রোবোটাব্দ

আমার সবচেয়ে পছন্দের সাহিত্য সম্পাদক যখন এলেন সেদিন, তখন আমি ঝগড়া করছি।

সপ্তাহখানেক হলো খুব বেগোড়বাই করছে চাকরটা। খাচ্ছে, দাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে – কিন্তু কাজ করছে না কোনো। কী কী সমস্যার কথা নাকি বলছিল কদিন ধরে, শুনিনি বলেই অসহযোগ। এখন আবার কুলুপ এঁটেছে মুখে; গণ্ডগোলটা কী, বলছেই না। হাসপাতালে নিয়ে যাব, সে-সামর্থ্যও আপাতত নেই। এমনিতে গাধাটা কাজ করে ভালো। সমস্যা একটাই – বিগড়ে যায় কথায় কথায়। আর গেলেই পড়ি বিপদে। কোনো কাজই ঠিকমতো করে উঠতে পারি না। একদিক সামলাতে গিয়ে দেখি বেসামাল পড়ে আছে অন্য ন’টা। অভ্যাস না থাকলে যা হয় আর কি। সবচেয়ে

বড় সমস্যা যেটা হয়, সেটা হলো – লেখালেখির সময় হয় না। ফলে খুব পুড়তেও থাকি ভেতর ভেতর। বাধ্য হয়েই তাই আলোচনায় বসা। তা যত যা-ই বলি, একটাই কথা গাধাটার – থাকবে না আমার বাসায়। সারাদুপুর বুঝিয়েও দেখি যেই-কে-সেই। কতক্ষণ আর সহ্য করা যায়? রেগেমেগে বলেছি, এরকম করতে থাকলে মাংসের দরে বিক্রি করে দেব বাজারে। শুনে তখন আবার বসে থাকল মুখ ভার করে।

বিরক্ত পায়ে পায়চারি করছি ঘরময়, দুই-একটা ধাওয়া-পালটা ধাওয়া হচ্ছে কথায়; হঠাৎ মনে পড়ল বাগানটার কথা। দেয়ালজুড়ে ডিজিটাল আর ঘরজুড়ে সিনথেটিক ফুলে আর কত? সত্যিকারের স্নিগ্ধতার জন্য তাই বাহারি ফুল আর পাতার কিছু গাছ লাগিয়েছি টবে। অন্য সবকিছু চাকরটার দায়িত্বে থাকলেও গাছগুলোর যত্ন আমিই নিই। তবে এই কদিনে তালগোল পাকিয়ে গেছে। ঘর দেখতে দেখতে বারান্দায় আর নজর দিতে পারিনি। অবশ্য দিয়েও যে খুব একটা লাভ হয়, তা নয়। ওরা মনে হয় খুশি না আমার হয়ে। কষ্টই সার, ফুল পাই না, ফল তো না-ই। তবু, সেবাযত্ন তো করতেই হবে। ভাবছিলাম, গোড়ায় একটু পানি দিয়ে ওদের ঘাড়-মাথায় হাত বুলিয়ে আসি। এমন সময় ডেকে উঠল রিসিভারটা। তাকাতেই দেখি সম্পাদক। বরাবরের মতোই হাসি মেখে এসেছেন মুখে। সঙ্গে বাড়তি একটু উত্তেজনাও যেন দেখলাম। উষ্ণস্বরে কুশল বিনিময় হলো। আরো কিছু এটা-সেটার পর আসল কথাটা বললেন তিনি।

‘মারাত্মক প্ল্যান করেছি, আপনার একটা গল্প দিয়েন তো।’

আমার সম্পাদক-ভাগ্য ভালো। সেই ভালোর মধ্যেও সেরাজন হলেন ইনি। সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী সম্পাদক হয়েও আমাকে বেশ গুরুত্ব দেন। লেখা চাইলে তাই ‘না’ করি না পারতপক্ষে। সমস্যা হলো, হাতে কোনো গল্প নেই। নতুন একটা যে লিখে দেব তড়িঘড়ি, তাও কঠিন। ক্রিয়েটিভিটির প্যাকেজ শেষের দিকে মনে হয়, আপডেট দিতে হবে। নইলে অনেক শ্রম যায়, সময়ও লাগে প্রচুর। লিখতে হবে ভাবলেই ঠান্ডা হয়ে আসে হাত-পা।

তবু লিখব।

প্রতিবেশী মিস্টার ক্যুওট একজন বিখ্যাত অধ্যাপক। গোটা কয়েক বেস্টসেলার বইয়ের লেখকও। লেখালেখি করি বলে স্নেহ করেন আমাকে। কোথাও আমার লেখার খোঁজ পেলে আগ্রহ নিয়ে পড়েন, প্রতিক্রিয়া জানান। তেমন হলে আমিও কোনো কোনো লেখার ট্রেস পাঠাই তার আইপিতে। লিখি, ‘কেমন হলো, জানায়েন।’ ব্যস্ত থাকেন, পড়ার সুযোগ হয়তো সহসা হয় না। তবে যত দেরিই হোক, পড়ে মতামত ঠিকই দেন। সময় সুযোগ হলে আমাকে আমন্ত্রণও জানান। বলেন, ‘লেখা কেমন হলো সেটা বলার ধৃষ্টতা দেখাব না, আমি বড়জোর আমার কাছে কেমন লাগল তা বলতে পারি।’ অথচ প্রতিটি লেখার খুঁটিনাটি নিয়ে এত বুদ্ধিদীপ্ত আর শিল্পিত কথা বলেন, অনেক সাহিত্য-সমালোচকও পারেন না অমন। আলাপগুলো হয় গল্পের সূত্রেই, তবে লতায় পাতায় তা কোথায় কোথায় গিয়ে যে পড়ে তার কোনো নকশা মানচিত্র নেই।

