আবুল হাসনাত : এক নিভৃতচারী সাহিত্যসেবক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৮৮ সালে মাস্টার্স ফাইনাল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন ও অন্যান্য কারণে চার বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯২ সালে বের হই। ফল প্রকাশের পর কোথাও চাকরি হচ্ছিল না – তেমন অবস্থায় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা, বিটিভিতে নানা অনুষ্ঠানে কাজ আর পুরোদমে লেখালেখি করছি। এমন সময়ে একদিন দুপুরবেলা যাই ৩৬ পুরানা পল্টনে, দৈনিক সংবাদ অফিসে। দোতলায় অফিস। আমার হাতে একটি লেখা। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বুকটা একটু দুরু দুরু করছিল। কারণ যাঁর কাছে যাচ্ছি, শুনেছি তিনি একজন রাশভারী মানুষ। কথা কম বলেন, কাজ বেশি করেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তাঁর মুখটি ভাবার চেষ্টা করলাম। চোখের সামনে

একটি বইয়ের প্রচ্ছদ ভেসে উঠল – মুক্তিযুদ্ধের কবিতা – সম্পাদক আবুল হাসনাত। এই বইয়ে তাঁরও একটি কবিতা রয়েছে। আবুল হাসনাতের কবি নাম মাহমুদ আল জামান। ষাটের দশকের খ্যাতনামা কবিদের অন্যতম। মাহমুদ আল জামানই যে আবুল হাসনাত সেটা হয়তো অনেকেই জানেন না। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবিদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কবিতা রয়েছে বইটিতে। গ্রন্থটি এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতার আকর গ্রন্থ। মাহমুদ আল জামান বা আবুল হাসনাত – কবি ও সম্পাদক, দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক – তাঁর মুখোমুখি হচ্ছি একটু পরেই। সে বছরের, অর্থাৎ ১৯৯২ সালের ৮ই জুন মিশরের মানবতাবাদী লেখক ফারাজ ফৌদাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সে-দেশের একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা। তাঁর ওপর আমাকে একটি লেখা লিখতে বলেন কবি শামসুর রাহমান। তিনি বলেন, ‘শিহাব তুমি তাঁর (ফারাজ ফৌদা) ওপর একটি লেখা লেখ। আমি তোমাকে কিছু তথ্য দিচ্ছি।’ আমি সেই তথ্য নিয়ে ছোট্ট একটি নিবন্ধ লিখলাম, লেখাটির শিরোনাম দিলাম : ‘ফারাজ ফোডা : মৌলবাদের কালো থাবার শিকার’। লেখাটি শেষ করে প্রথমে রাহমানভাইকে দেখালাম। তিনি লেখাটি পড়া শেষ করে হাসনাতভাইকে ফোন করে বললেন, ‘আমার স্নেহভাজন শিহাব শাহরিয়ার নামে একজন তরুণ কবি ফারাজ ফোডার ওপর একটি লেখা নিয়ে যাচ্ছে আপনার কাছে।’ সেই লেখাটিই নিয়েই যাচ্ছিলাম। দোতলায় উঠে ডানদিকে মোড় নিলেই হাসনাতভাইয়ের টেবিল। সাধারণ একটি কাঠের টেবিলের পেছনে একটি কাঠের চেয়ারে বসে আছেন তিনি। তাঁর টেবিলের সামনে আর কোনো চেয়ার নেই। পরে জেনেছি, তিনি চেয়ার রাখেন না কারণ চেয়ার রাখলে সবাই এসে বসবে, কথা বলবে, চা খাবে ইত্যাদি কারণে অনেক সময় চলে যাবে।

আমি তাঁর সামনে হাজির হয়ে সালাম দিয়ে পরিচয় দিতেই তিনি হাত বাড়িয়ে লেখাটি নিলেন। বললেন, ‘দেখা হবে, ভালো থাকবেন।’ সেদিন সম্ভবত সোমবার ছিল। বৃহস্পতিবার ‘সংবাদ সাময়িকী’ বের হয়। আমি চলে এসে অপেক্ষায় থাকি বৃহস্পতিবারের জন্য। বাংলাদেশের সাহিত্যের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা জানেন, তখন সংবাদের সাহিত্যপাতা ছিল লেখক ও পাঠকদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত। লেখাটি সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় ছাপা হয় পরবর্তী বৃহস্পতিবার।

