আমাদের দৃশ্য-সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন

মাহমুদুল হোসেন

না-দাবি :

amader drisho songskrity

এই লেখা চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের সাংগঠনিক বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রস্তাবনা নয়। যুক্ত সকলে মানবেন যে, চলচ্চিত্রসংসদ নিয়ে প্রায় সব চিন্তাই আবর্তিত হয় এর সাংগঠনিক বিস্তৃতি এবং সুস্বাস্থ্য অর্জনের সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা, কৌশল ইত্যাদি প্রসঙ্গে। এ বছর, চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে, সেরকম লেখা লিখেছি; আরো অন্যরাও নিশ্চয়ই লিখেছেন; এখানে সেসব কথা আর পুনরুল্লেখ করতে চাইনি। এ-লেখা পাঠ করতে গিয়ে অবধারিতভাবেই সাংগঠনিকভাবে কীভাবে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে, সে-চিন্তা পাঠকের ভেতরে জাগবে। সবকিছুর উত্তর আমাদের জানা নেই, আর কাজ করতে গেলেই ক্রমশ বেরিয়ে আসে নানা পথ। উৎসাহী পাঠক উদ্যোগী হয়ে সেসব লেখা পাঠ করে দেখতে পারেন নিশ্চয়ই, যাদের কথা উল্লেখ করেছি।

এই লেখাটি মূলত সাম্প্রতিক দৃশ্য-সংস্কৃতিতে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনার একটি প্রচেষ্টা। তবে শেষ পর্যন্ত কিছু প্রয়োজনীয়  উদ্যোগের কথাই লিখেছি। কিন্তু সাংগঠনিক কৌশল প্রস্তাব করা থেকে বিরত থেকেছি।

১. দৃশ্য-সংস্কৃতির পরিসর :

দৃশ্য-সংস্কৃতির ধারণাটি ব্যাপক। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমাজের যে দৃশ্যমান রূপ তা-ই ওই সময়ের, ওই সমাজের দৃশ্য-সংস্কৃতির প্রকাশিত অবস্থা। এর ভেতরে প্রতিদিনের আটপৌরে জীবনের রূপ আছে, সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের; আছে উৎসব-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস-ব্যবস্থাসমূহের দৃশ্যাবলি; আছে নির্মিতি, স্থাপনা ও কৌশলসমূহের বাহ্য উপস্থাপনা। আরো অগ্রসর সমাজে, এখন, প্রায় সর্বত্রই, ফ্যাশন এবং প্রচারণার চলমান ও স্থির ছবি। আর দৃশ্যশিল্প – যা বিশ্বাস, মানবমুখিনতা, প্রতিষ্ঠান ও বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন প্রশ্নণ নিয়ে সক্রিয়। দৃশ্যশিল্প সম্ভবত দৃশ্য-সংস্কৃতির একটি উপবিভক্তি নয়; অন্তত এভাবে অগ্রসর হওয়া সমীচীন নয় গভীর চিন্তনে – কারণ, শিল্প তো বিশ্বাস ও জীবনের প্রতি সংবেদী প্রতিক্রিয়াই। কিন্তু আমাদের এই পর্যালোচনাটি অনেকটাই কেজো; দৃশ্য-সংস্কৃতির কোনো কাঠামো-অন্বেষণ নয়; একটি চলমান কার্যক্রমের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে পাঠ করার ও কিছু প্রস্তাবনার ব্যাপার মাত্র এবং সম্ভবত কার্যক্রমটির সক্রিয়তায় দৃশ্যশিল্পই নিকটবর্তী সমাজের আর সব দৃশ্যমানতার তুলনায়। কিন্তু এ প্রসঙ্গ পরে, আপাতত এই মেনে নেওয়া যাক যে, আমাদের আলোচনার তলে দৃশ্য-সংস্কৃতির একটি উপবিভক্তি দৃশ্যশিল্প।

লেখা বাহুল্য যে, একটি সমাজের দৃশ্যমানতা একশৈলিক নয়। অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে এর বিসমতা বিশাল। কিন্তু লক্ষ করা যেতে পারে, সাধারণভাবে দুটি প্রবণতা সকল দৃশ্যমানতার গতিপথকে নির্দেশিত করে। মূলত এই প্রবণতা দুটি যেভাবে পরিচালিত হয় সমাজ, শাসিত হয় রাষ্ট্র, সৃষ্ট ও ভুক্ত হয় পণ্য, বিনোদন সেভাবেই কাজ করে দৃশ্যমানতার মধ্যেও। কারণ দৃশ্যমানতা আসলে তো সমাজ অথবা রাষ্ট্রে যাপিত ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের চলমান ও স্থির, বাস্তব ও বিনির্মিত ছবির সম্পূর্ণ ভান্ডার। প্রবণতা প্রসঙ্গে ফেরা যাক। প্রথম প্রবণতা এই যে, অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দৃশ্যমানতার একটি রূপ পরিধির দিকে যাত্রা করে। এই যাত্রায় রূপটি ব্যাসার্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা মাত্রার প্রভাব বিস্তার করে। ধরা যাক, সমাজের সবচেয়ে বিত্তবানরা এ-মুহূর্তে আইফোন বা নানা ব্র্যান্ডের ট্যাব বা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। এই ধরনের একটি মুঠোফোনের অভাব সমাজের সকলের জন্যে এত প্রবল হয়ে ওঠে যে, দুই হাজার টাকা দামেরও একইরকম দেখতে স্মার্টফোন বাজারে এসে যায় এবং নিম্নবিত্ত মানুষেরা তা সংগ্রহ করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠেন। দৃশ্যটি হয় এরকম যে, সমাজের সকলেই ব্যাগ, পকেট, ট্যাঁক, কোচর থেকে একটি বড় আকৃতির মুঠোফোন বের করে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেন। অথবা স্থাপত্যে – ধনী মানুষেরা বাস করেন তিন-চার হাজার বর্গফুটের বাসগৃহে (আরো ধনী যারা তাদের কথা স্বতন্ত্র)। যারা সাতশো বর্গফুটের বাসিন্দা, তাদের ঘরের আদলটিতেও আনার চেষ্টা ওই বড় ঘরের একটি নকল রূপ। তথাকথিত অ্যাটাচড বাথসহ মাস্টার বেড, লিভিং ও ডাইনিং স্পেস ইত্যাদি। কেমন দেখায় এরকম স্থাপত্য সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এভাবে বিত্তের দৃশ্যমানতা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে বিত্তহীনতাকে। দ্বিতীয় প্রবণতায়, দৃশ্যমানতার স্বতন্ত্র আয়োজন অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদে। তার দৃষ্টান্তের অভাব কী? রেললাইনের ধারের ল্যান্ডস্কেপ বা জীবনের ধারাচিত্র আর বারিধারার লাইফস্টাইলের ইমেজ বড়ই আলাদা। যেমন আলাদা রিকশার আরএসইউভির দেখন, এফডিসির গড়পড়তা বাংলা সিনেমা আর চেন্নাই এক্সপ্রেস অথবা আয়রন ম্যান-থ্রির চলমান দৃশ্যাবলি।

