এই যে আঁধার

পশ্চিম আকাশের লালিমা মিলিয়ে অচিন্ত্যপুরে অন্ধকার নেমেছে একটু আগেই। সেখানকার একটি বাড়ির উঠোনজুড়ে তখনো একজোড়া পথভুলো চামচিকা বিক্ষিপ্ত উড়ে বেড়াচ্ছে। উঠোনের এক কোণে ঘ্যাচর ঘ্যাচর শব্দ করে সবিতা টিউবওয়েল চেপে কাদামাটি-মাখা পা ধুতে-ধুতে বারান্দায় বইপত্র ছড়িয়ে বসে-থাকা আট বছরের বোনঝি ছটুকে বলে, ‘ইট্টু পড়ে নে মন দিয়ে তারপর ভাত দেব।’ আজকে হাঁটাহাঁটিটা বড্ড বেশি হওয়ায় পা-দুটো ব্যথায় টনটন করছে। পায়ের আর দোষ কি – ষোলো বছর বয়স থেকে শুরু করে ছত্রিশ বছর ধরে এভাবে হেঁটেই চলেছে। যতদিন পা-দুটো চলবে হাতে নগদ পয়সা আসবে, নইলে তো না-খেয়ে মরতে হবে কিংবা কারো গলগ্রহ হতে হবে। এখন ভগবানের কাছে তার একটাই চাওয়া – মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেহটা যেন চালু থাকে, বিছানায় পড়বার আগেই যেন যম এসে তাকে নিয়ে যায়। জ্যৈষ্ঠের মাঝামাঝি, আকাশের ঘোর অন্ধকার চিরে থেকে থেকে তীক্ষè বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আজ বিকেল থেকে ভ্যাপসা গরম, গাছের একটা পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। সবিতা ভাবে, কল চেপে মাথায় দু-ঘটি জল ঢালতে পারলে বেশ লাগতো; কিন্তু এই অবেলায় আর সায়া-ব্লাউজ ভেজাবে না। বৃষ্টি নামতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে, তখন ঠান্ডা বাতাসে গা-টা এমনিই জুড়াবে, এখন আর অহেতুক স্নানের প্রয়োজন নেই। ভাগ্য ভালো, খাঁ-বাড়িতে দুধ দিয়ে সময়মতো ঘরে ফিরে এসেছে। টানা ছত্রিশ বছর ধরে এই কাজ করে এলেও সবিতার একঘেয়ে লাগে না। প্রতিদিনই দুধ জোগান দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাড়ির বিচিত্র মানুষের সঙ্গে চলতে হয়। বউ-ঝিরা তাকে ডেকে সুখ-দুঃখের কথাও শোনায়। কেউবা শুকনো মুখ দেখে জল-মুড়ি-মোয়া এগিয়ে দেয়, দু-একদিন এক খিলি পানও দেয় কেউ কেউ। তাই এদের কারো বিপদ-আপদ দেখলে সবিতা না করতে পারে না। খাঁ-বাড়ির ফর্সা মতোন অল্পবয়সী মেজো বউটা ওই বেলায় ডেকে বলল, ‘পিসি আমার জন্যি ইট্টু কষ্ট করতি পারবা?’

‘কী বলো?’ সবিতা বউটার কাছে দু-কদম এগিয়ে যায়।

‘আমার ছেলেডার আইজ এক মাস আমাশা, এতো ওষুধ খাওয়াচ্ছি কিছুতিই কাজ হচ্ছে না। কবিরাজ কলো কিছুদিন ছাগলের দুধ খাওয়াতি। তুমি যদি কষ্ট করে ব্যবস্থা করতে।’

‘ছাগলির দুধ তো পাওয়াই মুশকিল, দেখি আমি যদি জুগাড় করতি পারি তালি দেখবানে ওইবেলা।’

