সুফিদর্শন ও নাগরিক জীবনের বয়ান

মহি মুহাম্মদ সমসাময়িককালের প্রতিশ্রুতিশীল

কথাসাহিত্যিকদের একজন। দলিত-নিষ্পেষিত, অস্পৃশ্য মানুষের নিত্যদিনের দুঃখ-কষ্ট, শোষণ-বঞ্চনা, তাদের কাম ও কামনা, স্বার্থ ও সংকীর্ণতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কার তাঁর রচনার উপজীব্য। আজকের আলোচনার বিষয় তাঁর নয়নপোড়া উপন্যাস।

এ-উপন্যাসে আছে রহস্য, রোমাঞ্চ, সুফিতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবাদের কথা। উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয় কুতুব নামে এক তরুণ সাংবাদিককে ঘিরে। কুতুবের পরিচিতি পর্বের পরপরই শুরু হয় উপন্যাসের রহস্যময়তা। এক সকালে চিফ এডিটরের ফোন পেয়ে অতিব্যস্ত হয়ে সে রওনা দেয় নয়নপোড়া গ্রামের দিকে। চিফের নির্দেশ, নয়নপোড়া গ্রামের ফজর আলী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা। গ্রামটির নাম যে ‘নয়নপোড়া’, তার পেছনেও রয়েছে এক মর্মান্তিক ও রহস্যময় ইতিহাস, যা জানা যায় উপন্যাসের শেষভাগে।

কুতুবের নয়নপোড়া গ্রামে যাত্রার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে যায়। যাত্রাপথে আদিবাসী মেয়ে দিয়ানার সঙ্গে আলাপের সুখকর স্মৃতি, বৃষ্টির বিড়ম্বনা, অচেনা জায়গায় রাত কাটানোর অনিশ্চয়তা, মোবাইলে চার্জ শেষ হয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার অসহায়ত্বের মধ্যে সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে কে যেন তাকে বলে ওঠে, ‘কই যাইবেন? নয়নপোড়া? এত রাইতে নয়নপোড়া যাইবেন কেন?’ সেই ঘোর অন্ধকার রাতে আলোকবর্তিকা হয়ে যে-লোকটি তার কাছে এগিয়ে আসে তিনিই ছিলেন রহস্যমানব ফজর আলী। তাঁকে অনুসরণ করে নয়নপোড়া গ্রামের উদ্দেশে যেতে থাকে কুতুব। চলতে চলতে ফজর আলীর সঙ্গে কথোপকথনে কুতুব আবিষ্কার করে তাঁর জীবনের লুকিয়েরাখা কষ্ট, অজানা কাহিনি ও আধ্যাত্মিকতা।

একসময় ফজর আলীর সঙ্গে কুতুব পৌঁছে যায় সুফি গোলাম সারওয়ার মুরাদ সীতাকুণ্ডীর আস্তানায়। এ-পর্যায়ে পাঠক জানতে পারে গোলাম সারওয়ার মুরাদুল ইসলামের সুফিসাধক হয়ে ওঠার কাহিনি। এক্ষেত্রে নয়নপোড়া উপন্যাসের সঙ্গে রবিশংকর বলের আয়নাজীবন উপন্যাসের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। কারণ পর্যটক ইবনে বতুতার কথনে বর্ণিত আয়নাজীবনের কেন্দ্রে আছে মওলানা রুমির জীবন। ইসলামি ধর্মবেত্তা ও পণ্ডিত জালালুদ্দীন বলখি থেকে মওলানা রুমি হয়ে ওঠার আখ্যান আয়নাজীবন। নয়নপোড়ার কাহিনিও

ঠিক তেমনই। কুতুব ও ফজর আলী মুরাদের খোশগুলবাগে গিয়ে দেখে লাল গালিচা আচ্ছাদিত ও মোম জোছনা পরিবেষ্টিত এক রহস্যাবৃত জলসাঘর। সেখানে নাহিয়ান নামে এক যুবকের কাওয়ালির সুরমূর্ছনায় বুঁদ হয়ে যায় কুতুব। সে ভুলে যায় নিজের পরিচয়। সে কোথা থেকে এসেছে, উদ্দেশ্য কী? সে যেন যুগ যুগ ধরে এখানেই বসে আছে। সুফি সাধকদের পথ অনুসরণ করছে।

মুরাদ আর ফজর আলীর কথাবার্তা যখন তুঙ্গে, তখন কুতুব কোথায় যেন জিকিরের সুরেলা ধ্বনি শুনতে পায়। তার মনকে আলোড়িত করে এ-ধ্বনি। কিন্তু কোন কক্ষে এই জিকিরজলসা বসেছে সে বুঝতে পারে না। কেবল হারমোনিয়ামের তীক্ষ্ন শব্দ তাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে। সুফিগায়করা যেমন চক্রাকারে ঘূর্ণিনৃত্যে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন, জিকিরের এই বর্ণনাভঙ্গির মধ্যেও দেখা যায় সে-মেজাজ।

