আনিসুজ্জামান-জীবনকথা

ত্রিশ

১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা বইমেলার ‘থিম কান্ট্রি’ ছিল বাংলাদেশ। বইমেলা উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর সঙ্গে ও সে-উপলক্ষে সরকারি খরচে গিয়েছিলেন লেখক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক ও আমলাদের বিরাট এক দল। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনের পক্ষে সবার থাকা-খাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। শুধু প্রধানমন্ত্রীর সহচর যাঁরা ছিলেন তাঁদেরই আবাসন ও অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা তাঁরা করতে পেরেছিলেন। সরকারি আমন্ত্রণে অন্য যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের নিজ নিজ আবাসন ও খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরার জন্য সরকারের নির্ধারিত হারে অগ্রিম অর্থ প্রদান করা হয়েছিল। তবে তাতে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন যে তাঁদের হতে হয়নি এমন নয়। এজন্য বইমেলায় যোগদানকারীদের মধ্যে কেউ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলে আনিসুজ্জামান তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বইমেলায় উপস্থাপনের জন্য মূল প্রবন্ধ লিখতে। আনিসুজ্জামান বই এবং বইমেলা সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সেটি উপস্থাপনের কোনো সুযোগই হয়নি। বস্তুত বইমেলার উদ্বোধক শেখ হাসিনা, অনুষ্ঠানের সভাপতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সে-অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ফলে স্বতন্ত্র প্রবন্ধ উপস্থাপনের কোনো সুযোগ তাতে ছিল না। আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য পরে একটি অধিবেশনের ব্যবস্থা করা হয় এবং তিনি সেখানে তাঁর প্রবন্ধ পড়েন।

কিন্তু উদ্বোধন-অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বড় বিপত্তি ঘটেছিল অন্য একটা বিষয় নিয়ে। সঞ্চালক শেখ হাসিনার পরিচয় দিলেন ‘বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী’ বলে, অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের উত্তেজনায় ভুলবশত। এ নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই বিস্মিত এবং বাংলাদেশের মানুষেরা ক্ষুব্ধ হলেন; কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া ঘটল দেশে। বিরোধীদলের নেত্রী বললেন, ‘উনি ভারতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে।’ পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ-নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছিল এবং ভারত সরকার এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিল। বইমেলার উদ্বোধনশেষে শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে প্রথমে চুরুলিয়া ও পরে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন যথাক্রমে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে। বিশ্বভারতী এ-সময় ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের বর্ণনা-প্রসঙ্গে আনিসুজ্জামান আরো কিছু কথা লিখেছেন তাঁর বিপুলা পৃথিবী গ্রন্থে। তাতে তিনি যা বলেছেন তার কিছু গুরুত্ব আমাদের সকলের জন্যই রয়ে গেছে। এতে তিনি লিখেছেন :

‘শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আরেকটি কথা দিয়ে শেষ করি। সেই বইমেলার কয়েক মাস পরে জাতীয় জাদুঘরে তার সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল এক অনুষ্ঠানে। তারই সৌজন্যে তার পাশেই বসেছিলাম। একটা বিরতির সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোনো কর্তাব্যক্তি তার কাছে এসে সংগোপনে কিছু বলে গেলেন। তিনি চলে গেলে হাসিনা আমাকে বললো, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন, আমি জানার আগেই সাংবাদিকদের তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে।

‘কিছুদিন ধরেই সরকারদলীয় ব্যক্তিরা মোহাম্মদ আবু হেনার সমালোচনায় নানা কথা বলছিলেন। আবু হেনাও ছুটি নিয়ে অনেকদিন বিদেশে থেকে এলেন। আমার ধারণা হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল আমরা একসঙ্গেই শিক্ষকতা করেছি। আমি তাঁকে জানি একজন সজ্জন ও বিবেচক মানুষ হিসেবে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন পরিচালনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন এবং বিরোধী দলের অন্যায় সমালোচনার মুখে পড়েন। তাতে অবশ্য তিনি অবিচলিত ছিলেন। এখন তাঁর ‘অসুস্থতাজনিত’ পদত্যাগের ঘটনা এমনভাবে ঘটলো যে, এটা আর পুনর্বিবেচনার সুযোগ রইল না।

