মনোভুবনের তিন অধ্যায়

সৌভিক রেজা

 

স্মৃতিগদ্য : বন্ধনহীন গ্রন্থি

হাসান আজিজুল হক

ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ

ঢাকা, ২০১৭

৩০০ টাকা

 

স্মৃতির কথা যখন আমরা বলি বা ভাবি, তার ভেতর আমাদের অতীতটা যেমন থাকে, তেমনি খানিকটা বর্তমানও সেখানে জুড়ে থাকে। সেজন্য তার মধ্যে অতীতের ধূসরতা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রাণের একটা স্পন্দন। হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিগদ্য : বন্ধনহীন গ্রন্থি বইটি পাঠের পর সেই উপলব্ধিই যেন আরো খানিকটা দৃঢ় হয়। আমরা ভাবতেই পারি যে, এই উপলব্ধির দায়বোধের খানিকটা হাসান আজিজুল হক যেন তাঁর পাঠককেও দিতে চেয়েছেন।

 

দুই

বইটি তিন পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব – ‘ব্যক্তিগত ও আত্মজৈবনিক’, দ্বিতীয় পর্ব – ‘রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ’ আর
তৃতীয় পর্বে রয়েছে – ‘সমকালীন বিষয়-আশয়’। শিরোনামহীন এক ‘ভূমিকা’য়, বইটি সম্পর্কে, হাসান আজিজুল হক জানিয়েছেন – ‘গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলো বেশ ক’বছর ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। টুকরো টুকরো শৈশবের স্মৃতি,
মা-বাবা, জানু আপাসহ অনেক স্মৃতিচারণমূলক লেখা এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সঙ্গে আছে রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ নিয়ে দু-চার কথা, আছে সমকালীন অন্যান্য বিষয়-আশয় নিয়েও।’ তারপরেও বলতে হয় যে, প্রথম পর্বটাই এ-বইয়ের মূল আগ্রহের জায়গা। সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছেন লেখক নিজেই।

 

তিন

বইটি শুরুই হচ্ছে মাকে নিয়ে হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিকথকতায়। তিনি বলছেন – ‘মাকে নিয়ে আমার বহু স্মৃতি আছে। … মা ছেড়ে গেছেন অনেকদিন হলো। আমার মা আমার জন্য কী ছিলেন তা আমি জানি। মাকে মনে করতে গিয়ে, মায়ের কথা বলতে গিয়ে আমার ক্যালেন্ডারের কোনো প্রয়োজন নেই। মায়ের কথা মনে করতে আমার কোনো উপলক্ষ্যের দরকার হয় না।’ আগে নানারকম অনুমান করা গেলেও এ-লেখাটি থেকেই আমরা জানতে পারছি আগুন পাখি উপন্যাসটি তাঁর মাকে নিয়ে লেখা। তিনি জানিয়েছেন : ‘একবার টেপ রেকর্ডার অন করে বললাম – মা, একটু কথা বলো না। উনি কিছু কথা বলেছিলেন, সেই কথাগুলো এখনো আছে, সেই কথাগুলো দিয়ে আমি ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসটা শুরু করেছিলাম।’ শুধু এখানেই এর শেষ নয়, হাসান আজিজুল হক তাঁর একটি পর্যবেক্ষণের কথা বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন – ‘তার (মায়ের) কথা শুনে দেখলাম, সারা জীবন তার মৃত্যুও স্মৃতিতে ভরা।’ এটা কি শুধুই তাঁর মায়ের বৈশিষ্ট্য, নাকি বয়সকালে সব মানুষের স্মৃতিই শেষকালে মৃত্যুতে গিয়ে ঠেকে, সে-সম্পর্কে অবশ্য তিনি কোনো মন্তব্য করেননি, তবে আমাদের মনে পড়ে যায় আগুন পাখি উপন্যাসের শেষাংশে বিবৃত মায়ের সেই সাহসী বয়ান : ‘আমি কি ঠিক করলম? আমি কি ঠিক বোঝলম? সোয়ামির কথা শোনলম না, ছেলের কথা শোনলম না, মেয়ের কথা শোনলম না। ই সবই কি বিত্তি-বাইরে হয়ে গেল না? মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে, কিছু একটা পাবার লেগে কিছু একটা ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলম। শ্যাষে একটা কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি।’ এই নিজে বুঝেশুনে নেওয়া, নিতে পারার চেষ্টা – এ হয়তো-বা আমাদের সব মায়েরই মনের একান্ত গোপন কথা। কেউ কেউ শুধু সেটি উচ্চারণ করার সাহস পাননি। হাসান আজিজুল হকের মা-ও কি সত্যিকার অর্থে পেরেছিলেন? যতই মায়ের প্রসঙ্গ টানুন, আগুন পাখি তো শেষ পর্যন্ত একটি সার্থক উপন্যাস, সেটিই তার পরিচয়।

