ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি প্রচণ্ড শব্দে আকাশে উড্ডয়ন করল! দুপুরের আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। রাশেদের মনে হলো, পিচঢালা সড়কপথের বেশ ভারী রোস্টার মেশিনটি তার বুক পিষে নিয়ে গেল! যে-যন্ত্রটির পেষণে প্রৌঢ় রাশেদ ক্ষত-বিক্ষত। যন্ত্রণায় হাত-পা অবশ হয়ে আসছে তার। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক নম্বর টার্মিনাল ছেড়ে সে আস্তে আস্তে পা বাড়ায়। ঘর্মাক্ত ঘাড়ে হাত রাখে। চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য একমাত্র ছেলে রাকিবের লন্ডনযাত্রা। ফ্লাইট বিলম্বিত ছিল। কথা ছিল, বাংলাদেশ সময় রাতে বিমান যাত্রা করবে। কিন্তু হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে আসতে দেরি হওয়ায় রাকিবকে বয়ে নেওয়া বিমানটি ছাড়ে পরের

দিন দুপুর বারোটায়। রাকিব বলেছিল, কী দরকার আব্বা এতক্ষণ এয়ারপোর্টে রাত জাগা? কিন্তু পিতার মন কি আর মানে! শল্যচিকিৎসায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ছেলে বিদেশে যাচ্ছে! কবে না কবে ফেরে! আদৌ দেখা হয় কি না এসব চিন্তা ভর করে। চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ছেলের কাছে থাকা। স্ত্রী রোকেয়া ও কন্যা রাবেয়া ছেলেকে বিদায় জানতে বিমানবন্দরে আসতে চেয়েছিল। এখলাছপুর থেকে সকালের লঞ্চে সরাসরি বিমানবন্দর আসা এবং ওদের অচেনা রাজধানী ইত্যাদিকে বেশ ঝামেলার মনে হয়েছে পিতা-পুত্রের।

রাকিবকে রাস্তায় খাবারের জন্য অনেক কিছুই দিয়েছে রোকেয়া। ছেলে আপত্তি করেছিল। পরিবারের তিনজনের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত কিছু খাবার নিতে হয়েছে তাকে।

পলিথিনের একটি ব্যাগ নিয়ে বিমর্ষ রাশেদ। আস্তে আস্তে এগোয়। আকাশ ঝকঝকে! হালকা বাতাসে আর্দ্রতা আছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের রাস্তা পার হয়ে পলিথিনের পুঁটলি থেকে বের করে একটি ভারি জামা। হেঁটে আসে আশকোনা রেলগেট সংলগ্ন এয়ারপোর্ট রোড বাসস্ট্যান্ডের কাছে। জামাটা পরে সে ফুটপাথের একটা চায়ের দোকানে ঢোকে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে দোকানিকে বিস্কুট ও কড়া চায়ের কথা বলে। রাশেদের এখন কিছুই ভালো লাগছে না!

– চা নিন! ও ভাই আপনার চা। কী হলো? কী এত চিন্তা করেন?

অন্যমনস্ক রাশেদ ফিরে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচু স্বরে তার উত্তর –

– জি! দ্যান।

বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে রাশেদের। মাথা জুড়ে নানা চিন্তা! মতলব উত্তর উপজেলার টিএনও কার্যালয়ের বড় কেরানি রাশেদ হাসানের বুক যেন বিষাক্ত শুয়াপোকা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। কিছুতেই মাথা থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণের ভাবনা যাচ্ছে না তার! ছেলেকে ডাক্তারি পড়ানো ছাড়াও অনটনের সংসারে বিভিন্ন সময় নেওয়া ধারকর্জ তার দাঁড়িয়েছে সাড়ে উনিশ লাখ টাকা! পর্বতসমান এই ঋণ কীভাবে পরিশোধ হবে – এই চিন্তা পরিবারের সবাইকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। তবে বেশি দুর্ভাবনা রাশেদেরই। কারণ সাত বছরে বিভিন্ন সময়ে কর্জের গ্রহীতা সে নিজে।

মনমরা ভাব দেখে দোকানি জানতে চায় তার কারণ।

– এয়ারপুর্ট থিকা আইছেন বুঝি?

– হ!

– কে আইলো, না গেল?

– ছেলে লন্ডনে বড় ডাক্তার অইতে গেল।

– তয় মন খারাপ ক্যা ভাইয়ের?

