রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ

আমার বয়স যখন বছর ছয়েকের মতো তখন আমাকে ময়মনসিংহে দাদুবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য পড়াশোনা। যমুনাপাড় থেকে ব্রহ্মপুত্রপাড়ে আমার এই যাত্রায় যে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম তা নয়। বাবা-মা, ভাইবোনসহ এতদিনের স্বজন-পরিজন এবং পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে নতুন জায়গায় যেতে আমার খুব ভালো লাগেনি। তবু যেতে হয়েছিল বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই। তখন মেয়েদের তেমন লেখাপড়ার চল না থাকলেও আমার বাবা-মা চেয়েছিলেন আমি যেন শহরে থেকে লেখাপড়া করি, জীবনটাকে অন্যভাবে গড়ি। মেয়েদের ক্লাস ফাইভের বেশি লেখাপড়ার দরকার নেই, সেটা আমার বাবা-মা মনে করতেন না। তাছাড়া ময়মনসিংহ শহরে যেহেতু আমার নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা আছে, তাই মা আমাকে কাছছাড়া করতে দ্বিধা করেননি।

একদিন মা একটি পুরনো ট্রাংকে আমার জামা-কাপড় সাজিয়ে আমাকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে বিদায় দিলেন। কে আমাকে রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহ পৌঁছে দিয়েছিলেন, সেটা আজ আর মনে নেই। তবে মেথিকান্দা স্টেশন থেকে কোনো এক সকালে যাত্রা করে বিকেলে ময়মনসিংহ গিয়ে পৌঁছানোর কথা বেশ মনে আছে। তখন ওই লাইনে লক্কড়ঝক্কড়মার্কা একটি ট্রেন চলতো। মেথিকান্দা থেকে ময়মনসিংহ যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো। তবে ট্রেনজার্নি আমার ভালোই লাগতো। আয়েশি ভঙ্গিতে হেলেদুলে ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেনের ছুটে চলা আমার খুব পছন্দেরই ছিল। গাছগাছালি, মাঠঘাট, নদীনালা, প্রান্তর সব পেছনে ফেলে ট্রেনের এগিয়ে চলার ছন্দে আমি মজাই পেতাম। সময় বেশি লাগলে আমার ক্ষতি কী! আমার তো তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর কোনো তাড়া ছিল না।

ময়মনসিংহ শহরে আমার দাদুর (মায়ের বাবা) বাড়ি ছিল গাঙ্গিনার পাড়ে। বাড়িটি মোটামুটি বড়ই ছিল। হাফ ওয়াল টিনশেড বাড়িতে বড় একটি আঙিনা ছিল। চৌকিপাতা শোবার ঘর ছিল চারটি। এছাড়া ছিল একটি বৈঠকখানা। অতিথিদের জন্যও আলাদা ঘর ছিল। সেখানে ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় দূরদূরান্ত থেকে পরীক্ষার্থীরা এসে থাকতো এবং শহরের পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা দিত। এই গেস্টরুমেই পরবর্তী সময়ে আত্মগোপনে থাকতেন কমিউনিস্ট নেতা অজয় রায়, যাঁকে আরো পরে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি।

বাড়িটি ছিল বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চারদিকে ছিল আম, নারকেলসহ বিভিন্ন ফলদ বৃক্ষ। ছিল পরিপাটি সাজানো ফুলের বাগান। জবা গাঁদা কামিনী শেফালি শিউলি হাসনাহেনা ফুলে  শোভিত সেই বাগান এখনো আমার চোখে ভাসে। আঙিনার একদিকে ছিল তুলসীতলা। বাঁধানো সেই তুলসীতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানো হতো।

জলের সরবরাহ ছিল। তিন ঘণ্টা পরপর জল আসতো।

আমার দাদু প্রফুল্ল রায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তবে তিনি ছিলেন রুচিশীল মানুষ। আমার মায়ের আরো দুই বোন ছিল। অবশ্য এক বোন অকালপ্রয়াত। ফলে অলোকা মাসিই ছিলেন আমার সবসময়ের সঙ্গী। দাদু-দিদিমার প্রথম মেয়ের ঘরের প্রথম মেয়ে আমি। দেখতেও মোটামুটি সুন্দরীই ছিলাম। তাই দাদু-দিদিমার আদর ছিল আমার জন্য উজাড় করা।

