কয়েকটি সাক্ষাতের স্মৃতি

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় মস্কোয় ১৯৮৬ সালে। বোধ করি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে – শীতের ঠান্ডা তখনো পুরোমাত্রায়। গণসাহিত্যের সম্পাদক হিসেবে তাঁর নামের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম, কিন্তু সরাসরি সাক্ষাৎ সেই প্রথম। মস্কোয় তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম। তাঁরই বাসভবনে এক সন্ধ্যায় ডাক পড়ল। সেখানে এর আগেও বারকয়েক গিয়েছি। তিনি অন্তরে নিখাদ বাঙালি, আড্ডা দেওয়ার মানুষ খুঁজে বেড়ান। হাশেম সাহেবের লেখায় যেমন রস ও সৃজনশীলতার ছাপ থাকে, তেমনই রসোদ্দীপ্ত তাঁর আলাপচারিতা। চল্লিশের দশকে বামপন্থী ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে ওঁর বিচরণ, শহীদুল্লা কায়সার ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সঙ্গে কলকাতায় ছাত্রজীবন, দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, দাঙ্গা – এসব নানা বিষয়ে তাঁর স্মৃতিচারণা আমাকে মুগ্ধ করে রাখত। সেবারে গিয়ে দেখি কবি ও সংবাদের সাহিত্যপাতার সম্পাদক আবুল হাসনাতও আমন্ত্রিত। ওঁর সম্পাদনায় সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী তখন দেশের সবচেয়ে পরিশীলিত ও আদৃত প্রকাশনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে-আসরে ছিলেন দ্বিজেনদা (দ্বিজেন শর্মা), সঙ্গে দেবী বউদিও এসেছেন। অনেকক্ষণ গল্প হয়েছিল সেদিন। হাসনাতভাই তাঁর মস্কো ভ্রমণ : প্রত্যয়ী নতুন জীবন বইয়ে সেদিনের সন্ধ্যা নিয়ে লিখেছেন : ‘এমন জমিয়ে আড্ডা সহসাও হয় না।’ সেটা যত-না  আড্ডাধারীদের গুণে, তারচেয়ে বেশি সেই সময়ের কারণে। তখন গর্বাচভের কাল। তাঁরই নেতৃত্বে সোভিয়েত পার্টির ২৭তম কংগ্রেস শুরু হয়েছে ১৯৮৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, চলবে ৬ মার্চ পর্যন্ত। সংবাদ পত্রিকার তরফ থেকে সেই কংগ্রেস কভার করার জন্য তিনি মস্কোয় এসেছেন। সেই সুবাদে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের জন্যে। আমার সঙ্গেও একই কারণে আগ্রহী ছিলেন সমসাময়িক সোভিয়েতের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের মতামত শুনতে। গর্বাচভের ক্ষমতায় আসার প্রথম দিকে মানুষের মনে আশা জেগেছিল যে, সমাজতন্ত্রের ত্রুটিগুলো দূর করার ক্ষেত্রে এবারে একটা আমূল পালাবদল হবে। গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকো শব্দ দুটো নিয়ে তখন লোকসমাজে নানা জল্পনা-কল্পনা। একসময় তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো দীর্ঘদিন আছেন মস্কোয়! লোকমুখে শুনেছি এখন নাকি পরিবর্তনের হাওয়া বইছে সর্বত্র! সত্যি নাকি?’ এর উত্তরে আমি অনেক কথা বলেছিলাম, ওই বইয়ের দু-পাতা জুড়ে তার বিবরণ আছে। গর্বাচভ ক্ষমতায় আসার পরপর যেভাবে পরিবর্তনের পক্ষে প্রচণ্ড আশাবাদ জাগিয়ে তুলেছিলেন তারই প্রতিফলন ছিল আমার কথায়। সবশেষে সেদিন তাঁকে বলেছিলাম, ‘গর্বাচভ লিবারেল, অর্থনীতিতে নতুন ধারা আনবেন। পাশ্চাত্যে এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। তিনি পার্টিতে পুরনো ধ্যান-ধারণা পালটানোর ব্যবস্থা নিলেন, বিভিন্ন কমিটিতে নতুন মুখ আনলেন। ক্ষমতায় এসে চেষ্টা করলেন পার্টি প্রশাসনকেও সাধারণ সদস্যদের মাঝে নিয়ে যেতে। সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামাজিক কল্যাণ মেলাতে হবে। চেষ্টা করছেন, দেখা যাক না কী হয়।’ হাসনাতভাই গম্ভীর মুখে আমার বিশ্লেষণ শুনে গেলেন। ভালোমন্দ কিছু বললেন না।

