অপূর্ব নিবিড় নিদ্রা

চেতনা ফিরে আসার সময়ে আমি দূরাগত কিছু শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, কেন মনে হয়েছিল জানি না, জলার ধারে একটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে নিরুপদ্রব মুহূর্তে উচ্ছ্বসিত পাখিদের কাকলি। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হলো, না, এটা মানুষেরই কণ্ঠস্বর। তবে টেপ রেকর্ডারে ধারণ করা কথা ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করে দিলে যেমন শব্দগুলো ভেঙেচুরে কিছু অর্থহীনতা ছড়িয়ে দেয়, অনেকটা সেরকম।

ধীরে ধীরে আরো থিতু হতে শুরু করলাম। এই যেমন আমি যে একটা বিছানায় শুয়ে আছি এটা বুঝতে পারছি। ‘আমি কোথায়? আমি এখানে কেন?’ – ইত্যাদি বহু ব্যবহারে জীর্ণ প্রশ্নাবলিও আমার মনে উদিত হলো। কিন্তু আমি তা উচ্চারণ করিনি। কারণ, আদতে এখন আমার কোথায় থাকা উচিত, নিজের শোবার ঘরের বিছানায়, না অন্য কোথাও, এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় এখনো পৌঁছতে পারিনি। তাছাড়া এর মধ্যে সবার অলক্ষ্যে আমি একবার চোখ খুলেছি, প্রথমে আবছা, ধীরে ধীরে লক্ষ্য নির্ধারণে সমর্থ দৃষ্টিতে আমি দুই ব্যক্তির সঙ্গে আলাপরত আমার স্ত্রীকে দেখতে পেয়েছি।

আমার স্ত্রীকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো, সে বেশ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কথা বলছে ব্যক্তিদ্বয়ের সঙ্গে। তাদের মধ্যে কখনো প্রথমজন, কখনোবা দ্বিতীয়জন প্রায় কাঁচুমাঁচু গলায় কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে জাকিয়া হক চৌধুরীর সঙ্গে। হুঁ হুঁ, আমি কতকাল ধরে চিনি এই মহিলাকে, ওর হাত থেকে পার পাওয়া সহজ নয়। একজন ধনাঢ্য শিল্পপতির স্ত্রী এবং মেট্রোপলিটন উইমেনস ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই মহিলার হাত যথেষ্ট দীর্ঘ তো বটেই, সেটাকে দীর্ঘতর হিসেবে প্রদর্শন করার ব্যাপারেও তার দক্ষতা তুলনাহীন। ফলে যে দুই ব্যক্তির সঙ্গে জাকিয়া কথা বলছে তারা এখন রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। এতোক্ষণে আমার মনে হচ্ছে, লোক দুটি পুলিশের মাঝারি গোছের কর্মকর্তা। জাকিয়ার সঙ্গে তারা আমার বিষয়েই কথা বলছে।

পুলিশ (১) : আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, স্যার এতো রাতে সেখানে কী করছিলেন?

পুলিশ (২) : এতো রাতে কোনো দোকানপাটও তো খোলা থাকে না …।

জাকিয়া : আপনার কি ধারণা দোকানপাট খোলা থাকলে এএইচ চৌধুরী সওদাপাতি কিনতে যান?

পুলিশ (১) : না না, স্যার কেন দোকানে যাবেন …

পুলিশ (২) : অসম্ভব, স্যার দোকানে যাবেন কী করতে? বাড়িতে লোকজনের কি অভাব আছে …? কিন্তু স্যার তাহলে দুইটা-আড়াইটার সময় ওখানে কী করছিলেন? … মানে, এটাই বুঝতে পারছি না ম্যাডাম।

পুলিশ (১) : আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম, স্যারের কি সিøপ ওয়াকিংয়ের কোনো সমস্যা ছিল? মানে, আছে না, অনেকে ঘুমের ঘোরে হাঁটতে থাকেন, কোথায় যাচ্ছেন নিজেও জানেন না …।

‘শাট আপ!’ এবার বেশ জোরে একটা ধমক দিয়ে পুলিশের মাঝারি কর্মকর্তাকে থামিয়ে দিলো জাকিয়া, ‘ওর সঙ্গে আমি সংসার করছি বিশ বছরেরও বেশি সময়, আমি জানি না, আর আপনি জানেন আমার স্বামী ঘুমের মধ্যে হাঁটে…।’

