রূপকথা নয় জীবনকথা

সালমা বিনতে শফিক

তুচ্ছ প্রেম গুচ্ছ প্রতারণা

উম্মে মুসলিমা

মুক্তধারা

ঢাকা, ২০১৫

১৩৫ টাকা

 

 

তুচ্ছ প্রেম গুচ্ছ প্রতারণা উম্মে মুসলিমার ছোটগল্পের সংকলন। ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গল্পগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। ২০১৫-এর বইমেলায় মুক্তধারা মুসলিমার তেরোটি গল্পকে এক মলাটে নিয়ে বই আকারে প্রকাশ করে। ভাতঘুমের আগে আগে যাদের পড়ার অভ্যাস, তাদের জন্য মোক্ষম একটা অবলম্বন হতে পারে এ-বইটি। তেরোটি দুপুরের জন্য নিশ্চিন্ত। তবে গল্প শেষ হওয়া মাত্র ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়া সহজ নাও হতে পারে। কারণ গল্পগুলো আকারে ছোট হলেও পাঠককে ভাবাবে নিঃসন্দেহে। সহজ কথায় বলা যায় তুচ্ছ প্রেম গুচ্ছ প্রতারণা গ্রন্থে মুসলিমার প্রতিটি গল্পই জীবন থেকে নেওয়া। আছে আটপৌরে মানুষের রক্ত-মাংস আর ঘাম-শ্রমের জীবন, প্রেম ও প্রতারণার জীবন। টানটান উত্তেজনায় ভরা প্রতিটি গল্পই শেষ হয় চমক দিয়ে। এখানেই লেখকের সার্থকতা।

প্রথম গল্পটির নাম ‘আলবোলা’। খাঁটি রুপার একটি মাত্র আলবোলা ছাড়া জমিদার বংশের আর কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। তরুণ সহকর্মীর কাছে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য, বনেদিয়ানা আর সেই ‘আলবোলা’টির গল্প করে যান উচ্চমান সহকারী থেকে সদ্য সেকশন অফিসার পদে উন্নীত সৈয়দ রহমান। কন্যাদায়গ্রস্ত কোনো পিতাই বোধকরি এমন সুপাত্র হাতছাড়া করবে না। এমন কোনো বাসনা রহমান সাহেব মনে মনে লালন করে থাকলে তার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। তরুণকে মাঝেমধ্যে তিনি বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হালুয়া-পায়েসের ভাগ দেন। এক ছুটির দিনে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণই জানিয়ে দেন সরাসরি। তরুণ নিজেও মনে মনে তাই চাইছিল। নির্ভেজাল চাওয়া। হাজার হোক জমিদারবংশের কন্যা। রূপবতী। কথায় কথায় জানা হয়ে গেছে এতদিনে। রান্নার হাতও বেশ। আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করে স্বপ্নেই ডানা মেলে উড়তে শুরু করে তরুণ। সৈয়দ রহমানের আদি পিতাগণের নতুন কল্পকাহিনি আর তাঁর স্ত্রী ও কন্যার শাহি আপ্যায়নে মুগ্ধ তরুণ ঘোরলাগা চোখে বিদায় নেয় সেদিনের মতো। গল্প এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেন ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। হঠাৎ গলির মোড়ে তরুণের দেখা একজন রায়চৌধুরীর সঙ্গে, যাকে প্রথম দেখায় ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা সৈয়দ রহমানের প্রপিতামহ বলেই মনে হয়। ধুতি, পাঞ্জাবি, কাঁধের ওপর ভাঁজ করে রাখা শাল আভিজাত্যের সাক্ষ্য বহন করছে। দ্বিতীয়বার তাকালে বেশ বোঝা যায় পোশাকে চাকচিক্য নেই, বরং দারিদ্রে্যর আভাস। শতচ্ছিন্ন তবে পরিষ্কার। এককালে জমিদার ছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষগণ, তা চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায়; কিন্তু তরুণকে কেন পিছু ডাকছেন এই বনেদি অথচ জীর্ণ বৃদ্ধ! মুখ খোলেন তিনি নিজেই। দেনার দায়ে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন রুপার আলবোলাটা বন্ধক রাখেন তিনি সৈয়দ রহমানের কাছে। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে আলবোলা ফেরত আনতে গেলে রহমান পুলিশের ভয় দেখান তাকে। তরুণকে ও-বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে মনে সাহস পান রায়চৌধুরী। ওর সাহায্য নিয়ে যদি কোনোমতে একমাত্র পৈতৃক সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করা যায়, তাই তার পিছু নেওয়া। তরুণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনেও যেন একটা ধাক্কা লাগে। এখানে কে প্রতারক? সৈয়দ রহমান, নাকি রায়চৌধুরী?

