শামসুজ্জামান খান : বাংলাদেশের আধুনিক ফোকলোরের রূপকার

আমিনুর রহমান সুলতান

বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চার গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বা যুগসৃষ্টির সময় বা বাংলাদেশের আধুনিক ফোকলোরচর্চার সংযোগ সেতুটির সময়কাল বলা যায় বিশ শতকের আশির দশকের মধ্য সময় থেকে। সংযোগ সেতুটি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রয়েছে লোকবিজ্ঞানী শামসুজ্জামান খানের। তবে এর আগেও যে আধুনিক ফোকলোরচর্চা বাংলাদেশে হয়নি এমন নয়। মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, মযহারুল ইসলাম, আবদুল হাফিজের নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু আধুনিক ফোকলোরের রূপকারের দায়িত্ব পালন করেছেন শামসুজ্জামান খান। তিনি অবশ্য সাহিত্যের প্রবন্ধ ও গবেষণায় ততদিনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছিলেন মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যসৃষ্টির নতুন ভাবনা সৃজনে। বাংলা একাডেমিতে চাকরিসূত্রে সংস্কৃতি বিভাগ থেকে অবহেলিত ফোকলোর বিভাগে বদলিসূত্রে ফোকলোরচর্চায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ১৪২৮ সনের ১লা বৈশাখ/ ২০২১ সালের ১৪ই এপ্রিল মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্ব পর্যন্ত তিনি আধুনিক ফোকলোরচর্চায় নিজেকে বিশিষ্ট এবং আধুনিক ফোকলোরচর্চার পথিকৃতের স্থানে অধিষ্ঠিত করতে সামর্থ্য অর্জন করেছেন। আধুনিক ফোকলোরচর্চাকে শানিত করেছেন তিনি। আধুনিক ফোকলোরচর্চায় তিনি ফোকলোরের তাত্ত্বিক ও গবেষণা পদ্ধতির প্রবন্ধ উপস্থাপন করে আধুনিক ফোকলোরচর্চার ধারার বিচারে অদ্বিতীয়ও। ফোকলোরবিষয়ক তাঁর একাধিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ পাঠে এর প্রতিফলন দেখা যেতে পারে।

দুই

বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর যে-কোনো দেশে প্রাচীনকালে ফোকলোরকে বিবেচনা করা হতো ঐতিহ্য হিসেবে। ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি হিসেবে। ফোকলোরের প্রেক্ষাপটে আমাদের ঐতিহ্যের সংস্কৃতির ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে সাধারণ লোক, লোকসমাজ, লোকায়ত দর্শন এবং বাংলার জাগরণে লোকায়ত ও লোকসংস্কৃতির ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত ও গবেষণালব্ধ অভিমতের পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৮৪৩ সালে ইংল্যান্ডের পুরাতত্ত্ববিদ জন থমস ঐতিহ্যের সংস্কৃতিকে Folklore