আরো যা এই লেখায় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো এই যে, সাম্প্রতিক দশকগুলিতে পণ্যচাহিদা ও যোগাযোগ সমাজের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমানতা খুব প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। অথবা দৃশ্যমানতার সাম্প্রতিক ডাইনামিক্স পণ্য ও যোগাযোগ বিষয়ে অসীম সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে এবং দৃশ্য-সংস্কৃতি, পণ্য ও যোগাযোগ প্রায় পরিপূরক ধারণাসমূহ হয়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই বলছি, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের কথা। দেখা মানে যুক্ত হওয়া, প্রচার করা, প্রচারিত হওয়া, মত প্রকাশ করা, মত নির্মাণ করা, বিক্রয় করা, ক্রয় করা, পণ্যের অভিনব অভাব বোধ করা, অভাব মোচনে অভিনব কৌশল অবলম্বন করা। আর এই দেখার, আসলে দৃশ্য-সংস্কৃতির, নতুন মাত্রা হচ্ছে তাৎক্ষণিকতা, গতিময়তা, ভঙ্গুরতা, অস্থায়িত্ব। এই নশ্বরতার মাত্রা সমাজের সবচেয়ে দৃশ্যমান চিহ্ন, আসলে সমকালের প্রতীক।

দুই. চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের শিল্পচর্চা বনাম আবদ্ধতা :

চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করে; চলচ্চিত্র দৃশ্যশিল্প ও দৃশ্যমানতার এক প্রধান অধ্যায়; এভাবেই দৃশ্য-সংস্কৃতির মধ্যে চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতার বিবেচনা।

চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলনের মধ্যে এক নিছক নিরীহ, ভালোমানুষি শিল্পচর্চার উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমেই দেখুন, তাঁরা চলচ্চিত্রের শিল্প-পরিচয়টাকে বড় করে গ্রহণ করেছিলেন; চলচ্চিত্রের চর্চা করতে চেয়েছিলেন শিল্প হিসেবে। চলচ্চিত্রের অন্যবিধ পরিচয় এবং প্রসারণের সম্ভাবনা বিষয়ে তাঁদের উৎসাহ গৌণই, এমনকি চলচ্চিত্রের শিল্পবিবেচনার ক্ষেত্রটিকেও তাঁরা সীমিত, শুদ্ধ রাখতে চেয়েছেন; বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র-আস্বাদন কার্যক্রমের এমন এক কেন্দ্রমুখী কাঠামো তৈরি করা আছে যে, একটি নিবেদিত চলচ্চিত্রিক বস্ত্তনিষ্ঠতার মধ্যে প্রবেশ না করে চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে পাওয়া যাবে না – এই বোধ হয়। আবার শিল্প-চলচ্চিত্রের প্রান্তিকতা তাঁদের বিচলিত করেছে এবং এই প্রান্তিকতায় যুক্ত হওয়ার রস ও রোমাঞ্চ তাঁদের উৎসাহিত করেছে। নানা ঘোষণায়, পৃথিবীর নানা রাষ্ট্রে তাঁরা, চলচ্চিত্রসংসদের প্রতিষ্ঠাতা এবং সংগঠকরা লিখেছেন, তাঁরা সেই সকল চলচ্চিত্র দেখতে, দেখাতে চান, যারা সাধারণত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয় না; অন্তত, সেদেশে দর্শক সেসব চলচ্চিত্র সহজে দেখতে পায় না। আর তাঁরা লিখেছেন যে, তাঁরা একটি শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের রসাস্বাদন করতে চান; আসলে বলতে চেয়েছেন, চলচ্চিত্র-পাঠ একটি সহজে সাধিত হয় এমন কার্যক্রম নয় এবং এর সফলতার জন্যে যৌথতা আবশ্যক – চিন্তাশীল, মননশীল চলচ্চিত্র-প্রেমিকদের। ভালোমানুষি বটে, কিন্তু লক্ষ না করে তো পারি না যে, পুরো ধারণাটির মধ্যে একটি প্রান্তিকতার আনন্দ রয়েছে। এ প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে যে, চলচ্চিত্রসংসদ- আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং কর্মকান্ডের এহেন সাধারণীকরণ ও সরলীকরণ আদৌ বাস্তবসম্মত কি-না। কারণ, যা লিখেছি তার বাইরে দেশে দেশে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের মানুষেরা আন্দোলনের মধ্যে এবং বাইরে আরো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। ছবি বানানোর বিকল্প কৌশল, ছবির সমবায়ী প্রযোজনা, ছবি নিয়ে নানারকম সংক্ষুব্ধতার পক্ষে দাঁড়ানো ইত্যাদি। কিন্তু এটি একটি বিশ্বাস, বোধই হয় তো, যে, চলচ্চিত্রসংসদ একটি শিল্প-অধ্যয়ন প্রচেষ্টা। অন্তত, চলচ্চিত্রসংসদের শতকরা নববই ভাগ কর্মকান্ড পরিচালিত হয় এই উপলব্ধি থেকে প্রেরণা নিয়েই।