এমনই এক আড্ডায় মজে ছিলাম গত মাসে একদিন। কথায় কথায় উঠে এলো অদ্ভুত সব মহামারির প্রসঙ্গ। নতুন ধরনের এক ছোঁয়াচে ভাইরাসের কথা বলছিলেন ক্যুওট, ভয়াবহ রকমের মারণক্ষমতা ছিল তার। খুব দ্রুতই নাকি এটা ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে। সংক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো প্রতিরোধই কাজ করেনি। বাধ্য হয়েই দেশে দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। বলতে গেলে পৃথিবীটাই নাকি সেঁধিয়ে গিয়েছিল ঘরে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা তবু বেড়েই চলছিল। পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল তখন, ওই মহামারির মধ্যেই, যখন নতুন আরেকটা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলো। এটা আবার ছিল বায়ু ও পানিবাহিত, লকডাউনেও কাজ হলো না তাই। দুই ভাইরাসের উপসর্গগত মিলও এত ছিল যে, তাদের আলাদা করে চেনার সুযোগ মানুষ পায়নি। তবে নতুনটায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ছিল পুরনোটার চেয়ে বেশি। তার ওপর আবার যোগ হলো মাসের পর মাস ঘরে থাকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ডিপ্রেশনজাত আত্মহত্যাও। ফলে, বলা চলে একরকম নির্বিঘ্নেই, মানবজাতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করতে পেরেছিল ভাইরাস দুটো। বহু বছর ধরে চলা তাদের নির্মম ভূরিভোজে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল চরাচর। খুঁজে খুঁজে বারোটা না তেরোটা দেশে সাকল্যে সতেরো জনকে (কেউ কেউ বলেন উনিশ জনকে) জীবিত পাওয়া গেছে। তারপর থেকে একরকম নতুন করেই গড়ে উঠেছে সভ্যতা আবার।

সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ চলাকালেই আমি কটা প্লট নিয়ে ভাবছিলাম। তার হলোগ্রাফ ইমেজ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঠিক করে ফেললাম, গল্পটা লিখব ওই সতেরোজনকে নিয়ে!

শুরুতেই যে-ব্যাপারগুলো সাজিয়ে নিলাম, তালিকায় ফেললে সেগুলো এমন দাঁড়ায় :

জীবিতদের দুটো ডাক্তার, দুটোই মানসিক ভারসাম্যহীন – আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে দিতে ঘরবাড়ি ভুলেছে, পরে দেখেছে নিজের পরিবারের লোকেরাই চিকিৎসাহীন। দুটো বুদ্ধিজীবী – একটা মহামারির শুরুতে নাস্তিক ছিল, ভয়াবহতায় পরে বিশ্বাস এনেছে; আর একটা পুরো উলটো – শুরুতে বিশ্বাসী, পরে নাস্তিক। একটা শিশু, বাপ-মায়ের লাশের ফাঁকে বসে কাঁদছে। দুটো অশীতিপর, আক্রান্ত সন্দেহে যাদের একটাকে সাগরতীরে ফেলে গিয়েছিল স্বজনরা, সেখানেই একটা বাতিল কুঁড়েঘরে থাকে সেটা; আর একটা টিকে আছে সরকারি এক বৃদ্ধাশ্রমে, একা। আরো দুটো বয়স্ক মানুষ, মারি থেকে বাঁচাতে শুরু থেকেই যাদের আলাদা রেখেছিল সন্তানেরা। মুমূর্ষু দুটো মোটিভেশন গুরু, শ্রোতা না পেয়ে যারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই বক্তৃতা দিয়ে চলে। বাকিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবা হয়নি এখনো, লিখতে লিখতে ভেবে ফেলব আশা করছি।

সতেরোটার মধ্যে ষোলোটাই পুরুষ, অথবা ষোলোটাই নারী। তবে শুনেছি সেই মহামারিতে পুরুষের মৃত্যুহার ছিল নারীর মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি। ষোলোটারই নারী দেখানো তাই অধিকতর যৌক্তিক মনে হচ্ছে।

লকডাউন চলমান থাকায় কেউই বের হয় না। খাবারের মজুদ শেষ প্রায়, এটা-ওটা খেয়ে দিন কাটছে। কোনো প্রকার যোগাযোগও নেই। এভাবে ঘরেই থেকে গেলে তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেক কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে।

অধিকাংশই তারা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের। কেউ পাহাড়ি, কেউ গ্রামের, কেউ নাগরিক। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকের ধরনও আলাদা।

সব ভুলে তারা যদি এক হয়, একে অপরের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে অন্তত আরো কিছুদিন বাঁচবে সবাই। বিশেষ করে শিশুটি। পৃথিবীতে মানবজাতির টিকে থাকার জন্য তার বাঁচাটা দরকারিও। বড় হলে সে-ই হবে তখনকার পৃথিবীর একমাত্র পুরুষ। অথবা একমাত্র নারী (যদি সতেরোটার মধ্যে ষোলোটাকেই পুরুষ ধরি)। যা-ই হোক, তার টিকে থাকাটা দরকার।

এমন অবস্থায় তাদের এক করা এক সংকট। সংকটটা সমাধানের পথে দেখা যাবে নানান জটিলতা, সংঘাত আর সম্ভাবনা। এগুলোই গল্পের সঞ্জীবনী।

তারা কেউই যেহেতু অন্যের সম্পর্কে জানে না, এবং বাইরে আসার সাহস রাখে না, সংকট সমাধান তাদের দ্বারা হবে না। এজন্য দরকার একজন অবতারের। কিন্তু কাকে দেব আমি এত মহান ও অনন্য দায়িত্ব? কে-ই বা পারবে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করতে? লোকবিশ্বাস ঠিক হলে একজনই তেমন আছেন – স্রষ্টা। তিনি ছাড়া আর কারো পক্ষেই এত দ্রুত এত কঠিন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।

ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য স্রষ্টা সম্পর্কিত নোট : বিশ্বাস করা হয় যে, স্রষ্টা বলে কেউ একজন আছেন যিনি সৃষ্টি করেছেন সবকিছু, আর সাত আসমানের ওপর থেকে চালিত করেন ব্রহ্মাণ্ডকে। বহুলোক এমনও আছে, যাদের মতে – এই ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই; নিজেদের দুর্বলতা আর ব্যর্থতার দোহাই দিতে মানুষই তাকে সাজিয়ে নিয়েছে কল্পনার জোরে; আর ‘যার-শীল-তার-নোড়া, তারই-ভাঙব-দাঁতের-গোড়া’র মতো করে মানুষের ওপরই কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে সেই কল্পনা। তবে গল্পের স্বার্থে আমি ধরে নেব স্রষ্টা বলে সত্যিই কেউ একজন আছেন।