‘মিনতির ছেলে’ গল্পটি গ্রামের এক খানদানি পরিবারের উৎসব-আয়োজন ঘিরে রচিত। ঈদের ছুটিতে গ্রামের অবস্থাপন্ন এক পরিবারে মেলা বসেছে। বিদেশ থেকে, শহর থেকে এ-বাড়ির ছেলেরা এসেছে মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে। ছোট ভাইয়ের বিয়ের কথাও চলছে। আড্ডা, খাওয়া, হাসিঠাট্টা, মান-অভিমান চলছে বাড়ির উঠান থেকে চিলেকোঠা আর খোলা ছাদে। পুরো গল্পে মিনতি নামের কোনো চরিত্রই নেই। তাহলে মিনতির ছেলে এলো কোথা থেকে? উত্তর আছে শেষ দৃশ্যে। এ-বাড়ির সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ছেলে, কথায় কথায় যে ধর্মাচরণ ও জাতবংশের গৌরব দেখায়, তার বালক ছেলের চেহারার সঙ্গে অনেককাল আগে এ-বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত যে-মিনতি, তার যুবক ছেলের সাদৃশ্য চমকে দেয় পাঠককে।

‘পুচুন’ ভাঙা পায়ের এক বিড়ালের নাম। তবে গল্পটা পুচুনের মালিক শাখিকে নিয়ে। দেশের নামি বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী হলেও নামিদামি বর, ঘর কিংবা উচ্চপদ কোনোকিছুর স্বপ্ন ছিল না তার। আটপৌরে ঘরকন্না,
ছোট-বড় চেয়ার বা পদ কিছুই চাই না ওর। এতই সাধারণ ছিল যে, সে নিজেই জানত না সে যে কি রূপবতী! ওকে নিয়ে ভাবনার শেষ নেই বন্ধুদের, বাবা-মায়ের। বান্ধবীদের স্বামীদেরও। নির্বিকার শাখি। ছোট বোনের বিয়ে দেয় নিজের হাতে, ধুমধাম করে। মা হবে বোনটি। পরম যত্নে আগলে রাখে সে-বোনকে। সেই শাখি, যে পশুপাখি আঘাত পেলে কেঁদে বুক ভাসাত, আপেল কাটার ধারালো ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল ছোট বোনের স্বামীর ঘাড়ে। সাক্ষ্য দেয় শাখি; আগামীকাল যে-শিশুটি পৃথিবীতে আসছে, তার বাবা, শাখির ছোট বোনের স্বামী একলা পেয়ে লুটিয়ে পড়েছিল শাখির পায়ে। ভালোবাসার ডালি নিয়ে। গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় শাখির জবানবন্দি। এই শাখিকে কেউ চেনে না। শাখি তো কারো কাছে প্রেম চায়নি। তবু কেন এই প্রতারণা!

‘ক্ষণিক বসন্ত’ গল্পের মাঝামাঝিতে থাকে প্রতারণা। তবে প্রতারণার শিকার এবার নারী নয়, পুরুষ। গল্পশেষে ভালোবাসাই সত্য হয়, যদিও ‘হ্যাপি এন্ডিং’ আসে না শেষ অংকে। বাড়ির ছোট ছেলের প্রেয়সী আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে মালা দেয় প্রেমিকের মেজো ভাইয়ের গলায়। স্বর্গ রচনা করে পশ্চিমের কোনো নামি শহরে। ছোটর আর ঘর বাঁধা হয় না। আঁকিয়ে হিসেবে অনেক নাম করে। কঠিন রোগও বাসা বাঁধে শরীরে। চিকিৎসার খরচ জোগাতে ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করে পশ্চিমের অন্য কোনো শহর থেকে উড়ে আসা ভ্রাতুষ্পুত্রী (বড়ভাইয়ের মেয়ে)।
নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী কিনে নেয় ‘ক্ষণিক বসন্ত’, নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দিয়ে। সে-নারীকে চিনে নিতে খুব অসুবিধা হয় না পাঠকের।

