃ ৩৮৭, সম্পাদক যোগেশচন্দ্র পাল)।

৭.       Ibid, p 41..

৮.       Ibid, p 41.

৯.       ‘ন্যাশনালিজমের দুর্গতি’ (প্রবন্ধ), ফণীন্দ্রনাথ রায়, ৯ই আগস্ট সংকলনগ্রন্থ, সোসিয়ালিস্ট যুব ক্রাস্ট, কলকাতা, ১৯৪৭।

১০.      পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কার্জন হল সভাপতির ভাষণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৮।

১১.      ১০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ।

১২. ‘It is an anti-colonial movement in every major sense except in not being directed against a European power. We have traditionally come to see anti-colonialism as a matter of brown people rising up against their domination and exploitation by white people. But Korean nationalism, which was directed against the Japanese, was anti-colonial too so why should we not see the Bangladesh case in this framework?’ – Herbert Faith, Professor of Politics at Manash University, Melbourne, Australia Flinders Asian Studies lecture, September 14, 1971 at Liberation War Museum, Bangladesh. The Flinders University of South Australia.’

১৩.      মানিকগঞ্জ নিবাসী অধ্যাপক আদালত খান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একমাত্র বাঙালি মুসলমান মুন্সি। হুগলির মিরজা দিলাওয়ার হোসেন আহমদ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি মুসলমান গ্র্যাজুয়েট)। তাঁর ইংরেজি লেখালেখি ছিল সমাজ সংস্কারমূলক বৈপ্লবিক ধ্যান-ধারণাসমৃদ্ধ। আল হেদাদ খান শিক্ষাবিদ, যিনি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা তদানীন্তন সহ-কমিশনারের সঙ্গে মিলিতভাবে সর্বজনীন সাধারণ শিক্ষা বিস্তারে বাংলা মাধ্যম টোল ও মাদ্রাসার পরিবর্তে স্কুল খুলেছিলেন। বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষার স্কুল আর এ-স্কুল যেন ছিল পরিপূরক। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ আল ওবেদী (রামমোহন রায়ের তুহফাৎ উল মুয়াহেদিনের অনুবাদক), আবদুর রহিম দাহরি – এঁদের কথা না থাকায় ওই রেনেসাঁসে হিন্দু বাঙালি উচ্চবিত্তের জাগরণ হয়েছে মাত্র। রেনেসাঁস শুধু বিশেষ কোনো ধর্মবাদীদের জন্য হয় না।

১৪. উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের পাঁচ বছর ধরে তৈরি করা সংবিধানের প্রিয়েম্বেলে (Preamble) ড. আম্বেদকর ও অন্য সদস্যরা তাতে ‘সেক্যুলারিজম’ ও ‘সোশিয়ালিজম’ যুক্ত করেননি। বাংলাদেশ সংবিধানে ১৯৭২-এ এই দুটি রাষ্ট্রনীতি হিসেবে আছে। তবে ১৯৭৬ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে সেক্যুলারিজম ও সোশিয়ালিজমে অন্তর্ভুক্ত হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শাসন আমলে, বাংলাদেশের সংবিধানের চার বছর পর।

১৫,      ব্রিটিশ সাংবাদিক ডান সিরিল। ১৬.      দৈনিক যুগান্তর (কলকাতা), ২৯ নভেম্বর ১৯৭২।