‘অনেক মাইল ব্যেপে পৃথিবীর রাঙা দীর্ঘশ্বাস’

নিকটজনের মৃত্যু ভিন্ন এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা। যেসব মানুষের স্নেহ-মমতা আমরা একটু বেশি মাত্রায় পাই, তাঁদের মৃত্যু বেশি আঘাত দেয়। আর সেই আঘাত এতটা গভীর হতে পারে যা আগে থেকে কিছুই অনুভব করা সম্ভব নয়। অনেক গুণী মানুষ থাকেন সমাজে যাঁদের হারালে ক্ষতি হয় সমাজদেহের, কিন্তু কিছু কিছু গুণী মানুষ থাকেন যাঁদের বিদায় শুধু যে ক্ষতিই করে সমাজের, তাঁদের নিকটজনের তাই নয়, এক দীর্ঘ প্রলম্বিত রক্তক্ষরণের ভেতর ফেলে দেয়। আবুল হাসনাতের মৃত্যু আমার জন্য অনেকটা সেরকমই আঘাত। এগারো বছর আগে আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার মনে হয়েছিল জগতের কোনো মৃত্যুই বোধহয় এর চেয়ে বেশি শোকাচ্ছন্ন করতে পারবে না! কিন্তু হাসনাতভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর কয়েকদিনের তীব্র ক্ষরণের কথা ঠিক কিছুতেই মনে হয় বোঝানো যাবে না। এই কদিন কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ভাবার চেষ্টা করেছি কেন আমার ভেতর এ-ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে! ঠিক উত্তর জানি না।

এখন থেকে ঠিক তেতাল্লিশ বছর আগে আমি মাত্র অনার্স পরীক্ষা দিয়ে ঘরে বসে টুকটাক পড়ালেখা আর অনুবাদ করি বিদেশি সাহিত্য পত্রিকা থেকে। মাঝে মাঝে আমার প্রিয় বন্ধুদের লেখা কবিতা বা গল্প অনুবাদ করি। কোথাও তেমন দেওয়া হয় না, মাত্র দৈনিক বাংলায় কিছু অনুবাদ ছাপতে দিয়েছি। আর ইত্তেফাকে কিছু। তাও একেবারেই অনিয়মিত। কিন্তু পড়া বা অনুবাদ করা চলছে ভালো গতিতে। দৈনিক বাংলা বা সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে বা পাবলিক লাইব্রেরিতে আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সবই পড়ি। আমার বন্ধু কাজী দিশু একদিন অক্তাভিও পাসের একটি কবিতার অনুবাদ পড়ে আমাকে বললেন, আপনি এসব অনুবাদ সংবাদে দিতে পারেন। সংবাদ আমাদের সবার প্রিয়, কিন্তু ওখানে যেতে সাহস পাইনি। দিশু সংবাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ক্রিকেট বা অন্য খেলা নিয়ে দারুণ একটি কলাম ‘দূরবীন’ লিখতেন সংবাদে। আমি সাহিত্য সম্পাদক হাসনাতভাইকে চিনতাম দূর থেকে। স্কুল-কলেজে আমাদের স্বল্পকালীন ছাত্র ইউনিয়ন করার সময় থেকে। এছাড়া সংবাদে আমার অনেক প্রিয় মানুষ প্রিয় লেখক ছিলেন, কিন্তু আমি তাঁদের কাছে নিজের লেখা বা অনুবাদ দিতে সংকোচ বোধ করেছি। লেখা বিষয়ে অতিরিক্ত প্রচার বা নিয়মিত আলোতে থাকা আমি কোনোদিনই পারিনি, তাছাড়া আলস্য আজীবন আমার মজ্জায়। কিন্তু ’৭৭ সালের মাঝামাঝি থেকে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় অনুবাদ বা গ্রন্থ-সমালোচনা করা একটু বাড়িয়ে দিই কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। একেবারে সাদা কথায় আহার সংস্থানের জন্য, টিউশনির পাশাপাশি। একদিন কয়েকটি ফরাসি কবিতা অনুবাদ করে আমি ভয়ে ভয়ে সংবাদে হাসনাতভাইয়ের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে বসতে বললেন, চা খাব কি না জিজ্ঞেস করলেন। আমি একটু বিস্মিত, জড়তামিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, ঠিক আছে। কবিতা কয়টির সঙ্গে একটা দু-পাতার ভূমিকা ছিল, তিনি সেটি তখনই খুলে পড়তে শুরু করলেন, আমি ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি ফরাসি জানি কি না; বললাম, না, আমি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছি। Modern European Poetry-এর যে-সংস্করণ থেকে অনুবাদ করেছি তার নাম ভূমিকায় দেওয়া ছিল।  মাঝপথে পড়া থামিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি কয়েকটি পত্রিকায় গ্রন্থ-সমালোচনা করেছেন দেখেছি, আমাদের গ্রন্থ-সমালোচনা দিন।’ আমি আবার বিস্মিত, তিনি আমার মতো একেবারে অখ্যাত কারো নাম মনে রেখেছেন, লেখা দেখেছেন! আমি গ্রন্থ-সমালোচনা খুব পছন্দ করি, এবং দেব বললাম। তিনি বললেন, ‘আপনি দু-চার সপ্তাহ পর এসে আমার কাছ থেকে বই নিয়ে যাবেন, পড়ে আলোচনা লিখবেন।’ এরপর আমি চলে আসি। অনুবাদ কবিতাগুলো কবে ছাপা হবে, বা আদৌ হবে কি না কিছুই বললেন না। আমি ভেবেছি হয়তো ছাপবেন, নয়তো ছাপবেন না। এরপর আর এ নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল না। একদিন লাইব্রেরিপাড়ায় বিকেলে আড্ডায় গেছি, আমার বন্ধু রাজা বলল, ‘দোস্ত সংবাদে তোর অনুবাদ ছেপেছে।’ আমি লাইব্রেরির ভেতরে গিয়ে অনুবাদগুলো পড়ে এলাম। সঙ্গে ইলাসট্রেশন ছিল সামান্য। মনটা ভালো হয়ে গেল সেদিন। ফিরে এলে রাজা বলল, ‘এবার দোস্ত চায়ের দাম মিটিয়ে দে, আর শিঙাড়ার অর্ডার দে।’ আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। কিছুদিন আগে আমার বন্ধু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইয়াসমিন আমাকে ক্যামুর আউটসাইডার পড়িয়েছেন। সেই থেকে আমি ঘোরের মধ্যে ক্যামু পড়ে যাচ্ছি। ভাবলাম, যদি ক্যামু অনুবাদ করি কেউ ছাপবে কি না। বন্ধুরা শুনে বললেন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা ধারাবাহিক বিদেশি উপন্যাসের অনুবাদ ছাপবে না, উত্তরাধিকার বা কোনো বিশেষ সংখ্যার জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারিস।

এর মাঝে কয়েক মাসে দু-তিনটে গল্পগ্রন্থ এবং কবিতার বইয়ের আমি আলোচনা লিখে দিলাম হাসনাতভাইকে। তিনি ছাপলেন। যদিও খুব কোমল ভদ্র আচরণ তাঁর, কিন্তু আলোচনা বিষয়ে কখনোই কিছু বলেন না। ভালো কি মন্দ কিছুই না। আমি খুব উদগ্রীব থাকি ভেতরে ভেতরে কোনো মন্তব্যের জন্য। না, তিনি আমাকে বা আমার পরিচিত কাউকেই কোনোদিন কিছু বলেননি। এভাবে বছরখানেক যায়, আমার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম ও মিলনের গল্প এবং জাহিদ হায়দারের কবিতা ছাপা হয়। ওঁরা সে-সময়ই খুব বিখ্যাত তরুণ লেখক। আমি একেবারেই অখ্যাত বন্ধুদের তুলনায়, তাছাড়া অনুবাদ করি বলে অনেকেই একটু ন্যূন মর্যাদার লেখক মনে করেন। আর গ্রন্থ-সমালোচনা, সে তো প্রায় সম্পাদকের ফুটফরমাস খাটার মতো, ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এ-সময় দৈনিক বাংলায় আমি একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার অনুবাদ করি ভাস্কর ব্রাঙ্কুসির, যা ছবিসহ ছাপা হয়েছিল লন্ডন ম্যাগাজিনে। আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। আমি কবি আহসান হাবীবকে দিলে তিনি বেশ যত্নের সঙ্গে ছাপেন। তিনি আমাকে সে-সময়ে অক্তাভিও পাসের অলটারনেটিং কারেন্ট বইটি সমালোচনা করতে দেন। আমি এ-বইটির আলোচনা প্রায় প্রবন্ধের আকারে দীর্ঘভাবে লিখি। এই দুটো লেখাই হাসনাতভাইয়ের নজরে পড়েছিল। এরপর তাঁর কাছে সমালোচনার জন্য বই আনতে গেলে তিনি ব্রাঙ্কুসির সাক্ষাৎকারটির কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘এটি আমাকে দিতে পারতেন।’ আরো বললেন, ‘যদি বিদেশি চিত্রকলা বা ভাস্কর্যের ওপর কোনো লেখা লিখতে চান বা অনুবাদ করতে চান, আমাকে দেখিয়ে করবেন, আমি সম্ভব হলে ছাপার চেষ্টা করবো।’ এ-সময়েই আমি প্রথম জানতে পারি যে, তিনি চিত্রকলা নিয়ে ভীষণ উৎসাহী। এর মাঝে দেখতে দেখতে আটাত্তর সাল চলে এলো, রফিকভাই রোববার সম্পাদনা শুরু করলেন। সেখানে আমি কিছু বিদেশি সংবাদপত্রের বা ম্যাগাজিনের লেখা অনুবাদ করতে শুরু করি, সবটাই বাজারি লেখা এবং রফিকভাইয়ের পছন্দ করা। মাঝে মাঝে গ্রন্থ-সমালোচনাও লিখতাম। এর মাঝে একদিন সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস মগ্নচৈতন্যে শিস বের হয় এবং আমাকে আলোচনা লিখতে বলেন হাসনাতভাই। আমি আলোচনাটি বেশ দীর্ঘ করে লিখি এবং গল্পের একটি চরিত্রের মাঝে এলিয়েনেশনের ছায়া সম্পর্কে বেশ খানিকটা লিখি, যা কিছুটা ইউরোপীয় এক ধরনের বিষণ্নতা-আক্রান্ত চরিত্রের আদল। লেখাটি প্রবন্ধের আকারে লিখে নাম দিয়েছিলাম ‘শ্রেয়তর মন্দিরে মগ্ন’, যা হাসনাতভাই খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপেন। উপন্যাসটির কাহিনিটিতে একধরনের স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের লক্ষণ ছিল। যেটা আমি উল্লেখ করেছিলাম। যা হোক এই গ্রন্থ-সমালোচনাটি একটু আলোচিত হয়েছিল, কারণ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসকে এত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা, তাও আবার সংবাদে, এবং আমার মতো এক অখ্যাত গ্রন্থ-সমালোচক করেছে। মনে হয় দু-চারজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হাসনাতভাইকে হয়তো কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি কী বলেছিলেন, তা আমি জানি না। একদিন আলোচনার জন্য বই আনতে গেলে তিনিই আমাকে বলেন, ‘আপনার আলোচনাটি কেউ কেউ পড়েছেন, আপনি পারলে আমাদের এ-সময়ের উপন্যাস নিয়ে লিখুন, তাতে সেলিনার আরো দুয়েকটি বই অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।’ বিষয়টি আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হলো।

