অ্যামেলিয়া

তিলোত্তমা মজুমদার

॥ ১৯ ॥

শবনম বিদায় নেবার পর মোলি খুব ভালো করে গরম জলে স্নান করল, তারপর বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। সোজা পুবদিকে হাঁটতে লাগল সে। হাঁটতেই লাগল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। ধীরে ধীরে অন্ধকারে জমাট রক্তের মতো লালাভা ফুটে উঠল। তারপর উজ্জ্বল সোনালি, লাল, গোলাপি, কমলার মিশ্রণ। মেরি অ্যান ক্যান্সার হাসপাতালের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল সে। একমনে দানিয়েল এলফিনস্টোনের মর্মরমূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। আমার ভয় করল। সে কি ওই মূর্তি মনে রাখবে? আমার শরীরী সত্তাকে কি সে চিনে ফেলবে? আশ্চর্য! জীবিতের মতো শঙ্কা ও ভয়ের শিরশিরে অনুভূতি হতে লাগল আমার!

এখান থেকে রাস্তাটা সোজা পুবে গিয়ে অনেক দূরে উত্তরে সেডার র‌্যাপিডের দিকে গিয়েছে। আকাশ সুবিস্তৃতভাবে দেখা যাচ্ছে। সে ধীর পায়ে চলতে চলতে সূর্যোদয়ের রঙের খেলা দেখতে লাগল। কণ্ঠে গুনগুনিয়ে তুলল ভৈরবের সুর। পথের ধারে পথচারীর বিশ্রামের জন্য পেতে রাখা লম্বা কাঠের বেঞ্চে বসল সে। আকাশের অপরূপ লালচে সোনালি আভা পড়ছে তার মুখে। এখন সে আর সুর গুনগুনিয়ে তুলছে না। উন্মীলিত দৃষ্টি অথচ যেন ধ্যানস্থ, এমন অচঞ্চল সে পূর্বদিকে তাকিয়ে বসে আছে। এদিকে ঘরবাড়ি কম। অনতিদূরে পাথুরে জমির ওপর ঝোপঝাড়, তারপর বনভূমি। আমার জীবদ্দশায় এদিকে ছিল ঘন বন। অ্যামেলিয়া ইয়ারহার্টের ছোট্ট লাল টুকটুকে ব্যক্তিগত বিমান কতবার উড়ে গিয়েছে এই আকাশ দিয়ে! আজ আমি আলোয় আলো হয়ে, বাতাসে বাতাস হয়ে জড়িয়ে আছি আমার অন্য অ্যামেলিয়াকে। দেখতে পাচ্ছি, তার চোখ জলে ভরে আসছে। প্রথমে খানিক ফুঁপিয়ে উঠল সে, তারপর কান্নায় ভেঙে পড়ল। এই নির্জনতায়, এই প্রত্যুষায়, তার কান্না টুকরো টুকরো হয়ে পথের পাথরে পাথর হয়ে রইল। আমি তাকে হাওয়ার ভিতর আদর করে বলে উঠলাম – কাঁদো কেন?

জানি, সে কাঁদছে নিজের জন্য, শবনম, ইয়াসমিন, হারিক, রোজানা – এমন সকলের জন্য। নারীকে পুরুষ কেন দুঃখ দেয়? নারীও কি পুরুষকে দুঃখ দেয় না? আমার মা ভালোবাসা পেয়েছিল, তার মূল্য বোঝেনি। সে কি দুঃখের নয়? মানুষই মানুষকে দুঃখ দেয় অথচ জীবন দুদিনের। জীবনের চেয়ে অনিশ্চিত, মৃত্যুর বেশি নিশ্চয়তা আর কীসে? মোলি, আমার অ্যামেলিয়া, তুমি শান্ত হও। আনন্দে শমিত হও। তুমি দৃঢ়চিত্ত। দুঃখকাতরতা যেন তোমার ওপর আধিপত্য কায়েম না করে। আমি বায়বীয় ওষ্ঠে মলির কপোল চুম্বন করলাম।

একসময় সে ফেরার পথ ধরল। আজ তাদের কোন কোন কাজ মনে করার চেষ্টা করল সে। তানিয়া জারভিরোভার ক্যালেন্ডার ক্লিনিক, তারপর পৌনে একটায় ইউনিভার্সিটি আইডি কার্ড করতে যাওয়া, দুটোয় লাইব্রেরি পরিচিতি। ১২৫ পশ্চিম ওয়াশিংটন স্ট্রিটে ইউ আইওয়া প্রধান গ্রন্থাগার তাদের বাসস্থান থেকে খুব দূরে নয়।