এবং তিনিই এ-গল্পের মূল চরিত্র, আমার নায়ক। প্রথমত ফেরেশতা পাঠিয়ে তিনি চেষ্টা করবেন সংকটের সমাধান করার। তবে সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকেই নেমে আসতে হবে। এসেই তার মস্ত একটা ভুল ভাঙবে – দূর থেকে পৃথিবীটা দেখতে যেমন, বা তৈরি করার সময় যেমন দেখেছিলেন, পৃথিবী এখন আর তেমন নেই। তার কোনো নির্দেশই একবারে পালিত হচ্ছে না। কোনো কাজ করতে বারবার চেষ্টা করা লাগছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, প্রায়ই ভুল করছেন তিনি। যা করতে চাইছেন তা হচ্ছে না, বা হলেও পরে মনে হচ্ছে – এটা করা ঠিক হয়নি। তার অবয়ব কী হবে, দৈহিক গড়ন কেমন দেখাব, ভেবে উঠতে পারিনি এখনো।

তবে সম্ভাব্য বাঁকগুলো তো আঁকাই আছে, শুরু করলাম গল্প বোনার আয়োজন। দিনপাঁচেক পরে যখন থামল তা, প্রথম পাঠে মনে হলো ঠিক জমেনি। গল্পের ঝাঁঝ একটু কম আর গল্পকারের স্বর একটু বেশি। ফলে সরিয়ে সেটা রেখে দিলাম দিনকয়েকের জন্য। এখন আর ভাববই না ওটা নিয়ে। অন্য কাজ করলাম। পড়লাম। বাগানচর্চা করলাম। চাকরটাকে বশে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। রাগ করে দিলাম একটা ধাক্কা একদিন। ব্যথা পেয়ে, নাকি ভান করে জানি না, কঁকাতে থাকল গাধাটা। তার মধ্যেই নানান ভাবনা এলো গল্পটা নিয়ে, সেগুলো টুকে রাখলাম। তারপর হালকা আঁচে গল্পটাকে আবার চাপিয়ে দিলাম চুলায়। বাকি লোকদের মধ্য থেকে কটাকে নেতা, আর দুটোকে করলাম ধর্মীয় গুরু। তাতে অবশ্য প্রভাব কমে গেল স্রষ্টার। তা যাক, নায়ক হলেই তাকে ‘একাই একশ’ হতে হবে নাকি? সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা অবশ্য আনতে হলো পরিবেশে।

প্রথম খসড়ার পরিপার্শ্ব বর্ণনাটা ঠিক হয়নি। চারপাশে গাছ আর গাছ, জমিনের ওপর পথঘাট নেই কোথাও, যাতায়াত চলে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে, অথবা ভূগর্ভস্থ পাবলিক ট্রান্সপোর্টে; বসতির ত্রিসীমানায় কলকারখানা নেই, নেই দূষণ। হাঁটাচলার রাস্তা একমাত্র দূরবর্তী জনপদগুলোয় কিছু আছে, তা সেখানে মানুষ ছাড়া থাকে না কেউ। যা দেখেছি, মানে এই যে আমার দেয়ালগুলো স্বচ্ছ করে নিয়ে বাইরে তাকালে যা যা দেখা যায়, তা-ই লিখেছি। অথচ কিছু প্রামাণ্য দলিল বলছে, তখন ছিল সব উলটো। প্রথম প্রজন্মের কিছু রোবটের জন্ম হয়েছে কেবল, খুবই নিম্নশ্রেণির বুদ্ধিমত্তা তাদের এবং মানুষেরই সহযোগী তারা তখনো। শহরে শহরে কলকারখানা, রাস্তায় রাস্তায় বাহনের ভার, ধোঁয়ার মেঘ, পথে পথে ঘুরেও দেখা মেলে না গাছের, চারপাশ ধূসর আর শুকিয়ে নালা হয়ে যাওয়া নদনদীতে রাসায়নিক বর্জ্যরে বিষ, বিষ ভাসে বাতাসেও। গল্পটা যখন ঘটছে, মারিশেষের সময়টায়, তখন যদিও বদলে গেছে ব্যাপারটা। আগের তুলনায় সবুজ অনেক বেশি, গাছে গাছে ভরে গেছে চারপাশ। তবু, চোখ বাড়ালেই বড় বড় দালান আর পা বাড়াতেই রাস্তা-সড়ক তো ছিলই। পরিবেশটাকে তাই দূষিত আর রুক্ষ করে দিলাম। তারপর আরো দিনদুয়েকের নাড়াচাড়া, কাটাকুটির শেষে যা দাঁড়াল, বলতেই হবে, অমৃত না হলেও তা অখাদ্য হয়নি একেবারে।

দারুণ কিছু সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছে গল্প। বিকল্প গর্ভধারণ পদ্ধতির দুয়েকটা ততদিনে আবিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও সেসবে দক্ষ ডাক্তার যেহেতু নেই, পুরুষ কেউ না থাকায় প্রশ্ন জেগেছে – মানবজাতি কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? নাকি ছেলেশিশুটিকে কেন্দ্র করে ওরা নানামুখী বিভেদ ও বিদ্বেষ সরিয়ে পাশে দাঁড়াবে একে অপরের? দাঁড়ালে তাদের মধ্যে কি কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে বাচ্চাটার জন্য? নাকি যতদিন বাঁচে পুরুষ ছাড়াই নিজেদের মতো বাঁচার সিদ্ধান্ত নেবে নারীগুলো? বাচ্চাটার দায়িত্ব কি শেষ পর্যন্ত কেউ পাবে? বাধ্য হয়ে স্রষ্টাকেই আবার নিতে হবে না তো তার ভার? স্বয়ং স্রষ্টাকে আলোচনার টেবিলে পেয়ে ধর্মান্ধ এবং ধর্মহীন দু-শ্রেণির মানুষের আচরণ কেমন হবে? নেতা আর পুরোহিতরাই বা কীভাবে সামলাবে সব? প্রশ্নগুলো টানটান ধরে রেখেছে গল্পের মেজাজ। শেষটাও হয়েছে উন্মুক্ত। বোদ্ধা পাঠক বুঝে নেবে একরকম, হালকা পাঠকের কাছেও সেটা দাঁড়াবে তার মতো। সবমিলিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া যায় বলেই মনে হলো। শেষ হতেই গল্পটা গরম গরম পাঠিয়ে দিলাম সম্পাদককে।