কষ্টের আগুনে কেরোসিন বা ঘি ছিটানোর মতো দোকানির প্রশ্নটা। রাশেদ চায় ছেলের প্রস্থানের পর থেকে জ্বলতে থাকা দহনটা নিজেরই থাক। মন খারাপের মূল কারণ বলা থেকে সরে আসে সে।

– একমাত্র পোলা, বুজেন না! হেই কারণেই মনডা খারাপ! ভাই বিল কত অইছে?

বিল পরিশোধ করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ায় রাশেদ। জয়দেবপুর থেকে সদরঘাটমুখী গেটলক বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দুটি বাস যাত্রীপূর্ণ ছিল। তৃতীয় গেটলক বাস খালি পেয়ে তাতে উঠে বসে সে। কত কথাই মনে পড়ছে তার। রাশেদের আব্বাও একই অফিসে কেরানি ছিল। গরিব পিতা মৃত্যুর আগে টিএনও স্যারকে অনুরোধ করে রাশেদকে একই অফিসে সহকারী পদে ঢুকিয়ে দেন। রাশেদও ভালো ছাত্র ছিল। কর্জ করা মোটেও পছন্দ করতেন না উপজেলা অফিসের সিএ কাম ইউডিএ রমিজ আলী। রাকিব কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বেশ ভালো ফল করে। বৃত্তিও পায়। ছেলের সে-সাফল্যের কথা রাশেদের মনে পড়ে যায়। অফিসের সবাই, এখলাছপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গ্রামের আশপাশের প্রতিবেশীদের মিষ্টিমুখ করায় সে! এইচএসসিতে ছেলের অভূতপূর্ব ফলের পর বাড়ির পাশে পিতার কবর জিয়ারত করে। রাকিব স্যার সলিমউল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর পিতার কবরে রাশেদ আবারো যায়। এখনো সেসব দৃশ্য তার চোখে ভাসে। 

রমিজ আলীর বসতবাড়ি ও ফসলি জমি ছিল সামান্যই। জমি বর্গা দেওয়া। ধান আসে। তাতে বছর চলে যায়। কিন্তু কষ্ট হয় আট সদস্যের সংসার চালাতে। অনটনের কারণে ছেলেকে বেশিদূর পড়াতে পারেননি রমিজ।

পিতার কাছে ছেলের শিক্ষা-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাশেদ পরামর্শ করতে গেলে সরাসরি মানা করে দেন রমিজ আলী। কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রাশেদ। পিতাকে জানায় রাকিবের উচ্চাকাঙ্ক্ষা!

– আব্বা আমনের নাতি ডাক্তারি পড়তে চায়। রোকেয়ারও ইচ্ছা রাকিব ডাক্তার ওক।

– পারবি তো খরচ চালাইতে? কেরানির পুত কেরানি! তুইও তো বালা ছিলি পড়ালেহায়। গরিব ছিলাম। সাধ ছিল তয় সাধ্য ছিল না। চাই নাই ঋণ কইরা তরে পড়াইতে। পিতিবিতে আমি নাই! তর ছেলে – আমি আর কী কমু! দ্যাখ পারস কি না? ঋণ করা বালো না বাপজান!

– আমনে দোয়া করেন আব্বা। কষ্ট কইরা পাঁচ-ছয় বছর চালাইয়া গেলে তো অয় ডাক্তর। তখন আর চিন্তা থাকবো না আমগো। অভাব দূর অইয়া যাইবো! দু-হাত ওপরে তুলে রাশেদ সুরা বলে – ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুরি, ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আসার।’

ভিক্টোরিয়া পাকের্র কাছে চলে এলো বাস। হেলপার চিৎকার করে উঠল –

– নামেন নামেন! সদরঘাট আইয়া পড়ছে। গাড়ি আর সামনে যাইব না। ধীরপায়ে রাশেদ বাস থেকে নামে। রাস্তার মাঝখানে সড়কে চলন্ত বাস থেকে নামার সময় হেলপার ছেলেটি রাশেদকে বলে –

– মুরুব্বি সামনে বাম ঠ্যাং দিয়া নামেন!

