আঞ্চলিক ভাষার আন্তরশক্তির অন্বেষণ

কাজী রাফি

 

লিয়র ভেজা চান্দের সবোন

শোয়েব শাহরিয়ার

নিসর্গ

ঢাকা, ২০১৮

৬০ টাকা

‘কবিতার ভিতরের দৃশ্যকল্প এবং চেতনাকে আলাদা করো, কবিতার ভঙ্গিমা হারিয়ে যাবে; ধ্বনি এবং ছন্দের আবহ অনুকরণ করো, হারিয়ে যাবে বিষয়বস্ত্ত। অক্ষরগুলোকে যদি ধরতে পারো, মিলিয়ে যাবে তোমার আত্মা, কবিতায় সেটাই তো আসল। আবার আত্মাকে ধরার চেষ্টা করো, মুছে যাবে অক্ষর, সেগুলোও তো কবিতার সবটুকু। তবে এগুলো বানোয়াট সংকট … পদ্যের উৎকৃষ্ট অনুবাদ দ্বিতীয় ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন উচ্চারণ সৃষ্টি করে।’

– জন ফেলস্টেইনার, ট্রান্সলেটিং নেরুদা : দ্য ওয়ে টু মাচ্চুপিচ্চু

লিয়র ভেজা চান্দের সবোন যে আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়েছে আমি নিজেও এই ভাষায় কথোপকথনকারী, স্বপ্নচারী,
জীবনযাপনকারীদের পাশে একটা নির্দিষ্ট, বিশেষত কৈশোর, বয়সে বড় হয়ে উঠেছি। তবু শোয়েব শাহরিয়ারের কবিতার বইটি পড়তে গিয়ে প্রাচীন পু-্র জনপদের অসংখ্য শব্দের অর্থ আবিষ্কারে আমি হিমশিম খেয়ে স্বয়ং কবির শরণাপন্ন হয়েছি। কিন্তু যখনই শব্দটির অর্থ জেনেছি, তখনি হারিয়ে ফেলা কোনো এক স্মৃতি আমার কাছে তরতাজা হয়ে ফিরে এসেছে। এবং আমার চেতনা থেকে হারিয়ে ফেলা সেসব অনুভূতিময় দৃশ্যকল্প ফিরে এসেছে প্রতিটি কবিতার অথবা এর কোনো বাক্যের এমনকি শব্দটির সঙ্গে নতুন করে তার অক্ষরগুলোর দিকে তাকানোর পর।

কবিতাগ্রন্থটি সম্পর্কে এর প্রচ্ছদপাতায় লেখা কয়েকটি লাইন গুরুত্বপূর্ণ – ‘প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত যে কোনো শিষ্ট ভাষা অবশ্যই কোনো না কোনো এলাকার এক সময়ের আঞ্চলিক ভাষা। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এবং কালজয়ী সারস্বত শিল্পস্রষ্টার অন্তরমথিত অমৃত সিঞ্চনে প্রকৃত অবয়ব ইতিহাস তৈরি করে। আমাদের বাংলা ভাষাও তার অন্যথা নয়। …’। আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা নামাঙ্কিত করে সে-ভাষার আন্তরশক্তিকে গ্রাম্য বলে অনেকেই আমরা অবজ্ঞা করি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষা মৌলিক, মৃত্তিকা-পবিত্র, আবহাওয়া ও ভূগোলঘনিষ্ঠ। পবিত্র করতোয়া-সান্নিধ্য মানুষের ভাষা প্রত্যক্ষ, এতে রসের ভাগ স্বল্প এবং এর প্রক্ষেপণরীতি নিজস্ব। এ-ভাষার বড় গুণবৈশিষ্ট্য হলো এর অভ্যন্তরীণ শক্তি, এ-ভাষা পুরুষালি, এর উপস্থাপন খানিকটা রূঢ়। তবে তেজোদীপ্ত ভাষায় সাধারণ জনজীবনের প্রাত্যহিক চালচিত্র বড় স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।

মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ভাষা। শুধু ভাষা মানব-ইন্দ্রিয়ের গভীরতম উপলব্ধিকে ধারণ এবং তার ব্যাপ্তিময় স্ফটিকখ-কে ছড়িয়ে দিতে পারে মানবের জীবনপ্রবাহে। ভাষা মানুষের নিজস্ব উপলব্ধির জগৎ থেকে গৃহীত ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়গুলোর সংযোগ ঘটায় মানুষে মানুষে। মাতৃভাষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির ভেতর থেকে স্বপ্ন এবং আকাঙক্ষা দিয়ে ভাবিত ভাবনাকে পরিস্ফুট করে তোলে। সেই ভাষাটিই যখন লিখিত আকার ধারণ করে, তখন তার কার্যকারিতা হয়ে ওঠে বহুবিধ। কিন্তু ভাষার এই বহুবিধ কার্যকারিতার সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য স্থান কোনটি? নিঃসন্দেহে সাহিত্য। এই সাহিত্য ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন মানুষ, এমনকি ভিন্ন জাতিসমূহের সত্তার মাঝে তাদের শাশ্বত আত্মিক মূল্যবোধের সংযোগ ঘটায়। জাও হিঞ্জিয়ান (সোল মাউন্টেন উপন্যাসের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত চায়নিজ লেখক) বলেছিলেন, ‘একজন লেখকের সৃজনশীলতার যথাযথ সূচনা ঘটে তার ভাষার মহৎ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এবং যেসব মহৎ উচ্চারণ তাঁর ভাষায় এখনো পর্যাপ্তভাবে উচ্চারিত হয়নি, তা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে!’ এই যে মানুষের অনুভূতির উৎকর্ষ নন্দনতত্ত্ব, তা মানুষের পরিবর্তনের ইতিহাসকে পেছনে ফেলে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকবে।