আমি উপন্যাস বিষয়ে ইংরেজিতে দুয়েকটি বই ততদিনে পড়েছি, এছাড়া সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা উপন্যাসের কালান্তর পড়ে ভালো লেগেছিল। পরীক্ষার জন্য ক্রিটিক্যাল থিওরি পড়া ছিল। কিন্তু সেই দিনগুলোতে শিল্প বা সাহিত্যের বিচারে আমি অনেকটাই ক্রিস্টোফার কডওয়েলপন্থী। সাহিত্যকে আমি ভাবতে শুরু করেছি সমাজের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার ফসল হিসেবে। শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি আমার কাছে সমাজ থেকে বা সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। যদিও আমার নিজের মাঝে ভিন্নরকম দ্বন্দ্বও কাজ করছিল। একদিকে বাংলাভাষায় এবং ইউরোপীয় লেখকদের অধিকাংশই যাঁরা আমার প্রিয় লেখক তাঁরা প্রায় সবাই কলাকৈবল্যবাদী, সেটা বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ বা সুধীন দত্তসহ প্রায় সবাই। এই শিল্পভাবনার অন্তর্গত দ্বন্দ্ব বিষয়ে আমি হাসনাতভাইকে লেখাটা প্রস্তুত করার সময় জানাই। তিনি নিজে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ, কিন্তু কোথায় যেন আশির শুরুর দিকে তাঁর নিজের মাঝেও কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে শিল্পবিচারের ক্ষেত্রে। তিনি আমার কথা শুনলেন, কিন্তু তেমন কিছু বললেন না। শুধু বললেন, লেখাটা শেষ করে তাঁকে দিতে, তিনি পড়ে দেখবেন। সেলিনার গোটাতিনেক উপন্যাস, এর মধ্যে যাপিত জীবন তখনো বের হয়নি, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। সেলিনা হোসেন আমাকে পড়তে দিলেন। আজ ভাবতে অবাক লাগছে, সেসব দিনে ফটোকপি করা ছিল না, মাত্র একটিই কপি, তাও পড়তে দিয়েছিলেন কোনো প্রকাশককে দেওয়ার আগে। আমি সব উপন্যাস, একটি ছোটগল্পগ্রন্থ পড়ে কিছুটা লিখলাম। কিন্তু প্রবন্ধটার শুরুর কয়েক পাতা ছিল বাংলাদেশের কয়েক দশকের উপন্যাসের বিশ্লেষণ। সেটা অনেকটাই মার্কসীয় বীক্ষার ভিত্তিতে। বারকয়েক পরিমার্জন করে লেখাটি আমি হাসনাতভাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। কিন্তু ভয় ছিল, লেখাটার আয়তন বেশ বড় হয়ে গেল। দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে চার-পাঁচ কিস্তি ছাড়া ছাপা যাবে না। এটা সংবাদে সম্ভব কি না, তাছাড়া আমি একেবারেই অখ্যাত তরুণ লেখক, মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর হাসনাতভাই লেখাটি কিস্তিতে ছাপতে শুরু করলেন। আমি খুব ভয়ে ছিলাম। তাছাড়া যদিও আমাদের উপন্যাসের গতি-প্রকৃতি নিয়ে লেখা, কিন্তু যার কয়েকটি উপন্যাস আলোচনায় মূল গুরুত্ব পেয়েছে সেই সেলিনা হোসেনও তখন খুব বিখ্যাত লেখক নন। কিন্তু এটি কিস্তিতে ছাপা হওয়ার পর কিছুটা আলোচনার তরঙ্গ উঠেছিল, তরুণ লেখকদের মধ্যে। যদিও অধিকাংশই সমালোচনামূলক, কারণ এই ঔপন্যাসিককে এত গুরুত্ব দেওয়া এবং আমার মতো অর্বাচীনের লেখা কিস্তিতে ছাপানো, তাও সংবাদের মতো সাময়িকীতে! তবে দুয়েকজন বন্ধু আমাকে বলেছিলেন যে, এটা মূলত ঈর্ষাপ্রসূত। কারণ সেলিনা হোসেনের বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই মনে করেছেন এতটা গুরুত্ব তিনি পেতে পারেন না। আমি সেসব দিনে প্রায় প্রতিদিন বাংলা একাডেমিতে রফিকভাইয়ের ঘরে আড্ডায় যোগ দিই, তাই ওখানেও দুয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন। কিন্তু এই লেখাটির মাধ্যমে আমি মানুষ আবুল হাসনাতকে একটু ভিন্নভাবে চেনার সুযোগ পেলাম। তিনি শুধু অমায়িক স্বভাবের মৃদুভাষী মানুষই নন, সাহিত্যের জগতে একেবারে অন্য ধরনের মানুষ, যাঁর কাছে একটি শব্দও আমি জীবনে পরনিন্দা শুনিনি।

এরপর থেকে আমি আবার গ্রন্থ-সমালোচনাই করে যেতে থাকলাম। আমি সংবাদে গিয়ে হাসনাতভাইয়ের কাছ থেকে সমালোচনার বই নিয়ে আসতাম, লিখে তাঁকে বইটি ফেরত দিতাম, মাঝে মাঝে দুয়েকটি বই তিনি আমাকে রেখে দিতে বলতেন। তার কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধের গল্প এবং মুক্তিযুদ্ধের কবিতা নামে দুটি সুন্দর সংকলন সম্পাদনা করেছেন তিনি ‘কথাকলি’ থেকে। সেসব বই আমার খুব প্রিয়। তাছাড়া সংবাদে লেখার অনেক আগেই আমি হাসনাতভাই এবং মফিদুল হকভাইয়ের সম্পাদিত গণসাহিত্য পত্রিকার মুগ্ধ পাঠক। প্রায় বছর-দুয়েক আমি নিজের পছন্দের পড়া কোনো বইয়ের সমালোচনা লিখে