নিজের ঘরে ফিরে ক্ষুধা বোধ করল সে। হুইস্কি, নানাবিধ উত্তেজনা এবং নির্ঘুম রাতের জন্য মাথা ভার। অন্তত এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। সে ঠিক করল, তানিয়ার কাছ থেকে ফিরে এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত ঘুমোবে।

প্রাতরাশ সেরে জেএম কোয়েটজির ডিসগ্রেস পড়তে লাগল সে। পৌনে আটটা বাজে। সাড়ে আটটায় সে ও ইয়াকভ শাম্বাগ হাউজ যাবে। দু-পাতা পড়েছে, দরজায় টোকা পড়ল। ইয়াকভ। আসতে পারি?

মোলি : নিশ্চয়ই ইয়াকভ। এসো চা-কফি খাবে?

ইয়াকভ : আই হ্যাভ এ ব্যাদ নিউজ মোলি। [তার ঠোঁট কাঁপছে। মুখ লাল টকটক করছে। সে কেমন দুলছে বেসামাল লোকের মতো। মোলি তার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।]

মোলি : হোয়াট হ্যাপেনড? হোয়াই আর ইউ সো আপসেট।

ইয়াকভ : আই গত এ মেল। আই হ্যাভ লসত মাই বেসত ফ্রেন্দ।

মোলিকে জড়িয়ে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে লাগল ইয়াকভ। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। এই তীব্র আবেগঘন দশায়ও শালীনতাবোধ হারায়নি ইয়াকভ। তার লম্বা শরীর চেয়ারে বসা অবস্থায় মোলির বুক বরাবর। ইয়াকভ বুকে মাথা না রেখে ঘাড় গুঁজে দিলো তার নিজের হাতের ওপর। হাত দুটি মোলিকে শক্ত করে জড়িয়ে রইল। মোলির ইচ্ছে করছে ইয়াকভের শোকসন্তপ্ত মাথা নিজের বুকের ওপর টেনে নেয়, কিন্তু  পারছে না সে। সে বিশ্বাস করে, সমস্ত মুহূর্তই যৌনতাবিমণ্ডিত নয়। বুকের পেলবতায় যে-শান্তি, যে-আশ্বাস, তা এই মুহূর্তে ইয়াকভের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মোলি শক্ত হয়ে রইল। নিজেকে কুসংস্কারমুক্ত ভাবা সহজ, সত্যিকারের মুক্তি প্রমাণসাপেক্ষ বটে।

ইয়াকভ ধীরে ধীরে সরে এলো। জলভরা চোখে সে তাকাল অমলিনীর দিকে। মোলির মনে হলো, সে-দৃষ্টিতে বিস্ময়াহত বেদনা। তার আড়ষ্টতা হয়তো ইয়াকভকে আহত করেছে। ইয়াকভ দু-হাতে মুখ চেপে ধরল। বহুক্ষণ কাঁদল সে।  একটু ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘টিসু প্লিজ।’

নাক-চোখ মুছতে মুছতে ফর্সা মুখে ভোরের আকাশের মতো রং ফুটিয়ে তুলল সে। তার শোকের রং। বলল, ‘আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মোলি।’

মোলি : কী হয়েছিল?

ইয়াকভ : লাঙ ক্যান্সার। শেষ পর্যায় ছিল আমি জানতাম। কিন্তু আর কিছুদিন কি বাঁচতে পারত না? আমাকে বলেছিল, নিশ্চিন্তে যাও, তুমি ফেরার আগে আমার কিছু হবে না। মৃত্যুশয্যায় সে আমাকে দেখতে চেয়েছিল।

আবার কাঁদতে লাগল ইয়াকভ। মোলি নিজেই এবার তাকে কাছে টেনে নিল। মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, ক্যান্সার হলে কত কষ্ট। কত যন্ত্রণা। আরো তিন মাস থাকলে হয়তো আরো দুর্ভোগ হতো।

ইয়াকভ : হয়তো। হয়তো তুমি ঠিক বলছ।

মোলি : মৃত্যুর মুহূর্তে বন্ধুর নিদারুণ যন্ত্রণা দেখে তোমারও অসম্ভব কষ্ট হতো, তারও যন্ত্রণার ভার বাড়ত। প্রিয়জনের কষ্ট বাড়াতে কে চায় বলো ইয়াকভ?

