অন্তিম

লো কটাকে বাঁচাবে বলে পড়িমরি করে তপু ছুটে গিয়েছিল। নতুন কিছু নয়, এটা ওর স্বভাব, বন্ধু-বান্ধব সবাই জানে।

রাস্তার ঠিক মাঝখানে, যেখানে রক্তাক্ত হয়ে কাতরাচ্ছিল বুড়ো মানুষটা, সেখান থেকে সে একাই তাকে কোলে তুলে নিয়ে ফুটপাতের ওপর শুইয়ে দিলো। তারপর এতোটুকু সময় নষ্ট না করে মানুষটাকে নিয়ে সিএনজি অটোরিকশা করে সোজা চলে এলো হাসপাতালে।

বৃদ্ধের নাম লোকমান হোসেন। পুরো রাস্তাটাই পার হতে পেরেছিলেন, সমস্যা হয়নি। মাত্র খানিকটা বাকি, তারপরই নিরাপদ ফুটপাত। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।

শরীরটা সরাতে পারলেও মাথাটা সরাতে পারেননি; দ্রুতগামী বাসের দরজার হ্যান্ডেলটা সরাসরি মাথায় মেরে দিয়ে চলে গেল সাঁই করে। সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে অবিরাম রক্ত ঝরছে। ক্ষতটা কত গভীর তা তখনো বোঝা যায়নি।

তবে তপুর পাঞ্জাবি-পাজামা সব রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। দেখে চটজলদি বোঝা দায় আসলে আঘাতটা কে পেয়েছে।

অথচ যখন দুর্ঘটনার শিকার মৃতপ্রায় মানুষটিকে সিএনজি অটোরিকশাতে তুলতে ব্যস্ত তখন শোরগোলের শব্দে মুখ তুলে তাকাতেই সে হতবাক হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সে অবাক হয়ে দেখতে পেল কটি নিরীহ বাস চোখের সামনে দাউদাউ করে পুড়ে খাক্ হচ্ছে। নিমেষের ভেতর যারা কটি বাসে আগুন দিলো, ভাঙচুর করল কটি নতুন সেলুন-কার আর জিপ, ওরা স্যুট-টাই পরা কেউ নয়, আশেপাশের মহল্লার কজন বখাটে আর রাস্তার টোকাই।

রাস্তার কিনারে দাঁড়ানো কিছু ভীতু কিসিমের কৌতূহলী পথচারী; চোখের সামনে এসব উত্তেজক দৃশ্য দেখছে আর নিরাপদ দূরত্বে নিজেদের রেখে দাঁত কিড়মিড় করে অবিরাম ভেতরের অসহায় ক্রোধ প্রকাশ করছে, ‘সব জ্বালাইয়া দে, সব পোড়াইয়া দে!’ একইসঙ্গে অকুস্থলে পুলিশ আসতে বিলম্ব হওয়ায় তাদের তাক করে গালাগালের ইটপাটকেলও ছোড়াছুড়ি চলছে রোদেলা দুপুরে; যেন পুলিশ না আসা পর্যন্ত কিছুতেই ভরসার জায়গাটা এদের নিরীহ প্রাণে তৈরি হচ্ছে না, হয়তো সাহস করে এক-আধ পা যে সামনের দিকে বাড়াবে তাও হচ্ছে না, হয়তো সেজন্য। তবু কেউ তপুর দিকে এগিয়ে এলো না।

সে লোকটার মোবাইল ফোনটা নিয়ে বাড়িতে খবর দিলো। মাত্র কদিন হলো বেসরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন লোকমান সাহেব। অফিসের টান যায়নি। তাই সাত-সকালেই অভ্যাসবশে বেরিয়ে পড়েছেন অফিসে যাবেন বলে। ছেলে নেই, বিবাহিত দুই মেয়ে আর স্ত্রী চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাউমাউ করে ছুটে এলো হাসপাতালে।

লোকমান সাহেব মোট তিনদিন বেঁচে ছিলেন। একবার মনে হচ্ছে ফাঁড়া কেটে গেছে, বেঁচে যাবেন। অন্যবার মেয়েরা আকুল স্বরে কেঁদে উঠছে, ‘আব্বা আপনারে ছাড়া আমরা কেমনে থাকুম? আব্বাগো!’