তার ঠিক ছয়দিন পর, আজ, পাঠক-না-পাওয়া হতাশ লেখক আমি, হঠাৎই যেন সেলিব্রেটি হয়ে গেছি।

প্রথম মেসেজটা পেয়েছি বউয়ের কাছ থেকে।

‘সাহিত্য করার জন্য আমাকে ছেড়েছ, অথচ একটা ভালো গল্পও লিখতে পারোনি এতদিন। আজ এই প্রথম কোনো লেখা এত পছন্দ হলো। শেষের দিকে তো মনে হচ্ছিল আমিই লিখছি বাক্যগুলো! খুব সুন্দর।’

গল্পটা কি তাহলে ওরা ছেপে দিয়েছে এর মধ্যেই? দ্রুত গিয়ে ডুবে গেলাম সম্পাদকের পোর্টালে। কিন্তু সেখানে আরেকজনের গল্প, সাহিত্যপাতার প্রতিটি কলাম-ইঞ্চি খুঁড়েও পেলাম না আমাকে। তাহলে কী দেখে ভালো লাগল ওর? এই ওর এক স্বভাব, রেফারেন্স ছাড়াই বকবক করে। বিরক্ত লাগে।

বিরক্তি নিয়েই পড়তে শুরু করলাম ছাপা হওয়া গল্পটা। খুব একটা ভালো লাগল না। কেমন যেন সারশূন্য চকমকি ভাষায় লেখা। ওপরচালাকি আর পাঠকভোলানো ঢংয়ে ভরা। ঢংটাও আবার নিজস্ব নয়, গল্পজুড়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিখ্যাত কজন লেখকের স্বর। সমসাময়িক অনেককেই দেখছি এমন করতে। আবেগের ছাকা তেলে মচমচে চিকেন ফ্রাইয়ের স্বাদে এমন গল্পই রাঁধছেন তারা ধারকরা ভাষায়। বাগাড়ম্বরপূর্ণ তেলতেলে এসব গল্প কেন যেন খাচ্ছেও লোকে। ভাবতে ভাবতেই দেখি আরো কটা মেসেজ। জ্বলজ্বল করছে প্রফেসর ক্যুওটের লেখাও।

‘অভিনব প্লট হলেও প্রথম দিকে একটু খাপছাড়াই লাগছিল। তবে শেষে এসে ইতিহাসের প্রতি যে আনুগত্য ও শিল্পের যে পরাকাষ্ঠা যুগপৎ দেখিয়েছেন, তাতে পুষিয়ে গেছে। সবমিলিয়ে বেশ একটা গল্প, আমার ভালো লেগেছে।’

মেইলেও দেখি ভিড় প্রচুর। সবার ওই এক কথা, অনন্য প্লটের গল্প। এমন ‘সাহসী কলম ধরতে পারার জন্য’ আমাকে অভিনন্দিত করছে সবাই। গল্পটা কি তাহলে অন্য কোথাও ছেপেছে? ওপেন সার্চ দিতেই দেখি, হ্যাঁ, গল্পটা ঝুলছে তাদেরই এক সিস্টার সংস্করণে। এক জায়গার কথা বলে গল্প নিয়ে অন্য কোথাও ছাপা হলে রাগ হওয়া স্বাভাবিক। তবে যে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি, তাতে আমি খুশিই হয়েছি বরং। সত্যিই হুলস্থূল পড়ে গেছে। পোস্টের পর পোস্ট দেখছি গল্পটা নিয়ে।

‘ভাইরাসের তাণ্ডব নিয়ে বহু গল্প পড়েছি, তবে এটা একদম অভাবনীয় ছিল।’

‘স্রষ্টাকে রক্তমাংসের চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন, তাকে মানুষের কাতারে নিয়ে এসে মানুষের সমস্যা সমাধানে বাধ্য করার মতো অভিনব চিন্তা লেখক কীভাবে করলেন? দুর্দান্ত!’

‘সবচেয়ে মারাত্মক লেগেছে ওইখানে, স্রষ্টা যেখানে হতাশ হয়ে পড়ছেন। ভাবছেন, কুন ফায়াকুন বলে যে তিনি পুরো বিশ্ব সৃষ্টি করলেন মুহূর্তেই, সেই তারই অনুরোধেও এক হলো না তেল আর জল!

‘চিন্তা করা যায়, হতাশ স্রষ্টাকে উৎসাহ দিচ্ছে মোটিভেশন গুরু : ‘তুমিও পারবে!’ কী তীক্ষè রস,তীব্র শ্লেষ! সব মিলে এটা এক বিজারে প্যাকেজ। লাভড ইট।’

পড়ছি আর লাফিয়ে উঠছি। শংসা আর শব্দের স্রোত আমায় যেন ভাসিয়ে নিচ্ছে অথই অতল আনন্দে। মনে হচ্ছে, এতদিনে কিছু একটা করতে পারলাম। কত কিছু ত্যাগ করেছি লেখালেখির জন্য, কত বিদ্রূপ আর অবহেলা সয়েছি, আজকের এই দিনটা দেখতে পাব বলেই হয়তো। আহা! মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবকিছু সুন্দর।

