অন্তর্জলীসূত্র

মোসাদ্দেক আহমেদ

কমলকুমার মজুমদার বাংলা সাহিত্যের তেমন একজন বিরল কথাশিল্পী, যিনি প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন কথাসাহিত্যকে গতানুগতিকতার বাইরে নিয়ে যেতে, চেয়েছিলেন কাহিনি-কাঠামোর প্রচল ও বহুচর্চিত ধারাকে ছত্রখান করে দিয়ে উপন্যাসকে থিমপ্রধান করে তুলতে; ফলে প্রথমদিককার রচনায় ঘটনাপ্রবাহের কিছু ঘনঘটা থাকলেও পরের দিকে তা তেমন ছিল না; বরং শব্দের পর শব্দের পসরা সাজিয়ে উপন্যাসকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন বিমূর্ত চিত্রকলা কিংবা উচ্চাঙ্গসংগীতের স্তরে, অর্থাৎ উপন্যাসকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যার রসাস্বাদনে বিদ্যাবুদ্ধির তুলনায় বোধশক্তিই হবে অধিক কার্যকর। এ-কথা লেখা বাহুল্য যে, সেখানে তাঁর সার্থকতা ঈর্ষণীয়। কথাটা উচ্চাঙ্গসংগীত অথবা বিমূর্ত চিত্রকলাই। ফলে এটি অনুভবেরই বিষয়। এভাবে দেখলে কমলকুমার মজুমদার তেমন দুর্বোধ্য নন, বরং অতীব গুরুত্বপূর্ণ লেখক। শব্দের বাচকতা তাঁর হাতে এতটাই স্ফূর্তি পেয়েছে যে, কমলকুমারীয় গদ্যে চিত্রকলার ছড়াছড়ি। দুটো লাইনের মাঝে যে ফাঁকা জায়গা থাকে, সেটাই যেন চিত্রকল্পের ইশারা হয়ে পাঠককে পথ দেখায়। এমন বিবেচনায় যদি বলা যায়, কাব্যের পাঠকরা বরঞ্চ তাঁর গদ্যপাঠে বাড়তি সুবিধা ভোগ করবেন, তবে তা অত্যুক্তির হয় না। কথাটা এ-কারণেই বলা যে, কাব্যে ওই জিনিসটা সুপ্রচুর থাকে। চিত্র যেখানে আক্ষরিক অর্থময়তায় আবদ্ধ, চিত্রময়তা তা নয়। চিত্রকল্প চিত্রের অধিক ব্যঞ্জনা সৃজনে সমর্থ। কিংবা এভাবেও বলা যায়, ছড়ার একটি পঙ্ক্তির সঙ্গে কবিতার একটি পঙ্ক্তির যে-তফাৎ, চিত্রের সঙ্গে চিত্রকল্পের পার্থক্যটাও ঠিক তেমন। ফলে কবিতার সাম্রাজ্য ছেড়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে চিত্রকল্প যখন ঢুকে পড়ে কথাসাহিত্যের কাঠখোট্টা জমিনে, তখন পাঠকের পূর্বপ্রস্ত্ততিটাও হয়ে পড়ে জরুরি।

কথাটা পাঠকের পূর্বপ্রস্ত্ততিই, সন্দেহ নেই, কমলকুমার তেমন তন্নিষ্ঠ পাঠকই চেয়েছিলেন আর সেটা সংগতই। কেননা, তাঁর ক্ষেত্রে বটতলার উপন্যাসের পাঠক জুটে গেলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী, ক্ষতি দুপক্ষেরই। এ-কথায় আরেক মজুমদার, অমিয়ভূষণকে মনে পড়ছে, তিনিও তেমন পাঠক চাইতেন, যাদের সঙ্গে তাঁর ওয়েভলেন্থ মিলবে। কথাটা এভাবেও বলা যায় – যারা রুপার খরিদ্দার, তাদের কাছে সোনার সমাদর প্রত্যাশা করাটা বাতুলতামাত্র। নর-নারীর নামযুক্ত ঘটনাবলি যা উপন্যাস বলে হামেশা চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমন প্রচেষ্টার সঙ্গে অমিয়ভূয়ণ মোটেই একমত ছিলেন না; তাঁর কাছেও উপন্যাস ছিল থিম বা জীবন্ত ভাবের বিষয়, যা চোখের নিচে ফুটে ওঠে। দুই মজুমদারের এই ঐকমত্য খেয়াল করার মতোই বটে। কেবল খেয়াল করার মতোই নয়, দুজনার এই সাহিত্যভাবনা এবং সেই আলোকে তাঁদের কাজগুলো অপরিসীম গুরুত্বেরও দাবিদার।

