হাসনাতভাই

নবাবপুরের মাঝামাঝি পশ্চিম দিককার এক রাস্তায় মানসী সিনেমা হল। মানসী হলের নাম তখন ছিল ‘নিশাত’। এই হলের ঠিক উলটোদিকে লোহার বিশাল একটা গেট, টিনশেডের দৈনিক সংবাদ অফিস। যতদূর মনে পড়ে তখন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ কিছুটা শুরু হয়েছে। ১৯৭৫-৭৬ সালের কথা। তখন দুটো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা অত্যন্ত জমজমাট। একটি দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতা, আরেকটি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী। দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করতেন কবি আহসান হাবীব।

আর দৈনিক সংবাদেরটা আবুল হাসনাত। তিনিও কবি। শুধু কবি বলা ভুল হবে। তিনি সব রকমের লেখাই লিখেছেন। ছোটদের উপন্যাস, শিল্পকলা নিয়ে সুচিন্তিত প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণা ও আত্মজৈবনিক রচনা। কিন্তু আবুল হাসনাত নামে তিনি লিখতেন না। লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে।

যে-সময়কার কথা বলছি, তখনো হাসনাতভাই সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই প্রায় জানি না। শুধু জানি, তিনি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক। তাঁর পাতায় লেখার জন্য দেশের খ্যাতিমান সব লেখক অপেক্ষা করেন। আর তরুণ লেখকরা মনে করেন, দৈনিক বাংলার কবি আহসান হাবীব ও দৈনিক সংবাদের হাসনাতভাইয়ের হাত দিয়ে লেখা ছাপা হলে সেই লেখককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। অন্যসব পত্রিকা তাঁকে মর্যাদার চোখে দেখবে।

আমার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম তখন তরুণ গল্পকার হিসেবে বিখ্যাত। দৈনিক বাংলার সাহিত্যপাতায়  নিয়মিত তাঁর লেখা ছাপা হয়। দৈনিক সংবাদেও হয়। সিরাজের বন্ধু শিল্পী কাজী হাসান হাবিব। সিরাজের মাধ্যমে আমারও বন্ধুত্ব হয়েছে হাবিবের সঙ্গে। হাবিবকে ঘিরে যুক্ত হয়েছে আমাদের আরো দুই বন্ধু। মোহাম্মদ জুবায়ের ও ফিরোজ সারোয়ার। এই পাঁচজনের একটি দল হয়েছি আমরা। তখন সাহিত্যপাতা প্রকাশিত হতো রবিবার ছুটির দিনে। হাবিব একটা সরকারি চাকরি করত। সরকারি প্রকাশনা বিভাগে ইলাস্ট্রেশন মেকআপ ইত্যাদির কাজ। সেক্রেটারিয়েটের উত্তর দিককার লম্বা একটি একতলা ঘরে তার অফিস। চারদিকে ইটের দেয়াল, ওপরে ভারি টিনের চালা। হাবিবের সেই অফিসেও আমরা আড্ডা দিতে যেতাম। কবি কাজী রোজীও এখানে কাজ করতেন। তবে সপ্তাহের যে-দিনটির জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম সেই দিনটি ছিল শনিবার। সরকারি চাকরির পাশাপাশি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় পার্টটাইম কাজ করত হাবিব। অসামান্য ছবি আঁকার হাত হাবিবের। তার প্রতিটি ইলাস্ট্রেশন দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। অসামান্য লেটারিং আমাদের চোখে লেগে থাকত।

