অস্তিত্বের আখ্যান

জাহিদ মুস্তাফা

শিল্পীর চোখ থাকে সুদূরে। তিনি সামনে তাকান, পেছনেও থাকে তাঁর দৃষ্টি। এ-দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, চোখ যেন চলে যায় মাটি খুঁড়ে প্রত্নের ভেতরে। তিনি খোঁজেন সমৃদ্ধ অতীত, কালের সাক্ষীসাবুদ। আপন অস্তিত্বকেই যেন খুঁজে পান পুরনোয়। তার সঙ্গে চলমান জীবনের তুলনামূলক বৈপরীত্যে শিল্পীমন নিজের সৃজনের একটা জায়গা আবিষ্কার করে নেন। প্রবহমান নদীর মতো মানুষের জীবন – ভাঙা-গড়া, অদল-বদলে ভরা। শিল্পীরা সে-পরিবর্তন আগে টের পান।

শিল্পী রেজা আসাদ আল হুদা অনুপম তাঁর দেখা নিসর্গ আর চারপাশের পরিবেশকে চিত্রপটে তুলে আনেন রূপে ও রূপান্তরের আলো-আঁধারে। বহমান সময়ের ছাপ, সন্তাপ, আবেগ-অনুভূতি প্রভৃতি নিয়ে তিনি ছবি আঁকেন কালের সাক্ষী হয়ে। শ্যাওলাজমাট নোনা ধরা দেয়াল, দীর্ঘদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ছাদে বা কার্নিশে যে-রূপটি তৈরি হয়, সেটির প্রায় কাছাকাছি অবয়বের দেখা মিলবে শিল্পী রেজা আসাদ আল হুদা অনুপমের চিত্রপটে।

তাঁর প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী হলো ঢাকার ধানমণ্ডতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। ‘অস্তিত্বের আখ্যান’ শিরোনামে এই প্রদর্শনী ২২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার শুরু হয়ে চলেছে ৬ অক্টোবর ২০১৭ শুক্রবার পর্যন্ত। এতে শিল্পীর আঁকা প্রায় অর্ধশত চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে।

এই শিল্পী ছবি আঁকেন প্রকাশবাদী বিমূর্ত ধরনে। আমাদের সমকালীন শিল্পীদের বড় একটি অংশ এই পথেই নিজেদের সৃজন-প্রক্রিয়া নিয়ে এগোচ্ছেন। অনুপম নিয়মিত আঁকেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু চারুকলা প্রদর্শনীতে তাঁর নিয়মিত অংশগ্রহণ আছে। তবে একক প্রদর্শনীর আয়োজন এবারই প্রথম। পেশাগত জীবনে শিল্পী রেজা আসাদ আল হুদা অনুপম বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ১৯৭৩ সালে কুষ্টিয়ায় তাঁর জন্ম। তৎকালীন চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৯৪ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ও ১৯৯৬ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এবং একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

এই প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো – শিল্পী তাঁর সৃজন অভিজ্ঞতার ভেতরে নিজের মননশীল অস্তিত্বকে অনুভব করতে চেয়েছেন বলেই এর এমন শিরোনাম দিয়েছেন। চিত্রপটের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্কটা হতে হয় প্রেমের, সেটি যেন কাছে টানে শিল্পীকে। তাতে সৃজন-প্রক্রিয়ায় আবেগ আসে এবং সৃজন যথাযথ ফুটে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ে। একসঙ্গে অনেকগুলো ক্যানভাসের ভেতরে একজন সৃজনশিল্পীর কাজ, বর্ণপ্রয়োগ, রেখার প্রয়োগ ও তুলি চালনার বিষয়কে উপস্থাপনার কলাকৌশলের মধ্য দিয়ে শিল্পী যেন নিজেকেই নানাভাবে আবিষ্কার করেন। শিল্পী অনুপমের চিত্রকর্মগুলো এমন সম্ভাবনা নিয়েই এগিয়েছে এবং দর্শকদের মুগ্ধতা দিয়েছে।

