দুই কবির দুই শহর

আখতার হোসেন খান

আমার ঢাকা

শামসুর রাহমান

সম্পাদনা : পিয়াস মজিদ

প্রথমা

ঢাকা, ২০১৮

২৮০ টাকা

 

আমার কলকাতা

বেলাল চৌধুরী

সম্পাদনা : পিয়াস মজিদ

প্রথমা

ঢাকা, ২০১৮

২৮০ টাকা

 

 

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ইংরেজি প্রবন্ধ ‘ক্যালকাটা’র (‘Calcutta’) শুরুতেই এমন এক খ্যাপাটে দার্শনিক বন্ধুর কথা এনেছেন যিনি বলতেন, কোনো জায়গা চেনার একমাত্র পথ হচ্ছে সেখানে কখনো না যাওয়া। সুধীন দত্ত-প্রতিষ্ঠিত পরিচয় পত্রিকার গত শতকের তিরিশের দশকের নিয়মিত আড্ডার অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ এই বন্ধুটির নাম বসন্তকুমার মলিস্নক। জীবনের একটা বড় সময় তিনি অক্সফোর্ড প্রবাসে দর্শনশাস্ত্রের সব তাত্ত্বিক বই লিখেছেন বটে, তবু এই অতুলনীয় বৌদ্ধিক ব্যক্তিটি ওই আড্ডায় তাঁর প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধা ও অর্জিত খ্যাতির অনেকটা জমিয়েছিলেন, অন্য কিছুর মধ্যে, তাঁর শানিত সব কূটাভাসভরা বক্তব্যের বলে।

পিয়াস মজিদ-সম্পাদিত প্রথমা প্রকাশনের ঢাকা ও কলকাতা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত দুই বইয়ের (শামসুর রাহমানের আমার ঢাকা ও বেলাল চৌধুরীর আমার কলকাতা) আলোচনার বর্তমান প্রয়োজনের নিরিখে বসন্তকুমার মলিস্নকের উদ্ধৃত বক্তব্য কেমন যেন ছন্দছাড়া মনে হবে। কেননা শামসুর রাহমানের জন্ম, পরিবর্ধন ও পরলোকগমন ঢাকায় আর যৌবনের দুর্নিবার দুরবস্থায় পড়ে বেলাল চৌধুরী পকেটে অঢেল কাঁচা টাকা নিয়ে মাছধরা জাহাজে চড়ে কলকাতায় নামেন এবং বছরদশেক কাটিয়ে দেন চরম দস্যিপনায়, তথা নিজের অজামেত্মই নতুন জায়গাকে জয় করে ফেলেন এবং প্রতিষ্ঠিত কবি হয়ে যান। উভয় ক্ষেত্রেই বর্ণিত কূটাভাসকে সরিয়ে রেখে বলা যায়, কবিত্বের তথা সাহিত্যের উৎপত্তিস্থল তথা মৌল দর্শন আর সে-পথের অগ্রযাত্রায় স্থানবিশেষকে ভালোবেসে ফেলা হয়তো এমনই, যা কোনো সরাসরি ব্যাখ্যায় পড়ে না। মানুষ কেন কবিতা লেখে বা কবি হয়, তা খুঁজতে গেলে কথা অনেক বাড়বে, সমাধান মিলবে না, শুধু জটিলতাই বাড়বে।