পরবর্তী ব্যর্থতার ফলাফল সকলের জানা। কিন্তু সেকথা তখন আমার বা সেদিনের সান্ধ্য আড্ডাধারীদের কারো পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না। আমি আরো কয়েকটা বছর তীব্র সম্মোহনের মধ্যে ছিলাম যে, এবারে বুঝি অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে! তারই ফল ছিল ১৯৮৭ বা ১৯৮৮ সালে সংবাদে কয়েক কিস্তিতে আমার লেখা – ‘সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব : একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পর্যালোচনা’, যেখানে ‘আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ ছক কেন টিকতে পারছে না, তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা ছিল।

দুই

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয় সংবাদ কার্যালয়ে। সেদিনের সান্ধ্য-আসরের তিন মাসের মাথায়, ১৯৮৬ সালের মে মাসে, আমি ঢাকায় ফিরে এসেছি মস্কোর পাট চুকিয়ে। বিআইডিএসে যোগ দিয়েছি। তখন এর একাংশ মতিঝিলের আদমজী কোর্টে, আর মূল অংশ আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে। কিন্তু আমার আসা-যাওয়া পড়ে আদমজী কোর্টেই, কেননা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে তখন আমার শিক্ষানবিশী, আর তিনি আপাতত সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। বিকেলে অফিস সেরে মাঝে মাঝেই চলে যাচ্ছি তোপখানা রোডে বা ওয়ারীতে একতা সম্পাদক মতিউর রহমানের বাসায়। মতিভাইয়ের সঙ্গে সংবাদের বজলুর রহমান ও আবুল হাসনাতের প্রতিদিনের যোগাযোগ। সেই সুবাদে আমিও খুব দ্রুত সংবাদের লেখকগোষ্ঠীর অনিয়মিত অংশে ঠাঁই পেলাম। বোধকরি ওই বছরের জুলাই মাসে আমার একটা ছোট্ট লেখা প্রকাশ পেল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাজেট উপলক্ষে একটা ভাষণ দিয়েছিলেন, তারই সমালোচনা ছিল সেটি। ‘রাষ্ট্রপতির ভাষণে অর্থনীতির চিত্র : একটি নিকট পর্যালোচনা’ – বজলু ভাই সস্নেহে সেটি প্রকাশ করলেন এবং আরো লেখার তাগিদ দিলেন। বজলুভাইয়ের টেবিলের দিকে যাওয়ার মুখে পড়ত হাসনাতভাইয়ের টেবিল। ওঁর সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময়ের পর আমি বজলুভাইয়ের কাছে যেতাম এবং লেখা দিয়ে চলে আসতাম। আমার দেখায় দুজনেই মিতবাক মানুষ ছিলেন। বিশেষভাবে হাসনাতভাইয়ের সামনে গিয়ে বসার কোনো উপলক্ষ তখনো আসেনি। কখনো ভাবিনি কবি নাজিম হিকমত অচিরেই সেই যোগাযোগের সেতু হয়ে দাঁড়াবেন।