 

চার

নিজের বাবা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন – ‘তিনি একইসঙ্গে শৌখিন এবং খুঁতখুঁতে ছিলেন, সবকিছু ভালো ও নিখুঁত চাইতেন। হয়তো বাড়ি বানাবেন, তিনি চাইতেন, বাড়ি এমন হবে যা এই তল্লাটে নেই। শৌখিন ছিলেন, কিন্তু বিলাসবহুল জীবনের অভ্যাস ছিল না।’ বাবার যে-গুণটির কথা তিনি খুব বড় করে বলেছেন, সেটি হচ্ছে তাঁর বাবা ছিলেন, হাসান আজিজুল হকের ভাষায়, অসাধারণ একজন কথক। তিনি বলেছেন – ‘কথক মানে গল্পকথক নয়, তাঁর সঙ্গে যাঁরাই কথা বলত, মুগ্ধ হয়ে শুনত। এর কারণ হচ্ছে, কথায় স্পষ্টতা ছিল, বাক্যগঠনগুলো ছিল ছোট। কোনো মুদ্রাদোষ ছাড়াই টানা শুদ্ধ উচ্চারণে সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন।’ হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে যাঁদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা সম্পর্ক রয়েছে কিংবা তাঁর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁরাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, পিতার এই গুণটি তাঁর নিজের মধ্যেও রয়েছে। পিতার আরেকটি গুণের কথা জানিয়েছেন তিনি : ‘তিনি খুব ঘৃণা করতেন মিথ্যা বলাটাকে। সেজন্য আমি পারতপক্ষে মিথ্যা কথা বলতাম না।’ সেইসঙ্গে হাসান আজিজুল হকের অকপট স্বীকারোক্তি – ‘কত মিথ্যা তো বলেছি জীবনে, যেখানে বলা যায়, ক্ষতি হয় না তাতে কারও। কিন্তু যেখানে মিথ্যা বলাটা কাজ নয়, মজা নয়, কৌতুক নয়, সেখানে আমি মিথ্যা উচ্চারণ করতে পারি না। এটা আমার স্বভাবের মধ্যে ঢুকে গেছে।’ শুধু বড়মাপের একজন লেখক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও হাসান আজিজুল হকের নৈতিক শক্তির প্রকাশটা যেন আমরা দেখতে পাই। বাবা সম্পর্কে আরো বলেছেন : ‘তিনি অসাধারণ কথক ছিলেন। কথক মানে গল্পকথক নয়, তার সঙ্গে যারাই কথা বলত, মুগ্ধ হয়ে শুনত। এর কারণ হচ্ছে, কথায় স্পষ্টতা ছিল, বাক্য গঠনগুলো ছিল ছোট। কোনো মুদ্রাদোষ ছাড়াই টানা
শুদ্ধ উচ্চারণে সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতেন। আমি তার মতো কথা বলতে
পারা মানুষ খুবই কম দেখেছি।’
কী চমৎকারভাবে গুছিয়ে নিজের বাবাকে

পাঠকের সামনে হাজির করেছেন তিনি!