অলোকা মাসিই আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। মাসিও ওই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। মহাকালী হাই স্কুলের তখন খুব সুনাম ছিল। চামেলিদি ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন তিনি। স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে পেয়েছিলাম ভক্তি ধরকে। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী মনোরঞ্জন ধরের স্ত্রী। মনোরঞ্জন ধর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ভক্তিদি একটু কড়া ধাঁচের শিক্ষক ছিলেন। ক্লাসে পড়া না পারলে বইয়ের ব্যাগ মাথায় দিয়ে বেঞ্চের ওপর এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। আমিও দু-একবার এই শাস্তি ভোগ করেছি।

ভক্তিদি ছাড়া আশাদি এবং টগরদির কথাও মনে পড়ছে। আশাদি দেখতে কিছুটা স্থূলকায় ছিলেন। ঘনঘন পান খেতেন। তাই ঠোঁট থাকতো প্রায়ই লাল। টগরদি স্কুলে আসতেন খুব পরিপাটি করে সেজে। বেশ লাগতো।

আমি অলোকা মাসির সঙ্গেই স্কুলে যেতাম। আমাদের স্কুলে কমলারঙের ইউনিফর্ম ছিল। মাথার চুল বাঁধতে হতো দুই বেণি করে। মাসি, আমি এবং আশেপাশের সব মেয়ে দলবেঁধে স্কুলে যেতাম। সকালে বাড়িতে আলু ভাজা, ডালসিদ্ধ এবং চচ্চড়ি দিয়ে গরম ভাত খেয়ে আমরা স্কুলে যেতাম। স্কুলেও টিফিন দেওয়া হতো। নিমকি, বিস্কুট, শিঙাড়া দেওয়া হতো টিফিন হিসেবে। এছাড়া আমরা ছাত্রীরা চাঁদা তুলে মাঝে মাঝে মিষ্টিও খেতাম।

শুরুর দিকে স্কুলে যেতে এবং পড়াশোনা করতে আমার তেমন ভালো লাগতো না। রায়পুরার বাড়ির জন্য মন পুড়তো, খারাপ লাগতো। বাড়ির জন্য টান অনুভব করতাম। তবে আস্তে আস্তে ময়মনসিংহে আমার মন বসতে শুরু করে। পড়াশোনার প্রতিও আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। ক্লাসে প্রথম-দ্বিতীয় না হলেও ছাত্রী হিসেবে একেবারে খারাপ ছিলাম না। গ্রীষ্মের কিংবা পূজার ছুটিতে বাড়ি যেতাম।

আমাদের সময়ে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে কেউ উত্ত্যক্ত করেছে বলে মনে পড়ে না। ইভটিজিং শব্দটার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল না। আমার দাদুবাড়ির কাছিকাছি গুরু নানকের মন্দির ছিল। এছাড়া ছিল শিববাড়ি ক্লাব। ক্লাবের দাদারা আমাদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেটা দেখভাল করতেন। ক্লাবে প্রতিবছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো।

স্কুলে স্বরস্বতী পূজা হতো প্রতিবছর। পূজার দিন লুচি-পায়েস-বাঁধাকপির ঘণ্ট-চাটনি পরিবেশন করা হতো। মাইকে বাজতো ভক্তিমূলক গান। শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে-র গান আমরা তখনই শুনেছি। আজো কানে বাজে – ‘আমার সাধ না মিটিলো, আশা না পুরিলো’ গানের মধুর ধ্বনি।

আমাদের স্কুলজীবনটা একটি গণ্ডির মধ্যেই বাঁধা ছিল। সবকিছু চলতো নিয়মমতো। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ গান গেয়ে অ্যাসেমব্লির মধ্য দিয়ে শুরু, শেষ ঘণ্টাধ্বনি বাজলে শেষ। তবে বছরের শুরুতে নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন বই পেলে তার গন্ধ, মলাট লাগানোর ধুম – আমাদের কিছুটা চনমনে করে তুলতো। এখনকার মতো তখন বই বিনামূল্যে পাওয়া যেতো না। নতুন বই কিনতে হতো। তবে আমরা আমাদের পুরনো বই গরিব শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে দিয়ে দিতাম।

 দুই

যেহেতু স্মৃতি থেকে লেখা তাই আগের ঘটনা পরে, পরের ঘটনা আগে এসে যেতে পারে। পাঠক বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। রায়পুরা থেকে ময়মনসিংহে এসে প্রথমে মন খারাপ থাকলেও পরে আস্তে আস্তে ময়মনসিংহও আমার নিজের শহর হয়ে উঠছিল। আমার জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহের দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো পরানের গহিন ভেতরে কেমন একটি অনুরণন ওঠে। মনে হয়, আবার যদি ফিরে পেতাম ওই সোনালি দিনগুলো! কিন্তু হায়! যে-দিন যায় তা আর ফিরে আসে না।