আমরা অতঃপর আমাদের লেখনকে একটি যৌক্তিক আকারের মধ্যে সীমিত রাখার জন্যে কেবলমাত্র আমাদের, বাংলাদেশের, চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন নিয়ে লিখব।

গত শতকের আশির দশকে চলচ্চিত্রসংসদকর্মী আবদুস সেলিম তাঁর এক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন যে, চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের মধ্যে একটি আবদ্ধ ভাব রয়েছে! আবদুস সেলিম সম্ভবত সত্তরের দশকের গোড়া থেকে চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং আমাদের  ঢাকা শহরে যখন এই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি মানুষকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিল  সে-সময়টাকে তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু আবদ্ধতার ভাবটি তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। এখানে একটি ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ রয়েছে। আবদুস সেলিম-কথিত আবদ্ধতা, যাকে প্রান্তিকতা লিখতে চাইছি, তার সঙ্গে অপ্রচল চলচ্চিত্রের প্রদর্শনের কোনো নিয়ামক সম্পর্ক নেই। সত্যিকার অর্থে, চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলন প্রচলিত, সহজলভ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে শুরু করলে তার প্রাসঙ্গিকতাই হারিয়ে ফেলার কথা এবং যে-প্রান্তিকতার কথা লিখছি, তা আরো ব্যাপ্ত হয়ে অবশেষে বিলুপ্তির মুখোমুখি হওয়ার কথা। অগভীর বিনোদন হিসেবে নির্মিত হয় যে-চলচ্চিত্র এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তাদের নিয়ে গণমাধ্যমবিষয়ক শিক্ষকরা কাজ করছেন, করে দৃশ্য-সংস্কৃতি বিষয়ে চিন্তাশীল কাজের একটি ধারা নির্মাণ করছেন। কিন্তু আমি মানতে চাই যে, এ-কাজটি অ্যাকাডেমিক, চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলনের এসব চলচ্চিত্র নিয়ে যদি কিছু কাজ করারও থাকে তবে সেটি অন্তত তাদের ধারায় নয়।

তিন. চলচ্চিত্রের অবভাসিক (phenomenological) রূপ; একটি বিকল্প পাঠের প্রস্তাবনা :

আসলে প্রান্তিকতার বিষয়টি অনেক বেশি সঞ্চারিত হয় চলচ্চিত্রকে একটি বিচ্ছিন্ন, একক শিল্প হিসেবে বিবেচনার ন্যারেটিভিটির ভেতর থেকে। চলচ্চিত্রের শিল্প-পরিচয়টি গুরুত্বপূর্ণ নিঃসন্দেহে, কিন্তু, এই শিল্প-পরিচয়ের বাহনটি কী হবে, কী হলে চলচ্চিত্র সকলের হয়ে উঠতে পারে – এই প্রশ্নটি করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক দৃশ্য-সংস্কৃতি এই প্রশ্নটিকে প্ররোচিত করছে যেন। আর যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘চলচ্চিত্র’ বা চলমান ছবি শিল্পের জাদুকরীর মধ্যে আটকে থাকেনি, হয়ে উঠেছে আরো অনেক কিছু। যেসব আলোচনা ওপরে করেছি, সমকালের দৃশ্য-সংস্কৃতি বিষয়ে, সেসব ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র বড় খেলোয়াড়, অনেক সময়ই শিল্প হিসেবে নয় কিন্তু! চিন্তাশীল, মননশীল চলচ্চিত্র-শিল্পপ্রেমিকরা চলচ্চিত্রের এই বেড়ে ওঠা পরিচিতি নিয়ে বড় একটা আগ্রহ দেখাননি; অন্যদিকে, চলচ্চিত্র-পাঠে একজন সৃজনশীল শিল্পীর নিজস্ব শিল্পভাষার বিশ্লেষণ করেছেন, তার নির্মিতির বৃহত্তর অবভাসকে বিবেচনায় নেননি সেভাবে। সেরকম বিবেচনা অন্তত দুটি কাজ করতে পারত। চলচ্চিত্রশিল্পের আলোচনাটিকে একটি অপেক্ষাকৃত বড় সম্ভাবনার মধ্যে সঞ্চালিত করত এবং এভাবে শুদ্ধ শিল্প নয়, এরকম ব্যবহারে চলচ্চিত্রের আলোচনাটি সূচিত হতে পারত। অন্যদিক থেকে, ততটা চলচ্চিত্রবোদ্ধা নন, অথচ চিন্তাশীল এবং সংবেদনশীল, এমন ব্যক্তিরা যুক্ত হতে পারতেন চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের ভেতরের পরিধিতে; ব্যাকরণের বেড়াজালে সংকুচিত আর আড়ষ্ট না হয়ে পড়েই। এভাবে ‘আবদ্ধ ভাবে’র নিরাকরণ হতে পারত, প্রান্তিকতাকে মোকাবিলা করার কথা উঠতে পারত। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র – যে-পরিচিতিটি নিয়ে আমরা খুব সংবেদনশীল, চলচ্চিত্রসংসদকর্মী হিসেবে, সে পরিচিতিটির গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপ্ত হতে পারত। আমরা দৃশ্যমানতায় শিল্প-চলচ্চিত্রের দৃশ্য এবং অদৃশ্য প্রভাব অনুভব করতাম। আর একটি ব্যাপার  ঘটতে পারত – দৃশ্যশিল্পের সকল শিল্পী শিল্প-চলচ্চিত্র নিয়ে উত্তেজিত বোধ না করলেও চলমান ছবির ঐতিহাসিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত ভাষাকে গুরুত্ব প্রদান করতেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গ পরে।