রাশেদ সদরঘাটের তিন নম্বর টার্মিনাল অভিমুখে হাঁটতে থাকে।

ঘাট থেকে কুড়ি টাকায় একটি পাউরুটি এবং পনেরো টাকায় এক হালি শবরি কলা কিনে গ্রিন ওয়াটার লঞ্চে চাপে রাশেদ। তিনটায় লঞ্চ সদরঘাট ছাড়ে। বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত কালো পানির দুর্গন্ধে প্রায় যাত্রীই মুখ হাত, রুমাল ও কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। বেশির ভাগ যাত্রী সরে আসে লঞ্চের জানালার পাশ থেকে। রাশেদ খেয়াল করল, আজকের লঞ্চে ভিড় কম। গতকাল ঢাকায় এ-লঞ্চেই আসার সময় বেশ যাত্রী ছিল। কম খরচে সংক্ষিপ্ত যাত্রায় এখলাছপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম এই গ্রিন ওয়াটার। পাঁচ ঘণ্টা যাত্রাপথে বিভিন্ন ঘাটে লঞ্চ থামে। সড়কপথে আসতে হলে অনেক ঘুরে আরো বেশি টাকা খরচ করে ঢাকা যেতে হয়। সেটা রাশেদের অপছন্দ।

ফতুল্লা ছেড়ে আসার পর নদীর জল পরিষ্কার হতে থাকে। রাশেদ কলা-পাউরুটি চিবুতে চিবুতে দোতলার ডেকে ওঠে। সারেংয়ের ঠিক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠান্ডা বাতাস। বেশিক্ষণ থাকতে না পেরে নিচে নেমে আসে সে। কাঠের বেঞ্চিতে আরাম করে বসে। ছেলের কথা ভাবে। বিমানে ওঠার আড়াই ঘণ্টা আগে রাকিবের কথাগুলো রাশেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ছেলের দেশে ফেরা, ঘর-সংসার ইত্যাদির পরিকল্পনার কথাগুলো কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছে না সে। তা নিয়ে অস্বস্তি কদিন ধরেই। তবে অস্বস্তির মাত্রা বেড়েছে রাকিবের উত্তরগুলো পাওয়ার পর থেকে। বিমান আসতে দেরি হওয়ায় রাতে রাশেদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করছিল তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে। একলাছপুর উচ্চ বিদ্যালয়, নটর ডেম কলেজ এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী পুত্রের উত্তরগুলো রাশেদের মনঃপূত হয়নি। বরং পিতাকে রাকিব হতাশার সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে।

– ফেলোশিপ সম্পন্ন হলে তো তুই বাবা বিলাতফেরত বড় ডাক্তার!

– জি আব্বা!

– ফিরে আইতে কদ্দিন লাগবো তর?

– এইটা নির্ভর করে কোর্সগুলোর পরীক্ষা পাশের পর।

– আচ্ছা! হুনছি এইটা নিলে সব দ্যাশেই মোটা বেতনে নাকি চাকরি পাওয়া যায়। আমগো দ্যাশেও মেডিক্যালে এফআরসি ও এফআরসিএস করা চিকিৎসকের অনেক দাম।

– একদম ঠিক কইছেন আব্বা।

– তাইলে আইয়া পড়িস। তুই ছাড়া আমার কেউ নাই বাপজান!

– ক্যান আম্মা, রাবেয়া ও দাদি?

– হেরা তো পোলা না।

– তই কী অইছে! ভাবছি লন্ডনে চাকরি পাইলে হেই দ্যাশে থাইক্কা যামু!

– এইডা কী কস? তর আম্মা রওশন আরার বাপ-মায়েরে কতা দিচে তুই ফিরা আইলেই তর লগে ওর আক্দ! সারা নয়ানগর গ্রামের মানুষও হেইডা জানে।

– আমার লগে পরামশ্শো কইরা তো আমনেরা টিক করেন নাই?

– এইডা রোকেয়া, রাবেয়া ও আম্মাও জানে। তর মেডিক্যাল পড়ার সময় রওশনের বাপ গ্রামের বড় জোতদার রমজান মুন্সীর থিক্কা অনেক টাকা আনছি।

– আনচেন ক্যান?

– কেরানির চাকরি, অপিসে হিসাবের কাম করি, তাতে হয় না। কয় টাকা আর বেতন! 

সংসার খরচা, ঘরে অসুস্ত আম্মার ওষুদপত্রো। মাসে মাসে তর টাকা পাটানো চারাও আইজ এইডা, কাইল ওইডা লাগব – এসব কইথিকা আসত? ভাবচি কেরানির পুতে ডাক্তর, আমগো আর চিন্তা কী!

– পারতেন না যহন তয় পড়াইলেন ক্যা?