সংবাদে দিইনি, শুধু হাসনাতভাই যে বই দিতেন তাই সমালোচনা করতাম। একদিন সাহস করে আমি দুয়েকটি সদ্য পড়া বিদেশি বইয়ের সমালোচনা লিখতে চাই বলে তাঁকে জানালে তিনি সহজেই অনুমোদন করেন। আমি সেসব দিনে অনেক পুরনো বইয়ের দোকান থেকে বই সংগ্রহ করতাম, এছাড়া কলকাতা ও ঢাকা থেকেও অনেক বিদেশি বই কেনার চেষ্টা করতাম। কলকাতা থেকে কিনলে অনেক সস্তায় কেনা যেত, তাছাড়া বিদেশ থেকে কয়েকজন বন্ধু বই উপহার দিতেন। তবে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বই কলকাতা এবং বোম্বে থেকে কিনে আমাকে উপহার দিয়েছেন আমার বন্ধু রাশিদা। বছরে ছয়-সাতবার সে কলকাতা যেত, সঙ্গে অনেক বই নিয়ে আসত। সেগুলো সে পড়েই আমাকে পড়তে উপহার দিত। আমি হাসনাতভাইকে দু-তিনটি বিদেশি বই আলোচনা করে দিলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কতগুলো বিদেশি বই আলোচনা করতে পারব। আমি বললাম, অনেক বই এখনো পড়া হয়নি, সদ্য পেয়েছি, এগুলো অনেকদিন ধরে পড়ে লিখতে পারব। তিনি আমাকে বললেন, তাহলে দু-তিন সপ্তাহে একটা করে দিন, এর জন্য একটা কলাম হিসেবে বিদেশি বইয়ের আলোচনা যাক। আমি একটু বিস্মিত হয়েছিলাম এই প্রস্তাব শুনে। কারণ আমি তখনো একেবারেই অগোছালো মানুষ, লেখায়ও তেমন সিরিয়াস নই। যা হোক তিনি একটি নাম দিতে বললেন। আমি এর কয়েক বছর আগে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং কবি শঙ্খ ঘোষ-সম্পাদিত বিদেশি কবিতার সংকলন সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, সংকলনটির ভূমিকাও খুব ভালো লেগেছিল। আমি এই নামটি হাসনাতভাইকে বললে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে।’ এভাবেই বিদেশি বইয়ের আলোচনা লিখে এই কলামটি প্রায় বছর-দেড়েক চালিয়েছিলাম। এরপর অনেক বিদেশি বই নিয়ে লিখেছি কিন্তু ছেঁড়া ছেঁড়া সময়ে। সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে আমার লেখায় আলস্য বেড়ে যায়। তবুও মাঝে মাঝে লিখেছি হাসনাতভাইয়ের নির্দেশে। কিন্তু এসময়ে পড়া হয়েছে একটু বেশি লেখার চেয়ে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আমি প্রায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি চাকরিতে। কেন জানি মনটা আর এই শৃঙ্খল নিতে পারছিল না। পালানোর পথ খুঁজছিলাম। আসার আগে তেমন কাউকে বলিনি, যে তিন-চারজন শ্রদ্ধেয় মানুষকে জানিয়েছি, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি রফিক আজাদ এবং হাসনাতভাইকে জানিয়েছিলাম। মনজুরভাই খুব উৎসাহ দিয়েছেন, কিন্তু রফিকভাই আর হাসনাতভাই কিছুটা দুঃখই পেয়েছেন মনে হয়। রফিকভাই কিছু বলেননি, চুপ করে ছিলেন শুনে; কিন্তু হাসনাতভাই বলেছিলেন, ‘আপনার পছন্দের অনেক বই পাবেন ওখানে, লেখাটা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবেন।’ আমি সেটা মনে রেখেছিলাম। তাই পরবর্তী দশ বছর আমি সংবাদে গ্রন্থ-সমালোচনা, অনুবাদ বা দু-চারটি প্রবন্ধ পাঠিয়েছি নিউইয়র্ক থেকে। আমার জীবনের সেটাই ছিল সবচেয়ে ফলবান এবং আনন্দের সময়। বিদেশে আসার পর হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তিনি নিউইয়র্কে এলে। বেঙ্গলে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই তিনি নিউইয়র্কে আসেন, আমি তখন মাত্র পড়াশোনা শেষে কলেজে যোগ দিয়েছি পড়াতে, আর খণ্ডকালীন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনা করি। নিউইয়র্কে হাসনাতভাইকে আমি সবচেয়ে কাছ থেকে জানতে পারি। এর আগে সত্তর দশক থেকে মানুষটিকে চিনি দূর থেকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ, ছাত্র ইউনিয়ন, প্রগতিশীল রাজনীতি, ছায়ানট, গণসাহিত্য ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁকে জেনেছি আমাদের তরুণ সমাজের মানসগঠনে এক বড় সংস্কৃতি বদলের কর্মী হিসেবে; কিন্তু কাছ থেকে নৈকট্য লাভ করে মানুষটির অন্তরজগৎকে বুঝতে পারিনি, কারণ আমি এত বেশি সংকোচ নিয়ে থাকতাম আর সমীহ করতাম তাঁকে যে প্রয়োজনের বেশি কোনোদিন একটি শব্দও বলিনি। রফিকভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটি ঠিক উলটো। রফিকভাইয়ের সঙ্গে আমাদের কয়েকজন বন্ধুর সম্পর্ক ছিল গভীর শ্রদ্ধামিশ্রিত; কিন্তু তার অতিরিক্ত বহু ধরনের ইয়ার্কি আর সমবয়সীদের মতো অন্তরঙ্গতায় ভরা! জগতের যে-কোনো বিষয় নিয়ে মানুষটির সঙ্গে কথা বলা যেত, সাহায্য চাওয়া যেত। তিনি অনেক কথা না বললেও বুঝতে পারতেন। কিন্তু হাসনাতভাইকে একই রকম গভীরভাবে শ্রদ্ধা করলেও তাঁর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতাম না, কিন্তু জানতাম তাঁর গভীর স্নেহ আমি পেয়ে যাচ্ছি না চাইলেও। 

