আজিমপুর কলোনি একটি পথপ্রদর্শক প্রকল্পের গোাড়র কথা

আজিমপুর কলোনি সম্ভবত এদেশে বহুতলবিশিষ্ট গুচ্ছ আবাসনের প্রথম প্রকল্প। ১৯৪৭-এর ভারতবর্ষ বিভাজনপূর্র্বকালে এই ভূখ-ে একতলা বা দোতলা বাংলো ধরনের পাকা আবাসিক ভবন নির্মাণের সূত্রপাত হলেও বহু পরিবারভিত্তিক বসবাসের জন্য তিন-চার তলাবিশিষ্ট ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘আজিমপুর এস্টেট’ হিসেবে পরিকল্পিত আজিমপুর কলোনি সম্ভবত এখানে পথিকৃৎ। এই আজিমপুর কলোনির সূচনাপর্ব থেকে সফল  বাস্তবায়নে অতিক্রান্ত সমস্যা ও সমাধানের  বিষয়াবলি সম্পর্কে জানতে পারা যায় তৎকালে সরকারের পূর্ত দপ্তরে দায়িত্ব পালনকারী স্থপতির লেখা একটি প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে। অধুনা প্রধান স্থপতি বা চিফ আর্কিটেক্ট পদবিটি উত্তর-১৯৪৭-এ কনসালটিং আর্কিটেক্ট (Consulting Architect) হিসেবে পরিগণিত ছিল। ব্রিটিশ স্থপতি কোলম্যান হিকস্ ভারত বিভাগ-পরবর্তী সময়ে পূর্ববাংলা সরকারের কনসালটিং আর্কিটেক্ট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তৎকালীন ঢাকা শহরের অনেক সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে আজিমপুর এস্টেটও তাঁর স্থাপত্য পরিকল্পনা ও ডিজাইনে গড়ে ওঠে। ১৯৪৮-৪৯-এ বিরাজমান ভবন নির্মাণ কর্মকাণ্ডের সীমাবদ্ধতা এবং আবাসিক ভবনের পরিকল্পনায় ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আরোপিত রক্ষণশীলতা বিষয়ে তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধ থেকে ধারণা পাওয়া যায়।

১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের ফলে ঢাকা তৎকালীন পূর্ববাংলা প্রদেশের রাজধানী হিসেবে পরিণত হয়। নবঘোষিত রাজধানী শহরে সরকারি দপ্তরাদির সংস্থান ও কর্মচারীদের বাসভবনের জোগান দেওয়া একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। তৎকালীন মফস্বল শহর ঢাকায় এ-কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অবকাঠামো কিংবা ভবনাদি বিদ্যমান ছিল না। কলকাতা থেকে ভাগ হয়ে আসা সরকারি দপ্তর ও কর্মচারীদের বাসস্থানের তাৎক্ষণিক চাহিদা সামাল দেওয়ার জন্য তোপখানা রোড এবং নবাব আব্দুল গনি রোডের মধ্যবর্তী স্থানে বছরদুয়েক আগে নির্মিত ইডেন গার্লস স্কুল ও কলেজের ক্যাম্পাসে সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র তথা প্রাদেশিক সচিবালয় স্থাপন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে শহরের বিভিন্ন স্থানে মিত্রবাহিনী-নির্মিত আধাপাকা সামরিক ব্যারাকে সরকারি কর্মচারীদের সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এ-ধরনের ব্যারাকের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত অপ্রতুল এবং এগুলোকে স্থায়ীভাবে বাসভবনে রূপান্তরের কোনো সুযোগ ছিল না। তা সত্ত্বেও প্রাথমিক চাহিদা মেটানো ও চাপ লাঘবের জন্য শুরুতে সরকারকে নতুনভাবে এ-ধরনের আরো অস্থায়ী ও কাঁচা বাসস্থান গড়ে তুলতে হয়েছিল।

ঘরবাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে গাঙ্গেয় অববাহিকার এই নিম্নাঞ্চলে স্থানীয় এবং সস্তা পদ্ধতি হিসেবে বাঁশ-নির্মিত কাঠামো অধিক প্রচলিত ছিল। সাধারণত কাঠের খুঁটি, ফ্রেম, ট্রাসের ওপর বাঁশের তৈরি তরজা বেড়া দিয়ে দেয়াল আর বাঁশের চাটাই, টিন বা কাঠের টুকরো (shingles) দিয়ে ছাদের ছাউনি তৈরি করা হতো। সাতচল্লিশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য এ-ধরনের কাঁচা স্থাপনা নির্মাণ ছাড়া অন্য কোনো উপায় হয়তো খোলা ছিল না। তবে সরকারি অফিস বা দপ্তরাদি স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে লভ্য সামান্য নির্মাণসামগ্রী দিয়ে পাঁচ-দশ ইঞ্চি ইটের দেয়ালের ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। সে-সময় বিদ্যমান সংকট বিবেচনায় বিদেশ থেকে সহায়তা হিসেবে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং দেওয়ার প্রস্তাব অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল। দেশের নির্মাণশিল্পে স্থানীয় প্রযুক্তি ও কর্ম দূরদর্শিতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিদেশি কারিগরি সহায়তার প্রস্তাব বিবেচনা-বহির্ভূত রাখা হয়। তুলনামূলক হিসাব করে দেখা গিয়েছিল কাঁচা, আধাপাকা ও

প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বাড়ির প্রতি বর্গফুট নির্মাণব্যয় যথাক্রমে ৪ টাকা ৭ আনা, ৫ টাকা ৮ আনা এবং ৯ টাকা ৮ আনা।

অস্থায়ী ধরনের নির্মাণ দিয়ে সাময়িক প্রয়োজনীয়তার সমাধান হলেও সরকার দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলার দিকে সচেষ্ট হয়। স্থায়ী ভবন নির্মাণে প্রধান যে-সমস্যাগুলো দৃশ্যমান হলো তার মধ্যে ছিল নির্মাণকাজে ব্যবহার্য্য সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা। ভৌগোলিক বিবেচনায় পূর্ববাংলার অবস্থান বেশ দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়। ভারত-পাকিস্তানের সীমানা কার্যকর হওয়ার পর দেখা গেল পাথর, বালি, সিমেন্ট, নুড়ি, লোহা যেখানে সহজলভ্য তার সবই ভারতের অংশে পড়েছে। পূর্ববাংলায় ইট পোড়ানোর জন্য কোনো কয়লা ছিল না। সদ্যসমাপ্ত বিশ্বযুদ্ধে অপরিমিতভাবে গাছ কেটে ফেলায় এমন অবস্থা হয়েছে যে, বৃক্ষাদি যুদ্ধের পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে কয়েক যুগ প্রয়োজন। পূর্ববাংলার একটি মাত্র সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম, যেখানে একত্রে মাত্র তিনটি জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ ছিল। এসব সমস্যার ওপর অতিরিক্ত সংকট হয়ে দেখা দেয় লোহা বা স্টিলের অপ্রাপ্যতা। সে-সময়ে কোনো দেশই প্রথমত নিজ প্রয়োজনের আলোকে এবং দ্বিতীয়ত চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ নোঙরের সমস্যার কারণে কোনো ইউরোপীয় দেশই রড নির্মাণের সামগ্রী স্টিল রফতানির নিশ্চয়তা দিতে রাজি ছিল না। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না। কারণ এগুলোর ইঞ্জিনে কয়লা থেকে জ্বালানি তেলে রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। সড়ক-যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল ছিল। ঢাকা শহরের ১২ মাইল ব্যাসার্ধের বাইরে যাতায়াত পথ নদীর কারণে বাধাগ্রস্ত ছিল। এছাড়া রেলের ইঞ্জিন ও ওয়াগন সংখ্যা শূন্যের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।