এমন নয় যে, এই দুই পূর্ববঙ্গীয় কবি শহরদুটি নিয়ে বই দুটি লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে দুটি শহর সম্পর্কিত তাঁদের ভাবনা-বেদনা-বক্তব্যকে একত্র করার সার্থক প্রয়াস নিয়ে প্রকাশকরা একটা মহৎ কাজ সম্পন্ন করেছেন। আর সম্পাদক পিয়াস মজিদ দুজনের সুবিসত্মৃত সাহিত্যকর্ম মন্থন করে একটা কঠিন কাজ সুষ্ঠু পরিণতিতে নিয়েছেন। বইদুটির পরিমিতিসম্পন্ন ভূমিকা দুটি অনির্বচনীয় প্রারম্ভের সূচনা করে। এ দুটি পড়ে নিলে পরে এগোতে আর সমস্যা হয় না; এক টানে শেষ পর্যন্ত যেতে যেতে এই দুই মহাশহরের প্রতি শামসুর রাহমান ও বেলাল চৌধুরীর আনুগত্য, টান ও অভিনিবেশ চোখে পড়বে; উন্মোচিত হবে। শামসুর রাহমান তো ঢাকারই সন্তান, তিনি ঢাকা শহরের সঙ্গে ঘর করেছেন বলা চলে। কিন্তু  বেলাল চৌধুরী পঁচিশ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে জাপানি ট্রলারে চড়ে মাছ ধরার টাকা নিয়ে কলকাতায় হাজির হয়ে সেই মহানগরকেই ভালোবেসে ফেললেন; প্রচুর বন্ধু হলো
কবি-লেখকদের মধ্যে, ঘনিষ্ঠতা পেলেন     বুদ্ধদেব বসু-সৈয়দ মুজতবা আলী-আবু সয়ীদ
আইয়ুব-সত্যজিৎ রায়-অমর্ত্য সেন-শঙ্খ
ঘোষ-শক্তি চট্টোপাধ্যায়-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ ডজন-ডজন মহালেখকের। অবশ্য পরিণত বয়সে ঢাকায় বেলাল চৌধুরীর কলকাতা নিয়ে বই লেখার পরিকল্পনা পাই সম্পাদকীয় বক্তব্যে : ‘তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহূদ মতিউর রহমানের প্রস্তাবে বেলাল চৌধুরী আমার কলকাতা নামে একটি বই লেখার কথা ভেবেছিলেন, যদিও আকস্মিক অসুস্থতা-প্রয়াণ তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি।’

কলকাতা বাংলা সাহিত্যের এক অচিন্তনীয় ধাত্রীভূমি। উপমহাদেশে বিদেশি সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে, বিশেষ করে বাংলাভাষীদের সবধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মের অন্তস্তল হওয়ার সুবাদে শুরু থেকেই এবং পরে রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত কে বাদ থেকেছেন এই মহাশহরের স্তনসুধা থেকে। রবীন্দ্রনাথের সব শিষ্য কলকাতাকেই নিজেদের কর্মক্ষেত্র ভেবেছেন; তার ইট-সুরকি-সড়ক-উপসড়কের গন্ধে, মানুষের ভিড়ে কবিত্বের উপাদান খুঁজেছেন।

১৯০৫ সালের পর ১৯৪৭ সালে ঢাকা দ্বিতীয়বার পায় প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা। ১৯৭১ পর্যন্ত চবিবশ বছরে বিভিন্ন কারণে তা বাংলা ভাষার লেখকদের একাংশের সূতিকাঘর হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
১৯৭১-এর পর স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঢাকা জোরে দৌড় শুরু করে। এখন ঢাকাও হয়তো আরেক কলকাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াচ্ছে। বিনা দ্বিধায় বলা যায়, ঢাকার এই শহরত্বের প্রথম প্রধান সম্পূর্ণ সাহিত্যিক ফসল শামসুর রাহমান। তাঁর ভাষায় মিলবে এই শহরের গন্ধ, গড়ে ওঠার গল্প। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ঢাকা যেমন এগিয়েছে
ইট-সুরকি-সিমেন্টে-সড়কে, তেমনি শামসুর রাহমানও এগিয়েছেন তাঁর উপকরণ নিয়ে। আর ওপরে যে-কলকাতার কথা বলা হলো, তার মজা ১৯৪৭-পরবর্তী একজন মাত্র পূর্ববঙ্গীয় কবিই, যিনি নিজ রাষ্ট্রিক পরিচয় অবিকল ঠিক রেখে পুরোটা পেয়েছেন; তিনি বেলাল চৌধুরী। বিপুলসংখ্যক মানুষ ১৯৪৭-এর আগে বা ঠিক পরে পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় গিয়ে নতুন রাষ্ট্রে নতুন পরিচয় নিয়ে সেখানেই থেকে গেছেন, মিশে গেছেন।