 নামে বিদ্যাশাখা (Discipline) হিসেবে অভিহিত করার পর পৃথিবীজুড়ে তা গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ফোকলোরতাত্ত্বিকগণ ‘ফোকলোর’ নামটিকেই গ্রহণ করেছেন। তবে ফোকলোর নাম গ্রহণের পূর্বে ‘ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি’ এবং লোকসাহিত্য হিসেবে প্রতিভাত ছিল। এর ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি সম্পর্কে শামসুজ্জামান খান যে-ইতিহাসকে সামনে এনেছেন তা থেকে আমাদের ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্যের প্রাথমিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পটে শামসুজ্জামান খানের পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হলো – ‘বাংলাদেশের ফোকলোর আমাদের লোক-মানস ও লোকজ বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে প্রাচীনকাল থেকেই দিক-নির্দেশক ভূমিকা পালন করে এসেছে। এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল নিরক্ষর, তবুও আশ্চর্যজনকভাবে এ-কথা সত্য যে ব্যাপক গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি থেকে যে-জীবনরস, বিবেচনা-শক্তি, বিচার-বুদ্ধি ও বিশ্বদৃষ্টি লাভ করেছে, তাদের মানবীয় গুণাবলী বৃদ্ধি ও শ্রেয়ো-চেতনার উৎকর্ষ সাধনে তার গুরুত্ব ছিল অনেক। প্রবহমান লোকসংস্কৃতি গ্রামীণ সমাজে চালু রেখেছে এক সুস্থ সামাজিক মিথস্ক্রিয়া যা মানুষের মৌলিক মিলন ও সংহতির ক্ষেত্রকে করেছে প্রশস্ত।’ আমাদের যে-লোকসংস্কৃতি তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের গুরুত্ব। আর এ-সংস্কৃতিই আবহমান বাংলার গ্রামীণ যে-জীবনযাপন সেখানে গড়ে তুলেছে এমন এক মানবিক সৌহার্দ্যময় সম্প্রীতি যা লোকসংস্কৃতির পাটাতন হিসেবে কাজ করেছে বলে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। প্রাচীনকালের সাধারণ মানুষের প্রাকৃত দর্শন অর্থাৎ লোকায়ত দর্শনও যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক পটভূমিতে গড়ে উঠেছে, এক্ষেত্রে  শামসুজ্জামান খানের  ব্যাখ্যা তাৎপর্যপূর্ণ – ‘বাংলা সাহিত্যের আদি কবি বাংলা দোহাকারদের রচনায়ও মানুষকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। অষ্টম-নবম-দশম ওই কবিতা এবং ভাবুক-সাধকদের জীবনচর্চায় লোকমানসে লোকায়ত দর্শনের ইহজাগতিক ধ্যান-ধারণা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে; গড়ে উঠেছে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও পরমসহিষ্ণু এবং সাংস্কৃতিক পদ্ধতি (Cultural system)। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম-দর্শন এবং অর্থব্য বেদের মানবিক অন্তঃসার যেমন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেছে তেমনি নানা লোকধর্ম কাল্ট এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক না হয়ে বরং পরস্পরের মধ্যে সহ-অবস্থানের পথ করে নিয়েছে।’ তিনি পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর মন্তব্যকে বিশ্লেষণ করে ভারতীয় সংস্কৃতিতে যে-বহুজাতির সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে এবং শক্তিশালী সমন্বয়বাদী সংস্কৃতিতে বিকাশ লাভ করেছে, সে-জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ‘প্রাচীন ও মধ্যযুগের লোকায়ত মৌখিক সাহিত্য-তে মানুষের অধিষ্ঠান ঈশ্বরের ওপরে এবং এই ধারা আরো গভীরতা পেয়েছে দ্বিজ দাস আরো পরে লালন শাহ ফকিরের কবিতায় এমন কী হাসন রাজা, বাউল দুদ্দু শাহ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর জালাল খাঁর গানের এইসব তথ্যও বর্ণনায় যোগ করেছেন। লোকায়ত দর্শনও লোকসংস্কৃতিতে তখনও নবশক্তি লাভ করে। বলা যায়, ‘মুসলিম আগমনের পর চৈতন্য যুগের গৌরীয় বৈষ্ণব ধর্মের অদ্বৈতবাদ (সোহম) এবং মুসলিম সুফিতত্ত্বের (আনাল হক) প্রভাবে জীবাত্মা পরমাত্মার অভিন্নতা প্রতিফলিত হয়ে মানুষ খুদা বা ভগবানের সত্তার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।’

প্রাচীন ও মধ্যযুগ থেকেই আমাদের সামাজিক পটভূমিতে বাংলার লোকায়ত বাক্সময়ের (Folklore expressions) পরিবেশনা কলা (Performance) দুটি সুস্পষ্ট রূপে ১. বৌদ্ধ-জৈনদের প্রাকৃত ধারা; ২. ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের শিষ্টধারা প্রত্যক্ষ ছিল। ব্রাহ্মণ-লেখক পণ্ডিতের মতো বৌদ্ধ-জৈনদের প্রাকৃত ধারা বৌদ্ধ বজ্রযানিক ও শৈব-নাথপন্থী গোষ্ঠী সিদ্ধাচার্য ভিক্ষুরা রাজসভার মনোরঞ্জন ও পণ্ডিতদের জন্য লেখেন নাই। তারা সাধারণ মানুষের স্তর থেকে উঠে আসা এবং তারা লোকশিক্ষার কড়চা ও লোকদর্শনে মানব-মাহাত্ম্যের কথা প্রচার করতেন।