– ওই যে গরিবের বিলাসিতা! যদি আমগো অভাব গুচে।

এয়ারলাইন্সের বুথগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আলো ঝলমল রাতে যখন কথা হচ্ছিল তখন রাশেদ বেশ ক্লান্ত। বিদেশযাত্রী পুত্রের জন্য মনোবেদনা এবং দীর্ঘ সময় প্রায় অভুক্ত থাকায় পুত্রের কথা সহ্য হচ্ছিল না। ছেলের মুখের কর্কশ ও ঝাঁঝালো ভাষার উত্তর তাকে প্রচণ্ডভাবে বিদ্ধ করছিল। তারপরও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সে। মিহি গলায় ডাক্তার রাকিবের কাছে তার বড় জিজ্ঞাসা।

– সত্যি কি আবি না?

– না আসার সম্বাবনাই বেশি।

– তর বিয়া? আর তর জন্য পাহাড়সমান আমার কর্জের কী অইব?

– এত বিয়া বিয়া করতাচেন ক্যান আব্বা? আগে বালামতো ডাক্তর অই! বিয়া করতে অইলে ওইখানথিকা দেইখ্খা একটা মেমরে কইরা পেলামু! যদি পারি চেষ্টা করুম মইদ্যে মইদ্যে ট্যায়া পাটাইতে।

ডাক্তার রাকিব হাসানের এমন উত্তরের জন্য মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না অসহায় কেরানি রাশেদ হাসান। ছেলের উত্তরগুলো তার বুকে ধারালো অস্ত্রের মতো আঘাত করল! দীর্ঘশ্বাসের মাত্রা বাড়ে। তার কাছে রাখা ছেলের দেওয়া বহুদিনের ব্যবহৃত গেঞ্জিটা পলিথিন থেকে বের করে তাতে রাশেদ ভেজা চোখ মোছে। এ-সময় মনে পড়ে যায় কবরে শুয়ে থাকা আব্বাকে। মরহুম পিতার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। নাতির মেডিক্যাল ভর্তির ব্যাপারে রমিজ আলী সঠিক পরামর্শই দিয়েছিলেন। কিন্তু আবেগ রাশেদকে পিতার পরামর্শ মানাতে পারেনি। সামনের পথ আরো অন্ধকার মনে হচ্ছে তার।

লঞ্চের বাইরেও অন্ধকার। কুয়াশায় নদীর পাড় দেখা যায় না। শীতের আমেজ নিয়ে যাত্রীরা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। লঞ্চের নিচটায় খাবার দোকান ও চা-স্টল। কাঁচা পাতা দিয়ে তৈরি ঘন দুধ চা রাশেদের বেশ পছন্দের। টোবা বিস্কুট কাপে ডুবিয়ে রাশেদ গরম চায়ে চুমুক দেয়। পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাপথে কখনোই সে লঞ্চে ভারি খাবার খায় না। দুপুর ও রাতের খাবারে এ-লঞ্চে গরম ভাতের সঙ্গে শুধু ট্যাংরা মাছ ও গরুর ভুনা মাংস থাকে। তার কোনোটাই সে খায় না। লঞ্চের কেরানি চিৎকার করে ওঠে।

– ষাটনল ঘাট আইছে! ষাটনল ঘাট আইছে! যারা নামবেন সামনে যান।

লঞ্চে গ্রামের অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে; কিন্তু কারো সঙ্গেই রাশেদ ঠিকমতো কথা বলেনি। ষাটনল ঘাট থেকে একলাছপুর বেশি দূরে নয়। মনে শংকা বাড়ছে তার। রাকিবের জন্য রোকেয়ার মেয়ে দেখে রাখা এবং ডাক্তার ছেলের মাধ্যমে ঋণ শোধ – এসব মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে তাহলে? লঞ্চ থেকে নেমে কোথায় যাবে রাশেদ? নয়ানগর! কী জবাব দেবে রোকেয়া ও রাবেয়াকে? সুখস্বপ্ন তাহলে ভেঙে যাচ্ছে? অফিসের হিসাব সুনিপুণভাবে যে-রাশেদ মেলায়, তার কি না জীবনের অংক অমিল হয়ে যাচ্ছে? মনে পড়ছে রাকিব যখন মেডিক্যালে ভর্তি হবে হবে সে-সময়কার কথা।