এরই ভেতর নিরিবিলি এক ফাঁকে কৌতূহলী তপু ফিসফিসিয়ে মানুষটাকে ভেতরে বলক-তোলা প্রশ্নটা করেই বসল, ‘কীভাবে হলো? নিয়মিত অফিসে যাওয়ার তিরিশ বছরের পরিচিত একই রাস্তা, একইরকম পারাপার, তবু কেন এমন ঘটল?’

মানুষটা বিস¥য়ভরা ঘোলাটে চোখ মেলে ওর দিকে বারকয় তাকালেন। তারপর মুখ বাঁকা করে অস্পষ্ট শব্দে যা বললেন লোকমান সাহেব, তা শুনে হতবাক তপু, ‘ছোটবেলার চেনা … খুব চেনা একটা গন্ধ পাচ্ছিলাম রাস্তার মাঝখানে এসে। নিমেষের জন্য চোখ বুঁজে ফেললাম। তখনই …।’ আর বলতে পারেননি। মাঝপথে নার্স ঠেলে সরিয়ে দিলো তপুকে।

লোকমান সাহেব পরদিনই মারা গেলেন। ব্রেন হ্যামারেজ, বাঁচানো গেল না কিছুতেই।

তপু এখন নতুন চাকরি পেয়েছে। ন’টা-পাঁচটার বেসরকারি চাকরি। নতুন বউ শ^শুর-শাশুড়ির নজর এড়িয়ে, ঘোমটা মাথায় দিয়ে, সলাজ ভঙ্গিতে টিফিন-ক্যারিয়ার ভরে প্রচুর খাবার দিয়ে দেয় ওকে। কিন্তু যখনই সে রাস্তা পারাপার হতে চায় তখনই মনে পড়ে বৃদ্ধের কথা। এসময় নাকে যেন ভয়ংকর স্মৃতিজাগানিয়া কোনো গন্ধ সুড়সুড়ি দিতে না পারে সেজন্য রীতিমতো নিশ^াস বন্ধ করে দমবন্ধ অবস্থায় এটুকু পথ পাড়ি দিতে চায় সে।

মৃত্যুর আগে মানুষ কি সত্যি সত্যি এরকম অদ্ভুত কোনো গন্ধ পায় নাকে? ফুটপাতে উঠে সে এ-প্রশ্নটি রোজই নিজেকে করে ।

কথাটা সে কাউকেই বলেনি এ পর্যন্ত, এমনকি নতুন বউ স্বপ্নাকেও নয়!

দুই

তপু যে-তলায় সংসার পেতেছে এর ঠিক ওপরে নববিবাহিত এক দম্পতি ভাড়া

থাকতেন। মহিলা কলেজে পড়াতেন আর পুরুষটি এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতেন চাকরির খোঁজে।

তপুর কেমন যেন খটকা লাগতো। স্বপ্নাকে বলল, ‘ওপরের লোকটা সোজা তাকাতে পারে না। গণ্ডগোল আছে।’

‘মহিলাটা কিন্তু খুব ভালো। দেখা হলেই বলে কুমিল্লা শহরের কোনো তুলনা নাই।’ স্বপ্নাদের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে, তাই।

তপুরা তখন নববিবাহিত দম্পতি। হয়তো এ-কারণেই ওদের সঙ্গে ভাববিনিময় বেশি। মাঝে মাঝে

ধার-দেনাও করতে আসেন। খুব বেশি টাকা নয়, পাঁচশো-এক হাজার মাত্র। মাসের বেতন পেলেই মহিলা ফেরত দিয়ে দিতেন।

ওদের হাতে যে অঢেল টাকা ছিল, তাও নয়। তবু সীমিত আয়ের সামান্য সঞ্চয় ভেঙে মহিলাকে সাহায্য করে ওরা খুব মানসিক সুখ পেত। মাইশা ভাবির আভিজাত্য আর বিনয় ওদের কাছে বরাবরই অসামান্য ঠেকত। পাশাপাশি তার স্বামীটিকে মনে হতো খলনায়ক। স্বপ্না মাঝে মাঝে ফিসফিস করে বলত, ‘জানো, ভাবির জামাইটা মনে হয় মাইরধরও করে। মুখটা কেমন ফোলা, দেখ নাই?’ সঙ্গে সঙ্গে তপুর মনটা বিষাদে ভরে যেত। লোকটার কুৎসিৎ নিষ্ঠুর চেহারায় যেন সেকথা ভেসে বেড়াত। এরকম বিদুষী মহিলার এমন স্বামী? মুখোমুখি হলে কথা বলতেও ইচ্ছা করত না ওর।