সর্বপ্রাণবাদী (Animism) অনুসারীরাও ছিলেন, যারা আদিম বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। যে-কোনো বস্তুর ভেতর প্রাণের সন্ধান করেছেন। এ-জন্যে প্রাণের প্রকাশ লক্ষ করেছেন তারা। ইচ্ছাশক্তিতে সকল বস্তুর প্রাণকে তারা বশ করার সাধনা করতেন। তারা জাদুবিশ্বাস (Magic belief)-কে গুরুত্ব দিতেন। ‘তাদের বিশ্বাস ছিল, আপন ইচ্ছাশক্তি এবং গভীরতর নিষ্ঠায় প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বশ করে মানুষ নিজের আয়ত্তে নিতে পারে।’ সময়ের পরিবর্তন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে লোকায়ত যে-দর্শন তার দ্রুতই রূপান্তর ঘটতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর কথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ-শতাব্দীতে বাংলার জাগরণকে অনেকে নব জাগরণ বলেছেন, আবার অনেকে খণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করেছেন। খণ্ডিত ভাবার অন্যতম কারণ হচ্ছে – নগরে বা শহরে পাশ্চাত্যের প্রভাবে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজে নব জাগরণের যে-ঢেউ আছড়ে পড়েছিল তা স্পর্শ করতে পারেনি গ্রামীণ লোকসমাজকে। বরং গ্রামবাংলার কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও একধরনের মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ সামূহিক ঐক্যচেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে লোকসমাজের ভেতর থেকে যে-জাগরণ ঘটেছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের বাঙালি জাতির জন্যে। বিষয়টিকে শামসুজ্জামান খান সময় ও সমাজের গভীর থেকে উপলব্ধি করেছেন। উনিশ শতক বা ঊনবিংশ শতাব্দী বাঙালি তথা আবহমান বাংলার মানুষের জন্য ঐতিহাসিক এবং জীবনযাপন পালটে যাবার কালের সূচনা করে। ‘নবজাগরণ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ দুই দিক থেকে। এক. শামসুজ্জামান  খান খোলাসাভাবে দেখিয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার জাগরণ সর্বত্র হয়নি। হয়েছে খণ্ডিত। খণ্ডিত এই অর্থে যে, শহরের হিন্দু সমাজের শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে তা প্রত্যক্ষ হলেও, গ্রামের অধিকাংশ কৃষিজীবী মুসলমান ও শিক্ষায় অনগ্রসর নিম্নশ্রেণীর ঘটেনি। না ঘটার কারণ যেটি – তাকে আমি আরেক ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গণ্য করতে চাই। যে-বিষয়টি লোকসংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। শামসুজ্জামান খান তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন – ‘শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসর গ্রামের মানুষের মধ্যেও জাগরণ ঘটেছিল। একে আমরা লোকদর্শন হিসেবে অভিহিত করতে পারি। লোকদর্শনের মূলভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনা। এক্ষেত্রে ভূমিকা ছিল যোগী, তান্ত্রিক, বৈষ্ণব, সুফি, বাউল এবং কবিয়াল ও বয়াতিদের সমন্বিত চিন্তা। এরাই আমাদের উপহার দিয়েছিল – মানবিক কল্যাণচিন্তা, শুভবুদ্ধি এবং পরমতসহিষ্ণুতার মানব শ্রেষ্ঠত্বের দর্শন – লোকদর্শন।’  

ঊনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য-প্রভাবগত খণ্ডিত জাগরণ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ তৃণমূলে কোনো প্রভাবই ফেলতে পারেনি। কিন্তু ওই গ্রামীণ সাধক, মরমিয়া ও আউল-বাউল-ফকিরদের লোকজ দর্শন বাঙালিকে একটি ঐক্যবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চেতনায় ঋজু করেছিল। শামসুজ্জামান খান যর্থাথই বলেছেন – ‘আমাদের বিবেচনায় বাংলায় গ্রামভিত্তিক ব্যাপক নবজাগরণের ভিত্তিমূলে আছে লোকদর্শন ও তার উপজাত লোকসংস্কৃতি, যা ফোকলোর। শুধু সামাজিক সুস্থতা, মানবিক মূল্যবোধ ও বিচারবুদ্ধি নয়, গোটা গ্রামবাংলাকে এক উদার মানবিক চেতনায় দীপ্ত করার ক্ষেত্রে লোকদর্শন এবং তার সাধক ভাবুক কবিয়াল, বয়াতি ও গায়েনদের ভূমিকাই প্রধান। এই জাগরণ গুরুত্ব ও ব্যাপকতায় উনিশ শতকের নগরভিত্তিক জাগরণের চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন-সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের উদ্ভবের ক্ষেত্রেও লোকসংস্কৃতি ও সমন্বিত জীবন-যাত্রানির্ভর এই জাগরণের গুরুত্ব বেশি বলেই মনে হয়।’  অর্থাৎ আদিম বস্তুবাদী দর্শন, মধ্যযুগের লোকায়ত মৌখিক সাহিত্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মধ্যযুগেই সর্বপ্রাণবাদী ও ব্রাহ্মণ অভিজাতদের তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য, বৈষ্ণব সহজিয়া দর্শন ও মুসলিম সুফিবাদী দর্শনের সমন্বয়ে লোকায়ত দর্শন যে-নবশক্তি লাভ করে এসবকে গুরুত্বে এনেছেন। এরই মধ্যে দিয়ে যে বাঙালির একটি ঐক্যবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চেতনায় ঋদ্ধ গ্রামীণ সাধক, মরমিয়া ও আউল-বাউল-ফকিরদের লোকজ দর্শন প্রতিষ্ঠা পায় – এ-বিষয়টিও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে ব্যাখ্যা করেছেন।