সম্ভবত দুদিন পর সংবাদ অফিসে গেলাম হাসনাতভাইকে ধন্যবাদ জানাতে। আমি ধন্যবাদ দেওয়ার আগেই তিনি বললেন, ‘শিহাব, ভালো হয়েছে লেখাটি। আপনি আরো লেখা দেবেন – প্রবন্ধ কিংবা কবিতা।’ আমি কিছু বলার সুযোগই পেলাম না। শুধু বললাম, ‘জি।’ চলে এলাম। এরপর বহুদিন কবিতা দিয়ে গিয়েছি, ছেপে দিয়েছেন। একবার কবিতা দিয়ে চলে আসবো, তখন বললেন, ‘শিহাব ২রা জানুয়ারি কবি আহসান হাবীবের জন্মদিন, আপনি তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ – এই বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখে আনুন।’ আমি বললাম, ‘জি।’ লিখে দিয়েও এলাম, তিনি পরের বৃহস্পতিবার লেখাটি ছেপে দিলেন। তাঁর এই স্নেহসুলভ আচরণ আমাকে মুগ্ধ করল। বহু লেখা তিনি ছেপেছেন। সে-সময় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে অত্যন্ত পুলকিত হতাম। বিশেষ করে দুটি কারণে – এক. চল্লিশের কবি থেকে শুরু করে আমাদের আশির দশকের তরুণ লেখকদের লেখাও ছাপতেন হাসনাতভাই; সেখানে আবুল হোসেন, শামসুর রাহমানদের সঙ্গে আমার কবিতাও থাকত কখনো কখনো! দুই. সে-সময়ে সাহিত্য সাময়িকী দুটিই – সংবাদের ও ইত্তেফাকের। সংবাদ সাময়িকীই আমার সেরা মনে হতো। সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দদের অসাধারণ প্রবন্ধ, শামসুর রাহমান-আল মাহমুদদের কবিতা। পত্রিকাটি ছিল বামপন্থী রাজনীতির একটি অঘোষিত প্লাটফর্ম, অর্থাৎ সংবাদের সম্পাদক থেকে শুরু করে প্রতিবেদক প্রায় সবাই বাম রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন, হাসনাতভাইও তাই। তখন হাসনাত ভাইয়ের পাশেই দেখতাম বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত, মনজুরুল আহসান বুলবুলসহ অনেক সাংবাদিককে, যাঁরা ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টিরও সমর্থক ছিলেন। সংবাদ অফিসে যাতায়াত এবং লেখা প্রকাশিত হওয়া – এটি এক ধরনের ভালো লাগার জায়গায় পরিণত হয়।

১৯৯৬ সাল। আমি তখন মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে গণসাহায্য সংস্থার অফিসে কাজ করি। আমার এই কাজটিরও জন্য সুপারিশ করেছিলেন শামসুর রাহমান। এখানে মাত্র ছয় মাস কাজ করতে পেরেছিলাম। ছেড়ে দেওয়ার মাসখানেক আগে হাসনাতভাই গণসাহায্য সংস্থায় যোগ দেন। তিনি যে কদিন সেখানে ছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনাকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। আমি চাকরি ছেড়ে আসার পরও কয়েকবার হাসনাতভাইয়ের ওখানে গিয়েছি। তিনি যথারীতি বসতে দিয়েছেন, চা খাইয়েছেন, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন। আরো পরে তিনি সংবাদ ছেড়ে বেঙ্গল গ্রুপের সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম-এ যোগ দেন। পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন তখন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

প্রথম সংখ্যা থেকেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য লেখকদের লেখার সমন্বয়ে কালি ও কলম সাহিত্যের একটি সুসম্পাদিত পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এমন একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা অনেকের পাঠের তৃষ্ণা মেটাল। আমিও পত্রিকাটি দেখে আনন্দবোধ করলাম। একদিন গেলাম কালি ও কলম অফিসে। সংস্কৃতিবোদ্ধা আবুল খায়ের বিমানবন্দরের পাশে নির্জন ও নিরিবিলি একটি স্থানে চমৎকার একটি ভবনে এই অফিসটি করেছিলেন। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় হাসনাতভাইয়ের কক্ষে যেতে যেতে চোখে পড়ে দেশের বিখ্যাত চিত্রকরদের আঁকা অসাধারণ কিছু চিত্রকর্ম। তাঁর কক্ষটি পূর্ব দিকে। দিনের আলোর সঙ্গে কৃত্রিম আলোয় ভরা কক্ষটির সামনের খোলা করিডোরে দাঁড়ালে মনে একটা ভালো লাগা কাজ করতো। প্রথম যেদিন গেলাম, সেদিন হাসনাতভাই করিডোরেই বসেছিলেন। আরেকটি চেয়ারে আমাকে বসতে দিয়ে বললেন, ‘শিহাব, কেমন আছেন?’ বললাম, ‘জি ভালো, আপনি?’ জবাব দিয়ে বললেন, ‘লেখা দেবেন।’ এরপর কবিতা পাঠাতাম, তিনি নিয়মিত ছাপতেন এবং কবিতার সম্মানী যথাসময়ে পাঠিয়ে দিতেন।

