অ্যামেলিয়া

তিলোত্তমা মজুমদার

            ॥ ২০ ॥

ফলাফল আমিষ-নিরামিষ দুরকমই হয়। অনেকটা ভারতের শিঙাড়ার মতো। তবে পুরো বন্ধ নয়। বেশ বড় আকারের রুটি শালপাতার ঠোঙার মতো করে ভেতরে আলুর তরকারি, স্যালাড আর কয়েকখানা ডালের বড়া। আমিষ ফলাফলে থাকে চিকেন কুচি। তারা নিরামিষ নিল। কম খরচে বেশ ভালো খাবার। সঙ্গে যে-কোনো ঠান্ডা পানীয় মুফত। অমলিনী আইস-টি নিল, ইয়াকভ নিল কোক। খাবারের ব্যাপারে আমেরিকা উদার। চৈনিক, ভারতীয়, থাই, মঙ্গোলিয়ান, জাপানি, ইথিয়োপিয়ান, লেবানিজ, ফ্রেঞ্চ, কোরিয়ান, মেক্সিকান, আফগানি, ইতালিয়ান – সবরকম খাবারের দোকান যে-কোনো শহরে দেখতে পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই তাদের চোখে পড়ল ‘সিটি ক্যাফে’তে জেরেমিস বসে আছে। সঙ্গে ওকিওকি, রুথ, ফিলিপ, ইভাসাকা এবং এক আমেরিকান তরুণ। ক্যাফের উন্মুক্ত বারান্দায় একটি টেবিলের চারধারে বসে আছে তারা।

ইয়াকভ : চলো, কফি খাবে?

মোলি : চলো। তবে রুথ সম্পর্কে আমার অস্বস্তি আছে।

ইয়াকভ : ওভাবে বলতে নেই। রুথ খুব ভালো মেয়ে। চলো, দেখি, ওর মা কেমন আছে। হাই এভরিবদি!

জেরেমিস : গুড মর্নিং মোলি, হাই ইয়াকভ। তোমাকে খুঁজছিলাম।

ইয়াকভ : কেন?

জেরেমিস : হাউ আর ইউ?

ইয়াকভ : আই’ম ফাইন। উই হ্যাদ ক্যালেন্দার ক্লিনিক। দাঁড়াও, দুটো চেয়ার নিয়ে আসি।

ফিলিপ : ক্যালেন্ডার ক্লিনিক, এঃ? রিয়ালিটি শো-এর আরেকটি অর্থহীন দেখনদারি।

ইয়াকভ : না না। আমার তো বেশ কাজের মনে হলো।

ফিলিপ : রাখো তো। কাল আমার ছিল এটা। তানিয়া জারভিরোভা এমনভাবে কথা বলে যেন আমরা সব ছাত্র আর তানিয়া আমাদের হেডদিদিমণি। বলে কি না, ইউ-আইওয়ায় থাকতে গেলে অ্যাক্রোনিম বুঝতে হবে। আরে, এর মানে কী! তোমরা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছ, আমরা দয়া ভিক্ষা করে আসিনি। ‘থাকতে গেলে বুঝতে হবে’ মানে কী!

ইয়াকভ : অত ধরছ কেন ফিলিপ! কথায় কত রকম কথা বেরিয়ে আসে।

রুথ : ফিলিপ ঠিক বলেছে, তানিয়া জারভিরোভার মধ্যে একটা কর্তৃত্ব আছে, যেন পরিচালকের চেয়ারটা তাকে দেওয়া হয়নি, এ এক মস্ত ভুল।

মোলি : সেটা কী করে বোঝা গেল? তোমার ক্লিনিক তো হয়নি!