সবিতা খেয়াল করেছে সালেক বিশ^াসের বাড়িতে কিছুদিন আগে ধাড়ি ছাগলটা বাচ্চা বিইয়েছে। তিনটে কালো ছানা ওদের বাড়ির উঠোনজুড়ে নেচে বেড়ায়। ফেরার পথে সবিতা সালেক বিশ^াসের বউকে বলে, ‘ভাবি এক পুয়া করে ছাগলের দুধ দিতি পারবা রোজ। সত্তর টাকা কেজি দিয়া যাবে।’

‘দুধ তো আমরা বেচি নে দিদি। যেটুক দুধ হয় তিনডে বাচ্চারই সব লাগে।’

সবিতা তখন খাঁ-বাড়ির নাতির কঠিন আমাশয়ের কথা বললে সালেকের বউয়ের মনটা গলে।

‘আইজ সন্ধেয় পুয়াটেক দুধ হলি কাজ হতো। বাচ্চাডার সমস্যা না-হলি বলতাম না।’

‘এখন তো দুধ পাবা না, তিনটে বাচ্চা মাডারে ছাড়ে কোনো সুমায়? তুমি বিকেলের দিকি অ্যাসো, আমি বাচ্চাগুলো সরায়ে রাখপানে।’

সবিতা ঠিক করেছে আজ রাতে আর কিছু খাবে না। দুপুরবেলা শখ করে চালতার অম্বল রান্না করেছিল। তাই খেয়ে এখনো টক ঢেকুর উঠছে। বয়স হচ্ছে, এখন আর পেটে যা-তা সহ্য হয় না। অথচ এককালে বরই-বাটা, তেঁতুল-মাখা, কাঁচা আমভর্তা দেদার গিলেছে। আজকাল রাতে মাঝে-মাঝে উপোস থাকলে শরীরটা বরং ভালো যায়। ঘণ্টাখানেক পরে এক গ্লাস জল খেয়ে ভাগ্নিটাকে কোলের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ছটু পড়ছিল, সবিতা তার পাশে পাটিতে গা এলিয়ে দিলে ক্লান্ত শরীরে ঝিমুনির মতো আসে। হঠাৎ তার একটা ফ্যাঁসফেঁসে পুরুষকণ্ঠ শুনে ঘুম ভাঙে। ‘সবিতা, সবিতা – বাড়ি আছো সবিতা?’

সবিতা একবার চোখ মেলে আবার চোখ বুজে বোঝার চেষ্টা করে সে স্বপ্ন দেখছিল কি না। অর্ধচেতনেও বুঝতে পারে বাতাসটা বোধহয় বেশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে।

তখন ছটু গায়ে হাত দিয়ে বলে, ‘মাসি মাসি – কিডা যেন ডাকছে।’

সবিতা চোখমুখ কচলে বুকে আঁচল টেনে উঠোনের শেষ মাথায় ঝোলানো চল্লিশ ওয়াটের বাতিটার সুইচে টিপ দেয়। তারপর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে সাবধানী পায়ে বারান্দা থেকে নেমে বলে, ‘কিডা?’

‘আমি, আসপ বাড়ির ভিতর?’

বয়স্ক পুরুষকণ্ঠটা ঠিক চিনতে না-পারায় সবিতা সে-কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায় দক্ষিণে বাড়ির প্রবেশমুখে পাটকাঠির বেড়ার কাছে। কণ্ঠটা প্রাচীন, ক্লান্ত আর বিষণ্ন মনে হয় বলে তার ভয় করে না। হলদে ঘোলাটে আলোয় সে দেখে সাদাচুল, মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ ঝাপসা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিরন্তর ঝিঁঝিঁর ডাকের ভেতর হঠাৎ সে ভাবে, এই মানুষটাকে কোথায় যেন দেখেছে। সামান্য একটুখানি ঘুমিয়ে উঠে সবিতার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। একটা কাপড়ের ঝোলা কাঁধে আগন্তুক দু-পা এগিয়ে এলে সে গভীরভাবে তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আবহাওয়ার গুমোট ভাবটা কেটেছে। অদূরে বাঁশঝাড় থেকে বাতাসের শনশন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

