অমৃতকথা

আমাদের বাড়ির ছাদের থেকে বোসবাড়ির ছাদটা এখনো দেখা যায়। চিলেকোঠার দেয়ালে সেই লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। জংপড়া, ঝরঝরে। উঠে গেছে একেবারে চিলছাদে। তার ওপরে তো আর কিছু নেই। কেবল আকাশ। ওই সিঁড়িতে নিধু বসে থাকে। সকালে, বিকেলে। সূর্য ডুবে গেলে মাঝে মাঝে চিলছাদে ওঠে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। গোধূলির রং মাখে। তারপর অন্ধকার …    

পাড়াতে নিধুদের বাড়িটা সবচেয়ে পুরনো। বিশাল দালান। ছয় শরিকে ভাগ হতে হতে এখন নানান খুপরি। যে যার মতো আড়াল তুলে নিয়েছে। নিধুদের ভাগে দোতলায় তিনটে ঘর।   একেবারে পশ্চিমে। একটাতে কাকারা, মাঝেরটা ঠাম্মির। মুড়োর ঘরটাতে বাবা ও নিধু। ওর মা  মারা গেছে বছর দুয়েক হলো। সেপটিসেমিয়ায়। পায়ে একটা ঘা হয়েছিল, সেখান থেকে শুরু। যেদিন মারা গেল মা, সেদিন ওদের বাড়ির কমন নেড়িকুত্তাটাও মারা গেছে। ঠাম্মি বলেছিল – ‘দোষ কাটল।’ নিধু খুব কষ্ট পেয়েছে। 

মায়ের মৃতদেহের সঙ্গে বাবা শ্মশানে যায়নি। এই অভিমানে সত্যব্রতের সঙ্গে কথা বলা ছেড়েছে নিধু। অথচ একই ঘরে থাকে দুজনে। রাতে নিধু খাটে শোয়, বাবা মেঝেতে। সারাদিনে কেউ কারুরই খবর রাখে না। কথা হলো লকডাউনে। ‘ভিকিরিরও একটা স্ট্যাটাস আছে।’  ‘স্ট্যাটাস!’ আচমকা মুখ ফসকে ছিল নিধু।   

উত্তরটা শুনেও শোনেনি সত্যব্রত। ইদানীং তার অসংলগ্নতার মাত্রা বেড়েছে। বাইপোলার এফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট। অনেকদিন হয়ে গেল ওষুধ নেই। রাগ তীব্র, বিষাদ তীব্র,  খিদেও তীব্র। যখন খাবে, একা এক হাঁড়ি ভাত সেঁটে দেয়। ঠাম্মি হাঁড়ি দেখিয়ে বলে, ‘আর নেই।’ সমস্যাটা এইখানে। আজ তিনদিন রাতের খাবার পায় না বাবা। এতদিন ঠাম্মির কাছ থেকে সব ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছিল। নিধুর কাকা – নিত্যব্রত – প্রতি রাতে ঠাম্মিকে তিনটে করে রুটি আর তরকারি জোগাত। তিনখানা থেকে দুখানা রুটি ঠাম্মি বাবাকে দিয়ে দিত। গোপনে। নিজের জন্য রাখত একখানা। দিন পনেরো হতে চলেছে ঠাম্মির জন্য দুটো রুটি আসছে। যে একখানা রুটি ঠাম্মি রাখত, সেটা পাত্রেই পড়ে থাকে। রাতের বেলা সেখানে বিড়ালের উৎপাত চলছিল। খাওয়ার ক্ষমতাটাই হারিয়েছে ঠাম্মি। তিনদিন হলো নড়াচড়া বন্ধ। বাথরুমে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙেছে। সেই থেকে বিছানা। সন্ধের পর রাত নটা অবধি ‘নিত্য নিত্য’ ডাক আসে ঠাম্মির ঘর থেকে। খাবার দেওয়ার পর ‘সত্য সত্য’। তারপর রাত যত বাড়বে, ততই এক কাতরানির শব্দ। শব্দটা মাঝের ঘর থেকে বেরিয়ে দেয়ালে ঠোক্কর খেতে খেতে দালানের এ-কোণ ও-কোণে ঘোরে। বিড়াল কটাও থুম মেরে যায়।   

