‘বিদ্রোহী’ – শতাব্দীর কণ্ঠস্বর

একশ বছর মহাকালের হিসাবে কম সময়; কিন্তু মানবেতিহাসের অঙ্কে এক শতাব্দী। এই একশ বছর নেড়ে দেখলে আমরা পাব প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, জাতিগত দাঙ্গা, দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই একশ বছরে দুজন কবি আমাদের সংস্কৃতিজগতে দারুণভাবে আলোচিত ও প্রভাবদায়ী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল ইসলাম ১৯২০ সালে অতর্কিতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে ভারতবর্ষের কবিতাজগতের সকলকে চমকে দেন। শুধু কাব্যজগৎ নয়, রাজনৈতিক জগতেও বিদ্রোহী কবিতার অভিঘাত লাগে। সেই অভিঘাতের ধারা এখনো সচল আছে। এই একশ বছরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তার অভিঘাতের রূপ বদলেছে; কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা বিনষ্ট হয়নি। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বিদ্রোহী শব্দটি ছিল দারুণ কাক্সিক্ষত শব্দ।

কিন্তু বিশ শতকের শেষদিকে শাসকশ্রেণি এবং শোষকশ্রেণি ‘বিদ্রোহী’ শব্দটিকে আইনের চোখে সন্দেহজনক করে তোলে। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বিদ্রোহী’র  দ্যোতনাকে গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা তেমন উৎসাহী নই। কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পাঠ করেন এবং শোনেন – তাঁদের কাছে এ এক সম্মোহনী শক্তির মতো।

আমরা আশির দশক পর্যন্ত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার যে-সমাদর দেখেছি, বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জাতীয় কবিতা উৎসবের সময়, তার তুলনা হয় না। এমনকি নজরুল জন্মশতবার্ষিকীর সময়েও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাভিত্তিক নৃত্য ও আবৃত্তি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ শতবর্ষে ‘বিদ্রোহী’ উদ্যাপন। পরাধীন ভারতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশিষ্ট সমাজচিন্তক প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন – ‘আমরা বিদ্রোহী কবিতা পাঠে একেকজন অতি মানুষে রূপান্তরিত হইবো। ভীরু দুর্বল ভারতবাসীকে জাগাতে নজরুল আমাদের অবলম্বন।’

এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নজরুল জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক ও গবেষক হেনরি গ্লাসি বলেন, ‘বিশ শতকের তিনটি শ্রেষ্ঠ কবিতার মধ্যে  ‘বিদ্রোহী’ একটি। আরো দুটি শ্রেষ্ঠ কবিতা ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘সেকেন্ড কামিং’ এবং টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’।’

