সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত

প্রারম্ভে কিছুটা ভণিতা।

নেত্রকোনার কুমড়ি পল্লিতে আমার জন্ম হয়েছিল আমার নানাবাড়িতে। সেই বাড়িতে একটি বিশাল কোঠা ছিল। তখন প্রায় পরিত্যক্ত এই কোঠায় কাঠের একটি আলমিরা ছিল।  একেবারে শৈশবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একদিন সেখানে লুকোতে গিয়ে আলমিরাটা খুলে ফেলেছিলাম। তখন সহসা সেখানে আমি অনেক পত্র-পত্রিকা দেখতে পাই। দেখে বেশ অবাক হই। আমার শিশুমন কিছুটা ভয়ও পায়। বেশির ভাগ বইপত্র ছিল কীটে খাওয়া। যতদূর মনে পড়ে এর মধ্যে ছিল কলকাতার দেশ ও সওগাত। ব্রিটিশ আমলে ছাপা। সে-ই ছিল বাংলা সাহিত্য সাময়িকীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা! তবে অদ্ভুত দেখাই বটে!

১৯৪৭ সালে ঢাকায় বসতি গাড়লেও, আমার রক্ষণশীল মুসলমান পারিবারিক পরিবেশে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে, বাংলা সাহিত্যচর্চার সুযোগ ছিলই না। সে-কারণে শিশুসাহিত্য পাঠ হয়নি। কৈশোরের শেষদিকে আমি নিজেই নিউমার্কেটের বইয়ের মহালে ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ ও [হুমায়ুন-কবির সম্পাদিত] চতুরঙ্গ পত্রিকা দুটির সঙ্গে দেখা ও মাখামাখি হয়। দুটো দুরকম প্রজাতির পত্রিকা; তাই স্বাদও পৃথক। একসময়, ঢাকা থেকে প্রথমে সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত সমকাল এবং পরে এনামুল হক-সম্পাদিত উত্তরণ নামে দুটি মেধাবী সাহিত্য পত্রিকা বাজারে আসে। বেগম, সওগাত, মাহে নও ছাড়াও দৈনিক পত্রিকাগুলোরও ছিল সাহিত্যপাতা। জগন্নাথ কলেজে আইএ পড়ার সময় আমি বৈতালিক নামে হাতে-লেখা একটি দেয়াল পত্রিকা চালাতাম। সেটা ছিল ১৯৪৭-৭১ কালের পরাধীন বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্য সাময়িকীর একটি স্বর্ণযুগ বলতে পারি। ষষ্ঠ দশকের কিছুটা সময় দৈনিক আজাদের সাহিত্যপাতা চালানোর দায়িত্ব আমার ওপর চাপানো হয়েছিল। এ-সুবাদে বেশ সাহিত্য আড্ডা বসত আজাদ আপিসে। তখন এই সাহিত্যপাতায় সে-সময়কার নবীন সাহিত্যিকদের মধ্যে, যতদূর মনে পড়ে – হুমায়ুন কবির, শশাঙ্ক পাল, নির্মলেন্দু গুণ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী লিখতেন। একসময় ভারত থেকে চতুরঙ্গ আসা বন্ধ হয়ে যায়। তবে সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে এর কাঠামো ও সৌষ্ঠব ও বিদগ্ধতা আমার মন থেকে কখনোই নড়েনি।

দুই

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার পর, একটি সুষ্ঠু ও মননশীল সাহিত্য পত্রিকার মুখ দেখার প্রগাঢ় বাসনা সাহিত্যরসিকদের মনে ছিল। শুধু মনে মনেই ছিল। ১৯৭৩ সালের শেষ মাসে আমি বিলেতে চলে আসি এবং সুদীর্ঘ কাল স্বদেশের সাহিত্য অঙ্গনের অনেক খবরই পেতাম না। যদিও যুক্তরাজ্য বাংলা সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে (কিছুকাল এর সভাপতিত্বের দায়ভার আমার কাঁধে ছিল) লন্ডনে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলন হতো; এতে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক ও (স্থানীয়ভাবে) আবদুর গাফফার চৌধুরীর মতো প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা আসতেন। তাঁদের মুখ থেকে অনেক তরতাজা সাহিত্য-সন্দেশ পাওয়া যেত। 

সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক বাংলা মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম যে ২০০৪ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেছিল তা আমি টের পাই ২০০৮ সালে দেশে যাওয়া-আসা শুরু করার পর। বছরে একবার যেতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ডক্টর আনিসুজ্জামান এর প্রধান সম্পাদক বা সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি। প্রকাশক আবুল খায়ের। তাঁর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। পত্রিকাটির অফিসে একদিন যাবার পর এর সম্পাদকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমি বলব ক্ষণিকের সাক্ষাৎ। আমার কোনো একটি লেখা কালি ও কলমে প্রকাশ করা নিয়ে। সম্পাদক আবুল হাসনাতকে মনে হলো – স্বল্পবাক, অনুচ্চস্বর ও অতিশয় বিনয়ী ও স্নিগ্ধ একজন মানুষ। এর পরেও কয়েকবার সাক্ষাতে ও টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল; তবে মানুষ হিসেবে তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণার মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমার জীবনে যে-সকল সাহিত্য সম্পাদকের দেখা পেয়েছি – যেমন কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস (সাপ্তাহিক পূর্বদেশ), আবদুল গণি হাজারী (লেখক সঙ্ঘ পত্রিকা), আহসান হাবীব (দৈনিক বাংলা সাহিত্য সাময়িকী), এস এম পারভেজ (চিত্রালী), সন্তোষ গুপ্ত (দৈনিক আজাদ সাহিত্য সাময়িকী), শাহাদাত চৌধুরী (সাপ্তাহিক বিচিত্রা), বেলাল চৌধুরী (কবিতা পত্রিকা) – এমনকি ডক্টর আনিসুজ্জামান, এঁরা সবাই কমবেশি আড্ডাবাজ ছিলেন – এদের কারোর মতোই হাসনাতকে মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে তাঁর চারপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর ছিল, সেটা ভেদ করে তাঁর ব্যক্তিটিকে আমি চিনতে পারিনি। চিনতে পারলে আনন্দময় হতো।

তিন

একজন সাহিত্য সম্পাদকের কৃতিত্ব বা কীর্তি টের পাওয়া সহজ নয়। কখনো তাঁর নাম পত্রিকায় ছাপাও হয় না। পত্রিকায় যা যা ছাপা হয়, যেমন প্রবন্ধ/ নিবন্ধ, কবিতা, গল্প/ উপন্যাস, সমালোচনা – এর কিছুই তিনি লেখেন না। সচরাচর তিনি ছবি আঁকেন না, আলোকচিত্র তোলেন না, যদি না তাঁর পত্রিকায় তাঁর নিজের সম্পাদকীয় লেখার নিয়ম থাকে। বকলম সম্পাদক বলে একটা কথা আছে না। তবে তিনি করেনটা কী? পত্রিকার প্রচ্ছদ, অঙ্গসজ্জা করার লোক থাকেন। মেকআপ করার জন্যে লোক থাকেন। তবে? পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে যে অসংখ্য লেখা পাঠানো হয়, যার সিংহভাগই ছাপার অযোগ্য, সেগুলো সবই কি তিনি পড়ে দেখেন? তাহলে সহযোগী/সহকারী সম্পাদকরা কী করেন?  এর বাইরে আছে পত্রিকার বিজ্ঞাপন, কম্পিউটার, ছাপা, বাঁধাই, বিক্রি, পাঠক প্রতিক্রিয়া, লেখক পারিতোষক/ কল্যাণ/ প্রণোদনা ও সাহিত্য পুরস্কার।

সম্পাদক নিজের হাতে হয়তো এর কিছুই করেন না। তবে সবকিছুর ওপর সম্পাদকের নজর থাকে। প্রকাশকের নীতিমালায় তিনি চলেন। প্রধান সম্পাদকের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক হতে পারে তাঁর। সহযোগী সম্পাদক এবং বিভাগীয় কলাকুশলীদের সঙ্গে তাঁর নিত্য যোগাযোগ। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্যে সবাই তাঁর কাছে ছুটে আসেন। তিনি যেন নৌকোর মাঝি। হাল ধরে থাকেন তিনি। তরী বা এ ক্ষেত্রে, পত্রিকা যে আপন নির্ধারিত পথে যায় সেটা নিশ্চিত করাই সাহিত্য সম্পাদকের কাজ।

কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাত এই কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছিলেন। তিনি নীরবে কাজ করতেন বলেই হয়তো উইকিপিডিয়ায় কালি ও কলমের পৃষ্ঠাটিতে তাঁর নামের কোনো উল্লেখ নেই। তবু পাঠক ও লেখক মহল জানে, আবুল হাসনাত কালি ও কলমের সৌষ্ঠব, বৈশিষ্ট্য ও রচনাদির নির্দিষ্ট ও উন্নত মান সমুন্নত রাখতে পেরেছিলেন। তিনি নিজে যে কবি ছিলেন এবং সুদীর্ঘ কাল ধরে তিনি যে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন, তা নিশ্চয়ই তাঁর সহায়ক ছিল। চরিত্রের দিক থেকে কালি ও কলম একটি নির্বিরোধ অমায়িক সাময়িকী আর তাই বাংলাদেশের জন্যে অপরিহার্য সাহিত্য সমালোচনার শূন্যতাটি আংশিকভাবেও পূরণ করতে পারেনি বলে আমার একান্ত ধারণা। অনাগতকালে এর পরিবর্তন হবে কি-না তা দেখবে কাল।