এতদিনের ব্যবধানে ময়মনসিংহ শহরটিও কি আর আগের মতো আছে? জনবিরল শহরটি এখন কত জনবহুল হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না বললেই চলে। চলাচলের জন্য প্রধান বাহন ছিল রিকশা। কিছু বাস চলতো দূরের গন্তব্যে। আমরা শহরে পায়ে হেঁটেই চলাচল করতাম।

আমি যখন স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করি, তখনই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি করে ছাত্রহত্যার ঘটনা ঘটে। তবে খবরটা পেতে আমাদের সময় লেগেছিল। তখন খবর আদান-প্রদানের এখনকার মতো সহজ সুযোগ ছিল না। ঢাকার পত্রিকাও কখনো কখনো পরের দিন গিয়ে পৌঁছতো। তবে বড়দের মুখে ‘ঢাকায় গণ্ডগোলে’র কথা শুনেছিলাম। কেন গণ্ডগোল, কী হয়েছে তা জানা-বোঝার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের ঢেউ ময়মনসিংহে পৌঁছতে সময় লেগেছিল বলেই মনে হয়। শহিদ মিনার তৈরি, একুশের প্রভাতফেরি – এগুলো আমরা উঁচু ক্লাসে ওঠার পরের ঘটনা। তাই ভাষা-আন্দোলন নিয়ে তাৎক্ষণিক খুব আলোড়িত হয়েছিলাম, সেটা দাবি করতে পারবো না।

আমার দাদুবাড়িতে দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটি রাখা হতো। একটি পত্রিকা অনেকেই পড়তেন। পত্রিকা পড়ার জন্য অনেকেই বৈঠকখানায় জড়ো হতেন। এক পত্রিকা অনেক হাতবদল হতো। বেশ মনে আছে, গাঙ্গিনার পাড়ে আমাদের বাড়ি থেকে অনতিদূরে একটি মোড়ে একজন বয়স্ক মানুষ পত্রিকা বিক্রি করতেন। ধুতি ও হাফশার্ট পরা ওই বৃদ্ধ পত্রিকা বিক্রেতার ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে। তখন পত্রিকাই ছিল দু-তিনটি। সংবাদ, আজাদ আর সম্ভবত ইত্তেফাক। জেলা শহর থেকে কোনো পত্রিকা বের হতো না। পাঠকরা ঢাকার পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতেন। পাঠক সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না।

ছোটবেলার অনেক স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। তখন মানুষের মধ্যে অন্য ধরনের আন্তরিকতা ছিল। বড়রা ছোটদের আদর করতেন। ছোটরা বড়দের সমীহ করতো। আমরা পাড়াপড়শি বড়দের এক ধরনের নজরদারির মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। মনে আছে, আমাদের মহাকালী স্কুলের কাছে একটি দোকান ছিল। বই, খাতা, পেন্সিল, রাবার, শার্পনার, সাদা কাগজ, লজেন্স ইত্যাদি বিক্রি হতো। দোকানে যিনি বসতেন তাঁকে আমরা দাদু বলতাম। টুপি, দাড়ি এবং চোখে গোল চশমার ওই দাদু আমাদের ডেকে কিছু লাগবে কি না জানতে চাইতেন। আমার কাছে পয়সা থাকতো না। পয়সা নেই বললেই দাদু বলতেন, আজ নিয়ে যাও, কাল বাড়ি থেকে পয়সা এনে দিও। আমি কখনো কখনো রাবার, পেনসিল বা শার্পনার বাকিতে নিয়ে পরদিন পয়সা দিয়ে দিয়েছি।