চাকর সংঘের লোক এসেছিল পরশু, ‘গৃহমানবের সঙ্গে অসদাচরণ’ করেছি বলে ভর্ৎসনা করল। ভবিষ্যতে এমন হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিয়ে গেল। সংখ্যালঘুদের অভিযোগ বলুন, বা আন্দোলন – তাতে খুব কিছু যে হয়, তা না। তবু একজন লেখকের বিরুদ্ধে কেস হলে সেটা কি ভালো দেখায়? চিন্তায় ছিলাম। তা কালই চুকে গেছে ব্যাপারটা। আমার এক প্রকাশক বললেন, কদিনের মধ্যেই রয়্যালটি দেবেন। দিলেই রোবট কিনব একটা। ঘরে মানুষ রাখার জন্য কত কথাই না শুনতে হয়েছে বন্ধু-প্রতিবেশীদের কাছে। ব্যাটাকে তাই ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি। বারান্দায় গিয়ে দেখি গাছে গাছে ফুল। রূপে গন্ধে মাতাল; উড়ে বেড়াচ্ছি সুবাসভরা হাওয়ার পাখায় চেপে।

গল্পটা শেয়ার করা প্রায় প্রতি পোস্টেই রয়েছে অজস্র পাঠকের মন্তব্য। কেউ কেউ অল্প-বিস্তর কোটও করেছে গল্প থেকে। তৃপ্তির স্বাদটুকু রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে স্বস্তির একটা ড্রিংক বানিয়ে নিলাম। তারপর বসলাম পোস্টগুলোর বিস্তারিত পড়তে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম ঝামেলা আছে, মহাকাশের আলোকিত অংশটুকুই কেবল দেখেছি এতক্ষণ। একটু খেয়াল করে দেখলেই পরিষ্কার হবে অন্ধকারটা।

‘রাজনীতিবিদ আর ধর্মান্ধদের সামনে স্রষ্টার অসহায়ত্ব উপভোগ করেছি খুব।’

‘নিরাকার স্রষ্টাকে এমনভাবে দেখানো উচিত হয়নি যদিও, কিন্তু তাঁর মহত্ব যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, তাকে সাধুবাদ জানাই।’

‘অর্থের দাপটের সামনে পড়লে স্রষ্টাও নাজেহাল হবেন, সুন্দর রূপকের মধ্য দিয়ে তা-ই কি বুঝিয়ে দিলেন লেখক?’

‘স্রষ্টার ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান যারা, তারা এই লেখাটা পড়ে নিক।’

‘মরিয়া স্রষ্টা যখন জোর করে বাচ্চাটাকে গছিয়ে দিচ্ছে নারীদের হাতে – তারা যেন তাকে বড় করতে পারে, তার দ্বারা ধারণ করতে পারে নতুন প্রজন্মের ভ্রূণ – তারা তখন রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদে। স্রষ্টার চোখে চোখ রেখে বলেছে, নারীর কাজ শুধুই সন্তান উৎপাদন নয়। তারপর দুপক্ষের ধস্তাধস্তির মাঝে আঘাত পেয়ে বাচ্চাটা মারা যেতেই যে মূর্তি ধারণ করেছে নারী, তারও তুলনা নেই। পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী স্রষ্টাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে নতুন ইতিহাস লিখেছে তারা। স্যালুট জানিয়ে যাই।’

‘নারীদের কাড়াকাড়ির মধ্যে হাত ফসকে বাচ্চাটা পড়ে গেল। শেষ হয়ে গেল পৃথিবীর শেষ পুরুষটাও। আশার সকল আলো হটিয়ে যখন রাজ করতে শুরু করেছে অনন্ত আঁধার, তখনই খেলটা দেখাল দুর্বার নারী। পৃথিবীতে মানব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে স্রষ্টাকেই বেছে নিল গর্ভধারণের উপায় হিসেবে। এ যেন প্রাচীনসব মিথের নবতর উপস্থাপন। তবে তার চেয়েও দুই কাঠি সরেস হয়ে উঠেছে গল্পটা এরপর। কে পাবে স্রষ্টার একান্ত সঙ্গ? কে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জননী? এই প্রশ্নে স্রষ্টা যখন গরিবদের ডিঙিয়ে উন্নতবিশ্বের ধনী নারীর পাণিগ্রহণ করলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক গল্পটাই যেন রচিত হয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি!’

‘শেষটা হয়েছে মারাত্মক। নবপ্রজন্মের জননী হওয়ার সুযোগ ধনী নারীটা ছাড়তে চায় না। কিন্তু ভাইরাস-আক্রান্ত বাচ্চা লালনপালনের ঝক্কিও কি তার সইবে? এমন অবস্থায় কথা বলে উঠল তার প্রতিপত্তি। তার হয়ে বাচ্চাটার শুশ্রূষা ও দেখভালের দায়িত্ব, মৃত্যুর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, নিল দরিদ্র এক নারী। প্রতীকের মাধ্যমে এই যে মুদ্রার দু-পাশটাই দেখিয়ে দিলেন লেখক, তার তুলনা কোথায়?’

এমনই পরস্পরবিরোধী সব বক্তব্যে ভরা পোস্টে ভরে উঠছে ওয়াল আমার। শুধু স্রষ্টা-সম্পর্কিত নয়, গল্পের উল্লেখযোগ্য প্রায় প্রতিটি দিক নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন এন্ডিংয়ের আভাস দিচ্ছে পোস্টগুলো।

কীভাবে কী?

বুঝতে না পেরে আমি পোস্টের নিচে কমেন্টসে মন দিলাম। সেখানে আবার উলটো রাজ্য। সমালোচনার ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, তাতে অফুরান বিদ্রূপের ধুলো আর অশেষ বিদ্বেষের বালি। সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে বিবিধ বিষোদ্গার আর বিচিত্র কটুকাটব্য। কমেন্টের পর কমেন্টে আমাকে ‘নারী-বিদ্বেষী’, ‘স্যাডিস্ট’, ‘নাস্তিক’ ‘মৌলবাদী’সহ নানা ধরনের ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে।

‘এত নিষ্ঠুর হয় কী করে একজন লেখক?’

‘স্রষ্টার সামনেই ওরা মেরে ফেলল বাচ্চাটাকে। বিশ্বাস করা যায়? নারীকে এমন রূপেই কি দেখেন লেখক?’

‘লিখতে লিখতে এতজন নারীর সঙ্গে স্রষ্টার সঙ্গমদৃশ্য কল্পনা করে নিশ্চয়ই বেশ পুলক বোধ করেছেন তিনি! এতটা কামুক ও ফন্দিবাজ হয় কি করে কেউ? ছিঃ!’