‘নৈবেদ্য’ গল্পটি সন্দেহপ্রবণ এক পুরুষের মানসিক টানাপড়েন নিয়ে। স্ত্রী ইতি সতী-সাবিত্রী জেনেও মনের দ্বিধা কাটছিল না তাপসের। সারাক্ষণ আগলে রাখে যেন কারো নজর না লাগে। পৃথিবীর সব পুরুষকেই সন্দেহ তার। সন্দেহের তীর ক্ষণে ক্ষণে ঘুরে যায় স্ত্রীর দিকেও। অতি ভালোবাসা বাতিক হয়ে যায়। ঘুম হারানোর দশা স্বামী বেচারার। সেই তাপস ভাইকে একটা জুতসই চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার জন্য ওপরওয়ালার দরবারে উপস্থাপন করে এত যত্নে আগলে রাখা পয়মন্ত বউটাকে। আগের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ধুয়েমুছে যায় মন থেকে। ভাইয়ের প্রতিষ্ঠার জন্য এটুকু না করলে কেমন পুরুষ!

কালো মেয়ে সুবর্ণার জীবনকাহিনি ‘সুবর্ণা’। মা তো সেই কবে মরে ভূত! একলা বেড়ে ওঠে। তিন কুলে কেউ নেই। ফুলের মালা বেচে পেট চালায়। বঁটিই ওর রক্ষাকবচ। এক রাতে এক অন্ধ ভিখিরি আসে ওর ডেরায়। চাল নেই চুলা নেই, চোখের আলো তো নেই-ই। ভবের গান করে সে দিনরাত। সাঁইজির শিষ্য অন্ধ গায়েনের গলা ভালোবাসা আর মায়ায় ভরা। স্বপ্ন দেখায়
কৃষ্ণকলি ফুলওয়ালি সুবর্ণাকে। জগৎসংসারে সে যে বড় একা। সুবর্ণা হঠাৎ পাওয়া অন্ধ যুবককে ভাত দেয়, ঘর দেয়, প্রেম দেয়। মনের সিংহাসনের রাজা বানায়। মালাবদল করে। কিন্তু যখনই সে-ভিখিরি জানতে পারে, সুবর্ণা আসলে দেখতে কুৎসিত, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। চোখে না দেখলেও সেও অন্য পুরুষদের মতো কেবল রূপেরই পূজারি।

আত্মজার মাঝে নিজের আংশিক ছায়া দেখে চমকে ওঠা এক মায়ের গল্প ‘সিস্ন­ভলেস’। হাতকাটা জামা কেনা নিয়ে মতবিরোধ হয়েছিল প্রথম প্রেমের দিনগুলোতে। মনের ভেতর খচখচ নিয়েই এক জীবন তবু পার করে দেয় ওরা; কিন্তু পরের প্রজন্ম ছাড় দিতে রাজি নয় এক বিন্দু। সেই হাতকাটা জামা কেনা নিয়েই মতবিরোধ, সেখান থেকে বিচ্ছেদ। বাবা-মা দুজনেই বাক্যহারা। এক প্রজন্মেরই তো ব্যবধান! কে ঠিক? মা, না মেয়ে? আরেক জোড়া অনুলেস্নখযোগ্য
মা-মেয়ের কথা আছে এই গল্পে, যারা জানেই না জীবনের কাছে কোনো কিছু চাইতে আছে।

‘শেকলে অর্গলে’ এক বনেদি পরিবারের বড় বউ নায়লার হঠাৎ জেগে ওঠা আত্মোপলব্ধি নিয়ে। সবার মুখে এক কথা, নায়লার মতো মেয়ে হয় না। দাম্পত্য নিয়েও স্বস্তি আর
তৃপ্তির শেষ নেই। শ্বশুরের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জাঁকজমকের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই নায়লার হঠাৎই মনে পড়ে যায়, বাবার জন্য কিছুই করা হয়নি ওর। স্বামীর পরিবারের সবার সুবিধার কথা ভাবতে গিয়ে বাবাকে একেবারে নিজের কাছে রেখে দিতে পারেনি। গান গেয়ে দুটো পয়সা আসত সংসারে। বাবাকে মৃত্যুশয্যায় রেখে গানের রেকর্ডিংও তাই বাদ দিতে পারেনি। চোখ বোজার আগে বাপ-মেয়ের শেষ দেখাটাও হলো না। সবার কাছে ভালো থাকতে গিয়ে নিজস্ব ভালোবাসার একমাত্র যে-গান, তাও ছেড়ে দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। বন্ধুরা ফোঁড়ন কাটত – সবই ওর বেশি বেশি ভালোমানুষি। ও ভেবে দেখেনি আগপাশ। সবার ভালোর জন্য, সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে থাকার জন্য একটু ছাড় দিতে তেমন খারাপ তো লাগেনি তখন। তবে আজ কেন সব অর্থহীন মনে হচ্ছে? পুরো জীবনটাকেই মনে হচ্ছে শেকল দিয়ে বাঁধা।

