রণজিৎ বিশ্বাস
শওকত ওসমানের সঙ্গে আপনার তো একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
: ছিল। এখনো আছে।
: এখনো আছে মানে?! তিনি তো এখন পরলোকে! এখন তাঁর সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে নাকি?! এটি কী করে সম্ভব!
: সম্ভব। শ’প্রতিশত সম্ভব। জীবনের অবসানে মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়ের সঙ্গে আত্মীয়ের সম্পর্ক কখনো শেষ হয় না। যেমন, আমার সঙ্গে আমার মায়ের বাবার ও পুত্রের সম্পর্ক এখনো ছিন্ন হয়নি। আমার সঙ্গে এখনো সম্পর্ক আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, কাজী নজরুল ইসলামের, সত্যজিৎ রায়ের ও আমার অকালপ্রয়াত বন্ধু জাকির আহমেদের। তেমন করেই আমার সম্পর্ক এখনো শক্তপোক্ত আছে শওকত ওসমানের (সেখ আজিজুর রহমানের। ‘সেখের সম্বরায় তিনি ‘সেখ’ই লিখতেন)।
: আপনি কি তাঁর ছাত্র ছিলেন?
: ছিলাম না, আবার ছিলাম খুব প্রবলভাবে। আমি তাঁর ক্লাসরুম স্টুড্ন্ট নই, তার চেয়ে বেশি! তিনি আমার ভাবশিক্ষক, আমি তাঁর ভাবশিষ্য। আমি আমার ছোট জীবনের একটা সময়ে তাঁর কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই স্নেহসম্ভাষণ পেতাম, প্রায় প্রতিদিনই তাঁর বকুনি খেতাম।
: বকুনির কথাটা আগে বলুন।
: তখন খুব বড় একটা অফিসে আমি ছোট একটা চাকরি করতাম। উপ-প্রেস সচিবের চাকরি। আনন্দে ছিলাম, আবার কষ্টেও ছিলাম। কারণ, আমার পার্শ্ববর্তী ও অনুবর্তী সহকর্মীদের কয়েকজন তাদের নিজ নিজ বিবেচনায় ষড়যন্ত্রী ও অসূয়াকাতর হয়ে উঠেছিল এবং যিনি চুক্তিভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন আসনে ছিলেন, তাঁর মেধাপ্রকোষ্ঠে হাওয়া ও মেরুদন্ডের জায়গায় জ্যামজেলি ছিল। নষ্ট পরামর্শে তাঁকে খুব কনভিন্স করা যেত। এবং তিনি ভজানো পছন্দ করতেন।
শওকত ওসমান চাইতেন, প্রতিদিন আজকের কাগজে ছাপা হওয়া (পত্রিকাটি এখন মৃত) ‘সেখের সম্বরা’য় ক্লিপিংস – আমি যেন যথাস্থানে যথাসময়ে পাঠাই। যেদিন আমার বিলম্ব হতো কিংবা উপস্থাপনে বাদ পড়তো, সেদিন তিনি ক্রুদ্ধ হতেন। আমি তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতাম এবং পারতাম।
প্রায় প্রতিদিনই – তিনি ফোন করতেন এবং অনেকক্ষণ কথা বলতেন। অধিকাংশ সময়ে সকালবেলা। অফিসে যাওয়ার আগে। সম্ভাষণে তিনি উচ্চারণ করতেন ‘প্রাতঃস্মরণ প্রাতঃস্মরণীয় হোক ভ্রাত’।
পরে জেনেছি এই একইভাবে তিনি অনেককেই সম্বোধন করতেন।
: এতে কী বুঝলেন?