আগেই বলা হয়েছে, স্টোরি টেলিং এখানে প্রধান বিবেচ্য নয়, এমনকি ভাবতে গেলে তেমন উল্লেখযোগ্য সমকালীন পটভূমিকাকেও কমলকুমার বেছে নেননি। বরং তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসের কালখন্ড উনিশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগ অর্থাৎ সেই ঔপনিবেশিক আমল। এটা যে কেবল বিগত শতকের বাঙালি-গৌরবের মুগ্ধতা থেকে সূচিত হয়েছে, তা একতরফা বলা যাবে না। প্রকৃতপ্রস্তাবে উপন্যাসকে বস্ত্তগ্রাহ্যতার সীমানা ডিঙিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। এমনকি এ-বাসনা তাঁর উপন্যাসে, অন্তর্জলী যাত্রায় গোপনও থাকেনি – ‘যশোবতীর কণ্ঠস্বর সঙ্গীতময় হইত যদি তাহা আকাশচারী; কাব্যময় হইত যদি তাহা সৃজনক্ষম; চিত্রমায়া হইত যতি তাহা বর্ণিকাভঙ্গধর্ম্মী’ ফলে এমন বাক্যবন্ধ ‘হায়, শ্মশানের সুদীর্ঘ গল্প আছে।’ আলোচ্য অন্তর্জলী যাত্রায় থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটির সময়কাল মাত্র কয়েক দিনের, চরিত্রসংখ্যাও হাতেগোনা। কাহিনিপ্রবাহ নিতান্তই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তাঁর হাতে পড়ে তা অসামান্য ব্যঞ্জনাদীপ্ত হয়ে উঠেছে।

মরণোন্মুখ অশীতিপর ব্রাহ্মণ সীতারামকে শ্মশানঘাটে আনার অব্যবহিত পরও যখন তার মৃত্যু হয় না, যখন দেখা গেল সীতারামের জান কঠিন, খানিকটা আগামই ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়ে গেছে, তখন জ্যোতিষী অনন্তহরী বেশ ফাঁপরে পড়ে, ক্ষুব্ধও বটে। তখন জ্যোতিষী গ্রহবিচার করে সীতারামের মৃত্যুক্ষণ ঘোষণা করে আসন্ন পূর্ণিমায় অর্থাৎ চাঁদ যখন লাল হবে তখন। শুধু কি তাই, সীতারাম একা যাবে না, দোসর নেবে – এই দোসর বলতে  যে সতীদাহ প্রথাকে বোঝানো হয়েছে, তা খোলাসা হতে সময় লাগেনি। পুরোহিত আর জ্যোতিষীদের তৎপরতায় দোসর জুটাতেও দেরি হয় না। লক্ষ্মীনারায়ণের পরমাসুন্দরী কন্যা যশোবতীর সঙ্গে মরণাপন্ন সীতারামের বিবাহ সম্পন্ন হয়। ঘটনার জট খুলতে থাকে ঠিক এখান থেকে। গঙ্গাতীরের এই বিবাহটি প্রকান্ডসব অভিঘাত সৃষ্টি করে ছড়িয়ে পড়ে অনন্তে। কথাটা অনন্তই, কেননা, মনুষ্যহৃদয়ে যা বিপুল ঢেউ তোলে, তা অনন্তের পানেই ধায়! আবার মানবমনের এই ঢেউসমষ্টি আর্টের বিয়য় বলে তাকে অতলান্তও বলা চলে। এদিকে উপন্যাসে চরিত্রসংখ্যা যেহেতু গুটিকয়েক, ফলে সেই অভিঘাত অল্প জায়গায় অনেক বেশি প্রচন্ডতা সৃষ্টিতে সমর্থ হয়। সীতারামের নবপরিণীতা যশোবতী ও যশোবতীর প্রতি অনুরক্ত ওই শ্মশানের শবদাহকারী চাঁড়াল বৈজুনাথের দিকে তাকালে তা সহজেই বোঝা যায়।