রুথ : দেখলেই বোঝা যায়। তাছাড়া রাশিয়ানরা একটু কর্তৃত্বপরায়ণ হয়। সবকিছু সবার চেয়ে বেশি বোঝে এমন ভাব। আগে তো আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিত সব ব্যাপারে। গ্লাসনস্তের ঠেলায় সব ভেঙে, তুবড়ে, চুপসে গেছে।

মোলি : এ-ধরনের কথার তীব্র প্রতিবাদ করতে চাই আমি।

ইয়াকভ : লিভ ইত্ মোলি। তোমার জন্য কী কফি আনব বলো?

ফিলিপ : ইয়াকভ মোলিকে খাওয়াচ্ছ নাকি? আমরা বাদ যাব?

ইয়াকভ : দুঃখিত ফিলিপ, আমাদের গোনাগুনতি ডলার। সবাইকে খাওয়াতে পারব না। মোলি নিজের পয়সায় খাবে। ও তো কফি ভালোবাসে। জানো না, ভারত থেকে আসার সময় নিজের পছন্দের ব্রান্ডের কফি নিয়ে এসেছে।

জেরেমিস : ভারত? সেটা কী?

মোলি : আমার দেশ জেরেমিস। ইন্ডিয়ার অন্য নাম ভারত।

জেরেমিস : হায় ভগবান! একটা দেশের দুটো নাম?

দক্ষিণ আফ্রিকার ইভাসাকা আধিয়ামো চুপ করে ছিল এতোক্ষণ। দীর্ঘাঙ্গী, স্বল্পভাষী, সুন্দরী ইভা মৃদুকণ্ঠে বলল,          ‘পৃথিবীতে বিস্ময়ের শেষ নেই। মোলি তুমি কী পান করতে চাও? ইয়াকভ, তুমি? আমি কাউন্টার থেকে নিয়ে আসছি।’ মোলি : কোল্ড কফি, চিনি ছাড়া।

ইয়াকভ : হট ক্যাপুচিনো।

ফিলিপ : ল্যাটে, ফর মি!

ইভাসাকা ধীরেসুস্থে উঠল। অল্প হেসে অমলিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার প্রতিবাদ আমি শুনতে আগ্রহী মোলি। আমি কফি নিয়ে আসার আগে বোলো না প্লিজ।’

অমলিনী হেসে বলল,  ‘সেরকম কিছু না। তুমি এসো, বলছি।’

তারা আমেরিকার আবহাওয়ার বিষয়ে কথা বলল। হলিউডি মুভি নিয়ে সবে আড্ডা জমছে, ইভাসাকা কফির ট্রে এনে রাখল টেবিলে। একটা ছোট নোটবইয়ে হিসাব রাখছে জেরেমিস, কার ক’কাপ হলো। কে কী খেল। কে কোনটা নিজের পকেট থেকে দিলো। ইভাসাকা নিজের শীতল কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘বলো, মোলি।’

মোলি :  দেখো, কোনো জাতি সম্পর্কে সাধারণীকৃত সমালোচনা ঠিক নয়। মানবিক দোষগুণ সব দেশের মানুষের মধ্যেই থাকে।

ইভাসাকা : আমি একমত।

ফিলিপ : জাতিগত বৈশিষ্ট্য তোমরা মানো না? এটা কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত।

মোলি : জাতিগত বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়ই আছে। জিন এবং পারিপার্শ্বিকতা তার জন্য দায়ী। কিন্তু একটা গোটা দেশের লোক সবাই কর্তৃত্বপরায়ণ, কিংবা স্বার্থপর, কিংবা ঈর্ষাতুর – এমনটা হতে পারে না। বৈশিষ্ট্যের অনেক ভাগ আছে। কিছু সামাজিক, কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কিছু গোষ্ঠীগত, কিছু পরিবারগত। কিছু শারীরিক, কিছু চরিত্রগত। তবে চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিজ্ঞান এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি।

ইয়াকভ : একদম ঠিক।

রুথ : লেকচার দিতে ভালো পারো তুমি মোলি। তবে আমি যে ক’জন রাশিয়ান দেখেছি, সবাই এরকম।

মোলি : তাহলে রাশিয়া ভেঙে যে এতোগুলো নতুন দেশ হলো, আমাদের মধ্যেও তার একজন আছে, তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য কী হবে?