দুই

পরপর তিন মেয়ে জন্ম দেওয়ায় সূর্যকান্তি দিনে একবার হলেও স্ত্রী উমাকে গালাগাল করত। মুখ বুজে দিনের পর দিন অন্যায়-বাক্য হজম করার মতো মেয়েলোক উমা নয়। মুখের কাছের চুলগোছা সরিয়ে সে বলত, ‘মেয়ে কি আমি বাপের বাড়িরতে পেটে বয়ে নিয়ে আইচি?’

বড় মেয়েটাকে এগারো বছর বয়সে বিয়ে দেওয়ার কয়েকদিন পর সে উমাকে বলে, ‘ম্যাঝেডারেও যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শ^শুরবাড়ি পাঠাবো।’

‘কও কী? এখন কি সেই আগের কালের দিন আছে যে দুধির বাচ্চা বিয়ে দিবা? সবিতার তো নয় বছরও বয়স পুজিনি।’

‘না পুজুক, মাথায় বুঝা তো তুমার না, আমার। আমি মরে গেলি তুমি পারবা মেয়েদের বিয়ে দিতি? আমার শরীরীর ভাবগতিক এমনিই ভালো না।’

এই কথার সাত মাসের মাথায় সূর্যকান্তি সফল হয়। নগদ দু-হাজার টাকা পণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নারায়ণ পাণ্ডেকে রাজি করাতে পারে। নারায়ণের ছেলে বিষ্ণু তখন ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়ে স্কুল বাদ দিয়ে বাপের কাঠের আড়তে বসা শুরু করেছে। বিষ্ণু বিয়ের আসরে ছাদনাতলায় শুভদৃষ্টির সময় সবিতাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। বাবা সামান্য টাকার লোভে কীভাবে এই কালো কুৎসিত মেয়েটাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারল?

শ^শুরবাড়ি নিতান্তই পাশের গ্রামে বলে সবিতা অনেকটা স্বাধীনভাবে বাপের বাড়ি বা শ^শুরবাড়ি থাকতে পারত। তবে সে তার অপরিণত বুদ্ধি দিয়েও সহজে মায়ের বাড়ি আর শ^শুরবাড়ির পার্থক্য স্পষ্ট টের পেতো। শাশুড়ি তাকে সারাদিন ইচ্ছেমতো খাটালেও আধপেটা খাইয়ে পার পেতে চাইতো। সে জানতো, এই বাড়িতে তার কালো রঙের কারণে কোনো কদর নেই। তাই এমনকি খেতে বসে দ্বিতীয়বার শাশুড়ির কাছে ভাত চাইতে সাহস করতো না। বালিকাবধূ সবিতা সহজে স্বামীর সামনে পড়তে চাইতো না। ও খেয়াল করেছে, বিষ্ণু তাকে দেখলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

বছর-দুই পর গায়ে-গতরে জোয়ান হয়ে-ওঠা বিষ্ণু একদিন পথে শ^শুরকে পেয়ে বলল, ‘আপনার মেয়ে যেন আর ও-বাড়িতে না যায়। আমি দরকার হয় আপনার দুই হাজার টাকা শোধ করে দেবো।’

সূর্যকান্তি বলে, ‘এ কেমন কথা বাবা?’