অনেকবার শুনেছে নিধু, ঠাম্মির কাছে মহামূল্যবান কী যেন আছে। পুরনো রুপোর কয়েন, গোপন দলিল, চুনি-হিরের জড়োয়া সেট … এরকমই কিছু একটা। ঠাম্মির ঘরে লোহার সিন্দুকও আছে। এ-বাড়ির একমাত্র সিন্দুক। ন-দাদুর ভাগে পড়েছিল। নিতে রাজি হয়নি বলে এ-ঘরেই রয়ে গেছে। চাবিটা থাকে ঠাম্মির মাথার বালিশের তলায়। সত্য আর নিত্য দুজন দুজনকে এটা নিয়ে প্রবল সন্দেহ করে। দুজন দুজনকেই নজরে রাখে। বহুবার দেখেছে নিধু, রাতে বাবা ঘরের সামনে বসে আছে। ঠাম্মির ঘরের দিকে মুখ। পাশের দেয়ালে ঠেস দেওয়া দরোজার ডাসা। নিত্যব্রত যেন মায়ের ঘরে না ঢোকে। পাহারা দিতে দিতে বাবা ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে কতদিন! … ‘তা ভিখিরি কেন হবে!’ কী ভেবে নিধু কথা চালে, ‘রাজরানির ছেলে আবার ভিখিরি!’    

‘কী – কার ছেলে? …’

ঘরটা গমগম করে উঠল বাবার বিকট হাসিতে। সে-হাসির রেশ থামতেই নিধু হতভম্ব। সত্যব্রত কখন যেন উঠে এসেছে নিধুর বিছানায়, অন্ধকারে। ‘এ নিধু বল না, সিন্দুকে কী আছে? নিধু, এ নিধু, নিধু …’   

দু-হাতে ছেলেকে ঝাঁকাচ্ছিল সতুদা। ঝাঁকি খেতে খেতে নিধু শুকিয়ে কাঠ – ‘জা … জা … জানি না।’    

‘কেন জানিস না, বল … বল … বল …’ 

নিধুর মৃত্যু তখন কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। মরিয়ার মতো বাবার বুকে এক লাথি মারে সে। খাট থেকে পড়ে গেছিল সতুদা। অনেকক্ষণ কোনো সাড়া নেই। নিধু উঠে অন্ধকার হাতড়ে লাইটের সুইচ টিপল। মেঝেতে তখনো পড়ে আছে বাবা। সোজা করে দেখল, সত্যব্রত হাঁপাচ্ছে। ঠোঁট ফেটে বোস বাড়ির রক্ত।

চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলো নিধু। রক্ত তবু থামেনি। নিচু হয়ে নিধু বাবার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। রক্ত চেটে নেয়। … সত্যব্রতের ফাটা ঠোঁট ঈষৎ টানটান হলো … ‘খেয়েছিস?’ 

‘হু।’

‘কী খেলি রে?’ 

একটু চুপ থেকে নিধু বলে, ‘অমৃত।’ 

‘অমর হয়ে থাক।’ নিধুর মাথায় হাতখানা বুলিয়ে আনে সত্যব্রত। তার চোখের দু-কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল – ‘আমাকে খাওয়ালি না তো!’  

ঘাড় পিঠ ধরে বাবাকে বসাল নিধু। হাতের চেটোয় চোখমুখের জল মুছিয়ে দেয়। বলে, ‘যাবে আমার সঙ্গে?’

‘কোথায়?’

‘বাইরে। এ নরকে অমৃত নেই তো।’ 

‘খাওয়াবি – খাওয়াবি তুই?’ ছেলের চোখে সত্যব্রত তাকায়। চোখের তারা দুটো দূর আকাশের তারার মতো – ‘কিন্তু যাব যে, ওই ঘরের সিন্দুকটা যদি …’

দুই

পাড়ার মোড়ে এসে থমকে দাঁড়াল সতুদা। এদিক-ওদিক তাকাল। আকাশে কালো ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। গুমোট গরম। সুনসান রাস্তা। দোকানপাট বন্ধ। যেন পরিত্যক্ত জনপদ।

কোথাও কি ট্রাম্পেটের আওয়াজ? যুদ্ধ চলছে তো – বিশ^যুদ্ধ! শত্রু অদৃশ্য। … নিজের মনে বিড়বিড় করছিল সত্যব্রত।

‘কী হলো?’ নিধু পিছিয়ে আসে, ‘দাঁড়ালে যে!’ 

