হৃদয়ের দুয়ার খোলার চাবি

হিম যন্ত্রাংশ ষ শামীম হোসেন ষ চন্দ্রবিন্দু ষ ঢাকা, ২০২১

২০০ টাকা

‘সেই বোবা ছেলেটির কথা আজ মনে নেই।/ ধুলোচাপা পথের কিনারে যে একদা ফুল হয়ে ফুটেছিল।’ – (‘বিস্মৃতি’) অভিবাসন-প্রত্যাশী শিশু আয়লানের কথাটি হয়তো আমাদের মনে আছে। শঙ্খের মতো সাদা মায়াবী শ্রীমুখ, হিমশীতল সমুদ্রের কূলবর্তী জলে অর্ধভাসমান স্থির চোখে পৃথিবীর দিকে চেয়ে থাকা সে-দৃষ্টি কেউ এড়াতে পেরেছি আমরা? আয়লানের একজোড়া হিমচোখে কী লেখা ছিল সে-কথা অজানা নয়। কিংবা সেই শিশুটির কথা? রক্তস্নাত হয়ে হিমশীতল মৃত্যুর পূর্বে আগুনচোখে শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে ইসরায়েলি সেনাকে উদ্দেশ করে যে বলেছিল, ‘আমার ঈশ্বরকে (আল্লাহ) আমি সব বলে দেব।’ মনীষী এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টারা বারবার বলেছেন, নিজেদের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদে জড়িয়ে পড়া মূর্খতারই নামান্তর। তাঁদের কথা অনুযায়ী চললে আবার আমরা নতুন করে সুখ-শান্তি গড়ে তুলতে পারব। কোন কোন জিনিসকে এড়িয়ে চলা দরকার, সেটুকু দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি মনীষীরা। প্রদীপ্ত সৌন্দর্য আর আশ্চর্য দ্যুতিময় এক পৃথিবী গড়ে তোলার শক্তিও যে মানুষের আছে, তাও দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। কবি, সুরস্রষ্টা, চিত্রকরদের কথা ভাবুন। তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি মহিমময় ঔজ্জ্বল্যে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছে স্বপ্নরাজ্যের ছবি। স্বপ্নের সেসব দেশ আমাদের হতেই পারে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও হয়ে উঠতে পারে গীতিকাব্যের মতো সুন্দর। নারী-পুরুষের ভালোবাসায় কখনো কখনো এই ধরনের একটা ছবি অনেকের কাছেই মূর্ত হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেল এই কথাগুলোই বলেছিলেন, যখন তাঁর মনে দ্বিধা ‘মানুষের কোনো ভবিষ্যৎ আছে?’ ‘এইসব ধূম-ধোঁয়াশা আতশবাজির অরণ্য থেকে দূরে কাছিম-স্বভাবে ঝিম মেরে বসে আছে এক তুলতুলে খরগোশ।/ কচি কচি ঘাসের ডগায় ছড়িয়ে দিয়েছে পা।/ তারো দূরে সূর্য-আগুনে পুড়ে যাচ্ছে পাখিবিমানের মিলন রানওয়ে।’ (‘ছলদৃশ্যের সেলাই’)