শনিবার দুপুরের পর হাবিব চলে আসত সংবাদ অফিসে। টেবিলে মাথা গুঁজে বসে গল্প পড়ত। সেই গল্পের ইলাস্ট্রেশন করত। চারটা-পাঁচটার দিকে সিরাজ, জুবায়ের, সারোয়ার আর আমি গিয়ে উপস্থিত হতাম। হাবিবের টেবিল ঘিরে আমরা চারজন। ফুকফুক করে সিগ্রেট টানছি আর চা খাচ্ছি। হাবিবের এক হাতে সিগ্রেট। সেই হাতের কাছে চায়ের কাপ। এক চুমুক চা খাচ্ছে আর একটান সিগ্রেট। অন্য হাতে কোনো গল্পের ইলাস্ট্রেশন করছে। সাহিত্যপাতা মেকআপ করছে কখনো-কখনো। ফাঁকে ফাঁকে আড্ডাও ঠিক চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে একজন গুরুগম্ভীর মানুষ এসে মৃদুস্বরে দু-একটা কথা বলে যাচ্ছেন হাবিবকে। আমাদের দিকে তাকিয়ে অতি বিনয়ী ও ভদ্রকণ্ঠে হয়তো বললেন, ‘কেমন আছেন?’ তারপরই চলে গেলেন নিজের কাজে। এই মানুষটি আবুল হাসনাত। আমাদের প্রিয় হাসনাতভাই। তিনি আমাদের ব্যাপক প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আমরা চার বন্ধুই লিখি। ছবি আঁকার পাশাপাশি হাবিব কবিতা লেখে। দু-চারটি গল্পও লিখেছে। তার ‘পরিস্থিতি’ নামে একটি গল্পের কথা আমার মনে আছে। সারোয়ার খুব সুন্দর একটি গল্প লিখেছিল। গল্পের নাম ‘একা’। হাবিবের ইলাস্ট্রেশনটি এখনো আমার চোখে লেগে আছে। সিরাজ, জুবায়েরের গল্প, আমার কত গল্প যে হাসনাতভাইয়ের হাত দিয়ে ছাপা হয়েছে! বলতে দ্বিধা নেই হাসনাতভাই না থাকলে ইমদাদুল হক মিলন নামে কোনো লেখকই হতো না। হাসনাতভাইয়ের পর আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন কবি রফিক আজাদ। এই দুজন মানুষের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা-পরিসীমা নেই।

তখন নানা ধরনের হালকা চালের প্রেমের গল্প, কিঞ্চিৎ রগরগে গল্প লিখে আমি বেশ নিন্দিত। পাশাপাশি গ্রামনির্ভর কিছু গল্প লিখে বা প্রথম উপন্যাস যাবজ্জীবন রফিক আজাদ যখন বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকায় ছাপতে শুরু করলেন তখন কিছু বড় লেখক-কবি আমার ওই লেখাগুলো পছন্দও করতে লাগলেন। আমার ওপর দিয়ে তখন দুটি স্রোত বয়ে যাচ্ছে। একদিকে নিন্দামন্দ, অন্যদিকে কিছুটা প্রশংসা। এই অবস্থায় হাসনাতভাই আমাকে নিয়ে একটা বোমা ফাটালেন। তিনি নিয়মিত আমার গল্প ছাপছিলেন। মাঝে মাঝে গল্পের নানা দিক নিয়ে আমাকে অল্প কথায় বোঝাতেন। বোমাটা ফাটালেন দৈনিক সংবাদের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে অসামান্য একটি সংকলন প্রকাশিত হলো সেই সংকলনে আমার একটি গল্প ছেপে। আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় সুকান্ত  চট্টোপাধ্যায়ের লেখা হাসনাতভাই খুব পছন্দ করতেন। ওই সংকলনে সুকান্তর ছোট্ট একটি উপন্যাস ছাপা হলো। নাম দেশ গেরামের মনিষ্যি। সেই লেখাটি ভারি চমৎকার। পাশাপাশি তরুণতর গল্পকার হিসেবে একমাত্র আমারই একটি গল্প ছাপলেন। গল্পের নাম ‘রাজা বদমাশ’।

অন্য কারো লেখা নিয়ে কোনো কথা নেই, আমার গল্প নিয়ে অনেকে কথা তুললেন। বিশেষ করে আমার বয়সী কিছু তরুণ লেখক। আমার লেখা হাসনাতভাইয়ের হাত দিয়ে ওরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সংকলনে ছাপা হয়েছে, এটা তাঁরা মেনেই নিতে পারছেন না। হাসনাতভাইকে নানা রকমভাবে সে-কথা তাঁরা বলতে লাগলেন। হাসনাতভাই চিরকাল কম কথার মানুষ। অভিযোগ শুধু শুনে যাচ্ছিলেন। একদিন বিরক্ত হয়ে এক তরুণ লেখককে বললেন, ‘ওরকম একটি গল্প লিখে নিয়ে আসুন। বিশেষ মর্যাদা দিয়ে ছেপে দেব।’