ইয়াকভ : ঠিক! ঠিক মোলি! সে বড় ভালো মানুষ ছিল। তবু তার ক্যান্সার কেন হলো? ধূমপান করত না। মিথ্যে কথা বলত না। কাউকে আঘাত করে কথা বলেনি। তবু তার এমন অসুখ করল কীভাবে? 

মোলি : পাপ-পুণ্যের সরল হিসাব জীবনে মেলে না ইয়াকভ। তুমি তা জানো।

ইয়াকভ : জানি মোলি। তোমাদের তাগোর পাপ-পুণ্য মানতেন। কিন্তু পাপই বা কী, পুণ্যই বা কী, সে-কথা কে বলে দেবে?

মোলি : পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায় বিষয়ে মানুষ কখনো একমত নয়, তাই না?

ইয়াকভ : সবকিছুই বড় ঘোলাটে, বড়ই গোলমেলে মোলি।

মোলি : একজন বন্ধু হারিয়েছ, তার দুঃখ তোমার কোনো দিন যাবে না। সেই অভাবও মিটবে না। তবু তুমি বিষণ্ন বোধ কোরো না। এখানে তুমি অনেক বন্ধু পেয়েছ। অনেক পাবে আরো।

ইয়াকভ : ধন্যবাদ। তোমাকে ধন্যবাদ।

মোলি : খেয়েছ কিছু?

ইয়াকভ : আমাকে খেতে বোলো না প্লিজ।

মোলি : আচ্ছা এখন খেয়ো না। শাম্বাগ হাউজ থেকে ফিরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ কোরো।

ইয়াকভ : আজ সারাদিন আমার সঙ্গে থাকবে?

মোলি : আজ আমাদের তিনটে কাজ। সেসব মিটিয়ে তোমার যেখানে যাবার ইচ্ছে হয়, বোলো।

ইয়াকভ : আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াব।

মোলি : বেশ তো।

ইয়াকভ :  আর ওই গ্রেড গার্ডেনের কাছে, শেরাটন হোটেলের একটু দূরে, একদল লোক সন্ধ্যায় নানারকম বাজনা বাজায়। সেখানেও যাব।

মোলি : এত কিছু জানলে কী করে ইয়াকভ?

ইয়াকভ : আমি যে আনন্দসন্ধানী মোলি! আমার বন্ধুও এমন ছিল, চলে গেল। লোকে আমাদের হরিহর আত্মা বলত।

ইয়াকভের পায়ের কাছে, কার্পেটের ওপর বসল মোলি। ইয়াকভও চেয়ার ছেড়ে নেমে এলো নিচে। দুজনে দুটি হাত ধরে বসে রইল চুপচাপ। ম্যাসিডোনিয়ার কবির শোকাহত শীতল অনুভব বইতে লাগল ইন্ডিয়ার সাহিত্যিকের সমবেদনার উষ্ণতায়।

ইয়াকভ : তানিয়া জারভিরোভার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যেতে হবে।

মোলি : আমাদের একজন বিশিষ্ট কবির একটি কবিতার পঙ্ক্তি এবং কাব্যগ্রন্থ আছে। তার নাম যেতে পারি কিন্তু কেন যাব।

ইয়াকভ : কী সুন্দর! তাগোর পড়ে আমি বুঝেছি, বাংলা সাহিত্য কত মহান। তাগোরের কবিতা আমার গবেষণাপত্রের একটি অংশ ছিল। কী অদ্ভুত, উনি যে গানও বেঁধেছেন, আমি জানতাম না।

মোলি : প্রায় আড়াই হাজার গান। অন্তত বাইশশো গানে সুর দিয়েছেন। তাঁর কথা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। একদিন বলব তোমাকে।

ইয়াকভ : তোমাকে একটি অনুরোধ করব মোলি। কাল তুমি ইয়াপের অনুষ্ঠানে প্রথম অংশীদার। পঞ্চাশ বছর পূর্তি ওয়ার্কশপের সূচনা হবে তোমার পাঠ দিয়ে। তুমি একটা গান গেয়ো। তোমার নিজের ভাষায়।

মোলি : সময় যে মাত্র আধঘণ্টা। তারই মধ্যে গল্পের পাঠ।

ইয়াকভ : অর্ধেক গেয়ো। গাওয়া উচিত। আমি আজ তানিয়াকে বলব।

মোলি : বেশ তো, ইয়াকভ। তুমিও কি বাজাবে তোমার তম্বুরা?