‘রাতে একাকী দাঁড়িয়ে আগুনগাছ/ ফুটেছে আগুনফুল -/ বাকলে হিম। শরীরে লু হাওয়া,/ চোখ ধাঁধানো -/ ফুলে ফুলে বসন্ত থাকে না!’ (‘মেঘের ক্ষরণ’) মানুষ তার ব্যক্তিজীবনে যেভাবে যতটুকু বেড়ে ওঠে ততটুকুই তার পরিচয়। তার জন্ম কোথায়, কীভাবে, কার ঘরে, কোন পরিচয়ে – এসব বিষয় একান্তই গৌণ। এর চেয়ে সে বেড়ে উঠল কোন পারিপার্শ্বিকতায় এবং তার বর্তমান পরিচয়ই মুখ্য। ‘জন্ম সত্য জেনে যাপনে রাখি ক্ষরণের পাহাড়।/ ডিঙির আলোর মতো আমাদের জীবনের ভাঁজ।’ (‘মাছির গুঞ্জন’)  জন্মের কারণে মানুষকে হীন বা উচ্চ জ্ঞান করা বাতুলতা মাত্র। বার্ট্রান্ড রাসেল এ-সম্পর্কে বলেন, ‘মানবচরিত্রের দশ ভাগের ন’ভাগই গড়ে ওঠে পরিবেশের প্রভাবে, মাত্র এক ভাগের জন্য দায়ী থাকে জিনগত কারণ। পরিবেশের প্রভাবে যে-অংশটি গড়ে ওঠে সেই অংশটিই উপযুক্ত শিক্ষার সাহায্যে নতুন পৃথিবীর পক্ষে মানানসই করে তোলা যেতেই পারে। এমনকি জিনগত কারণ যে-অংশটিকে প্রভাবিত করে সেই অংশটিও হয়তো একদিন বিজ্ঞানের সামনে নতিস্বীকার করবে। পরিবর্তনকালীন এই পর্যায়টি সফলভাবে অতিক্রম করা গেলে যে-পৃথিবীতে পা রাখব আমরা, সে-পৃথিবী কেমন হবে? সে-পৃথিবীতে কীভাবে কাজ করবে

শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান? যাবতীয় ভয় থেকে, ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ভয় আর রাষ্ট্রীয় স্তরে যুদ্ধের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার ফলে মানুষের কর্মোদ্দীপনা এক অকল্পনীয় উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। অদ্যাবধি মানুষের যাবতীয় আশা-আকাক্সক্ষা-কল্পনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য বিধিনিষেধ। দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই জীবনের ওপারে এক স্বর্গলাভের আশার আশ্রয় নিয়েছে সে। নিগ্রোদের আধ্যাত্মিক গানে এই ভাবনাটা ব্যক্ত হয়েছে এইভাবে, ‘ঘরে যখন ফিরবো আমি, ঈশ্বরকে জানাবো আমি আমার সকল দুখের কথা।’ কিন্তু স্বর্গের আশায় বসে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই।’ এতো কথার ফিরিস্তি দেওয়ার কারণ হিম যন্ত্রাংশ। ‘কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের আগে একদা এক পাহাড়ি ঝরনায় স্নান করেছিলেন।/ তার দুরবিনে ধুলো জমে গেলে মসলিন আনতে বঙ্গদেশে পাঠালেন লোক। এ কথা মিথ্যে হলে শালিক পোড়ানো দুপুরে আমার দণ্ড কার্যকর হোক।’ (‘প্রলাপের পাখা’)