চিতার হাজারো শব যার হাতে ঠেঙা খায়, সেই বৈজুনাথই এমন জবরদস্তির বিবাহকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না; আর সেটা সে অপ্রকাশ্যও রাখে না। কেননা, সহমরণের বড় চিতায় জ্যান্ত কেউ পুড়ে মরবে – এটা ভাবতেই চাঁড়াল বিচলিত হয়ে পড়ে। এটা যে সে কেবল যশোবতীর রূপে আবিষ্ট হয়ে এমত করে, তা নয়; বরং তা সে আন্তরিকভাবেই চায়। তার বিবেচনায় কাল যাকে টেনে নিয়েছে অর্থাৎ যে সীতারাম একপা চিতায় বাড়িয়েই রেখেছে, সে যাক; কিন্তু এই ঘাটের মড়ার সঙ্গে যশোবতী কেন নিজেকে আত্মবিলোপ করবে? বিষয়টি অধিক বিবেচনার দাবি রাখে। কেননা, উচ্চবর্ণশাসিত তৎকালীন সমাজ যে জীবনসত্য বুঝতে অসমর্থ, তা কত অনায়াসেই নিম্নবর্ণের অচ্ছুৎ বৈজুর ভাবনায় ধরা পড়ছে। এতে করে তদানীন্তন সমাজচিত্র অতিশয় জীবন্ত হয়ে ওঠে, খন্ড স্থিরচিত্র থাকে না। কখনো ইশারায় কখনো সরাসরিই যশোবতীকে পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করে বৈজু। তেমন উস্কানিতে যখন যশোবতী কান করে না, তখন বৈজু এমনও ভাবে – ব্রাহ্মণকন্যাকে একবার ছুঁয়ে দিতে পারলে বুঝি অভিপ্রায় হাসিল হয়। অস্পৃশ্যের ছোঁয়ায় হয়তো জাতচ্যুত হবে। তেমন ভাবনা থেকেই বুঝিবা বৈজুর মধ্যে ভাবান্তর আসে, যশোবতীর প্রতি সে কামপরবশও হয়ে পড়ে। এই লিপ্সার পেছনে আরেক কারণও কাজ করে। যশোবতীর মধ্যে সে তার মৃত স্ত্রী পান্না ভৈরবীর ছায়া দেখতে পায়। স্ত্রী পান্না ভৈরবীকে যে অকালেই হারিয়েছে। পান্নার কুমীরের পেটে যাওয়ার পেছনে যে-কারণটি বৈজু দেখতে পায়, সেখানে সে নিজেকেই অপরাধী মনে করে। সহমরণের বিরাটকায় চিতায় অসংখ্য জলজ্যান্ত বধূকে পুড়িয়ে মারার স্বীয় পাপবোধকেই সে দায়ী করে। যেন তার হয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতেই ভৈরবীর এই অকালবিদায়। এভাবে যশোবতীর ওপর তার যে ঐকান্তিক টান তৈরি হয়, তা নানামাত্রিক হয়ে ওঠে, যা বৈজুর চরিত্রকে গহিনতা দান করে।

বৈজুনাথ, লোলচর্ম বৃদ্ধ সীতারাম এবং যশোবতী – এই প্রধান তিনটি চরিত্রের মধ্যে যশোবতীই সর্বোচ্চ গভীরতাব্যঞ্জক ও অনবদ্য। সুতরাং যশোবতীকে নিরীক্ষণের আগে সীতারামের কাছে যাওয়া ভালো। তাতে করে অন্তত ব্যঞ্জন পরিবেশনের ধারাটি রক্ষিত হয় অর্থাৎ শেষে গিয়ে দইয়ের স্বাদ পাওয়ার আশ্বাস থাকে। এভাবে বলাটাও আবার ষোলোআনা সঠিক হয় না। কেননা, জীবন-অভিলাষী বৈজু ও ব্রাহ্মণ সমাজের দায়-উদ্ধারকারী যশোবতীর মাঝখানে এক অস্বস্তিকর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকে তো এই সীতারামই। মহাকাল আপন গর্ভে যাকে প্রায় টেনেই নিয়েছে, তার পক্ষে, সেই সীতারামের পক্ষে উজানসাঁতারকাটা যে আর সম্ভবপর নয়, এটা বুঝেও অবুঝ সে। এমনকি অপস্রিয়মাণ জীবননদীর তীরবর্তী হতেও সে যৎপরনাস্তি বেপরোয়া। যশোবতীর সঙ্গে বিয়ের কথা হতে প্রথমেই সে মুখের দাড়ির দিকে ইঙ্গিত করে। এর মধ্য দিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াতে চায়, হোক না দন্তহীন মাড়ির তল দিয়ে মুখের লালাপ্রবাহকে বাধা দিতে সে অসমর্থ, তবু সে যেন নিজেকে একটু ভদ্রস্থ করে নিতে চায়। বিয়ের পরে তার বাঁচার অদম্য আকাঙ্ক্ষা সুতীব্র হয়। বউকে সে গান গাইতে বলে। একপর্যায়ে সে নিজেই প্রবল হিক্কা ও কাশির দমকের মধ্যে গান ধরে। আরো পরে বলে, ‘বউ আমি আবার ঘর করব, ছেলে দুব।’ জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সীতারামের এই যে তীব্রতর আকুতি, মজার ব্যাপার এখানে। তা কিন্তু পাঠকের সমবেদনা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়। এমত হওয়ার কারণ এই, এটা পাঠকের তো বটেই, যশোবতীরই বিশ্বাস হয়নি। কেবল যশোবতীর কেন, এটা খোদ সীতারামের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এই যে দোলাচল, অন্যভাবে দেখলে, পাঠককেও তা আতান্তরে ফেলেছে। যতই পাঠক মনে-মনে বৈজু ও যশোবতীর মিলন কামনা করুক না কেন, পাঠক তো আবার প্রকাশ্যে ওই সীতারামের মরণও চাইতে পারছে না। ফলে হচ্ছে কী, এই কার্যকারণ সম্বন্ধটি উপন্যাসসৃজনের সপক্ষে চলে যাচ্ছে। লেখাটিকে এক শক্ত ভিতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে; নির্মাণকৌশলের এই ধরনটি তাই আমাদের মুগ্ধ না করে পারে না।