শামসুর রাহমানের আমার ঢাকা বইটির নিবন্ধগুলোর নাম থেকেই বোঝা যাবে শহরটি কীভাবে তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে ছিল : ‘আমার জন্মশহর’, ‘স্মৃতির শহর’, ‘এই শহরে বহুদিন’, ‘দুরন্ত দুপুর’, ‘আমরা ছ’জন’, ‘যখন ভেঙে গেল কাঁটাতারের বেড়া’, ‘গোধূলির বন্দী এখন মুক্তির আকাশে’, ‘আমার ছোট ঘর’, ‘আমার উঠোন’, ‘মেঘের পরে মেঘ জমে আঁধার করে আসে’, ‘নিউ মার্কেটের বই ও আবদুল কাদির’, ‘পুরানো ও নতুন বইয়ের সন্ধানে’, ‘মনীষায় দীপ্ত গ্রন্থাবলি আমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার’, ‘সাহিত্যিক আড্ডা ও ‘কবিকণ্ঠ’, ‘এই লাঞ্ছনা আমাদের সবার’, ‘আমার দৃষ্টি আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে’, ‘ইতিহাসের জন্য আকুলতা এক ধরনের স্মৃতিকাতরতা’। এছাড়া ঢাকার প্রত্যক্ষ স্পর্শ, স্বাদসহ কুড়িটি কবিতার স্থান হয়েছে এ-বইয়ে। আর এসবে কবির ঢাকা-প্রেম প্রত্যক্ষ হয়েছে প্রতিটি শব্দে-বর্ণে। এই প্রেম কোনো উদগ্র ঘোষণা নয়; এই শহর মিশে আছে কবির রক্তে-মজ্জায়-শিরা-উপশিরায়, তাকে ছাড়া তিনি কবি বা লেখক হিসেবে জন্ম নিতেন কিনা সন্দেহ থেকে যায়।

‘আমার জন্মশহর, স্মৃতির শহর’ নিবন্ধে শামসুর রাহমান জানিয়েছেন : ‘পুরানো ঢাকায় আমি পুরানো ইতিহাসের নিশ্বাস ও দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাই।’ সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, এই কবি শহরের ইতিহাস বিষয়ে বিশেষভাবে আসক্ত; পুরান ঢাকাই তো এই শহরের ইতিহাস ধারণ করে আছে; পুরনো ইট আর ভাঙা দালান,
শ্যাওলা-ধরা প্রত্নচিহ্ন, অলিগলিতে নবাবদের একটা অবঙ্গজ আমেজ, এসবেরই স্বাদ তিনি দিনে দিনে পেয়েছেন, এর মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। তাঁর পক্ষে, বিশেষ করে ওই ধরনের এক কবিমানসের পক্ষে, এসব উপেক্ষা করা কি আদৌ সম্ভব ছিল?

শামসুর রাহমান বিংশ শতাব্দীর মানুষ। তিরিশ, চলিস্নশ আর পঞ্চাশের দশকে তিনি বড় হয়েছেন। স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের উদ্ভবের ঘটনা ভিত্তি তৈরি করেছিল বায়ান্ন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের গণহত্যা; এসবই তাঁর মনে দাগ কেটে যায়, যেমন যায় পুরনো ঢাকার অলিগলি।