আমি নিশ্চিত, এই অঞ্চলে যারা বড় হয়ে উঠেছেন এবং এখানকার আঞ্চলিক ভাষায় ইন্দ্রিয়ের গভীরতম উপলব্ধিকে ধারণ করে আছেন, এই কবিতার বইয়ের
বাক্য-শব্দ, চিত্রকল্প, এখানকার মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং দর্শন তাদের পুনরায় স্মৃতিকাতর করবে এবং তাদের নিজস্ব উপলব্ধির জগৎ থেকে গৃহীত ইন্দ্রিয়লব্ধ বিষয়গুলোর সংযোগ ঘটাবে একে অন্যের সঙ্গে।

লিয়র ভেজা চান্দের সবোন কবিতাগ্রন্থটি পু–্রর প্রাচীন ভাষার স্বরূপ তথা এর ভাষার ইতিহাসকে ধরে রাখার মতো এক অনন্য প্রয়াস। প্রাচীনত্বটুকু এ-অঞ্চলের মানুষের অন্তর্লোকে যেভাবে খেলা করে বর্তমানে তাদের মননে, মনস্তত্ত্বে প্রতিভাত এই কবিতাগুলোতে তার একটা চিত্র আমরা পাই। লছিরুদ্দির ডাক্তারি পাশ করা এবং অনেক ডিগ্রি অর্জন করা মেয়েটার প্রতি মাদকাসক্ত আর সন্ত্রাসী হয়ে-ওঠা তিন নাতিনের উদ্দেশে দাদার কথন এই অঞ্চলের মানুষের রক্তে লুকিয়ে থাকা এক আদিম আর্তিই শুধু নয়, আমরা যারা এই অঞ্চলের বাসিন্দা, আমি নিশ্চিত আমরা অনেকেই এমন ঘটনার অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ।

লছিরুদ্দির লাতনি লোস তুই, তোর ইংকে দেমাক?

তোর দাদা হামার নানার বাড়িত কামলা আছলো,

…    …    …

দশ বারোখান হাল আছিলো, তিরিস জোড়া হালের গরু

গাই আছিলো আটকোনা রো

…    …    …

হামাক দেকে চিনলু না তুই,

তোর বাপ থাকলে আজ বুজলুহিনি হামার কদর।

এটা সামাজিক উত্থান-পতনে জর্জরিত এক দাদার আর্তিই শুধু নয়, তার বলা মিথ্যাটুকুর মধ্যে এ-অঞ্চলের মানুষের রক্তে লুকিয়ে থাকা এক আদি ঈর্ষাপরায়ণতার বেদনাও লুকিয়ে আছে। কবি তারই মনস্তত্ত্বের ঝাঁপি খুলেছেন নিখাদ এক পর্যবেক্ষণে। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, কবি আঞ্চলিক শব্দের উচ্চারণে থেকেছেন অত্যন্ত সচেতন এবং তিনি খুব যত্নের সঙ্গে গভীর মনোযোগে সেই শব্দের উচ্চারণকে অক্ষরে সন্নিবেশিত করেছেন তাঁর আঞ্চলিকতার শাশ্বতরূপে।

লিয়র ভেজা চান্দের সবোন কবিতাগ্রন্থে পু-্র জনপদের পরম্পরাগত প্রথা, এই জনপদের ভাষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য,
সংস্কৃতি, সংস্কার-বিশ্বাস এবং প্রথার নির্দিষ্ট কিছু নৈর্ব্যক্তিক এক নকশা আমরা পাই। আঞ্চলিক কবিতার ক্ষেত্রে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কী হতে পারে? বগুড়া অঞ্চলের মানুষের নৃতাত্ত্বিক রকমারি বৈচিত্র্যে কবিতার বইটি আঞ্চলিকতার এক মৌল সংশেস্নষ, যা শোয়েব শাহরিয়ারের হাতে সুষমায় বিভাবিত।

সমকালীন বগুড়ার সমাজবাস্তবতা এবং মানুষের যাপিত জীবনের দীপিত আলোয় কবি নিজের অন্তরকে আলোকিত করে নিয়েছেন তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে। মানুষের চলমান জীবন দৃশ্যায়িত করতে গিয়ে কবি নিঃসন্দেহে প্রভাবিত হয়েছেন এই আঞ্চলিকতা ও ঐতিহ্যের অনির্বচনীয় শিল্পের রস দ্বারা। কবির কবিতার এই আঞ্চলিকতার প্রমিত চিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে এ-অঞ্চলের মানুষ আর তাদের জীবনবাস্তবতা, মানবতা এবং অমানবিকতা, লোকাচার, মানব ভাবনার নান্দনিক তথাপি অনুক্ত উপলব্ধি, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। করতোয়াবিধৌত প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সভ্যতার চিহ্ন বহনকারী অঞ্চলটির প্রামিত্মক মানুষের কথন, তাদের স্মৃতিচারণের মধ্যে লুকানো মিথকে খুঁজে ফেরা এই প্রাচীন জনপদটির ইতিহাসকে শনাক্তকরণেরই একটা প্রক্রিয়া। নিসর্গ-প্রকাশিত গ্রন্থটিতে কবি আঞ্চলিক মিথকে খুব সফলভাবে ব্যবহার না করলেও আঞ্চলিক ভাষার আন্তরশক্তিকে মন্থন করেছেন – এখানেই শোয়েব শাহরিয়ারের কৃতিত্ব।