‘এইডেই আমার সিদ্ধান্ত।’ সূর্যকান্তি টের পায় বিষ্ণুর কণ্ঠ এই দু-বছরে অনেক ভারী হয়ে গিয়েছে।

‘তাও তুমার বাবার তো বিষয়ডা জানা দরকার, তুমি নিতান্তই বাচ্চা ছেলে।’

‘ঠিক আছে, দরকার মনে করলি আপনি তার সাথে কথা বলেন, কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত ফাইনাল।’

পরের সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় সূর্যকান্তি নারায়ণের কাঠের আড়তে হাজির হলে

 নারায়ণ বলে, ‘আমার আর কোনো কথা নেই। ছেলে এখন বড় হয়েছে, তার মতামতই আসল। তার উপর আমি কোনো কথা বলতি পারব না। তাছাড়া আমার ওই এট্টাই ছেলে।’

‘বিষয়ডা কিন্তু দুই বছর আগেই তুমার ভাবা উচিত ছিল, বিয়ে ব্যাপারডারে তুমি ছেলেখেলা মনে করলে?’

‘আরে মুশকিল – আমি কি জানতাম এই অবস্থা হবে – আমার ছেলে যদি কালো মেয়ের সাথে সংসার করতি না চায় তালি আমি কী কত্তি পারি? তুমি তুমার মেয়ে ফিরয়ে নিয়ে অন্য ব্যবস্থা করোগে।’

এরপর দুটো-তিনটে দিন পাতার বিড়ি টানতে-টানতে সূর্যকান্তি উ™£ান্তের মতো পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এক রাতে সামনে ভাতের থালা নিয়ে স্ত্রীর কাছে প্রতিজ্ঞা করে, ‘আমি নারায়ণরে ছাড়ব না, আমার কষ্টের দুই হাজার টাকা! আর কালো বলে আমার মেয়ে কি মানুষ না?’

সেদিনই দুপুরবেলা গাঙের ঠান্ডা জলে দুটো ডুব দিয়ে সূর্যকান্তির মাথাটা হঠাৎ খুলে যায়। তখন তার মনে পড়ে হক গ্রুপের আইয়ুবের কথা। আইয়ুব মাঝে মাঝে তার দোকান থেকে চাল নেয়, বাকিও দেওয়া লাগে কোনো কোনো দিন। ওরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাত-বিরাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় বলে আইয়ুবের কথা অগ্রাহ্য করার সাহস এই তল্লাটে কারো নেই। আইয়ুব একশ টাকার বিনিময়ে রাজি হয় বিষয়টা হেনস্তা করতে। সে বলে, ‘এই গিরামে থাকতি হলি আইয়ুবির কথা শুনাই লাগবে। আমি আইজ রাত্তিরিই যাব নারায়ণের বাড়ি। ওর ছেলের কী যেন নাম?’

‘বিষ্ণু – বিষ্ণু পাণ্ডে। এই পঞ্চাশ টাকা দিলাম। কাজ ফাইনাল হলি বাকি টাকা পাবা।’

‘তুমি চিন্তা করো না কাকা – আমি কারোর সাথে বেইমানি করিনে। কালকের দিনডা বাদ দিয়ে পরশু সকালেই তুমি মেয়ে পাঠাবা শ^শুরবাড়ি। দেখি পাণ্ডেগের কত সাহস!’

দুদিন পর শনিবার দুপুরবেলা বউকে দিয়ে মেয়েকে শ^শুরবাড়ি রেখে আসতে পাঠায় সূর্যকান্তি। কিন্তু উমা এক ঘণ্টার ভেতর ফিরে এসে পাংশুমুখে বলে, ‘বিষ্ণু তো বাড়ি নেই।’

বিস্মিত সূর্যকান্তির জিজ্ঞাসা, ‘ক্যান সে কনে গেছে?’