বছর-ষোলো আগে হাসনাতভাই নিউইয়র্ক এলেন একটি চিত্র-প্রদর্শনীতে বেঙ্গলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন শিল্পীর ছবি নিয়ে। প্রদর্শনীতে তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলে আমরা কয়েকজন তাঁর সঙ্গে বসেছি আড্ডা দিতে। রাতের প্রায় শেষ প্রহর পর্যন্ত সে-আড্ডা চলত, সেখানেই হাসনাতভাইকে খুব নিবিড়ভাবে আমি জানতে পেরেছিলাম। এর দিন-দুই পর আমি তাঁকে নিয়ে নিউইয়র্কের পুরনো বইয়ের দোকান Strand-এ গেলাম। মনে আছে আমরা প্রায় সারাদিন সেদিন একসঙ্গে ছিলাম। কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে কিছু বইপত্র কিনে দুপুরে আমি তাঁকে আমার নিউ স্কুলে নিয়ে যাই, সেখানে দু-চারজন প্রিয় অধ্যাপকের সঙ্গে কফি খেয়ে গল্প করে আমরা ইউনিয়ন স্কয়ারে একটি রেস্তোরাঁয় খেয়ে আবার বার্নস অ্যান্ড নোবেলে বই খুঁজে কয়েক ঘণ্টা কাটাই। এভাবেই আমাদের দিনটা কাটে, সন্ধ্যার একটু আগে ইউনিয়ন স্কয়ারে আমার প্রিয় একটি কাফেতে বসে অনেকক্ষণ কথা হয়, আমি শ্রোতা, হাসনাতভাই তাঁর ছাত্রজীবন, সংস্কৃতি সংসদ, ছাত্র ইউনিয়নে তরুণ বয়সের কথা এবং জীবনের বহু স্মৃতির কথা বলেন। হাসনাতভাইকে আমি কোনোদিন এত কথা বলতে শুনিনি আগে। সেই সন্ধ্যায় কফি খেতে খেতে তিনি বলেছিলেন, ‘আবেদীন, ভাবা যায় আমরা দুজন ঢাকা থেকে এত দূরে নির্জনে বসে কফি খাচ্ছি, আর সারাটা দিন বইপত্র দেখে কাটিয়ে দিলাম!’ তাঁর কণ্ঠে ভীষণ আবেগ দেখেছিলাম সেদিন। তিনি বলেছিলেন, মস্কোতে এক বছর থাকার সময় তিনি অনেকগুলো মিউজিয়াম তন্নতন্ন করে ঘুরে দেখেছেন, কী যে ভালো লেগেছে তাঁর! নাটক, ব্যালে, মিউজিয়াম এবং লাইব্রেরি এসব তিনি প্রাণের ক্ষুধা মিটিয়ে প্রথম যৌবনে উপভোগ করেছেন মস্কোতে। বলেছিলেন, শিল্পের এবং সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় সে-সময়টাতেই তিনি সবচেয়ে বেশি অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বলেছিলেন যে, কলকাতায় ’৭১ সালের প্রায় একটি বছর অনেক বড় লেখকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে, অন্তরঙ্গতা হয়েছে, সাহিত্য-শিল্পকলা তাঁদের কাছ থেকে অনেক ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সে-সময় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত থাকার কারণে তেমন সাহিত্য নিয়ে চর্চার সুযোগ ছিল না; কিন্তু কলকাতার শিল্প-সাহিত্য বা বামপন্থী রাজনীতির বড় মানুষগুলোর সঙ্গে সারাজীবনের জন্য একটি স্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর, যা মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল। সময় পেলেই তিনি কলকাতা ছুটে যেতেন, কলকাতার বন্ধুরাও ঢাকায় এসে তাঁর এবং মিনু ভাবির আতিথ্য গ্রহণ করতেন। এই কাফেতে বসেই তিনি গল্প করেছিলেন, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, এবং আরো বেশ কয়েকজন মার্কসবাদী বড় কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে তিনি বিদেশে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তাঁর খুব ভালো লেগেছে এসব মানুষের হৃদয়ের মানবিক দিকগুলো।

সেবার আরেকদিন আমি হাসনাতভাইকে নিয়ে নিউইয়র্কের কয়েকটি মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম। তিনি আগে তাঁর ভাগ্নি শর্মীকে নিয়ে এসব মিউজিয়ামে ঘুরেছেন। তবুও আমরা দুজন সারাদিন এসব ছবি দেখে কাটালাম। এই প্রথম কয়েকটা দিন হাসনাতভাইয়ের রাজনীতির বাইরে, শিল্পকলা বা সাহিত্য বিষয়ে আমি একটি স্বচ্ছ ধারণা পেলাম। আর পেলাম মানুষটির ভেতরের অনেক নীরব থাকা কিছু অভিমান-মিশ্রিত কিছু বেদনার ছবি দেখতে, যা আগে কোনোদিন টের পাইনি, ভাবিনি। আমাদের সমাজের কিছু মানুষ, কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি কিছু বেদনার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, যা সাধারণত তিনি কোনোদিন কারো সঙ্গে শেয়ার করেননি। কেন জানি না সেসব কিছু কথা আমাকে বলেছিলেন। কোনো বন্ধু বা সতীর্থ রাজনীতিক বা সমকালীন লেখকদের বিষয়ে একটি শব্দও নিন্দার কথা উচ্চারণ করেননি, কোনো আপত্তিকর মন্তব্য করেননি, কিন্তু তাঁর অন্তর্গত বেদনার কিছু কথা বলেছিলেন মাত্র। এসব কথা থেকে এই মানুষটির রুচি এবং জীবনের ভিন্ন এক বোধ আমাকে স্পর্শ করে।