একাত্তরের মফস্বলের এক বনেদি ঘরের মেয়েদের নিয়ে গল্প ‘কাগজের রাজকন্যে’। বনেদি বাড়ির পাশের বাড়ির নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এক কিশোরীর মুখের কথায় এগিয়ে যায় কাহিনি। বড়বাড়ির মেয়েদের রাজকন্যা বলে মনে করত কথক। তাই ওর কাগজের পুতুলদের সে ওদের নামেই ডাকত। ও-বাড়ির বড় মেয়েটি ভালোবাসে এক বিপস্ন­বীকে, কিন্তু ভাইয়েরা ওর বিয়ে ঠিক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার সঙ্গে। ভালোবাসার পুরুষকে ভাইদের হাত থেকে বাঁচাতে জীবন দেয় বড় রাজকন্যাটি। এই গল্পে প্রেমিককে নয়, বরং প্রতারক হিসেবে দেখানো হয়েছে দেশদ্রোহীদের।

উম্মে মুসলিমার নারী চরিত্রদের বেশিরভাগই প্রতারিত হয় ভালোবাসতে গিয়ে। তাই তো বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে তুচ্ছ প্রেম গুচ্ছ প্রতারণা। কিছু ব্যতিক্রম আছে, যারা সরাসরি প্রতারিত হয় না ভালোবাসার জন্য, তবে পারিপার্শ্বিকতা, বাস্তবতার নির্মমতা, মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ও সামাজিক টানাটানির ফলে স্বপ্নভঙ্গ হয় প্রতিনিয়ত। ‘অগাহাস্ট লিওনহার্ট’ বাঙালি তরুণীর বুকে প্রথম কাঁপন-ধরানো এক পরদেশি তরুণের নাম। পরদেশি নিজের অজামেত্মই ঝড় উঠিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়; কিন্তু সেই তরুণীর আর কাউকে মনে ধরে না। একাই কাটিয়ে দেয় জীবন। ঠিক একা নয়, ভাইয়ের সন্তান ও তার পরিবারের সঙ্গে বেশ হেসেখেলেই কাটিয়ে দেন অধ্যাপক, তরুণী থেকে ততদিনে বৃদ্ধ হওয়ার পথে। তৃতীয় প্রজন্মের হাত ধরে পরিচয় হয় তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে। পরদেশিকেও খুঁজে দেখতে মন চায় অন্তর্জালে। শেষ দৃশ্যে যদিওবা সন্ধান মেলে, ততক্ষণে ‘অগাহাস্ট লিওনহার্ট’ এক সদ্য পরলোকগত ব্যক্তির নাম। নামের পাশের ছবিতে অনেককাল আগে তোলা এক বাঙালি মেয়ের বেণি ঝুলানো মুখ। কোনো এক বন্ধুর জবানি থেকে জানা যায় ‘অগাহাস্ট লিওনহার্ট’ অকৃতদার ছিলেন। কিছুদিন আগে যদি খুঁজে পাওয়া যেত পরদেশিকে! তাহলেই সত্যি হতো রূপকথা।