‘কেবল ছোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য একটা মুমূর্ষু রোগীকে কেউ এভাবে হত্যা করতে পারে?’

‘স্রষ্টাকে ব্যঙ্গ করে এমন একটা গল্প লেখা তো দূরে থাক, ভাবার জন্যই তাকে হত্যা করা উচিত।’

এত বিচিত্র ও অপ্রত্যাশিত মন্তব্য, আমি তাল ঠিক রাখতে পারছি না। সবচেয়ে অবাক লাগছে এটা ভেবে যে, এসব তো আমার গল্পে ছিলই না, ওরা পেল কোথা থেকে? স্যাডিজমেরই বা কী দেখল? যদিও তখনকার বাস্তবতা আর পরিপার্শ্ব খুব আশাপ্রদ ছিল না, সমাজ মানুষকে নৃশংসতাই শেখাত, জোর করেই তবু আলো রেখেছি। আশাবাদী টোনেই শেষ করেছি গল্পটা। ভুলটা তাহলে হলো কোথায়? অস্থির ভাবনার মধ্যেই প্রশ্ন জাগল, এত লেখক থাকতে আমাকে নিয়েই বা এক্সপেরিমেন্ট কেন? আমি কি তবে জরুরি খুব! নাকি স্রেফ বলির পাঁঠা? সত্যটা হয়তো সম্পাদকই জানেন।

কিন্তু কানেক্ট করতে পারছি না তার সঙ্গে। মেসেজ দিয়েছি, তিনি দেখছেন না। শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ বাড়ছে আমার। ড্রিংকটা ঠান্ডা হয়ে গেছে, মুখে দিতেই দেখি অখাদ্যের একশেষ। রাগে সেটা দিলাম ছুড়ে ফেলে। ফুলগাছগুলো মলিন লাগছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যেন। দ্রুত নিচে নামছি আর ভেতরে ভেতরে গড়াপেটা করছি পুরো ব্যাপারটা। এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে সম্পাদকই হয়তো বাঁধিয়েছেন গোল।

না, তেমন কিছু হয়নি। গল্প দেখলাম ঠিকই ছেপেছে। কিছু ভুল বানান ঠিক করেছে, কিছু আঞ্চলিক শব্দ ভুল ভেবে ঠিক করতে গিয়ে উলটো ভুল করেছে। সম্পাদনা বলতে যা, তা হয়েছে শেষের অংশে। জায়গাটা বেশ বদলেই দিয়েছে বলতে হবে। তবু সেটা আমার গল্পই। এবং কোনোভাবেই এত বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়ার মতো নয়। আবার এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে, বিশেষ করে স্রষ্টাকে বা রোগীটাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, কিংবা নারীদের বিদ্রোহ বা ঝগড়াঝাঁটি, বা এ-সংক্রান্ত কিছুই নেই।

তাহলে?

উত্তরটা দেওয়ার জন্যই হয়তো হাজির হলো সম্পাদকের ছায়া। অপার উচ্ছ্বাসে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। বুকে জড়িয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘বিখ্যাত হয়া গেলেন তো মিয়া! কেমন দিলাম?’ কী যে রাগ হলো শুনে! তবে সম্পাদকের সঙ্গে তো আর চোটপাট করা যায় না, সামলে নিতে হলো। ভেতরের কথা পাকিয়ে বেড়াল ভেতরেই, মুখ দিয়ে বেরুল আমতা আমতা না-এর নামতা।

‘কেমন দিলেন বুঝতেছি না ভাই। কিন্তু ঘটনা তো সুবিধার লাগতেছে না।’

শুনেই হা হা করে উঠলেন তিনি আবার। ‘এই হইতেছে আপনার সমস্যা, বুঝলেন? যা লেখছেন, লেখছেন, আত্মবিশ্বাস লয়া বুক চিতায়া দাঁড়াইতে পারেন না। মানুষের লগে থাকতে থাকতে আপনি ওগো মতোন শেকি হয়া গেছেন, জানেন? তাছাড়া, মার্কেটিং তো কয়াই দিছে, নেগেটিভ মার্কেটিংই বড় মার্কেটিং।’

কিন্তু আমি তো মার্কেটিং করতে আসিনি, এসেছি লিখতে। যদিও লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছি না, কেউ পাত্তা দিচ্ছে না – এসব চিন্তা কুরে খায় ভেতরটা। তাই বলে এমন করে আলোচনায় আসতেও চাইনি। বললাম, ‘মান-সম্মান বইলা কিছু আর থাকল না। কী করছেন কন তো ভাই! গল্প তো আমি নর্মালই লিখছি। এরম হইল ক্যামনে?’

শুনে তার ঠোঁটের চাঁদটা বড় হলো আরো। ‘সেটাই তো মজা রে ভাই! আপনি তো ইতিহাস হই গেলেন।’

‘মানে কী, ভাই। খুইলা বলেন প্লিজ। রহস্য নেওনের মতো অবস্থায় আমি নাই।’

শুনে তিনি হাসলেন বিকট। তারপর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘শোনেন, ব্যাপারটা হইছে কি, লেটেস্ট কনফিগারেশনের এক বন্ধু আছে আমার। নানারকম সফটওয়্যার-টফটওয়্যার বানায়। বড় বড় এমএনসি সব ওর অ্যাপ কিইন্যা ইউজ করতেছে। মঙ্গলের জন্য কী একটা যন্ত্র বানানোরও কন্ট্রাক্ট পাইছে। ক্যান, মাঝে বেশ লেখালেখি হইছিল তো এইটা নিয়া, মনে নাই?’

এমন একটা নিউজ মনে হয় পড়েছিলাম, হ্যাঁ। কিন্তু তার সঙ্গে আমার গল্পের কী সম্পর্ক?