আমাদের সময় ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসার জন্য একধরনের প্রতিযোগিতা হতো। আগে স্কুলে গেলে প্রথম বেঞ্চে বসার জায়গা রাখা নিয়ে আমাদের মধ্যে টুকটাক ঝগড়াঝাটিও হতো। শিক্ষকরা ক্লাসে পড়া ধরতেন। না পারলে কিছু শাস্তিও দিতেন। যেদিন পড়া তৈরি করে যেতাম না, সেদিন সামনের বেঞ্চে না বসে পেছনে বসতাম। শিক্ষকরা বিষয়টি বুঝতেন। তাই সামনের থেকে পেছনে গিয়ে বসলেও পড়া ধরে লজ্জা দিতেন। আমাদের ছোটবেলায় প্রাইভেট টিউটরের চল ছিল না। আমরা ছোট-বড় সবাই গোল হয়ে বসতাম এবং জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়তাম। দূরে বসে দাদু বা দিদিমা পড়ার তদারকি করতেন। ভুল উচ্চারণ করলে শুধরে দিতেন। তাছাড়া অলোকা মাসি তো ছিলেনই। আমি একটু ওপরের ক্লাসে উঠলে আমার মা মাঝে মাঝে ময়মনসিংহে এসে থাকতেন। মা এলে আদর যেমন পেতাম, তেমনি মায়ের শাসনও ছিল কড়া। পড়তে বসলে মা একটি বেত হাতে একটু দূরে বসে থাকতেন। মা বেত দিয়ে কখনো মেরেছেন বলে মনে পড়ে না। তাঁর বেত নিয়ে বসে থাকা দেখেই ভয়ে জবুথবু হয়ে যেতাম।

আমি আমার জীবনে বাবার সান্নিধ্য বা সাহচর্য খুব একটা পাইনি। বাবা তাঁর ডাক্তারি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমার বড় হয়ে ওঠা, শিক্ষাগ্রহণের পেছনে বড় অবদান আমার মা এবং দাদুর। মা নিজে বেশি লেখাপড়া জানতেন না। হাই স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি। কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তিনি বেশ আগ্রহী ছিলেন। আমার দাদুও ছিলেন অনেক উদার মনের মানুষ। লেখাপড়া না শিখলে মেয়েরা মর্যাদার জীবন পাবে না – এটা আমার দাদু বিশ্বাস করতেন। তাই আমার লেখাপড়ায় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে মা এবং দাদুর সমান নজর ছিল। আমি আজ যতটুকু যা হয়েছি, এর পেছনে আমার দাদু এবং মায়ের অবদানই বেশি। তাঁদের উৎসাহ ও প্রেরণাই আমাকে আমার মতো জীবন তৈরিতে সহায়তা করেছে।

তিন

দাদুর বাসায় নিয়ম করে রাত ১০টায় রাতের খাবার পরিবেশনের রীতি ছিল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আমরা বাড়ির পাশের মাঠে কিছু সময় খেলাধুলা করতাম। তবে সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে হতো। সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকার কোনো উপায় ছিল না।

সন্ধ্যায় বাড়ির কাজ ভাগ করা ছিল। সবাইকে কিছু না কিছু করতে হতো। আমি ছোট ছিলাম বলে সন্ধ্যাবাতি দেওয়ার কাজ মাঝে মাঝে আমার ভাগে পড়তো। বাসায় কাজের লোক থাকলেও রান্নার কাজ বাড়ির মেয়েদেরই করতে হতো। তখন রেফ্রিজারেটর ছিল না। তাই প্রতিদিনের রান্না প্রতিদিন হতো। মা এলে দিদিমার একটু আরাম হতো। না হলে ঘরের সব কাজ দিদিমাকেই করতে হতো। তিনি অবশ্য সানন্দচিত্তেই সব করতেন। ঘরের কর্তৃত্ব করার মধ্যেই নারীদের সব আনন্দ সীমাবদ্ধ ছিল। হাঁড়ি-চুড়িতে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আসার অবস্থা তখন ছিল না।

দাদুর বাড়িতে একাধিক গাভি ছিল। গরু পালনের জন্য আলাদা লোকও ছিল। তাই বাড়িতেই প্রচুর দুধ হতো। রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস দুধ আমাকেও খেতে দেওয়া হতো। দুধ আমার খুব পছন্দের না হলেও না খেয়ে উপায় ছিল না। দাদু নিজে গ্লাসভর্তি দুধ নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরতেন। তাঁকে না করার কোনো উপায় থাকত না।

স্কুল আর বাড়ি ছাড়া আমাদের আর যাওয়ার তেমন জায়গা ছিল না। স্কুলে প্রতিবছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। ওই সময়গুলো আমাদের খুব আনন্দে কাটতো। নানারকম খেলাধুলা হতো। গান, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যারা পুরস্কার পেতো তারা যেমন খুশি হতো, তেমনি অন্য শিক্ষার্থীরাও ওইসব উপভোগ করে আনন্দ পেতো। দারুণ সময় কাটতো তখন।