 

পাঁচ

নিজের বালক-বয়সের কথা বলতে গিয়ে হাসান আজিজুল হক তাঁর এক বিধবা ফুফুর কথা আমাদের জানিয়েছেন এভাবে : ‘বাড়িতে এত মানুষ কিন্তু সকলের দায়িত্ব ছিল আমার এক বিধবা ফুফুর ওপর। তিনি ছিলেন বালবিধবা। মাত্র ন-বছর বয়সে বিধবা হয়ে তিনি তাঁর বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। তখন তাঁর বাবা বোধহয় জীবিত ছিলেন না, তবে তাঁর মা, আমাদের পিতামহী তখনো জীবিত।’ এটুকু বলার পরই তিনি বিধবা-বিয়ের সমস্যার কথা পরোক্ষক্ষ উলেস্নখ করেন। খোদ বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গও টেনে আনেন। তিনি বলছেন : ‘বিসত্মৃত জনপদবহুল রাঢ়ের হিন্দুসমাজে বিদ্যাসাগর মশাই দন্তস্ফুট করতে পারেননি একটুও, হিন্দু বিধবার বিয়ের কথা তখন কল্পনা করা অসম্ভব ছিল; অদ্ভুত কথা, ভদ্র মুসলমান পরিবারেও সেকথা উচ্চারণ করা যেত না। প্রতিবেশী সমাজের প্রভাব
কি-না আমি জানি না।’ এই প্রভাবের ব্যাপারটি খানিকটা সত্যি হলেও হতে পারে। হাসান আজিজুল হকের অনুমানকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তারপর কী হলো সেই ফুফুর? তিনি জানিয়েছেন – ‘আমার এই ফুফু ন’বছর বয়সে সেই যে ঢুকেছিলেন আমাদের বাড়িতে … একেবারে সত্তর বছর বয়সে তিনি তাঁর ভাইদের কাঁধে চড়ে মাঠের কোল ঘেঁষে প্রদীপের মতো দেখতে কাকচক্ষুজলে ভরা দিঘিটির উত্তর-পশ্চিম কোণে বড় একটা
আমগাছের নিচে তাঁর নিজের মায়ের কবরের পাশে গিয়ে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে রইলেন।’ সেদিনকার প্রায় প্রতিটি বাল্যবিধবারই এ হচ্ছে, যাকে বলে, চিরদিনের এক কাহিনি। হাসান আজিজুল হকের ফুফু শুধুই একজন নারী নন, একটি সমাজেরও দীর্ঘশ্বাস যেন।

 

ছয়

অনেকেরই হয়তো জানা নেই বিশিষ্ট
কথাসাহিত্যিক জাহানারা নওশিন, যাঁর অনবদ্য একটি উপন্যাস পিতামহীর পাখি, – তিনি সম্পর্কে হাসান আজিজুল হকের আপন বোন। শুধুই বোন বললে ভুল বলা হবে, তিনি যেন তাঁর সত্তারই একটি অংশ; অন্যদিকে জানু আপার বেলায়ও কথাটি সত্যি। তারপরও বলতে হয় – ভাইয়ের পরিচয়ে নয়, আমাদের সকলের ‘জানু আপা’ নিজের গৌরবেই পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত। লেখালিখির পাশাপাশি দীর্ঘকাল তিনি সুনামের সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন। হাসান আজিজুল হকের বিবরণে পাচ্ছি যে, জাহানারা নওশিন ‘লেখালিখিটা শুরু করলেন ঢাকায় আসার পর।’ লেখক হিসেবে জাহানারা নওশিনের কৃতিত্বটা কোথায়? এর উত্তরে হাসান আজিজুল হক জানিয়েছেন, ‘উনি (জানু আপা) লিখতে শুরু করার পরে যখন কিছু কিছু পাঠকের চোখে পড়ল, তখন তাঁরা বলেছেন যে তাঁর প্রোজটা অতিরিক্ত ভালো।’ হাসান নিজের মতামত প্রকাশ করতে গিয়েও অনেকটা একই ধরনের বলেছেন, ‘আমারও মনে হয় তাঁর গদ্যটা খুব ভালো; সাবলীল গদ্য তো বটেই। সাধারণভাবে মেয়েদের লেখায় যে কতগুলো বিষয় থাকে, সেরকম কিছু নেই। মানে নারী-পুরুষ একই রকম।’ এই কথাটিকে শুধুই বোনের প্রতি একজন ভাইয়ের স্ত্ততি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। জাহানারা নওশিনের লেখার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় রয়েছে, তাঁরাও নিশ্চয়ই মানবেন কথাগুলো অক্ষরে-অক্ষরে সত্যি।