এরপর ২০০৬ থেকে প্রায় প্রতি বছরই হাসনাতভাই আসতেন, সেই আসাটা বেড়ে গিয়েছিল তাঁর কন্যা দিঠি এবং নাতনি শ্রেয়সী যখন আমেরিকায় আসে। দিঠি এখানে পড়তে এসে ডিগ্রি শেষ করে চাকরিতে যোগ দেয়; কিন্তু নাতনিটিকে না দেখে হাসনাতভাই খুব মনঃপীড়ায় ভুগতেন, তাই সুযোগ পেলেই চলে আসতেন। প্রতিবারই মাসখানেক করে থাকতেন, এসময়টা তিনি লিখতেন, পড়তেন আর আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। বিশেষ করে হাসানভাইয়ের বাসায়ই দীর্ঘ আড্ডা বসত। কিন্তু ২০০৯ সালের আগের কয়েকবার যখন সেন্টুদা, জেসমিন, শীলু এবং শাহীন খান নিউইয়র্কে ছিলেন, সে-বছরগুলোতে হাসনাতভাইকে নিয়ে আমরা শাহীনের বাসায়ও প্রচুর আড্ডা দিয়েছি। একবার হাসনাতভাই ছিলেন ওয়াশিংটনে দিন-কয়েকের জন্য টুলু ভাইয়ের বাসায়, তখন সেন্টুদাও থাকেন ওয়াশিংটনে। আমরা কয়েকজন, শাহীন, গালিব আমি চলে গেলাম ওয়াশিংটন, সেখানে হাসনাতভাই, বিনায়ক এবং সেন্টুদা, জেসমিন মিলে আমাদের দীর্ঘ হার্দিক আড্ডার স্মৃতি রয়েছে। সেবার মনে পড়ে আমাদের আড্ডায় আরো যোগ দিয়েছিলেন আমার ঢাকার ছাত্র ধূলি চৌধুরী। ধূলিকে আমি সেই ছেলেবেলায় পড়িয়েছি সুবর্ণার সঙ্গে, বহু বছর পর ধূলিকে পেয়েছিলাম হাসনাতভাইকে নিয়ে আড্ডার সময়। ধূলির বাবা, আবদুল বারিক চৌধুরী হাসনাতভাইয়ের প্রিয় মানুষ ছিলেন, ঢাকার বড় কবি-সাহিত্যিকদের মতোই।

এভাবেই প্রায় তেতাল্লিশটা বছর খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে চেনার চেষ্টা করেছি এই কবি-সম্পাদককে। তাঁর পেশার বাইরে সত্যিকার অর্থে আমি বিমুগ্ধ হয়েছি মানুষটার অন্তঃকরণের জন্য। এতটা স্নেহপ্রবণ এবং রুচিবান মানুষ আমি জীবনে কম দেখেছি। কিন্তু কবি মাহমুদ আল জামান বা সম্পাদক-লেখক আবুল হাসনাতকে আমাদের সমাজ এবং সাহিত্য কীভাবে মূল্যায়ন করবে আজ থেকে দশ বা পঞ্চাশ বছর পর, এ-প্রশ্নও আমার মনে এসেছে। আমি ভেবেছি, তিনি নিজেকে মানে তাঁর লেখক এবং কবি সত্তার প্রতি কি কিছুটা অবিচার করেছেন আমাদের সাহিত্যের ভালো সম্পাদক হতে গিয়ে? বছর-দুয়েক আগে নিউইয়র্কের উডসাইডে আমাদের দুজনেরই প্রিয় একটি ডানকিন ডোনাট কফিশপে বসে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মাঝে মাঝে আমি আর হাসনাতভাই তাঁর ছোট বোন সালমার বাসা থেকে বেরিয়ে নিরিবিলি এই কফিশপে গিয়ে বসতাম, তাঁকে কফি এগিয়ে দিয়ে আচমকা আমি এ-প্রশ্নটি করেছিলাম, তিনি একটু বিব্রত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কী যে বলেন আবেদীন!’ এরপর একটু থেমে বলেছিলেন, ‘নিজের লেখার কথা খুব সিরিয়াসলি কোনোদিন ভাবিনি তো। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছি, তখন স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। কিছু বড় মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি, মণি সিংহসহ কয়েকজন আমাদের দেশের বড় মানুষকে কাছ থেকে দেখেছি, চেয়েছি দেশটা বদলাক, স্বাধীন হোক। এছাড়া শহীদুল্লা কায়সারসহ কয়েকজন মানুষকে ছাত্রজীবনে কাছ থেকে দেখেছি, তাঁদের প্রতি আমার অনেক ঋণ। এরপর একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে সংস্কৃতি সংসদ এবং ছায়ানটের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে। আমি সবসময় চেয়েছি আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎটা আরো উন্নত হোক, বদলাক। কিন্তু এসব করেই সময় চলে গেল, অনেক কিছুই লিখতে চেয়েছি, হয়নি অন্য সব কাজের চাপে।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, রাজনীতিতে থাকেননি কেন? তিনি বলেছিলেন, ‘একটা সময় দেখেছি সরাসরি রাজনীতির চেয়ে আমি সাহিত্য বা শিল্পকলার জগতের সঙ্গে জড়িত থেকে কাজ বেশি করতে পারব। তাছাড়া আমি বোধহয়, রুচিগত দিক থেকে, বা মানসিকভাবে রাজনীতির কিছু অভ্যন্তরীণ জটিল দিক আছে, তার সঙ্গে ঠিক নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি না। এছাড়া নেতাদের অনেক বিষয়, ঠিক আমি বুঝতে পারি না।’ এরপর তিনি রাজনীতি নিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে তেমন কিছু বলতে চাননি, কিন্তু সাহিত্যে কেন আরো বেশি সময় দেননি জিজ্ঞেস করলে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন, বলেন, ‘একদিন আহমেদুল কবির সাহেব ডেকে বললেন, ‘তুমি কবিতা লেখো, তাই পারবে, সাহিত্যের পাতাটা তুমি দেখো।’ সেই থেকে এই পাতাটাকে একটু সুন্দর করতে গিয়ে, বিভিন্ন তরুণ লেখকদের উৎসাহ দিতে বা তাদের খুঁজে বের করতে আমার সময় বেশি চলে যেত। তবে আমি যেহেতু চিত্রকলা খুব পছন্দ করতাম, তাই সেসব নিয়ে লিখতেও কিছুটা সময় গেছে। তাই কবিতা লেখা কম হয়েছে। আমি সার্বিকভাবে চেয়েছি আমাদের সাহিত্যজগৎটা উন্নত হোক, নিজের লেখায় বিশেষ অভিনিবেশ দেওয়া বা সার্বক্ষণিক নিমগ্ন থাকা বোধ হয় হয়নি। হলে কী হতো জানি না, তবে আরেকটু বেশি হয়তো লেখা হতো, এই যা।’

