সমুদ্রে জোয়ার ঠেলা দিতে নোনা জলের তোড়। সরু খালে সেঁধিয়ে পাঁক-কাদা হোড়ের নরম দেহ খোল বেয়ে আরো ঢেউ ফাঁপিয়ে নরনারীর আবাসের দিকে। কিংবা গন্ধে। মজা গাঙপাড়ে দখলি জায়গায় বাস্তু। সীমানায় তেতুল বাঁশবাগান। দু-চারখানা মোটা গেঁমুয়া, একলা  কেওড়া, নয়তো পাতার খাঁজে খাঁজে সরু ডগায় কাঁটা সাজিয়ে তিন-চার হাত উঁচু হড়কোচ ঝোপ। ঝোপের গা ধরে একদা প্রবল গাঙ, বছরকাবাড়ি খাজনা আদায় ও জমিজমার কিছু কেস হেয়ারিং, খাল ফেরি হাট বাজার স্বৈরাতি নিলাম দিতে আসতেন ব্রিটিশ আমলের জেলা কালেক্টর বাহাদুর সরকারি লঞ্চে, বোটে। জোয়ারভাটাময় সেই নদী পলি জমে এখন মরা খাল।

ডিমাগুড়িহাট বেড় দিয়ে খালটা। সমুদ্র গায়ে মস্ত হাঁ-মুখে নোনা পানি টানছে। ভারি লোহার পাঁচ ফলা বাঁকা দাড়ায় নোঙর খালের গায়ে গেঁথে পরপর ক-খানা লাল-গোলাপি-খয়েরি ট্রলার। চওড়া পাছঘেঁষে খালের পাঁক-কাদায় পোড়া ডিজেল-মবিলের সর লেপে। তেল-সিঁদুর মাখিয়ে আহ্নিক কাঠের গলায় কাগজের রঙিন মালা ঝুলছে হাটমুখো তাকিয়ে। হাটের মানুষের বিকিকিনির টুকরো কথা, দরাদরির বাক্যবিনিময় পুঞ্জীভূত হয়ে হাটের আকাশে। মেঘের গায়ে চাকবেঁধে ঝোলে গুনগুন শব্দ বাতাসে …।   

পাশে ডিঙি নৌকা নোঙর ফেলে কাছি বাঁধা। এক বা দুই অশ্বশক্তি সিলিন্ডার ফিটিং করে লোহার লম্বা তাড়া হাল বা শুকনা নিয়ে জল কাটা তিন ব্লেড পাখায় ভুটভুটি কখানা দেশি নৌকার গায়ে।  নোঙরে সরু কাছি বেঁধে বোরাস ডালির খোঁটা জড়িয়ে সে কাছির পাঁজা।  বেলা সাড়ে ন-টার রোদে নোঙরের লোহা মুঠি তেতে আগুনে-গরম।    

বাণী গাছের চামটি খোঁটায় বাতা মেরে বেঞ্চ।  বেঞ্চে বসে ঘেমো গেঞ্জি খুলে কাঁধে রাখে খরিদ্দার প্রভাত বাঢ়। দোকান ছাউনির পেটে হাওয়া পাক দিতেই কানে ঝপাৎ শব্দ। ঊনপঞ্চাশ-পঞ্চাশের প্রভাত বলে, ‘ও বাপ বিশু কামিল্যা … তিরপালটা বড্ড জখম। কবে পাইথিলু? গত সনে আম্ফান? কত চাষির পানবরজ প্যাকাঠি ভেঙে কাত …।’

চারখানা খুঁটির ডগায় জম্পেশ গিঁট দিয়ে আধখানা তেরপলিন ছাউনি বাঁধা। সেদিকে নজর রেখে সমুদ্রের আচমকা হাওয়ায় মাচায় সাজানো মুড়ির টিন, ছোলা ভাজা, চানাচুর, লেড়ো বিস্কিটের প্লাস্টিক জার, বিড়ি-পান, লাল চায়ের সরঞ্জামে চোখ বুলিয়ে, তেমন বিপদ নেই বুঝে বলে, ‘না খুড়া, যে-বছর বুলবুল হইলো। ভিটায় খড়ের মটকা উড়ে গেল, বুড়ো বাপ-মাকে লিয়ে টানাটানি। মেটে দেওয়াল ধসে কাদা, সে-বছর পঞ্চায়েত …  অঞ্চল দিছিলি।’                                                    

‘ঘর … পাকার ঘর দিছেনি … এক লাখ বিশ হাজার, দিছেনি?’