সীতারামকে নিয়ে পাঠককুলের এটাই কিন্তু একমাত্র সমস্যা নয়, আরো আছে। বোধকরি একেই প্যারাডক্স বলে। সীতারামের অনেক ন্যায়সংগত চাওয়া-পাওয়াকেও আবদার-হেন মনে হয়। শুধু কি তাই? বৃদ্ধের যখন দুধ খেয়ে বলশালী হওয়ার ইচ্ছে জাগে আর সেই দুধ কিনতে গিয়ে ভেড়িপথে চাঁড়ালের সঙ্গে যশোবতীর দেখা হয় এবং সেই সাক্ষাতের এক জায়গায় বৈজুর ভেড়িপথের ঢাল বেয়ে আছাড় খাওয়া দেখে যশোবতী সশব্দে হেসে ফেলে এবং সেই হাস্যধ্বনি কানে যেতে কোলকুঁজো বুড়ো ঈর্ষায় ফেটে পড়ে নববধূকে যখন চূড়ান্ত শাপমন্দ করে। তখন তা কৌতুকের ব্যাপারই হয় যেন-বা। উপরন্তু বৃদ্ধের সামগ্রিক কার্যকলাপ দেখে পাঠকের তখন আরেক মজুমদার, অমিয়ভূষণের সেই বিখ্যাত উক্তিটিকেই মনে পড়ে – পুরুষ কখনো লজ্জা শেখে না।

