‘শিল্প’ – যার উন্মেষ মানুষের জীবনকে ঘিরে এবং মানুষের আবেগ, অনুভূতি, অভিব্যক্তি ও জীবনের বিচিত্র ব্যঞ্জনারই নান্দনিক প্রকাশ হলো শিল্প।

সমসাময়িককালে শিল্প অনেক ব্যাপক এবং বহুধাবিস্তৃত। নানা মাধ্যমে নানা উপকরণে মিশ্রিত শিল্পের নব নব রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি নানাভাবে। নবীন-প্রবীণ সব শিল্পীই নিজস্ব কাজের সৃষ্টিশীল ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন তাদের নতুনতর ভাবনাচিন্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে।

গত ৬ থেকে ১০ এপ্রিল ২০১৮-তে চট্টগ্রামের জামালখানের জার্মান ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র ‘ডি স্প্রাখে’তে ‘বন্ডেজ’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শিল্পী কিংশুক দাশ চৌধুরী ও শিল্পী শর্মিলা কাদেরের যৌথ চিত্র-প্রদর্শনী। ক্যানভাসের রং-তুলির ছোঁয়ায় নান্দনিক সব শিল্পকর্মের সমারোহ দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে নজর কেড়েছে।

পৃথিবী, প্রকৃতি, পরিবার, মানুষ ও পারিপার্শ্বিক জগতের প্রত্যেক কিছুর সঙ্গেই মানুষ নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। জাগতিক নিয়ম অনুযায়ী এ-বন্ধনকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো নেই।

আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগতে আমরা যা দেখছি, অনুভব করছি, অনুধাবন করছি তা আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিযন্ত্রে প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতালব্ধ নানা ঘটনা, নানা চাহিদা, সমাজ ও ধর্মকে পুঁজি করে ভ-ামির যে-খেলা শিল্পী প্রত্যক্ষ করেন এবং যা শিল্পীর জিজ্ঞাসু মন ও অনুভূতিকে নাড়া দেয় সেসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলি ও অনুভবের বিষয়াবলি, অবচেতন মন ও মস্তিষ্কে ভাসতে থাকা সেসব টুকরো টুকরো ছবি যার বন্ধন থেকে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুক্তি লাভ করা যায় না তাই শিল্পী কিংশুক তার ক্যানভাসে রূপদান করেছেন। প্রদর্শনীতে তেলরং, অ্যাক্রিলিক ও ওয়াশনির্ভর জলরং মিলিয়ে শিল্পীর মোট ২২টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়। কাজগুলোতে আমরা দেখি, অল্পমাত্রার বর্ণের প্রয়োগ, আধাবিমূর্ত মানব শরীরী অবয়ব বিভিন্ন অবজেক্টের উপস্থাপনা, কতক চিত্রে জ্যামিতিক ফর্মের ব্যবহার এবং বেশকিছু ছবিতে ওয়াশের ওপর সাবলীলভাবে সরু ও মোটা রেখানির্ভর কাজ, ফর্মের বিভাজনে, বর্ণপ্রয়োগে মনের অনুভূতিগুলোকে ক্যানভাসে মেলে ধরেছেন নিজস্ব স্বকীয়তায়। সব মিলিয়ে কাজগুলোতে শিল্পী হৃদয় ও মস্তিষ্কের অতল গভীরতর পর্যায়ের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতির চমৎকার অবয়বিক বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

শিল্পী কিংশুক দাশ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাপচিত্র শাখায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ভারত, আমেরিকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ‘ইন সার্চ অব এফিনিটি’, ‘সাইলেন্ট ডায়ালগ’সহ বিভিন্ন শিরোনামে আরো সাতটি একক ও ৪৫টির মতো দলীয় প্রদর্শনীতে শিল্পীর অংশগ্রহণ রয়েছে।

‘বন্ডেজ’ যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী আরেকজন শিল্পী হলেন শর্মিলা কাদের। তিনি ১৯৮০ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাপচিত্র শাখায় ২০০৭ সালে সম্মানোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। প্রদর্শনীতে শিল্পীর অ্যাক্রিলিকে করা ১০টি চিত্রকর্ম স্থান লাভ করে।

শিল্পী শর্মিলা কাদের এর কাজে বন্ডেজ শব্দটি ধারণ করেছে অন্যমাত্রা। চিত্রকর্মগুলোতে লক্ষ করার মতো বিষয় হলো – ক্যানভাসের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে ড্রাফারির ব্যবহার এবং স্থানে স্থানে নানা ভঙ্গিময় মানব-মানবীর শরীরের অবস্থান। কাজগুলোতে উড়ন্ত কাপড়ের বাঁধন দেখে মনে হতে পারে, স্বাধীনতার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা। লাল-সবুজ, কমলা-নীল প্রভৃতি বিপরীতধর্মী রঙের ব্যবহারও আমাদের সে-ইঙ্গিত প্রদান করে। কিন্তু শিল্পীর ভাষায় কাজগুলোতে ভিন্ন অর্থ বিরাজমান। মানুষ কখনো স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে না। জীবনের এগিয়ে চলার পথ বড়ই সংকীর্ণ, কণ্টকাকীর্ণ ও বাধাবিপত্তিময়ের মধ্য দিয়েই মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়, বাঁচতে হয়। নিজের মতো করে স্বাধীনতা, সুখ ও আনন্দের সন্ধান করতে হয়। এই বাধাকে প্রতিহত করে জীবনকে অর্থময় ও উপভোগ্য করে তুলতে মানুষে মানুষে পারস্পরিক বন্ধন যতই মজবুত হয়, সফলতার পথ ততই পোক্ত ও সুগম হয়। শিল্পীর কাজে বন্ডেজ শব্দটির অন্তর্নিহিত শক্তি চিত্রিত ভাষায় বিভিন্নভাবে রূপ লাভ করে। উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ও নানান ভঙ্গিমায় মানব শরীরের দৃশ্যায়নের মাধ্যমে শিল্পী শর্মিলা কাদেরের সৃষ্ট এই শিল্পকর্মগুলোতে আমরা ইতিবাচক দিকনির্দেশনা প্রত্যক্ষ করি।

মানুষ সামাজিক জীব এবং শিল্প হলো সামাজিক প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। সামাজিক প্রেক্ষাপট, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের বিভিন্ন দিক প্রকাশিত হয় মানুষের বিচিত্রসব কল্পনায়।

‘বন্ডেজ’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত শিল্পী কিংশুক দাশ চৌধুরী ও শিল্পী শর্মিলা কাদেরের এ যৌথ প্রদর্শনীর শিল্পকর্মগুলো দৃষ্টিনন্দন, উপভোগ্য ও শৈল্পিক শাশ্বত গুণসম্পন্ন।