রুথ : সেটা দেখতে হবে! দেখে বুঝতে হবে।

জেরেমিস : দেখলেই আর কী বোঝো তুমি রুথ? তানিয়া খেতে বসলে ডান পা নাচায়, বই পড়ার সময় নাক খোঁটে, স্বপ্ন দেখতে দেখতে পাশের লোককে কনুই দিয়ে গুঁতোয়।

রুথ :  আমার বোঝার ক্ষমতা আছে। তোমার নেই। তুমি তো সারাক্ষণ মেয়েদের পেছনে ছুঁক ছুঁক করছ। বুঝবে কী!

জেরেমিস : মেয়ে না হলে আর চলছে না যে! খুব দরকার। হু উইল স্লিপ উইথ মি?

ইয়াকভ : রুথ, তোমার মায়ের অপারেশন ঠিকমতো হয়েছে? কেমন আছেন তিনি?

রুথ : ওঃ হোঃ থ্যাঙ্কস ফর আস্কিং! এখন অপারেশন হবে না।

ইয়াকভ : সে কি! কেন?

রুথ : এখুনি না করালেও চলবে।

মোলি : [হেসে] এটা তবে সাংঘাতিক কিছু নয়, যেমনটা তুমি ভাবছিলে!

রুথ : না। খুবই বড় অপারেশন। যতদিন ঠেকিয়ে রাখা যায়। আচ্ছা, কাম্বা ঘালোন্দা তোমার ঘরের পাশেই থাকে না?

মোলি : থাকে। কিন্তু মাঝরাতে দরজায় টোকা দেয়নি।

ইয়াকভ : আচ্ছা, এতোক্ষণ হয়ে গেল কেউ ওর সঙ্গে পরিচয় করে দিলো না তো? হাই, আমি ইয়াকভ করচাগিন, ফ্রম ম্যাসিডোনিয়া। শি আমালাইনি ঘুফথা ফ্রম ইন্দিয়া।

জেরেমিস : আরো আগেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। ড্যানিয়েল স্টোন। লেখক। ওর স্বরযন্ত্রে একটা অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাই আপাতত কথা বন্ধ। আমরা সিøপে লিখে আড্ডা দিচ্ছিলাম।

ইয়াকভ : দ্যানিয়েল, ইউ আর তু ইয়ং এ রাইতার।

মোলি : তোমাকে খুব চেনা লাগছে ড্যানিয়েল। কোথায় যেন দেখেছি।

জেরেমিস : হয়তো শাম্বাগ হাউজে।

আমি দানিয়েল, আমি উঠে পড়লাম। অমলিনীর সামনে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। তাকে এতোই আপনার করে নিয়েছি, কাঁধ জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। জেরেমিসকে যা বলেছি, মিথ্যে কিছুই নয়। আমার প্রথম অস্ত্রোপচার গলাতেই হয়েছিল। আমি কণ্ঠস্বর হারিয়েছিলাম। ইচ্ছাপূরণের এই শেষ শরীরী সত্তায় আমি তা ফেরাতে পারিনি। হয়তো পাব। শরীর ফিরে পাব, তা-ই কি ভেবেছিলাম? আমি শুধু ইচ্ছেগুলো সংগ্রহ ও সংহত করছিলাম। কিন্তু সময় বড় জটিল। আমি শরীর চাই, কোন শরীর? কোন মুহূর্তের শরীর? মানব শরীর প্রতি মুহূর্তে বদলে যায়। লক্ষ-কোটি কোষের মরণ ঘটে। লক্ষ-কোটি জন্মায়। হয়তো, স্বরযন্ত্র খুইয়ে, সেই সময়ের অসম্পূর্ণ শরীরটি আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। জীবন-মৃত্যু, আত্মা, কাল, স্রষ্টা ও অজ্ঞাত অনিবার্য ভবিতব্যের কোনো ধারণাই আমার নেই। এই মুহূর্তে আমার শরীর একটি সক্রিয় যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রণা নেই, খাদ্যের চাহিদা নেই, এমনকী আমার যৌনাঙ্গও শিথিল। ক্যান্সার হওয়ার কিছুকাল পর আমি স্বাভাবিক যৌনবোধের শরীরী উত্থানশক্তি হারিয়েছিলাম। অথচ আমার যৌনতার অভীপ্সা আছে। মৃত্যুর এতো বছর পর, জীবিতের মাঝখানে অনিবার্য ভৌতিকতায় আমি বুঝলাম, যৌনতা আসলে সম্পূর্ণ মানসিক। জীবিতের শরীর জীবিত মনের নির্দেশে ক্রিয়া করে। তাই যৌনতার নিবারণ সম্ভব। নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