‘উঁ …’, তখন চোখজোড়ায় চৈত্রে পুরনো চৌকায় কোদাল চালিয়ে গত সনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ গভীরতার মাপে কোদাল কোদাল মাটি, বাঁধ গায়ে গায়ে মেখে ডাগর। কোটালে ঢেউয়ের ধাক্কা রুখতে হাত-পা-গা-পিঠ বিছিয়ে নোনা বাঁধ রোদ খাচ্ছে। বোশেখ পারানি রোদ। সে-রোদে সমুদ্রের ঢেউ চিকমিকিয়ে নাচে। যত নাচে, কালো বরনের বউটা পোঁটলা কাছে টানে। মুড়ির ছাতু গুঁড়োয় তালগুড় মাখিয়ে নাড়ুর গন্ধ। গায়ের বাতাস ঘুলিয়ে মিঠে সুবাস বাঢ় বউয়ের নাক বেয়ে নিজ পুরুষের নাকে। সে-গন্ধ হাওয়ায় পাতলা হয়ে দোকানি বিশু কামিল্যা ঘ্রাণ পায় … সামান্য সমঝে বলে, ‘ও খুড়া কুটুম … কুটুম ঘরে যাবে বোধহয় …?’      

পাশেই গোলাপি শাড়ি জড়িয়ে কলাপাতা রঙের ব্লাউজ গায়ে আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ বয়েসের কালোবরন বউটা। ছোকরা দোকানির মুখে তাকিয়ে কথার স্বর বুঝে দৃষ্টি থেকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। পষ্টি ভাত, নয়তো এক সানকি পান্তা আর শুকনো লংকা মুড়িয়ে নিহেড়ে ভাজা ঝুরোর টাকনায় উদর পূরণে ডাঁটো গতর। দু-তিন পাটে কাপড়ে বাঁধা মুড়ির ছাতু তালগুড়ে নাড়ুর পোঁটলা কাছে টানতে টানতে বিড়বিড়ায়, ‘যতোই ঢাকাঢুকি দিয়ে খাবার আর যৈবন সামলাও পোকামাকড় … মানুষ ঠিক গন্ধ …।’ বলে নিজের পুরুষকে ঝাঁঝায়, ‘তোমার অতো খোঁজ লিবার কী? দোকানি ভাই যৌখান থেকে পায় লিবে। একি পঞ্চায়েত মেম্বরদের নিজের পকেটের পুইসা? গরমেন্টের …।’ একটু থেমে দম নেয়। তটের সাদা পাঁশুটে ডানা মেলে ক-খানা বক এ-তট থেকে ও-তটে যায়। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে বলে, ‘কত বেলা থিকে বুসে আছি ফাঁকা রোদে … বরং শুধোও দিকি, তোমার ভাটা কখন লাগবে?’

‘কী কইলি আমার ভাটা …?’

শেষ টাইমে বেলা দশটা-সাড়ে দশটা। মানুষের বাগানে পটোল, বেগুন, কুমড়ো, ব্যাপারীর ইঁদুরমারা ওষুধ, জলঘাটা গেরস্ত মেয়েদের হাতে-পায়ে হাজার মলম, ঢেলে বিছানো গামছা, সস্তা আটপৌরে শাড়ি বিকিকিনির খণ্ড টুকরো বাক্যগুলো হাটের বাতাসে মিইয়ে যায়। পুলিশ দাঁড়িয়ে, হাট কমিটির বুটি আদায়কারীর টিনের চোঙ ফুঁকিয়ে ঘোষণা, ‘এতদ্বারা হাটের সকল ব্যাপারী পাবলিক ক্রেতা বিক্রেতাদের জানাচ্ছি যে, বেলা দশটায় বেচাকেনা বন্ধ দিন। হাট ফাঁকা করুন। এই মারণ কোভিডের সময় নিজের ও পরিবারের স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন … মুখে মাস্ক ও সাবান বা স্যানিটাইজারে হাত ধোবে …।’