১৯৪৭-এ ভারতভাগের প্রায় এক বছর পর বালি, সিমেন্ট ও কয়লা সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। তবে আর্থিক সংকটের কারণে লোহার জোগান অসম্ভবই রয়ে যায়। কিন্তু বাসস্থানের অভাব প্রকট রূপ ধারণ করায় আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। সরকারি কর্মচারীদের আবাসিক চাহিদা নিরসনের জন্য ঢাকা শহরের আজিমপুর এলাকায় প্রথম প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে বিশাল এলাকা জুড়ে আজিমপুর এস্টেট থাকলেও সর্বপ্রথম হাতে নেওয়া প্রকল্পটি ছিল আজিমপুর রোডের  দক্ষিণাংশে। বোঝার সুবিধার্থে এখানে উপস্থাপিত সাইট প্ল্যান নকশাটি দেখা যেতে পারে। মূলত আজিমপুর চৌরাস্তার (ইডেন কলেজ মোড়)

পশ্চিম-দক্ষিণ এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। পরবর্তীকালে ১৯৫০-এর দশকে আজিমপুর রোডের উত্তর পাশ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকায় এই সরকারি আবাসনের বিস্তার ঘটানো হয়। ১৯৪৯-এর সাইট প্ল্যানে ‘ঢাকা কলেজ’ চিহ্নিত স্থানটি পরে আজিমপুর মাতৃসদন এবং আজিমপুর গার্লস স্কুলের জন্য বরাদ্দ করা হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও এ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে।

সরকারের পূর্ত দপ্তরে এ-সময়ে স্থানীয়ভাবে লভ্য নির্মাণ উপকরণাদি ব্যবহার করে নির্মাণকাজের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্ভাব্য নির্মাণে খিলানাকৃতি ছাদ (vaulted roof), বাঁশ-দৃঢ়ীকৃত কংক্রিট (bamboo reinforced concrete)  ইত্যাদি প্রয়োগ বিষয়ে

পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কিন্তু অত্যধিক ব্যয় অথবা দীর্ঘ সময়ব্যাপী ব্যবহারিক ইতিহাস বা অভিজ্ঞতার অভাবে এসব প্রযুক্তির ব্যবহার অনুমোদন বাদ দেওয়া হয়। ভারবাহী দেয়ালের (load-bearing wall) ওপর সাধারণ আরসিসি ছাদ নির্মাণপদ্ধতি ব্যবহারের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও

রড-সংকটের কারণে এক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে দেশে লভ্য যৎসামান্য রডের ভাণ্ডার অধিকতর জরুরি ওভারহেড পানির ট্যাঙ্ক নির্মাণে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। অনেক বিচার-বিশ্লেষণের পর অবশেষে বিকল্প হিসেবে পাকা ভবন নির্মাণে একটি বিশেষ উপকরণের ব্যবহার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে বিমান উড্ডয়নস্থলে ব্যবহারের জন্য মার্কিনিদের আনা এক ধরনের ছিদ্রযুক্ত হালকা ঢেউ খেলানো স্টিল ম্যাট (Marston mat)। এসব ম্যাট যুদ্ধবিমান অবতরণস্থলের রানওয়ে এবং এদেশের কাদাপ্রধান মাটিতে যানচলাচলে ভার বহন ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে আনা হয়েছিল এবং যুদ্ধশেষে এ বস্তুটি প্রচুর উদ্বৃত্ত ছিল। অন্যত্র পুনর্ব্যবহারের সম্ভাব্যতার ক্ষেত্রে এসব ম্যাটের ওজন ও পরিবহন ব্যয় বিবেচনায় বাণিজ্যিক মূল্য লাভজনক ছিল না। (এ-ধরনের ছিদ্রযুক্ত স্টিল ম্যাট আমাদের দেশের সেনা ছাউনিগুলোয়  বেষ্টনী দেয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখা যেত)। ১০© ©- ০© ©´ ৫© ©-৩© © (দশ ফুট দৈর্ঘ্য আর পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি প্রস্থ) পরিমাপবিশিষ্ট এসব স্টিল শিট ঢেউটিনের আদলে তিনটি অনুচ্চ ঢেউ (treble ribbed) এবং ন্যূনতম দৃঢ়তা দেয় এমন বিন্যাসে বড় গোলাকৃতি ফুটোবিশিষ্ট (hole) ছিল। আরসিসি ছাদে রডের পরিবর্তে এই সহজলভ্য সামগ্রী ব্যবহারের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর সবশেষে সর্বোচ্চ

