প্রিয় হাসনাতভাই

সাতমসজিদ রোডে ছায়ানটের অপরিসর আঙিনায় জনাপনেরো নারী-পুরুষ। সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মাস্ক-মোড়া মুখে কয়েকজনকে চেনা-চেনা লাগলেও আমার দৃষ্টি অদূরে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে ওটার ডালা আটকানো সারা, মৃদু শব্দে ভ্যানটা পিছিয়ে মূল রাস্তায় গড়িয়ে নামতে বাকি। কে যেন এগিয়ে  এসে বললেন, দেখবেন? আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঘড়ি দেখছি, এখানে তো আরো আধঘণ্টার মতো থাকার কথা, সেরকমই জেনে এসেছি, নাকি ভুল জেনেছি! যিনি জানতে চেয়েছিলেন দেখব কি না তাঁকে মাথা নেড়ে না বললাম। এর মধ্যে ভ্যান আরো কিছুটা গড়িয়ে রাস্তায় নেমে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ভ্যান চলে যেতে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কী হতো দেখে! দেখতে গোঁ ধরলে হয়তো সুযোগ দেওয়া হতো, কিন্তু তুলা-গোঁজা নাক ও নিথর-বোজা চোখমুখের অচেনা হাসনাতভাইয়ের শেষ স্মৃতি মাথায় নিয়ে আমি কী করব! তার চেয়ে বরাবর তাঁকে যেমন দেখেছি, তেমনই থাকুন তিনি।

হাসনাতভাইয়ের এত সাধের পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লিখতে বসে লেখার কিছুই পাচ্ছি না। বিড়ম্বনা ছাড়া কী! তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা মার্চের সাত তারিখ সন্ধ্যায়, আমার লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে মিনুভাবিও ছিলেন। আরো ছিলেন কয়েকজন সাহিত্যানুরাগী – কলকাতা থেকে আগত সাংবাদিক, কবি ও অনুবাদক বাহারউদ্দিন, কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম, ফয়জুল ইসলাম, আফসানা বেগম ও তার বর পুশকিন, কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ ও গল্পকার ফাতেমা আবেদিন নাজলা। আরো কেউ কি ছিলেন, মনে পড়ছে না। তারিখটা মনে আছে এ-কারণে – করোনাকালের সূচনাতে সেই যে আমরা সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত অবধি আড্ডায় মেতেছিলাম (সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াটা ছিল উপলক্ষ), এরপর এই কমাসে এঁদের কারো সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে হবেও না। কথাটা যতই নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাই, বিপাকে পড়ি, তাঁর নিঃসাড় মুখ তো আমার দেখা হয়নি, দেখব বলে গিয়েও দেখিনি। ফলে এখন মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে। আমি তাঁকে গত পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর যেভাবে দেখে এসেছি, সেই স্মৃতিগুলোই বেঁচে থাকুক।

হাসনাতভাইয়ের কথা বলতে গেলে কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ঠেকানো মুশকিল। কিছু করার নেই। সেই আশির দশকের শুরুতে ডাকযোগে পাঠানো আমার লেখাগুলোকে যদি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে তিনি জায়গা না দিতেন, তাহলে হয়তো লেখালেখির ব্যাপারটা আমার জীবনযাপনের সহগামী হতো না। কথাটা আমার একার নয়। নিউইয়র্ক থেকে বন্ধু হাসান ফেরদৌস ফোন করেছিল তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে বেশ রাতে। কথাবার্তা বেশিদূর এগোয়নি, একসময় বলল, গণসাহিত্যসংবাদ সাময়িকীর সুবাদেই তাঁর লেখালেখিতে আসা – দুটো পত্রিকারই তিনি ছিলেন সম্পাদক। একই কথা আমাদের জাপানপ্রবাসী বন্ধু মনজুরুল হক লিখেছে এক কাগজে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও লিখেছেন কী দারুণ প্রেরণাদায়ী ছিলেন হাসনাতভাই। মনজুরভাইয়ের ‘অলস দিনের হাওয়া’র মতো মনকাড়া কলাম তো দীর্ঘদিন ধরে সংবাদেই ছাপা হয়েছিল, আর বলার অপেক্ষা রাখে না, এটি তখনই মননশীল রচনায় তাঁর কৃতিকে বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল।

আশির দশকের শুরুতে দেশে গুটিকয় লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া মানসম্পন্ন সাহিত্যের কাগজ বলতে ছিল একমাত্র সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী। ফলে লেখা জমা পড়ত বিস্তর, আর তাই আমার মতো সদ্য লিখতে আসা তরুণদের সংগত কারণেই অপেক্ষায় থাকতে হতো। মনে আছে প্রথম যে-লেখাটি তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে পাঠিয়েছিলাম সেটা ছিল একটা বইয়ের আলোচনা, তবে সচরাচর প্রকাশিত বইপত্রের আলোচনার চেয়ে আকারে খানিকটা বড়। মাস দুয়েক অপেক্ষায় থেকে যখন লেখাটি পত্রস্থ হলো, দেখলাম তিনি সেটাকে পুস্তক সমালোচনা বিভাগে না ছেপে প্রবন্ধ আকারে ছেপেছেন। খুবই উদ্দীপ্ত বোধ করেছিলাম। কয়েকদিন পর হাতে এলো একটা চিরকুট, খোদ সম্পাদকের – বইপত্রের আলোচনা যেন আরো পাঠাই। চিরকুটের জবাবে বইয়ের আলোচনা নয়, পাঠিয়েছিলাম একটা গল্প, সেই সঙ্গে ‘শ্রদ্ধাস্পদেষু’ সম্বোধনে জানিয়েছিলাম আমি গল্পই লিখতে চাই। ইতোমধ্যে কিছু গল্প বিচিত্রা, সন্ধানী, রোববার, ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে, তবে সংবাদে ছাপা হওয়া মানে যে বিশেষ কিছু এ-তাড়নাটা বেশ অনুভব করতাম। গল্প তো পাঠালাম, প্রতি বৃহস্পতিবারে পত্রিকা হাতে নিয়ে সাময়িকীতে চোখ ওপর-নিচ করি। কয়েক মাস যেতে যখন আশা-টাশা ছেড়ে দিয়েছি, তখন হঠাৎই অবাক হওয়ার পালা। গল্পটা ছাপা হয়েছে, তাও এক বিশেষ সংখ্যায় (সম্ভবত বিজয় দিবস উপলক্ষে)।