বিশ শতকের অবক্ষয়, বিমানবিকতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, বিচারহীনতা, উপনিবেশ তৈরির নতুন কৌশল, তৃতীয় বিশ্বের জাতিগত দাঙ্গা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, সীমান্তে সহিংসতা, গণতন্ত্রীদের নতুন ফন্দি, পারমাণবিক প্রতিযোগিতা, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নগ্ন আগ্রাসন এই তিনটি বিশ্বজয়ী কবিতাকে তুল্যমূল্য করে তুলেছে। তবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নানা পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এখনো মানুষের নিত্যপাঠ্য ও উচ্চার্য  কবিতা। এখনো কোনো তরুণ কবি কবিতা লেখার প্রারম্ভে ‘বিদ্রোহী’ দ্বারা প্রভাবিত হন। নজরুলের সমকালে যেমন ছিল আজো তার ব্যতিক্রম নয়। অডেন কোনো রচনায় প্রথম পুরুষের উপস্থিতিকে সেন্ট্রাল আই বলে শনাক্ত করেছিলেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিত্ব সেন্ট্রাল আইয়ের সমার্থক। দান্তের ‘ডিভাইন কমেদিয়া’ পাঠ করে পল ক্লোদেল এক খেরো খাতায় লেখেন ইনফার্নো, প্রারগ্যাটোরিও এবং প্যারাডিসোতে যেসব দৃশ্যের বর্ণনা আছে সেরকমই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ‘বিদ্রোহী’র উত্তেজক টেক্সটের মধ্যে আছে আতিশয্যের অভিব্যক্তি। এ-আমরা বিশ্বাস করে নিতে বাধ্য হই যে, তা প্রথম পুরুষে লেখা। ‘বিদ্রোহী’র ভেতর দিয়ে আমরা পাই পরাধীন জাতির বেদনা, পরাধীনতার ভেতর থেকে জেগে ওঠা এবং প্রায়শ্চিত্ত করার অঙ্গীকার। আমরা চারভাবে ‘বিদ্রোহী’ পড়তে পারি। আক্ষরিক অর্থে বা সাহিত্যরূপে, আদর্শিক পৌরাণিক ব্যাখ্যায়, রূপক রূপে এবং আবৃত্তির মর্যাদায়। ‘বিদ্রোহী’ এক মহৎ কবিতা, সে উচ্চারণ দাবি করে। মহৎ বা চিরায়ত কবিতা এই অর্থে যে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – যে-সাহিত্য সমকালের হয়েও চিরকালের, নিজের হয়েও সকলের। শতবর্ষে ‘বিদ্রোহী’ সকলের হয়ে উঠেছে এবং সমকালের সেতু পার হয়ে চিরকালের পথিক হয়ে উঠেছে। উত্তম পুরুষে লেখা ‘বিদ্রোহী’। আমরা যখন কাব্যিক আস্থা নিয়ে উচ্চারণ করি :

বল বীর

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি আমারি, নতশির ঐ

শিখর হিমাদ্রির!

তখন আমরা অবিশ্বাসকে স্থগিত রেখে বিশ্বাস করি যে, আমরা বীর হয়ে উঠেছি। প্রায় একশ বায়ান্ন পর্যায়ে ‘আমি’র ব্যবহার কবিতাটিকে ক্লিশে করে না বরং ক্রমোন্নয়ন ঘটায় এবং আমাদের হিমালয়ের চূড়ায় উঠতে প্রাণিত করে। এক ইউলিসিসের অভিজ্ঞতা হয় আমাদের, আমরা তখন আমাদের পরিচালন ভার দিয়ে দিই কবিতার হাতে। পৌরাণিক চরিত্রগুলো মহাকাব্যের জগৎ থেকে আমাদের স্বজন হয়ে ওঠে এবং আমাদের সঙ্গে ন্যায়যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তখন চেঙ্গিস,  চণ্ডী, পরশুরাম, ভৃগু, ইন্দ্রাণী, ইস্রাফিল, জিব্রাইল, অর্ফিয়ুস এক কেন্দ্রে এসে মিলিত হয়। পথ আলাদা, উদ্দেশ্য এক :

মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেইদিন হবো শান্ত

যবে-উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –

বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত

আমি সেই দিন হবো শান্ত।

শোষণমুক্ত এক সর্বমানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইতিহাসের, ধর্মগ্রন্থের, পুরাণের শক্তিমান বীরগণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

‘বিদ্রোহী’র কোনো শেষ নেই। যখনই পৃথিবীতে দুঃশাসন ও অবিচার নামবে তখনই বীরগণ আবির্ভূত হবেন :

আমি চির-বিদ্রোহী বীর –

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!

প্রায় একশ পঞ্চাশ চরণের কবিতা; কিন্তু মহাকাব্যের চিরন্তন ঐশ্বর্য ও আবেগে দীপ্যমান ‘বিদ্রোহী’। রবীন্দ্রনাথ প্রতিপক্ষকে বলেছিলেন, ‘তোমরা নজরুলের কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়োনি। পড়লেও হৃদয় দিয়ে অনুভব করোনি। যে-কবিতা যুগের দাবি মেটায় তা কাব্য নয় মহাকাব্য।’ 

   এই মহাকাব্যিক স্বীকৃতি আমাদের দেয় অবিচল আস্থা। চিরকালের জন্য নির্ণীত হয়ে যায় বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং মহান অতীতে বিদ্রোহীর কণ্ঠস্বর।

ছবি : ইন্টারনেট