সেই মাইশা ভাবি হঠাৎ ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। সেসময় এসব রোগের তেমন জুতসই চিকিৎসা ছিল না। মাসতিনেকের ভেতর ভদ্রমহিলা মারা গেলেন।

মারা যাওয়ার দশ-বারোদিন আগে মহিলাকে তপু হাসপাতালে দেখতে গেল। একদম চেনা যায় না। সেই সৌন্দর্য আর আভিজাত্য পুরনো বিল্ডিংয়ের পলেস্তারার মতো খসে পড়েছে। চোখ দুটো কোটরাগত। মাথা কামানো।

ওকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন মহিলা। একপর্যায়ে সহসা ওর হাত চেপে ধরে বলে উঠলেন, ‘একটা জিনিস খাওয়াবেন ভাইজান?’

হতচকিত তপু প্রশ্ন করল, ‘কী ভাবি?’

‘বেসনে ভাজা বকফুলের বড়া। আমার আম্মা করতেন। খাওয়াবেন?’ নিষ্প্রভ চোখ জুড়ে আকুতি।

‘খবর দেবো খালাম্মাকে?’

‘না।’ চোখ বেয়ে ব্যথার অশ্রু গড়াচ্ছিল অবিরাম।

তপু সহ্য করতে পারেনি। মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছে বাসায়। কথাটা আর স্বপ্নাকে বলেনি সে। ভাবির মৃত্যুর পর বহুবার তপুর সেকথা মনে পড়েছে আর মনে মনে অনুশোচনায় ভুগেছে।

মাইশা ভাবির মৃত্যুর কিছুদিন পর স্বামী নামের লোকটা বাসাটা ছেড়ে দিলেন। যাওয়ার আগে লোকটা একদিন ওর মুখোমুখি পড়ে গেলেন। সেদিনওঅন্যদিনের মতন মাথা নিচু করে ওকে পাশ কাটিয়ে সামনে দিয়ে চোরের মতো হেঁটে যাননি। বরং তিনি ওর পথ আগলে চোখে চোখ রেখে বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘একটা কথা কমু ভাইজান?’

‘বলেন।’ নিস্পৃহ গলা তপুর। লোকটার নামটাও ওর জানা নেই, কোনো প্রয়োজনও বোধ করেনি কখনো, এমনই তীব্র অনীহা মনে মনে।

‘মাইশা আপনাদের কাছে বকফুলের বড়া খাইতে চাইছিল, না?’

এবার চমকে ফিরে তাকায় ওর দিকে তপু। মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো, ‘ভাবি বলেছেন?’

‘শেষদিন পর্যন্ত মাইশা ভেবেছিল আপনারা ওকে সেটা খাওয়াবেন। খুব আশায় আশায় ছিল। ওর তো আর কেউ নেই। আমার মতো এক অভাগারে বিয়ে করায় ওর বাড়ির সবাই ওকে ত্যাগ করেছিল। আমি যে ওদের কুমিল্লার বাড়ির ড্রাইভার আছিলাম।’ বলে মাথা নুইয়ে চলে গেলেন মাইশা ভাবির স্বামী।

এরপর তপুর যে কী হলো, প্রথমে অচেনা বকফুল চিনে নিল, তারপর বকফুলের বড়ার রেসিপি জোগাড় করে স্বপ্নাকে বলল, ‘মজা করে রাঁধো তো। দেখি কেমন?’

এখন তপুদের কাছে খুব মুখরোচক একটি খাবার এই বকফুলের বড়া। বেসনে চুবিয়ে ডুবো তেলে ভেজে গরম ভাতের সঙ্গে ঘি মিশিয়ে খেতে অভ্যস্ত ওরা। এটা শুধু ওদের বেলায় নয়, ওদের চোখের মণি চুন্নু-মুন্নুরও প্রিয় খাবার।

তবু মাঝে মাঝে সংগোপনে মাইশা ভাবির কথা মনে পড়ে যায় তপুর। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে কেন প্রিয় খাদ্যের কথা মানুষের সহসা মনে পড়ে যায়?