সেই শুরু। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে আমার একতরফা যোগাযোগের অবসান হলো, তিনি তখন লেখা চাইতে ফোন করতেন। প্রতিবারই একই ঢঙে চার-পাঁচটা বাক্যে কথা শেষ করতেন। শুরুটা অবধারিতভাবে – ওয়াসি, ভালো আছেন?

হাসনাতভাইকে নিয়ে অনেকের অভিযোগ তিনি রাশভারী, কথা কম বলেন, প্রয়োজনের বাড়তি কিছুই না। এ-অভিজ্ঞতা অন্যদের মতো আমারও একসময় হয়েছে। সংবাদের যে-স্বল্পপরিসর জায়গায় ছোট টেবিল আগলে তিনি বসতেন, সে-টেবিলের উলটোদিকে অভ্যাগতের বসার ব্যবস্থা ছিল না। গণ্যমান্য কেউ এলে নিশ্চয় পাশের বার্তা সম্পাদকের ঘর থেকে চেয়ার আনা হতো, হয়তো চায়ের কথাও বলা হতো। অনেকদিন পর যখন তাঁর সঙ্গে ‘যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা’ হয়েছে বলে আমার ধারণা হয়েছে, তখনো লক্ষ করেছি তিনি তেমনি মিতবাক। ব্যাপারটা তাঁর স্বভাবসুলভ হলেও আমার অবাক লাগত ভেবে, গোটা যৌবন সরাসরি রাজনীতি ও ছাত্র-আন্দোলনে থেকেও তিনি মানুষের সামনে আড়ষ্টতা কাটাতে পারতেন না। তাঁর সময় লাগত। যেমন হয়েছে আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। তবে তা পালটেছে একসময়। গত কুড়ি বছরে আমরা দেশে ও দেশের বাইরে অন্তরঙ্গ পরিবেশে অনেক স্মৃতিময় সময় কাটিয়েছি। তাঁর ধানমণ্ডির বাসায় দীর্ঘ আড্ডায় বসেছি, তেমনি যখনি তাঁকে আহ্বান জানিয়েছি, তিনি সাড়া দিয়েছেন।

কালি ও কলমের দায়িত্ব নিয়ে তিনি আমাকে আমার তখনকার নিবাস দিল্লিতে ফোন করে প্রথম সংখ্যায় একটা গল্প দাবি করেছিলেন; সুখের কথা দাবিপূরণ সম্ভব হয়েছিল। কালি ও কলমে মাঝে মাঝে অতি সাধারণ মানের লেখা দেখে আমার ব্যক্তিগত মতামত জানাতে গিয়ে দেখেছি তিনি অপ্রস্তুত বোধ করছেন। মনে আছে একবার এমনও বলেছিলাম, ছাপতেই যদি হয় চারটা বাজে লেখার বদলে একটা বাজে লেখা ছাপুন। লেখা পাচ্ছেন না, নতুনদের দিয়েও মানসম্মত লেখা আদায় করা যাচ্ছে না – এ নিয়ে তাঁর হতাশা ছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সমালোচনা ধরনের লেখা কেউ তেমন সিরিয়াসলি লিখতে চান না – এ-অনুযোগ প্রায়ই তাঁর মুখে শুনেছি। তবু এ তো ঠিক, তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায়ই দেশ ও দেশের বাইরের অনেক গুণী লেখককে কালি ও কলমে টানতে পেরেছিলেন।

নিজের লেখালেখি বা কাজকর্ম নিয়ে মুখে তাঁর খিল আঁটা থাকত। আত্মজীবনীমূলক বই হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে সম্বন্ধে তাঁর কথা থেকে মনে হয়েছিল তিনি তৃপ্ত হতে পারেননি। বলেছিলেন বইটা আরো গুছিয়ে তৈরি করা উচিত ছিল। নিজে পরিপাটি, গোছানো মানুষ ছিলেন; গুছিয়ে কিছু করার তাড়না নিয়েই জীবনে যা করার করেছেন।

তারপরও সবকিছু তো গুছিয়ে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। নিজের আওতায়ও থাকে না। ব্যক্তিগত কিছু কষ্টের কথা তিনি দু-একবার আমাকে বলেছেন। এ যেন সেই গুছিয়ে উঠতে না পারারই পরিণাম।

মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় ছিলাম বেশকিছু সময়। চেনা ঘর, ঘরভর্তি দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা শিল্পীদের বর্ণময় ছবি, স্কেচ, এচিং, ড্রয়িং। একটা দেয়ালেও দশ ইঞ্চি ফাঁকা জায়গা মিলবে না। মিনুভাবি এত এত ছবির মধ্যে হাসনাতভাইকে পাবেন, নিশ্চয়ই পাবেন; আর আমাদের দিঠি, তুই দূরে থেকে বাবাকে পাবি মানুষের নিখাদ ভালোবাসায়। ভালো থাকবেন প্রিয় হাসনাতভাই।