সিটি স্ক্যান

এখানে কি নদী আছে? এত বালু উড়তাসে, কুথা থিকা জলের গন্ধ পাইতাসি।

দাদা, এটা নদী নয়, ই এম বাইপাস।

ই এম? এর মানে কী?

ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন।

আরে আমিও তো ইস্টার্ন। মানে পুবের মানুষ। পুব বাংলা যারে কইত, এখন বাংলাদেশ।

জয় বাংলা, জয় বাংলা।

কইয়েন না। শুনলাই চোখের রোগ মনে হয়। এইহানে চোখ দেখাইতেই আসছি তো।

চোখে কী হয়েছে আপনার?

কে জানে। খুব উলটাপালটা দেখি। একদিন অফিস থিকা ফিরছি, গাড়ির জানলা দিয়া দেখলাম, ফুটপাত দিয়া আমার বিবি এক উচক্কা যুবকের লগে কথা কইসে, তারপর হাত ধরাধরি কইরা পাশের পার্কে ঢুকল।

এতে চোখের গণ্ডগোল কেন হবে, দেখতেই পারেন।

আপনি বুঝতাসেন না। বাসায় গিয়া বিবিকে কইতে সে কয়, তোমার চোখের দুষ হইসে, আমি সারা দুপুর তোমার নাস্তার জন্য ভাপা পিঠা বানাইতাসিলাম, এই শেষ হইল, তারপর সবে পিঠটা একটু টান করসি, অমনি তুমি আইলা।

তাহলে তো সত্যি বড় ভাবনার কথা, ভাবি বললেন, উনি বাসা থেকেই বেরোননি অথচ আপনি ওনাকে দেখলেন।

আপনি বুঝতাসেন না, শুধু যদি ওনারে দেখতাম, তাহলে এতো সমস্যা হইত না। সমস্যা বাধসে বেশি দেখে ফেলে। আমি যে আবার …

বুঝেছি, ওই উচক্কা যুবক। ওকে কেন যে আপনি দেখতে গেলেন!

আরে আমার চোখের দুষ হয়েছে যে। বিবি কইল। ঠিকই কইল। আরো সমস্যা বাধসে।

আবার কী হলো?

আরে আমি সব জায়গাতেই উল্টাপাল্টা দেখতাসি।

আবার কোথায় কী বেশি দেখলেন?

সব জায়গায় বেশি না, কোথাও কোথাও কম। আমাদের অফিস গতবছর অনেকগুলি ঠান্ডা মেশিন কিনসিল, সেই ফাইলটা দেখতে দিছিল বস, দেখি যত টাকা খরচ হয়েছে, তত মেশিন ঢুকে নাই, কম ঢুকসে।

বসকে বলেননি?

বলসি। উনি কইলেন, উল্টাপাল্টা দেখো, চোখ দেখাও সত্বর।

তা ভালোই করেছেন, চোখ মাঝে মাঝে দেখানো ভালো। তা কোথায় যাবেন, চেন্নাই?

চেন্নাই আবার কোথায়? কলকাতাতেই। এই যে কইলেন ইস্টার্ন বাইপাস, এইহানেই। মুকুন্দপুর নামে কুনো জাগা আছে?

আছেই তো, আমি ওখানেই থাকি।

আপনের বাসা মুকুন্দপুর? তবে তো আপনের বাসায় যাওন লাগব। সবাই কয় ইন্ডিয়ার লোকজন অত মিশুক না, কিপ্টা। এখান থিকা যারা যায়, তাদের তো দাওয়াত খাইতে খাইতে পেট ছাইড়া দ্যায়, আর এইখানে নাকি কারো বাসায় গেলে তিন ঘণ্টা আলাপের পর কয় ‘আপনি কি চা খাবেন?’

ইয়ে মানে মুকুন্দপুরে আমার বাসা না। আমার শালির বাসা।

তবে তো আরো ভালো দাদা, শালিরে কয় আধি ঘরওয়ালি।

ইয়ে মানে, মামলা একটু গম্ভীর। আমার শাশুড়ি আছেন শালির বাড়ি, আমার বাসায় ছ-মাস, শালির বাসায় ছ-মাস। আমরা তিনদিন একটু দীঘা বেড়াতে গেছিলাম, তাই ছ-মাস পেরিয়ে তিনদিন – না, না, চারদিন হয়ে গেছে। এতো বালি জামাকাপড়ে, কাচতে কাচতে শেষ হচ্ছে না।

বালু ক্যান?