কিন্তু এমন একটি সময় আসে যখন লোকজসংস্কৃতি একটা অস্থিরতার কাল অতিক্রম করে, গ্রামাঞ্চলে নতুন কোনো ধারাও সৃষ্টি হয় না, এরই মধ্যে আশাব্যঞ্জক নতুন প্রবণতা লক্ষ করা যায় রূপান্তরিত লোকজ উপাদানে। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানি অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে ‘ছায়ানট’ নববর্ষকে বরণ করার মধ্য দিয়ে। স্থানটি রমনার বটমূল। আবার ১৯৮৯ সালে স্বৈরাচার ও ধর্মান্ধতার বিরোধিতা করে চারুকলা ইনস্টিটিউট যে-মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা করে তা ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়ে যায়। লেখকের ভাষায় বলা যায় ‘সামাজিক সংহতিকে দীপ্র করেছে।’

তিন

আধুনিক ফোকলোরের অনেক Genra রয়েছে। শুধুই লোকসাহিত্যে নয়। তাছাড়া ক্ষেত্রসমীক্ষাও এক্ষেত্রে অন্যতম অবলম্বন। ফোকলোর বলতে কী বোঝায় এ-সম্পর্কে তিনি আধুনিক আন্তর্জাতিক মানের একটি সংজ্ঞাকে গুরুত্ব দিয়েছেন – ‘সংস্কৃতির যে-সব উপাদান ঐতিহ্যগতভাবে কোনো সংশ্লিষ্ট গ্রুপের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্যে মৌখিকভাবে বা সামাজিক রীতি, প্রথা, বিশ্বাস বা অভ্যাসের আকারে সঞ্চারিত হয় (Communicate) তখন তাকে ফোকলোর রূপে চিহ্নিত করা হয়।’ সংজ্ঞা থেকেই বোঝা যায় ফোকলোরের গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য এবং প্রাণভ্রমরা সম্পর্কে। আর এজন্যে বৈশিষ্ট্যও নির্ধারণ করে বলেছেন, ‘ফোকলোর স্থবির (Static) নয়, জঙ্গম, চলমান (Dynamic)। আর্থসামাজিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে এর রূপান্তর ঘটে। নতুন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে (Context) তৈরি হয় নতুন নতুন ফোকলোর ও তার আবাসস্থল (Habitat)। এই রূপান্তরই লোকসংস্কৃতির প্রাণ।’ আর এই চরম সত্য ও বাস্তবতার ঐতিহ্যময় স্বরূপটিকে বিশ্লেষণের জন্য তিনি প্রাচীন বাঙালির লোকায়ত দর্শনচিন্তার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের সময় পর্যন্ত অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর পূর্ব সময় পরিসরে লোকবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন।  

শামসুজ্জামান খান ঐতিহাসিক প্রসঙ্গসূত্রে প্রথমে বুঝতে চেয়েছেন ফোকলোরচর্চার প্রথাগত অঞ্চলকে। এ-ব্যাপারে তিনি সুস্পষ্ট ধারণা নিয়েছেন এবং আমাদের জন্যে সে-ধারণাকে উপস্থাপনও করেছেন। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি খোলাসা হতে পারে।

প্রাচীনকালে গ্রামদেবতাকে কেন্দ্র করে গ্রামসমাজে যে-ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতো তার পাশাপাশি সামাজিক আচারও ছিল, যা জঙ্গম ও স্থাবর দুই ধরনের উৎসবই হতো। দেবমন্দিরে দেবমাহাত্ম্য গীত দীর্ঘ হওয়ার কারণে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য প্রচলন ছিল পুতুলনাচের। চলত পুতুলনাচ এবং নাচের সঙ্গে গান। প্রাথমিক পর্যায়ের এই ধারণাকেই তিনি বলেছেন লোকজসংস্কৃতির উৎস। আর ভিত্তিটা দাঁড়িয়েছিল যে-পন্থায় এ-ব্যাপারেও তাঁর সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে মন্তব্য হচ্ছে – ‘আদিম আচার-অনুষ্ঠান ও পরবর্তীকালের ধর্ম ও জাদু বিশ্বাসভিত্তিক সংস্কৃতি উপাদানে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাথমিক পর্বের ভিত্তি নির্মিত।’ উদাহরণও দিয়েছেন তিনি। ভাদু ও তুষু এই দুটি লোকউৎসব যে প্রাচীন এবং জাদুবিশ্বাসভিত্তিক তা উল্লেখ করেছেন।

