বিশ্বব্যাপী অতিমারীর কারণে দীর্ঘকাল ধরে বাড়িতে বন্দি। এই অবসরে নিজের অসমাপ্ত কাজগুলো গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। তারপর প্রায় মাস আষ্টেক বাদে হঠাৎ একটা  জরুরি কাজে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় চলেছি ভাড়া-করা বাহনে। বহুদিন পরে বিস্তীর্ণ খোলা আকাশের নিচে। চারদিকে ঝলমলে রোদ্দুর, দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত্রের পরে তাল-খেজুরের সারি, কিছুটা দূষণমুক্ত বলে আকাশের রং ঘন নীল – অনেকদিন পরে এসব যেন নতুন চোখে দেখছি। বীরভূম আর বর্ধমানের সীমারেখার মতো সোনালি বালির বুক চিড়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণতোয়া অজয়। ধারে ধারে নিপুণভাবে জমি তৈরির কাজ চলছে, নতুন ফসলের প্রস্তুতি। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। তবে হাতের কাছে মোবাইল মায়াদর্পণ সর্বদা সজাগ তার নিজের মেজাজে। ওকে এখন বেশি আশকারা নয়, কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঠন্ করে ঘণ্টা দিয়ে এলো হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ। আমাদের জীবনটা এই যন্ত্রটার দ্বারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত তা বলার নয়। সবসময় একে উপেক্ষা করাও যায় না। এবারেও তাই, চোখ রাখতেই হলো তার স্ফটিক-গাত্রে। বাংলাদেশের এক শিল্পীবন্ধুর মেসেজ … ‘সাহিত্য সাময়িকী কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত আজ শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন …।’ এ কী খবর, এজন্যে যে একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না! কিছুকাল তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি ঠিকই, তাই বলে এমন অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ! মনটা ভার হয়ে এলো, এতক্ষণ মুগ্ধ চোখে দেখা

আলো-আকাশ যেন এক মুহূর্তে ফ্যাকাশে, গুণী বিনম্র মানুষটি এভাবে হঠাৎ চলে গেলেন! এই ক্রান্তিকালে কি একের পর এক গুণীজনকে হারিয়ে ফেলবো?

এমন ব্যক্তি বোধকরি কম আছেন, যিনি দূরের সীমানা মুছে মুহূর্তে বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন। প্রথম পরিচয়ের ঠান্ডা আড়ষ্টতা সেক্ষেত্রে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এমনকি বাধা হয় না বয়সের ফারাকও। পোশাকি আভিজাত্যের আড়াল থেকে অন্তরের আমন্ত্রণ স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেখানে। আবুল হাসনাত তেমনই একজন মানুষ যাঁকে এক লহমায় নিকট আত্মীয় বলে চেনা যায়। চোখমুখের অভিব্যক্তি চকিতে জানান দেয় তাঁর অন্দরের খবর। কবে কোথায় কীভাবে তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল – আজ তা স্পষ্ট মনে পড়ে না, তার প্রয়োজনও নেই। ঠিক যেমন সত্যিকার বন্ধুত্বে পরিচয়ের স্থানকালের হিসাবটুকু আমরা মনে রাখি না। ভাবলে আশ্চর্য হই, এই কৃতী মানুষটি প্রথম আলাপে কখনো বুঝতে দেননি তাঁর কাজের বিস্তার। প্রখ্যাত সম্পাদক হিসেবে তাঁকে প্রথমে চিনেছিলাম ঠিকই, তবে পরে পেয়েছি তাঁর সাহিত্যকীর্তির খবর। অথচ সেই মানুষ কি অনায়াসে, কত সহজে আমার শান্তিনিকেতনের বাড়িতে চলে এলেন কালি ও কলম পত্রিকায় শিল্পকলা প্রসঙ্গে লেখার অনুরোধ নিয়ে। সে অনেকদিনের কথা। তারপর বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে শিল্পালোচনায় অংশ নিতে বাংলাদেশে গিয়েছি। অন্য কাজে ওদেশে গেলেও প্রতিবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। তিনিও কলকাতায় এলে সুযোগ পেলেই শান্তিনিকেতনে এসেছেন, অন্যথায় কথা হয়েছে টেলিফোনে – সে হয়তো পত্রিকার বিষয়ে, শিল্পকলার প্রসঙ্গে, বা নতুন কী কাজ হচ্ছে তার খবরাখবরে। এর কিছুকাল পরে আবার যখন শিল্প ও শিল্পী শিরোনামের আর্ট-ম্যাগাজিন প্রকাশিত হলো, তখন তাঁর অনুরোধে অনেকবার কলম ধরতে হয়েছে সে-পত্রিকাতেও। আর একটা বিষয় এখানে স্বীকার করতে হবে যে, বাংলা ভাষায় এই জাতীয় আর্টের পত্রিকা যে প্রথম দেখা দিলো, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্তটা আর্ট-পেপারে ছাপা ঝকঝকে স্মার্ট সম্পূর্ণ রঙিন এই শিল্পকলার কাগজ, প্রকাশের শুরুতে বাংলাদেশে তো বটেই এপারেও সমান সাড়া ফেলেছিল। আর তা কেবল ছবি ও ভাস্কর্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি – শিল্পকলা ছাড়া সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র – কোন বিষয়ে বিস্তৃত আলাপ-আলোচনা সেখানে পাইনি? আজ দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলি, পত্রিকাটি শুধু তার চেহারার জৌলুসে নয়, বিষয়বৈচিত্র্যেও অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। সেখানেও তিনি সম্পাদনার কাজ সামলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। তবে কেবল আর্টের পত্রিকা সম্পাদনা নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও শিল্পকলার সঙ্গে নিবিড় যোগ ছিল তাঁর। ছবি বড় ভালোবাসতেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহেও আছে অনেক ছবি। নিজের বাড়িতে যেন গড়ে তুলেছিলেন ছবির এক স্নিগ্ধ গ্যালারি। আমাদের কাছে সগর্বে ঘোষণা করতেন, তাঁর কাছে এই-এই শিল্পীর কাজ আছে। সাগ্রহে আমন্ত্রণ জানাতেন তাঁর সংগ্রহের ছবি দেখাবার জন্য। হাসনাতদার গভীর আগ্রহে আমিও দুয়েকটা ছবি তাঁকে সংগ্রহ করে দিয়েছি। সে যেমন কলাভবনের ‘নন্দন মেলা’ থেকে অথবা কখনো-বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। শিল্পী কে. জি. সুব্রহ্মণ্যের কাজের একজন বিশেষ ভক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর সংগ্রহে মানিদার একাধিক কাজ রয়েছে। শেষের দিকে কলাভবনের আরেক শিল্পী, সত্যজিৎ রায়ের সহপাঠী দিনকর কৌশিকের কাজ সংগ্রহ করতে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। আমিও কথা দিয়েছিলাম, সুযোগ পেলে নিশ্চয় একটা ছবি বা স্কেচ তাঁকে জোগাড় করে দেব – কিন্তু নিতান্ত দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করি, তাঁকে দেওয়া সেই কথার মর্যাদা আমি রাখতে পারিনি। কথা দিয়ে তা না-রাখতে পারার বিষণ্নতা আমার মনের মধ্যে নিয়ত পাক খেয়ে চলেছে। আজ বহুযোজন দূরের সেই মানুষটির কাছে আমার মার্জনা পৌঁছে দিলাম।