আমি তাঁকে হেঁটে হেঁটে সালমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেই বলতেন, ‘পৌঁছেই আমাকে একটা ফোন করবেন। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হলো কি না।’ এটা ঢাকায়ও দেখেছি, যেদিনই তাঁর বাসায় যেতাম, রাতে খাওয়ার পর একা আসতে দিতেন না, বলতেন – ‘ঢাকার রাস্তা ভালো না, আপনাকে গাড়ি পৌঁছে দেবে।’ সংবাদে থাকতে কোনোদিন তাঁর বাড়িতে আড্ডা দিইনি, কিন্তু নিউইয়র্ক থেকে প্রতিবছর গেলে তিনি ডাকতেন সন্ধ্যায় বাসায়, তখন তিনি কালি ও কলমে। একদিন মিনু ভাবি, আমি আর হাসনাতভাই সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ আড্ডা দিচ্ছি, এর মাঝে কাইয়ুমভাই এলেন। আড্ডাটা ভিন্ন দিকে মোড় নিল, রাজনীতি আর শিল্প-সাহিত্য মিলে আমাদের চেনাজানা মানুষদের নিয়েও অনেক কথা বলেছিলেন সেদিন। হঠাৎ কেমন যেন একটু আনমনা হয়ে গেলেন, এই সন্ধ্যাটা ছিল কাইয়ুমভাই চলে যাওয়ার ঠিক কিছুদিন আগে। আমি ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর যাব একটা গবেষণার কাজে, হঠাৎ হাসনাতভাই আমাদের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কাইয়ুমভাইয়ের কথার জবাবে বললেন, ‘এ-সমাজটা নিয়ে আমরা যতই ভাবি না কেন কাইয়ুমভাই, আমরা বোধহয় কোনো এক অবক্ষয়ের জটিলতার মধ্যেই ঘুরছি। যে-দেশে ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ সুদূরপরাহত, সামন্ততান্ত্রিক উত্তরাধিকার জড়িয়ে রয়েছে, জীবনে, সমাজে, সাহিত্যে, সকল প্রকার স্বভাবে, সংস্কৃতির সকল স্তরে, সেখানে মানুষের কীর্তিকলাপ, নিয়তি নির্ধারিত, বা ভবিতব্য নির্ধারিত কি না তাই ভাবি।’ কাইয়ুমভাই একেবারেই স্বল্পভাষী থাকতেন আড্ডায়, তিনি গায়ের জ্যাকেটটা একটু টেনে, গলার মাফলারটা একটু সরাতে সরাতে পাশে বসা মিনু ভাবির দিকে তাঁর বড় বড় চোখ দুটি নিয়ে তাকিয়ে কেমন যেন একটা বিষণ্ন চাহনি দিলেন! আমি হাসনাতভাইকে এমন গম্ভীর হয়ে কখনো কথা বলতে শুনিনি আগে কোনোদিন। আমার সবসময় মনে হতো তিনি ভীষণ কোমল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে উজিয়ে যাওয়ার একটা প্রখর দৃঢ় মনোভাব আছে, যা আমাদের সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোকের গণ্ডির বাইরে আমাদের অসূয়াপ্রবণ মনকে তিনি সত্যিই অপছন্দ করতেন, যা আমাদের লেখকদের মধ্যে দেখে দেখে তিনি পীড়িত হতেন; কিন্তু এসব থেকে সমাজকে উত্তরণের পথ যে সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে উন্নত করেই সম্ভব, সেটা সব সময় দুয়েকজনের আড্ডায় বলতেন। তিনি কাইয়ুমভাইকে নিয়ে সেই সন্ধ্যায় কেন জানি না একটু বিষণ্ন ছিলেন, বললেন, ‘জীবনযাপনে শ্রমে সংকটে সহায়ে জীবন্ত মানুষকে, মানুষের সমস্ত অস্তিত্বকে বোঝা যে সত্যিকার লেখকের কাজ, সেটাই আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না। কোনো লেখকের সঙ্গে এদেশে কথা বলতে গিয়ে মনে হয় না, অসংস্কৃত কুৎসিত বীভৎসতা বা আপাত ইতরতার মধ্যে শিল্পীরা যে সন্ধান করেন মাধুর্য, সংবেদনশীলতা, প্রগাঢ় মানবিকতা ও মূল্যবোধ, তা যেন আমাদের লেখকরা ভুলতে বসেছেন, বা কেউ ভাবেনই না। এটা খুব বেদনার।’