মনে আছে, আমি একবার ‘যেমন খুশি সাজো’তে বেদের মেয়ে সেজে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম। বেদে নারীদের সাপের খেলা দেখানো, শিঙা ফুকানো আমরা কত দেখেছি। ওসব দেখেই আমার হয়তো বেদে সাজার শখ হয়েছিল। দাদুবাড়িতে ঝাড়পোছের কাজ করতেন যিনি তাঁর ছিল রুপার গহনা। আমি বেদে সেজেছিলাম ওই গয়নাগুলো পরে এবং মুখে কাজল মেখে। ‘হে বাবু, দুইটা পয়সা দে’ বলে হাঁক দিয়ে টুকটাক জিনিসপত্র বিক্রি করে ওই সময়েই আমি ৫০ টাকা পেয়েছিলাম। তখন ৫০ টাকা মানে অনেক টাকা।

আমার সহপাঠী এবং অন্য বন্ধুরা অতো টাকা দেখে আমার কাছে খাওয়ার বায়না ধরেছিল। পয়সা থাকলে আমরা সাধারণত শিঙাড়া ও বাদাম খেতাম। কিন্তু সেদিন বেশি টাকা থাকায় সুধীর ঘোষের মিষ্টির দোকান থেকে বড় বড় রসগোল্লা কিনে খেয়েছিলাম। এমনিতে স্কুলে যাওয়ার সময় সুধীর ঘোষের মিষ্টির দোকানের দিকে লোভাতুর চোখে  তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে সুধীর কাকা আমাদের ডেকে পদ্মপাতায় হালুয়া খেতে দিতেন। সেই হালুয়া আমাদের কাছে অমৃতের মতো লাগতো। বিনেপয়সায় হালুয়া নিতে আমরা দ্বিধা করলে সুধীর কাকা বলতেন, তোরা আমার লক্ষ্মী। তোদের হালুয়া খাওয়ালে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আহা, অমন মানুষ কি আর এখন খুঁজে পাওয়া যাবে! এখন মানুষ লাভ বোঝে, আন্তরিকতা বোঝে না।

রায়পুরায় থাকতে আমরা চড়ুইভাতি করতাম। ময়মনসিংহে এসে সেটা হয়ে গেল বনভোজন। চুরি করে মুরগি ধরে বনভোজন করার মজাই ছিল আলাদা।

কালীপূজার সময় বেশ আনন্দ হতো। পূজার দিন আমরা খুব হইচই করে কাটাতাম। সন্ধ্যায় সারাবাড়ি মাটির প্রদীপ জ্বেলে সাজাতাম। মাইকে গান বাজানো হতো। লক্ষ্মীপূজার দিনও খুব মজা হতো। নাড়ু-মোয়া-তক্তি খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আমাদের মুসলিম বন্ধুরাও নাড়ু-মোয়া খেতে আসতো। তখন পাকিস্তান আমল হলেও চমৎকার সম্প্রীতির পরিবেশ ছিল। উৎসব-পার্বণে সবার অংশগ্রহণ ছিল। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ কম ছিল।

আমাদের ছোটবেলায় আরেক আনন্দের উপলক্ষ ছিল ভাইফোঁটা। ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। তখন বেশ শিশির পড়তো। ভোরবেলা ঘাসের ওপর জমা শিশির সংগ্রহ করতাম ভাইফোঁটার জন্য। কালীপূজার পরদিন ভাইফোঁটায় খাওয়া-দাওয়া হতো, বোনেরা ভাইদের কাছ থেকে কিছু উপহারও পেতো।

আমরা স্কুলে পড়ার সময়ই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নল হন মোনায়েম খান। তিনি ছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে তাঁর বাড়ি। গভর্নর হয়ে ময়মনসিংহ এলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। আমরা স্কুলের ছাত্রীরা সালোয়ার-কামিজ পরে, হাতে ছোট ছোট পতাকা নিয়ে রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মোনায়েম খানকে স্বাগত জানিয়েছিলাম।

পরে জেনেছি, মোনায়েম খান লোকটি খুব ভালো ছিলেন না। তাঁকে বটতলার উকিল বলা হতো। পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান একজন বশংবদ হিসেবে মোনায়েম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বানিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বাঙালির স্বার্থবিরোধী, আইয়ুব খানের চামচা। আইয়ুব খানকে তিনি ‘আমার প্রেসিডেন্ট’ বলে সম্বোধন করতেন।

মোনায়েম খানের বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে অনেক রসালো গল্প আছে। তিনি নাকি একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাইকে ডেকে নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত লিখতে বলেছিলেন।

মোনায়েম খান ছিলেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিদ্বেষী। তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বলেছিলেন, আপনি হয়েছেন উপাচার্য, আমাকে বানিয়েছেন আচার্য। আমার প্রেসিডেন্টকে কি ব্রহ্মাচার্য বানাবেন!