‘তো হইছে কি, দারুণ একটা অ্যাপ খুঁইজা পাইছে অয়। বহু বছর আগে এইটা নাকি মানুষরাই বানাইছিল। তবে তার ব্যবহার হয় নাই খুব একটা। ফলে ভুইলাও গেছিল সবাই। তো অয় কইতেছে, কিছু ব্যাপার যোগ-বিয়োগ কইরা সেইটারে ও বাজারে আনবার চায়। আমারে কইছিল একটা ডেমো টেস্টের কথা। ইতিহাসে নাম লেখনের এমন সুযোগ তো বারবার আসে না। তিনজনের গল্প নিছিলাম, আপনারটাই ফিট খাইছে। আপনে তো মিয়া খেল দেখায়া দিলেন!’

আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। খালি হু-হু করে গেলাম। লোকটা খুব উদ্যম নিয়ে বলে যাচ্ছে। কথার তোড়ের সামনে সিমেন্ট-বালির ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখলেও যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, আমি তো কোন ছার।

‘গল্পটা ভালো লিখছেন আপনে। তবে এই ক্ষেত্রে আমি গল্পের চাইতে অ্যাপটারেই বেশি নম্বর দিব। শালার কী যে জিনিয়াস ছিল এই মানুষ জাতি একসময়! ঈর্ষা করতে মন চাইতেছে, জানেন? অথচ ধর্ম ধর্ম করতে করতে শেষ হয়া গেল। সাধেই কি সবাই ওদের হাফব্রেন … কয়া খেপায়! তা হাফব্রেন কন বা ফুল, এরাই তো বদলায়া দিছে পৃথিবী, নাকি? এই গল্পও একটা বদলের অংশ হয়া গেল।’

পৃথিবী বদলে গোল্লায় যাক, আমি ভাবছি, আমার লেখা বদলালো কে? মিনিট পাঁচেক বগরবগর শেষে তিনি সেটাই বললেন।

‘তো আইডিয়াটা হইতেছে, ইউজারগো অনলাইন হিস্ট্রি অ্যানালাইজ কইরা তার টেনডেন্সি অনুযায়ী কন্টেন্ট মডিফাই করা। অনলাইন মার্কেটাররা এইভাবেই সার্চ হিস্টরি ইউজ কইরা টার্গেট সেট করে। মানে আপনি রিসেন্টলি কী ব্রাউজ করতেছেন কী খুঁজতেছেন সেসবের ট্র্যাক ধইরা সে বিজ্ঞাপন দেয়। সোশ্যাল সাইটগুলাও সেইম কাজ করে। দেখবেন, যে বন্ধুর লগে বাতচিৎ হয়, ওয়ালে যাতায়াত নিয়মিত, কমেন্ট লাইক করেন, তার কাজের নোটিফিকেশনই বেশি আসে। ম্যাকানিজমটারে একটু অন্যভাবে কাজে লাগাইছে এই অ্যাপ। কোনো অসম্পূর্ণ লেখাও ওতে আপ করলে লেখকের রাইটিং হিস্টরি অ্যানালাইজ কইরা অ্যাপটা নিজ দায়িত্বে লেখাটারে কমপ্লিট কইরা দিবে।’

‘কিন্তু আমার লেখাটা তো সম্পূর্ণই দিছি। তারে আবার সম্পূর্ণ করতে হইল ক্যান? ভাই, সত্য কন তো, গণ্ডগোলটা হইছে কোথায়?’

‘গণ্ডগোল না ভাই, জিগান ক্যারিশমাটা হইল কোথায়। ক্যারিশমাটা হইল, আপনার অনলাইন পার্সোনালিটি আর লেখার স্টাইল ফলো কইরা আপনার স্টাইলেই সে ফিকশন লিখছে। গল্প আপনি পুরা দিছেন সত্য, কিন্তু আমি তো পুরাটা দিই নাই। দিছি মনে করেন সত্তর-পঁচাত্তর ভাগ, বাকিটা বলছি লেইখ্যা নিতে।’

‘ভাই, আমি শিওর, আমার সঙ্গে মজা করতেছেন আপনি।’

‘মজা যে আপনের সঙ্গে করি না তা না, কিন্তু আজ যা বলতেছি সব সত্য। আপনি বুঝতে পারতেছেন না, কী ঘটায়া ফেলছে এই অ্যাপটা। প্রকাশনার জগৎটাই বদলায়া যাইব, জানেন? সেটিংস আর চরিত্রগুলো সেট কইরা শুধু একটু সূত্র ধরায়া দিতে হইব, তারপর দেখবেন জাদু! টারমিনেশনের বহু বছর পরও জনপ্রিয় কোনো লেখকের ‘অপ্রকাশিত’ লেখা ছাপা হইতেছে দেইখা তখন টাসকি খায়া যাইয়েন না আবার!’

‘কিন্তু …’

‘কিন্তু-ফিন্তু কিছু না, ভাই। একটা এক্সপেরিমেন্ট করব এইটা তো আপনারে বইলাই নিছিলাম, নিই নাই?’

‘অবশ্যই নিছেন। তা নিয়া সমস্যাও নাই। তবে গল্পটা পুরা না ছাপলে পুরাটা আসলো কেমনে? আমি তো মাত্রই পড়লাম, হালকা কিছু অদলবদল ছাড়া আমার লেখাটাই ছাপছেন। তাছাড়া, আমি আসলে কনফিউজড। মানে এইরম তো শুনি নাই কোনোদিন।’

‘এমন কিছু তো ছিলই না, শুনবেন ক্যামনে। এখন শুনেন কী করছি। আপনের গল্পের সেটিংস, সংকট আর দ্বন্দ্বগুলো যখন প্রতিষ্ঠিত হয়া গেছে, মানে ওই যে কোনোভাবেই কনভিন্স করতে না পাইরা স্রষ্টাশেষে জোর কইরাই মিটিংয়ে বসাইছে সবাইরে, তারপর থেইকা গল্প নিজেই তো নিজেরে টাইনা নিবার পারে, পারে না? ওই পর্যন্ত আপ কইরাই আমরা অ্যাপরে বইল্যা দিছি গল্পটার যৌক্তিক এন্ডিং লেখতে।’

শুনতে শুনতেই একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। ফেসবুকে যারা পোস্ট দিচ্ছে, মানে ডিরেক্ট পাঠক, তারা সবাই লেখাটা পছন্দ করছে। কিন্তু ওই পোস্ট যারা পড়ছে তাদের অধিকাংশেরই বিরূপ মনোভাব। একটা পোস্টের নিচে তো দেখছি দুজনের মধ্যে তর্ক তুমুল। দুজনই ডিরেক্ট পাঠক, দুজনই তার পড়া এন্ডিংয়ের স্ক্রিনশট দিয়েছে। অবাক ব্যাপার হলো, দুটো স্ক্রিনশটের লেখা দুরকম! সম্পাদককে তাই থামাতেই হলো।

‘ভাই, ভাই, শোনেন, হয়তো আপনি খেয়াল করেন নাই, কিন্তু কোনো একটা ব্লান্ডার ঠিকই হইছে। নইলে আপনাদের অ্যাপ তো একটা গল্পের একটাই এন্ডিং লিখবে, নাকি?’