আমাদের পাঁচজনের দলটি ভেঙে হাবিব চলে গেল। ক্যান্সার আক্রমণ করেছিল তাকে। ধানমণ্ডির এক ক্লিনিকে চিকিৎসা চলছে। গেছি হাবিবকে দেখতে। তার বিছানার পাশে বসে আছেন হাসনাতভাই। যন্ত্রণায় ছটফট করছে হাবিব। সহ্য করতে না পেরে আমি বারান্দায় এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। খানিক পর এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন হাসনাতভাই। কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। কোনো কথা বললেন না। চোখ মুছতে মুছতে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন।

হাবিব চলে যাওয়ার বেশ কিছু বছর পর চলে গেল জুবায়ের। একটা সময় সে চলে গিয়েছিল আমেরিকায়। ডালাসে থাকত। একবার আমি গিয়ে জুবায়েরের ওখানে দিন-বিশেক ছিলাম। আমাদের ফেলে আসা জীবনের কত আনন্দময় স্মৃতির কথা যে দুই বন্ধুর মধ্যে হতো! জুবায়েরও আক্রান্ত হয়েছিল ক্যান্সারে। যখনই নিজেদের নিয়ে আমরা কথা বলতাম, দলটির মধ্যে নিঃশব্দে এসে ঢুকে যেতেন হাসনাতভাই। আমাদের লেখালেখির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন এই মানুষটি। আমাদের মাথার ওপর বটবৃক্ষের ছায়ার মতো ছিল তাঁর স্নেহমাখা হাতখানি।

এই হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে খুবই বাজে একটা আচরণ করলাম আমি। ১৯৭৯ সালের কথা। জীবনের প্রথম সাংবাদিকতার কাজ করছি রফিক আজাদের সঙ্গে। পত্রিকাটির নাম সাপ্তাহিক রোববার। হাসনাতভাই অসামান্য একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা করতেন তখন। ডিমাই সাইজের পত্রিকাটির নাম ছিল গণসাহিত্য। দেশের বড় লেখকরা লেখেন সেখানে। হাসনাতভাই আমার কাছে গল্প চাইলেন। অন্য জায়গায় ছাপা হওয়া একটি পুরনো গল্প হাসনাতভাইকে দিয়ে দিলাম। একবারও ভাবলাম না, পুরনো লেখা গণসাহিত্যে কখনো ছাপা হয় না। হাসনাতভাইকে বুঝতেও দিলাম না কিছু। তিনি সরলমনে গল্পটি ছাপলেন। ছাপা হওয়ার পর আমার চালাকিটা ধরা পড়ে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে হাসনাতভাই এলেন রোববার অফিসে। রোববার অফিসটা ছিল ইত্তেফাকের তিনতলায়। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমাকে ডেকে নিলেন বারান্দায়। আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি হাসনাতভাইয়ের সামনে। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, এটা আপনি কী করেছেন? আমাকে এ-রকম লজ্জার মধ্যে ফেললেন!

হাসনাতভাইয়ের লজ্জা যেন আমার ওপর এসে ভর করল। মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকাতেই পারি না। একসময় মাথা নিচু করেই বললাম, আমার ভুল হয়ে গেছে হাসনাতভাই।

হাসনাতভাই আর কোনো কথাই বললেন না। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে যেমন ঢুকেছিলেন, সেভাবেই বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, হাসনাতভাইয়ের দরজাটি আমার জন্য বন্ধ হয়ে গেল।

ধারণাটি যে কত বড় ভুল, বুঝলাম মাস দুয়েক পর। রোববার অফিসে ফোন করে হাসনাতভাই আমাকে চাইলেন। ধরলাম। বললেন, সংবাদের জন্য আগামী সপ্তাহে একটি গল্প দিতে হবে। আমার বুকের পাথর নেমে গেল।