এক দুপুরে শামসুর রাহমান তাঁর বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন পুরান ঢাকাকে দেখার জন্য। সেই দুপুর ‘এক মোহন খেলা’ জুড়ে দিয়েছিল তাঁদের সঙ্গে, ‘দুরন্ত দুপুর, আমরা ছ’জন’ লেখাটি সে-কথা জানাচ্ছে : তিনি নিজে ছাড়া বাকিরা শিবনারায়ণ রায়, ড. অমলেন্দু বসু, নরেশ গুহ, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী এবং রশীদ করীম। ‘অনেক কিছুই ভুলে যাব, কিন্তু রবিবারের সেই দুরন্ত দুপুরটির কথা চিরদিন মনে থাকবে।’ এই তো একজন কবির অনুভব; প্রিয় শহর এভাবেই তো স্নায়ু, মস্তিষ্ক, রক্তে মেশে তার আবেদন রেখে যায়। আর পুরনো ঢাকা কোনোদিন কি এই মাপের ছয়জনকে একসঙ্গে পাবে, যাঁরা আবিষ্কারের মোহে বেরিয়েছিলেন এক ‘দুরন্ত’ দুপুরে কোনো  ধরনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া।

শামসুর রাহমান আর বেলাল চৌধুরীর জীবনের ফারাকটা অনেক। দুজন দুই শহরকে ভুলতে না পারলেও একজনের শুরু এই শহরেই এবং শেষও সেখানে। কবিতায় সারা দুনিয়ার স্বাদ জাগালেও ঢাকা অন্তর্মুখীন শামসুর রাহমানের প্রাণ, তাঁর কবিতায় আমরা আজীবন পেয়ে এসেছি ঢাকা শহরের বাতাসের গন্ধ, বাখরখানির আস্বাদন। এমনকি ঢাকাইয়া বাগধারায় যে-কবিতাটি (‘এই মাতোয়ালা রাইত’), তা যেমন বাংলা ভাষার নতুন দিগন্ত, প্রাণপ্রাচুর্য, তেমনি কবির ঢাকা-আসক্তির নিঃসংকোচ প্রমাণ (‘মৌত তক সহি সালামত জিন্দা থাকবার চাই।/ তামাম দালানকোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের/ মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের/ পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির -/ হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব!’)

সম্ভবত বাইরে থেকে গেছেন বলেই বেলাল চৌধুরী কলকাতাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। শামসুর রাহমান ঢাকাতেই জন্ম-নেওয়া বলে সম্ভবত ওই ধরনের উন্মত্ততা নেই তাঁর ঢাকার টানে; কিন্তু তাঁর পুরো কাজ চাখলে বোঝা যায় কী দুর্দান্তভাবে তিনি একটা শহরেরই সন্তান, এক নিশ্চিন্ত নাগরিক-কবি। ঢাকার আওলাদ হোসেন লেন আর হোসেনি দালান, মধুর ক্যান্টিনের মধুদা, বিউটি বোর্ডিং, বেগমবাজার, লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা কলেজ, ঢাকার বইমেলা, নিউমার্কেট প্রভৃতি প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসে আর জানান দিয়ে যায় এই কবি এই শহরেরই। কলকাতা নিয়ে যেমন বেলালীয় উত্তেজনা ও প্রকাশ্য দ্রোহ, তা নেই তাঁর কোথাও। এমনকি অনেক কবির যেমন বাংলার রূপ নিয়ে আকুতি ও প্রেম প্রকাশ্যে আসে, শামসুর রাহমানে তার ছোঁয়া মেলা ভার। তিনি ঢাকার বাইরে দীর্ঘদিন থাকা পছন্দ করতেন না। বাইরে গেলেও এই মূলে ফিরে আসতে উদগ্রীব থাকতেন।

পুরনো ঢাকা থেকে মতিঝিল-পুরানা পল্টনের সংযোগস্থলের দৈনিক বাংলা খুব দূরের নয়। বহু বছর এই ছিল তাঁর প্রতিদিনের যাতায়াত। কবির মন নিয়ে তিনি এই পথে দিনের পর দিন চলেছেন। তাঁর কবিমনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে এই পথেই। আর ছিল বাড়ির উঠোন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ভবন।