চার. দ্রোহের দৃশ্যমান ফ্যাশন ও আন্দোলনের প্রান্তিকতার মোকাবিলা :

কিন্তু চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন তার স্বভাবজাত প্রান্তিকতার মোকাবিলা করতে চায় – এরকম ধরে নিচ্ছি কেন? এ জন্যে যে, এই আন্দোলনের ভেতর বিকল্প এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বারবার এসেছে। এই দুটি পদ প্রান্তিকতাকে অদৃষ্ট হিসেবে মেনে নেয় না, একে মোকাবিলা করে, ক্রমাগত একটি উজান বাওয়ার কাজ করতে চায়; একটা লড়াইয়ের ধারণাকে সামনে রাখে। আর একটি মজার বিষয় লক্ষ না করে পারি না; বিকল্প এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এখন খুবই ফ্যাশনেবল! এ এক আশ্চর্য প্যারাডক্স এই ভীষণ বিষয়ী কালে – কিন্তু চারদিকে এই বিদ্রোহের দৃশ্যমানতা। তারুণ্যের ওপর একটি ছোট চলচ্চিত্র দেখা গেল। ঢাকা শহরেরই। ছেলেমেয়েদের অবয়বে, উচ্চারণে, আচরণে বিরোধিতা, ঔদ্ধত্য; বিকল্পের প্রয়োজনে আস্থা। আবার তারা ভোগ্যপণ্যে খুবই দুরস্ত – মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, গিটার, পোশাক, চশমা, নানা ফ্যাশনের দাড়ি। এ চলচ্চিত্রে নেই, কিন্তু তরুণরা সব চে গুয়েভারার ছবি-আঁকা টি-শার্ট গায়ে নয় কি? চে গুয়েভারা কে? সঠিক জানা নেই, কিন্তু জানা আছে আবছাভাবে, অন্যায্যতায় অনাস্থার প্রতীক, সব ভেঙে গড়ার ইমেজ। পণ্যনির্মাতারা এই ইমেজ সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেন যখন, তখন ভাঙার একটা মোহ আছেই! এই তারুণ্য সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ এই লেখার সম্ভাবনার বাইরের ব্যাপার। কিন্তু এটি বোধগম্য যে, এই তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি, ক্রোধ, দ্রোহ, বিলাস। এরকম প্রতিষ্ঠানবিরোধী ফ্যাশনের সময়ে চলচ্চিত্রসংসদ-আনেদালন প্রান্তিকতায় বিষণ্ণ? সংগঠন নড়বড়ে, কাজের কোনো যুগোপযোগী কাঠামো নেই, ছবির প্রদর্শনী কালেভদ্রে, সেখানে দর্শক নেই।

আসলে মধ্যবিত্ত এলিটিজমের ভেতর একধরনের মফস্বলীয়পনা থাকে। আমাদের চলচ্চিত্রসংসদ- আন্দোলন এই দোষে দুষ্ট অনেককাল। আমরা চলচ্চিত্র দেখাই, এককালে সদস্য ছাড়া আর কাউকে দেখাতাম না, এখন কেউ এলে ধন্য হয়ে যাই। কেউ না এলে বড় দুঃখিত হই। ভেবে দেখি না, কেন কেউ আসবেন। ভেবে দেখিনি এককালে যাঁরা আসতেন তাঁরাই বা কেন আসতেন। এসব ভাবনা না ভেবে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন করার আর কোনো অর্থ নেই; যাঁরা ভাবতে রাজি আছেন নতুন করে, সময়ের উপযোগী করে, তাঁরাই চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। ষাট এবং সত্তরের দশকের মধ্যবিত্ততার কবর দিয়ে দিয়েছে ডিজিটাল হাইপার রিয়ালিটি। আসুন তার মোকাবেলা করি।

পাঁচ. নতুন দেখা ও প্রস্তাবিত অবভাসিক চলচ্চিত্র পাঠ :