দীঘায় সমুদ্র আছে না? বঙ্গোপসাগর।

লোকটা একটা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

আমি কুনোদিন সমুদ্র দেখি নাই, জানেন।

কেন, এই একই সাগর তো কক্সবাজার, পতেঙ্গা। আমরা ঘুরে এলাম প্যাকেজ ট্যুরে।

আরে আমার বিবি পানিতে ডরায়, তাও আবার মহাসাগরের পানি। তারপর সে বালু মোটেই সহ্য করতে পারে না, কয় সব তার ভেতরে ঢুকে থাকে – দাঁতে, কানে, এমনকি মেয়েদের ওইসব ইয়ের মধ্যেও নাকি। কিচকিচ করে। ঘুমের মধ্যেও নাকি কিচকিচ করে, আমারে গায়ে হাত দিতেই দ্যায় না। বলে আমার হাতে নাকি বালু, ওর ননির মতো গা ছড়ে যায়।

আমার বাড়ির দাওয়াত থেকে জল আর বালির দিকে কথা ঘুরে যাওয়ায় আমি খুব খুশি। হাঁফ ছেড়ে বলি – এরকম আছে। অনেকেই জলে ভয় পায়, আর বালি একদম পছন্দ করে না।

কিন্তু দাদা, তাইলে আমি ওইটা দেখলাম কী কইরা?

আবার কী দেখলেন?

সেদিন খবরের কাগজওলা আসছে, আমার বিবি গেসে ছেলেরে ইস্কুলবাসে তুলতে। আমি ভাংতি না পাইয়া আলমারি খুলসি, বিবি একটা থলিতে অনেক ভাংতি জমায় জানি। খুইলা এদিক-ওদিক হাতড়াইয়া তো আমি অবাক।

আমি যেন কোনো গোয়েন্দা কাহিনি শুনছি, উদ্গ্রীব হয়ে বলি কেন, কেন?

দেখি একখান ওই যে সাঁতারের পোশাক, যারে কয় সুইম সুট, একটা প্লাস্টিকে রাখা, আর তার মধ্যে বালু আর বালু।

তাই তো, তাই তো কথা খুঁজে পাই না আমি।

ভাবেন তো ঢাকা শহরে এতো বালু কোথা থেকে এলো?

বালু, মানে বালি আসতেই পারে। আমি প্রায় ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠতে চাই। শুনুন বলি, মানে  বালির কেসটা আমি বুঝে গেছি। ইট’স সলভ্ড।

মানুষভাই, মানুষভাই, আপনে কি গোয়েন্দা নাকি, একবার শুইন্যাই বুইঝা গেলেন! আর সবকিছুরেই কি কেস কন আপনে?

আরে তা না, কিন্তু আমাকে আপনি মানুষভাই বললেন কেন? অদ্ভুত!

প্রথম কথা আপনার নাম জানি না। দ্বিতীয় কথা, চারদিক বেবাক ফাঁকা। আসা থেকে চারদিকে শুধু পুলিশ আর পুলিশ, মানুষ দেখলাম না একটাও। আপনারেই দেখলাম একটা মানুষ, বিশ্বাস করেন, আল্লাহর কসম। কিন্তু কী বুঝলেন ওই বালু কেসটা কন দেহি।

আমার একটু উৎসাহ কমে গেছে ‘মানুষভাই’ শুনে। লোকটা কি যাত্রা করে? আমি মিনমিন করে বলি, এই কলকাতায়ও তো শুধু বালি আর বালি। এতো হাইরাইজ উঠছে চারদিকে। সবসময়ই বালি উড়ছে, রাস্তাঘাটে বেরোলে সবসময় বালি কিচকিচ করছে। আপনাদের ওখানেও নিশ্চয় বড় বড় বাড়ি উঠছে।

আর কইয়েন না, আমার এক চাচাত ভাই, নবাবপুর রোডে আলিশান মোকাম, একটু পুরানা ঠিকই, কিন্তু বিরাট। সে কয় ওই বাড়ি বেইচা নাকি ফ্ল্যাট করবো বত্রিশ তলা। ভাবেন?