বিস্তারিত খালমুখে নোনা জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।

সেদিকে চোখ পড়তেই বাতার বেঞ্চে মৃদু নড়ে ওঠে প্রভাত বাঢ়, ‘আমার ভাটা …।’

আকাশের দিকে মুখ তুলে দূরে সমুদ্রে সবুজ গাছপালায় এক মুঠি মৃত্তিকাময় ভূরেখা দেখে নিশ্বাস ফেলে! সূর্য দেখে বলে, ‘গন তিথির ভাটা জুয়োর মা গঙ্গা না, সমুদ্র দেবতার লীলা … আমার ভাটা … এ-জলবিশ্বে আমি কে …!’ 

ভাঙা হাটের দু-চারজন মেয়ে-পুরুষ এখানে হাজির। তাদের মুখে হাটে কেনা সাদা রঙিন কাপড়ে মাপমতো নাক-ঠোঁট আটকে ফিতেয় কান বেড় দিয়ে মুখোশ বা মাস্ক। মেয়ে-পুরুষগুলো হাতে-কাঁধে কেনাকাটা দ্রব্যে ভারী ব্যাগ সামলে পেছনে তাকায়। হাটের চালা, বাঁধা কাপড় শায়া, রড-সিমেন্ট-ইট-বালির গোডাউন, ওষুধ, পুস্তকালয়, জেরক্স, মিষ্টি দোকানিরা অনেক দূরে …। সেই নিরাপত্তায় মেয়ে-পুরুষরা পুটুস করে মাস্ক টেনে নাক-ঠোঁটের আড়াল সরিয়ে থুঁতনিতে রাখতে রাখতে বলে, ‘ধুর বাপু, চারদিকে গাঙ ঝাঁপিয়ে, মাঠ ঝাঁপিয়ে হুহু বাতাস … বুকভরে নিতে পারবুনি …? দেহের ভিতর যে হাইফাই … কই আগের বছর আমানকে ভাই দেওর বর ভাইপো ভাগ্নারা গুজরাট, মুম্বাই থানে চেন্নাই থেকে লরি বাস ভাড়া করে ফিরলে …। কদিন দাওয়া, পাশ চালায়, নয়তো উঠোনে বাতায় পলিথিন ঘিরে আলাদা খেলে, আলাদা থাকলে …  তেমন কিছু মারাত্মক হলুনি …।’                                                        পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ভারি চেহারায় মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুলে রমণী। ধান সিদ্ধ উঠোনময় গোবর ন্যাতায় নখের কোণা খোয়ানো আঙুলের মুদ্রা ফুটিয়ে বলে, ‘উঁ … যতসব এখন ভোটাভুটি পেটাপিটি খ্যাদানোর পর …!’

পায়ে পায়ে সকলে কামিল্যার দোকানে হাজির, ‘ও ভাই, আড়খেয়ার ফেরি ভুটভুটি কাইগো? ভাটা লাগছেনি …?’

মানুষগুলো কি শুধু আড়খেয়ার যাত্রী …! তাদের খরিদ্দার বানাতে বিশু কামিল্যা খাল, খালের জলরেখা নয়, বরং সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ঢেউ … উথাল-পাতাল ঢেউয়ের হাবসানিতে সবার মনোযোগ টানে …। সবার যখন সেদিকে আগ্রহী নজর, কামিল্যা বলে, ‘আর আধ ঘণ্টার মধ্যে ফেরি আসবে মনে লাগছে …।’

চুড়িদার-পাঞ্জাবিতে মাঝবয়েসের মেয়েটা গোলাপি শাড়িতে বাঢ় বউকে বলে, ‘তুমি কতক্ষণ বুসে গো দিদি?’