এবার আসা যাক তাঁর চিত্রসম্ভারের কয়েকটির বিশ্লেষণে। লম্বাটে ক্যানভাসে লিরিক্যাল ইমেজ নামে এক সিরিজে শিল্পী নিজের মনোভাবনার কাব্যিক অনুভূতিকে রং ও রেখার আবর্তে নিসর্গের ছন্দিত রূপের আবহে তুলে ধরেছেন। ‘লিরিক্যাল ইমেজ-১’ শিরোনামের চিত্রকর্মটির ক্যানভাসের কেন্দ্রস্থলে লালচে ও হলুদ বর্ণের সাদর উষ্ণতা, ওপরে-নিচে সাদা ও ছাই রঙের ওপর কালোর ছোপ ছোপ প্রলেপ। সব মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দন ও মনোগ্রাহী একটা রূপ নিয়েছে।

শিল্পীর আঁকা অন্যান্য সিরিজ চিত্রকর্মের শিরোনাম হলো – বর্ণনাধর্মী দেয়াল, ভূ-দৃশ্য, চাঁদের ভূমি, অস্তিত্ব, অস্তিত্বের কাব্য ইত্যাদি। স্বতন্ত্র কয়েকটি চিত্রকর্মের শিরোনাম হলো – অস্তিত্বের সুর, অস্তিত্বের গভীর আভিজাত্য ও অস্তিত্বের আখ্যান।

বর্ণনাধর্মী দেয়াল সিরিজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় বর্ষীয়ান কৃতী চিত্রকর মুর্তজা বশীরের গত শতকের ষাটের দশকে আঁকা দেয়াল সিরিজের কথা। সেটি ছিল সে-সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকেন্দ্রিক। অনুপমের দেয়ালও কালের সাক্ষী, তবে তা দেয়ালের পলেস্তারা খসে যাওয়া রূপের চেয়ে শ্যাওলা-ধরা, নোনা রূপটাই প্রধান হয়ে এসেছে। এর ওপর রং ঢেলে ছিটিয়ে দীর্ঘ সময় বয়ে যাওয়ার একটা ক্ষয়প্রাপ্ত অবয়ব তুলে ধরেছেন শিল্পী। অনেকটা এ-ধরনেই আঁকেন বাংলাদেশের শক্তিমান শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস। দেয়াল যেমন আত্মরক্ষার, তেমনি বিভাজনেরও। সে হোক ইট-পাথর-মাটি কিংবা মনের। এই দেয়াল আবার কালের সাক্ষী, তার পরতে পরতে আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার আবেগ জড়ানো। প্রকৃতির পরিবর্তন দেয়ালের গায়। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-বাদল সবকিছুর ছোঁয়া তাতে। এখানে যেমন পুরনো পরত বিদ্যমান, নিত্যনতুন কিছু ইফেক্টও মেলে। অনুপমের দেয়াল সিরিজে এসবের বৈচিত্র্যময় প্রয়োগ দেখা যায়।

তাঁর চিত্রপটে প্রাচীন পানামনগরী, লালবাগের কেল্লা, প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপনার নিদর্শন ময়নামতি আর মহাস্থানগড়ের দেয়ালের দীর্ঘকালের রূপ, শিল্পীর জন্মস্থান কুষ্টিয়ার নদী, সরষেক্ষেতের বর্ণিলতা প্রভৃতি চিত্রিত হয়েছে।

তাঁর আঁকা ভূ-দৃশ্যগুলো যেন সান্ধ্য অন্ধকার কিংবা ভোরের আলো ফুটে ওঠার সময়কে তুলে ধরে। স্পষ্টতার চেয়ে অস্পষ্টতার দিকেই শিল্পী তাঁর মনোযোগ দিয়েছেন। এই স্পষ্ট আর অস্পষ্টতার দ্বন্দ্বে প্রাণবান হয়ে উঠেছে শিল্পী রেজা আসাদ আল হুদা অনুপমের চিত্রকর্মগুলো। r