তপুর জানা নেই।

তিন

আজকাল কেউ আর অন্যের কথা ভাবতে চায় না।

তবে তপু ভিন্ন মানুষ, ঠিক ওর মায়ের মতো। কথায় নয়, মানুষের পরিচয় দিতে জানে কাজে।

ওর মায়ের বয়স প্রায় সত্তর ছুঁইছুঁই। পান-দোক্তার কোনো নেশা নেই। নেশা একটিই – গ্রামে এখনো যে-কারো বিপদে-আপদে ছুটে যেতে পারলে সুখ বোধ করেন। পোয়াতিকে হাসপাতালে নেওয়া থেকে মুখের খাবারটা ভিক্ষুককে দিয়ে দেওয়ার আকছার ঘটনা শৈশব থেকে তপু দেখে এসেছে ওর মায়ের বেলায়। ওর মায়ের কোনো নিজস্ব রোজগার নেই। তবু মানুষের দুঃসময়ে টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। এজন্য ওর ব্যবসায়ী বাবার প্রয়োজনীয় খরচের টাকা প্রায়ই অজানায় হারিয়ে যেত। বাবা বেশ বুঝতেন, এটা মায়ের কাজ। টাকা হারানোর কষ্ট, তাই মাকে নানারকম ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের পরোক্ষ বাক্যবাণে বিদ্ধ হতে হতো যখন-তখন। তা সত্ত্বেও নিজের অভ্যাসটুকু আগলে রেখেছেন এখন অবধি, ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে কখনো অভ্যাসটি হাতছাড়া হতে দেননি। প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি টিকে রয়েছেন, এখনো সুযোগ পেলে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটে যান। তার ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই জানে মায়ের এই পরোপকারের অভ্যাসের কথা।

মায়ের মতোই তপু। ছোটবেলায় একটা পোষা বিড়ালছানা হারিয়ে যাওয়ায় সে দুদিন না খেয়ে থেকেছে। মানুষের যন্ত্রণায় সেই ছেলে মানুষ হিসেবে পাশে দাঁড়াবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

ছেলেকে নিতে স্কুলে এসেছে সে। এ-স্কুলটায় ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে। ছুটির বেলা। হুড়মুড় করে পাম্পমেশিনের জলের তোড়ের মতো ছাত্রছাত্রীরা বের হচ্ছে। এজন্য ভিড় সবখানে। পিচের রাস্তা গাড়ি, ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের পদচারণায় মুখর। রাস্তায় লম্বা জ্যাম। সমস্ত গাড়ি-রিকশা থেমে রয়েছে অপারগ মুখ করে। ভেঁপু আর হট্টগোল চারদিকে, কান পাতা দায়।

এসময় হঠাৎ তপুর চোখে পড়ল, স্কুলের একটি নিরীহ মেয়েকে রাস্তার একটি বেয়াড়া গোছের ছেলে চোখ বড় করে রীতিমতো শাসাচ্ছে। ছেলেটি যে হিংস্র আর বেপরোয়া তপু দূর থেকে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। একটু পর হাত ধরে টানাটানি – লজ্জায় তপু চোখ ঘুরিয়ে নেবে কি না যখন ভাবছে তখনই ঘটনাটা ঘটে গেল। ছেলেটি পকেট থেকে একটি ছুরি বের করে নিমেষে পরপর বেশ কবার ঢুকিয়ে দিলো মেয়েটির পেটে। একবার, দুবার, তিনবার। মেয়েটি বাঁহাত দিয়ে আটকাতে চাইল । ফিনকি দিয়ে রক্তের হাজারটা ফোঁটা ওর গাল-মুখ ভাসিয়ে দিলো। শূন্যে কচি-কোমল হাতটা নেড়ে ক্ষীণ স্বরে মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘আম্মাগো, মেরে ফেলল। আম্মা বাঁচাও।’ তারপরই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল দেহখানা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি ভিড়ের ভেতর হারিয়ে গেল।

গিজগিজ করা ছাত্রছাত্রী আর অভিভাবকদের দল ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ, হতবাক। প্রকাশ্য দিবালোকে এমন গোলাপ-পাঁপড়ির মতো দেখতে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে কেউ এভাবে এলোপাতাড়ি ছুরি মারতে পারে?