১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি একদিন বিকেলে অফিস শেষ করে আমি মতিভাইয়ের বাসায় যথারীতি গিয়েছি। কথা বলতে বলতে একসময় ওঁর সামনে একটা কাগজ রেখে বললাম, ‘একটু দেখে দেবেন? নাজিম হিকমতের একটা কবিতা অনুবাদ করেছি রুশ ভাষা থেকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এটা এখনো করেননি।’ কবিতা এবং আমি এ-দুটো বিপরীত সন্নিপাতে একটু অবাক হয়ে মতিভাই সেটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগলেন। নাজিম হিকমতের ‘আত্মজীবনী’ একটি মোটামুটি দীর্ঘ কবিতা। আশির দশকের শুরুতে মস্কোয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলাম এই কবিতাটি নিয়ে, যাতে তিনি এর অনুবাদ করেন বাংলায়। একসময় নিজেই হাত দিয়েছিলাম এ-কাজে। মতিভাই স্বভাবত যা করেন, পড়তে পড়তে নানা লাইনে লাল কালি দিয়ে দাগ দিলেন, কোথাও কোথাও টিক টিহ্নের সম্মতি জানালেন। তারপর বললেন, ‘ভালোই তো, একটা ভূমিকা লিখে দাও এর শুরুতে, তারপর সংবাদে হাসনাতের কাছে দিয়ে এসো।’ সেটাই আমার প্রথম অনুবাদ। জানতাম যে, মতিভাই নিজেই একজন কবি, যদিও এ-পরিচয়টা তিনি বরাবরই অহেতুক আড়াল করে গেছেন। গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে হাজির হলাম সংবাদ অফিসে – এবারে সরাসরি হাসনাতভাইয়ের টেবিলে। তিনি অল্পক্ষণ দেখে লেখাটিকে তাঁর ডান দিকের ড্রয়ারে রেখে দিলেন এবং ইঙ্গিত দিলেন যে পড়ে দেখবেন। এক-দুই সপ্তাহ বাদে সংবাদের সাহিত্যপাতায় শীর্ষ রচনা হিসেবে ছাপা হলো সেটি। এর কিছুদিন পর তোপখানা রোডের মোড়ে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, ‘আপনার অনুবাদটা ভালো হয়েছিল। শামসুর রাহমান নিজে এসে আগ্রহ নিয়ে সংখ্যাটি নিয়ে গেছেন।’ এর দু-তিন বছর বাদে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা হয় আমার। দেখলাম, লেখাটার কথা তিনি মনে রেখেছেন। তখন তিনি শ্যামলীর বাসায় উঠে এসেছেন। বিআইডিএস তাঁর বাড়ির কাছেই। যতবারই দেখা হয়েছে এর পরে, জিজ্ঞেস করেছেন, কাজ কেমন চলছে না চলছে। একবার বললাম, সেজার ভায়েহোর ‘আমি মারা যাব প্যারিসে বুধবার এক বৃষ্টির সন্ধ্যায়’ এরকম কোনো কবিতা তিনি পড়েছেন কি না। স্বভাবসুলভ স্মিত হাসি হেসে তিনি বললেন, কবিতাটি তিনি পড়েছেন ষাটের দশকেই এবং নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থে এরই প্রভাবে তিনি একটি কবিতাও লিখেছিলেন। হাসনাতভাই সেদিন কবিতাটি না ছাপালে শামসুর রাহমানের সঙ্গে এভাবে পরিচয় হতো না আমার, এটা নিশ্চিত বলতে পারি।

হাসনাতভাই অল্প কথার মানুষ ছিলেন, কিন্তু সাহিত্যের শুধু নয়, রাজনীতি-অর্থনীতি ইত্যাদি মণ্ডলের নীরব পরিবর্তনগুলো ওঁর দৃষ্টি এড়াত না। মূলত, ওঁরই উৎসাহে এবং বজলুর রহমানের সস্নেহ পরিচর্যায় আমি ১৯৮৭ সালে ধারাবাহিকভাবে সংবাদের পাতায় লিখতে শুরু করি গর্বাচভের সংস্কার-প্রক্রিয়া নিয়ে। শুধু সোভিয়েতের অর্থনীতির সংস্কার নয়, আমি যুক্তি দিতে শুরু করি যে, সমাজতন্ত্র নিয়ে আমাদের সনাতনী ভাবনাতেও সংস্কার আনা দরকার। সে-সময় বামপন্থী রাজনীতির ভেতরে ও বাইরের চিন্তার মহলে নানা বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিল। মুক্তির দিগন্ত পত্রিকায় (ওয়ার্ল্ড মার্কসিস্ট রিভিউর বাংলা সংস্করণ) এ-সময়ই আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয় – ‘বাংলাদেশে বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ’। পরে ম্যাকমিলান থেকে একটি ইংরেজি বইতে এর একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে সংবাদে বের হতে থাকে ‘পেরেস্ত্রোইকার অর্থনীতি’। মতিউর রহমান তো এসব কর্মকাণ্ড জানতেনই পূর্বাপর, কিন্তু হাসনাতভাইয়েরও দৃষ্টি এড়ায়নি এই লেখাগুলো। সমাজ অর্থনীতি রাষ্ট্র বলে আমরা একটি বার্ষিক পত্রিকা বের করতে শুরু করেছি তখন। তাতে আমার ও মতিভাইয়ের একটি যুগ্ম লেখা ‘গোলাম আম্বিয়া খান : জীবন ও কর্ম’ ছাপা হয়েছিল। সংখ্যাটি হাসনাতভাইয়ের হাতে আসার পর তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন এ নিয়ে আরো বড় করে লিখতে। লোহানী স্ট্যালিনীয় তিরিশের দশকে তথাকথিত ‘শুদ্ধি অভিযানে’ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। গর্বাচভের সময়ে এরকম অনেক তথ্য মস্কো নিউজ এবং অন্যান্য সোভিয়েত পত্র-পত্রিকায় বের হচ্ছিল। এসব তাঁর মনকে আহত করেছিল। সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার আগে যতবারই দেখা হয়েছে প্রতিবারই তাঁর কাছ থেকে একটি উদ্বেগভরা প্রশ্ন পেয়েছি – ‘কী বুঝছেন, কোন দিকে যাচ্ছে?’ এর হয়তো একটা কারণ ছিল যে, রবীন্দ্রনাথের তীর্থ দর্শনের মতো রাশিয়ার গোটা ব্যাপারটাই তাঁর কাছে এক অভূতপূর্ব সাহসী সামাজিক এক্সপেরিমেন্ট বলে মনে হতো। সেটা যে শেষ পর্যন্ত অবিমৃষ্যকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে ভেঙে পড়েছিল, হাসনাতভাইয়ের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। পরবর্তীকালে, বামপন্থী রাজনীতিতে বিশুদ্ধবাদী বনাম বিলুপ্তবাদী লড়াইয়ে কোনো পক্ষেই হাসনাতভাই থাকতে চাননি। আরো অনেকের মতোই ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতন তাঁর কাছে ছিল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির মতো। মান্টোর ‘তবাতেক সিং’ গল্পের মতো তিনি থেকে গিয়েছিলেন নো ম্যান’স ল্যান্ডে।

তিন

১৯৮৬ সালে আমার দেশে ফেরার পরের পাঁচ বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গর্বাচভের পেরেস্ত্রোইকা-গ্রাসনস্ত ছিল যেমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, তেমনি সেই সময়টা দেশের জন্যেও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তখন আন্দোলন চলছে, কখনো সেটা চলেছে নির্বাচনের ভাষায়, কখনো সেটা রূপ নিয়েছিল রাস্তার লড়াইয়ে। এরশাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সমালোচনা করে সেসময় একটি বই প্রকাশিত হয় রেহমান সোবহানের সম্পাদনায় বাংলাদেশ – ডেকেড অফ স্ট্যাগনেশন নামে। বিআইডিএস থেকে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই তাতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছিলেন। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল খেলাপি ঋণ নিয়ে একটি লেখা তৈরি করার। লুটেরা ধনিক শব্দটা সেসময় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং রাজনীতিতেও লুটেরা ধনিক বনাম জাতীয় ধনিক বিতর্ক দানা বাঁধতে থাকে। অ্যাকাডেমিক বলয়ে এ-কাজে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দেন রেহমান সোবহান। ওঁর সঙ্গে তখন এ-সংক্রান্ত একাধিক গবেষণাকর্মে আমি নিয়োজিত ছিলাম। এসব বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে আমার পত্র-পত্রিকায় লেখার প্রবাহ, যা এমনিতেই ক্ষীণ ছিল, তা ক্ষীণতর হতে থাকে। মাঝে-মাঝে কখনো-সখনো সাপ্তাহিক একতার পাতায় এর্নেস্তো কার্দেনাল, নাজিম হিকমত বা গ্রামসি নিয়ে ছোটখাটো লেখা প্রকাশ পেলেও বড় পরিসরের কোনো কিছু কলম থেকে বের হচ্ছিল না। বিষয়টা হাসনাতভাইয়ের চোখে পড়েছিল। ১৯৯১ সালে হাসনাতভাই ‘ভদ্র সম্প্রদায় বনাম লোকসাধারণ : স্বদেশী সমাজ প্রকল্পে রবীন্দ্রনাথ’ নামে আমার একটি লেখা ছাপান। তার কিছুদিন পরে দেখা হতেই প্রাথমিক কথাবার্তার পর তিনি বললেন, ‘বিনায়ক, এটা ঠিক হচ্ছে না, আপনার বয়সে আপনার আরো বেশি করে লেখা উচিত ছিল। জানেন, এ বয়সে রেহমান সোবহানরা কত কিছু লিখেছেন।’ কথাটা এখনো আমার কানে বাজে। কেননা হাসনাতভাই যেটা চেয়েছিলেন, সেটা আমি পরবর্তী জীবনে করে উঠতে পারিনি। জীবিকা ও জীবনের প্রাত্যহিকতায় জড়িয়ে থেকে দেশে-বিদেশে কর্মসূত্রে গেছি, কিন্তু কাছের শিশিরবিন্দুগুলোকে আপন রচনালোকে খুঁজে নিতে পারিনি। ২০০০ সালের পর থেকে এই ব্যস্ততা এত বাড়তে থাকে যে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে যায়। ২০০৩ সালের দিকে একটা লেখা নিয়ে একদিন সংবাদের অফিসে যাই। সে-বছরই এ্যানি ইসলামের প্রথম চিত্র-প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল বোধকরি একুশে গ্যালারিতে, তারই একটি রিভিউ ছিল সেটি। নাম দিয়েছিলাম – ‘বেরিয়ে আসার ছবি’। কী করে রক্ষণশীলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এদেশের নারীরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছে সেটাকে থিম করে লেখাটি দাঁড় করানো হয়েছিল। লেখাটি দেখে যথারীতি হাসনাতভাই তাঁর ডান দিকের ড্রয়ারে রাখলেন। বুঝলাম, ছাপা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ততদিনে আমি জেনে গেছি যে মতিভাইয়ের মতো তিনিও আধুনিক চিত্রকলার নিবিষ্ট সংগ্রাহক (পরে জেনেছি অবশ্য এ-ব্যাপারে তিনি মতিউর রহমানের চেয়েও অগ্রণী)। একবার বিপাশা হায়াতের বিমূর্ত চিত্রকলার প্রশংসা করেছিলেন, মনে পড়ে।  ওঁদের দেখাদেখি আমার মধ্যেও তখন এই আগ্রহ জাগতে শুরু করেছে।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল ধানমণ্ডিতে পরিচিত কারো বাসায়। আবারো বেশ কয়েক বছর বিদেশে কাটানোর পর প্রতিচিন্তার সঙ্গে সবে যুক্ত হয়েছি ২০১০ সালে। হাসনাতভাই ততদিনে কালি ও কলম পত্রিকায়। তাঁর সঙ্গে সেদিন দেখা হলো অনেককাল পর। দুই বাংলার সাহিত্য, শিল্পকলা ও রাজনীতি নিয়ে কথা হলো। ওঁর সম্পাদনায় বেরুনো সাহিত্য-শিল্পকলা বিষয়ক পত্রিকাটি আগ্রহ নিয়ে পড়ি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে, এর ফলে উদারনৈতিক প্রগতিশীল শক্তি অন্যান্য রাজ্যেও মার খাবে, এসব নিয়ে অনেক কথা হলো। শঙ্খ ঘোষ ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতা, রাইজিং মমতার তৃণমূল