‘নিধু, আমি যাব না।’

‘কী?’ … বাবার পরে  রাগ হয় নিধুর। অসুখটা এমনি বাঁধেনি। অবুঝ বাহানাগুনি কোনোদিন ছাড়ল না। ওই বাহানার জন্যই সব শেষ। না হলে মেজো তরফের ভাগে কিছু কম ছিল না। আটাত্তর রুটে বাস, আর পেরেক কারখানাটা – বোসেস নেইলস ফ্যাক্টরি। দুই ভাইয়ের বনিবনার অভাবে বিক্রি হয়ে গেল। ছিল কুকুরের ব্যবসাটা। ওটা বাবার নিজস্ব। সেটাও শেষ। ল্যাব্রাডর, স্প্যানিয়েলের বাইরে যায়নি সতুদা। জাঁদরেল হিংস্র ওয়ানপেট বিরোধী সে। সাতটা স্প্যানিয়েল, পাঁচটা ল্যাব্রাডর ছিল। তাদের খাওয়ানো-পরানো, পটি করানো, রাখার জায়গা-টায়গা মিলে  একেবারে নাজেহাল। শেষে রাখল একটা ল্যাব। মনের শখ। কুকুরটা একদিন কাকার ঘরে ঢুকে কাকার মেয়ে অতসীর ব্যবহৃত ন্যাপকিন মুখে করে নিয়ে এলো। তাই নিয়ে এঘর-ওঘর-সেঘর … গোটা বাড়ি নোংরা করে তুলকালাম কাণ্ড। অতিষ্ঠ হয়ে ল্যাবটাকে দান করে দিলো খুসিমাসির মেয়েকে। সেইদিন – সেইদিনই বোঝা গেল বাবার অসুখটা। এই কাঁদে, তো এই হাসে – এই চিৎকার। ছোড়দাদুর ছেলে সোনা জেঠু বাবাকে নিয়ে তার ঘরে বসিয়েছিল। দুটো গ্লাসে তরল সোনা ঢেলে বলল, ‘তোর জ্বালা বুঝি রে সতু। নে, সুধা রস – ঠিক হয়ে যাবি।’ 

ঠিক আর হলো কই! উত্তরোত্তর বাবা খারাপের দিকেই। চিকিৎসা হলো স্থানীয় সাইক্রিয়াটিস্ট দিয়ে। তারপর দু-মাস এসাইলাম। … ‘বুঝেছি’, নিধু রুক্ষ, ‘আবার নিয়ে যেতে হবে তোমাকে।’

‘কোথায় রে?’ 

‘অন্তরা – গোবিন্দপুরে। ওটাই তোমার ঠিকানা।’ নিধু দুবার গেছিল ওই মেন্টাল হসপিটালে। বাবাকে দেখতে। তখন মা বেঁচে। ব্যবস্থাপনা ভালোই। বাবাও সুস্থ হয়ে ফিরল। চিকিৎসা খরচ সামান্য। কিন্তু কোথায় এখন পাওয়া যাবে! এসময় ঠাম্মি গুপ্তধনটা বার করতে পারে না? বাবা তো তার ছেলে। মা বেঁচে থাকতে সন্তান যদি … ‘যাগ্গে, চলো – বাড়িতে।’

সত্যব্রতের মুখ ব্যাজার। নিধুর হাতখানা খপ করে ধরল – ‘ও নিধু, কথা দে – আমাকে এসাইলামে রাখবি না। কথা দে – বল?’ 

হাত ছাড়িয়ে নিধু পিছনে ঘোরে। কয়েক পা দূরেই বাড়ি। বোসবাড়ির সেই পেল্লাই গেটখানা এখন আর নেই। অতীত অস্তিত্ব নিয়ে ভাঙা থাম দুটো আছে। বাঁদিকের থামে একটা অশ^ত্থ চারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ওইখানে এসে নিধু দাঁড়ায়। পিছু পিছু সতুদাও। হাতের তর্জনী দেখিয়ে নিধু বলল, ‘চলে যাও ভেতরে। আর কোনোদিন আমার সঙ্গে বেরুবে না।’

স্থির দাঁড়িয়ে থাকে সতুদা – ‘ফিরে যেতে বলছিস?’