দেখার গুরুত্বের কথা লিখেছি আগেই। দেখার জগতের আবার অনেকটা জুড়ে আছে চলমান ছবি। সে কেবল প্রেক্ষাগৃহের সিনেমাই নয়, নয় টেলিভিশনের নাটক, সিরিয়াল আর সংবাদ, এমনকি বিজ্ঞাপনও। চলমান ছবি এখন জীবনের অংশ, বাস্তবতার ভাগীদার। ইন্টারনেটে ভিডিও কনফারেন্স, স্কাইপ সংলাপ অথবা হাতের কাছের ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা প্রতিদিনের ছবি – সে কোনো কালের লিখিত দিনপঞ্জির মতোই। আর এসব দৃশ্যের ছড়িয়ে দেওয়া, ছড়িয়ে পড়া –  বাস্তবতার অথবা আমিত্বের চড়ে ওঠা জাহির। আর বাস্তবতা নিয়েই বা এত উত্তেজনার কী আছে? কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ এমন চলমান ছবির জন্ম দিচ্ছে এবং আরো দেবে যে, বাস্তবতার প্রতিরূপ ধারণ না করেই নির্মাণ করা যাবে সমান্তরাল বাস্তবতা। অন্তত জর্জ লুকাস তো তেমনটাই বলছেন। এখন শিশুরা বলে, মা শিগগির এসো, বাবা এসেছে। আসলে বাবা আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায়। ফেসবুক বা স্কাইপেতে ভিডিও চ্যাটে যোগ দিচ্ছে পরিবারের সঙ্গে। অথবা ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনে এখন তথ্য এবং জ্ঞানের ভান্ডারটি প্রায় বহুলাংশেই ভিজুয়াল, দৃশ্যমান কোনোকিছু। কিন্তু এসব চলমান ছবি, কেজো চলমানতা ইমেজের, এর সঙ্গে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের সম্পর্ক কী? সম্পর্কটি এই যে, আমরা বলেছিলাম, চলচ্চিত্রের ভাষাকে আমরা বুঝব, আমাদের বোঝার ভেতর দিয়ে সমাজ চলমান ছবিকে পাঠ করবে এবং সাহস করে বলা যাক, চলমান ছবিকে ব্যবহারের যে প্যারাডাইমটি সৃষ্টি হবে সেখানে আমাদের বোঝাপড়া একটি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। আসলে প্রথম কথাটিই কেবল চলচ্চিত্রসংসদ বলেছিল; কিন্তু, ভাবতে চাই, ওই বলার ভেতর পরের কথাগুলো লুকানো ছিল, স্বপ্ন হিসেবে, প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণা হিসেবে, ‘আন্দোলন’ শব্দটি ব্যবহারের যৌক্তিকতা হিসেবে। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব ছিল, বা এখনো সম্ভব? সম্ভব, চলচ্চিত্রচর্চার ধারণাটির নবায়ন করলে। আমরা চলচ্চিত্রসংসদে কীভাবে চলচ্চিত্র পাঠ করি সে-বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া যাক। চটজলদি লিখে নেওয়া যেতে পারে, যে-কাজটি করি বলে উল্লেখ করছি সেটিও এখন খুব একটা হয় না। কিন্তু সেটা সাংগঠনিক প্রসঙ্গ এবং এ-লেখার বিস্তারের বাইরের ব্যাপার। আমরা পাঠ করি চলচ্চিত্রনির্মাতার নির্মাণশৈলী। চিত্রনাট্য, ক্যামেরার কাজ, সম্পাদনা, শব্দের প্রয়োগ, ভিজুয়াল রিয়েলাইজেশন – এসব চলচ্চিত্র-ভাষার বিবেচনা। সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হলে আমরা সাহিত্য বনাম চলচ্চিত্র বিতর্ক করি, প্রামাণ্যচিত্র হলে সত্য, বাস্তবতা, ‘বাস্তবতার সৃজনশীল শুশ্রূষা’ এসব প্রসঙ্গকে কিছু ছকে ফেলে বিবেচনা করি – সেসব ছক চলচ্চিত্রের অন্দরমহলের ব্যাপার। এসব আলোচনায় সমাজ, ইতিহাস, ব্যক্তি, রাষ্ট্র, দর্শন, প্রযুক্তি কী বিবেচিত হয় না? হয় তো হয়, কিন্তু সেটার জন্যে একটি কাঠামো নির্মাণ করা আছে, সেটি চলচ্চিত্রের। এই কাঠামোটির অধীনে আমাদের যত পাঠ; চলচ্চিত্রশিল্প পাঠের উপ-অধ্যায় হিসেবে। এভাবে, সন্দেহ করি, একটি ঘেরাটোপ সৃষ্টি হয় – আবদ্ধতার, প্রান্তিকতার। সকলে নয় : কেউ, কেউ চলচ্চিত্র ‘বোঝেন’ – এরকম একটি রূপকথা ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু চলচ্চিত্রের পাঠ বিষয়ীকেন্দ্রিক এবং অবভাসিক হতে পারে। নির্মাতার সৃজনশীলতাকে তার চেতনা এবং চেতনার উপাদান – যেমন, আবেগ, উপলব্ধি, প্রত্যক্ষণ এবং অবধারণের বিবেচনার ভেতর দিয়ে পাঠ করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। চলচ্চিত্রনির্মাতার যে প্রাতিজনিক প্রতিক্রিয়াসমূহ সমাজে তারই প্রতিরূপ চলচ্চিত্রটি – এভাবে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। এই অবভাসিক পাঠের ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রটির স্বগতসত্তার (noumena) দিকে আমরা যাত্রা করতে পারি। এরকম পাঠের সবচেয়ে বড় উপযোগিতা এই যে, তা সমাজের নানারকম বুদ্ধিদীপ্ততাকে আকর্ষণ করবে, চলচ্চিত্র পাঠ অনেকের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠবে। এই কাজটি চলচ্চিত্রটি, যা আছে, তা কী – শুধু এই প্রশ্নের উত্তর দিতে সচেষ্ট হবে না, তা কেন আছে – এই প্রশ্নের জবাবটিও খুঁজবে। আর এই জবাবটির বৃত্তান্ত বৃহত্তর সামাজিক পরিন্ডলে চলচ্চিত্রটির বিচ্ছিন্ন শিল্পরূপের আলোচনার চেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং আগ্রহোদ্দীপক প্রমাণিত হবে বলে মনে হয়, আশা জাগে, চলচ্চিত্রটি প্রবেশ করবে সকলের বা অনেকের মধ্যে। এরকম আলোচনার বৃত্তান্ত তথাকথিত দুরূহ অথচ জরুরি চলচ্চিত্রের পাঠকে দর্শকনন্দিত করবে। হোক সে তারকোভস্কি বা মনি কাউলের ছবির আলোচনা। এই লেখনটির প্রমাণিত অভিজ্ঞতা, অতি স্বল্পমাত্রায় হলেও আমাদের কাছে রয়েছে। এসব জরুরি ছবির পাঠ কিছু দৃশ্যগত বোধ প্রতিষ্ঠিত করতে পারে সমাজের সামগ্রিকতার মধ্যে, যা  দৃশ্য-সংস্কৃতির প্যারাডাইম বদলের এই বিপ্লবী কালে আমাদের দিতে পারে প্রয়োজনীয় শুশ্রূষা। অনন্ত, বিকল্পের, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যে-দৃশ্যমানতা সমাজে ভীষণ প্রয়োজন তার জন্যে লড়াইটা শুরু হতে পারে এভাবে, যারা দ্রোহী কিন্তু অনির্দিষ্টতায় দিশেহারা, তাদের দিতে পারে বিকল্পের ভিজুয়াল প্যারাডাইম। দৃশ্যমানতার একটি অবিপন্ন প্রতিবেশ আমাদের প্রয়োজন হতে পারে বলে প্রায় চার দশক আগে মন্তব্য করেছিলেন সুজান সনটাগ। এই প্রতিবেশের প্রয়োজন এখন নিশ্চিতভাবেই উপলব্ধি করা যাচ্ছে। ভালো চলচ্চিত্র, নতুন এবং পুরনো, ডিজিটাল অথবা সেলুলয়েডে, বাস্তবের প্রতিরূপ অথবা কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজ আমাদের এই প্রতিবেশ গড়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই ভালো চলচ্চিত্রকে সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা এবং অনেকের বোধের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলনের কাজ। এই বিকল্প পাঠ, অনেককে জড়িত করে পাঠ, সেই কাজ সাধনের জন্যে।