আমি সানন্দে বলি, এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। বালি দেখে ভাবির সম্বন্ধে উলটোপাল্টা ভাবেন কেন? বালি, বালি হচ্ছে সভ্যতার চিহ্ন। এর মানে হচ্ছে নগর বাড়ছে। মানুষ আর চাষাভুষো হয়ে গ্রামে ভূতের মতো থাকতে চাইছে না, তারা উঁচুতে উঠছে। উঁচু উঁচু বাড়িতে থাকছে, উঁচু উঁচু মলে বাজার করছে, হাওয়াই জাহাজে চড়ে উঁচু দিয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। আপনিও নজরটা উঁচু করুন।

লোকটা কি একটু মুষড়ে পড়ল এ-কথায়? আমারই উচিত হয়নি একজন ভিনদেশি মানুষকে এমন করে কথা বলা। আমি ব্যাপারটা একটু হালকা করার চেষ্টা করি।

আপনি কিছু মাইন্ড করলেন নাকি? আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম …

আরে মাইন্ড করি নাই মানুষভাই। আমি একটা অন্য কথা ভাবতেছিলাম। আপনি কইতাছেন বালি সভ্যতার চিহ্ন, তাহলে কি আপনি কইতে চাইছেন মরুভূমি আমাদের সভ্যতার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর?

আমি একটু থমকে যাই। কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়, বৃষ্টির অরণ্য না, নদী না, সমুদ্র না, মরুভূমি কি না আমাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর!

ইয়ে মানে …

শুনুন না, আপনি কইতাসেন উঁচুর দিকে তাকাতে, কিন্তু সুইমিং সুট মানে তো পানি, পানি তো নিচু দিয়েই যায়।

আমি একটু শূন্য চোখে তাকাই, যেন কিছুই বুঝছি না। আমার মনে হয়, লোকটাকে যতটা সরল ভেবেছিলাম, ঠিক ততটা সরল না। কিংবা আমাদের জটিলতা আর ওদের জটিলতা একদম আলাদা।

লোকটা আবার বলে, পানিরে কখনো দ্যাখসেন, উঁচু দিয়া যায়? তাহলে এই পানির কিস্যাটা জানার জন্যে আমাকে তো সেই নজর নিচাই করতে হইতাসে? বুজলেন কি না?

বুঝি বা না বুঝি, মাথা নাড়ি আমি। হঠাৎ আমার মাথায় আবার একটা ভাবনা খেলে যায়।

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, ভাবি মিস ঢাকা কনটেস্টে নাম দিয়েছিলেন। একেবারে প্রাইজ জিতে চমকে দেবেন বলে আপনাকে আগেভাগে কিছু বলেননি।

তা হইতে পারে। এরে কয় সারপ্রাইজ। বিবি কয়, সারপ্রাইজ নাকি পেয়ার-মহব্বতের শরীল-স্বাস্থ্যের জন্যে খুব ভালো।

একজ্যাক্টলি। আমার মিসেসও আমাকে লুকিয়ে মাঝে মাঝে ডায়মন্ড কিনে আমাকে চমকে দ্যায়।

আপনারে ডায়মন্ড দ্যায়? দাদা, আপনে কিন্তু খুব লাকি।

আমাকে দেবে কেন? নিজেকেই দ্যায়, আমাকে দ্যায় ওই যাকে বললেন  সারপ্রাইজ, হেলদি সারপ্রাইজ। যাই হোক, এসব বিউটি কনটেস্টে একটা সুইম সুট ইভেন্ট আছে, জানেন তো?

হ হ জানি, দেখায় তো টেলিভিশনে। কত ছুটো ছুটো দেশ, নামই শুনি নাই, তাগো মেয়েরা আজকাল ওই মিস দুনিয়া হচ্ছে।

শুনুন মিস দুনিয়া যেমন আছে, মিসেস দুনিয়াও তেমনি আছে। সেইরকম কিছু একটাতেই ভাবি পারটিসিপেট করেছেন চুপিচুপি, আর ওই সুইম সুটটা সেখানকার স্মারক।

বাহ, এইডা তো আপনে বেশ বললেন। লোকটার পছন্দ হয় কথাটা, অন্তত পছন্দ করার চেষ্টা করে সে। সে আবার বলে –

এই যে স্মারক কইলেন না, আমাদের দেশে আসলে দেখবেন ভাষা দিবসের স্মারক আছে, মুক্তিযুদ্ধের স্মারক আছে, আমার বিবি সেই দ্যাশের মাইয়া, সে মিসেস দুনিয়ার স্মারক সংগ্রহ করছে। আহা! আহা।

পরক্ষণেই আবার তার ভ্রু কুঁচকে যায়। কী যেন খচখচ করে তার মনের মধ্যে।

সে বলে, কিন্তু দাদা ওই বালু, বালুর কেসটা আপনে কী কইরা সলভ্ করবেন? আমি তো দেখসি বড় বড় পাঁচতারা হোটেলের সুইমিং পুলের পাশে এইসব সুন্দরী খাড়া হইয়া আসে। তো সেখানে বালু আসে কুথা থেকে? সুইমিংপুলে বালু আছে নাকি?