এবার যাকে সবচেয়ে বেশি জায়গা দেওয়া উচিত, সেই যশোবতীর প্রসঙ্গে আসা যাক। চরিত্রটি কমলকুমারের এক অপূর্ব সৃষ্টি। এর মুখ্য কারণ যশোবতী নিরেট সত্তা নয়, বরং তার চরিত্রের দ্বৈততাই নবোঢ়াকে প্রাণবন্ত ও অতলান্ত করেছে। একদিকে সে পতিব্রতা, অন্যদিকে বৈজুর দিকেও তার চোরাটান লক্ষ করা যায়। তার মনের এই বিভাজন পুরো উপন্যাসজুড়েই ক্রিয়াশীল থাকে এবং ক্ষণে ক্ষণে তা রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি খেলার মতো রূপ বদলায়। তার পতিপ্রেম এই হয়তো প্রাধান্য বিস্তার, তো পরক্ষণেই তার দ্বিচারিণী মানসলোক প্রবলতর হয়ে ওঠে। আরো চমৎকারিত্ব এই, দুটো সত্তাই প্রায় সমান আন্তরিক। ফলে এই দ্বৈরথ ক্লাসিক লড়াইয়ের মর্যাদা পেয়ে যায়। বৈজুর হাজারো মনভোলানো কথায় যে যশোবতী অনড় এবং একসময় ক্ষিপ্ত হয়ে হাতের বলয় ছুড়ে মারে। পরে সেই যশোবতীর প্রতিরোধ কীভাবে একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ে, তা বুঝতে এই উদ্ধৃতি যথেষ্ট হয় – ‘এবম্প্রকার ভাষায় যশোবতীর দেহ, শিখা যেমত, পদ্মপত্র যেমত, তড়িৎপ্রবাহ যেমত, অতীব চঞ্চল, আপনার মস্তক সঞ্চালন করিয়া অন্তর্মুখী হইতেই কাজললতা মাটিতে খসিল। তিনি, ইহা কি সত্য, সম্মোহিতা হইলেন।’ তবে যশোবতীর এই চিত্তচাঞ্চল্য কিন্তু স্থায়ী হয় না। প্রতিমুহূর্তে তা রং বদলায়। এর প্রমাণ মেলে দ্বিধাবিভক্তির এই খেলাটি অনেকটা অগ্রসর হলে। কোনোপ্রকারে যখন যশোকে টলানো যায় না, তখন তামসিক চাঁড়াল বৈজু মরিয়া হয়ে ওঠে। রাত্রিবেলায় নবদম্পতির চাঁদোয়ার কাছে ফের ফিরে আসে। এর আগে একবার তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, এবার ব্যর্থতাকে মুছে ফেলতে সে দৃঢ়সংকল্প। যাবতীয় আক্রোশ চরিতার্থ করতে হিতাহিত কান্ডজ্ঞানরহিত। প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে আচমকা ঘুমন্ত যশোবতীর পাশ থেকে নিদ্রিত সীতারামকে দুই হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত গঙ্গার দিকে ধাবিত হয়। উদ্দেশ্য পথের কাঁটা সীতারামকে ডুবিয়ে মারা; কিন্তু তেমন প্রয়াস সফল হয় না। আচম্বিতে অচৈতন্য সীতারাম জেগে উঠে বিঘ্ন ঘটায়। অবস্থা এমন হয় যে, সীতারামকে জলে ফেলতে গেলে বৈজুকেও ডুবে মরতে হয়। ভীত চন্ডাল যখন বলে – ‘কি রে বাবা, আমায় দোসর লিবি নাকি’? তখন তা যতটা না কৌতুককর শোনায়, তার চেয়ে নাছোড় সতীদাহ প্রথার ভয়াবহতাকেই ভিন্ন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনে। সীতারামকে জলে চুবিয়ে মারার চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর জাতচাঁড়াল কৌশল পরিবর্তন করে। গঙ্গাতীরে বুড়োকে নামিয়ে তার হাতদুটো এঁটে বাঁধতে থাকে। এখানে এসে পরিস্থিতি দ্বিতীয় দফা পাক খায়। নিদ্রিতা যশোবতী ইতোমধ্যে জেগে উঠে স্বামীর খোঁজ করতে-করতে গঙ্গাতীরে উপস্থিত হয়ে শায়িত বৃদ্ধের ওপর রজ্জু বন্ধনকারী বৈজুকে দেখতে পায়। আর যাবে কোথায়, যশোর সেই সত্তাটি সজাগ হয়, যা স্বামীপ্রেমের প্রতিরূপ; অর্ধদগ্ধ একটা চেলাকাঠ কুড়িয়ে নিয়ে বৈজুকে আঘাত করে ধরাশায়ী করে।