এখন পাঠকের হাতে হিম যন্ত্রাংশ। ‘নালিশের তুলা তুমি বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে যেও না গাছভাই!/ ভোর হলে কুড়িয়ে এনো পাকা ডুমুরের রাশনাই।’ পাঠ চলছে হিম যন্ত্রাংশের কবিতাবলি। তার পূর্বে রুশ সাহিত্যচিন্তক ও সমালোচক ইলিয়া এরেনবুর্গের কাছে ফিরে যাওয়া যেতেই পারে, ‘বই পড়া হচ্ছে একটি সৃজনশীল প্রক্রিয়া। বই পড়ার সময় পাঠক এমন কাজ সম্পাদন করে যা লেখকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাঠকের কল্পনা গল্পবয়নের ফাঁককে ভরাট করে নিজলব্ধ অভিজ্ঞতার নিরিখে। ভিন্ন ভিন্ন পাঠক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে দেখে। চরিত্রগুলো রঞ্জিত হয় বা বিবর্ণতা পায়, উন্নত বা খর্বিত হয় পাঠকের কল্পনাশক্তির নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। ঠিক এরকমই কিছু একটা লেখকদের ক্ষেত্রেও ঘটে। কোনো জিনিস তাঁদের নজর কেড়ে নেয়, আবার অন্যটা হয় উপেক্ষিত।  তাঁদের  বিস্মরণশীল  মন  বা  অলস  প্রকৃতির  জন্যই এমনটা হয়, তা নয়। তাঁদের জীবন ও প্রকৃতি বিশিষ্ট উৎপাদনে গঠিত হয় বলেই এটা হয়। হৃদয় প্রবেশের প্রশ্নে লেখক মাত্রেই কারো কারো ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় পারঙ্গম, আবার অন্যদের বেলায় তাঁদের বুঝতেই চান না, নয় তো বা বোঝার ক্ষমতা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। হৃদয়ের দরজা খোলার চাবিকাঠি প্রত্যেক লেখকেরই হাতে থাকে, কারো কম, কারো বেশি। কিন্তু এমন একজন লেখকও অদ্যাবধি জন্মাননি, সব মানুষেরই হৃদয়-দুয়ার খোলার চাবি যার করায়ত্ত।’ উপন্যাসের চরিত্র সম্পর্কে ইলিয়া এরেনবুর্গ আরো বলেন, যেহেতু উপন্যাসের চরিত্রেরা লেখকের কাছে জীবন্ত মানুষরূপে প্রতিভাত, সে-কারণেই লেখক তাদের ভালোবাসেন। তাদের আনন্দ-উল্লাসের তিনি সমভোগী। কথাটা কতখানি সত্য জানি না, শুনেছি বালজাক যখন পিয়ের গরিয়ের মৃত্যুদৃশ্য চিত্রিত করছিলেন, তিনি তখন অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করেন এবং ডাক্তার ডাকতে পর্যন্ত চেয়েছিলেন। শোকসন্তাপে হৃদয় যদি আকুলিত না হয় তবে একজন লেখক কেমন করে তাঁর প্রিয়তম চরিত্রের মৃত্যুদৃশ্য বর্ণনা করবেন? আমি আরো এগিয়ে বলতে চাই, প্রকৃত মৃত্যু ঘটবার অনেক আগেই লেখক বহুবার মৃত্যুযন্ত্রণায় জর্জরিত হন। বালজাক ছিলেন অকপট। তিনি অনেক কিছুই খোলাখুলি বলেছেন, যা অন্য লেখকেরা নিজেদের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কাছেও গোপন করে থাকেন। কবিতার ক্ষেত্রেও কথাগুলো সমানভাবে সত্য। ‘মেঘ আমার দেহে থাকে চোখে সমুদ্র/ তোমাকে বলেছি আমি গুহাচিত্র দেখো/ প্রবহমান স্রোতের উজানে হেঁটে -/ দাঁড়াও দিগন্তে।’ (‘বাধার পাহাড়’) কিংবা ‘টর্পেডো মাছের পেটে শুয়ে শুয়ে ভাবি -/ দহন শেষ হলে মাঠজুড়ে নদী বুনে দেবো।’ (‘গ্রাস’)

নাম কবিতা ‘হিম যন্ত্রাংশ’ স্বল্পায়তনের একটি কবিতা। আর একটু খোলাসা করে বলা যায়, ছোট, তবে সূক্ষ্ম। কবিতাটি পাঠ করে পাঠককে কবি শামীম হোসেনের অনুভবের সঙ্গে একাত্ম হতেই হবে এবং পাঠককে অনুভব করতে হবে যে, অনুভূতিগুলো তার নিজের এবং তার ভেতরের মানুষকে তিনি নিয়তই একত্রবাসে লালন করে চলেছেন। পুনরায় ইলিয়া এরেনবুর্গের শরণাপন্ন হতে হয়, যা হিম যন্ত্রাংশের কবিতাগুলোর কপাট খুলে দেয় – ‘একজন বাস্তব মানুষের