পুলিশ (১) : না, না, আমি জানি বলছি না, আমি আসলে জানতে চাচ্ছি…।’

‘আরে রাখেন…’ আবার ধমকে উঠে অর্ধেকেই পুলিশের কথা থামিয়ে দিয়ে জাকিয়া বলল, ‘হরর মুভি-টুভি দেখে আজগুবি সব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। মানুষ ঘুমের মধ্যে হাঁটে এরকম ঘটনা আমি জীবনে দেখি নাই, শুনিও নাই …।’

পুলিশ (১) : এরকম হয় কিন্তু ম্যাডাম, শুধু সিনেমায় না …।

জাকিয়া : চুপ করেন। এইসব ফালতু গল্প আপনার বউ-শালি আর খালাশাশুড়িকে শোনান গিয়ে …।

এটা হচ্ছে কথা বলার আর্ট। আমি জাকিয়ার এই বলার ভঙ্গিটাকে রীতিমতো উপভোগ করি। যেমন ধরুন, বলা   যেত   ‘এসব   গল্প   আপনার  বউ-বাচ্চাদের শোনান গিয়ে’ কিংবা ‘এসব গল্প আপনার বউ-শালীদের শোনান গিয়ে …’, কিন্তু যেই বলা হলো ‘বউ-শালি আর খালাশাশুড়িকে শোনান গিয়ে’ তখন সম্ভাব্য গল্প-শ্রোতাদের পরিধি বিস্তৃত হলো শুধু নয়, এর একটা অন্যরকম ব্যঞ্জনাও সৃষ্টি হলো।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি দূর এগোয়নি, দরিদ্র পরিবারের পঞ্চম সন্তান হলে যা হয়, কোনোমতে এসএসসির বেড়া ডিঙিয়েছিল জাকিয়া। কিন্তু এই খামতি তার প্রতিষ্ঠার পেছনে খুব বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

দশজনের মধ্যে আলাদা করার মতো চেহারা ছিল কম বয়সে। মানে আমি যেবার গ্রামে গিয়ে প্রথম দেখে বড়শিবিদ্ধ মাছের মতো ছটফট করছিলাম সে-সময়টার কথা বলছি। এখন সবুজ লাউডগার মতো তরতরিয়ে বেড়ে ওঠার দিনগুলো নেই হয়তো, কিন্তু আলাদা করে শনাক্ত করার জায়গাটাতেও কোনো ঘাটতি নেই। বরং যথার্থ পরিচর্যার সঙ্গে বিত্ত ও ব্যক্তিত্বের ছাপ রীতিমতো একটা জেল্লা এনে দিয়েছে চেহারা ও শরীরে। সব বয়সেরই একটা সৌন্দর্য আছে, বছর দুয়েক আগে জাকিয়ার কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ে প্রায় পুত্রবৎ এক তরুণের ডুবে মরার প্রবল আকাক্সক্ষা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম বুড়িয়ে-ফুরিয়ে যেতে যথেষ্ট দেরি আছে। যাক শেষ পর্যন্ত জানে বেঁচেছিল ছেলেটা, জাকিয়াও বোধহয় মিডএজ ক্রাইসিসটা সামলে উঠেছিল অল্পের  ওপর  দিয়ে। চারপাশে  আনন্দ-উপলক্ষের অভাব ছিল না, তাই সহজে পেরেছিল হয়তো। আমি এসব বিষয় নিয়ে নিজে খুব একটা বিচলিত হইনি, জাকিয়ার সঙ্গে ঝামেলায়ও জড়াইনি। কারণ নিজে আমি ধোয়া তুলসীপাতা নই, এটা আমি নিজে তো জানিই, জাকিয়াও জানে। ফলে এসব ব্যাপারে পরস্পরকে বিব্রত না করাটাই ছিল বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত।

সহজাত একটা নেতৃত্বগুণ ছিল। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে মেট্রোপলিটন উইমেনস ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছিল। জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে পাঁচ বছর, অতঃপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরো ছয় বছর, এখন তো মোটামুটি জাকিয়া হক চৌধুরীর নেতৃত্ব অবিকল্প।