সেই সন্ধ্যায় হাসনাতভাইয়ের বাসা থেকে আসতে আসতে আমার মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে গিয়েছিল। কাইয়ুমভাইকে বসিয়ে রেখে তিনি আমাকে নিচে নেমে গাড়িতে তুলে দিলেন, পরদিন আমি সিঙ্গাপুর ফিরে তাঁকে ফোন করেছিলাম। অনেক কথা হয়েছিল ব্যক্তিগত বিষয়ে, বিশেষ করে দিঠিকে নিয়ে। খুব দুশ্চিন্তা করতেন দিঠি আর শ্রেয়সীকে নিয়ে। ২০১৯ সালের আগস্টের শেষদিকে আমার শেষ দেখা হয় হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে। আমি সিঙ্গাপুর হয়ে নিউইয়র্ক ফিরব, বাসায় সেদিন যেতে পারিনি, কিছু জরুরি কথা বলবেন দিঠির বিষয়ে জানালেন, তাই অফিসে গেলাম। আমাকে কফি দিয়ে তিনি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যকে বললেন, আমার বইয়ের কিছু শেষ প্রুফ দেখাতে। আমি যেহেতু এসব বইপত্র নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নই, গুরুত্বও দিই না, তাই সংকোচে নির্ঝরের সঙ্গে বসে কম্পিউটারে দু-চারটা জিনিস দেখে চলে এসেছি হাসনাতভাইয়ের টেবিলে। খুব সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর, সেই কৃতজ্ঞতাটুকুও তাঁকে জানানো হয়নি। হাসনাতভাই দিঠিকে একটি ব্যক্তিগত পরিকল্পনার কথা জানাতে বললেন। এরপর আমার সঙ্গে লিফট পর্যন্ত এলেন, কিছু কথা বললেন একেবারেই তাঁর ও দিঠির বিষয়ে। তাঁর কণ্ঠ খুব আর্দ্র ছিল, কেন জানি দিঠির খবরাখবর নেওয়ার ব্যাপারে জীবনের শেষদিকে আট-ন’বছর তিনি আমার ওপর কিছুটা আস্থা রাখতেন, কিছুটা নির্ভর করতেন। আমি তাঁর সেই আস্থাকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গেই মান্য করতাম মাঝে মাঝে দিঠির সঙ্গে কথা বলে তাঁর খবর টেলিফোন করে হাসনাতভাইকে জানিয়ে।

জীবনের কিছু ক্রান্তির মুহূর্তে আমার এই মানুষটিকে খুব মনে পড়ে, এমন উষ্ণ বুকের উত্তাপ ভরা মানুষ আমি জীবনে কম দেখেছি। আজ কয়েক সপ্তাহ ধরেই কেমন এক মন বিষণ্ন-করা তীব্র কষ্ট পাই মানুষটার কথা ভাবলে, আর কিছুতেই তাঁকে চিন্তা থেকে সরাতে পারি না, জীবনের অনেক কষ্টের স্মৃতি আমার আছে, কিন্তু এমন বিহ্বল করা বেদনার স্মৃতি কম। হাসনাতভাইকে নিয়ে ভাবতে বসলেই আমার সামনে আমাদের গত চল্লিশ বছরের সাহিত্যের একটা ছবি ভেসে ওঠে, যার অনেকখানিরই ধাত্রীর ভূমিকায় ছিলেন তিনি। নিজের সৃষ্টিকে ন্যূন মূল্য দিয়ে তিনি সামনে তুলে ধরতে চাইলেন আমাদের শক্তিশালী সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পীদের কাজকে। আমাদের বিজীর্ণ হেজে যাওয়া সমাজে এটা করতে যে আত্মস্বার্থবোধহীন মানুষের প্রয়োজন, তা দিনে দিনে প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে, এর শেষ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। সমাজের শুধু নয়, যে-কোনো শিল্পীর ক্রান্তির সময়েও তিনি নীরবে পাশে দাঁড়াতেন। রোগে-শোকে সংস্কৃতির দীনতায় নিঃশেষিত ম্রিয়মাণ আমাদের সাহিত্যজগতে ভালোবাসার মানুষ সত্যিই কমে যাচ্ছিল অনেকদিন থেকে, তবুও তাঁর সঙ্গ বা স্নেহশীলতা আমাদের কাউকে কাউকে ঋদ্ধ করত! এখনো মনে পড়ে আমরা কয়েক বন্ধু সাহিত্যকে ভালোবাসা বা স্বপ্ন দেখার প্রেমে পড়েছিলাম প্রায় সাড়ে চার দশক আগে, তাতে তাঁর অনেকখানি ভূমিকা ছিল। তাঁর কথা মনে হলে অনেক লেখকের কথাই মনে হয়, যাদের লেখা আমার কোনোদিন পড়া হতো না হয়তো যদি না তিনি সেসব বই হাতে তুলে  দিতেন। ভয়চকিত মনে তাঁর সামনে বংশালে বা পুরানা পল্টনের অফিসে গেলেই বইগুলো তুলে দিতেন। তার মধ্যে অনেক তরুণ লেখকের বই থাকত, চাইতেন সেসব মানুষ পড়ুক। একে একে চার দশকের বেশি সময়ের স্মৃতি দ্রুত ধাবমান হয়ে আবার মনের মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে! আমি বধির নিশ্চল পিত্তল মূর্তির মতো ধূসর আর্দ্র চোখে সেসব দেখছি। আমার স্মৃতির সেসব কংকাল আমাকেই ব্যথিত করে, ভাবি – আমার ও আমাদের অবসিত সমাজকে তিনি সামান্য একটু উজ্জ্বল করতে চেয়েছিলেন জীবনের প্রায় ছয়টি দশক সাংস্কৃতিক বিভিন্ন শাখায় নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে। বিনিময়ে তাঁকেও মূল্য দিতে হয়েছে। এসব হাজার বিষয় মনে পড়ছে, আর শেষবার আমাকে নিজের দপ্তরের লিফটের কাছে এগিয়ে দিয়ে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলা, দিঠি ও শ্রেয়সীকে নিয়ে দুর্ভাবনার কথা বলা, আর জলে ভেজা সেই দুটি বড় বড় চোখ আমার দৃষ্টি থেকে একটু সরিয়ে আড়াল করার ছলে বলে উঠলেন, ‘সাবধানে যাবেন। সিঙ্গাপুর বা নিউইয়র্কে পৌঁছে পারলে একটা ফোন করবেন।’ করোনার মাঝে অনেকদিনই কথা হয়েছে ফোনে, কণ্ঠ থাকত উৎকণ্ঠা উদ্বেগে ভরা। আমি তাঁকে দিঠির খবর দিয়ে আশ্বস্ত করতাম, কিন্তু তিনি আমাকে সাবধানে থাকতে বলতেন বারবার। সেই ভেজা চোখ আর উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর বহুদিন আমাকে তাড়া করে ফিরবে জানি। তাঁর ঋণ পরিশোধযোগ্য নয় জানি, কিন্তু তাঁর স্নেহের স্মৃতি থেকেও কোনোদিন বেরোনো সম্ভব নয়! আমাদের সাহিত্য এবং শিল্পজগৎ এই নীরব সংস্কৃত-হৃদয়কে বহু দশক এর ইতিহাসে ধরে রাখবে, এটুকুই আমাদের কাম্য!