হাসনাতভাই ছিলেন আমার কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রকাশনা কমিটির অন্যতম সদস্য। তিনি ২০১৪ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছেন। জাদুঘরের প্রকাশনা কমিটির সভায় যোগ দিতে আসতেন নিয়মিত। মৃদুভাষী ও বিনয়ী মানুষটি জাদুঘরে এলে প্রায় সব সময়ই আমার খোঁজ করতেন। আমি ছিলাম প্রকাশনা শাখার বিভাগীয় প্রধান। প্রকাশনা সংক্রান্ত সভায় পদাধিকারবলে আমি উপস্থিত থাকতাম। এখানে উল্লেখ করি, জীবনানন্দ-গবেষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সে-সময়ে ছিলেন জাদুঘরের মহাপরিচালক, যিনি আবুল হাসনাতকে অসম্ভব সম্মান, সমীহ ও মূল্যায়ন করতেন। হাসনাতভাই এলেই তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতেন। ফয়জুল লতিফ সাহেব আমাকে একদিন বললেন, ‘শিহাব, হাসনাতভাইয়ের মতো একজন নিভৃতচারী, সাহিত্যসেবক, মেধাবী মানুষকে মূল্যায়ন করা উচিত।’ আমি বললাম, ‘জি।’ তিনি বললেন, ‘শুনুন, তাঁকে আমাদের সেমিনারগুলোতে ডাকুন।’ আমি বললাম, ‘জি।’ এরপর একটি সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়ার জন্য টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানালে ওপাশ থেকে হাসনাতভাই বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘শিহাব, আমাকে বাদ দিন, অন্য কাউকে নিন। আমি বরং দর্শক-শ্রোতা হয়ে যাবো।’ আমিও নাছোড়বান্দা, বললাম, ‘আপনাকে আসতেই হবে।’ আমার অনুরোধ তিনি শেষ পর্যন্ত রাখলেন। এলেন প্রবন্ধ লিখে নিয়ে। মহাপরিচালকের রুমে তাঁকে নিয়ে গেলাম। তিনি ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ও আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনারা আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। জানেন তো আমি স্বভাবত কোনো অনুষ্ঠান বা সেমিনারে কথা বলি না, বলতে পারি না। শুনতে পছন্দ করি।’ কিন্তু মঞ্চে গিয়ে যখন প্রবন্ধ পড়লেন, সে এক অসাধারণ লেখা। আজীবন পরিমিত কথা বলা আবুল হাসনাত প্রবন্ধ পাঠ শেষে চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকলেন। অনুষ্ঠান শেষে আবারও বললেন, ‘শিহাব, আমাকে আর মঞ্চে ডাকবেন না বা রাখবেন না, আমি আপনাদের সব অনুষ্ঠানেই আসতে চাই শ্রোতা হিসেবে।’

এরপর বহুদিন হাসনাতভাই এসেছেন জাদুঘরে। কখনো জাদুঘরের কোনো কমিটির সভায় যোগ দিতে কিংবা ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ প্রদান অনুষ্ঠানে কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে। এলেই একবার আমাকে খুঁজতেন। খোঁজ করার একটি বড় কারণ অবশ্য ছিল জাদুঘরের প্রকাশনা থেকে বই কেনা। বলতেন, ‘শিহাব ওই বইটির দাম কত? বইটি কি আছে?’ খোঁজ নিয়ে – ‘আছে’ – জানালে তিনি বলতেন, ‘জাদুঘরের কর্মকর্তা হিসেবে আপনার নামে অর্ধেক দামে কেনার ব্যবস্থা করুন।’ আমি সেভাবেই তাঁকে বই কিনে দিতাম। সত্যি   বলতে কী, হাসনাতভাইকে এভাবে বই দিতে পেরে আমি খুব আনন্দ পেতাম। এক. দেখতাম তাঁর বইয়ের তৃষ্ণা; দুই. তাঁর বিনয়। আমরা যে বলি, কথা কম, কাজ বেশি; এর পুরোটাই হাসনাতভাইয়ের মধ্যে ছিল। তিনি কখনো কখনো লোক পাঠিয়ে দিয়ে বই নিতেন এবং আমি আমার কোটায় অর্ধেক দামে বই কিনে পাঠিয়ে দিতাম। আর তো পাঠাবেন না কখনো!