অবশ্য এখন শুধু এই ক্লাবটি নয়, নারী সংক্রান্ত যে-কোনো সরকারি-বেসরকারি ফোরামে আমার স্ত্রীর উপস্থিতি অনিবার্য। এহেন জাকিয়া হকের সঙ্গে দুজন মাঝারি গোছের পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষে কথা বলে সুবিধা করতে পারার কোনো সম্ভাবনা কোথায়।

পুলিশ (২) : কিন্তু স্যার এতো রাতে খুলশী হাউজিং সোসাইটির রাস্তায় কী করেছিলেন? … কেন সেখানে গিয়েছিলেন সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

জাকিয়া : আমিও বুঝতে পারছি না। এএইচ চৌধুরীর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সেটা জানার কোনো উপায় নাই। কিন্তু একটা কথা আমাকে বলেন তো, আজহার সাহেব যে ডাকাতি করতে যাননি, সে-বিষয়ে আপনাদের কোনো সন্দেহ আছে?

এবার দুজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রায় সমস্বরে কঁকাতে লাগল, ‘ছি ছি ম্যাডাম, কী বলছেন, স্যার … মানে … ডাকাতি… ছি ছি …।’

জাকিয়া : আপনারা শিওর যে আজহার সাহেব ডাকাতি করতে যান নাই?

পুলিশ (১) : ছি ছি ম্যাডাম।

পুলিশ (২) : ছি ছি …।

জাকিয়া : আরে রাখেন আপনাদের ছি ছি। আপনারা শিওর কি না?

পুলিশ (১) : জি, শিওর।

পুলিশ (২) : শিওর।

জাকিয়া : তাহলে রাত দুইটা বা আড়াইটায় সোসাইটির রাস্তায় হাঁটাহাঁটি

করলে কাউকে লাঠি দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া যায়?

এতোক্ষণে ঘটনার কিছুটা কূল-কিনারা পাওয়া গেল। পুলিশের বাঁশির তীব্র আওয়াজ, রাস্তায় শুয়ে থাকা লোকজনের হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটির কথা ভেসে উঠল আমার বন্ধ চোখের পর্দায়। তারপরের কথা আর মনে নেই। এখন বিছানায় শুয়ে পরের দৃশ্যের একটা যোগসূত্র পাচ্ছি। পুলিশের লাঠির আঘাতে মাথা ফেটেছিল আমার, তারপর জ্ঞান হারিয়েছিলাম। আমার প্রাণশংকা কি কেটে গেছে? নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে জাকিয়ার সঙ্গে মাঝারি পুলিশ কর্মকর্তাদের আলাপ শুনে মনে হচ্ছে কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত আমি। কারণ তাদের আলোচনার মধ্যে একবারও পেশেন্টের শারীরিক অবস্থার কথা আসেনি।

জাকিয়া কিন্তু ছাড়ছে না, ‘বলেন, রাত দুইটায় হাঁটাহাঁটি করলেই মাথা ফাটিয়ে দেওয়া যায় কি না …।’

‘দুইজনকে অলরেডি সাসপেন্ড করা হয়েছে ম্যাডাম। কমিশনার সাহেব আমাদের পাঠাইছেন আসল ঘটনাটি কী জানার জন্য।’

‘মাথা ফাটালেন আপনারা, আমার হাজবেন্ডের এখনো হুঁশ আসে নাই। কারণ জানতে পাঠাইছেন আমার কাছে? ভালো … খুব ভালো ব্যবস্থা আপনাদের। প্লিজ গো নাউ, অ্যান্ড কনভে মাই থ্যাংস টু কমিশনার।’

ঠিক এ-সময় একজন মহিলা ডাক্তার বা নার্স এসে বললেন, ‘আপনারা এখানে এতো জোরে জোরে কথা বলবেন না। কথা বলতে চাইলে প্লিজ দরজার বাইরে করিডরে যান …।’