‘আশেক লেনের বাড়ি’, ‘এ শহর’, ‘এ শহর ঢাকাতেই’, ‘হরতাল’ (‘ন্যাশনাল ব্যাংকের জানালা থেকে সরু/ পাইপের মতো গলা বাড়িয়ে সারস এক স্তব্ধতাকে খায়’ জীবনানন্দ দাশের ‘উটের গ্রীবা’কে মনে করিয়ে দেবে; অথবা এই শব্দগুলো : ‘কেমন সবুজ হয়ে ডুবে আছে ক্রিয়াপদগুলি/ গভীর জলের নিচে কাছিমের মতো শৈবালের সাজঘরে।’), ‘তুমি বলেছিলে’ একাত্তরের দানবীয়তাকে মনে আনে, ‘মধুস্মৃতি’, ‘একটি বিনষ্ট নগরের দিকে’ (শহরের সব দুঃখ আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে/ গাঁথা; আমি দুঃখের বাইরে চলে যেতে চেয়ে আরো/ বেশি গাঢ় দুঃখের ভেতরে চ’লে যাই), ‘জোৎস্নায় ভাসছে ঢাকা’, ‘দুঃসয়ের মুখোমুখি’, ‘বিউটি বোর্ডিং’, ‘দুপুরে বেগমবাজারে’, ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ (পুরান ঢাকার কথ্যভাষার দুঃসাহসিক মিশ্রণ), ‘পুরানো শহর’, ‘আমার এ শহরের চোখ’, ‘শ্যামলীর গালিব’, ‘ঢাকা কলেজকে নিবেদিত পঙ্ক্তিমালা’, ‘লক্ষ্মীবাজারের রৌদ্রময় অন্ধকারে’, ‘শহীদবাগ’, ‘হে শহর, হে অন্তরঙ্গ আমার’ এই কবিতাগুলো প্রমাণ করে কীভাবে তিনি ঢাকার সঙ্গে সারাজীবন কাটিয়েছেন, ঘর করেছেন।

‘হে শহর, হে অন্তরঙ্গ আমার’ কবিতায় মৃত্যুর দু-দশকেরও বেশি আগে লিখে গেলেন : ‘আমি অপেক্ষা করব,/ তোমার নীলচক্ষু বৎসদের সকল খেলা গোধূলিতে মিলিয়ে গেলে,/ আমি তোমার ওষ্ঠে চুম্বন এঁকে/ সৌন্দর্যের ভিতরে মৃত্যু এবং মৃত্যুর ভিতরে সৌন্দর্য দেখে যাব,/ আমি সমেত্মর মতো অপেক্ষা করব উপবাসে দীর্ঘকাল।’

 

দুই

বহির্মুখীন বেলাল চৌধুরী যখন কলকাতায় নামেন, ‘পকেটে তখন জাপানি ট্রলারে চেপে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও মাছ বেচার সুবাদে দেদার কাঁচা টাকা। কফিহাউস চেনার আগে কদিন বিভিন্ন বার এবং হোটেলে সে বয়সে যা যা করা যায় সবই হলো।’ কলকাতায় আসার পর চন্দননগরে এক আলস্যমেদুর দিনে অকুণ্ঠ প্রশ্রয়দাত্রী এক বউদির সঙ্গে ‘সুন্দর, হূদিরঞ্জন’ সারাদিন কাটানোর সুখস্মৃতি তৈরি বেলাল চৌধুরীর পক্ষে সম্ভব হলেও শামসুর রাহমানের পক্ষে তা ছিল অচিন্তনীয়। এমন নয় যে শামসুর রাহমান নারীতে অনাসক্ত, কোনো পুরুষের পক্ষেই তা সম্ভব নয়; কিন্তু তিনি ভীরু, রক্ষণশীল, রবীন্দ্রনাথের মতো মার্জিত থাকার জন্য সদাসচেষ্ট।