মনে পড়ছে ২০১৫ সালের কথা। সেবার আমেরিকার নিউইয়র্কের বাংলা বইমেলায় যাচ্ছি, আমাদের দলনেতা কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও হুমায়ূন আহমেদ। যাওয়ার আগের দিন হাসনাতভাইকে ফোন করলাম, বললাম, ‘দিঠির কাছে কোনো কিছু পাঠাবেন?’ অনেকেই জানেন, দিঠি হাসনাত তাঁর একমাত্র কন্যা। খুব ভালো গান করে, সে থাকে নিউইয়র্কে। ফোনের ওপাশ থেকে তিনি বললেন, ‘কিছু পাঠানোর নেই, তবে ওর ফোন নম্বরটি পাঠাচ্ছি, সময় পেলে ওর সঙ্গে একটু কথা বলে আসবেন।’ আমি বললাম, ‘হাসনাতভাই, নিশ্চয়ই আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আসবো।’ পরে নিউইয়র্কে গিয়ে দিঠিকে ফোন করেছিলাম। কথা হয়েছে, কিন্তু ওর ব্যস্ততার কারণে দেখা হয়নি। তবে ঢাকায় কয়েকবার কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে।

আবুল হাসনাত কবিতা লিখতেন মাহমুদ আল জামান নামে – এখনকার তরুণ প্রজন্ম ছাড়া আমরা বড়রা কমবেশি সবাই সেটা জানি। ধারণা করি, নতুনরা তাঁর কবিতাও হয়তো অনেকে পড়েননি। তবে আমরা যারা পড়েছি, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাংলাদেশের কবিতায় মাহমুদ আল জামান একজন শক্তিশালী কবি। তাঁর কবিতার বইগুলির নাম – জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোন একদিন ভুবনডাঙায় ও ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বিড়াল। জ্যোৎস্না, ভুবনডাঙা – শব্দগুলি কেমন কাব্যিক ব্যঞ্জনা তৈরি করে। তেমনি তাঁর কবিতাও মাধুর্যে ভরা। মৃত্যুর আগে হাসপাতালশয্যায় শুয়ে রচিত তাঁর জীবনের শিরোনামহীন শেষ কবিতাটি এখানে তুলে ধরছি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তিনি যেন বুঝতে পারছেন – অনতি ওপরে ঝোলানো অক্সিজেন মিটার দেখে; রবীন্দ্রনাথের মতোই ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম …।’ তাই যেন লিখলেন :

আমার রোদ্দুর ঢেকে যাচ্ছে কালো মেঘে

হায় ছায়াবৃতা দাও, আমাকে দাও

সহজ উজ্জ্বলতা

ঘুম নেই চোখে, তাকিয়ে থাকি

অক্সিজেনের মিটারে …

জীবন নিভে যাওয়ার আগে কী যে আবেগময়, কাব্যময় পাঁচ পঙ্ক্তি রেখে গেলেন তিনি বাংলা কবিতায়! হাসপাতালে যাওয়ার আগমুহূর্তে লেখা কবিতাটি দেখুন, নির্যাতিত মানুষের, মানবতার, দারিদ্র্যপীড়িত এক নারীচিত্র তুলে ধরলেন কী অসাধারণ মমতায় :

মালতী সেদিন অপরাহ্ণের রোদে

উদ্বাস্তু হলো

নদীর স্রোত আর পাখির কলরব

শুনতে শুনতে

সে বিলীন হয়ে গেল জনারণ্যে

ট্রেনে যেতে যেতে ধর্ষিত হয়েছিল

তারপর গহন অরণ্যের নীরবতায়

দেখেছিল ত্রাস ও উল্লাস

(কবিতা : ‘ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটাকে মেলাবেন’)

আবার দেখুন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার কয়েকটি চরণ, যেখানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে জীবনের সৌন্দর্যকে মেলালেন।

সূর্যোদয় দেখে ফিরে যায়।

দাঁড়িয়ে থাকে চোখের পাতায়

এই রং, নিসর্গ

আর পুণ্য প্রাণ লাবণ্য।

আরো অনেক কবিতা – জীবনকে দেখেছেন, মেলে দিয়েছেন রোদ্দুরে; আবার রোদ্দুরের ঝলকও নিয়েছেন। ভুবনডাঙার জ্যোৎস্নালোকিত কবি মাহমুদ আল জামান যেমন, তেমনি দারুণ সফল এক সম্পাদক আবুল হাসনাত – একের ভেতর দুই চিরঞ্জীব আবারো ফিরে গেলেন তাঁর নদী-অধ্যুষিত প্রিয় ভুবনডাঙায়।

ভুবনডাঙার আলো, মেঘ, আকাশ, মাঠ, নদী ও নদী-তীরবর্তী রৌদ্রকিরণ সবার গায়ে লাগে না, নদীস্রোতের কলতান সবাই শোনে না, শুনেছিলেন কবি মাহমুদ আল জামান।