মুরাদ ও সাবিনা বিনতে ওয়াজেদের গড়া খোশগুলবাগ কুতুবকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। সে জাগতিক ও পার্থিব সবকিছু ভুলে যায়। নয়নপোড়ার যাত্রী কুতুব তার গন্তব্য ভুলে ডুবে যায় সুরের গহিনে। কুতুব ভাবে, যদি শহরে ফিরে না গিয়ে খোশগুলবাগে থেকে যেতে পারত, তাহলে কী এমন ক্ষতি হবে? কে তাকে খুঁজবে? কুতুবের এমন ভাবমত্ততার মধ্য দিয়েই নয়নপোড়া উপন্যাসের সুফিতাত্ত্বিক তথা আধ্যাত্মিক জীবনদর্শন ফুটে ওঠে।

কুতুবের এরূপ আধ্যাত্মিক ভাবমত্ততার হাত ধরে এ-উপন্যাসে আসে পদ্মাবতী ও বৈষ্ণব পদাবলীর প্রসঙ্গ। আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যে পদ্মাবতীর রূপবর্ণনা এবং বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধার রূপবর্ণনার অভিনবত্ব নয়নপোড়া উপন্যাসকে এক ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায়। লেখকের বর্ণনায় আলাওলের পদ্মাবতীর চোখ খঞ্জনা পাখির চোখকেও হার মানায়, যা দেখে হরিণরা বনে লুকায়। তার পা পর্যন্ত লম্বা চুলে মৃগনাভির সৌরভ। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধা বাইরে এলে হঠাৎ যেন মেঘের কোলে বিদ্যুৎ চমকে যায়। সেখানে অল্পবয়সী রাধাকে ফুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

খোশগুলবাগ থেকে এক সময় কুতুবের বের হওয়ার সময় আসে। তখন সে উপলব্ধি করে যে, এখানে অত্যন্ত সুচারুভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে মওলানা জালালুদ্দীন রুমির জীবন। জালালুদ্দীন রুমি ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনীষী। তিনি ছিলেন একাধারে সুফিতত্ত্ববিদ, মৌলবিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা, সর্বোপরি একজন সাধক পুরুষ। সুফিদর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচনা করেছেন। তিনি যে মরমি দর্শনের বাণী কাব্যিক ছন্দে প্রকাশ করেছেন, তার মধ্যে প্রেমতত্ত্ব অন্যতম। জালালুদ্দীন রুমি তাঁর বিখ্যাত মসনবি কাব্যে এক বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রেমের রূপরেখা প্রণয়ন করেন। সেই মসনবি কাব্যের বিভিন্ন কবিতার লাইন আমরা নয়নপোড়া উপন্যাসে মুরাদের কণ্ঠে শুনতে পাই।

খোশগুলবাগকে বিদায় জানিয়ে কুতুব আবার রওনা হয় নয়নপোড়ার পথে। কিন্তু শেষ হয় না সে-রহস্যময় পথ। ফজর আলীর শায়েরি শুনতে শুনতে কুতুব এক ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যায়। এ-ঘোরের মধ্যে জীবন-জগতের সবকিছু যেন পানসে মনে হয়। লেখক এই পর্যায়ে নয়নপোড়া গ্রামের নামকরণ নিয়ে ফজর আলীর কথনে এক লোমহর্ষক কাহিনি উপস্থাপন করেন। যদিও নয়নপোড়া উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সুফিতত্ত্ব এবং অধ্যাত্মবাদ, তবু এ-উপন্যাসে মানবীয় প্রেমানুভূতির বিষয়গুলো একেবারে উপেক্ষিত থাকেনি। কারণ নয়নপোড়া গ্রামের নামকরণের পেছনেও রয়েছে দুজন মানব-মানবীর বিয়োগান্ত প্রণয়গাথা। তাছাড়া রয়েছে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুতুবের সঙ্গে তামারার প্রেমঘটিত সম্পর্কের অম্ল-মধুর রসায়ন।

নয়নপোড়া গ্রামে পৌঁছানো নিয়ে পুনরায় রহস্যের জাল বিস্তৃত হতে থাকে। এরপরই উপন্যাসে চমক দেখা যায়। সেটা এমন – যার ফোন পেয়ে কুতুব নয়নপোড়ায় গিয়েছিল, সে আসলে কুতুবকে ফোনই করেনি। তাহলে কে ফোন করেছিল কুতুবকে? এ-প্রশ্ন ঘিরে সৃষ্টি হয় গোলকধাঁধা। অবশেষে কুতুব ফিরে এলো তার চিরচেনা শহরে। নাগরিক জীবনের কোলাহলে হারিয়ে গেল তার সাধকমন।

কাহিনি, চরিত্র, আঙ্গিক, শব্দচয়ন, বর্ণনাভঙ্গি – সবদিক থেকে বিচার করলে নয়নপোড়া উপন্যাসটিতে স্বতন্ত্র স্বর নির্মাণে প্রয়াসী হয়েছেন মহি মুহাম্মদ। তাঁর সে-প্রচেষ্টা কতটা সফল তার বিচার করবেন তাঁর পাঠকেরা।