 

সাত

হাসান আজিজুল হক বরাবরই
রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ বিষয়ে সচেতন। লেখক হিসেবে নিজের সেই দায়টাকে তিনি কখনো অস্বীকার করতে চাননি, করেনও নি। আমাদের দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র যে বারবার হোঁচট খেতে-খেতে এগিয়ে চলেছে – সেই সত্যটি হাসান আজিজুল হক এড়িয়ে যাননি। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের পরিচালনায় যাঁরা থাকবেন, তাঁরা সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করবেন – এটাই কাম্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে তা হয়নি। এখানে বারবার ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। … স্বাধীনতার এই ৪৪ বছরে আমি ভীতি ও শঙ্কায় বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছি।’ সেটিই তো স্বাভাবিক। কেননা, তাঁর কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভরসার একমাত্র ভূমি’। তার কারণ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের জের টেনে তিনি বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আমি ব্যক্তিগতভাবে তিন-তিনবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। তিনবারই মানুষের অপরিমেয় ভালোবাসা আমাকে রক্ষা করেছে। দেশের মানুষের অপরিমেয় মানবিকতা – এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।’ তাঁর মতে, ‘এটাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। চুয়ালিস্নশ বছর পেরিয়ে এসে আজ আত্মসমীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই মানবিকতার চেতনার কাছেই ফিরতে হবে। কেননা, সেটাই আশার স্থল, ভরসার একমাত্র ভূমি।’ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ২০০৭ সালে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে সমাজ ও অর্থনীতি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। বিনিয়োগ ও উৎপাদন ক্ষেত্র, প্রযুক্তি, সম্পর্ক, অগ্রাধিকার, শ্রেণিবিন্যাস, লিঙ্গীয় সম্পর্ক এগুলোর মধ্যে বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তন জৌলুস এনেছে, নারকীয়তাও এনেছে; আবার একই যাত্রায় উন্মোচিত হয়েছে মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠার নতুন নতুন সম্ভাবনাও।’ সেই সম্ভাবনাকে হাসান আজিজুল হকও কিন্তু একেবারে অস্বীকার করেননি।

 

আট

হাসান আজিজুল হক বিশ্বাস করেন যে, ‘আমরা বর্তমানে বাঁচি, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি, কল্পনা করি। পেছনে যেটা ফেলে আসি সেটা অতীত।’ সেই অতীতটাকে খুব সহজেই যেন তিনি ধরে রেখেছেন। এটাও লেখক হিসেবে তাঁর সমর্থতারই একটা অন্যরকমের পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘নাম মনে রাখা তো স্মৃতি নহে, প্রাণ ধরিয়া রাখাই স্মৃতি।’ এই স্মৃতিগদ্যে হাসান আজিজুল হক যেন সেই প্রাণটাকেই বারবার, নানাভাবে ধরে রাখতে চেয়েছেন। সেটি তাঁর সাহিত্যিক সমর্থতারই বিরাট এক পরিচয় বহন করছে।