একথায় আমিও চিন্তিত হয়ে পড়ি। বলি, দেখুন আমি সাঁতার জানি না। পুকুরে, নদীতে, সমুদ্রে কোনোদিন ভয়ে নামিনি। সুইমিং পুলেও না। তাই সুইমিংপুল বিষয়ে টেকনিক্যাল নো হাউ আমার নেই। সেখানে বালি আছে কি না আমি বলতে পারব না।

দাদা একটা রিকোয়েস্ট করি। আপনাগো তো এতো বড় শহর, এখানে মেলা হোটেল, কারো না কারো নিশ্চয় আছে ওই টেকনিক্যাল নো হাউ। তাদের কারোরে একটু পুছতাছ কইরা দেখেন না এই বালু কুথা থেকে আসছে।

এবার আমার খুব বিরক্ত লাগে। বলছি, আপনি তো এসেছেন চোখ দেখাতে। বালির খোঁজে আপনার কী কাজ?

দাদা বুঝতাসেন না।  যদি বালুর কেসটা সলভ হয়ে যায়, তবে তো আমায় আর চক্ষু দেখাতেই হয় না। আমার বিবি যে বলতাসে আমার চক্ষুর দুষ, সেইডা তো মিথ্যা প্রমাণ হইয়া যায়। আমি যে বালু দেখি, বিবির পাশে ছোকরা দেখি, ঠান্ডা মেশিনের ভুল হিসাব দেখি – সেইগুলি সত্য। তার মানে আমার চক্ষুর কুনো দুষ নাই। আমি পারফেক্টলি অলরাইট।

কিন্তু আপনি এতো টাকা খরচা করে এদেশে এসেই যখন পড়েছেন,  চোখটা তখন দেখিয়ে নেওয়াই ভালো।

বেবাক সময় নষ্ট। সেই সময়টা আমি এই শহরটা ঘুইরা দেখুম। জাদুঘর, পাতাল রেল আর সমুদ্র ঘুইরা আসন যায়। দীঘা, নাম শুনসি খুব। একেবারে বালুর কারখানা ওইটি। দেইখাই বুঝা যাবে সুইমিং সুটের বালুর সঙ্গে মেলে কি না।  কিন্তু দাদা একটা নদীর গন্ধ পাইতাসি।

নদীর গন্ধ! অসম্ভব নদী দেখতে হলে তো সেই হাওড়ায় যেতে হবে। এতো দূর থেকে নদীর গন্ধ পাবেন কী করে?

পাইতাসি যে। আমার ঘ্রাণশক্তিরে আপনি ইগনোর কইরেন না। ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব …

এই রে, আপনিও কি শাহরুখ খানের ফ্যান নাকি?

ক্যান দাদা? আপনে না?

আমার শালি খুব ফ্যান।

আর আপনে নিশ্চয় শালির ফ্যান! ঠিক কইসি কি না বলেন?

আপনার শালি নেই বুঝি?

আর কইয়েন না। সে বড়ই ব্যস্ত। চাইনিজ ভাষা শিখছে দিনরাত। কয় চায়না যাবে। শ্বশুরের বাসায় গেলে দুই মিনিটও তার দেখা পাই না।

চায়না!

না না, অমন কইরা তাকাইয়েন না। অনেক আগে থিকা শিখসে। কয় নাকি সে ভাষাটার প্রেমে পড়সে। তয় মিথ্যা কমু না, সে আমারে একদিন চাইনিজ রাইন্ধা খাওয়াইসে আর চাইনিজ ভাষায় রবীন্দ্রগীতি শুনাইসে – ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’। সে কী মিষ্ট কী মিষ্ট কী কমু। আমি একটা কথা সার বুজসি দাদা, বউ যতই আপনার বাড়া ভাতে বালু দিক, শালিরা কিন্তু বদলায় না, ভাষার মতোই ওদের টান।