‘শেখ হাসিনাকে আমি বললাম, ‘তুমি বিরোধী দলের নেত্রীকে আমন্ত্রণ জানাও পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রশ্নে আলাপ করতে।’

‘হাসিনা বললো, ‘উনি আসবেন না।’

‘আমি বললাম, ‘সে ক্ষেত্রে তুমি বলতে পারবে, এ-বিষয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা তুমি করেছিলে। যদি উনি আসেন এবং তোমরা একমত হতে পারো, তাহলে সকলেই স্বস্তি পাবে। যদি উনি না আসেন কিংবা একমত না হন, তখন নিয়োগের ব্যাপারটা তোমার হাতেই রয়ে যাবে।’

‘সামান্য একটু ভেবে নিয়ে হাসিনা কথাটা মানলো। তার দপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে ডেকে বলল, ‘নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়ে পরামর্শের জন্যে বিরোধী দলের নেত্রীকে একটা সময় দিয়ে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিন।’ …

‘বিরোধী দলের নেত্রী অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী তখন নিজের অভিপ্রায়-অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিলেন।’ (পৃ ৫১৩-১৪)

এই বিবরণ-প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন যে, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে এই একবারই তিনি তাঁকে ‘অযাচিত’ পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তিনি সেটা গ্রহণ করেছিলেন। পরে আরেকবার অন্য কোনো বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কিছু বলেছিলেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সেটা গ্রহণ করা, বোধহয়, সম্ভব হয়নি।

২০০০ সালে আনিসুজ্জামান সিলেটে যান একটি প্রতীকী অনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করার জন্য। এর একটি পটভূমি ছিল। সেটি হলো : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক সেখানে সদ্যনির্মিত একটি আবাসিক হলের নাম শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ভাই, মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই দাবি জানানোর এক পর্যায়ে তাঁরা উগ্রপন্থীদের আক্রমণের শিকার হন এবং এর প্রতিবাদে তাঁরা অবিরাম ধর্মঘট করতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে অমর একুশে বইমেলা চলার সময়ে হুমায়ূন আহমেদ একদিন আনিসুজ্জামানকে জানান যে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিয়ে তিনিও তাঁর পরিবারের লোকজনসমেত সেখানে একদিনের প্রতীকী অনশন ধর্মঘট করতে যাবেন। আনিসুজ্জামান তাঁর সঙ্গী হতে রাজি হলেন।

২৫শে মার্চ রাতের ট্রেনে সম্ভাব্য অনশনকারীদের দল সিলেট রওনা হলেন। হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের লোকজন ছাড়াও ছিলেন কবি-লেখক-প্রাবন্ধিক হায়াৎ মামুদ, প্রকাশক আলমগীর রহমান, অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, তাঁদের

সঙ্গী-সাথিরা এবং অনেক তরুণ-তরুণী। ট্রেনের কয়েকটি কামরা রিজার্ভ করা হয়েছিল। কমলাপুর স্টেশনে নিরাপত্তার ব্যাপক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে-ব্যবস্থা সিলেটেও ছিল। আনিসুজ্জামানের সঙ্গী ছিলেন বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও হুমায়ূনের নিকটজন ওবায়দুল ইসলাম। সিলেট স্টেশনে নামার পর ওবায়দুল ইসলাম তাঁর শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে গেলেন আনিসুজ্জামানকে, মুখ-হাত ধুয়ে নাশতা খাওয়ার জন্যে। তবে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল হোটেলে।