জঙ্গম উৎসব হিসেবে যাত্রার কথা বলেছেন। কারণ সূচনাপটে যাত্রা ছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ। এরও ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে যাত্রা তার ধর্মীয় বৃত্ত অতিক্রম করে সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানে তা সাহিত্যনির্ভরও।

শামসুজ্জামান খানের মূল্যায়ন থেকে আধুনিক ফোকলোরের বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লোকশিল্প কীভাবে আধুনিক ফোকলোরচর্চায় গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে এ-বিষয়েও তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ ‘ঐতিহ্য ও আধুনিকতার নিরিখে লোকশিল্প-অবলোকন’। এ-প্রবন্ধে তিনি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছেন। ব্যাখ্যায় তিনি দেখিয়েছেন সংজ্ঞা-সূত্র, অর্থ-জিজ্ঞাসা, নান্দনিকতা ও ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা, মানবিক ও সাংস্কৃতিক বাক্সময়তার প্রবহমানতা। পাশাপাশি অনুসন্ধান করেছেন ঐতিহ্য-অন্বেষায় সমাজ পরিবর্তনের অভিঘাতে সমাজ-ইতিহাসভিত্তিক লোকশিল্পের রূপান্তর প্রক্রিয়ার ধরন।

আধুনিক ফোকলোরচর্চা বা গবেষণায় ‘বিবরণমূলক’ পদ্ধতিকে তিনি খারিজ করে দিয়েছেন তাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে, আবার কোন পদ্ধতি আধুনিক ফোকলোরচর্চায় যুগোপযোগী তারও ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘বিবরণমূলক গবেষণায় বিশেষ শিল্পকলার রূপান্তর, বিন্যাস, বিন্যাসগত ভিন্নতা বা ক্রিয়াগত (Functional) পরিবর্তনের চিত্র উন্মোচনের সুযোগ থাকে না। কিন্তু সমাজ এমনকি ঐতিহ্যগত সমাজেরও পরিবর্তন হয়।’ লোকশিল্প পটচিত্র হতে পারে, আলপনা হতে পারে, মৃৎশিল্পের নানান উপাদানসহ শখের হাঁড়ি হতে পারে। এইভাবে বহু লোকশিল্পের উদাহরণ দেওয়া যাবে। সামাজিক রুচি ও মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন হয় আমরা জানি। এই রুচি ও মূল্যবোধের সঙ্গে লোকশিল্প খাপ খাইয়ে চলতে পারে। আর পারে বলেই শামসুজ্জামান খান, আধুনিক ফোকলোরে যুক্ত করেছেন নকশিকাঁথাকে। কেননা বর্তমানে নকশিকাঁথার ‘নানা আধুনিক ও তাৎপর্যময় ব্যবহার আছে।’ উল্লেখ করেছেন ‘বিয়ের আসরে’, মহান একুশের আগের দিন রাতে শহিদ মিনার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আলপনাচিত্রের কথা। আর এ-কারণে আধুনিক ফোকলোর চিন্তার বিশ্লেষণ থেকে তিনি যে-মন্তব্য করেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন,  ‘আসলে ঐতিহ্য যে নতুন ঐতিহ্য নির্মাণ করে এ তারও এক উদাহরণ।’১০

চার

শামসুজ্জামান খান আধুনিক ফোকলোরচর্চার পদ্ধতি সম্পর্কে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাদের ধরিয়ে দিয়েছেন বাংলা ফোকলোরের উদ্ভবের ইতিহাস ঐতিহাসিক প্রসঙ্গসূত্রে আলোকপাত হলেও আধুনিক ফোকলোরচর্চার উদ্ভবের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা তেমন অবগত নই এবং এ নিয়ে তেমন উৎসাহও ফোকলোরবিদদের কাছ থেকে আমরা পাইনি। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পাঠ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাঠপর্যায়ে যে-অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তার আলোকে আধুনিক ফোকলোরচর্চার উদ্ভবের ইতিহাসের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে সিনক্রনিক আলোচনাই যথেষ্ট  নয় – ডায়াক্রনিক (ঐতিহাসিক পটে স্থাপন করে) আলোচনাও বহু সমস্যার গ্রন্থিমোচনের সহায়ক। আমরা আশা করব ভবিষ্যতে এ বিষয়ে অনুপুঙ্খ, বিজ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যনিষ্ঠ আলোচনার সূত্রপাত হবে। বাঙালির জাতিতাত্ত্বিক আত্মপরিচয় উদ্ধারের লক্ষ্যেই আমাদের লোকসংস্কৃতির উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস নির্মাণ করা প্রয়োজন।’১১