পেশেন্টের অসুবিধার কথা এতোক্ষণে তোমার মনে পড়ল ডাক্তার বা নার্স! তবু ভালো যে মনে পড়েছে, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। হাসপাতালের কেবিন কথোপকথন বিশেষত এরকম উত্তেজিত বাক্য-বিনিময়ের জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আরো আগেই এ-বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত ছিল। তবে কথোপকথন পর্বটা থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমি উপকৃত হয়েছি। অর্থাৎ অসুবিধার চেয়ে আমার লাভ বেশি। মোটামুটিভাবে রাতের ঘটনার একটা চিত্র আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।

ডাক্তার বা নার্সের আপত্তি সত্ত্বেও আমার স্ত্রী বা দুই মাঝারি পুলিশ কর্মকর্তা আলোচনাও বন্ধ করেনি। কেবিনের বাইরে করিডরেও যায়নি, প্রথমদিকে কয়েক মুহূর্ত কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করেছিল, তারপর আবার স্বাভাবিক গলায় চলছিল আলাপ।

পুলিশের দুই কর্মকর্তা জাকিয়াকে জানালেন, কিছুদিন ধরে সোসাইটি এলাকায় চুরি-ছিনতাই বাড়ছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এই এলাকায় রাতে গৃহহীন কিছু মানুষ ফুটপাতে বা কোনো কোনো বাড়ির গেট ও গ্যারেজের সামনে ঘুমায়। এদেরকে চাল-চুলোহীন ও নেহাত নিরীহ মনে হলেও তলে তলে চুরি-চামারির সঙ্গে এরাই জড়িত বলে এলাকাবাসীর ধারণা। সেই কারণেই গতরাতে পুলিশ চড়াও হয়েছিল ওদের ওপর। মৃদু লাঠিপেটাও করতে হয়েছে। ‘কিন্তু স্যার কেন যে ওই সময়টাতে … মানে আমাদের লোকজন ভিড়ের মধ্যে স্যারকে চিনতে না পেরে হয়তো …।’ আবার সেই জবাবদিহি।

এবার এই ঘ্যানঘ্যানে আলোচনাটা বন্ধ করা দরকার, লোক দুটিকে কী করে এতক্ষণ সহ্য করছে জাকিয়া! স্বামীর দুরবস্থা বেচারীকে কতটা বিচলিত করেছে, তার এই সহিষ্ণুতা দেখেই অনুমান করা যায়।

শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটা আমাকেই নিতে হলো, আমি কঁকিয়ে উঠলাম, ‘পানি …।’

মুহূর্তে পাল্টে গেল পরিস্থিতি, যুগপৎ স্বস্তি ও ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে আমার স্ত্রী বলল, ‘জ্ঞান ফিরেছে বোধহয়, আপনারা এখন যান …, সিস্টার … সিস্টার …।’

সিস্টার ছুটে এলো। সিস্টারের হাতে দু-চামচ পান করার পর তার হাত থেকে বাটি ও চামচ নিয়ে জাকিয়াও দু-চামচ পানি খাওয়াল আমাকে।

বাড়ি ফিরে আসার পরদিনই কথাটি তুলল জাকিয়া, ‘আচ্ছা তুমি এতো রাতে বাড়ি থেকে কেন বেরিয়েছিলে বলো তো? সোসাইটির রাস্তায় কী করছিলে?’