ঊনচল্লিশের বাঢ় বউ মেয়ে সঙ্গী পেয়ে বলে, ‘তোমরা আট-দশবার হাট যাবে আর পাক মেরে আসবে যত সময় লাগবে, ততো সময় থিকে বুসে …।’

কপালে রঙিন টিপ সাঁটা মাঝ বয়েসে চুড়িদার মেয়েটা। তার আধফর্সা হাতে একগুচ্ছ কাচের রঙিন চুড়ি। কব্জির ইঙ্গিতে ঠাঁই দেখিয়ে পাশে বসতেই গোলাপি বউ সরে যায়।  গোলাপি বউ নাড়ুর পুঁটলি কোলে তোলে। মেয়েটা নিজে হাতের ব্যাগ দুপায়ে চুড়িদারের ঠেকনোয় টাইট রাখে। ছোকরা দোকানিকে বলে, ‘ফেরি আসতে আধা ঘণ্টা …? দাও পঞ্চাশ চেনাচুর, চিবাই …।’

দোকানি বলে, ‘পোঞ্চাশে আধা ঘণ্টা …?’ 

চুড়িদার-পাঞ্জাবিতে আধফর্সা মুখটায় কপালে কুচো রঙিন টিপ। ঘামে রোদে চকমকে। সে-মুখ দেখে বিশু কামিল্যা খানিক তাকিয়ে মুখ ফেরাতে দেরি। এটুকুতে থিতু পেয়ে চুড়িদার-পাঞ্জাবি   মেয়েটা হাইকোর্টের উকিল বাবুবাড়ির মেয়ে-বউদের সুরে চোখ ভুরু বাঁকিয়ে বলে, ‘এ তো বড্ড ঠ্যাটা দোকানি? না হয় আবার লুবো …? মাপো তো …।’

খালি গায়ে নোনা জল রোদে কালো আস্তরে বুক-পিঠ। গোলাকার মুখে সাদা দাঁতের ঘন সারি। কালো শর্টসের ওপর ময়ূর রঙের চটকদার লুঙ্গি সেঁটে পেটের কাছে উঁচু গিঁট্টি। স্টিলের চওড়া খোলের চামচ মাপে তিন-চার-পাঁচ চামচ আন্দাজে পঞ্চাশ গ্রাম হতেই কাগজ টুকরো মুড়তে উদ্যোগী দোকানি বিশু কামিল্যা। চানাচুরের পরিমাণ মনমতো না-হতেই বলে, ‘কত দাম গো ভাই …’

‘বেশি না …। চার টাকা মাত্র।’ কামিল্যার স্বরে যেন তুচ্ছতা নেই, বরং বিস্ময়। ধীরগলায় বলে, ‘আর একটু লিবেন গো …।’ ভাই … দিদি … বোন … বউদিমণি …না, ফাঁকা সিথিতে কালো চুল! কী সম্বোধনে যে বাক্যটা সম্পূরক হয় এই কলরোলময় সমুদ্র সমীপে!

কাচের চুড়িভর্তি আধফর্সা বাম কব্জি বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে নেয় চুড়িদার-হাফ পাঞ্জাবি। কাগজ মোড়ক বাড়িয়ে  থমকে যায়। আধফর্সা ডান হাত এগিয়ে আসে। আঙুল মেলে পেতে দেয়। দ্রব্যটা না অপচয় হয় – এমন গ্রহণের ভঙ্গি। আধফর্সা হাত সরে গেলেও যেন কালো হাত হাওয়ায় পাতা থাকে কোন আবেশে যে দু-এক মুহূর্ত! আচমকা আলগা বুকে ঢেউ। কিংবা গায়ে সমুদ্র স্রোত!

চুড়িদার-পাঞ্জাবি চানাচুর খানিক কাটিয়ে গোলাপি শাড়িকে বলে, ‘দিদি হাত বাড়াও, লও।’

‘কেনি গো? তুমি চিবাও …’

‘লিবেনি …? আগো তোমার মেয়ের মতো … না হয় মেয়েছেনার মতো। লিবেনি …?’