‘পরশু রাত্রিরতে সে নাকি উধাও। কনে গিয়েছে কয়ে যায়নি। ও-বাড়ির কেউ কিছু কতি পারে না।’

সূর্যকান্তি বৃত্তান্ত শুনে একটা বিড়ি ধরিয়ে উঠোনে পায়চারি করতে থাকে, তার কিছু বুঝতে বাকি থাকে না। আইয়ুবের হুমকি শুনে ওই সুমুন্দির চালাক ছেলে বাড়ি ছেড়েছে।

এ-ঘটনার তিনদিন পর সবিতা ভরদুপুরে একটা পোঁটলা হাতে করে শ^শুরবাড়ি থেকে চলে আসে। এরপর আর সে ওখানে যায়নি। দিনে দিনে বছর পেরিয়ে গেলেও এলাকায় বিষ্ণুর টিকিটি পর্যন্ত দেখা না-গেলে নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে সূর্যকান্তির মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া উপায় থাকে না। অল্পবয়সী ছেলে, আগে বুঝলে এভাবে ভয় না-দেখিয়ে সে আদর-স্নেহ করে কাছে টানতে পারতো। ডেকে মিষ্টি কিনে খাওয়াতো, নতুন লুঙ্গি-গেঞ্জি কিনে দিত মাঝে মাঝে।

তিন বোনের পর সবিতার একটা ভাই হয়েছিল, ওর বয়স আট। গত ফাল্গুনে ছোট বোনটারও বিয়ে হয়ে গেল। সবিতার সমবয়সী মেয়েরা যখন সন্তান কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেজেগুজে স্বামীর সঙ্গে সিনেমায় বা পুজোমণ্ডপে যায়, তখন সবিতার চোখে জল আসে। বাড়িতে ফিরে গিয়ে সে আয়নার নিজের কালো মুখখানা দেখে নিজেকে ধিক্কার দেয়। তোর ওই কালো মুখের কারণে জগতে কেউ আপন হলো না। সে কয়েকবার করে ভেবেছিল লাথিঝাঁটা-খাওয়া এই জীবন থাকার চেয়ে না-থাকাই ভালো। ভগবান যদি তাকে পৃথিবীতে পাঠাবেই তো এমন পোড়ামুখো করে বানাতে গেল কেন? তার ভাণ্ডারে কি কোনোকিছুর অভাব পড়েছিল? কী হতো গায়ের রংটা একটু উজ্জ্বল করে গড়লে? প্রত্যাখ্যাত জীবনকে ক্রমাগত ধিক্কার দিতে দিতে, গলায় ফাঁস নেওয়া নাকি বিষ খাওয়া কোনটা সহজ – ভাবনা এতোদূর পর্যন্ত এগোয়। এ-সময় কয়েকটা মাস তার ঘোরাচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যে কেটেছে; কিন্তু আত্মহত্যা করলে নাকি পেত্নি হয়ে গাছে গাছে থাকতে হয়, দুষ্টুমি করলে ফকির-ওঝারা বোতলে ভরে রাখে, আবার পুড়িয়েও মারে – এই কথা মনে হলে তার আর ওই পথে পা বাড়ানোর সাহস হয় না।

খামখেয়ালি-স্বভাব বাপের চালডালের ব্যবসা কখনোই খুব রমরমা চলতো না। বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সূর্যকান্তির বাতের ব্যথাটা চরমে ওঠায় সে-ব্যবসা কোনোরকমে চলতে থাকে। স্বামী-পরিত্যক্ত সবিতা অনেকদিন ধরে দুটো পয়সা আয়ের পথ খুঁজছিল, বাপ-মাকে এই হতভাগা মুখ দেখাতে আর ভালো লাগে না, ভাতের থালা সামনে নিয়ে তার লজ্জা লাগে, দু-একদিন গণ্ড বেয়ে চোখের জল পড়ে ভাতের থালায়। সে ভেবে দেখে, কাঁথা সেলাই বা ধান ভানা কাজে তার পোষাবে না। কয়েকটা মাস রাতদিন চিন্তা করে শেষে সিদ্ধান্ত নেয় মানুষের বাড়িতে গরুর দুধ জোগান দেওয়ার কাজ করবে। লোকে হয়তো প্রথমে নানান কথা বলবে, কিন্তু অতো কিছু পরোয়া করতে গেলে অকালে নিঃস্ব-অসহায় হয়ে তাকে মরতে হবে। অ্যালুমিনিয়ামের একটা কলস আর একটা বালতি নিয়ে সকাল-বিকাল বের হয়ে প্রথম মাসে দুশো টাকা লাভ রইল। আট-নয় মাস পরে জমানো টাকা দিয়ে সবিতা ছোট ভাই দূতকুমারকে একটা মুদির দোকান করে দেয়। কলস আর বালতি টানতে টানতে সবিতার কোমরে-হাতে কড়া পড়ে যায়। কিন্তু মাস গেলে হাতে যখন টাকাগুলো আসে সবিতার সব কষ্ট নিমিষেই লঘু হয়ে ওঠে। বাপের মুখে শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষ নাকি জমিদার ছিল, তাদের অধীনে শত শত বিঘা জমি, বেশকিছু পাইক-পেয়াদাও ছিল। কাঁখে কলস হাতে দুধের বালতি নিয়ে ঝুঁকে হাঁটতে হাঁটতে সবিতা ভাবে, পূর্বপুরুষের কোন পাপে ব্রাহ্মণ জমিদারের বংশধর হয়ে তার এই দাসী-বাঁদির জীবন?