‘হ্যাঁ, বলছি।’ নিধুর গলা একটু যেন কাঁপল, ‘শোনো, তুমি আর বাঁচবে না।’ 

সত্যব্রত ফ্যালফ্যাল করে ছেলেকে দেখল – ‘কেমন করে বাঁচতে হয় রে নিধু?’

‘জানি না।’ বলেই মুখ ফেরায় নিধু। রাস্তার দিকে হেঁটে চলে। সতুদা ছুটে গিয়ে নিধুকে ধরল – ‘তুই যে বললি আজ খাওয়াবি – সেই অমৃত!’ 

‘না, যাও। ঠাম্মির কাছে যাও।’ 

‘না রে, আমি তোর সঙ্গে যাব।’ ছেলেমানুষের মতো বায়না ধরে সতুদা, ‘চল না, এ নিধু!’ 

এই বাবার সঙ্গে ঘরে স্ট্যান্ডফ্রেমের ছবিটা আর মেলে না। মাঝে মাঝে ছবিটা চোখে পড়ে। মা-বাবার মাঝখানে ছোট্ট নিধু। অন্য কোনো জন্মে তুলেছিল কেউ। …

বাবার মুখে তাকাল সে। নিরীক্ষণ করল কয়েক মুহূর্ত। দীর্ঘদিনের না-কাটা দাড়ি। চোখের নিচে কালচে ছোপ। মুখখানা ইটচাপা ঘাসের মতো। … ওই ছবিটাই বরং জীবন্ত, এই বাবা নয়। ‘ঠিক আছে – চলো। কিন্তু …’ 

আনমনা নিধু। একটা দীর্ঘশ^াস চাপে।   

                                                তিন

ওরা দুজন আমিনা গলিতে হাঁটছিল। আকাশে ধোঁয়া মেঘ তখন জমাট। হাঁটতে হাঁটতে কখন ছেলের হাতটা ধরেছে সত্যব্রত। কী এক অনুভব খেলে যায় নিধুর ভেতরে। হয়তো কোনো অনুষঙ্গ। বাবার হাতখানা ছাড়ায়নি সে। ওর হাতে আলতো চাপ দেয় সতুদা – ‘আর কদ্দূর রে?’

নিধু নিরুত্তর। ভাবছিল। মায়ের মৃত্যুর পর সংসারটা কেমন তছনছ। বাবার মনও। শরীরের আর দোষ কী! শরীর-মন নিয়ে বাবা সেঁদিয়ে গেছে কবে! লকডাউনে কথা বলতে চায়ছিল। প্রতিরাতেই। আগ্রহ দেখায়নি নিধু। সতুদা বলে, ‘ও নিধু, আর হাঁটতে পারি না। কদ্দূর?’  

‘কেন, ভালো লাগছে না?’

নির্বোধের মতো তাকায় সতুদা।

‘কতদিন তো বাইরে আসোনি! চিনতে পারো সব?’

সত্যব্রতের অচেনা নয়। নিজের পাড়া। এখনো সেই একরকম। কলকাতার হা-মুখের নাগালে। তবু তার লকলকে জিব এখানটা পুরোপুরি চাটেনি। অ্যান্টিক ইমেজের বাড়ি, বিহারিদের পুরনো বসত, আবার হঠাৎ দুয়েকটা ফ্ল্যাট। এসবের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে একেকটা গলি। শতাব্দীপ্রাচীন। গলির মাথাগুলি সব গঙ্গার ঘাটে। ওইদিকে তেজপাতা গলি। নাম এখন এস কে ব্যানার্জি লেন। একসময় অনেক তেজপাতা গাছ ছিল এদিকে। ওই গলিটাই এখন নিধুকে টানে। প্রতিদিন। যেন অমোঘ এক টান। দুপুর হলেই টনক নড়ে তার। সমস্ত শরীর ছটফটিয়ে ওঠে। বেরিয়ে পড়ে সে। লেন ধরে শর্টকাটে রাশখোলা ঘাট। ঘাটের পাশেই রাধামাধবের মন্দির – দুশো বছরের পুরনো। এখানেই নিধুর প্রাণের আনন্দ, মনের তৃপ্তি আত্মার শান্তি। … 

লকডাউন আর ঠাম্মির বিছানা নেওয়া – একই সঙ্গে। নিধুরও হতদ্দশার শুরু। প্রথমদিনটা ছাদে কেটেছে। যেন বাড়ির পুজোয় নবমীর উপোস। পরদিন আর সহ্য করতে পারেনি। ধুঁকতে ধুঁকতে রাশখোলা ঘাটে এসেছিল। সিঁড়িতে বসেছিল অনেকক্ষণ। নিজের সঙ্গে  জীবনের বোঝাপড়াটা সারে সে। এজন্মের পৃথিবীটা টুব করে সরিয়ে দেবে চোখ থেকে। তারপর কী ভেবে শেষবারের মতো মন্দিরে ঢুকেছিল। তখনই আবিষ্কার করে সবকিছু। 

নিধু বলল, ‘দেখেছো?’

সামনে তাকায় সত্যব্রত। সাঁওতাল যুবতীর মতো গঙ্গা। দু-কূলের জল যেন কোনো মহাঅনিশ্চয়তার দিকে ছুটছে। হাত ছাড়িয়ে সতুদা ঘাটে নেমে যাচ্ছিল। বাবার হাতখানা শক্ত করে ধরল নিধু। গত সপ্তাহে একটা মড়া এসে বেঁধে ছিল এই ঘাটে। নাকি করোনার লাশ। সতুদা বলে, ‘আমি মল্লে তো এখানেই আনবি, বল?’

উত্তর করেনি নিধু। কদিন দুপুরে সতুদা চিৎকার করেছে ঘরের মধ্যে – ‘যন্তন্না, নিধু রে …।’ আশপাশে অনেকে শুনেছে সে চিৎকার। শোনেনি নিধু।

বাবা-ঠাম্মি-বোসবাড়ির ত্রিসীমা ছাড়িয়ে সে তখন অনেক দূরে – এই রাধামাধবের মন্দিরে। …  

 ‘নিধু’, কাছে ঘেঁষে এলো সতুদা, ‘আমি বোধহয় বাঁচব না। ব্যথা করছে, দ্যাখ – এখানটা।’ নিজের পেটখানা হাত দিয়ে দেখায় সত্যব্রত – ‘হেঁটে এলাম … এই হাঙরটা জেগে উঠেছে – সব অন্ধকার দেখি। নিধু রে -’ 

চোখ ফেটে জল এসেছিল নিধুর। বাবার যে হাতখানা ধরা, সে হাতখানা কাঁপছে। টের পেল, শরীরটাও ঠকঠক করছে। ‘না না, বাঁচবে তুমি। বাঁচতেই হবে। এসো।’

বাবাকে নিয়ে নিধু মন্দিরে ঢোকে। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা প্রশস্ত চত্বর। গর্ভগৃহের সামনে উঠোনটা বাঁধানো। অনাথ আর ভিখিরিদের ভিড় সেখানে। উঠোনের দুধারে লম্বা সারিতে বসেছে অনেকে। বাবার কানের কাছে নিধু ফিসফিস করে – ‘কী, গন্ধ পাচ্ছো? শ্বাস নাও – আহ্, অমৃত!’ 

সত্যব্রতের হাত ছেড়ে নিধু লম্বা শ^াস টানে। রান্নার ঘ্রাণে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তার। চোখ দুটো বুজে এলো। … মন্দিরের এই লঙ্গরখানা লকডাউনেই চালু। ব্যবস্থাপনায় এক এনজিও। দুপুর আর রাতে দরিদ্রনারায়ণ সেবা। দূর দূর থেকেও আসছে অনেকে। নিধুর আর তর সইছিল না – ‘চলো, লাইনে বসবে – এখুনি শুরু হয়ে যাবে।’  

সহসা দমকা হাওয়া। সতুদা সজোরে এক ধাক্কা মারল ছেলেকে। আচমকা ‘আঁক’ করে ছিটকে পড়ে নিধু। সত্যব্রত চিৎকার করে ওঠে – ‘কী ভাবিস তুই আমাকে? কুলাঙ্গার

কোথাকার, দূর হ – তুই আমার কেউ না, কেউ না …’

গেট দিয়ে দপদপিয়ে বেরিয়ে আসে সতুদা। আর ঝেপে বৃষ্টি নামল। সেইসঙ্গে গঙ্গার ঝোড়ো হাওয়া। হাওয়ার ঝাপট আর বৃষ্টির তোড়ে ছেয়ে গেল চারদিক। দেখতে দেখতে পথঘাট ঝাপসা। তার মধ্যেই সতুদা ঊর্ধ্বশ^াসে হেঁটে চলল। 