ছয়. চলমান ছবির ভাষা আর যত দৃশ্যশিল্প :

দৃশ্যশিল্পের চর্চা এখন ব্যাপকতা লাভ করেছে। দৃশ্যমানতার গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই অথবা এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই দৃশ্যশিল্পের এই প্রবৃদ্ধি। নিউ মিডিয়া আর্ট তেমনি এক সংজ্ঞা ভাঙার সংজ্ঞা। আর গড়ে উঠেছে অনেক বাতাবরণ – দৃশ্যশিল্পের চর্চার জন্যে। তাদের ভিন্নতার অভাব নেই। কিন্তু যে-ঐক্যটি তাদের সকলের মধ্যে সেটি আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না – তারা সকলে চলমান ছবিতে আগ্রহী। এখানেও কাজ করছে একই প্রকরণ। প্রায় এরকম যে, জীবনের একটি চক্রকে সম্পন্ন করার জন্যে ইমেজের চর্চা শুরু করেছিল মানুষ; সে কতকাল আগের কথা। চলমান ছবি এবং তার সর্বব্যাপিতা যেন শেষ পর্যন্ত এই চক্রটিকে সম্পূর্ণ করেছে। আত্মপ্রকাশই মানবতা – এই আমরা আবিষ্কার করেছি এবং এর সর্বাধিক গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা এখন চলমান ছবির ভেতর দিয়ে বাস্তব হয়ে উঠেছে। মাঝখানে আছে প্রযুক্তি, কিন্তু সে বাহন মাত্র। দৃশ্যশিল্প, কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই, চলমান ছবিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এই আগ্রহ প্রয়োজন, সৃজনশীলতা এবং মেধা অনুযায়ী নানামাত্রার এবং নানারকমের। এভাবে চলমান ছবি শিল্প-অভিব্যক্তিসমূহের একটি প্রয়োজনীয় আধার হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য যে, আমরা চলচ্চিত্রকে, চলমান ছবিকেই তো, নিখাদ শিল্প বলে ভেবেছিলাম; তার অন্যবিধ যে-ব্যবহার বরাবরই প্রচলিত ছিল তাদের আমল দিইনি – কারণ শিল্প-পরিচয়ে চলচ্চিত্র দিয়েছিল মহৎ অভিজ্ঞতা, সকল ছাপানো সৃষ্টির প্রকরণে যুক্ত হওয়ার আনন্দ। এ-বাক্যের ক্রিয়াপদের রূপ অতীতকাল হওয়াও সংগত নয়, কেননা, শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র এখনো সফল অভিব্যক্তির জন্ম দিয়ে চলেছে, নানা বিরুদ্ধতার মধ্যেও চলচ্চিত্রের শিল্পরূপের ধারণার নবায়ন ঘটছে, শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের সমসাময়িকীকরণ ঘটছে, ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। এসবই আনন্দের কথা। কিন্তু যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো প্রকাশের একটি আধার হিসেবে চলচ্চিত্রের ব্যবহার – তাঁদের; যাঁরা দাবি করেন না যে, তাঁরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। অন্তত, তাঁরা চলচ্চিত্র হিসেবে একটি শিল্প প্রদর্শনের, শিল্প বিচারের যে-জীবনচক্র তার ভেতর দিয়ে যেতে আগ্রহী নন – তাঁরা তাঁদের অভিব্যক্তির একটি আংশিক রূপ হিসেবে, অথবা খসড়া হিসেবে অথবা সম্পূরক হিসেবে অথবা অভিব্যক্তি নির্মাণের   প্রক্রিয়ার প্রামাণ্যকরণ হিসেবে (যার সঙ্গে যুক্ত করতে চান শিল্পভোক্তাকে) চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেন। চলচ্চিত্রসংসদকর্মীরা যখন এরকম চলমান ছবির মুখোমুখি হন, তখন তাঁদের কী অনুভূতি হয়? এটি অত্যন্ত সাধারণীকৃত একটি প্রশ্ন এবং এর কোনো জবাব হয় না। কারণ চলমান ছবির এমত ব্যবহারের কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। কিন্তু, শিল্প-চলচ্চিত্র নিয়ে উত্তেজিত, প্রৌঢ়ত্বে উপনীত একজন চলচ্চিত্রসংসদকর্মী হিসেবে এই প্রশ্নটি আমাকে নিয়মিত বিদ্ধ করে। এই বিদ্ধ হওয়া থেকেই কিছু ভাবনা।