আমি একথায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। এ-সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। এই লোকটাকে বাড়ি নিয়ে যাব না বলে শালির গল্প ফেঁদেছি। আমার শালি-শাশুড়ি কিছুই নেই। বউও না। আমি যার সঙ্গে লিভ ইন করি, সে বাইরের মানুষজন মোটেই পছন্দ করে না। তার একটা নিজের বৃত্ত আছে। তাদের নিয়ে শনিবার শনিবার পার্টি হয়। মানে আগে হতো। এখন সব বন্ধ।

সে তাই অনলাইনে সারাদিন দীর্ঘ দীর্ঘ ভিডিও কল করে দরজা বন্ধ করে। যখন দরজা খোলে, আমি সেই ঘরে বালির গন্ধ পাই। আজ অনেকদিন পর বাইরে এলাম। লিফটে জল ঢুকেছিল, আমি হেঁটে হেঁটে আটতলা সিঁড়ি ভেঙে নেমে পুরনো শহরটাকে খুঁজছি। শুধু চায়ের দোকানটা আছে, আর কিছু নেই। হঠাৎ আমার মাথায় একটা প্রশ্ন উঁকি মারে।

আপনি কী করে এলেন? ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট তো এখনো চালুই হয়নি।

আমার কিছু লাগে না দাদা। আমি যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারি। আমার হঠাৎ মনে হইল নদীর গন্ধ পাইতাসি। সেই খোঁজে খোঁজে চলে এলাম। ওই গন্ধটাই আমার ভেহিক্যাল।

আপনি বলতে চাইছেন, আপনি গন্ধের পিঠে চড়ে চলে এসেছেন এখানে। আর সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলছেন?

বিশ্বাস করা না করা আপনার নিজস্ব ব্যাপার। অবিকল সেই সুরে বলল লোকটা যে-সুরে ট্রেনের হকাররা বলে ‘কেনাকাটা আপনার নিজস্ব ব্যাপার, কিন্তু নেড়েচেড়ে দেখলে পয়সা লাগে না।’

আমি বুঝলাম লোকটা আসলে একজন জাত ফেরিওয়ালা। ও আমাকে কিছু একটা গছাতে চাইছে। আমি তেরিয়াভাবে বলি –

শুনুন, তখন থেকে কী গছাতে চাইছেন বলুন তো? বালি, সুইম সুট, না নদী?

চাপ নিয়েন না। আমি বেচুবাবু না। তবে আমার একখান অ্যাজেন্ডা আছে।

অ্যাজেন্ডা!

হ। আমি নতুন মানুষ দেখলে একটা টেস্ট রান করি। এই গল্পটা ছাইড়া দি, এই গল্প শুনলে ১০০ জনের মধ্যে সাড়ে সাতজন তাদের বাসাতে দাওয়াত দ্যায়। আমি তখন বুঝতে পারি।

সাড়ে সাত মানে?

মানে আট নম্বর লোকটির সঙ্গে তার বাসায় যেতে যেতে, হঠাৎ তার ফোন বাজে। সে খুব চেতাইয়া কথা কইতে থাকে, তারপর রাইখা কয়, সরি আমারে অফিসে ফিরতে হবে এক্ষুনি, আপনারে আর খাওয়াইতে পারলাম না।

ওহ!

কিন্তু কেসটা কি জানেন স্যার, ওইটা তার ফলস ফোন। আমারে অ্যাভয়েড কইরতে চায় আর কি। কিন্তু সে তো আমারে দাওয়াত দিসিল? তাই উনারে আধখানা মানুষের রেটিং দিলাম।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকি। আমি তো দাওয়াতও দিইনি, আমার রেটিং কত হবে, সিকি, নাকি কিচ্ছু না?

দেখুন আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি আদৌ বাংলাদেশ থেকে আসেননি, শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন আমার।

হুদাই করি নাই। আমি একটা টেস্ট রান নিই কইলাম না? যে নতুন শহরে যাই, সেই শহরটার একটা টেস্ট রান নিই। যেমন কোনো স্ট্রাকচার বসানোর আগে সয়েল টেস্ট হয়।

তো?

আমিও শহরের একটা স্ক্যান কইরা বুঝতে পারি, শহরটার নিচে পানি আছে কি না, পানি না থাকলে আমি পানি নিয়া আসব, নদী না থাকলে নদী নিয়া আসব। শুধু সমুদ্রটা আমি ঠিক দেখিনি এখনো, তাই দেখতে যাচ্ছি। টেনশন নেবেন না, কোথাও না কোথাও খাইয়া নিব। তবে সমুদ্র কোনো শহরে না আনাই ভালো। সে চেষ্টাও আমি করুম না।