প্রতিকৃতি অঙ্কন করতে কবিতা বিশ্বস্ত মাধ্যম নয় বলে মনে হতে  পারে  কিন্তু  আমরা  সকলেই  ভেসিলি  তিয়রকিনের  সঙ্গে পরিচিত, এবং তার সঙ্গে আমরা বহুবার সাক্ষাৎ করেছি, এরকম একটা বোধ আমাদের সকলের মধ্যেই সক্রিয়।’ কবিমাত্রই অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়েও সৃষ্টিশীল কাজটি অব্যাহত রাখেন। তাঁর জীবনেও নিজস্ব কিছু ত্রুটি বা দুর্বলতা থাকতে পারে, তবু তিনি নিজস্ব ধরন-ধারণে জীবনযাপন করেন, প্রেমে পড়েন, ঈর্ষায় পীড়িত হন, আশা-নিরাশায়, আনন্দে-দুঃখে এক জীবনে পরিপূর্ণ থাকেন। হিম যন্ত্রাংশের কবিতাগুলোও যেন সে-কথাই প্রতিধ্বনিত করে। অনেকটা শঙ্খের ভেতরে সমুদ্রের শব্দ শোনার মতো অনুভূতি জাগায়। কবিতার শিরোনাম এবং বিষয় নির্বাচনেও পাঠক সে-স্বাদ অনুভব করেন প্রকারান্তরে আপন সাধকে সাধ্যের সীমায়িত প্রান্তরে দুই মলাটের ঠাসা কুঠুরিতে। হিম যন্ত্রাংশের নবত্ব এখানেই। শামীম হোসেন কবিতার সঙ্গেই বসবাস করেন। কবিতাই একমাত্র আরাধ্য তাঁর জীবনযাপনে। হিম যন্ত্রাংশের পরিণতি উপলব্ধ হয় তার চলমান কবিতার ক্যাফেতে প্রবেশ করলেই। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে – বরেন্দ্র প্রান্তরে বসন্ত নামে (২০০৭), পাখি পাখি ভয় (২০১১), উপমাংসের শোভা (২০১২), শীতল সন্ধ্যা গীতল রাত্রি (২০১৩), ধানের ধাত্রী (২০১৫) এবং ডুমুরের আয়ু (২০১৭)। ছড়াগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে – এক তুড়ি ছয় বুড়ি (২০০৮) এবং গাছভাই নাচভাই (২০১৭)।

হিম যন্ত্রাংশ শামীম হোসেনের সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। রাজীব দত্তের প্রচ্ছদে, চন্দ্রবিন্দু থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১। হিম যন্ত্রাংশের কবিতাবলি দুটি গুচ্ছে বিভক্ত। প্রথম গুচ্ছের শিরোনাম ‘লীলার জ্যামিতি’। এখানে স্থান পেয়েছে ৩৮টি কবিতা। ‘বরফ কলের ঘ্রাণ’ শিরোনামে দ্বিতীয় গুচ্ছে স্থান পেয়েছে ১৪টি কবিতা। সর্বসাকল্যে হিম যন্ত্রাংশের মলাটের ভেতর স্থান পেয়েছে ৫২টি কবিতা। নাম কবিতা হিম যন্ত্রাংশ প্রথম গুচ্ছ ‘লীলার জ্যামিতি’র অন্তর্ভুক্ত ২৮ নম্বর কবিতা।

শামীম হোসেনের কবিতা লেখা ও জীবনযাপন সমান্তরাল। কবিতা লেখার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত তিনি। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার (২০১৫), রূপান্তর সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩), রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (২০১১), অধ্যয়ন শিশু ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৬), বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), কবি-সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ স্মৃতিপদক (২০১৭)।  ‘তোমার আঙুলের নখের কাছে একটা রাত কাতরাচ্ছে খুব …/ তোমার ঠোঁটের কাছে তিরতির করে কাঁপছে একটা ফড়িঙ …’ – (‘মিলিয়ে যাবার আগে’) এই পৃথিবীর বুকেই সুখময় হয়ে উঠতে পারে জীবন। কল্পনাকে প্রকাশ করার জন্য অতিকথার আশ্রয় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সুন্দর পৃথিবীতে কবিতা হোক অনুষঙ্গ, হৃদয়ের দুয়ার খোলার চাবি হোক হিম যন্ত্রাংশ।