আমার বন্ধু হাসি চক্রবর্তী

মনসুর উল করিম

আমার বন্ধু, সহপাঠী, সতীর্থ শিল্পী হাসি চক্রবর্তী না ফেরার দেশে চলে গেল ২৮ জুলাই। চলে গেল বলতে আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিল চিরকালের জন্য। তার এ-বিদায়ে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও শোকাহত। একই সঙ্গে শোকাচ্ছন্ন চারুশিল্পের অঙ্গনে যাঁদের বসবাস, ওঠাবসা এবং যাঁরা চারুশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত, দেশের ও দেশের বাইরে, বিশেষ করে চট্টগ্রামের সকলেই।

হাসি চক্রবর্তী একটি প্রতিষ্ঠান, একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, একজন সংগঠক, একজন শিল্পবোদ্ধা-লেখক, সর্বোপরি শেকড়-নিংড়ানো ও শেকড়-সন্ধানের অভিযাত্রী। তার তিরোধানে আমরা হারিয়েছি একজন অকৃত্রিম ও একনিষ্ঠ চারুশিল্পীকে। আমি হারিয়েছি একজন প্রকৃত বন্ধুকে, আমার সমালোচক, একজন প্রকৃত প্রতিপক্ষ, দীর্ঘদিন নীরবে পাশাপাশি চলার সাথিকে। হাসি চক্রবর্তীকে নিয়ে এই বিশেষণগুলো লেখার যৌক্তিকতা যে কতটা বাস্তবসম্মত এ-বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই।

হরিহর আত্মা বা আত্মার আত্মীয়কে নিয়ে কতটুকু আলোচনা সম্ভব আমি জানি না, তবে আমি শিল্পী হাসি চক্রবর্তীকে যেভাবে দেখেছি বা মূল্যায়ন করি তা অকুণ্ঠচিত্তে ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হবো না।

আমি লেখক নই, সমালোচক নই। কলম হাতে নিয়ে বসলে রেখার অাঁকাঅাঁকি সৃষ্টি হয়, লেখা হয় না। তাই কোনোকিছু লেখার ব্যাপারে আমার সীমাবদ্ধতা ব্যাপক। যাঁরা শিল্প-সমালোচক – সমালোচনা করেন, এখনো করছেন ও ভবিষ্যতেও করবেন; বন্ধুমহলে বা চায়ের টেবিলে যাঁরা নানা প্রসঙ্গে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেন, তাঁদের মতো অভিজ্ঞতা, পটুতা, বাক্চারিত্র্য – কোনোটাই আমার নেই। হাসি চক্রবর্তী প্রথমে আমার সহপাঠী, বন্ধু ও একধরনের প্রতিপক্ষ এবং সঠিক সমালোচক – এ-বিষয়গুলো উপলক্ষ করে একের পর এক শব্দ সাজিয়ে যাবো। সে আমার সহপাঠী, একজন প্রকৃত চারুশিল্পী, একজন রসসমৃদ্ধ মানুষ। একজন রাগী, একজন মেজাজি, প্রকৃতপক্ষে নিঃস্বার্থ সংগঠক – আমি এ-বিষয়গুলো দীর্ঘদিন উপলব্ধি করেছি, কখনো কখনো প্রসঙ্গক্রমে আলোচনা-সমালোচনা করেছি।

হাসি চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা হয় তারুণ্যের দ্বারপ্রান্তে। এই বয়সে রক্ত থাকে টগবগে, উচ্ছলতা থাকে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। আমরা দুজনই উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পা রেখেছিলাম। কিন্তু মনের টানে আর প্রাণের আবেগে ১৯৬৭ সালে ঢাকা এসে চারু ও কারুকলা কলেজে ছবি অাঁকায় ভর্তি হই। শাহবাগের মনোরম পরিবেশে অবস্থিত চারুকলা কলেজে ভর্তি হতে এসেই আমাদের প্রথম  পরিচয়। হাসি ও আমি মফস্বল শহরে বড় হয়েছি, তাই আমাদের বেশভুষা, আচার-আচরণ অতটা নগরকেন্দ্রিক ছিল না। হাসির পরনে ছিল হাফহাতা লম্বা শার্ট,  বুকে ও পাশে পকেট, পাজামা, কাঁধে শিল্পীদের সাইনবোর্ড থলে। আর আমার ছিল সবচেয়ে সস্তা খদ্দরের মিশেল সবুজ-বাদামি লম্বা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা, পায়ে কমদামি স্যান্ডেল, কাঁধে শিল্পীঝোলা – যাকে বলে সেই সময়ের ‘আর্টিস্টম্যান’। আর সঙ্গে ছিল ছবি আঁকার নানা সরঞ্জাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। হাসিরও তাই। তবে ব্যতিক্রম গান্ধী ফ্রেমের চশমা। ওর মুখে বড় বড় গোঁফ।