আসলে চলচ্চিত্রের শিল্প বনে যাওয়া তো কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতা ভিন্ন কিছু নয়। নিছক প্রমোদ, জাদুকরী, বাণিজ্য, রাজনীতিকরণ এসব অনিবার্য ঘটনাবলির ভেতর দিয়েই তার এই হয়ে-ওঠা। কী না যে, চলচ্চিত্র একটি শিল্প। কিন্তু লক্ষ করি না কেন যে, চলচ্চিত্র বরাবরই একটি আধার মাত্র। নিজেই সে শিল্প নয়, যেমন নিজেই শিল্প নয় কাগজ আর কালি-কলম, পাথর আর হাতুড়ি-বাটাল। এমনকি রং আর তুলির মতো শিল্পের জন্যে নিবেদিত আবিষ্কারও সে নয়। বরং তার মিল ওই কাগজ আর কালি-কলমের সঙ্গেই বেশি, যার রয়েছে আরো নানা ব্যবহার। শিল্প হিসেবে বা অন্য যে-কোনো কিছু হিসেবে যাঁরা গোড়া থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে আসছেন তাঁরা এই আধার বা মাধ্যমটিকে ব্যবহার করে আসছেন। এই ব্যবহারের ইতিহাস যাঁরা জানেন, সংসদকর্মীদের জানার কথা, তাঁদের কাছে এ-তথ্য নতুন নয় যে, নানারকম ব্যবহারের অপরিকল্পিত যৌথতা এবং প্রযুক্তির নানারকম সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ মিলে চলচ্চিত্রের একটি সাধারণ ভাষা নির্মিত হয়েছিল। এই ভাষা মানুষ বুঝতে পারে। এর ভেতর দিয়ে যা দেখাতে চায় চলচ্চিত্র তার সঙ্গে দর্শক যুক্ত হতে পারে। এর ভেতর শিল্পের রহস্য নেই, আছে প্রকাশের কেজো যথার্থতা। ভুলভাবে দেখালেও হয়তো লোকে দেখবে, বুঝবে – ভুল বা সঠিক। তবে সেটি কথ্য বা লিখিত ভাষার কাঁচা বা ভুল ব্যবহারের মতোই কঠিন হবে দর্শকের জন্যে, হতে পারে ব্যক্তিবিশেষের জন্যে বিভ্রান্তিকর। এই সাধারণ চলচ্চিত্র-ভাষার উপযোগিতা এতখানি যে, সুনির্মিত অগভীর সিনেমা এবং বিজ্ঞাপনচিত্র এই ভাষা ব্যবহারে কোনো ত্রুটি রাখে না। কারণ দর্শক-বোধগম্যতা তাদের জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প-চলচ্চিত্রে চলচ্চিত্রের এই সাধারণ ভাষার ওপরে প্রতিষ্ঠা লাভ করে নির্মাতার বিশেষ ভাষা। কবিতায় অক্ষরবৃত্তের মধ্যেই যেমন শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদের বিশেষ ভাষা। চলচ্চিত্রের যে সাধারণ ভাষা সে পরিবর্তিত হয় ধীরে, বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়। এই ভাষাকে জানা চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে নিজের যে-কোনো অভিব্যক্তির প্রকাশের জন্যে জরুরি। নিজস্ব বিশেষ চলচ্চিত্র-ভাষা নির্মাণের পূর্বশর্তও হচ্ছে  এই ভাষায় স্বচ্ছন্দ হওয়া। আমার মনে  হয়, আমাদের দৃশ্যশিল্পের জগতে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন যে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারেনি, তা হলো, চলচ্চিত্রের সাধারণ ও বিশেষ ভাষা বিষয়ে জড়িতজনদের সচেতন করে তোলা। যেসব বাতাবরণ রয়েছে, দৃশ্যশিল্পবিষয়ক, তারা নিজেরা চলচ্চিত্র দেখার উদ্যোগ নেন মাঝে মাঝে। এসব ভালো উদ্যোগের দুই ধরনের সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। প্রথমত, এরকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে, যার যার নিকটবর্তী বিষয়ে চলচ্চিত্র দর্শন বিশেষ কার্যকর হবে। হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটা একটা তথ্য সংগ্রহী উদ্যোগে পর্যবসিত হতে পারে। যাঁরা ছবি অাঁকেন তাঁদের জন্যে একজন খ্যাতিমান বা ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্পীকে নিয়ে একটি গড়পড়তা প্রামাণ্যচিত্র দর্শন চলচ্চিত্রিক ঋদ্ধি অর্জনে কোনো সাহায্য করবে না। আলোকচিত্রীরা যদি দেখেন এরকম চলচ্চিত্র কার্তিয়ের ব্রেসোঁ বা এফ-৬৪ নিয়ে, তাহলেও ফলাফল একই হতে পারে। তার সঙ্গে আরেকটি বিপর্যয় ঘটতে পারে – চলচ্চিত্রটি চিত্রশিল্প অথবা আলোকচিত্রের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে উদাসীন হলে এমনকি ভিজুয়াল তথ্য বিপর্যয়ও ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, খুব আলোচিত, সাম্প্রতিক কোনো চলচ্চিত্র দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটি জনপ্রিয় অথবা বিতর্কিত চলচ্চিত্র হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব চলচ্চিত্র পাঠের কিছু প্যারাডাইম তৈরি হয়েছে। জনসংস্কৃতির প্যারাডাইম, নেতি এবং নৈরাজ্যের প্যারাডাইম, জাতীয় বনাম উপনিবেশবিষয়ক প্যারাডাইম ইত্যাদি। সমস্যা হলো, এসব প্যারাডাইমের চলচ্চিত্রিক মাত্রাটির সঙ্গে পরিচিতিরও প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে চলচ্চিত্র-ভাষার একটি ঐতিহাসিক অনুধাবন। এই লেখাতেই উল্লিখিত প্রস্তাবনার সূত্র ধরে বলি যে, সে-অনুধাবনের জন্যে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন নামের চলচ্চিত্রের নিজস্ব পাঠের কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ বাধ্যতামূলক নয়। যাঁরা তা করতে চান, তাঁদের জন্যে সে পাঠের সুযোগ খোলা থাকবে নিশ্চয়ই। কিন্তু চলচ্চিত্রের ভাষার ঐতিহাসিক পাঠটি সকলের জন্যে হতে পারে এক ধরনের অবভাসিক পাঠ। একশটি চলচ্চিত্রের কথা ভাবা যেতে পারে, আঠারশো পঁচানববই থেকে আজ পর্যন্ত। এই ছবিগুলি দেখা এবং এসব ছবি কেন নির্মিত হয়েছে তার বিষয়ীকেন্দ্রিক উপলব্ধি এবং এভাবে চলমান ইমেজের একটি স্টাডিয়ামে (studium) পৌঁছানো যেতে পারে। এই স্টাডিয়ামটি গড়বেন প্রত্যেক দর্শক (এক্ষেত্রে দৃশ্যশিল্পজন) তাঁর নিজস্ব বোধ ও সজ্ঞার আলোকে। একশটি ছবি দেখতে অনেক সময় লাগবে, এত সময় কোথায় পাওয়া যাবে, সকলে নিয়মিত একত্রিত হওয়া যাবে কি না – এসবই খুব বাস্তব সমস্যা। আসলে যা প্রয়োজন তা হলো তালিকাটি এবং ছবিগুলির প্রাপ্যতা। আর প্রয়োজন এদের সম্পর্কে ক্ষুদ্রকায় সাহিত্য – অবভাসিক। আমরা একটি বিষয়ীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রিক চেতনার কথা লিখছি সম্ভবত এবং এই চেতনার ঐতিহাসিক পাঠের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। এ বিষয়ে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলনের করণীয় আছে বলে মনে করি। বিষয়টি নিঃসন্দেহে দ্বিপক্ষীয়, কিন্তু চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন চলমান ছবির এই পরিবর্তিত, গণতন্ত্রায়িত, সর্বত্রগামিতার কালে এই জরুরি কাজটি সম্পন্ন করতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগী হতে পারে। প্রায় এরকম মনে হয়, চলচ্চিত্রের দিক থেকে এটি তাঁদের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। যেসব বাতাবরণের কথা লিখছি, তাদের সদস্য, সেখানে যাঁরা নিয়মিত ও অনিয়মিত, তাঁরা দৃশ্যশিল্পজন, দৃশ্য তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ততার অংশ। নৈকট্য অর্জিত হলে তাঁরা চলচ্চিত্রের ভাষাকে নিজের মতো করে পড়ে নেবেন –  এ-আশা করতেই পারি। তার ফল দৃশ্যশিল্প থেকে সূচিত হয়ে প্রভাবিত করবে কেজো দৃশ্যমানতাকে। কারণ, এই সময়ে কেজো পৃথিবী আর শিল্প তাদের সীমানা ভেঙেছে। আর দৃশ্যমানতা সময়ের প্রতীক; দৃশ্যশিল্প তার থেকে খুব আলাদা কিছু নয়, অন্তত হয়ে থাকতে চায় না।

এ খানিকটা দূরে দেখা নিশ্চয়ই, কিন্তু ভিজুয়াল প্রতিবেশ, যা আসলে সময়েরই প্রতিবেশ, নির্মাণে এ-ই তো করতে পারে চলচ্চিত্রসংসদ-আন্দোলন। r

অক্টোবর ২০১৩