ইয়াকভ : ইচ্ছে করে। কিন্তু তুমি তো বোঝো, অভ্যাস নেই। শুনতে ভালো না লাগলে লোক হাসিয়ে লাভ কী?

মোলি : তোমার আলোচনাসভা তো ৮ সেপ্টেম্বর। জারবের লাউঞ্জ, দুপুর বারোটা। তুমি, জেরেমিস, মানঘিল। তোমার শাম্বাগ হাউজ অনুষ্ঠান কবে? আরো পরে নিশ্চয়ই? সেইদিন বাজিও।

ইয়াকভ : অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে।

মোলি : অনেক সময় আছে। রোজ বাজাও। বাজাবে তো?

ইয়াকভ : বাজাব। কথা দিচ্ছি প্রিয় বন্ধু। আমার অনুষ্ঠানে তুমি অবশ্যই এসো।

মোলি : আসব তো। কাল তুমিও এসো প্রথমদিনের অনুষ্ঠানে।

ইয়াকভ : একদম শেষের সারিতে বসে থাকব আমি। শুনব তোমার গান, তোমার পাঠ। মোলি তুমি পাহাড়ে বেড়াতে ভলোবাসো? আমার বড় পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। মন খারাপ হলে আমি পাহাড়ে চলে যাই।

মোলি : আমি পাহাড়-জঙ্গল বড়ই ভালোবাসি। আমার নেশা জঙ্গল। পাহাড়ও ভালোবাসি খুব। টেকিং।

ইয়াকভ : ট্রেকিং? ইউ মিন হাইকিং? আই লাভ হাইকিং। আমাদের শহরে, মানে ম্যাসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপজিতে অত্যন্ত দূষণ। প্রতিবছর বউ আর দুই ছেলে নিয়ে আমি কোনো পাহাড়ে যাই ছুটি কাটাতে। এখন আমার বউও আমার মতো হাইকিং পছন্দ করে।

মোলি : কিন্তু যাবে কোথায়? এখানে তো পাহাড় নেই।

ইয়াকভ : সিয়াটলে আছে। অক্টোবরেই তো যাচ্ছি আমরা। আরো অনেকেই হয়তো আগ্রহী হবে। কোনো একটা পাহাড়ে চলে যাব।

মোলি : নিশ্চয়ই যাব ইয়াকভ।

ইয়াকভ : আর্ট মিউজিয়াম দেখব, কারাওকি যাব, সিয়াটলে  গাঁজা আইনসিদ্ধ, একটু নেশাও করব।

শাম্বাগ হাউজের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল তারা। সাড়ে ছ-ফুট ইয়াকভের সঙ্গে পাঁচ ফুটের অমলিনীকে আরো ছোট লাগছে। তাদের নিজেদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা নিয়ে কোনো বিড়ম্বনা নেই। তারা পথ চলতে চলতে একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করতে লাগল, যা আইওয়া ছেড়ে যাবার আগে তারা মঞ্চস্থ করবে। ইয়াকভ খুবই উৎসাহী। মোলির ভালো লাগছে যে সে খানিকটা হলেও ইয়াকভকে উজ্জীবিত করতে পারছে।

শাম্বাগ হাউজে তানিয়ার দফতর দোতলায়। ছোট্ট ঘর, বিশাল টেবিল, তাতে বইয়ের স্তূপ। ঠিক আধঘণ্টার আলোচনা। তানিয়া প্রয়োজনীয় কথাগুলি বলে অমলিনীর দিকে তাকাল সরাসরি। বলল, ‘আমালাইনি, আমি তোমাকে লিখেছিলাম সব কাগজপত্র ডক্স ফাইলে পাঠাতে, তুমি ডক ফাইলে পাঠিয়েছ কেন? যাই হোক, আমি কাজ চালিয়ে নিয়েছি। ঠিক আছে। কাল দেখা হবে।’

তানিয়ার সঙ্গে আলোচনা সেরে শাম্বাগ হাউজ থেকে ফিরতে লাগল দুজনে। অমলিনী খানিক আহত স্বরে বলল, ‘আমি এখনো কম্পিউটারে তেমন অভ্যস্ত নই। ডক ফাইল আর ডক্স ফাইলের তফাৎ বুঝতে পারিনি।’

ইয়াকভ : ও নিয়ে ভেবো না। কাজ তো হয়ে গেছে। তুমি কম্পিউটারে লেখো না?