: বুঝলাম, তিনি কাকে যে বেশি স্নেহ করেন, বুঝতে দিতেন না। আমরা আলাদা আলাদাভাবে ভাবতে চাইতাম – স্যারের স্নেহটা আমি বোধহয় একটু আলাদাভাবে পাচ্ছি, একটু আলগাভাবে পাচ্ছি। আমার মনে হয়, এ-আচরণ সেই পিতার মতো, যার প্রতিটি সন্তান মনে করে, আমার বাবা বোধহয় আমাকেই বেশি স্নেহ করেন; অথবা সেই শিক্ষকের মতো, যার প্রতিটি শিক্ষার্থী ভাবে – স্যারের স্নেহ ও সাপোর্ট আর কেউ সম্ভবত আমার মতো পাচ্ছে না।
: তাঁর সম্পর্কে নতুন কিছু কি বলতে পারেন?
: তেমন পারবো না। তবে, এমন কিছু বোধহয় জানানো যাবে, যা কারো কারো মনে হতে পারে ‘নতুন সংবাদ’। যেমন হুগলীর সবলসিংহপুরে জন্মগ্রহণকারী সেখ আজিজুর রহমানের (শওকত ওসমান) লেখাপড়া শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায়। তিনি কলকাতার কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটে মহানায়ক উত্তমকুমারের (তখন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়) শিক্ষক ছিলেন। চট্টগ্রামে শিক্ষকতার সময় তিনি একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে, বড় অমানবিক ও অযৌক্তিক নামে ডাকতে হলে ‘শত্রুসম্পত্তি’তে বসবাস করতেন। ‘শুভার্থীরা’ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন – বাড়িটা নিজের করে নিন। অনেকেই তেমন করে। আমরাও করেছি।
তিনি তা না করে ভারতে গিয়ে বাড়ির বৈধ উত্তরাধিকারীদের খুঁজে বের করেন ও তাদের বুঝিয়ে দেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যার পর যাঁরা দেশত্যাগ করেছিলেন, তাঁদের সারিতে শওকত ওসমানও ছিলেন।
শ্মশ্রূমন্ডিত হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি এক জিজ্ঞাসুজনকে বলেছিলেন – মানুষ হওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এখন ছাগল হওয়ার চেষ্টা করছি।
: তাঁর কাছে এমন কী শিখেছেন, যা ভুলতে তো পারছেনই না, বরং জোরেশোরে প্রচার করে চলেছেন।
: ‘সংসারে সকল ক্ষেত্রে জয় কামনা করিবে, দুই ক্ষেত্রে পরাজয়। ছাত্র (শিক্ষার্থী অর্থে) ও পুত্র (সন্তান অর্থে)।’
: ওঠার আগে একটি দাবির কথা বলি?
: বলুন। ছোট কোনো দাবি পূরণে যেন খাবি না খাই।
: কয়েকটি সম্বরার উল্লেখ করুন, যা আপনার স্মৃতিছুট হবে না।
: সে তো সংখ্যায় খুব বেশি নয়!
: না হোক, গোটা ছয়েকও হবে না!
: বলা যাচ্ছে না। আমি আওড়াতে থাকি আপনি গুনেগুনে টুকে নিন। তার উলটোটাও করতে পারেন, টুকেটুকে গুনে নিন।
: শুরু করুন।
: করলাম। একেবারেই কিন্তু স্মৃতি থেকে। কোথাও আমার টোকা নেই।
ক. যুদ্ধ মানেই মাথায় লোহার দস্তানা
মগজ উধাও শয়তানের আস্তানা
খ. কুকুর যদি রাজ্য পায়
জুতো পায়ে হাঁটা দায়।
গ. মায়ের প্রথম স্বামী যেমন বাপ নয়
অতীতে কৃত অপরাধও তেমন পাপ নয়।
ঘ. হিন্দু পাকিস্তানি হয় মরিবার পরে –
অন্যরা পাকিস্তানি হয় মরিবার তরে
(তিনি ‘অন্যরা’ বলেননি। একটি নাম করেছিলেন। খুব পরিচিত নাম। সে নাম আমি লিখলাম না। কয়েকটি কারণ মেনে)।
ঙ. সে দেশে অসহায় রসুল ও আল্লাহ
যে-দেশে সরকার খোদই এক মোল্লাহ।
চ. মনে দুঃখ বড় জাগে
মানুষ হওয়ার আগে
হিন্দু কিংবা মুসলিম হওয়া লাগে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.