‘টেলিফোন’ গল্পটিতে এক কিশোরীর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের গল্প হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়। বাবার পদোন্নতি হলে বড়লোক বন্ধুদের মতো ওদের ঘরেও টেলিফোন আসবে, জানার পর ঘুম হারিয়ে যায়। কত না জল্পনা-কল্পনা! আটপৌরে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে এক জনম পার করে দেওয়া মাও সঙ্গী হয় মেয়ের। টেলিফোন বসানোর জন্য ছোট্ট একটা নকশা পায়ার টেবিল, সেই টেবিলে বিছিয়ে দেওয়ার জন্য ডিএমসি সুতায় ফুলতোলা সুদৃশ্য একখানা টেবিল ক্লথ তৈরি নিয়ে মা-মেয়ের কথোপকথনে পাঠকমাত্রেরই মন ভিজে যাবে। গত শতকের শেষ দশকগুলোতে যাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে, তাদের অনেকে ‘টেলিফোন’ গল্পের রিনির সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাবে। ‘টেলিফোন’ এসেছিল ওদের ঘরে; কিন্তু অনেক অপেক্ষার সে-টেলিফোন শেষমেশ বাজে না। টেলিফোন লাগানোর কর্মী কাগজ, তার – সবকিছু ঠিকঠাক করতে করতে রিনির বাবার চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার দিন চলে আসে। শেষ উপহার জায়নামাজ, কোরান শরিফ আর ফুলের তোড়া নিয়ে ঘরে ফেরেন বাবা। প্রাণ না পাওয়া টেলিফোন যন্ত্রটা রিনিকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে যায় ওদের বাড়ি ছেড়ে।

‘টেলিফোন’ যেমন মা-মেয়ের অবমুক্তি, তেমনি মা-ছেলের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের জীবনগাঁথা। গাঁও-গেরামের কিশোর রবিনের মাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। মা-ছেলের একটাই স্বপ্ন – একদিন কাগজে ছাপা হবে রবিনের কবিতা। অনেক অপেক্ষার পর একদিন নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পায়। কবি হিসেবে অভিষেক হয় রবিনের; কিন্তু মায়ের তা দেখা হয়নি। সেই প্রতীক্ষার ছাপানো কবিতা নিয়ে বাড়ি ফিরে রবিন দেখে বাড়িভরা মানুষ। মায়ের শেষযাত্রার আয়োজন চলছে।

‘ফেকু খান’ ঢাকার পথে পথে কাজ খুঁজে বেড়ানো এক কারিগরের নাম। সেই শহরের এক নিম্নমধ্যবিত্ত একক পরিবারে
টাকা-পয়সার টানাটানি; কিন্তু সুখের সীমা নেই। স্ত্রীর বড় শখ এবার বিশেষ দিবসে শাড়ি না নিয়ে একখানা কার্পেট নেবে। অনেক অংক কষে বাজেট তৈরি করা, কোনো এক ছুটির দিনে বাণিজ্যমেলায় যাওয়া, অনেক ঘুরে দেখে কমদামি একটা কার্পেটের মালিক হওয়া, এরই মধ্যে অদিনের বৃষ্টি এসে অনেক সাধের কার্পেটের রং লেপ্টে যাওয়া – সবকিছুতে নিম্নমধ্যবিত্ত ভালোবাসার ছড়াছড়ি। দৃশ্যপটে ফেকু খানের আগমন গল্পের মাঝামাঝিতে। কার্পেট সারাইয়ের কারিগর ফেকু খানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’কে দেখতে পায় গল্পের প্রধান নারীচরিত্র ঝুমা। আটকেপড়া পাকিস্তানি ফেকু খান জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য পাই-পাই করে পয়সা জমায়। স্ত্রী-পুত্র জেনেভা ক্যাম্পের উদ্বাস্ত্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে মূলধারার সঙ্গে মিশে গেলেও ফেকু খান দিন গুনে চলে – একদিন মাতৃভূমিতে ফিরে যাবেই যাবে। গল্পটিতে ফেকু খান প্রতারিত হয় জীবনের কাছে।

উম্মে মুসলিমার এই সংকলনের প্রতিটি গল্পের যে-বাক্যেই চোখ বোলানো হয়, পাঠকের সামনে তা ছবি হয়ে ধরা দেয়। গ্রামের বনেদি বাড়ি, শহরের ঝলমলে প্রাসাদ থেকে মধ্যবিত্তের নোনাধরা দেয়াল, বস্তির ছাপরাঘর, বিশববিদ্যালয়ের আবাসনে ছাত্রীদের বসবাস ও জীবনযাত্রা সবকিছু জীবন্ত মনে হয়। যৌথ পরিবারের খুনসুটি, আহ্লাদ, ভোজনানন্দ, সম্পর্কের টানাপড়েনের অপূর্ব দৃশ্যায়ন পাঠককে নিমিষে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা শৈশবে। দৃশ্যপট রচনায় এখানেই লেখকের কৃতিত্ব।