মোনায়েম খান ১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত আইয়ুব খানের অনুগ্রহে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরগিরি করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনের জন্য মুসলিম লীগের এই নেতাকে ১৯৭১ সালের ২৩ অক্টোবর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোজাম্মেল হক তাঁর বনানীর বাসভবনে ঢুকে হত্যা করেন। এভাবেই মোনায়েম খান তাঁর দালালির পুরস্কার পেয়েছেন।

চার

বালিকাবেলার ময়মনসিংহে রথযাত্রার কথাও বেশ মনে পড়ে। রঘুনাথজির আখড়া থেকে স্বদেশিপাড়া পর্যন্ত রথ টেনে আনা হতো। রথযাত্রা প্রধানত হিন্দুদের একটি উৎসব। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন ফেরার স্মরণে এই উৎসব আষাঢ় মাসে পালন করা হয়। আমরা অবশ্য রথযাত্রাকে সেভাবে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে দেখতাম না। তেমন বুঝতামও না। রথ, যা কি না, আসলে একটি বিশেষ যান, দড়ি ধরে টানলে সেটা চলে। ছোট-বড় সবাই টেনে রথ এগিয়ে নিয়ে যেতো। আমার মতো ছোটদের কাছে এটা যতটা না ধর্মীয় আচার ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল উৎসবের আমেজ। তাছাড়া আমার মনে আছে, শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নয়, অনেক মুসলমানও রথযাত্রায় শামিল হতেন। দড়ি টেনে আনন্দ করতেন। রথ চলতো আর বাতাসা,  চাঁপাকলা ও লটকান ছিটিয়ে দিতেন পুণ্যার্থীরা। আমরা ছোটরা সেগুলো সংগ্রহ করে মজা করে খেতাম। লটকনের সঙ্গে নাকি রথযাত্রার বিশেষ সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কটা কী তা আমি তখনো জানতাম না, এখনো জানি না ।

আমি যখন ফোর-ফাইভে পড়ি, তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান আমার পছন্দের তালিকায় স্থান পায়। তখন সব গানের অর্থ হয়তো বুঝতাম না, তবে বাণী ও সুর আমাকে মুগ্ধ করতো। ওই রথযাত্রার সময়ই হয়তো প্রথম কারো কাছে শুনেছিলাম :

রথ ভাবে আমি দেব

পথ ভাবে আমি

মূর্তি ভাবে আমি দেব

হাসে অন্তর্যামী।

সবাই যখন রথের দড়ি ধরে টানতো, আমার মনে হতো দেবতা বুঝি মর্তে এসে মানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন। বড় হয়ে আরো বুঝেছি :

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক

কে বলে তা বহুদূর

মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক

মানুষেতে সুরাসুর।

রথের সময় মেলা বসতো। সে-মেলায় মাটির তৈরি নানা রকম পুতুলসহ খেলার সামগ্রী বিক্রি হতো। আমাদের কাছে পুতুলের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল মেলার গরম গরম জিলেপি। রথের মেলার জিলেপির স্বাদই আলাদা ছিল।

আরো একটি উৎসব-আয়োজনের কথা বেশ মনে পড়ে। সেটা হলো ঝুলনযাত্রা। এটাও শ্রীকৃষ্ণের অনুগামীদের একটি উৎসব। এটি মূলত দোল পূর্ণিমা-পরবর্তী বৈষ্ণবদের বড় উৎসব। দোলনা সাজিয়ে তাতে রাধা-কৃষ্ণের ছবি বা মূর্তি বসিয়ে এই উৎসব সাধারণত শ্রাবণ মাসে পালন করা হয়। দ্বাপরযুগে বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে এই ঝুলন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। তবে আমার কাছে এটা ঠিক পূজাপার্বণের মতো  ছিল না। ছিল নিছক আনন্দ-আয়োজন, একটি সামাজিক সমাবেশ। বাড়ির বৈঠকখানায় আমরা দোলনা বানিয়ে তাতে পুতুল বসিয়ে সুন্দর করে সাজাতাম। কাঠের গুঁড়ায় রং মেখে পাহাড়ের মতো বানাতাম। ঝুলন উৎসব শ্রাবণের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত – পাঁচদিন ধরে চলতো। পাড়ার অন্য মেয়েরাও এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতো। পাঁচটি দিন কী যে আনন্দে কাটতো। ধর্মীয় বিধানের চেয়ে এটা আমার কাছে ছিল বরং একটি বার্ষিক বিনোদন।