ঘটনাক্রম এখানে রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির অবতারণা করে। উত্তেজনার পেন্ডুলামটি বারবার অবস্থান বদল করতে থাকে। আঘাতপ্রাপ্ত বৈজু মাথা তুলে যখন দেখতে পায়, বিমূঢ় যশোবতী অচেতন স্বামীকে জাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করার পর অসহায় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তখন সে এগিয়ে এসে নির্জীব বৃদ্ধকে কোলে তুলে নিয়ে চাঁদোয়াতলে রেখে আসতে চায়; কিন্তু সেটাও যখন বাদ সাধে মেয়েটি, তখন ক্রুদ্ধ ধৈর্যচ্যুত চন্ডাল স্থানত্যাগ করে। চন্ডালের প্রস্থানের পর যশোর কর্তব্যজ্ঞান উপস্থিত হয়। সিক্ত কর্দমাক্ত নিঃসাড় বুড়োর নোংরা বস্ত্র বা কটে খুলে নিয়ে অন্য একটি কটে পরিয়ে দেয়। আরো যা করে, শুচিতারক্ষার নিমিত্তে সে গঙ্গার জলে স্বামীর নোংরা কাপড় ধোয়ার পর নিজের ভেজা শাড়িটি পরিষ্কার করতে উদ্যত হয়। একটা গামছা কোমরে জড়িয়ে নদীজলে স্নান-সমাপনপূর্বক সে যখন বেলাতটে উঠে আসে, পেন্ডুলামের কাঁটাটি আরেকপ্রস্থ মোচড় খায়। কেননা, ভেড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ বস্ত্রসংস্কারের সবই দেখছিল চন্ডাল। মাভৈঃ গর্জন ছেড়ে পশুর মতো চিৎকার দিয়ে সে যশোবতীর সামনে হাজির হয়। গামছাপ্রান্ত আকর্ষণ করে সে যখন যশোবতীর যৌবনবতী অনাবৃত নশ্বর দেহখানি তুলে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন এক মস্ত ঘোরই তৈরি হয়। গোটা প্রক্রিয়াটি বৈজুকে কতখানি মনুষ্যোচিত করে আর কতখানি কামাতুর করে – এই এক পরিত্রাণহীন গোলকধাঁধাই নির্মিত হয়। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্যই তো। কার পক্ষাবলম্বন করবে পাঠক – তাও যেন অনিশ্চিতময় হয়ে ওঠে। কেননা, যে-পক্ষই জয়লাভ করুক না কেন, তাতে কি সত্য কুণ্ঠিত হয় না! একবার মনে হয়, এই অন্যায্য সতীদাহপ্রথা বানচাল হওয়া উচিত। বৈজুর কথামতো যশোর এমন কোনো দূরদেশে চলে যাওয়া উচিত, যাতে করে সে বেঁচে যেতে পারে; পরমুহূর্তে মনে হয়, এটা কি বৈজুর অন্যের স্ত্রীকে বলপূর্বক অপবিত্র করা নয়, যদিও এমত ভাবনাটি স্থায়িত্ব পায় না। পাঠকের মনোভঙ্গি পরিবর্তিত হতে সময় লাগে না। মনে হতে থাকে, তারুণ্যের জয়গান এত প্রলম্বিত হচ্ছে কেন, কেনই-বা শ্মশানঘাটের মড়া বা সামাজিক অনাচারের কারণে পীড়িত হচ্ছে সেই প্রাণোচ্ছলতা যা জীবনরসের সহোদরা।

কিন্তু যশোবতী যেহেতু একক নিরেট সত্তার প্রতিভূ নয়, ফলে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস বিলম্বিত হয়। বৈজু যতই যশোর মধ্যে সাদামনের পান্না ভৈরবীর ছায়া দেখুক না কেন, মেয়েটির পতিঅন্তঃপ্রাণ মনটি পেন্ডুলামের চঞ্চল কাঁটাটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যশোর অধার্মিক নিন্দনীয় ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বৈজু পুনরপি প্রস্থান করে। কিন্তু সেই সোনালি গোলকধাঁধার প্রভাব বলে কথা, ক্ষুব্ধ হতাশ বৈজুর চলে যাওয়া মোটেই যশোকে আশ্বস্ত করতে পারে না। উল্টো শ্মশানের প্রেতাত্মক পরিবেশ ও স্রোতবিক্ষুব্ধ বেলাভূমি তাকে ভীতসন্তস্ত্র করে। সে দৌড়ে ভেড়িপথে গিয়ে বৈজুর খোঁজ করে এবং বৃক্ষের আড়ালে চাঁড়ালকে দেখতে পেয়ে তাকে চলে যেতে নিষেধ করে। তবে তা ওই পর্যন্তই। হিরন্ময় গোলকধাঁধাটি তার সদাচঞ্চল পেন্ডুলামের সম্মোহনসহ ফিরে-ফিরে আসে।