বনাম ডিকলাইনিং বুদ্ধদেবের বামফ্রন্ট, আওয়ামী লীগ ও এদেশের বাম – অচর্চিত কিছুই থাকল না। জানালাম যে, মতিভাইয়ের সঙ্গে মিলে নিয়মিত প্রতিচিন্তা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলাম। এর প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখাটি ছিল ‘কেন প্রতিচিন্তা’ – যাতে বলা ছিল যে, প্রথাগত সমাজতন্ত্র আজ অচল, আবার পুঁজিবাদও কোনো সমাধান নয়। আমাদের দরকার অন্য কোনো বিকল্প। সেটা হতে পারে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, আবার হতে পারে এদেশের উপযোগী কোনো সোশাল ডেমোক্রেসি। এরকম একটি পত্রিকা বের হচ্ছে তা তিনি আগেই শুনেছিলেন, কিন্তু আমার কাছ থেকে সেটা মনোযোগ দিয়ে আবারো শুনলেন। এক ফাঁকে তাঁকে বললাম, আবার অনেকদিন পরে কিছু কবিতার অনুবাদ করেছি। নাজিম হিকমতের আরো কিছু কবিতা যা বাংলায় এর আগে অনূদিত হয়নি, আর এলেন গিনসবার্গের কবিতা। বিশেষত গিনসবার্গের বড়সড় একটা কবিতা, যেটি লালনের সরাসরি প্রভাবে লেখা, আমি তাঁকে দেখাতে চাই। নাম দিয়েছি ‘গিনস্বার্গের লালন’ – তাতে করে লেখাটিতে কবিতাটিও থাকবে, আবার গিনস্বার্গের লালন-অনুরক্তি বিষয়ে কিছু আলোচনাও থাকবে। হাসনাতভাই এক কথায় সেটি প্রকাশে রাজি হয়ে গেলেন। গিনসবার্গ, বিটনিকস্ ও লালন এসব ব্যাপারেই তাঁর প্রচুর উৎসাহ ছিল, যেমন ছিল কবি ইয়েভতুশেংকো ও ভজনেসেনস্কির প্রতি। বললেন, একসময় তাঁর অফিসে এসে দিয়ে যেতে। সেটি নিয়ে তাঁর কাছে আর আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কর্মব্যস্ততার শৈথিল্যে গিন্সবার্গের লালনের আইডিয়াটি চাপা পড়ে গেছে। না গেলেও যখনই তাঁর কালি ও কলম দেখেছি, সংগ্রহ করে নিয়েছি, বিশেষত যখন বেঙ্গল আর্ট গ্যালারিতে কোনো চিত্র-প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা দেখতে পেলে আগে সেটি পড়তাম, পড়তে পড়তে মনে হতো, আমি মানুষটাকে চিনি, ব্যক্তিগত অনুভূতির অক্ষর ধরে ধরে আমি যেন তাঁকে পড়তে পারছি।

আসলে আমার পরিপার্শ্বের দীর্ঘদিনের চেনাজানা মানুষগুলো যে এভাবে গত কয়েক মাসে হঠাৎ করে চলে যাবেন এবং তার মধ্যে এমন একজন অন্তর্মুখী মানুষও পড়তে পারেন তা কখনো কল্পনা করিনি। ওঁর সঙ্গে অনেক বেশি সাক্ষাতের দরকার ছিল, সাহিত্য-শিল্প সম্পর্কিত অনেক গল্প ও কাহিনি ওঁর কাছ থেকে শোনার কথা ছিল। আমার ব্যক্তিগত বৃদ্ধিতে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।

১৯৮৬ সালে মস্কোয় রবীন্দ্রনাথের মতোই মাত্র ১৫ দিনের সফরে এসেছিলেন আবুল হাসনাত। মস্কো-ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে লেখা ওঁর বইয়ের শেষ স্তবকে বিশ্বাস ও হতাশার কথা আছে : কত কী যে দেখলাম এই নতুন ও উন্নত সমাজে। আমি দারিদ্র্যপীড়িত দেশের মানুষ। নিত্য বৈষম্য, পীড়ন, অবহেলা, লাঞ্ছনা এবং সর্বোপরি একটি অসংস্কৃত পরিবেশে আমার দিনযাপন। এই তীর্থস্থানে না এলে কতটুকু বা বুঝতে পারতাম! কী দুঃসহ দুঃখের বোঝা আমরা বয়ে চলেছি। কবে যে এই ঘনকৃষ্ণ ছায়া বাংলাদেশ থেকে সরে যাবে! এই সুখ এই ‘আনন্দযজ্ঞের’ মধ্যে কখন আমরা অবগাহন করবো? এ জন্মে এ সাধ কি মিটবে? কে জানে?