অন্যদিকে বেলাল চৌধুরী দুর্নিবার ও নির্ভয়। মনে পড়তে পারে বোদলেয়ার অনুবাদের ভূমিকায় বুদ্ধদেব বসু উনিশ শতকের ফরাসি দেশের যে-বর্ণনা দিয়েছেন, নর-খুলিতে মদ্যপান বা মৃত নারীর দেহের সঙ্গে সঙ্গম-চেষ্টা, বেলাল চৌধুরী অনেকটা সেসব ফরাসি যুবকের মতো। কলকাতায় তিনি সাথি হিসেবে পেয়েছিলেন যাঁদের, তাঁরা যেন প্যারিসের ঊনবিংশ শতকী যুবক, রুচিতে-অভিপ্রায়ে অভিন্ন। তাঁদের একজন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বেলাল চৌধুরীরই বর্ণনায় শোনা যাক : ‘শক্তিদার কথা এত বিশদ করে বলার কারণ নিঃসন্দেহে এত বড় কবি কিন্তু মদ্যসঙ্গীর ব্যাপারে ছিলেন নির্বিচারী এবং নির্মম। প্রথমদিকে প্রায় রোজই আমরা গোটা কলকাতা বলতে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চষে বেড়াতে গিয়ে কত না প্রাণসংশয়ী ঠেকে নিজেদের সঁপে দিয়েছি।’ (‘কলকাতার দিনরাত্রি’) আর বেলাল চৌধুরী ভাগিরথীর পাড়ের মহাশহরের সঙ্গে কাটিয়েছেন এক দশক, ঘর করা নয়, দশকব্যাপী দস্যিপনা/ জীবন-মোচড়ানো অভিজ্ঞতা-অর্জন। দুজনেই এই দুই শহর না থাকলে কবি হতেন না।

বেলাল চৌধুরী যাঁদের সঙ্গে মিলেছিলেন কলকাতায়, তাঁরা সবাই ওই কলকাতার সব নামজাদা সরস্বতী সাধক, হয় তখনই, বা পরে। এবং কলকাতা যতখানি বিশ্বজনীন এই ক্ষেত্রে, অন্তত সাহিত্যচর্চায় বা কলার ক্ষেত্রে, ঢাকা এখনো সেখানে পৌঁছায়নি বটে, তবে সে-সম্ভাবনা অবশ্যই আরো বেশি আছে।

‘কলকাতার দিনরাত্রি’ আত্মস্মৃতিমূলক প্রবন্ধ বিরাটাকৃতি লেখা, এতে আছে অনেক কিছু, কিন্তু আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, কী করে কবিতায় এলেন সে-বর্ণনা। একজন পাকিস্তানি যুবকের কলকাতায় থাকা, তাও কথিত অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে, তাই সহজেই গুপ্তচরের অপবাদ জোটা অসংগত নয়। তাঁর নিজের কথা : ‘এ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসকে যেকোনো উপায়ে অতিক্রম করতেই হবে। একে বাঙালির ছেলে। তার উপর মতি নেই ধর্মে-কর্মে। পঞ্চ মকারের একনিষ্ঠ সেবক। ‘জয় বাংলা’ বলে হাতে তুলে নিলাম কলম। এত তো পড়েছি। দেখাই যাক না কিছু কিছু লেখাজোখা করা যায় কি না।’ এই হলো শুরু।