বিশ্বের আধুনিক ফোকলোরতাত্ত্বিকরা সাম্প্রতিককালের কনটেক্সট, পারফরম্যান্স, পাঠভেদ, ফাংশন সম্পর্কে উৎসাহী – এ-ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা রেখেছেন তিনি। আধুনিক ফোকলোরচর্চাকে জানার জন্য ফোকলোর গবেষক ও অনুসন্ধিৎসুদের কয়েকটি বইয়ের পাঠের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। শামসুজ্জামান খান এ-ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক মানের লেখক ও গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন কারণসহ। তাঁর মন্তব্য তুলে ধরছি – ‘আমাদের লোকসংস্কৃতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হলেও এ প্রাথমিক এবং অতিপ্রয়োজনীয় কাজটি এখনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়নি। বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এ বিষয়টির ওপর যথাযথ আলোকপাত করা না হলে আমাদের ফোকলোর চর্চা আধুনিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে না। মার্কিন মুলুকের ফোকলোরবিদ্যার একালের অন্যতম প্রধান স্থপতি ড. রিচার্ড মে. ডরসন ‘আমেরিকান ফোকলোর’ (অসবৎরপধহ ঋড়ষশষড়ৎব) (১৯৫৯) বইটিকে ওইভাবে বিন্যস্ত করেছেন। অন্যদিকে ‘ঋড়ষশড়ৎব রহ ঃযব গড়ফবৎহ ডড়ৎষফ’  (১৯৭৯) সম্পাদনা করে তিনি আধুনিক ফোকলোর চর্চার উৎস মুখটি খুলে দিয়েছেন। ফিনল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডেও এ ধরনের বহু বই লেখা হয়েছে। জার্মানিতে ইওহান গটফ্রিড ভন হের্ডার (ঔড়যধহহ এড়ঃঃভৎরবফ ঠড়হ ঐবৎফবৎ, ১৭৪৪-১৮০৩) প্রমুখের কাজের ধরনও তাই। তবে বর্তমানে আমেরিকা ও ইউরোপের পারফরমেন্স স্টাডি প্রাধান্য পাওয়ায় সিনক্রনিক পদ্ধতিই ব্যাপকভাবে অনুসৃত হচ্ছে।’১২

পাঁচ

বাংলাদেশে আধুনিক ফোকলোরচর্চার জন্যও উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। রূপরেখা তৈরি করে চর্চায় এগিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। এ-ব্যাপারেও তাঁর বক্তব্য হচ্ছে – ‘বাংলাদেশের ফোকলোর-চর্চার একটি উপযোগী মডেল তৈরি করা না গেলে আমাদের ফোকলোর-চর্চা হয়তো আরো দীর্ঘকাল থেকে যাবে বর্তমানের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত, শিথিল এবং অগোছালো। অথচ যে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার মতো ফোকলোর-চর্চাতেও স্বতঃস্ফূর্ততা নয়, যুক্তি, বিশ্লেষণ এবং প্রামাণ্য তথ্য চাই। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানই আধুনিক ফোকলোরের জন্মদাতা। সামাজিক অগ্রগতি ও বিজ্ঞান প্রযুক্তির উদ্ভবই ফোকলোরকে চিহ্নিতকরণে সহায়ক হয়েছে।’১৩

শামসুজ্জামান খান ফোকলোরচর্চার প্রথাগত ধারণায় যুক্ত করেছেন আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, যা লোকসংস্কৃতির রূপান্তরের ধারাটিকে স্বকীয়তায় দাঁড় করায়। শামসুজ্জামান খান লোকগল্প নিয়েও কাজ করেছেন। এর ভেতরও আধুনিক যুক্তি ও পরম্পরাকে খুঁজেছেন। তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন ‘লোকগল্পের পরিযানতত্ত্ব ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংযোগ’ নিয়ে। সেখানে তিনি বিশেষভাবে দেখিয়েছেন লোকগল্পের কাহিনি কীভাবে পরিভ্রমণ করেছে এক জাতি থেকে অন্য জাতিসমূহে, দেশ থেকে দেশে। তবে লোকগল্পের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ও চরিত্রগুলো পরিভ্রমণ করলেও যে প্লট ও  মোটিফ করে না তা আধুনিক ফোকলোরচর্চার নিরিখে উপস্থাপন করেছেন।