৯© © ©- ৬© © স্প্যানের আরসিসি কংক্রিট স্লাব নির্মাণের জন্য ব্যবহারযোগ্য বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। স্প্যান বা ছাদের প্রস্থ বিস্তারের এই সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে প্রস্তাবিত ফ্ল্যাটের স্থাপত্য নকশা চূড়ান্ত করা হয়। প্রস্তাবিত ধরনের ছাদে (marston mat)এর ব্যবহারপদ্ধতি প্রদর্শিত নকশায় দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে ছাদে পাখা ঝোলানোর জন্য হুক লাগানোর প্রক্রিয়াটি দৃষ্টিপাতযোগ্য।  তৎকালে দুই রুম (এক শয়নকক্ষ) এবং তিন রুম (দুই শয়নকক্ষ) বিশিষ্ট দুধরনের তিনতলা ফ্ল্যাটের পরিকল্পনা করা হয়। এগুলোর মেঝের ক্ষেত্রফল ছিল যথাক্রমে ৯০৪ ও ১২০৮ বর্গফুট।

পরিকল্পনা প্রণয়নকারী ব্রিটিশ স্থপতির কাছে এদেশের বাসভবনে ধর্মীয় ও সামাজিক চাহিদা অদ্ভুত মনে হয়েছিল। তাঁর জবানীতে দেখা যায়, চল্লিশের দশকের শেষ লগ্নেও এখানে অনুসৃত মেয়েদের পর্দাব্যবস্থা পাশ্চাত্যে অজানা ছিল। পর্দা এখানে কঠোরভাবে মানা হতো। স্নানাগার বা শৌচাগারের পাশে রান্নাঘরের অবস্থান অনুমোদনযোগ্য ছিল না। শয়নকক্ষের সঙ্গে বারান্দা থাকা জরুরি ছিল; কিন্তু বারান্দায় উপবিশিষ্ট কোনো মহিলাকে বাহির থেকে যেন না দেখা যায় সে-ধরনের রেলিং বা জালি স্থাপনের আবশ্যকীয়তা ছিল।  স্নানকক্ষ বা শৌচাগার অবশ্যই পৃথক করার নির্দেশ ছিল।

সাধারণ পর্যায়ে তখনো টেবিল-চেয়ারে বসে খাওয়ার রীতি চালু হয়নি। রান্নাঘর বা তৎসংলগ্ন কোনো স্থানে মেঝেতে আসন পেতে খাবার গ্রহণের রেওয়াজ ছিল। অর্থাৎ ফরমাল লিভিং কাম ডাইনিং বা পৃথক খাবার কক্ষের ধারণা অপ্রচলিত ছিল। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার কারণে মক্কা বা পশ্চিম দিকে সম্মুখ বা পশ্চাৎ বিবেচনায় শৌচাগার স্থাপন সম্ভব ছিল না। শয়নকক্ষের বিন্যাস পশ্চিম দিকে পা দিয়ে শুতে হয় এমনভাবে করা বারণ ছিল (এটি অবশ্য এখনো অনুসৃত হয়)। এর ফলে বাসভবনের বিন্যাস পরিকল্পনায় উন্মুক্ততার (flexibility) পরিবর্তে অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয়। এসব কারণে তৎকালে চালু ইউরোপীয় মান বা কোডের সঙ্গে এদেশে পরিলক্ষিত ভবন নকশার তুলনা বা মূল্যায়ন করা সম্ভব ছিল না। স্থানীয় পরিবেশ ও জলবায়ুর কারণে কক্ষের অভ্যন্তরে বায়ু ও সূর্যের আলো প্রবেশের জন্য সানশেডসহ খোলা জানালা, চোরের উপদ্রব থেকে রক্ষার্থে বিশেষ করে নিচতলায় গ্রিল স্থাপন, বৃষ্টির পানি ও মল নিষ্কাশন পাইপ বেয়ে ওপরে ওঠার সম্ভাবনা নাকচ করার জন্য ভবনের বহির্ভাগের পরিবর্তে নিরাপত্তাজনিত কারণের অন্তর্ভাগে বা দেয়ালে প্রোথিত করে স্থাপন করা হয়েছিল।