অমলিনীকে সশরীরে দেখে আমার আনন্দ! কিন্তু আমি কি সত্য আঁকড়ে থাকতে পারব? মেরি-অ্যান হাসপাতালে আমার মূর্তি যে-কেউ দেখতে পারে, যে-কেউ পড়তে পারে দানিয়েল এলফিনস্টোন! যেটা, তারা উচ্চারণ করবে ড্যানিয়েল। আমি কী বলব?

আমি উঠতেই ফিলিপ ও রুথ উঠে পড়ল। ইয়াকভ ও অমলিনীর কফি শেষ হতে তারা ফেরার পথ ধরল। ওকিওকির কাঁধ জড়িয়ে হাঁটছে জেরেমিস। ইয়াকভ ও অমলিনী পাশাপাশি চলছে। ওল্ড ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের সামনে সবুজ ঘাসের গালিচা। গাছপালা। বসার চেয়ার।

জেরেমিস : চলো, ঘাসের ওপর বসি।

ইয়াকভ : আমরা ভাবছিলাম মিউজিয়ামটা দেখব।

জেরেমিস : ও তো রইলই। এমন ঝলমলে দিন এখানে বেশি পাবে না। এমন ঘাসের গালিচা, শুয়ে পড়তে ইচ্ছা হয়।

ইয়াকভ : ওপাশে যাই চলো। ওদিকটায় সুন্দর ঢাল আছে। একেবারে কুঞ্জবনের মতো আড্ডার জায়গা। স্টুডেন্টরা হ্যামক ঝুলিয়ে শুয়ে থাকে। কী জীবন।

ওকিওকি : আমি হোটেলে ফিরে যেতে চাই।

জেরেমিস : ঠিক আছে। একটু পরেই তো দেখা হচ্ছে।

পশ্চিম ওয়াশিংটন স্ট্রিট ঘেঁষে সবুজ ঘাসের সুবিস্তৃত ঢাল। ইতস্তত ঝাঁকড়া পাতাওয়ালা নানাবিধ গাছপালা। হ্যাকবেরি, বার্চ, এলম, গ্লেনলেভেন, গ্রিনস্পাইয়ার, ওক, মেপল, স্প্রুস, হোয়াইট পাইন, গোল্ড গিঙ্কো, ব্যালসাম ফির, চেস্টনাট, সাইপ্রাস, জুনিপার, উইলো, ম্যাগনোলিয়া। গাছের গহনে, ছায়ায় ছায়ায় বসার জায়গা। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়, ইমু, হুবার্ড পার্ক, তার পাশে লাইব্রেরি, ইংলিশ বিল্ডিং।

ঘাসের ওপর টানটান শুয়ে পড়ল জেরেমিস। ইয়াকভ অমলিনীর হাত টেনে বলল, শুয়ে পড়ো।

অমলিনী : শোবো? (চলবে)