মেয়েটি হাত দিয়ে পেট চেপে ফুটপাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর কাতরাচ্ছে। তবু কেউ এগিয়ে আসছে না।

তপু নিজের ছেলের কথা ভুলে ছুটে গেল সেদিকে। চোখের পলকে মেয়েটিকে কোলে করে ছুটতে লাগল মেডিক্যাল কলেজের দিকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা আর ওর পলকা শরীর। মেয়েটি গোঙাচ্ছে। পেছনে কিছু পরোপকারী উৎসুক লোকজন। ওরাও ছুটছে। বাঁচাতে চাইছে মেয়েটিকে।

সহসা মেয়েটি চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে। চিনতে পারছে না ওকে। একধরনের স্পষ্ট আড়ষ্টতা চোখেমুখে। খুব কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায়, তবু বারকয় ওর দিকে তাকিয়ে সাহস সঞ্চয় করে সহসা বলে উঠল, ‘আঙ্কেল, আমার মাকে দেখবেন। আমি ছাড়া তার কেউ নেই।’ তারপরই একটা হেঁচকি দিয়ে ঘাড়টা ফেলে দিলো।

হাসপাতালের ডাক্তার নাড়ি টিপে যা বলার তাই বললেন, ‘অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে। কিছু করার নেই।’ ওরা মেয়েটির নিথর শরীরটা পোস্টমর্টেমের জন্য রেখে দিলো।

পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছাত্রী খুনের সংবাদটি ছাপা হলো। এক কলাম এক ইঞ্চি সংবাদে কিছুই বোঝা গেল না। পুরোটাই রহস্য হয়ে পড়ে রইল পুলিশের কাছে। তপু রীতিমতো হতাশ। হৃদয়বিদারক এরকম একটি মৃত্যু পর্যন্ত সবাইকে জাগাতে ব্যর্থ হলো!

বেশ কদিন পর মেয়েটির মায়ের সঙ্গে তপুর দেখা হলো স্কুলের মাঠে। নানারকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে মেয়েটির জন্য শোকযাপন হচ্ছে বিদ্যায়তনের আঙিনায়। তখনই তপু জানতে পারে মেয়েটির নাম লিসা, নবম শ্রেণির ছাত্রী। নানুর বাসায় থাকে মায়ের সঙ্গে। এক ভাই এক বোন। অকালে বাবা মারা যাওয়ায় মা বেকারিতে ঘরে তৈরি কেক-পুডিং জোগান দিয়ে সংসার চালায়। কাপড় বানানোর জন্য মাঝে মাঝে মা-মেয়ে এলাকার এক টেইলারের দোকানে যেত। সেখানেই খুনি ছেলেটি কাজ করত। একতরফা প্রেম। প্রায়ই বিরক্ত করত। বহুবার মালিকের কাছে অভিযোগ করেও ছেলেটিকে শোধরানো যায়নি। শেষে লিসাকে খুন করার মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুর এ-হয়রানির সমাপ্তি ঘটল।

লিসার মা ওকে এক দেখাতেই চিনে নিল, ‘আপনিই তো আমার মেয়েকে কোলে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। অনেক ধন্যবাদ। আজকাল সেলফি তোলা অগুনতি দর্শক পাওয়া যায়, কিন্তু সাহায্যকারী পাবেন না। আল্লাহ আপনার ভালো করুন।’

‘খুব দুঃখের ঘটনা। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কীভাবে? ’ মন্তব্য করে তপু।

মহিলা চোখ মোছে কষ্টে। সহসা মুখ তুলে বলে উঠলেন, ‘আপনার তো মেয়ে আছে। দেখে রাখবেন প্লিজ, মেয়েরা মায়ের গর্ভ আর কবর ছাড়া আর কোথাও নিরাপদ নয়। খেয়াল রাখবেন।’ বলে নিজের কষ্ট আড়াল করতে ভিড়ে মিশে গেল।

মেয়েটির কথা তপুর খুব মনে পড়ে। নিজের মেয়ে দিন দিন যত বড় হচ্ছে তত বেশি করে তপু সতর্ক হচ্ছে।

ওর মেয়েটি কি নিরাপদে থাকবে?

চার

ওপরের তিনটি ঘটনা ছাড়া তপুর জীবনে এরকম মৃত্যুদৃশ্য এখন পর্যন্ত আর ঘটেনি। তবে ওর জীবনে এরকম ঘটনা যখন-তখন ঘটে যেতে পারে বলে ওর বিশ্বাস রয়েছে। তখন সে ওদের পাশে ঠিকই দাঁড়ােেব। কিন্তু নিজের জীবনে যদি ঘটে তাহলে কোনো ‘তপু’ কি দাঁড়াবে ওর পাশে?

বাসা থেকে বেরোনোর সময় প্রতিদিন সে এ-প্রশ্নটি নিজেকে করে পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেয়, কার বালে জানে!