পরবর্তী দৃশ্যপটে খুনখুনে বুড়োর সঙ্গে ডবকা যুবতী যশোর মিষ্টি খুনসুটি শুরু হয়। মালসার জলে বুড়ো কদর্য মুখখানি দেখেও নিজেকে সুন্দর ভাবে। ছোঁদো প্রেমের সংলাপ ছাড়ে, ভোরের নবীন পৃথিবী দেখে শ্বাসটানা কণ্ঠে ভোরাই গায়। বাঘবন্দি খেলে, হাড়সার গতরে মাংস লাগানোর খায়েশে দুধ খাওয়ার বায়না ধরে। সেই দুধ আনাকে কেন্দ্র করে বুড়ো ঈর্ষাবশত একসময় বউকে শাপশাপান্তও করে। পরে সেই মান-অভিমানপর্ব ঘুচে যাওয়ার পর ফুলশয্যার আয়োজন করা অবধি খুনসুটির কার্যক্রম বুড়ো হাবড়ার পক্ষেই থাকে। ফ্যাসাদ বাধে তখনই, যখন সেই ফুলশয্যার ঘাটতি-পড়া ফুল আনতে যশোবতী পূর্ণিমার রাত্রে পুনরায় ভেড়িপথে যায়। সেখানে ফের দেখা মেলে বৈজুনাথের। গাছপালার আবডাল থাকায় তখনো তাদের দৃষ্টিবিনিময় হয় না। এ ছাড়া বৈজুর হাতে তখন নরকপাল ছিল, যাকে সে মৃত বউ ভৈরবীগিন্নি বলেই ডাকে। ওই নরকঙ্কালের সঙ্গেই চলছিল দুর্দান্ত বৈজুর রসের কথোপকথন, যদিও সেই রসালাপে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় নিতান্তই অসমর্থ নরকপালটি। বরং যে পারে সে তো ওই রক্তমাংসের যৌবন-উপচানো স্বাস্থ্যের যশোবতীই! অনতিদূরের গঙ্গায় ইতোমধ্যে বান ডাকতে শুরু করেছে; কিন্তু সেই ভরা জোয়ারও এবার হার মানে দুজন তরতাজা বেপথুমান নর-নারীর কাছে। এক অপার রতিসুখের সুখশয্যা রচিত হয় আকন্দ গাছতলে আর তা এতটাই উদ্দাম বাঁধনহারা যে, সেই সুখশয্যা ত্যাগ করার ক্ষমতা যশোবতী রাখে না। ফলে নিম্নের গঙ্গায় জলপ্লাবন ধেয়ে-আসা দেখে অভিজ্ঞ বৈজু যখন সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলে – ‘কোটাল বান আসছে হে বুড়ো…’, তখন মৈথুনক্লান্ত যশোবতীর কণ্ঠে বড়জোর এতটুকুনই ধ্বনিত হয়, ‘মরুক…’

তবে একটি নিশ্বাসের পরেই ব্রাহ্মণের বউ যশোবতীর কর্তব্যবুদ্ধি ফিরে আসে। ভেড়িপথে উঠে বিস্ফারিতনেত্রা যশোবতী স্রোতলাঞ্ছিত নদীতীরে ছুটে আসে ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জলস্ফীতি পূর্ণতা পেয়ে যাওয়ায় মহাবিপর্যয় দ্বারপ্রান্তে। জলের আলোড়নে বৃদ্ধের ভঙ্গুর দেহখানি চক্র দিয়ে উঠতে দেখে যশোর সাধ্বীমানসসচেতন হয়ে ওঠে। পেন্ডুলামের দন্ডটি শেষবারের মতো আদি অবস্থানে ফিরে আসে স্থায়ীভাবে। কেননা, টকটকে লাল চাঁদের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস ততসময়ে এতখানিই রক্তিম যে, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধের দোসরকে টেনে নেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট বটে। দুজনারই সলিলসমাধি ঘটে। হেন বিপৎকালে মায়া যদি কোথাও অবশিষ্ট থাকে, তবে তা ওই নৌকাগাত্রে অঙ্কিত চোখে, যা কাঠের হয়েও ক্রমাগত জলে ভিজে-ভিজে অশ্রুপাতক্ষম!

উপন্যাসটির ভূমিকায় যদিও তিনি লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের।… এই গল্প সেই গল্প, ঈশ্বর দর্শন যাত্রার গল্প।’, তথাপি এমত মনে করার কোনো হেতু নেই যে, মানুষ এখানে খাটো হয়ে গেছে।  প্রকৃতপ্রস্তাবে এটি মানুষের জীবনেরই এক অসামান্য রূপমন্ডিত গল্প। রামকৃষ্ণের প্রথম ‘জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর দর্শন’ উক্তির চেয়ে দ্বিতীয় ‘মানুষ কি কম গা!’ উক্তিটিই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। শেষমেশ একজন লেখকের কাছে যে মানুষই নমস্য, অন্য কেউ নয়; আর এমনটি হয় বলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেকানেক শাখা-প্রশাখা থাকা সত্ত্বেও ঘুরেফিরে কথাসাহিত্যেই দ্বারস্থ হতে হয়!

ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কমলকুমারীয় বর্মাচ্ছাদিত গদ্যরীতির নিকটবর্তী হতে কেবল যে তাঁর গদ্যের চিত্রকল্পসমুদয়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তা নয়। এখানে বরঞ্চ আরো একটি ব্যাপার পাঠকের সাহায্যকারী হয়ে উঠতে পারে : হ্যাঁ, পাত্রপাত্রীর অসম্ভব প্রাণময় সংলাপসমষ্টিও হয়ে ওঠে তাঁর উপন্যাসগুলোর লাইফ-লাইন; জঠরস্থ শিশুর আমবিলিক্যাল কর্ডটি যেভাবে লাইফ-লাইনের কাজটি সম্পাদন করে, এটা যেন অনেকটা তেমন; চরিত্রের সংলাপ ধরে ধরে এগোলেও বৈতরণীর অনেকটাই পার হওয়া যায়। তাঁর ট্রেডমার্ক গদ্যশৈলীর কারণে নির্মল কৌতুকের সাক্ষাৎলাভ সম্ভবপর না হলে হবে কী, তাঁর লেখায় শ্লেষাত্মক বর্ণনার অভাব নেই। সীতারামের সঙ্গে যশোবতীর অসম বিয়েটিকে ঠাট্টা করতে বৈজু তাই কৌতুকপ্রদ বাক্যকেই বেছে নেয় – ‘আ হা… মানুষ এক অচিন গাছ, মানুষ বড় ডাগর জীব, কাঠের বিড়াল দিয়ে ইন্দুর ধরে… তাই না?’ আবার ওই সাদৃশ্যহীন বিয়েতে শুভদৃষ্টির সময় সীতারামের মালা তার কাশির দমকে ছুটে চলে যাওয়ার পর বৈজুর ছাগলটি এসে যখন তৎক্ষণাৎ খেয়ে ফেলে, তখন তা যে কেবল তুমল রঙ্গতামাশার সৃষ্টি করে। তা-ই নয়, এমন বিয়ের প্রতি লেখকের ঘোরতর অনাস্থাও জ্ঞাপিত হয়। এছাড়া ধর্মের ফাঁকিগুলো বোঝাতেও জায়গাবিশেষে রগড়াত্মক ঢংটি প্রয়োগ করেছেন তিনি। বিয়ে পড়ানোর পারিশ্রমিক বাবদ পুরোহিত যখন রৌপ্যমুদ্রা দাবি করে, তখন হয় কী, রৌপ্যমুদ্রাটি কনের বাবা লক্ষ্মীনারায়ণ অথবা অন্য কারো কাছে না থাকলে হয় কী, অদূরে উপবিষ্ট বৈজু তা ব্রাহ্মণকে ধার দিতে চায়। আর মজাটা ঘটে তখনই। নীচকুলোদ্ভব চাঁড়ালের কাছ থেকে রৌপ্যমুদ্রাটি ধার নিতে লক্ষ্মীনারায়ণের আত্মসম্মানে সাংঘাতিক লাগে; কিন্তু নগদ রৌপ্যমুদ্রা বলে কথা। পুরোহিতের ওই দামি মুদ্রাটি প্যাকেটস্থ করতে বৈষ্ণব কৃষ্ণপ্রাণ সাধুভাষায় যে ফতোয়াটি জারি করে, তা কৌতুককরই – ‘শান্তকণ্ঠে বৈষ্ণব কৃষ্ণপ্রাণ সহাস্যবদনে কহিলেন, ‘কন্যা সম্প্রদানকালে ক্রোধ পরিত্যাজ্য’ বলিয়া ক্রমাগত সাধুভাষায় আপনার মনোভাব ব্যক্ত করিলেন, ‘যে কোন জাতি বর্ণের নিকট হইতে ধাতু তথা অর্থমুদ্রা গ্রহণযোগ্য, একমাত্র মুদ্রার ক্ষেত্রে জাতিবিচার চলে না… এতদ্ব্যতীত শ্মশানে উচ্চ নীচ ভেদ নাই।’ মনে হইল কোন অকাট্য সংস্কৃত শ্লোকের ইহা সরল ভাষার অনুবাদ।’

কমলকুমারের অপরাপর উপন্যাসগুলোর মতো বর্তমান উপন্যাসেও দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দ্বন্দ্বমুখর স্রোতধারা বেগমান থেকেছে সারাক্ষণ। তার একটি যদি হয় মৃতকল্প সীতারামসংশ্লিষ্ট, অন্যটি অবশ্যই জীবনাকাঙ্ক্ষী বৈজুকে ঘিরে আবর্তিত। তবে এখানে যা সবচেয়ে বিস্ময়কর তা এই, প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুটো ধারার কোনো একটি যে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছে, তেমন বলার উপায় নেই। বড়জোর একটুকু বলা যেতে পারে – দুইয়ের সংঘর্ষে জীবনঅভিলাষী স্রোতের দিকে জয়ের পাল্লাটি সামান্য হেলে আছে। কথাটা সামান্য হেলে থাকাই। কেননা, ঠিক এখানেই নিহিত উপন্যাসটির প্রকৃত শক্তিমত্তা, আর এ-কারণেই উপন্যাসটি এত মহার্ঘ্য!