এ-প্রশ্নের  কী  উত্তর  দেব!  সত্যকথাটা জাকিয়ার বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না, এমনকি আমার মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন জাগতে পারে তার মনে। আমার স্ত্রী দীর্ঘকাল একই খাটে পাশাপাশি শুয়েছে, কিন্তু আমি যে গত প্রায় দেড় বছর নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি সে-কথা সে জানে না। দীর্ঘদিন নিদ্রাহীন আমি। এমন নয় যে, যথাসময়ে মাল শিপমেন্ট নিয়ে দুশ্চিন্তা, বা ঋণখেলাপির তালিকায় নাম উঠে গেল বলে ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারকে সহজভাবে নেওয়ার স্নায়ু আমার তৈরি হয়ে গেছে আরো কম বয়সে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানা আছে, এই বিষয়গুলোর উনিশ-বিশে জীবনমানের যেমন হেরফের হয় না, সামাজিক মর্যাদারও পরিবর্তন হয় না। সুতরাং এসব ব্যাপারে দুশ্চিন্তাহীন জীবন আমার; কিন্তু আমার ঘুম উধাও হয়ে গেল কেন তার উত্তর পাওয়া গেল না। চিকিৎসকেরা সব রোগীকেই পূর্বনির্ধারিত কিছু ধারণা দিয়ে যাচাই করতে চান। ফলে চিকিৎসক বদল করি, তাঁরা কিছু ওষুধ বদল করেন, কিছু পরামর্শও দেন, কিন্তু দু-চোখের পাতায় ঘুম ফিরিয়ে দিতে পারেন না। আমার স্ত্রী সামাজিক দায়-দায়িত্ব ইত্যাদি সেরে প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরে, এবং বিছানায় গেলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নাক ডাকাতে থাকে। আমি বিরক্ত হয়ে একটি সুন্দরী নারীর কুৎসিত অভ্যাস বা আচরণকে প্রত্যক্ষ করি। আমার ঘুম আসে না। প্রচণ্ড ক্রোধ ও বিবমিষায় আমার মন ভরে যায়, একটি ঘুসি মেরে তার নাকের বাঁশি ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আবার মাঝে মাঝে আমার স্ত্রীর স্বচ্ছ রাতপোশাকের ভেতর থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠা শরীর আমাকে এই বয়সেও প্রলুব্ধ করে। আমাদের একমাত্র কন্যাটি এ লেভেল শেষ করে নিউইয়র্কে পড়তে গেছে; কিন্তু জাকিয়ার দেহসুষমা বলা যায় বিস্ময়কর রকমের অটুট। আমি অনেক সময় স্বামীর অধিকারবোধে ঘুম থেকে জাগিয়ে তার সঙ্গে মিলনে লিপ্ত হই। সে সহায়তা করে, কতটা উপভোগ করে জানি না, তারপর আবার দ্রুত নাক ডাকিয়ে ঘুমের মধ্যে হারিয়ে যায়। আমি ক্লান্ত শরীরে নির্ঘুম রাত কাটাই, অনেক দূর থেকে গাড়ির শব্দ কানে আসে আমার, অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন ড্রিল মেশিনের মতো ছিদ্র করে ঢুকে যায়  মাথার ভেতর।

বিদেশে শুনেছি, নাক ডাকার শব্দের জন্য স্বামী-স্ত্রীর ডিভোর্স হয়ে যায়। এদেশে এই তুচ্ছ (?) কারণ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যায় না, আমি বরং জাকিয়াকে আলাদা ঘরে থাকার প্রস্তাব দিলাম। সে সানন্দে রাজি হলো। এতো বড় একটি পরিচারক-পরিবেষ্টিত বাড়িতে আমরা আলাদা কক্ষে শোয়ার ব্যবস্থা করে নিলাম। নিজের ঘরটিকে বাইরের যেকোনো শব্দের উৎপাত থেকে মুক্ত রাখার জন্য রেডিও-টেলিভিশনের রেকর্ডিং কক্ষের মতো সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলাম আমি; কিন্তু গ্রীষ্মের দিনগুলোতে নিঃশব্দ ঘরটিকে সাইবেরিয়ার তুষারাবৃত অঞ্চলে রূপান্তরিত করে উষ্ণ নরম লেপমুড়ি দিয়ে শুয়েও ঘুম হয় না আমার। একশ থেকে নিরানব্বই, আটানব্বই সাতানব্বই হয়ে এক ও শূন্য পর্যন্ত পৌঁছাই, পুনরায় গুনতে থাকি … ক্লান্তিতে শরীর-মন নিঃসাড় হয়ে আসে, কিন্তু ঘুম আসে না।