ফোকলোর যে সংগ্রহের বিষয় ছিল এবং এর সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন চীনের হীন রাজাদের লোকসংগীত সংগ্রহের উদাহরণের মাধ্যমে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই ক্ষেত্রে দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। ১. প্রাচীনকালে ফোকলোর সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কোনো সুচিন্তিত ও সংগঠিত প্রয়াস ছিল না। ২. চীনা রাজারা ফোকলোর বা লোকসংগীত সংগ্রহ করতেন প্রীতি থেকে নয়, রাজ্য শাসনের সুবিধার্থে। অর্থাৎ রাজারা জনগণের মনের খবর জানাবার জন্যই ফোকলোর সংগ্রহে ব্রতী ছিলেন।১৪ মানুষের গুণ, একটি জাতির আত্মপরিচয়ের স্বরূপ উপলব্ধির জন্যে যে ফোকলোর কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তার তুলনামূলক উৎকৃষ্ট উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে ফিনল্যান্ডের মাধ্যমে। শামসুজ্জামান খানের মন্তব্য তুলে ধরা হলো – ‘জার্মানদের মতো সমৃদ্ধ ভাষা সাহিত্যের ঐতিহ্য ছাড়াই ফোকলোর-উপাদান থেকে প্রথমবারের মতো সোনালি শস্য ঘরে তুলতে সক্ষম হয় দীর্ঘদিন ধরে পরাধীন নর্ডিক অঞ্চলের এক ক্ষুদ্র দেশ ফিনল্যান্ড। প্রকৃতপক্ষে তখন ফিনল্যান্ডের যেমন কোনো উল্লেখযোগ্য জাতীয় ইতিহাস ছিল না, তেমনি স্ট্যান্ডার্ড কোনো ভাষাও ছিল না, অতএব সংগত কারণেই কোনো সাহিত্যিক ঐতিহ্যও ছিল না। প্রথমে রুশদের অধীনে ও পরে সুইডেনের অধীনে থাকার ফলে উচ্চবিত্তের ফিনরা রুশ ও সুইডেনের ভাষাই ব্যবহার করতেন। আত্মপরিচয়ের মাধ্যমে ও জাতীয় চেতনার বানে হিসেবে গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত দেহাতি ফিনিশ ভাষা ব্যবহার করার কথন উচ্চ সমাজের ফিনরা চিন্তা করেননি। এলিটদের দ্বারা উপেক্ষিত এই লোকজ ভাষাই ধীরে ধীরে ফিনদের জাতিসত্তা বিকাশে মূল এবং অনিবার্য ভূমিকা পালন করে।’১৫

ফিনল্যান্ডের ফোকলোরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের পাশাপাশি শামসুজ্জামান খান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন ফিনল্যান্ডের ‘ফোকলোর মেথডলজি’কে অর্থাৎ ‘ফোকলোর উপাদান বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি সুসংবদ্ধ পদ্ধতি (Method)’ যে আবিষ্কার হয়েছিল তার বিবরণ। এক্ষেত্রে জুলিয়াস ক্লোহন এবং তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র কার্লে ক্লোহন-এর যে ভূমিকা তুলে ধরেছেন।

জুলিয়াস ক্লোহন প্রথম ফোকলোর উপাদান সংগ্রহ এবং তার ওপর মন্তব্য ও বিবরণ লেখার পর ওইসব উপাদানের ভেতর থেকে ফোকলোর অনুসন্ধানের সূত্রের রূপরেখা নির্ধারণ করেন। কিন্তু পূর্ণতা পায়নি তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর কারণে। তবে তাঁর পুত্র কার্লে ক্লোহন ফোকলোরচর্চার মধ্য দিয়ে যে-পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন তা আধুনিক ফোকলোরচর্চায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম ‘ঐতিহাসিক ভৌগোলিক পদ্ধতি বা ফিনিশ পদ্ধতি’। কার্লে ক্লোহনের ফোকলোর মেথডলজি নামে প্রকাশিত গ্রন্থটিকে শামসুজ্জামান খান ফোকলোর গবেষকদের জন্য বাধ্যতামূলক গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। গ্রন্থের গবেষণা-পদ্ধতি সম্পর্কেও তিনি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর লেখায়। তিনি বলেছেন – ‘লেখক তাঁর বইয়ে কোনো অঞ্চলের অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় বিশ্বাস সংস্কারের অনুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেননি। এমনকি তিনি সাহিত্যের ছাত্রের মতো ফোকলোরের মনস্তাত্ত্বিক পটভূমিকা বা ফোকলোরের সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক উপাত্তের কোনো তুলনামূলক আলোচনায়ও যাননি। তাঁর অন্বিষ্ট ছিল ফোকলোরের উৎস অনুসন্ধানের একটি উদ্ভাবক, যা বিষয়টির বিভিন্ন উপাদানের (Text) উৎপত্তিস্থল (Place of origin) ও তার প্রচারের (dissemination) ধারাকে চিহ্নিত করবে।’১৬