বাধ্য হয়ে হাত বাড়ায়, বলে, ‘পাগলি তুই খা  গো – ’

আর একটু নিয়ে গোলাপি দিদির পুরুষের উদ্দেশে চানাচুর হাত এগোয়, ‘একটুক লও গো বায়ু …’

‘কেন গো তুমি কিনছ তুমি খায়ে লিবে। দিলে আর খাবেটা কী? কাগজ?’

‘কইছি আঙ্কেল, তুমি একটু লও।’

মেয়েটার এমন বাহানায় প্রভাত বাঢ় হাত পাতে। বাকি চানাচুরের খানিক নিয়ে পেছনে তাকায়, ‘বউদি, একটু লও … আরে লও -’

‘কেনি গো … গাঙ সমুদ্রের পাড়ে ধারদেনা, খেয়ে ঋণ লুবনি…।’

‘আরে একি আড়খেয়ার পারানি, নাওয়ের ভাড়া পুইসা বাকি রাখছো যে? সঙ্গে আছি এক পথের যাত্রী তাই …।’

হাটফেরত যাত্রীদের মধ্যে ডাঁটো বউদি মোটা কব্জিতে রুপোর বালা গলানো হাত পাতে, ‘দাও … দিবেই যৌখন …।’

কাগজের চানাচুরটুকু ভাগা হাতে দিয়ে দেখে, অতি সামান্য অবশিষ্ট আছে। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে চেঁচায়, ‘ও দোকানি ভাইয়া … আউর পোঞ্চাশ দিবে তো’, বলে ওড়না সরিয়ে পাশ আড়ালে বুকের ভেতর থেকে পাতলা রেক্সিনে চিত্তির-বিচিত্তির পার্সটা বের করে। বাম হাতের মুঠোয় কাগজে মোড়া চানাচুরটুকু। হাতের মুঠোর ঠেকনোয় পার্স রেখে চেইনটা হালকা টান দেয়। মৃদু ধাতব আওয়াজ জল-বাতাসের দমকায় ঢাকা পড়ে। বেশ কয়েকখানা বড়-ছোট নোটের গা থেকে দশ টাকার নোট বের করে। পার্স বুকে রেখে নোটটা এগিয়ে দেয় দোকানির হাতে, ‘লও, দাম কেটে … চেনা দাও জলদি …’

দোকানি ছোকরার হাতে নোট বেয়ে আবদ্ধ গাবুকের পরিপাটিময় গন্ধ কত কাছে … নোনা জলের হাওয়ায় উবে ঘেমো রোদ পোড়া গন্ধ এখন।

নতুন কাগজের দ্রব্য ভাগ দিয়ে, নিজের টুকু দাঁতে চিবোতে শুরু করেছে, চোখে পড়ে খাল বেয়ে এ-মুখো আসছে ভুটভুটিটা লগি ঠেলে ধীরে ধীরে পাড়ে পাঁকে ধাক্কা দিয়ে। প্রভাত বাঢ় দু-চার পা এগিয়ে যায়, ‘এই তোমার সময় হইল মাঝি? ন্যাশায় জুটছিলে? প্যাসেঞ্জার না খেয়ে বুসে?’   

বউ-মেয়েরা কোমরে আঁচল গুঁজে এগিয়ে যায় খাল পাড় বেয়ে জলের দিকে, ‘মাঝি এই তোমার আক্কেল?’

ম্যাশিনের হাল বা লোহার লম্বা রডে  শুকনা বগলে বাগিয়ে দাবড়ি দেয়, ‘চুপ মারো সকলা! ম্যাশিন এমনি চালাইনি গো? কিচিরমিচির থামাও।’

খেয়া পেরোনোর আকাক্সক্ষায় দোকান ছেড়ে সবাই খালের ঢালে ব্যাগ-বোঁচকা-পুঁটলি নিয়ে ডিঙির গায়ে গায়ে হাঁটে। আর কিচিরমিচির-চেঁচামেচির মিলিত রব বাতাস বেয়ে হাটমুখো।

মাঝি বলে, ‘হাত জোড় করি মা-মেয়েরা চুপ কররে!’