সবদিক বিবেচনান্তে নকশা ও নির্মাণ দলিলাদি চূড়ান্ত করার পর নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগকালে দেখা যায় যোগ্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এমনকি শেষ পর্যন্ত ছয়জন ঠিকাদারের মধ্যে কাজ বণ্টন করা হলেও মাত্র দুজনের এ-ধরনের বড় নির্মাণকাজের (তিনতলা ভবন!) পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল। এমনকি নির্মাণের অভিজ্ঞতা না থাকায় ফাঁকা দেয়াল বা cavity wall বাদ দিতে হয়েছিল। সাধারণ ইট, বালু, সিমেন্টের বাইরে বিশেষ কোনো নির্মাণ-উপকরণ পাওয়া কঠিন ছিল। তাও সব সামগ্রী সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত ছিল। ভবন নকশাকালে প্রস্তাবিত অনেক সূক্ষ্ম বিশদ (detail), অলংকরণ, ফিনিশ সামগ্রী পরবর্তীকালে বাদ দিয়ে সহজলভ্য এবং সহজ নির্মাণ সম্ভব বিকল্প অনুসরণ করে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছিল। ক্ষেত্রবিশেষে প্রকল্প ব্যয় সংকোচনের স্বার্থেও কিছু উপকরণ বাদ দিতে হয়।

‘আজিমপুর এস্টেট’ নির্মাণ প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি পথ-প্রদর্শনকারী (pioneering) পদক্ষেপ হিসেবে

গ্রহণ করা হয়। এশিয়ার অন্যান্য দেশে নির্মাণশিল্প যখন স্থবিরপ্রায়, সেখানে এই অনগ্রসর পূর্ববাংলার ঢাকা শহরে সম্পূর্ণ প্রকল্পটি রেকর্ড সময়ে শেষ করা হয়। চারটি ব্লকে

তিন কক্ষবিশিষ্ট ৪৮টি এবং ৩৮টি ব্লকে দুই কক্ষবিশিষ্ট ৪৫৬টি ফ্ল্যাট এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিল। আবাসিক ঘনত্ব অর্জিত হয় একরপ্রতি ৮৫ জন। ১৯৪৯-এর জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ওই বছরের অক্টোবরে সমাপ্ত এ-প্রকল্পে থেকে দেখা যায়, গড়ে প্রতিদিন প্রায় দুটি ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় ছিল কোটি নয়, মাত্র ৭৫ লাখ টাকা! তৎকালে নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের উদ্যমী প্রকৌশলীদের দক্ষতা ও কর্মকুশলতায় এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশাল আবাসিক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছিল। বিশেষত ইমারত নির্মাণ দপ্তরের প্রথম প্রধান প্রকৌশলী খান বাহাদুর মো. সুলায়মান সিআইইর নেতৃত্ব প্রকল্পটির সফল সমাপ্তির অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। আজিমপুর কলোনি তাই গণ্য হতে পেরেছিল পরবর্তীকালে এদেশে বাস্তবায়িত অসংখ্য সমজাতীয় সরকারি আবাসিক এলাকার পথপ্রদর্শক প্রকল্প হিসেবে।

 

লন্ডন থেকে প্রকাশিত BUILDING-November 1950   সাময়িকীতে  Coleman Hicks- ÔFlats in DaccaÕ প্রবন্ধ অনুসরণে।