আধুনিক ফোকলোর গবেষণায় ফিল্ডওয়ার্ককে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফিল্ডওয়ার্কের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যে-রূপরেখা তার পুঙ্খানুুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। ফিল্ডওয়ার্কের ক্ষেত্রে যে সক্রিয় ঐতিহ্যবাহী, নিষ্ক্রিয় ঐতিহ্যবাহকের গুরুত্ব অপরিসীম। পাশাপাশি আধুনিক ফোকলোর গবেষণায় কোনো গোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক উপাদানের পরিবেশনাও যে অপরিহার্য এ-বিষয়টিকেও তুলে ধরেছেন। এর জন্যে যে পারফরম্যান্স থিওরির গুরুত্ব রয়েছে তার সমর্থনে ফোকলোরতাত্ত্বিক রজার আব্রাহামের কথাও উল্লিখিত হয়েছে। ফোকলোরে পারফরম্যান্স এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি যদি কোনো গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-অনুপস্থিত থাকে তাহলে সে-উপাদান ফোকলোর নয়, এটিও আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন শামসুজ্জামান খান।

আমাদের সমাজে অনেকের ধারণা এবং অভিমত এই যে, আমাদের লোকসংস্কৃতি বা ফোকলোর হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংগ্রহ-সংরক্ষণ করা জরুরি। এটি শুধু ধারণা নয়, আক্ষেপও। কিন্তু আধুনিক ফোকলোরচর্চায় শামসুজ্জামান খান বিভিন্ন ধরনের উদাহরণের সাহায্যে আমাদের দেখার দৃষ্টিকে সময়োপযোগী করার তাগিদ অনুভব করিয়েছেন।

আধুনিক ফোকলোর বিজ্ঞানীদের অভিমত অনুসারে তিনি বলেছেন, ‘ফোকলোর প্রত্নতত্ত্বের মতো স্থির (ঋরীবফ) বা অপরিবর্তনীয় উপাদান নয়, ফোকলোর প্রবহমান ও বহুভাষ্যে বিদ্যমান; এর নতুন নতুন রূপান্তরই শুধু হয় না, সময়ের বিবর্তনে গড়ে ওঠে নতুন ফোকলোর।’১৭ এর সপক্ষে উদাহরণও দেওয়া হয়েছে তাঁর লেখায়। একসময় গ্রামবাংলায় লোকসংস্কৃতির উপাদানের উৎস ছিল – ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মীয় উৎসব এবং লোকসমাজের সাধারণ ঐতিহ্যগত সম্পদ, নববর্ষ উৎসব, লোকসংগীত প্রভৃতি। বর্তমানে গ্রামবাংলায় প্রযুক্তির কল্যাণে নতুনতর বহু উপাদান যুক্ত হবে – আশাবাদ আমাদের।

শামসুজ্জামান খান আধুনিক ফোকলোরচর্চার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব ও পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন ফোকলোর বিশ্লেষণের গভীরে পৌঁছানোর জন্যে। টেক্সট-এর পাশাপাশি কনটেক্সট বা প্রসঙ্গকেও অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি ফোকলোরকে পরিপূর্ণ ও গভীরতর ব্যাখ্যার জন্য।

তথ্যনির্দেশ

১. শামসুজ্জামান খান, ‘বাংলার জাগরণ লোকায়ত দর্শন ও লোকজ সংস্কৃতির ভূমিকা’, সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা, অনিন্দ্য প্রকাশ, প্রথম, অনিন্দ্য সংস্করণ ২০১৭, ঢাকা, পৃ ১১-১২।

২. প্রাগুক্ত, পৃ ১২।

৩. প্রাগুক্ত, পৃ ১৫।

৪. প্রাগুক্ত, পৃ ১২।

৫. প্রাগুক্ত, পৃ ১৩।

৬. প্রাগুক্ত, পৃ ১১।

৭. প্রাগুক্ত, পৃ ১৫।

৮. শামসুজ্জামান খান, ‘বাংলাদেশের ফোকলোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও আধুনিকতার নতুন দিগন্ত’, আধুনিক ফোকলোর চিন্তা, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১২, ঢাকা, পৃ ৩০।

৯. প্রাগুক্ত, পৃ ১৮।

১০. শামসুজ্জামান খান, সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা, পৃ ১১১।

১১. প্রাগুক্ত, পৃ ৩৭।

১২. শামসুজ্জামান খান, আধুনিক ফোকলোর চিন্তা, পৃ ২০।

১৩. প্রাগুক্ত, পৃ ২১।

১৪. শামসুজ্জামান খান, সাম্প্রতিক ফোকলোর ভাবনা, পৃ ২৮।

১৫. প্রাগুক্ত, পৃ ২৯।

১৬. প্রাগুক্ত, পৃ ৩১। ১৭. প্রাগুক্ত, পৃ ৬৩-৬৪।