অনুবাদ : আলম খোরশেদ
হোর্হে লুইস বোর্হেসের (১৮৯৯-১৯৮৬) জন্ম আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেস শহরে। শিক্ষাজীবন কাটে সুইজারল্যান্ডে। তখনই ফরাসি ও জার্মান উভয় ভাষাই খুব দক্ষতার সঙ্গে আয়ত্ত করেন তিনি। প্রথম মহাযুদ্ধের পরপর ইউরোপ ভ্রমণকালে খ্যাতনামা লেখকদের সংস্পর্শে আসেন এবং সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কবিতা দিয়েই হাতেখড়ি, যদিও বোর্হেসের খ্যাতি মূলত নতুন ধরনের, নিরীক্ষাধর্মী, দর্শনঋদ্ধ গল্প-লিখিয়ে হিসেবে। গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধ মিলিয়ে তাঁর গ্রন্থসংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের প্রায় সব বড় বড় পুরস্কারপ্রাপ্তির সৌভাগ্য হলেও, এবং নোবেল পুরস্কারের জন্য একাধিকবার মনোনীত হওয়া সত্ত্বেও কেন জানি শেষ পর্যন্ত তা জোটেনি তাঁর ভাগ্যে। ১৯৮৬ সালে প্রায়ান্ধ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কবিতায় স্মৃতি, সময়, অস্তিত্ব ও আত্মবীক্ষণের মতো আধিবিদ্যক বিষয়গুলো উঠে আসে এক ধরনের নিজস্ব ও প্রাতিস্বিক বোর্হেসীয় কাব্যভাষায়। কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রণিধানযোগ্য : ফারভার অব বুয়েনোস আইরেস (১৯২৩), পোয়েমাস (১৯৪৩), ড্রিম টাইগারস (১৯৬০), ওবরাস পোয়েতিকাস (১৯৬৪), দ্য গোল্ড অব দ্য টাইগারস (১৯৭২), ইন প্রেইজ অফ ডার্কনেস (১৯৭৪) ইত্যাদি।
যখন দুঃখ আমাদের শুইয়ে ফেলে
যখন দুঃখ আমাদের শুইয়ে ফেলে
মনঃসংযোগ কিংবা স্মৃতির ধারাপাত
আমাদেরকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও
বাঁচিয়ে দেয় : একটি ফলের আস্বাদ,
জলের আস্বাদ,
স্বপ্নের ফিরিয়ে দেওয়া একটি মুখচ্ছবি,
নভেম্বরের প্রথম ফোটা জুঁই,
কম্পাসের অন্তহীন আকুতি,
একটি বই, যা হারিয়ে গেছে ভেবেছিলাম,
একটি ছয়মাত্রার কবিতার কম্পন,
একটি ছোট্ট চাবি যা আমাদের জন্য পুরো বাড়ি খুলে দেয়,
গ্রন্থাগারের গন্ধ, অথবা চন্দনকাঠের,
কোনো এক সড়কের পুরনো নাম,
মানচিত্রের বিবিধ বর্ণ,
একটি শব্দের অদেখা ব্যুৎপত্তি,
যত্নে-ঘষা কোনো নখের মসৃণতা,
একটি প্রতীক্ষিত তারিখ, বারোটি অন্ধকার ঘণ্টা-ধ্বনি,
যা আমাদের গণনার মধ্যে বাজতে থাকে,
একটি আকস্মিক শরীরী যন্ত্রণা।
আশি লক্ষ শিন্টো দেবতা
গোপনে পৃথিবী ভ্রমণ করেন।
সেই বিনম্র দেবতারা আমাদের স্পর্শ করেন –
স্পর্শ করেন এবং সামনে এগিয়ে চলেন।
যেকোনো মৃত্যুর জন্য পরিতাপ
স্মৃতি ও আশা থেকে মুক্ত,
সীমাহীন, বিমূর্ত, প্রায় ভবিষ্যতের মতো,
মৃত মানুষটি আসলে একজন মৃত লোক নন : তিনিই মৃত্যু।
অধ্যাত্মবাদীদের ঈশ্বরের মতো,
যাঁর সম্পর্কে যা-ই বলা যায়, তা-ই অস্বীকৃত হতে বাধ্য,
মৃতজন, সর্বত্র আগন্তুক,
আসলে এই পৃথিবীর অনুপস্থিতি কিংবা ধ্বংসেরই প্রতিরূপ তিনি।
আমরা তার কাছ থেকে সব হরণ করে নিই,
আমরা তাকে বড়জোর একটা রং কিংবা অক্ষররূপে রেখে দিই :
এখানে, এই উঠোন, যা তার চোখ আর দেখতে পায় না,
সেখানে, সেই হাঁটাপথ, যেখানে আশারা অপেক্ষমাণ।
এমনকি আমরা যা ভাবছি,
সেও তা ভাবতে পারতো,
আমরা চোরের মতো দিন ও রাতের
সব সম্পদ ভাগাভাগি করে নিয়েছি।
আমরাই সময়
আমরাই সময়। আমরাই সেই
দুর্বোধ্য হেরাক্লিটাসের বিখ্যাত উপমা।
কঠিন হীরক নই, আমরা সেই জল,
যা বয়ে চলে গেছে, যা একই জায়গায় স্থির নয়।
আমরা সেই নদী এবং আমরাই সেই গ্রিক
যে নিজেকে দেখে নদীর পানিতে। তার ছায়া
ক্রমে জল হয়ে যায় পরিবর্তনশীল আয়নায়,
ফের স্ফটিক হয়ে ওঠে আর আগুনের মতো পাল্টায়।
সমুদ্রের দিকে ধাবমান
আমরা সেই পূর্বনির্ধারিত অহংকারী নদী।
ছায়ারা ঘিরে ধরেছে তাকে।
সবকিছুই আমাদেরকে বিদায় বলেছে, চলে গেছে সবাই।
স্মৃতি তার নিজের মুদ্রা ছাপায় না।
যদিও এমন কিছু আছে যা রয়ে যায়,
এমন কিছু, যা অনুতাপ করে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.