এর বাইরে আমার কাছে বিশেষ আনন্দের সময় ছিল দুর্গাপূজা এবং ডিসেম্বরে বড়দিনের ছুটি। এই ছুটির সময় আমি রায়পুরায় আমাদের বাড়িতে যেতাম এবং আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপড়শি, পরিচিত সমবয়সীদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে মেতে থাকতাম। দুর্গাপূজার বিষয়টি ছোট থেকেই বুঝতাম। পূজার আয়োজন দেখতাম। নতুন জামাকাপড় পেয়ে উল্লসিত হতাম। শুধু মন্দিরে নয়, অনেকের বাড়িতেও দুর্গাপূজা হতো। প্রতিমাদর্শন, সন্ধ্যায় আরতি দেখার জন্য এ-পাড়া ও-পাড়া ঘোরা ছিল একটি মজার বিষয়। তবে বড়দিন কী তা ঠিক বুঝতাম না। ঠাকুরমার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলতেন, দিনরাত সমান হওয়াকে নাকি বড়দিন বলে! ছোটবেলায় আশেপাশে মসজিদ, মন্দির দেখলেও কোনো গির্জা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গেও দেখা হয়নি। তবে বড়দিন উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে ঝুড়িভর্তি কমলা আনা হতো। বড় বড় মিষ্টি কমলা খাওয়ার মধ্যেই আমাদের বড়দিনের আনন্দ সীমাবদ্ধ থাকতো।

ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আরো একটি আকর্ষণ ছিল ট্রেনে চড়ার সুযোগ পাওয়া। ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ পার হওয়ার সময় কী যে ভালো লাগতো। ব্রিজের ওপর ট্রেন উঠলে একটি আলাদা শব্দ হতো। কেমন যেন বাদ্যযন্ত্রের সুরধ্বনির মতো লাগতো। গম্ গম্ করতো। ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে অপেক্ষা করতাম মেঘনা ব্রিজের একই রকম ধ্বনিতরঙ্গ শোনার।

ঠাকুরমার সঙ্গে তাঁর বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সুযোগও ছুটির সময়ই পাওয়া যেতো। আমরা মেথিকান্দা থেকে ট্রেনে উঠে খানাবাড়ি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে দেড় মাইল পথ অন্য বাহনে গিয়ে ঠাকুমার গ্রাম হাইরমারায় পৌঁছতাম। তবে নৌকা করে ঠাকুরমাদের গ্রামে যাওয়া ছিল বেশি মজার। নৌকায় চলাচল আমার খুব ভালো লাগে। জলের ওপর ভেসে চলার আনন্দই আলাদা। লগি-বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এবং নৌকার মৃদু দুলুনি মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি তৈরি করতো। প্রকৃতির অকৃত্রিম সান্নিধ্যে মন প্রফুল্ল­ হয়ে উঠতো। মাঝিমাল্লারা যখন গলা ছেড়ে গান ধরতেন : মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে, আমি আর বাইতে পারলাম না – তখন ওই ছোট বয়সেও মনের মধ্যে শিহরণ তৈরি হতো। নদীর জলের কুলুধ্বনির সঙ্গে মাঝিদের দরদি কণ্ঠের গান মিলেমিশে একাকার হতো। সমস্ত পরিবেশটাই অন্যরকম হতো। গুন টেনে নৌকা এগিয়ে নিয়ে মাঝিরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঠাকুরমা তাঁদের একটু জিরিয়ে নিতে বলতেন। তাঁদের গুড়-মুড়ি খেতে দিতেন। পরিতৃপ্তির সঙ্গে সেগুলো খেয়ে তাঁরা আবার নতুন উদ্যমে নৌকা বাইতে শুরু করতেন।

ঠাকুরমা তাঁর বাড়ির এলাকায় ব্যাপক পরিচিত ছিলেন। তাঁকে সবাই বিনুর মা বলে চিনতো। ঠাকুরমার দুই ভাই ছিলেন এমবিবিএস ডাক্তার। ডা. শ্রীশ পাল এবং ডা. মনমোহন পাল। তাঁরা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেছিলেন। দুই ভাইয়েরই যশখ্যাতি ছিল যথেষ্ট। ঢাকার বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. নন্দী ছিলেন শ্রীশ পালের বন্ধু। ঠাকুরমার আরেক ভাই অনঙ্গ পাল খুব ভালো বেহালা বাজাতেন।