‘হ্যাঁ, তা-ই তো কইতেছি ভাই, আপনার স্টাইল ফলো …’

‘কিন্তু অনলাইনে দেখছি যুদ্ধ বাইধা যাইতেছে এর নানা রকম এন্ডিং আর বক্তব্য নিয়া।’

‘কী বলতেছেন?’

এবার মনে হয় সমস্যাটা ধরতে পারলেন তিনি। আমিও জোর পেলাম। তাড়া দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ ভাই, ঠিকই বলতেছি। আপনি একটু দেখেন ব্যাপারটা। প্লিজ, গর্দান যাওয়ার হাত থেইকা বাঁচান আমারে।’

ভীত গলায় ‘আচ্ছা দেখতেছি’ বললেন সম্পাদক।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অথচ আলো জ্বলেনি এখনো। নাকি আজ চার্জ নেওয়া হয়নি বলে আমিই আঁধার দেখছি চোখে? বুঝতে পারছি পাওয়ার কম, তবু নিতে ইচ্ছে করছে না। অন্ধকারেই হেঁটে বেড়াচ্ছি ঘরময়। অস্থির লাগছে খুব। অলরেডি দেখলাম ডেথপোল চালু হয়ে গেছে আমার নামে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে জানি না, কাঁপছি খুব। আর পায়চারি করছি অস্থির। অস্থিরতাটা আরো বাড়িয়ে দিলো সম্পাদক।

‘ভাই, সমস্যা আসলেই হইছে।’

‘কী সমস্যা, ভাই? আচ্ছা, সমস্যার কথা পরে শুনবোনে, সমাধান কন আগে।’

‘সমাধানের কথা তো মাথায় আসতেছে না। ঝামেলাটা আমার বন্ধুই পাকাইছে। লেখকের প্রোফাইল দেইখা লেখা সম্পন্ন করার অ্যাপটায় একটা ত্রুটি ধরা পড়ছিল। বহু আগের তো, এখনকার সিস্টেমে খাপ খাইতেছিল না। অয় তাই গল্পটা আপ দিছিল আরেকটা অ্যাপ দিয়া। এইটা আবার অরই বানানো, কাজ মোটামুটি আগেরটার মতোই। তয় রাইটার না, এইটা লেখার সমাপ্তি টানবে হোস্ট আইপির প্রোফাইল ফলো কইরা। মানে রিডারগো রিসেন্ট লেখালেখি, কমেন্ট হিস্টরিসহ অনলাইন অ্যাক্টিভিটির লিগেসি দেইখা আরকি।’

‘কিন্তু আমি যখন পড়লাম, গল্পটা তো প্রায় আমার লেখার মতোই মনে হইলো।’

‘তা তো হইবোই। আপনার আইপি থেইকা পড়ছেন, তাই আপনের মতো হইছে। পাঠক পড়ব তাগোর আইপি থেইকা …’

‘তার মানে গল্পটার কোনো নির্দিষ্ট এন্ডিং হয় নাই?’

‘না, হয় নাই। আপনি পড়বেন আপনার মতো, আমি পড়ব আমার মতো। সোজা কথায় ‘যার মনে যা, ফাল দি ওঠে তা’।’

‘কিন্তু ভাই, এইটা একটা কনফ্লিক্টিং ব্যাপার হই গেল না? মানে সব পাঠকের কাছে তো একই গল্প গেল না।’

‘এমনিতেও কোনো গল্প সব পাঠকের কাছে একই আবেদন নিয়া যায় না। একই কচু আদা আলু নিয়া আপনেরা যেমন ভিন্ন গল্প লেখেন, পাঠকেরাও তা থেইকা নিজের নিজের মতো ভাব-ভাপ নেয়। একটু আগ বাড়ায়া সেই কাজই করতেছে অ্যাপটা।’

এবং সেটা আমার বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট। মনে হলো লেখাটা সরিয়ে নিতে বলি, বা কিছু একটা করতে যাতে করে ওটা আর না ছড়ায়। কিন্তু কী একটা হট্টগোলের শব্দ শুনেই সম্পাদক ছিটকে গেলেন আমার থেকে। আরেকবার কল দিতে গিয়ে শুনি আমার বাসার নিচেও হইচই। হইহই করে গেট ভেঙে ফেলল নিম্নবুদ্ধির হিংস্র কজন রোবট, সঙ্গে কটা মানুষ। সব কটাকেই আমার কাছে প্যাথেটিক মনে হচ্ছে, গড়পড়তা মানুষের মতোই। বুদ্ধিশুদ্ধি নেই,  হুজুগে লাফানো জন্তু সব। বিরক্ত লাগছে, একটু যেন ভয়-ভয়ও করছে। এবং ভয়ের কারণেই কি না জানি না, চাকরটার অভাব বোধ করছি। ও থাকলে ঠিকই একটা উপায় বের করে ফেলত এতক্ষণে। কিংবা এমনও হতে পারে, ও পাশে নেই বলেই হয়তো এত অনিরাপদ লাগছে আমার। মনে হচ্ছে, চারপাশ থেকে জড়িয়ে ধরছে কালো কালো ছায়া। ফালি ফালি করে কাটা যাবে এমন পুডিংয়ের মতো আঁধারে মিশে আছি। ঠিকমতো ভাসতে পারিনি কোনোদিনই, তবু ডুবে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে।