সাহিত্য-সমালোচক আবুল হাসনাত ও তাঁর সংবেদনশীল সৌজন্য

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে লেখা এক চিঠিতে ‘সাহিত্যের আদর্শ’ সম্বন্ধে নিজের অভিমত জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, সাহিত্যে ‘আদর্শরক্ষা করতে গেলে প্রয়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না। বারোয়ারির আসরে দাঁড়িয়ে সাধনা অসম্ভব।’ রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছিলেন, ‘সেই সাধনাপেক্ষী সাহিত্যের জন্য সময়ও চাই বড়ো, ক্ষেত্রও চাই উদার। এ-জায়গায় ভিড় জমাবার আশা নেই। কাজেই গুণজ্ঞের পরিতোষ ছাড়া অন্য পারিতোষিকের আকাক্সক্ষা বিসর্জন দিতেই হবে।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৪০২ : ৪৪)।

প্রয়াত আবুল হাসনাতের কাজের কথা, তাঁর নিবিষ্টতার কথা, সাধনার কথা যখন ভাবি, তখন আমাদের নানাভাবেই রবীন্দ্রনাথের কথাগুলি মনে পড়ে যায়। ওটা শুধু রবীন্দ্রনাথের বা সুধীন্দ্রনাথের মনের কথাই ছিল না, সেইসঙ্গে তার মধ্যে আবুল হাসনাতের সমস্ত কাজের মর্মবস্তু যেন নিহিত রয়েছে। বোধকরি, সেইসব বিবেচনা করেই শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘আবুল হাসনাত ছিলেন কাজের মানুষ। অনেক ছিল তাঁর কাজ, গভীর ছিল দায়িত্ববোধ। তাঁর প্রধান পরিচয়টা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সম্পাদকের। এ কাজে তিনি ছিলেন অসাধারণ।’ তিনি এ-ও বলেছেন, আবুল হাসনাতের ‘আরও    অনেক কাজ ছিল সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক … কোনো কাজই তাঁর জন্য গুরুত্বহীন ছিল না। আবুল হাসনাতের সাংস্কৃতিক কাজে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল অনমনীয়।’ (হাসনাত, ২০২২ : ভূমিকা) আবুল হাসনাতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘তাঁর মতো রুচিস্নিগ্ধ মানুষ আমরা কমই পেয়েছি। … তাঁর রচনাতে কাব্যানুশীলনের নান্দনিকতা ও ছন্দস্পন্দন উপস্থিত রয়েছে পদে পদে।’ আবার এসবের পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, ‘হাসনাতের সকল লেখাই প্রাণবন্ত। পড়তে শুরু করলেই টের পাওয়া যায়। সঙ্গে আছে স্বতঃস্ফূর্ততা। স্বতঃস্ফূর্ততা ও প্রাণবন্ততা একসঙ্গেই যায়, যেমনটা ঘটেছে এই প্রবন্ধগুলোতে।’ আবুল হাসনাতের লেখালেখির কথা বলতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনেকটা আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে আমাদের জানান যে, ‘হাসনাত কিছুই লেখেননি দায়িত্ব না নিয়ে। তাই দেখি তাঁর লেখা পুস্তক সমালোচনাও কেমন মূল্যবান হয়ে ওঠে। তাঁর জন্য সহায়ক ছিল অভিনিবিষ্ট পাঠাভ্যাস … একইসঙ্গে নিয়মিত পড়তেন তিনি কালজয়ী সাহিত্য। হাসনাতের আগ্রহ ছিল চিত্রকলাতেও; সে আগ্রহের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সাহিত্যকর্মে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ভূমিকা)। সাহিত্যের জগতে রবীন্দ্রনাথ যে-সাধনার কথা বলেছিলেন, তার সঙ্গে সংগতি রেখেই সাহিত্য-সমালোচকের আন্তরিকতার কথা, অকপটতার কথা যদি এখানে বলা হয়, তার প্রায় সবখানিই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম আবুল হাসনাতের সাহিত্যকর্মে।

সাহিত্য-সমালোচনার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমার কাব্য ঠিক কী কথা বলছে, সেটি শোনার জন্যে আমাকে বাইরে যেতে হবে যাঁরা শুনছেন তাঁদের কাছে।’ তবে তিনি এইটিও মনে রেখেছিলেন যে, ‘সম্পূর্ণ করে শোনবার ক্ষমতা সকলের নেই। যেমন অনেক মানুষ আছে, যাদের গানের কান থাকে না তাদের কানে সুরগুলো পৌঁছয়, গান পৌঁছয় না, অর্থাৎ সুরগুলোর অবিচ্ছিন্ন ঐক্যটি তারা স্বভাবত ধরতে পারে না।’ তাঁর এই কথাটিকে আরো খানিকটা সবিস্তারে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ‘কাব্য সম্বন্ধে ঐক্যবোধের অভাব অনেকেরই আছে। তারা যে একেবারেই কিছু পায় না তা নয় … তার মধ্যে স্বাদের যে সমগ্রতা আছে সেটি পাবার জন্যে রসবোধের শক্তি থাকা চাই।’ সে-শক্তিটাই যে একজন সমালোচকের প্রধান অবলম্বন, সেটি নানাভাবেই আমরা ভুলে থাকি। যার জন্যে রবীন্দ্রনাথ খানিকটা জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘বহু ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার দ্বারা, চর্চার দ্বারা এই সমগ্রতার অনির্বচনীয় রসবোধের শক্তি পরিণত লাভ করে।’ আর তাই তো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যে ব্যক্তি সেরা যাচনদার, একদিকে তার স্বাভাবিক সূক্ষ্ম অনুভূতি, আর-একদিকে ব্যাপক অভিজ্ঞতা, দুয়েরই প্রয়োজন।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৩৯৪ : ১৯০-১৯১)। রবীন্দ্রনাথ একজন সাহিত্য-সমালোচকের যে-সূক্ষ্ম অনুভূতি আর ব্যাপক অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন, সেই সামর্থ্য আমরা আবুল হাসনাতের পাবলো নেরুদা-ফয়েজ আহমদ ফয়েজ-শামসুর রাহমান-আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্য-সমালোচনার মধ্যে দেখতে পাই।

দুই

পাবলো নেরুদা ছিলেন ঠিক সেই ধরনের কবি, যাঁকে নিকানোর পাররা বিবৃত করেছিলেন এইভাবে, ‘নেরুদা সম্পর্কে আমরা বিমূর্তভাবে কথা বলতে পারি না, কারণ তিনি তো ড্রয়িংরুমের কবি নন, তিনি তো আত্মধ্যানে নিমগ্ন বুদ্ধ নন।’ তাহলে তিনি কে? এর উত্তরে পাররা জানিয়েছিলেন, ‘তিনি মূলত একজন সামাজিক কবি, স্পেনীয় বলা মায়াকোভস্কি, একজন রক্তমাংসের মানুষ, যিনি সব বিপদ এড়াতে চেয়েছিলেন।’ (পাল, ২০১৮ : ৩৬০)। প্রকৃতপক্ষে একদম তা-ই। এতটুকুও বাড়িয়ে বলেননি পাররা। নেরুদা নিজেও আমাদের জানিয়েছিলেন, ÔI have always wanted the hands of people to be seen in poetry|Õ শুধু এইটুকু বলেই তিনি তাঁর কথা শেষ করেননি, সেইসঙ্গে এ-ও বলেছিলেন যে, ÔI have always preferred a poetry where the fingerprints show. A poetry of loam, where water can sing. A poetry of bread where everyone may eat.Õ (Stavans, 2005 : xxxiii)| নেরুদা-পাঠের অভিজ্ঞতা থেকেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘নেরুদাকে কেবল কবি হিসাবে নয়, হাসনাত দেখেছেন তাঁকে গত শতাব্দীর বিবেকী কণ্ঠস্বর হিসেবেও। নেরুদা আজীবন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন; তিনি লড়ছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে; তাঁর নিজের দেশে এবং স্পেনে। কবির এই রাজনৈতিক লড়াইটা এবং সে লড়াইয়ের আন্তর্জাতিকতা হাসনাতকে আকৃষ্ট করেছে, নাড়া দিয়েছে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ভূমিকা)।

নেরুদার জীবন ও কাব্য আবুল হাসনাতকে যে নাড়া দিয়েছিল, তার প্রমাণ পাই আমরা তাঁর ‘পাবলো নেরুদা : কবি, শতাব্দীর বিবেকী কণ্ঠস্বর’ নামক এক দীর্ঘ প্রবন্ধে।

এখানে বলে নেওয়া দরকার যে, আবুল হাসনাত নেরুদার কাব্যকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে খুব বেশি নির্ভর করেছেন কবির ‘অনুস্মৃতি’টির ওপর। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। নেরুদা নিজেও তাঁর ‘অনুস্মৃতি’র ‘ভূমিকা’য় বলেছিলেন, ‘আমি শুধুমাত্র আমার জীবনের পরিধির মধ্যে বেঁচে থাকতে চাইনি, আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছি আরো হাজারো জীবনের সাথে।’ তারপরই তিনি জানিয়েছেন, ‘এই যে পাতাগুলো ভরে লিখে গেলাম, একদিন এরা শরতের তরুবীথিকার পাতা ঝরার মতো ঝরে পড়বে, অথবা পাবে এক নবজন্ম, যেমন নবজন্ম পায় আঙুর তার পবিত্র সুরায় দ্রাক্ষাকুঞ্জ কাটা হলে যেমন হলুদ পাতার ঝরার সময় আসে।’ (নেরুদা, ১৯৮৩ : ভূমিকা)। ওই ‘ভূমিকা’টির তিনি সমাপ্তি টেনেছেন এভাবে – ÔMy life is a life put together from all those lives: the lives of the poet.’ (Neruda, 1977)।

কবি যে-কারণে এই ‘অনুস্মৃতি’র মধ্যে তাঁর জীবন, মানুষ, দেশ, রাজনীতির কথা বলতে চেয়েছেন, ঠিক সেই একই কারণে সমালোচক হাসনাত যদি এর ওপর ভর দিতে চেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে আমরা দোষ দিতে পারি না। হাসনাত আমাদের জানিয়েছেন, পাবলো নেরুদার ‘অনুস্মৃতিটি ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে যখন প্রকাশিত হলো, তখন চিলির জনজীবনের দুর্গতি চরমে। ঐতিহ্যিক চিলির মনন তখন ধস্ত; মানুষ নিরাশায় নিমজ্জিত। সেনাবাহিনী দোর্দণ্ড প্রতাপে চিলির জনগণের সকল অর্জনকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে নিয়েছে জেনারেল পিনোশে … এ যে কত মর্মঘাতী ছিল পেছনে ফিরে তাকালে সে-কথা মনে পড়ে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ২১)। এখানে ১৯৭৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে সংঘটিত আয়েন্দের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের কথা বলেছেন হাসনাত। যার হাত থেকে নেরুদার মতো কবি বা ভিক্টর জারার মতো গায়কও রেহাই পাননি।

আবুল হাসনাতের ভাষ্যমতে, নেরুদার ‘শৈশবের নদী, নিসর্গ ও জীববৈচিত্র্য প্রত্যক্ষণ তাঁর জীবনচর্যায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাবলো নেরুদার মানসভুবন, ব্যক্তিত্বের সত্তা-সংকট ও সর্বোপরি লাতিন আমেরিকার ঐতিহ্যিক বৈভব তাঁকে কীভাবে একজন অগ্রগণ্য কবি হিসেবে গড়ে তুলেছিল, সে-কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন নেরুদা তাঁর স্মৃতি আলেখ্যে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ২৫)। এর পাশাপাশি আমরা যদি নেরুদার ‘অনুস্মৃতি’র এই অংশটি পাঠ করি, তাহলে সেখানে দেখতে পাই, কবি লিখেছেন, ‘আমি যখন আমার প্রথম কবিতার বইটি লিখেছিলাম তখন ভাবতেই পারিনি যে, রাস্তাঘাটে,
কলে-কারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, থিয়েটারে, সভাসমিতি কিংবা প্রতিটি প্রতিবাদ সভায় আমার কবিতা আমাকেই পাঠ করতে হবে, শোনাতে হবে, সাধারণ মানুষের কাছে।’ (নেরুদা, ১৯৮৩ : ১৮৪)। আর সে-কারণে নেরুদাকে এ-ও বলতে শোনা যায়, ÔI have gone into practically every corner of Chile, scattering my poetry like seed among the people of my country.Õ (Neruda, 1977 : 253)|

আবুল হাসনাত তাঁর লেখায় মোজাম্মেল হোসেনের কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি ধারাবাহিকভাবে সংবাদ সাময়িকীর পাতায় নেরুদার ‘আত্মস্মৃতি’র অংশবিশেষ অনুবাদ করেছিলেন। সেই অনুবাদ থেকে নেরুদার ‘আত্মস্মৃতি’র শেষাংশের খানিকটা তুলে ধরছি, যেখানে নেরুদা বলেছেন, ‘আমার আত্মস্মৃতির জন্য এই কথাগুলো লিখেছিলাম অবিশ্বাস্য সেই ঘটনার তিনদিন পরে, যাতে আমার মহান বন্ধু ও কমরেড আলেন্দের [য়] মৃত্যু হয়। ওরা তাঁকে খুন করার কথা চেপে যেতে চেয়েছিল, তাঁকে সমাধিস্থ করেছিল গোপনে; শুধু তাঁর বিধবা স্ত্রীকে শবানুগমনের অনুমতি দেওয়া হয়।’ (মফিদুল, ২০১৪ : ৪৩)। আর এরপরই নেরুদা তাঁর বুকের দীর্ঘশ্বাস চেপে যেন আমাদের জানিয়েছিলেন, বিদেশের সংবাদপত্রের ভাষ্য, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘বোমাবর্ষণের অব্যবহিত পরেই ট্যাঙ্ক পাঠানো হয়। ট্যাঙ্কের বহর “বীর বিক্রমে” এগিয়ে যায় একজন নিঃসঙ্গ মানুষের বিরুদ্ধে, চিলি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট সালভাদোর আলেন্দের [য়] বিরুদ্ধে, যিনি আর কিছু নয়, শুধু তাঁর বিরাট হৃদয় নিয়ে আগুনের শিখা আর ধোঁয়ার মধ্যে অফিস ঘরে অপেক্ষায় ছিলেন ওদের।’ (মফিদুল, ২০১৪ : ৪৩)।

এখানে হয়তো অনেকেই প্রশ্ন করবেন, নেরুদার কবিকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে আবুল হাসনাত বারবার রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন কেন? এর উত্তর নেরুদার ‘একনায়কেরা’ (অনুবাদ : রফিক আজাদ) কবিতাতেই আমরা পেয়ে যাই, যেখানে তিনি লিখেছেন – ‘রক্ত আর মৃতের শরীরের সংমিশ্রণে/ তীব্র এক পূতিগন্ধ থেকে যায় আখের ভেতরে;/ বিবমিষা আনে ঐ অন্তর্ভেদী পাতা।/ নারকেলবীথির মধ্যে কবরে রয়েছে/ নষ্ট হাড়, বাক্যহীন মৃত্যুময় স্বর;/ আপাদমস্তক সুদৃশ্য পোশাক পরে/ কথা বলছেন একনায়ক মশাই।’ (মফিদুল, ২০১৪ : ৬৬)। নেরুদার এই কবিতার মধ্যে প্রেম থেকে শুরু করে রাজনীতি – সবই যেন একত্রে মিশে রয়েছে। যে-কারণে অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক আলী আনোয়ার আরো অনেকেরই মতো করে নেরুদার কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘প্রেম, প্রকৃতি ও রাজনীতি এই তিনটিই তাঁর কবিতার মূল বিষয় এবং জীবনে যেমন এই তিনটি বিষয় মিলেমিশে থাকে, তাঁর কবিতাতেও তেমনি।’ (আনোয়ার, ২০০৭ : ১১)। সেই পটভূমি থেকেই আবুল হাসনাত লিখেছেন, ‘তাঁর জীবনের স্বরূপ ও অসীমতাকে ছুঁয়ে যে-আত্মজীবনী লিখেছেন নেরুদা তাতে সজীব হয়ে উঠেছে আত্মজাগরণের স্বপ্ন। অন্যদিকে দেখব, কী অবিচলিত আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে গোটা জীবন মানুষকে সচেতন করেছেন শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৩৮)। অন্যদিকে নেরুদার জীবনের অন্তিম পর্যায়ের কবিতায় দেখতে পাই, তিনি লিখেছেন, ÔPerhaps my destiny is different/ My militant fighter’s chest/ moved me toward guerrillas in the government/ to gain with the ardent patience/ of truth the working class/ the Law of the poor.’ (Stavans, 2005 : 832)| প্রত্যেক বড় কবির মতো নেরুদাও ছিলেন একেবারে অন্যরকমের, তাঁর নিজের ধরনের। শুধু কবিধর্মেই নন, স্বভাবে ও ব্যক্তিত্বেও তিনি ছিলেন ভিন্ন। আবুল হাসনাতের ভাষায়, ‘কবিতা আর তাঁর সৃষ্টিশীলতা আরেক সেতু নির্মাণ করেছিল এ-সময় থেকে। এও তো জীবনে ভিন্ন এক অর্থযোজনা যে-কবির মানস পুষ্টি-অর্জন করেছে মার্কসবাদে, ঐতিহ্য-চেতনা এই মানসকে আরো প্রতিশ্রুতিময় ও অঙ্গীকারবদ্ধ করে তুলেছে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৩৮)।

১৯৭১ সালে রোনাল্ড ক্রিস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নেরুদা তাঁর কাব্যপরিক্রমার পর্ব-পর্বান্তর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার কবিতা আমার জীবনেরই পর্বে-পর্বে মিলিয়ে এগিয়েছে। নির্জন শৈশব থেকে দূরে কোণঠাসা বয়ঃসন্ধিকালে, পরিত্যক্ত অবস্থায় দেশে-দেশে আমি নিজেকে এক বিরাট মানবমণ্ডলীর অংশীভূত করতে প্রয়াসী ছিলাম। আমার জীবন পরিণত হলো আর সেখানেই শেষ।’ (পাল, ২০১৮ : ৩৫২)। এই শেষের রেশ টেনেই হাসনাত লিখেছেন, ‘নেরুদার জীবনালেখ্যে
যে-আত্মোন্মোচন; নিজেকে নিয়ে, সৃষ্টিকে, পরিবেশ নিয়ে সেখানে বৃহত্তর মানবধর্মের সন্ধান পাই আমরা, সেও তো ভালোবাসারই আরেক আর্তমানবিক রূপায়ণ; কবির এমন উন্মোচনের দৃষ্টান্ত বোধকরি বিশ্বের সাহিত্য-পরিমণ্ডলে আর সৃজনশীলতার ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৩৮)। এ-প্রসঙ্গে নেরুদার স্ত্রী মাতিলদে উরুটিয়ার (Matilde Urrutia)-i My Life with Pablo Neruda (Stanford University Press : 2004) বইটির কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি আবুল হাসনাত।

তিন

আবুল হাসনাতের কাছে উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ নানাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। এ-প্রসঙ্গে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘হাসনাতের রচনাতে নেরুদা যেমন তেমনি ফয়েজ আহমদ ফয়েজও অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছেন।’ এর পাশাপাশি তিনি আরো জানিয়েছেন, ‘উর্দু ভাষার কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে নিয়ে লেখাটাও দীর্ঘ এবং গুরুত্বপূর্ণ। ফয়েজকেও তিনি চিনেছেন সমাজ পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ কবি হিসেবেই। এই কবির জীবনধারা ও কর্মপ্রবাহ তিনি অনুসরণ করেছেন।’ (হাসনাত, ২০২২ : ভূমিকা)

আবুল হাসনাত তাঁর ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজ : তাঁর কবিতা ও অঙ্গীকার’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, ফয়েজ আহমদ ফয়েজের ‘ছাত্রাবস্থা থেকে মৃত্যুকাল অবধি এই সুদীর্ঘ ষাট বছরের জীবনে সুসময় কোনোভাবেই তাঁর জীবনে কোনো পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর কাব্যপ্রকৃতি ও কবিসত্তা বিকশিত হয়েছে বৈরী পরিবেশের মধ্যে। সুস্থির আর স্বস্থ হওয়ার মতো প্রতিবেশ ছিল না পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহে। … কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের ক্ষেত্রে এই বৈরী পরিবেশই সৃজনকে করে তুলেছিল সূক্ষ্ম, তীব্র ও প্রতিবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৪১)।

ফয়েজের কবিতার অন্যতম ইংরেজি অনুবাদক বারান ফারুকি তাঁর অনুবাদের ভূমিকায় বলেছিলেন, ÔThe struggle against poverty and the fight against the forces of capitalism gave young Faiz’s poetry a sense of direction. The fight against political and social exploitation provided a common platform for poets who did not recognize the Hindu-Muslim divide, a divide which could have been a concern in Faiz’s poetic imagination.Õ (Faiz, 2027)

এরই রেশ টেনে যেন আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘ষাটের দশক আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানা দিক থেকে তাৎপর্যময় ও মুক্তিপিয়াসী। এই সময়ে যখন তাঁর অনূদিত কবিতা একের পর এক প্রকাশ করেন … বাঙালি কবিতা পাঠকদের জন্য এক নতুন জগতের হাট খুলে যায়। গালিব কিংবা ইকবালের কবিতার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা কেবল বুঝতে পেরেছিলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজের অনন্যতা।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৪৩)। নিজের বিষয়ে ফয়েজ বলেছিলেন, ‘আমি লাহোর গভর্নমেন্ট কলেজে ভর্তি হলে সেখানে অনেক জ্ঞানী-গুণী অধ্যাপকের সাহচর্য পাই …। তাছাড়া ইমতিয়াজ আলি তাজ, চিরাগ হাসান, হাফিজ জলন্ধরি এবং আখতার শিরানী প্রমুখ গুণী উর্দু লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।’ এরপর ফয়েজ জানিয়েছেন, ‘আমি কলেজে যা কিছু শিখেছি তারচেয়ে বেশি শিখেছি এসব গুণী ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষকদের সাহচর্যে ও ভালোবাসা পেয়ে। … আমার বন্ধুদের কাছেও অনেক কিছু শিখেছি। কোনো কবিতা লেখার পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পড়ে শোনাতাম। … কবিতার কোনো লাইন পছন্দ না হলে বন্ধুদের শুনিয়ে তাঁদের পরামর্শে কেটেও দিতাম। এম এ অধ্যয়নকালে আমি যথারীতি নিয়মিত উর্দু কবিতা লেখা শুরু করি।’ (আলম, ২০১৫ : ২৮-২৯)। এরও কারণ রয়েছে, সেটি হচ্ছে, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের দিকে কবির অঙ্গীকার। ফারুকির ভাষায়, ÔThe Marxist ideology, which gave primacy to economic and social forces governing human life in history.Õ (Faiz, 2027)|

বাংলাদেশ ও এ-দেশের নিপীড়িত মানুষের প্রতি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের অনুরাগের কথা এখন আর কারো অজানা নয়। অনুবাদক জাফর আলমের সৌজন্যে আমরা জানতে পারছি যে, একাত্তরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের সময় ফয়েজ বাংলাদেশকে নিয়ে দুটো কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর ‘বাংলাদেশ-২’ কবিতার অংশবিশেষ এ-রকম (অনুবাদ : জাফর আলম) – ‘প্রত্যেক গাছ রক্তের মিনারের মতো/ প্রতিটি ফুলও রক্তমাখা/ প্রতিটি চাহনি যেন রক্তের বর্শার তীর।/ প্রত্যেক ছায়াও রক্তে আপ্লুত।/ রক্তের নদী যতক্ষণ বহমান রবে/ রক্তের রং হবে লাল/ শহীদদের জন্য বহমান রক্তের নদীর কান্না।’ (আলম, ২০১৫ : ৩৪)। আবুল হাসনাতের মনে হয়েছে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ‘নতুন সুর এনেছেন উর্দু কবিতায়। জনজীবনের জন্য নতুন, সময়ের জন্য নতুন, এমনকি নতুনভাবে আবিষ্কৃত অনুভূতিও নতুন। পুরনো প্রকরণের কোনোকিছুকে তছনছ করে ভেঙে দেননি বটে বরং সমকালীন উর্দু কবিতাকে আত্মস্থ করে সে ধারাতে সংযোজন করেছেন নবীন প্রকরণ ও শৈলী। উর্দু কবিতার ঐতিহ্যিক ধারাতেই তাঁর অবসান হয়েছিল।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৪৩)।

ফয়েজের জীবনীকার আলী মাদিহ্ হাশমি (Ali Madeeh Hashmi) অনেকটা একই ধরনে বলেছিলেন, ÔWhile Faiz’s poetry worked magic on his admirers, the same cannot be said of the way he recited his verses. Many people commented on this|Õ এরই সূত্র ধরে তিনি আরো জানিয়েছিলেন, ÔUnlike other poets of his era, including Iqbal, Faiz always recited new verses in a rather austere, unembellished, style, almost as if he were reciting prose. This was … a reflection of his shyness and his self-effacing personality.Õ (Hashmi, 2016 : 270)

আবুল হাসনাত তাঁর বক্তব্যের সারকথা বলেছেন এইভাবে যে, ‘সৃজনশীলতা আর মানুষের মানবিক উপলব্ধির কোনো গণ্ডি নেই। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ উর্দু আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ হিসেবে এই ঐক্যবন্ধনকে সুদৃঢ় করে তুলেছিলেন মানুষের সঙ্গে মানুষের।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৫১)

চার

আবুল হাসনাতের কাব্যিকচেতনা ও তাঁর মনোজগতের কথা বলতে গিয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘আবুল হাসনাত মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মনীষা নিয়ে সর্বদাই ভাবতেন। কিন্তু সে ভাবনা তাঁকে মোটেই সীমাবদ্ধ করেনি। কারণ একইসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকর ছিল আন্তর্জাতিকতা।’ (হাসনাত, ২০২২ : ভূমিকা)। কথাটি যে কতখানি সত্যি সেটি আমরা বুঝতে পারি, যখন নেরুদা-ফয়েজের পাশাপাশি শামসুর রাহমান-আবদুল মান্নান সৈয়দের সাহিত্যচর্চা নিয়ে আবুল হাসনাতের বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়াটির দিকে আমরা নিবিড়ভাবে খেয়াল করি।

‘শামসুর রাহমানের কবিতায় সময়-চেতনা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আবুল হাসনাত বলেছেন, ‘শামসুর রাহমানের ব্যক্তিস্বরূপ ও কবিসত্তা এবং সৃজন-ক্রমবিকাশের ধারা খুবই বিস্তৃত। তিনি যখন কবিতা চর্চা ও সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, তখন তিনি সাহিত্যের উৎসাহী পাঠক। তাঁর কবি হয়ে-ওঠা এবং প্রারম্ভ থেকে অন্তিম যাত্রার যে-বিবর্তন তা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। এই বিবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিকাশ এবং আধুনিক কবিতার বিবর্তনের সঙ্গে সুখপ্রদভাবে সংশ্লিষ্ট। একজন কবির জন্য এ খুবই গৌরবের।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৬৩)

শামসুর রাহমানের কবিতায় যে-সমকালিক চেতনা, যাকে কেউ-রাজনৈতিক চেতনাও বলতে চেয়েছেন, সেটি কিন্তু তাঁর কাব্যচর্চার শুরু থেকেই দেখতে পাই। বিশেষ করে, রাহমানের তৃতীয় কাব্য বিধ্বস্ত নীলিমার (১৯৬৭) দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাবো যে সেখানে শামসুর রাহমান যেন ধীরে-ধীরে সমাজসচেতন হয়ে উঠছেন। তারপর নিরালোকে দিব্যরথ-এর (১৯৬৮) পথ বেয়ে নিজ বাসভূমে (১৯৭০) এসে কবি তাঁর মনের সমস্ত জানালা খুলে দিলেন। তাঁর যেসব কবিতা একাত্তরের পূর্ববর্তী সময়ে এবং একাত্তরের পরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক দুর্যোগে পাঠকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার অনেকগুলিই সেই সময়ের রচনা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘রাজকাহিনী’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘হরতাল’ প্রভৃতি। বলা যায়, ব্যক্তির অস্তিত্বের সংকট সেইসঙ্গে সামগ্রিক সমাজবোধ এইসব কবিতায় একত্রে এসে যেন মিলেছে। এই ব্যাপারটি আমাদের অনেক সমালোচকই খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক রশীদ করীম তো এ-কারণেই খোলাখুলি রাহমানের সমালোচনা করেছিলেন। কেননা, তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, ‘বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থান, জলোচ্ছ্বাস, ঝঞ্ঝা, লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ, শহীদের আত্মত্যাগ এইসব বড় বড় ব্যাপারে শামসুর রাহমানের মন জড়িয়ে থাকে, তিনি ইনভলভড হয়ে যান।’ (করীম, ২০০৩ : ১৪০)। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবো, রশীদ করীমের এই কথাটার মধ্যে একটু ‘খোঁচা’ দেওয়ার ব্যাপার আছে। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে এই খোঁচাটা দিলেন রশীদ করীমের মতো একজন প্রজ্ঞাবান সাহিত্যিক। যেন কবিতায় সমাজ-রাজনীতির প্রসঙ্গ এলেই কবিতার জাত-মান চলে যায়! আবার রশীদ করীম কিন্তু এ-ও বলেছিলেন, ‘শামসুর রাহমানের সাম্প্রতিক কবিতাগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য এই যে পড়তে পড়তে মনে হয়, যদিচ কবিতাই কিন্তু টেবিলের ওপাশে বসে শামসুর রাহমান যেন অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন।’ এরপর রশীদ করীম লিখেছেন, ‘বিধাতা তাঁকে এমন অলৌকিক শক্তি দিয়েছেন যে আমরা যেকথা গদ্যে বলি, গদ্যময় করে বলি, যেসব বিষয় নিয়ে খবরের কাগজের সম্পাদকীয় লেখা হয়, রাস্তায় মিছিল বের হয়, মনোমালিন্য হয় স্বামী-স্ত্রীতে, সেই কথাই তাঁর [শামসুর রাহমান] লেখায় কাব্য হয়ে ঝরে।’ (করীম, ২০০৩ : ১৩১)।

বিপরীত দিকে, আবুল হাসনাতের কিন্তু মনে হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের কবিতা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে সাবালকত্ব অর্জন করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এই অঞ্চলের বাঙালিকে স্বাজাত্যবোধে  উদ্দীপিত করেছিল, শিল্প ও সাহিত্যের পথ নির্মাণে এবং ভাষাচেতনায় ও ঐতিহ্যভাবনায় … নিঃসন্দেহে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৬৩)। আমরা যদি শামসুর রাহমানের রাজনৈতিক বা সমাজসচেতন কবিতাগুলির দিকে শিল্পিত দৃষ্টি নিয়েও তাকাই, তাহলেও হাসনাতের বক্তব্যকেই যথার্থ বলে মনে হয়। শামসুর রাহমানের দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩) কাব্যের ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ কবিতার খানিকটা যদি পাঠ করি, দেখতে পাবো, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের গতিকে যেন একসূত্রে গেঁথেছেন। আর এইভাবেই তিনি জীবনের চিরন্তন সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে জীবনকেই মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। আমরা যখন পাঠ করি, দেখি ‘নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানি,/ সমস্ত দোকান-পাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ,/ ধাবমান রিকশা, ট্যাকসি, অতিকায় ডবল ডেকার,/ কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান,/ প্যান্ডেল, টেলিভিশন, ল্যাম্পপোস্ট, রেস্তোরাঁ, ফুটপাত/ যাচ্ছে ভেসে, যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে।’ আবুল হাসনাত সে-কারণেই প্রচণ্ড আস্থা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সকলে জানি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের ভাষা, নির্মিতি ও বোধ পালটে গিয়েছিল “নিরালোকে দিব্যরথে” এসে। তারপর তাঁর কবিতা শিল্পিত হয়ে উঠল মানুষের দুঃখ-বেদনাকে কেন্দ্র করে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ভাষা ও অভিব্যক্তি হয়ে পড়েছিল জীবনলগ্ন, অন্যদিকে দেশ-আত্মার সংকট উপলব্ধি শামসুর রাহমানের দেশচেতনাকে প্রখর করে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে তিনি বোধকরি অনন্য। এসব সত্ত্বেও কোনদিনই তাঁর কবিতা উচ্চকণ্ঠ ও শ্লোগানধর্মী হয়নি।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৬৭)। আমরা দেখতে পাই যে রশীদ করীমের মতো সমালোচকও নিজের পূর্বের মতামত থেকে সরে এসে, শামসুর রাহমানের এই ধরনের কবিতা সম্পর্কে আগ্রহোদ্দীপক ও ইতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। (করীম, ২০০৩ : ৩৮৪)

বর্তমান সময়ের দিকে তাকিয়ে আবুল হাসনাত বলেছিলেন, ‘এই সময়ে তাঁর [শামসুর রাহমানের] অভাব আমরা খুবই অনুভব করি। অনেক বিরূপতার মধ্যে তিনিই তো লিখেছিলেন “সুদর্শন যাবে না”-র মতো কবিতা। আমরা এই ধরনের সংকটকালে তাঁকে বিনিদ্র রাত্রিযাপন ও অস্থির হয়েও প্রতিবাদী হতে দেখেছি। এই প্রতিবাদ তাঁর কাব্যধর্মে ও সৃজনেও ছাপ ফেলেছিল। সেজন্য আজ তাঁকে, তাঁর অঙ্গীকারকে, তাঁর কাব্যচেতনাকে খুব মনে পড়ে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৬৭)। শুধু শামসুর রাহমানই একা নন, বলা যায় আমাদের পঞ্চাশের দশকের কবিদের কাব্যচর্চা সম্পর্কে আবুল হাসনাত খুবই উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। যে-কারণে তিনি অকপটে বলতে পেরেছিলেন, ‘পঞ্চাশের দশকের কবি সংঘের দিকে তাকালে আমরা প্রত্যক্ষ করি, কী প্রচণ্ড অঙ্গীকার নিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের কবিতাকে নানাদিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন!’ এই কবিদের কাব্যপ্রকাশের স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে হাসনাত বলেছিলেন, ‘চল্লিশের দশকের ভাষা ও প্রকরণের বলয়, বিশেষত রূপকল্প ও শব্দচয়ন থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ নবীন এক কাব্যভাষা তাঁরা নির্মাণ করেছেন। প্রথাশাসিত সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই যে সাহিত্যিক অর্জন, এ খুবই তাৎপর্যময় বিষয় বলে পরবর্তীকালে বিবেচিত হয়েছে। … প্রকরণ, বিষয়, অভিব্যক্তি, উপমা ও চিত্রকল্পও হয়ে উঠেছিল এঁদের প্রযত্নে সম্পূর্ণ নতুন।’ (হাসনাত, ২০২২ : ৬৩)

শামসুর রাহমান বিষয়ে তিনি লিখেই শুধু থেমে থাকেননি। আমরা দেখতে পাই যে, শামসুর রাহমানের রচনাবলি সম্পাদনার কাজে হাসনাত এগিয়ে এসেছিলেন। সেই রচনাবলির দুটো খণ্ডের প্রকাশ তিনি দেখেও গিয়েছিলেন। আমরা আশা করবো, যোগ্য কেউ তাঁর সেই অসমাপ্ত কাজটি সম্পাদন করবেন।

পাঁচ

আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন আবুল হাসনাতের সমসাময়িক। ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটিতে হাসনাত বিনয়ের সঙ্গেই জানিয়েছেন, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে গুছিয়ে কিছু লেখা খুব সহজ নয়। বাংলাদেশের সাহিত্যের সকল শাখায় তাঁর দৃপ্ত বিচরণ ছিল। তাঁর প্রতিভার বহুমুখিনতা নিয়ে কিছু বলা খুবই শ্রমসাধ্য কাজ।’ কেন শ্রমসাধ্য কাজ? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হাসনাত আবারো প্রশ্ন করছেন, ‘আজ পশ্চাতে ফিরে তাকিয়ে আমরা এমত প্রশ্ন তো করতেই পারি সাহিত্যের কোন ক্ষেত্রে বা শাখায় তাঁর সৃজনবৈভব দীপিত হয়েছিল? কবিতা, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য ও অনুবাদ কোন ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা, প্রজ্ঞা, মনন ঔজ্জ্বল্যে দীপ্তিমান হয়ে উঠেছিল?’ এবার আর প্রশ্ন নয়, হাসনাত তাঁর মেধা আর প্রজ্ঞা দিয়ে বিবেচনাপূর্বক উত্তর দিয়েছেন এভাবে, ‘আমরা বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করি, উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।’ (হাসনাত, ২০২২ : ১৩১)

তাঁর নিজের কবিতা সম্পর্কে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘আমি অনেকের মতো, একটানা কবিতা লিখে লিখে যাইনি। মাঝে-মাঝেই বিরতি পড়েছে। আবেগে আন্দোলিত না-হয়ে উঠলে আমি কবিতা লিখতে পারি না।’ সেইসঙ্গে তিনি আরো জানিয়েছিলেন, ‘এই আবেগকে মূল্য দিতে চাই বলেই আমি কবিতার পরিমার্জনায় খুব-একটা বিশ্বাস করি না।’ ( সৈয়দ, ১৯৮৪ : ৪৪)। বলতে পারি মান্নান সৈয়দের কবিতায় এটি দেখতে পেয়েই আবুল হাসনাত মন্তব্য করেছিলেন, ‘কবিতায় তিনি যে মাত্রা সঞ্চার করেছিলেন নানা অনুষঙ্গকে ধারণ করে তার মূল্য অসীম। তিনি যে বৃহৎ মাপের এবং দেশের শীর্ষ কবি ছিলেন একথা তো নির্দ্বিধায় বলা যায়।’ তিনি তাঁর কথাটিকে একটা দৃঢ় ভিত্তি দিতে গিয়ে সবিস্তারেই বলেছিলেন, ‘তাঁর কবিতাসমগ্রের পাতা ওলটালে খুব সহজ দৃষ্টিপাতে চোখে পড়ে জীবনের নানা দিক উন্মোচন করতে গিয়ে কখনো-সখনো মগ্নচৈতন্যকে ধারণ করলেও জীবনবোধের তীব্রতা উপেক্ষণীয় ছিল না তাঁর কাব্যে। বিশেষত প্রেম, নিসর্গচেতনা ও রোমান্টিক বেদনার তাপ তাঁর কবিতায় মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল।’ (হাসনাত, ২০২২ : ১৩১)। আমরা এখানে আবদুল মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তব কবিতা কাব্যের (১৯৮২) ‘কবি’ কবিতা থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি, যার মধ্যে দিয়ে আবুল হাসনাতের মন্তব্যটি সারগর্ভ আর প্রাসঙ্গিক মনে হবে : ‘তাৎক্ষণিকতা নাম্নী হুর-পরীর টাগরা অবধি ছুঁয়ে এসে/ মানুষ উঠেছে দোতলায় তেতলায় নিজস্ব জমিতে,/ ভিতরে কবিতা মরে মানুষ বেঁচেছে;/ শুধু কবি তুমি স্তব্ধ হও, শব্দ হও,/ কবি তুমি নিঃস্ব হও, নগ্ন হও,/ নিজে হও নিখিলপৃথিবী/ তুমি তো নিশ্চিত জানো/ পরিপূর্ণ ফলটির ভিতরে চলেছে সোনা-পোকা।’

আমরা বুঝতে পারি, সেই বিবেচনা থেকেই মান্নান সৈয়দের কবিতা সম্পর্কে হাসনাত বলেছিলেন, ‘বিস্তৃত পটভূমিতে বৈচিত্র্যময় বিষয় তাঁর কবিতার বিষয়-আশয় ছিল। প্রবল এক ইন্দ্রিয়বেগের চাপে ছবি ও ছবি ব্যবহারের ওলটপালট দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিয়ে যায় পাঠককে।’ তাঁর এটিও মনে হয়েছিল যে, মান্নান সৈয়দের কবিতার ‘ছন্দ, কবিতার নির্মিতি … সযত্নলালিত।’ (হাসনাত, ২০২২ : ১৩১)। কবি ইয়েটস বলেছিলেন, ÔI commit my emotion to shepherds, herdsmen, cameldrivers, learned men, Milton’s or Shelley’s Platonist, that tower Palmer drew. Talk to me of originality and, I will turn on you with rage. I am a crowd, I am a lonely man, I am nothing.Õ (Reeves, 1969 : 114)| মান্নান সৈয়দের কাব্যপরিক্রমায় দেখা যাবে, বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাব্যদৃষ্টি, জীবনবোধের পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কবিতার সেই পথ চলায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবুল হাসনাতের কাব্যবোধে ভিন্নতা থাকলেও এইখানে এসে তাঁরা দুজনেই যেন এক বিন্দুতে এসে মিলেছিলেন।

মান্নান সৈয়দের গবেষণাকর্মকে আবুল হাসনাত সবসময় প্রশংসার দৃষ্টি নিয়েই দেখেছিলেন। এর কারণ, তাঁর মনে হয়েছে, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রবন্ধ, সমালোচনা ও গবেষণার ক্ষেত্রকে এমন এক শৃঙ্খলায় নবীন মাত্রা দান করেছিলেন, যা বাংলাদেশের সাহিত্যে বিরলই বলা যায়। তিনি সাহিত্য বিশ্লেষণের ও সমালোচনার একটি মানদণ্ড বা প্রতিমান তৈরি করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।’ এর পাশাপাশি তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাছে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট। তিনি গবেষণা করেছেন বটে এবং সে-গবেষণা কোনোভাবেই বিশ^বিদ্যালয়কেন্দ্রিক অধ্যাপক-সুলভ হয়ে ওঠেনি। … আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর এই বিষয়টি পরিহার করে এমন এক স্বাচ্ছন্দ্য এনেছিলেন, যা সাহিত্যানুরাগী যে-কোনো পাঠককে অনুসন্ধিৎসু করে তোলে।’ সেইসঙ্গে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘জীবনানন্দ, নজরুল ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্লেষণ ও গবেষণায় তিনি এমন এক যুক্তিবাদী গদ্য নির্মাণ করেছিলেন, যা গদ্যশৈলীর দিক থেকে স্বকীয়তা অর্জন করেছিল। উপলব্ধি করা যেত এ তাঁর গদ্য, এ তাঁর যুক্তি। কখনো-সখনো তাঁর যুক্তি ও বিশ্লেষণে দৃষ্টিভঙ্গি যে কত অতল ও গভীরতাস্পর্শী হয়ে উঠেছিল এ আমরা উপলব্ধি করতাম।’  (হাসনাত, ২০২০ : ১৩২)

আবুল হাসনাত বিশ্বাস করতেন যে, ‘সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণার ধর্ম হলো জিজ্ঞাসাকে উসকে দেওয়া এবং নিত্যনতুন অনাবিষ্কৃত জগতে প্রবেশ করা।’ মান্নান সৈয়দের কৃতিত্বকে তিনি এইদিক থেকে বিচার করেছেন। তাঁর মতে, আবদুল মান্নান সৈয়দের জীবনানন্দবিষয়ক সমস্ত গবেষণাকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শুদ্ধতম কবি। হাসনাতের ভাষায়, ‘এই বইটি প্রকাশমাত্রই দুই বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। … তাঁর প্রবন্ধাবলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমার তো কেবলই মনে হয়, তিনি এদেশের প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ করেছেন, বিশ্লেষণে নবমাত্রা সঞ্চার করে।’ (হাসনাত, ২০২২ : ১৩২)। এ-প্রসঙ্গে এই বইটি নিয়ে শামসুর রাহমানের উচ্ছ্বাসের কথাও আমাদের মনে পড়ে। বইটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি সেই ১৯৭২ সালে লিখেছিলেন, ‘এই নিষ্ঠাবান তরুণ লেখক [আবদুল মান্নান  সৈয়দ] জীবনানন্দ দাশের কবি-চারিত্র্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে কাব্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। … আবদুল মান্নান সৈয়দের “শুদ্ধতম কবি” পড়ে আনন্দ পেয়েছি। সেজন্যে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই।’ (রাহমান, ২০১৭ : ১২)

নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে হাসনাত লিখেছেন, ‘আমি সংবাদ সাময়িকীর দায়িত্ব নেবার পর দীর্ঘ ৩৫ বছরে তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখাগুলো সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে। যে-কোনো গবেষক সংবাদ সাময়িকীর ফাইল ঘাঁটলে এ-কথার সত্যতা অনুধাবন করবেন। সম্পাদনাসূত্রে তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল।’ (হাসনাত, ২০২২ : ১৩৫)। অন্যদিকে আবার আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর একটি বইয়ের ‘প্রবেশক’-এ একেবারে অকপটে এইভাবে ঋণ-স্বীকার করে জানিয়েছিলেন যে, ‘অনেক সম্পাদক, প্রকাশক ও সমালোচকের দাক্ষিণ্য আমি পেয়েছি। এঁদের মধ্যে একজন সম্পাদকের কথা কখনো বলা হয়নি যাঁর কথা, অন্তত এই গ্রন্থের প্রসঙ্গে, অনিবার্যভাবে এসে যায়। ইনি হচ্ছেন “দৈনিক সংবাদ”-এর সাহিত্য-সাময়িকীর সম্পাদক আবুল হাসনাত।’ আবদুল মান্নান সৈয়দ এইটুকু বলেই থামেননি। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘সম্পাদক হিশেবেই আমার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেন স্বাধীন বাংলাদেশে, সত্তরের দশকের প্রারম্ভে। ক্রমশ তাঁর সঙ্গে একটি নিবিড় বন্ধুতা ঘটে যায়।’  সৈয়দ, ১৯৯৪ : বিশ)।

তবে এই মধুর বন্ধুত্বের সমাপ্তিটা ছিল বেশ বিষাদের। এ-প্রসঙ্গে আবুল হাসনাত জানিয়েছিলেন, ‘“কালি ও কলম” প্রকাশিত হবার পর ‘ছন্দ’ নিয়ে এ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ক্ষুদ্র পত্রকে কেন্দ্র করে তিনি আমাদের ওপর কুপিত হন ও দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ছিন্ন করেন। কোনো বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও সম্পাদকের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি বিবেচনা করতে চাননি।’ (হাসনাত, ২০২২ : ১৩৫)।  এতকিছুর পরেও আবুল হাসনাত সবসময়ই আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘শক্তিমত্তা ও সৃজন উৎকর্ষে’ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শুধু সমালোচক বা সম্পাদক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও আবুল হাসনাত ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রাসঙ্গিকভাবেই মন্তব্য করেছিলেন, ‘বস্তুত হাসনাতের জগৎ সংবেদনশীলতায় পরিপূর্ণ। তাঁর আপনজনদের অনেকেই চলে গেছেন তাঁর জীবনকালেই। তাঁদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন গভীর আবেগের সঙ্গে। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বতন্ত্র এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের ওই স্বাতন্ত্র্য, গুরুত্ব দুটোই উপস্থিত তাঁর লেখাতে। এঁরা পাঠকেরও আপনজন হয়ে ওঠেন হাসনাতের মাধ্যমে।’ তাঁর এই প্রবণতার কার্যকারণ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশ্লেষণ অনেকটা এ-রকম, ‘হাসনাত বিচ্ছিন্নতাকে মানতেন না। চাইতেন সংলগ্ন থাকতে। তাঁর প্রবন্ধগুলো বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও বৈকি!’ (হাসনাত, ২০২২ : ভূমিকা)।

ছয়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন সমালোচকের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন সাহিত্যকে ব্যাখ্যা করবার দক্ষতা, সেইদিক থেকে তাত্ত্বিক বিচারেও তাঁর তেমন-একটা আপত্তি ছিল না। এসবের পাশাপাশি তিনি সমালোচকের রচনায় যে-গুণটি কামনা করতেন, সেটি হচ্ছে, সাহিত্যের রস বিশ্লেষণে অকৃপণতা, সাহিত্যিকের প্রতি সহনশীল স্পর্শের সৌকুমার্য আর তাঁর সাহিত্যকর্মের প্রতি সংবেদনশীল সৌজন্য। আবুল হাসনাতের মধ্যে এসবের প্রতিটি উপাদান এত স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে তাঁর সমালোচনার পথটিকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।

প্রয়াণ দিবসে আবুল হাসনাতের স্মৃতির প্রতি রইলো আমাদের শ্রদ্ধা।

আকর-গ্রন্থ

১. আবুল হাসনাত, ২০২২। বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ, নেরুদা ও অন্যান্য (ভূমিকা : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী), জার্নিম্যান,  ঢাকা।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১.        আবদুল মান্নান সৈয়দ, ১৯৮৪। আমার বিশ্বাস, রূপম প্রকাশনী, ঢাকা।

২.       আবদুল মান্নান সৈয়দ, ১৯৯৪। বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

৩.       আলী আনোয়ার, ২০০৭। পাবলো নেরুদা : প্রেমে ও সংগ্রামে, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।

৪.       জাফর আলম (সম্পাদনা), ২০১৫। ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স লিমিটেড, ঢাকা।

৫.       পাবলো নেরুদা, ১৯৮৩। অনুস্মৃতি (অনুবাদ : ভবানীপ্রসাদ দত্ত), রূপা অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা।

৬.       মফিদুল হক (সম্পাদনা), ২০১৪ [প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৬]। পাবলো নেরুদা : আত্মস্মৃতি ও কয়েকটি কবিতা, সাহিত্যপ্রকাশ, ঢাকা।

৭.       রবিন পাল, ২০১৮। পাবলো নেরুদা : অনুবাদে অনুভাবে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

৮.       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩৯৪। সাহিত্যের পথে [প্রথম প্রকাশ : ১৩৪৩], বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।

৯.       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৪০২। চিঠিপত্র : ষোড়শ খণ্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।

১০.      রশীদ করীম, ২০০৩। প্রবন্ধ-সমগ্র, সাহিত্যপ্রকাশ, ঢাকা।

১১.      শামসুর রাহমান, ২০১৭। একান্ত ভাবনা, কথাপ্রকাশ, ঢাকা।

12. Ali Madeeh Hashmi, 2016. Love and Revolution : Faiz Ahmed Faiz, Rupa Publications, New Delhi.

13. Faiz Ahmed Faiz, 2017. Selected Poems (Translated by Baran Farooqi), Penguin Books, London.

14. Ilan Stavans (Edited), 2005. The Poetry of Pablo Neruda, Farrar, Straus and Giroux, New York.

15. James Reeves, 1969. The Poets And Their Critics, Hutchinson, London.

16. Pablo Neruda, 1977. Memoirs (Translated by Hardie St. Martin), Penguin Books, London.