নিধুও বাবার পিছু পিছু – ‘কোথায় যাচ্ছ … ও … ও, বাবা … আ … আ?’  নিধুর হাঁক শুনছে না সতুদা। কোনোদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। ভিজতে ভিজতে সপসপিয়ে হাঁটছে সে। আমিনা গলির জেলেপাড়া ছাড়াল। হিজড়েপট্টিও ছাড়ায়। নিধু আর কিছুতেই নাগাল পাচ্ছে না। বৃষ্টির ছাঁটের ভেতর আবছা অশরীরীর মতো দেখাচ্ছে বাবাকে। অশরীরী হাঁটছে। ‘যেও না … আ’, গলা ছেড়ে ডাকে নিধু, ‘দাঁড়াও – বাবা … আ, খেতে হবে … খেয়ে যা-ও-ও …’    

পাড়ার মোড় থেকে দ্রুত বাড়িতে ঢুকে যায় সত্যব্রত। সারা শরীর দিয়ে জল ঝরছে।  একেবারে কাকভেজা। হাঁপাতে হাঁপাতে দোতলার পশ্চিমে উঠে গেল সে। সোজা মায়ের ঘরের সামনে। ভেজানো দরজাটা দড়াম করে খুলল।

মা শুয়ে আছে খাটে। মাথার বালিশ উঁচু করে সেই চাবির গোছা বার করে সতুদা। ছোঁ মেরে। হাত-পা কাঁপছে তার। ঘনঘন নিশ্বাস। তাড়াতাড়ি সিন্দুকের সামনে দাঁড়াল। ডালাটা খুলল। সিন্দুকের ভেতর আঁতিপাঁতি করে হাতড়াল। অনেকক্ষণ। তারপর চেঁচিয়ে বলে, ‘কিছু নেই? মা, ও মা?’  

বলতে বলতে মায়ের বিছানার কাছে এলো সতুদা – ‘সিন্দুকে কিছু নেই? মা – ও মা, সিন্দুকে …।’ মায়ের দুই ডানা ধরে তুলতে গিয়ে থামে। হাত দুটোতে সাড় নেই! নিচু হয়ে মায়ের বুকে কান পাতল। কয়েক মুহূর্ত চুপ। তারপর মায়ের মুখখানা দু-হাতে ধরে আকুল সত্যব্রত – ‘মা নেই … মা নেই … মাগো …!’ 

নিধুও এসেছে তখন। ছেলেকে দেখে ডুকরে ওঠে সতুদা, ‘মা উধাও … চলে গেছে মা … ও  নিধু …’

ঘরে ঢোকে নিধু। বিছানার সামনে দাঁড়ায়। ঠাম্মির মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে স্থির। সত্যব্রত হঠাৎ হাসতে শুরু করে – ‘ফাঁকিবাজি রে … আমার সঙ্গে ফাঁকিবাজি … সব বুজরুকি …।’ ইতোমধ্যে  নিত্যব্রতরা এসেছে। সতুদার সে অট্টহাসি আর থামে না। নিধু ধমক দেয় – ‘চুপ করো। চুপ।’    

এঘর-ওঘর থেকে কেউ কেউ জড়ো হলো দোতলার পশ্চিমে। তারপর একে একে গোটা বোসবাড়ি, বোসবাড়ি ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে পৌঁছে গেল মৃত্যুর খবর।    

                                                চার

পরদিন রাশখোলা ঘাটে পাডোবা সিঁড়িতে দাঁড়ায় সত্যব্রত। ভাটার টান তখন গঙ্গায়। হবিষ্যির পোড়া মালসাটা জলে ভাসিয়ে দিলো। অনেকক্ষণ ওই মালসার দিকে তাকিয়ে থাকে।  কয়েক ধাপ ওপরে নিধু দাঁড়িয়ে। ছেলের কাছে এলো সতুদা। নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে, ‘অ্যাসাইলামে এখন যেতে হবে না রে। চ।’ 

ঘাট ছেড়ে দুজন উঠে আসে। উঠতেই রাধামাধবের মন্দির। ছেলের হাতখানা টেনে ধরল সত্যব্রত – ‘ও নিধু, মা-বাবা নেই যার, সে অনাথ। তোর বাবাও তো নেই। এবার আমরা দুজন এখানেই খেতে আসব রে – হ্যাঁ – অমৃত!’