মোলি : না। এখনো হাতে লিখি।

ইয়াকভ : ডক মাইক্রোসফটের পুরনো ওয়ার্ড ফাইল। ডক্স অনেক বেশি আধুনিক। এতে কাজের সুবিধেও বেশি।

মোলি : ব্যাখ্যা করার জন্য ধন্যবাদ ইয়াকভ।

ইয়াকভ : তুমি খুব ক্লান্ত। কাল তো ঘুমোওনি ভালো করে।

মোলি : চোখটা একটু কড় কড় করছে। কেন বলো?

ইয়াকভ : হাতে দু-ঘণ্টা সময় আছে। আমরা ওল্ড ক্যাপিটাল মিউজিয়ামটা দেখে নিতে পারি।

মোলি : তোমার খাবারের কী হবে?

ইয়াকভ :  হা হা মোলি। ইউ আর সো কেয়ারিং। আই নিদ আ ফ্রেন্দ লাইক ইউ। আমি একটু ছন্নছাড়া বুঝলে? মাই ওয়াইফ সেইস আই অ্যাম এ ম্যাদম্যান।

মোলি : তোমাকে দেখলে মনে হয় তুমি খুবই শান্ত, সমাহিত।

ইয়াকভ : ওটা ছদ্মবেশ। পরে থাকতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই যে। কিন্তু আমার বউ আমাকে নিয়ে তিতিবিরক্ত। কী করে দাম্পত্য টিকে আছে জানি না। বোধহয় ছেলে দুটোর জন্য। অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। আজকাল মনে হয় বিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আসলে কঠিন শেকলের মতো। কিছুতেই তোমাকে নিজের মতো বাঁচতে দেবে না।

মোলি : ভালো দিকও আছে। পারিবারিকতার সুখ, সন্তানের সান্নিধ্য, নিরাপত্তা। বিপদে-অসুস্থতায় পাশে দাঁড়ানোর মানুষ।

ইয়াকভ : এর মধ্যে সন্তানসুখের বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে একমত। বাকি সবকিছুর জন্য উই হ্যাভ তু পে এ লত। উই নিদ  ফ্রেন্দস। লাইক ইউ, লাইক জেরেমিস। লাইক মাই বেস্ত ফ্রেন্দ স্তেফান, হুম আই হ্যাভ লস্ত। বন্ধুরা কখনো স্বার্থ দেখে না, কিন্তু সব করে। তোমার ইউরো লাগবে? দেবে। তোমার বাড়িতে অনুষ্ঠান? সাহায্য করবে। তোমার মন খারাপ? তোমাকে পানশালায় নিয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমার বকবকানি শুনবে। তুমি যখন মাত্রাতিরিক্ত পান করে ফেলবে, হাত ধরে বলবে, বন্ধু আর নয়। তোমার দুঃখে দুঃখী হবে সে। তোমার সুখে পিঠে চাপড় মেরে বলবে, পার্টি দাও।

মোলি : এখন আমি তোমার পিঠে চাপড় মেরে বলব খেতে চলো।

ইয়াকভ : থ্যাঙ্ক ইউ। তুমি কি জানো, খালি পেটে থাকলেই আমার পেটব্যথা করে?

মোলি : আর তুমি প্রায়ই না খেয়ে থাকো।

ইয়াকভ : দেয়ার ইউ আর। আই দু।

মোলি : আলসার আছে?

ইয়াকভ : লতস অব সিস্ত ইন মাই স্তমাক। ফিরে গিয়েই আমার একটা বড় অস্ত্রোপচার করতে হবে। তারিখও ঠিক হয়ে আছে। সাত নভেম্বর আমরা আমেরিকা ছাড়ছি, ষোলোই আমার অপারেশন। উইল ইউ প্রে ফর মি? আই অ্যাম স্কেয়ার্দ। আই তোল্দ ইউ, মাই  ফ্রেন্দ দায়েদ ইন ক্যান্সার।

মোলি : আমি প্রে করব। তুমি একদম সুস্থ। ভয় পেয়ো না। ভয়, আশঙ্কা, দুর্ভাবনা, বিষাদ এগুলো ভালো নয়। মনে রেখো, দুঃখই দুঃখের কারণ। চলো, এবার আমার ঘরে যাই।

ইয়াকভ : চলো তোমাকে ফলাফল খাওয়াই।

মোলি : ফলাফল?