ছোটভাই দূতকুমার নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল এক গ্রাম পরে শান্তিডাঙ্গায় রতন গাঙ্গুলির মেয়েকে। ওই গ্রামে সে কয়েকটি পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করতো। সেসব দেখাশোনার কথা বলে সবিতার ভাইটা শেষে শ^শুরবাড়িতেই থাকতে শুরু করল। নিঃসঙ্গ সবিতা তখন ওর পিঠাপিঠি বোন শর্মিলার ছেলেটাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। সুমন সকালে স্কুলে যায় আর বিকেলবেলা দুধ জোগানের কাজে তাকে সাহায্য করে। আশি^নের এক সন্ধেবেলা সবিতার বাপটা হঠাৎ বুক-ব্যথায় দোকানের ভেতরেই মরে পড়ে রইল। সেই শীতে ওর মা’টা শ^াসকষ্টে মরলে সবিতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এখন সে কাকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবে? ততোদিনে বোনপো সুমন বাপের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে সৌদি আরব যাবে বলে গোঁ ধরেছে। মাসিকে বলছে, বাকি টাকা তোমার দেওয়া লাগবে।

দূতকুমার সপ্তাহে কি পনেরো দিনে একদিন এটা-সেটা কিনে নিয়ে বোনটাকে দেখে যেতো। সে একদিন বলল, ‘দিদি তুমি একা একা থাকো, না-হয় আমার সাথে চলো।’

সবিতা বলেছিল, ‘তুই এমনি থাকিস শ^শুরবাড়ি। তারপর যদি দিদিরে নিয়ে উঠাস লোকে কী কবে? তার চেয়ে আমি যে-কয়দিন বেঁচে আছি বাপের ভিটে আগলায়ে ধরেই পড়ে থাকি। তাও তুই যদি কোনোদিন আলাদা বাড়িঘর করিস সেদিন যাব।’

দোকানদারি আর মাছের চাষ করে দূতকুমারের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছিল। ভাইয়ের বিষয়বুদ্ধি দেখে খুশিই হয় সবিতা। জমানো পয়সা দিয়ে সে প্রতিবছর আধ-এক বিঘা করে জমি কেনে। পুবপাড়ার বদু লস্কর গোপনে সবকিছু বেচে ইন্ডিয়া যাবে বলে দূতকুমারের কাছ থেকে এক বিঘা ধানি জমির বায়না বাবদ পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিল। পরের মাসেই রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা। এর মধ্যে এক সন্ধ্যায় আইয়ুবের চেলা মাজেদ দূতকুমারের দোকানে এসে হাজির। ‘বদু লস্করের জমিডা তুই ছ্যাড়ে দে। উডা আমরা নিচ্ছি।’

‘তুমরা নেচ্ছ মানে – আমি তো টাকা দিয়ে বায়নাই করিচি।’

‘বায়না করিচিস ভালো কথা। এখন বাকি টাকা আইয়ুব চাচা দেবে, জমি তার নামে রেজটি হবে।’

‘ইডা কি মগের মুল্লুক নাকি?’