বিভিন্ন আড্ডায় অনুষ্ঠানে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর স্নেহমাখা হাসিটি আমার জন্য আছেই। দেখা হলেই এক ফাঁকে জানতে চাইবেন সিরাজ, সারোয়ারের কথা। হঠাৎ হঠাৎ আসবে হাবিব প্রসঙ্গ। জুবায়েরের প্রসঙ্গ। তাঁর চোখে সে-সময় বিষণ্নতা খেলা করে যেত।

ঢাকা ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে দেখা। আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে কালি ও কলম নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বেরোবে। প্রথম সংখ্যা থেকে আমরা দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপব। কলকাতা থেকে লিখবেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলাদেশ থেকে আপনি। কাল থেকেই লেখা শুরু করুন।

দুই বছর ধরে কালি ও কলমে লিখলাম দেশভাগের পটভূমিতে পর উপন্যাসটি। সময়মতো কিস্তি দিতে পারতাম না। কিন্তু হাসনাতভাই কখনোই রাগ করতেন না। মায়াবী গলায় বোঝাতেন, পত্রিকাটি তো সময়মতো বের করতে হবে। দেরি করলে ঝামেলায় পড়ব।

আহা রে, লেখালেখির জন্য কত কষ্ট হাসনাতভাইকে আমি দিয়েছি!

‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক’ পুরস্কার প্রবর্তন হলো। বিচারকমণ্ডলীতে নিয়মিতই আমাকে রাখতে লাগলেন হাসনাতভাই। পুরস্কার প্রদানের এক অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমিও অতিথি। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্ণধার আমার অতিপ্রিয় আবুল খায়ের লিটু ভাই আছেন। লুভা নাহিদ আছেন আর আছেন সবার প্রিয় আনিসুজ্জামান স্যার। সেই অনুষ্ঠানে হাসনাতভাইয়ের স্নেহের ছায়ায় কিভাবে বেড়ে উঠেছি আমি সেসব কথা কিছুটা বললাম। নিজের প্রশংসা বা কৃতিত্বের কথা শুনলে এতটাই আড়ষ্ট হতেন হাসনাতভাই, মুখ তুলে কারো দিকে তাকাতেই পারতেন না। অনুষ্ঠানশেষে এক ফাঁকে আমাকে শুধু বললেন, ‘এত কিছু বলতে হয় নাকি!’

এই হাসনাতভাই নিঃশব্দে আমাদের ছেড়ে গেলেন। খবরটা আমাকে প্রথমে দিলেন কবি তারিক সুজাত। আমি জানালাম কবি কামাল চৌধুরীকে। কয়েক বছর ধরে কবি মাহবুব সাদিক ও আমার বন্ধু অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষের সঙ্গে ‘কালি ও কলম’ পুরস্কারে বিচারক থাকি আমি। ব্যবস্থাটি হাসনাতভাই করেছেন। তাঁর চলে যাওয়ার দিন মাহবুব সাদিক ফোন করলেন। ফোনের দুই প্রান্তে আমরা দুজন দু-একটি কথা বলে নিঃশব্দ হয়ে থাকলাম। বিশ্বজিতের সঙ্গে ফোনেও একই অবস্থা। কালের কণ্ঠে আমার সঙ্গে কাজ করে জাকারিয়া জামান। অফিসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, আমি অনেককে বলেছি আজ মিলনভাইয়ের মন খুবই খারাপ থাকবে। তাঁর অতিপ্রিয় হাসনাতভাই চলে গেছেন। আমার দীর্ঘদিনের সহকারী মোহাম্মদ শাহীন। বিভিন্ন সময় হাসনাতভাইয়ের কাছে আমার লেখা নিয়ে সে গেছে। আমাকে না পেলে অনেক সময় শাহীনকে ফোন করতেন হাসনাতভাই। তাঁর চলে যাওয়ার কথা শুনে ধপ করে বসে পড়ল শাহীন। মৃদু কণ্ঠে বলল, হাসনাত স্যার ছিলেন সোনার মানুষ। এই জীবনে এ-রকম মানুষ আর দেখব না। শাহীনের কথা শুনে আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমাদের সোনার মানুষটি চলে গেছেন। কোথায় পাব তারে!