ইয়াকভ :  জানো না? মেক্সিকান খাবার। দারুণ খেতে। তারপর আমরা মিউজিয়াম যাব।

মোলি : আমার ভাষায় ফলাফল মানে পরিণতি।

ইয়াকভ : যেমন আমার অনিয়মের ফলাফল পেটের যন্ত্রণা। বিয়ের ফলাফল একজন সুন্দরী রমণীর সঙ্গে চিরশত্রুতা। দেখবে আমার বউ-ছেলের ছবি? তুমি তো আবার বিয়ে ব্যাপারটার বিরাট সমর্থক।

মোলি : তোমার পরিবারের ছবি আমি নিশ্চয়ই দেখব। তবে ইয়াকভ, বিয়ে সম্পর্কে আমার মতামত হলো, আগামী প্রজন্মের জন্য অন্যতর কোনো নিয়ম ভাবার সময় এসেছে। যেটা বাণিজ্যিক হবে না। যেটা কারো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা খর্ব করবে না।

ইয়াকভ :  ইউ আর আবসেলিউতলি কারেক্ত। এই দেখো আমার বড় ছেলে। কী যে ভালো, ভাবতে পারবে না। সব রান্না জানে। বাগান করে। বয়স পনেরো। কিন্তু সংসারের কত দায়িত্ব যে নেয়। ছোটটাও ভালো। সে-ও রান্না শিখছে। আমার মতো গানপাগল। আমার বাড়ির দোতলায় আমার বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ। দুশো যন্ত্র আছে আমার। পৃথিবীর যখন যে-দেশে গিয়েছি, ফ্রান্স, চীন, রুমানিয়া, ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি – কোনো একটা বা একাধিক বাদ্যযন্ত্র কিনেছি। এই দেখো আমার বউ। ক্যান্সার রিসার্চার।

মোলি : তোমার ছেলেরাও খুব সুন্দর। আর তোমার বউও অপরূপ সুন্দরী।

ইয়াকভ : ধন্যবাদ মোলি। আজ আমার মনটা বড় উদাস হয়ে আছে মোলি। আই মিস মাই চিলড্রেন। কী করে ওদের না দেখে তিন মাস থাকব? নভেম্বরে আমার ছোটটার জন্মদিন। নিউইয়র্কে টাইমস স্কোয়ারে একটা বিখ্যাত দোকান আছে, ‘গিটার সেন্টার’, ওখান থেকে একটা কিনে নিয়ে যাব। দেখছ দোকানটা?

মোলি : না ইয়াকভ।

ইয়াকভ : নিয়ে যাব তোমাকে। ওখানেই তো শেষ কটা দিন কাটবে আমাদের।

মোলি : যাব তো। তোমার বড় ছেলের জন্য কী নেবে?

ইয়াকভ : কী জানি। হয়তো রং-তুলি! ও আঁকতে ভালোবাসে, মোলি, হি ইজ দা লাভলিয়েস্ত বয় ইন দা ওয়ার্লদ। ওকে আশীর্বাদ কোরো মোলি। আমার বড় ছেলেটা এপিলেপটিক। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করতে পারে না। যখন-তখন ফিট হয়। সেই দৃশ্য যে কী করুণ। যখন শিশু ছিল, কিছু বোঝে না, বোঝাতে পারে না, ভীষণ খিঁচুনি দিয়ে ফিট হতো, আমার বুক ফেটে কান্না পেত মোলি!

কাঁদছে সে। ঠোঁট চেপে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রাণপণ। অমলিনীর হাত চেপে ধরে বলছে, কাউকে বোলো না প্লিজ। ইতস এ তপ সিক্রেত। কেউ জানে না। জেরেমিসও নয়। সব সময় হাসি, মজা করি, গান-বাজনা, কাব্য নিয়ে মেতে থাকি। কিন্তু ছেলের জন্য বুকের মধ্যে যে কী কষ্ট! আমি বলেছি ওকে, চাপ নেবে না, যা পারো, করো। ফিজিক্সে খুব ভালো।

মোলি :  ডাক্তাররা কী বলেন?

ইয়াকভ : বড় হলে অনেক সময় আপনা-আপনি সেরে যায়। আজ আমার মন বড় দুর্বল, মোলি। বড় ব্যক্তিগত দুঃখের কথা বলছি।

মোলি : আমরা বন্ধু ইয়াকভ। ইয়াকভ : থ্যাঙ্কস মোলি। r (চলবে)