ছেলে জানাল বেতন, থাকা ও খাওয়া খরচ হলেই কোনোরকমে সে মাস চালিয়ে নেবে। এ-কথাতে রাশেদ খুশিই হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই তার চাহিদা বাড়তে থাকে। আজ দামি দামি অ্যাপ্রন, মেডিক্যালের বই ও উপকরণ, বিদেশি ব্র্যান্ডের দামি জুতো, অভিজাত পোশাক, ক্লাসমেট বান্ধবীদের জন্মদিন ও নানা উপলক্ষে উপহার কেনায় অর্থ পাঠাতে পাঠাতে রাশেদ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিকভাবেও পঙ্গু সে। অফিসে বিষয়টি জানে শুধু সহকর্মী সিএ সাহেব হেলাল পাটওয়ারী। তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এ-পরামর্শ শোনার পর তাৎক্ষণিক হেলাল সাহেবের ওপর রাশেদের রাগ হয়; কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি রাশেদ। অফিস সুপার পঞ্চান্ন বছর বয়সী রাশেদের কদর সবার কাছে। সন্তান বয়সী খোদ টিএনও স্যার তার ওপর অফিস রেখে ঢাকায় নিশ্চিন্তে থাকেন। প্রয়োজন হলে ভ্রাম্যমাণ ফোনে কাজ সারেন। এ-সুনামের কারণে অফিস থেকে বিভিন্ন সময়ে ঋণ গ্রহণে কোনো অসুবিধা হয়নি তার।

এখলাছপুর ঘাট স্পর্শ করেছে গ্রিন ওয়াটার। রাত আটটা তেরো মিনিট বাজে। লঞ্চটি আর কোথাও যাবে না। রাতে ঘাটেই থাকবে। পরের দিন সকাল ন-টায় ঢাকায় আবার যাত্রা করবে। তাই তাড়াহুড়ো নেই রাশেদের। আর যাবেই বা কোথায় সে? ভয় তাকে জাপটে ধরেছে! ইচ্ছে করছে লঞ্চেই থেকে যেতে!

এখলাছপুর লঞ্চঘাট থেকে থানা সদর অবধি রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক সারারাত চলাচল করে। মতলব থানাধীন প্রায় এলাকাগুলো শিক্ষিত ও শান্তিপূর্ণ। অনেকে হেঁটেও চলাচল করে। রাতে চলাচলকারীদের প্রায় সবার হাতেই থাকে টর্চলাইট! রাশেদ ঢাকা যাওয়ার আগে ঘাটের পাশে স্টেশনারি দোকানদার আবুল মুন্সীর কাছে চার ব্যাটারির টর্চটি রেখে গিয়েছিল।

– কী রাশেদ ভাই, পোলার পেলেন কয়ডায় ছাড়ল?

– আর কইয়েন না। টাইম ঠিক নাই! এয়ারপোর্টে একজনের ঢুকতে লাগে আড়াইশো ট্যাকা। বাথরুমগুলিতে দুর্গন্ধে ডুকা যায় না। যেই কষ্ট পাইছি ভাই!

টর্চটা হাতে নেয়। নয়ানগর গ্রামে তার বাড়ির কাছে সব যানবাহন থামে। রাত বেশি হয়ে গেছে। মন খারাপের সঙ্গে সঙ্গে রাশেদের শরীরটাও ঠিকমতো আর চলছে না। তাই ইজিবাইকে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয় সে। ছেলেকে বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর আগেই তার ম্যাক্সিমাস ফিচার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায়। ইজিবাইকে উঠে বসে সে। সেটটি হাতে নিয়ে তা খোলার চেষ্টা করল কয়েকবার। চারজন হলেই ব্যাটারিচালিত যানটি রওনা হবে। এ-সময় ছেলের কথাগুলো মনে পড়তে থাকে তার। কীভাবে শোধ করবে বিপুল ঋণ? ভাবনায় এনজিও অফিস, নিজের কর্মস্থলের ঋণ ও আগাম পণ হিসেবে ছেলের ভাবি শ্বশুরের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ইত্যাদি। জীবন-অংকে গরমিল! বাবার আপ্তবাক্য আবারো মনে পড়ে। তার চোখে যেন বিষাক্ত কোনো পোকা দংশন করছে। জ্বালা করছে। হঠাৎ শব্দ! ইজিবাইক থেকে নিচে বালিতে লুটিয়ে পড়ল রাশেদ। ড্রাইভারসহ পরিচিত কয়েকজন তাকে নিয়ে যায় আবুল মুন্সীর দোকানে। তারপর বেঞ্চিতে টেবিল ফ্যানের নিচে শুইয়ে দেয় জ্ঞানশূন্য রাশেদকে।