এর মধ্যে একদিন ক্লাব থেকে একটু বেশি রাতে বাড়ি ফেরার সময় এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। গৃহহীন লোকজন আমাদের দেশের পথে-ফুটপাতে ঘুমায়, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। সেরকম হাউজিং সোসাইটির ফুটপাতে লোকজন ঘুমাচ্ছিল। রাতে আমার দ্রুত ধাবমান গাড়িটি প্রায় একটি মাঝবয়েসি লোককে চাপা দিতে যাচ্ছিল। ঠিক ফুটপাতে নয়, সড়কের কিনারে নিদ্রিত লোকটির ছড়িয়ে থাকা একটি পা ছিল রাস্তার ওপর। গাড়ির একটি চাকা প্রায় উঠেই যাচ্ছিল সেই পা-টির ওপর। ব্রেক কষে ধরার কর্কশ শব্দ, এমনকি উপর্যুপরি হর্নের শব্দেও বিন্দুমাত্র ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি লোকটির। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে নিজের হাতে রাস্তা থেকে তার পা-টা সরিয়ে দিয়েছিল। তাতেও ঘুম ভাঙেনি, শুধু পাশ ফিরে শুয়েছিল লোকটা। সেদিন বাড়ি ফিরে আসার পর কিছুতেই চোখ থেকে এই দৃশ্যটা মুছে ফেলতে পারিনি আমি। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরুদ্বিগ্ন নিদ্রা, সবচেয়ে গভীর ও তৃপ্তিকর ঘুমটা কী রকম হতে পারে তার নমুনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেদিন। আর আইডিয়াটাও মাথায় ঢুকেছিল সেদিনই। আরো দুটি নির্ঘুম রাতে নানা দিক থেকে বিষয়টি চিন্তা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলাম।

একদিন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম রাত বারোটা সাড়ে বারোটা কি আরো একটু পরে, সিøপিং স্যুট-ফুট নয়, লুঙ্গি আর একটা টি-শার্ট পরে, বগলের নিচে একটা চাদর নিয়ে মূল ফটকের সামনে বিস্মিত দারোয়ানকে এ-বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ না করে চুপচাপ থাকার নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

হাউজিং সোসাইটির কিছু সড়কবাতি সবসময় নষ্ট থাকে, কেন নষ্ট তার কারণটা এতোদিনে অনুমান করতে পারলাম, পথে রাতযাপনকারীদের এতে হাত আছে। আলো-আঁধারি একটা জায়গা বেছে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম চাদরটা বিছিয়ে। আশপাশে যারা ঘুমাচ্ছিল তাদের কোনো কৌতূহল, কারো কোনো আপত্তি বা ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। কী অদ্ভুত এক রাত! কতকাল পরে এমন অসাধারণ রাত ফিরে এলো আমার জীবনে! সুবেহ সাদিকের আলো চোখে এসে লাগার আগে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিলাম গভীর ঘুমের অতলে!

এরপর থেকে প্রতিদিন রাত বারোটার পর চুপচাপ বেরিয়ে যাওয়া, আর খুব ভোরে পাখিরা যখন নীড় ছেড়ে বেরোয়, আমার সুরুৎ করে ঘরে ফিরে যাওয়া। নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিলাম, প্রতিদিন এক একটা নতুন দিন, সুন্দর জীবন!

‘এতো রাতে তুমি কী করছিলে সোসাইটির রাস্তায়?’ আবার জিজ্ঞেস করল জাকিয়া।

‘ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি কি আজকাল ঘুমের ঘোরে হাঁটতে শুরু করেছি জাকিয়া?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিলাম তাকে।

চমকে উঠল, সিøপ ওয়াকিংয়ের কথা সম্প্রতি কার কাছে শুনেছে মনে করার চেষ্টা করল। সম্ভবত মনে পড়েছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আমার হাত ধরে শোবার ঘরে নিয়ে  এলো  জাকিয়া,  নরম  একটা বালিশ মাথার নিচে দিয়ে শুইয়ে দিলো বিছনায়। কিন্তু ঘুমের আসল ঠিকানা তো আমি চিনে গেছি জাকিয়া। হাউজিং সোসাইটির পথের আশ্রয়টা হাতছাড়া হয়ে গেল! এসব অভিজাত এলাকায় এই ঝামেলা থাকবেই। তারচেয়ে রেলওয়ে স্টেশনের পাশে একটা জায়গা করে নিতে হবে। এই পরিকল্পনাটা আমাকে   উৎফুল্ল   করে   তুলল।   রাত-গভীরে লোকজনের ভিড়ে ঠেলেঠুলে একটা জায়গা করে নিতে পারলেই হবে, তারপর সেই ঘুম … মৃত্যুর মতো ঘুম … গভীরে তলিয়ে যাওয়ার অসাধারণ পরিতৃপ্তি … সুবেহ সাদিকের আলো ছাড়া কেউ আমাকে জাগাতে পারবে না …।