‘আইয়ুব চাচারে মনে হয় তুই এখনো ভালো করে চিনিসনি। তোর বাপ কিন্তু চিনতো।’

‘আমার অতো চিনার দরকার নেই। দেশে তো আইন-আদালত আছে, নাকি?’

‘দেখি আইন-আদালত তোরে কীভাবে বাঁচায়।’

‘তুমি যাও, যা পারো করোগে। ওইরম কথা জীবনে বহুত শুনিচি।’

প্রতিরাতেই দশটার দিকে তিন ব্যাটারির টর্চটা নিয়ে দূতকুমার তার তিনটে পুকুরের চারপাশ একবার ঘুরে আসতো। সেই রাতেও বেরিয়েছিল টর্চ হাতে করে, এবার অনেক টাকার মাছ ছাড়া হয়েছে বলে চৌকিদারিটাও বেশি করতে হয়। রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেলেও স্বামী যখন বাড়ি ফিরছে না তখন অর্চনা ভাইটাকে পুকুরের দিকে পাঠায় স্বামীর খোঁজ নিতে। সে গিয়ে খানিক খোঁজাখুঁজি করে পুকুরপাড়ে তালগাছের নিচে দূতকুমারের শরীরের তিনটে রক্তাক্ত খণ্ড আবিষ্কার করে।

ভাইয়ের এই করুণ মৃত্যু দেখে সবিতা দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে যদি আগে জানতো তাহলে দূতকুমারকে সাবধান করে দিতো ওই বাহিনীর লোকেদের সঙ্গে না লাগতে। গ্রামে পুলিশ এসেছিল, লাশ মর্গে নিয়ে কাটাছেঁড়াও হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সবিতা ভাই-হত্যার কোনো বিচার পায়নি।

এরপর থেকে যতই দিন যায় সবিতার চারপাশ ততোই সংকীর্ণ আর অন্ধকার হয়ে আসে। কাছের মানুষগুলো একে একে সব চলে গেল। একটা মেয়েমানুষ কীভাবে একলা বাড়িতে থাকতে পারে। তাই সুমন সৌদি আরব চলে গেলে ছোট  বোনের মেয়ে ছটুকে সে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ছটু বলে, ‘মাসি আমি বড় হলি তুমি কি আমারেও সুমনদার মতো সৌদি আরব যাতি দিবা? শুনিচি ওই দেশে নাকি মেলা টাকা।’

‘না মা, তুই বিদেশ যাবি ক্যান, আমি তোরে বিয়ে দিয়ে ঘরজামাই র‌্যাখে দেব আমার কাছে।’

সবিতা আজো দুপুরে স্নানশেষে হাতে আয়নাখানা নিয়ে যত্ন করে সিঁথিতে সিঁদুর দেয়। বিষ্ণু চলে যাওয়ার তিন বছর পর কলকাতা থেকে ঘুরে এসে একজন বলেছিল, সে বাসে করে যাচ্ছিল রাস্তায় নাকি বিষ্ণুকে দেখেছে। তারপর তিন যুগ কেটে গিয়েছে মানুষটার কথা কেউ কিছু বলতে পারে না। সবিতা ভাবে, আমি কি এতোই কদর্য যে আমার কারণে দেশ, বাপ-মা সব ছেড়ে গেলে চিরকালের জন্যি? তার খুব ইচ্ছে হয় একবার কলকাতায় যদি যেতে পারতো, যদি দেখতে পারতো বিষ্ণু ওই দেশে কার সঙ্গে ঘর বেঁধে কতটা সুখে আছে, কতজন ছেলেমেয়ের বাপ হয়েছে সে, ওরা দেখতে কেমন হয়েছে।

তিন

মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে সবিতার জবান বন্ধ হয়ে আসে। অথচ বহু কথা অজস্র প্রশ্ন বিস্তর অভিমান তার রয়েছে এই মানুষটার কাছে। কিন্তু এতো কথা সে কীভাবে বলবে একসঙ্গে? সবিতা কেবল বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলতে পারে, ‘আপনি?’