আমার বাবার এক মামাতো ভাইয়ের ছেলে শংকর পাল মনিপুর স্কুলের একজন ভালো ছাত্র ছিল। আমার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। শংকর আমার থেকে বয়সে একটু ছোট ছিল। তবে আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা, এমনকি মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাটিও করেছি।

শংকরের বাবা পাকিস্তান আমলেই কলকাতা চলে যান। শংকরের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে মুক্তিযুদ্ধের পর আবার আমাদের যোগাযোগ হয়। শংকর পরিসংখ্যানে ডক্টরেট করেছে আমেরিকা থেকে। কিছুদিন নাসাতেও চাকরি করে আবার কলকাতায় ফিরে এসে বরাহনগর পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউশনে পরিচালক পদে চাকরি করেছে।

শংকর গত কয়েক বছরে তিন-চারবার ঢাকায় এসেছে। প্রতিবার আমার বাসায় উঠেছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে বহু বছর পর আমিও হাইরমারা গ্রামে গিয়েছি। ওদের বাড়িঘর কিছু আর এখন নেই। তবু স্মৃতিতাড়িত হয়ে গাড়িতে করে সারা গ্রাম ঘুরে দেখেছে। ছোটবেলার কত কথা তার মনে পড়েছে আর আমার কাছে ঝাঁপি খুলে তা বয়ান করেছে। মানুষ সততই স্মৃতিকাতর। খানাবাড়ি রেলস্টেশনে গিয়ে একটি খাম্বা দেখে শংকর আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। ও যখন কলকাতায় চলে যায় তখন ওকে বিদায় জানাতে এসে ওর দাদু ওই খাম্বা ধরে নাকি অঝোরে কেঁদেছিলেন। বহু বছর আগের সেই ঘটনা মনে হওয়ায় শংকরেরও চোখের জল বাধা মানেনি।

ভারত সরকার শংকরকে পদ্মশ্রী খেতাব দিয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির হাত থেকে এই সম্মাননা গ্রহণ করেছে শংকর। ওর সাফল্যে আমি যারপরনাই খুশি। শংকর এখন দাবি করে, ও আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমি ওকে বলেছি, তুমি অবশ্যই জ্ঞানে-মানে আমার চেয়ে অনেক বড়। বয়সের ছোট-বড় হওয়া না-হওয়ায় কি আসে-যায়!

ছোটসময়ের আরো একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচিতি ও সম্পর্কের কথাও আমার খুব মনে পড়ে। আশুগঞ্জে তিতাস নদীর পাড়ে লালপুরের একটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। পরিবারের কর্তা লালপুরের একজন বড় ব্যবসায়ী সূর্যকান্ত চৌধুরী। তিনি আসলে চট্টগ্রামের মানুষ। ব্যবসার কারণে তিনি সপরিবার একসময় লালপুর থাকতেন। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।  কীভাবে এই বন্ধুত্ব তা আমার আর মনে নেই। তবে সূর্যকান্ত চৌধুরী আমার ঠাকুরমাকে মা বলে ডাকতেন। দুই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ এবং যাতায়াত ছিল। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে অন্যদের সঙ্গে আমিও তাঁদের বাড়িতে গিয়েছি। সূর্যকান্ত চৌধুরীর ছেলেময়েদের সঙ্গেও আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল। বেশ মনে আছে, সূর্যকান্ত বাবুর এক ছেলে সুকাশ আমার পেছনে ঘুরঘুর করতো। তার একটি ক্যামেরা ছিল। সেই ক্যামেরা দিয়ে আমাদের ছবি তুলতে তার উৎসাহের কমতি ছিল না। তবে আমি তাকে খুব একটা পাত্তা দিয়েছি বলে মনে পড়ে না।

বহু বছর পর সুকাশ আমাকে খুঁজে বের করেছে। এখন তারা চট্টগ্রামেই থাকে। ঢাকায় তার এক আত্মীয়ার বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি তার নিমন্ত্রণ রক্ষাও করেছি। সুকাশ জানিয়েছে, সে নাকি আমার প্রেমে পড়েছিল! সেই একতরফা বাল্যপ্রেমের কথা শুনে এখন কি আর শিহরিত হওয়ার সময় আছে!

সুকাশ এখন গুরুতর অসুস্থ। তাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। করোনার প্রকোপ কমলে যেতে চাই। জানি না, এ-ইচ্ছা পূরণ হবে কি না! (চলবে)