অনশন ধর্মঘট চলাকালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হাবিবুর রহমান এসেছিলেন অনশনস্থলে। আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘তিনি ভালো মানুষ, কেউ কেউ অবশ্য তাঁকে ভুল বুঝছে।’ অনশন ধর্মঘট কর্মকাণ্ডের কিছু বর্ণনাও পাই তাঁর লেখায় : ‘বেতার-টেলিভিশন-সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদেরও বিরাট বাহিনী। পুলিশের পাহারা সত্ত্বেও কৌতূহলী মানুষেরও ভিড় কম নয়। কেউ কেউ নজর রাখছেন অনশনকারীরা লুকিয়ে কিছু খেয়ে ফেলছে কি না তা দেখতে। সামনের একটা বাড়িতে অনেকে যাচ্ছিল টয়লেট ব্যবহার করতে। সেটা খানিকটা সন্দেহের উদ্রেক করে।

‘হুমায়ূন একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাঠ করেছিল। তাতে জানানো হয়েছিল, ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার জন্য’ এই অনশন।’

প্রতীকী অনশনশেষে সবাই হোটেলে ফিরে গিয়েছিলেন এবং সেই রাতেই ট্রেনে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, হুমায়ূন শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে সেদিন তাঁর কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। তবে অনশনকারীদের মধ্যে অনেকে আবার সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনশনস্থলে চলে গিয়েছিলেন।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঢাকায় আনিসুজ্জামানের আবাসে এসেছিলেন। ‘তিনি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন, হুমায়ূনকে বুঝিয়ে আন্দোলনের ইতি টানার। নইলে, তাঁর আশঙ্কা, বড়ো ধরনের গোলযোগ হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে।’

আনিসুজ্জামান উপাচার্যের এই অনুরোধের কথা হুমায়ূনকে জানিয়েছিলেন। সম্ভবত এই অনুরোধ এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে হুমায়ূন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত সংকট নিয়ে নতুন কোনো কর্মসূচি আর গ্রহণ করেননি।

আনিসুজ্জামানের বিদেশ-ভ্রমণের অধিকাংশই ছিল কোনো সেমিনারে বা কনফারেন্সে যোগদান কিংবা প্রবন্ধ পাঠ বা পুরস্কার-স্বীকৃতি গ্রহণ উপলক্ষে। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে সেসব কারণ ছাড়াই জার্মানি যাওয়ার সুযোগ পান তিনি। তবে তারও একটা কারণ ছিল। জার্মানির হ্যানোফার শহরে এক্সপো ২০০০ অনুষ্ঠিত হবে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের এক প্রতিনিধিদল সেখানে যায়। তাতে অন্তর্ভুক্ত হন আনিসুজ্জামান। বাণিজ্য-সচিব গোলাম রহমান ছিলেন প্রতিনিধিদলের নেতা। বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিচালক ফরিদুল হাসান ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার সদস্য। বার্লিনের এক স্থপতির সহযোগিতায় সামসুল ওয়ারেস এক্সপোতে বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের নকশা করে দিয়েছিলেন। আর এক্সপোতে বাংলাদেশ-বিষয়ে যে-পুস্তিকা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার পাঠ দেখে দিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। তবে এই পুস্তিকাটি নিয়ে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। তার বিবরণ বিপুলা পৃথিবী বইটিতে আনিসুজ্জামান যা দিয়েছেন তা হলো : ‘দুর্ভাগ্যবশত প্রকাশিত লেখাটি যেভাবে আমি সংশোধন করে দিয়েছিলাম, আমার এবং ব্যুরোর অজান্তেই শেষ পর্যন্ত তা উপেক্ষিত হয়। ফলে পুস্তিকাটির বক্তব্য যে-রূপ নেয়, তা স্পষ্টতই সরকারি নীতির সঙ্গে – এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারণার সঙ্গে – মেলেনি। ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়ে জার্মানিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল মাসুদের কাছে। তিনি হ্যানোফারে আমাদের প্রতিনিধিদলে এসে যোগ দিয়েছিলেন। তিনিই এ-বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ব্যুরোর কাছে সরকার কৈফিয়ত চায় এবং আমি ফিরে আসার পর ব্যুরোর বিপন্ন প্রধান এ বি চৌধুরী আমার শরণাপন্ন হন। আমি লিখিতভাবে এই ভ্রান্তির দায়িত্ব স্বীকার করি, তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, মনে হয়, বিষয়টা সেখানেই থামিয়ে দেন।’