ওই একই লেখায় আরো আছে : ‘বটুক ঘোষ আমাকে সুধালেন, শক্তি-টক্তি আজ আর কাউকে পাওয়ার জো নেই। কে
কোথায় চলে গেছে বা জমে গেছে কে জানে। চল তো কোথাও যদি মালটাল জোগাড় করা যায়, আমরা একটা জায়গায় যেতে পারি, এহেন প্রস্তাবে আমি তো এক পায়ে খাড়া।’ ভাষার এই স্টাইল ও সরল স্বীকারোক্তি অভিনব। কার কথা নেই এই লেখায়? প্রকৃতপক্ষে এই দীর্ঘ লেখাটিই, যা ষাট পৃষ্ঠারও বেশি, তাতেই বেলাল চৌধুরীর কলকাতা দর্শনের অনেকটাই তুলে ধরে। শুরুর ‘আমার কলকাতা’ তার দশ পৃষ্ঠায় আরেক ধরনের আমেজ আনে।

ছয়টি গদ্য লেখা (‘আমার কলকাতা’, ‘মুহূর্তভাষ্য’, ‘কলকাতার দিনরাত্রি’, ‘কলকাতায় একাত্তর’, ‘রকবাজ সন্তদের কথা’, ‘কফি হাউস : চন্দ্রাহত এক রাত’) ও সাতটি নাতিদীর্ঘ কবিতা বেলাল চৌধুরীর কলকাতা-প্রেমকে সামনে আনে। এদের মধ্যে ‘মুহূর্তভাষ্য’ গদ্যে লেখা হলেও কবিতায় ভরা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা কবিতাটিতেও তো কলকাতারই সব মাল-মশলা। কলকাতায় যতটা সময় কেটেছে কবিদের সঙ্গে, তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় মদের বোতল নিয়ে। লেখককুলের সঙ্গে জানা-অজানা, অনুমোদিত-নিষিদ্ধ সব জায়গায় যাওয়ার যেসব বিচিত্র বর্ণনা মেলে, তাতে মনে হয় সবাই যদি এমন স্পষ্টবাক হতেন, দুনিয়ার অনেক সমস্যা কেটে যেত।

কলকাতা কি শুধু বঙ্গীয়দেরই জাগিয়েছে? আরো অনেকেই কলকাতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। ক্যালকাটা নামে এক চমৎকার, সুপাঠ্য বই লিখেছেন ইংরেজি ভাষার লেখক জিওফ্রে মুরহাউস। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য, তাঁর লেখা আঠারোটি বইয়ের মধ্যে এই ক্যালকাটাই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়; অন্যগুলোকে পারলেও এই বইটাকে তিনি আর উন্নততর চেহারা দিতে পারবেন না, এটা তাঁর পরিষ্কার খেদোক্তি। মুরহাউস আরো জানিয়েছেন, এই মহানগরের সাহায্যেই তিনি মাপতে শিখেছেন এই উপমহাদেশকে।

পক্ষান্তরে কিপলিংয়ের কটু কথা আছে কলকাতাকে নিয়ে (সিটি অব ড্রেডফুল নাইট দ্রষ্টব্য), আছে গুন্টার গ্রাসেরও। শেষোক্তজন ‘ঈশ্বরের বিষ্ঠা’ নাম দিয়েছিলেন প্রথম দর্শনে, পরে তিনি একাধিকবার আসেন এখানে এবং কলকাতার আকর্ষণে মজেন। ‘রবীন্দ্রনাথের পরে আমি দ্বিতীয় বাঙালি যে নোবেল পুরস্কার পাবে’ – এই ছিল তাঁর কথা, যখন সবাই বারবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করত, কলকাতা ও ঢাকায়, কেন তিনি এখনো নোবেল পাচ্ছেন না। এই বেলাল চৌধুরীই আবার গুন্টার গ্রাসের ১৯৮৭ সালের ঢাকা সফরে ছিলেন তাঁর
সঙ্গী-গাইড।

বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের বের করা অলকনন্দা প্যাটেলের স্মৃতিচারণা পৃথিবীর পথে হেঁটে বইয়ে ঢাকার কথা এসেছে। কিন্তু তাঁরটা একটু ভিন্ন : এদেশের অনেকের মতোই তাঁর শিকড় ছেড়ে বাইরে গিয়ে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ার আখ্যান। কেতকী কুশারী ডাইসন একবার আমাকে বলেছিলেন, গোপীবাগে বংশীয় বসত দেখতে গিয়ে নতুন উত্থিত অট্টালিকার নিচে পুরনো পিতৃভবনের ধ্বংসাবশেষ দেখে তাঁর কান্না পেয়েছিল; প্যাটেলের ঢাকা-অনুভূতি ঘুরেফিরে অনেকটা সেরকম, বেদনাভরা স্মৃতিকথা।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে-আসা মীজানুর রহমান লিখেছেন ঢাকা পুরাণ (প্রথমা প্রকাশনা) : এক অপূর্ব বই, পড়তে পড়তে ইতিহাসে, ইটের টুকরায়, খালের ধারে, নদীর পাড়ে, পুরান প্রাসাদে ‘হারিয়ে যেতে নেই মানা’। এই বইয়ের বিপরীতেই কি মনে পড়বে শ্রীপান্থের কলকাতা (আনন্দ পাবলিশার্স) : সুপরিসর এই বইটিতে কী না আছে। আর ঢংটাও অপূর্ব।

বেলাল চৌধুরীর বইয়ের সম্পাদকীয়তে দেখি : ‘প্রাতিষ্ঠানিক পাঠের চেয়ে পৃথিবীর পাঠশালাকেই জ্ঞান করেছেন শ্রেষ্ঠ অধ্যয়নশালা।’ এবং তাঁর বইয়ের পরিচিতিতে যে-যৌবনের মন্ত্র লেখা
থাকত ‘ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্ট মন্দির’ – এ-ধরনের একজন যুবক কলকাতায় জাহাজে এসে যা করার তা-ই করেছেন।

আমার সর্বস্বের বিনিময় এক জীবন    থেকে অন্য জীবনের উত্তরণে

সহস্র অলিগলি সরীসৃপ বিস্তারে          ট্রাফিক জ্যামে রাস্তার বাঁকে

ল্যাম্পপোস্টের বিশীর্ণ ভৌতিক আলোয়           নিয়নসাইনের বর্ণালিচ্ছটায়

জটিল গ্রন্থির গোলকধাঁধায়

পোড়া পেট্রোলের গন্ধে আমি ঘুরছি

আস্তাবলে ফুটপাথে বেশ্যাবাড়ির        সিঁড়িতে গুরুদ্বারায়

আমি ঘুরছি শুঁড়িখানায় পান্থনিবাসে   নিমতলা কেওড়াতলায়

চোর জুয়াড়ির ভিড়ে থানার লক        আপে

ভিখিরিদের আস্তানায় গোরস্থানে

আমি ঘুরছি ক্ষণভঙ্গুর শক্রে হলাহল     পান করে।

আমাকে করুণা কর

আমি এক নির্বোধ যুবক

এখনো আমি বেঁচে আছি

আমাকে করুণা কর

আমাকে করুণা কর

আমাকে করুণা কর

আমাকে করুণা কর।

(‘কলকাতাকে’, ২০১০)

সুধীন দত্ত তাঁর ‘ক্যালকাটা’ প্রবন্ধে মহানগরকে বলেছিলেন বিদেশি শাসনের সুফলগুলোর নিকাশঘর। আর জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘দিস্ সিটি’ নামে ইংরেজি লেখায় মহানগরে উপমহাদেশ ও পশ্চিমের শ্রেষ্ঠসম্ভার নিয়ে পুনর্জাগরণের ক্ষেত্র তৈরি করা দেখেছিলেন। শামসুর রাহমানকে উপহার দিয়ে ঢাকা তার ভবিষ্যৎযাত্রার ইঙ্গিত দেয়। আর দুজন কবির বঙ্গভূখ–র দুই মহানগর নিয়ে লেখাগুলো একত্র করে বই বের করে প্রথমা প্রকাশন বাংলাভাষীদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার এক নতুন দিগমেত্মর দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করেছে।