কখন যে বাঁধের ঢালের গোড়ায় মাঠ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুই মানুষ গা বেয়ে একদম বাঁধের মাথায়। তাদের একজনের কড়া চিৎকার, ‘এই ভুটভুটির মাঝি কে?’

এতোক্ষণ লগি ঠেলে চুপচাপ ফেরিমুখে এগিয়ে নিয়ে এলো ছোকরা, তার চোখে একেবারে খাকি পোশাক মাথায় টুপি। মুখে মাস্ক। কাঁধের কাছে ধাতব অক্ষর ‘সিভিক পুলিশ’। রোদ পড়ে ঝিকমিকিয়ে বুকের মধ্যে চিক্কির। ডিঙিতে এক হর্স পাওয়ারে ম্যাশিন বসিয়ে ভুটভুটি। তিন ব্লেডের পাখায় নোনা জল। নাওমালিক কাঁচুমাঁচু মুখে বলে, ‘আমি গগন নাইয়া গো বাবু।’

সিভিক পুলিশ বলে, ‘কাল থেকে ঘোষণা হচ্ছে, ফেরি বন্ধ … এক ডিঙিতে গায়ে গায়ে বোসা যাবেনি … রোগ বাড়বে … মুখোশ-মাস্ক লাগাও সক্কলা।’

যাত্রী মেয়েরা থুঁতনিতে নামানো মাস্ক সঙ্গে সঙ্গে টেনে নাক অবধি ঢাকে, ‘অখন খেয়া ছাড়লে টানে আধধণ্টা চাল্লিশ মিনিটে বেলেয়াড়া গো বায়ু? কি তার আগেও গো লাবি পড়বো?’

গোলাপি শাড়িতে কালো বউ ভাইপো-ভাগ্নার বয়েসি ছোকরা পুলিশ দেখে পোঁটলা আলগা করে খানচারেক নাড়ু তার হাতে দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ বাপ…  মেয়ের দোরে যাবো বলে বার হলুম।’ আর চারটে হাট কমিটির ঘোষকের হাতে গুঁজে দিয়ে মায়ের কণ্ঠে অনুরোধ, ‘তোরা তোদের বোনের ঘরে যেতে দিবিনি গো … ক-মাস চোখে দেখিনি আঁতের পাখিকে।’ চুপ থেকে নজর, হাতের নাড়ু হাতে। মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভারি। গোলাপি শাড়ি বলে, ‘ভালোবেসে কষ্টের ক’টা … মুখে দিলিনি গো?’

চুড়িদার-হাফ পাঞ্জাবি, কপালে রঙিন টিপ ওড়না গুছিয়ে নিজেকে জানান দিয়ে কাছাকাছি হয়, ‘দিন না ভাই মায়ের কাছে যেতে।’

ছোকরা সিভিক পুলিশ ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘ইয়ার্কি? ফেরি ছাড়তে দিলে নিজের চাকরি থাকবে? আবার সমুদ্দুরে ঘূর্ণি জন্মাচ্ছে, দুশো কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসবে … নাকি …। কিছু ঘটলে অফিসার …?’

মেয়ে-বউরা সকলে আরো বেগে আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার দেয়, ‘সে তো দেরি … আমাদের বাবা কপিল মুনি আর কোটগোড়ার পীর সাহেব আছে, ও-ঝড় বাঁকিয়ে দিবে।’

ছোকরা পুলিশ গোলাপি বউয়ের হাতে নাড়ু ক’টা দিয়ে বলে, ‘লও, ফ্যারত লও দিকি।’ চুড়িদার-পাঞ্জাবির বুকে ঢেউ আছড়ায়, ‘ক’দিন কাটিয়ে এলুম মাসির দোরে … আবার …!’ হঠাৎ দেখে হাটের ঘোষক খানদুয়েক চিবিয়ে ঘিঁটছে…! গোলাপি শাড়ি-দিদির হাতটা টেনে ক-পা এগোয় চুড়িদার-পাঞ্জাবি। ফিসফিসোয়, ‘আর খানচারেক বার করু গো দিদি …।’