‘হ্যাঁ সবিতা আমি। তুমি আমারে থাকতি দিবা তুমার কাছে?’

‘কী কন, কুথায় ছিলেন এতোকাল – আপনার বউ-ছেলেমেয়ে?’

‘পিছনের কথা জিজ্ঞেস করলি কোনো উত্তর দিতি পারব না। তবে এট্টা সত্যি কথা বলি – এখন আমার কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। জগতে তুমিই এখন আমার একমাত্র আপনজন।’

‘আমার বিশ^াস হচ্ছে না, আপনি সত্যিই নারায়ণ পাণ্ডের ছেলে বিষ্ণু পাণ্ডে?’

‘তোমার আর দোষ কী – অবিশ^াস তো হবেই। তুমার কাছে আমার মাপ চাওয়ারও কোনো মুখ নাই।’

হঠাৎ দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি নামলে সবিতা লোকটার শুষ্ক হাতখানা ধরে বলে, ‘চলেন ঘরে চলেন।’

সবিতা বিষ্ণুর হাত ধরে মাদুরে বসালে ছটু বলে, ‘মাসি এই বিটাডা কিডা?’

‘তুমার মেসো হয় মা।’

বিষ্ণু বলে, ‘এক গ্লাস জল দিতি পারবা, খুব পিপাসা।’

ঘরে ঢুকে কলস থেকে জল ঢালতে গিয়ে সবিতার বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। সে কান্না রোধ করতে মুখে আঁচল চেপে ধরলেও বুকের ভেতর থেকে একটা গুমরানো আওয়াজ বের হয়ে আসে। আঁচলে চোখ মুছে জলভর্তি গ্লাস নিয়ে বিষ্ণুর সামনে যখন ধরে তখন একটা বজ্রপাতের আওয়াজের সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গিয়ে চারপাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে দেয়। সবিতা ভেতর থেকে হারিকেন ধরিয়ে এনে বারান্দায় রাখছিল। আচমকা তার পায়ে বিষ্ণুর স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে। বিষ্ণু সবিতার দু-পা জড়িয়ে ধরে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি তুমার কাছে মাফ চাই সবিতা। আমি তুমার জীবনডা নষ্ট করে দিছি, তুমি মাফ না করলি ভগবানও আমারে ক্ষমা করবে না।’

বিব্রত সবিতা এক কদম পিছিয়ে এসে বলে, ‘ছি, এ কী – আপনি আমার স্বামী না – গুরুজন!’

আবার কাছাকাছি কোথাও বজ্রপাত, বাতাসের গতি বাড়ছে। প্রচণ্ড শব্দে ছটু চমকে ওঠে, অনেকক্ষণ হলো তার খিদে লেগেছ। মাসি কখন বলেছিল ভাত দেব, এখন আর মনে নেই। আগন্তুকের সামনে ভাতের কথা বলতেও ছটুর সংকোচ হয়। ঘুম-ঘুম চোখে সে টের পায় মাসি কাঁদছে, কাঁদছে ওই অদ্ভুত বুড়ো লোকটাও। কিন্তু দুজন বয়স্ক নরনারীর এই যৌথ ক্রন্দনের কারণ উদ্ঘাটন করতে পারে না কিছুতেই। আলো-আঁধারির ভেতর পুরো পরিবেশটা তার কাছে ভারী অদ্ভুত লাগছে।