ভর্তিপরীক্ষার আগেই আমাদের আলাপ হয়। হাসির বাবা সুশীল চক্রবর্তী স্কুলশিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী, বাম রাজনীতি করেন। মা-ও শিক্ষক। আমার বাবা সরকারি চাকরি ছেড়ে অবসরে। মা গৃহিণী। হাসির ভাইবোন-সংখ্যা পাঁচ। আমার এগারো। হাসি দুরন্তপনায় পারদর্শী;  ক্রিকেট খেলে। আমি চুপচাপ, আমার নিক নাম ঠান্ডুর মতো ঠান্ডা। তবু খেলাধুলা করি, ভলো হকি খেলি, ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে মোটামুটি পারঙ্গম। তবে হকিতে রাজবাড়ীর সেরা। আমাদের দুজনের সবচেয়ে বেশি পরিচয় নিজ এলাকায় অর্থাৎ মফস্বল শহরের বড় ‘আর্টিস্টম্যান’। দুজনেই ‘ভুলো না আমায়’, ‘মনে রেখো’, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’, অথবা ‘ডালিম পাকিলে পরে ফাটিয়া যায়, ছোট লোক বড় হলে বন্ধুকে ঠকায়’ – এলাকার মেয়েদের এ-কথাগুলো লিখে দিয়ে আত্মতৃপ্তি পেতাম।

আর্ট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় দুজনই পাশ করলাম। ১৯৬৭ সালে ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সহপাঠী হিসেবে পেলাম চন্দ্রশেখর দে, কাজী হাসান হাবীব, আসেম আনসারী, মো. সিরাজ উদ্দিন, আঞ্জুমান আরা হাবিব, মারুফ আহমদ, অলকেশ ঘোষ, সাইদা কামাল, ফারজানা এহতেশাম প্রমুখকে। ফার্স্ট ইয়ারে শিক্ষক হিসেবে পেলাম শিল্পী ও শিল্পশিক্ষক রফিকুন নবীকে এবং শিল্পী মনিরুল ইসলামকে। ক্লাসরুমে দুদিকে দুই সারিতে ছাত্রছাত্রী বসত। যে-সারিতে মেয়েরা বেশি বসত হাসি প্রায়ই সেখানে বসত। ফলে তার সঙ্গে অনেক মেয়েরই সখ্য গড়ে ওঠে। আমরা আর্ট কলেজে ওই ব্যাচে ভর্তি হয়েছিলাম ৬৪ জন। তার অর্ধেকই মেয়ে। টিফিন আওয়ারে সিনিয়র ভাইয়েরা মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য আমাদের কাজ বোঝানোর ভান করতেন। তবে ওর নাম ‘হাসি চক্রবর্তী’ নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম প্রথম। সনাতন ধর্মাবলম্বী সিনিয়র ভাইদের অনেকে ওকে মেয়ে ভেবে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কারণ, অনেকদিন পর কলেজে একজন সনাতন ছাত্রী ভর্তি হয়েছে! তাকে দেখতে হবে, আলাপ করতে হবে। আলাপ হলো। বরিশালের ছেলেটির সঙ্গে। নাম তার হাসি চক্রবর্তী। এই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে হাসি নিজের নাম পরিবর্তন করেছিল, রেখেছিল ‘হাস্যচক্র’। বেশ কবছর তার এ-নাম তার অাঁকা ছবিতে স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহার করত। এখন মনে হয় এগুলো তো সবই সেদিনের কথা।

২৮ জুলাই বন্ধুবর হাসি চক্রবর্তীকে আমরা শেষ বিদায় দিলাম। এখন তাকে নিয়ে অনেক কিছু বলতে পারি, লিখতেও পারি। আমরা অনেকে হয়তো প্রসঙ্গক্রমে তাকে নিয়ে নানা কথা বলব। হয়তো বলাও শুরু করেছি এরই মধ্যে। হাসি চক্রবর্তীকে নিয়ে, তার শিল্পসম্ভার, তার শিল্পীসত্তা, বৈচিত্র্যময় জীবন, তার সৃজনক্ষমতা ও ভাবনা, তার সাংগঠনিক ভাবনা – সবকিছু সময়ের ওপরেই ছেড়ে দিতে হবে। একটি মানুষের মূল্যায়ন করা সহজ নয়, স্বল্প সময়ে উচিতও নয়। আমার পক্ষে শিল্পী হাসি চক্রবর্তীকে নিয়ে আলোচনা বা মূল্যায়ন কী করে সম্ভব। যাঁরা বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, যাঁদের লেখালেখিতে ক্ষুরধার বক্তব্য ফুটে ওঠে, যাঁরা নিয়ত সবকিছুকে বিশেষণে বিশেষায়িত করেন, তাঁরাই হয়তো এই দায়িত্ব নেবেন।

শিল্পী হাসি চক্রবর্তীকে দেখেছি সাদামাটা সাধারণজ্ঞানে। আমি দেখেছি শিক্ষাগুরু শিল্পী রশিদ চৌধুরীর হাত ধরে চট্টগ্রাম শহরে একটা সাধারণ অবস্থায় এবং প্রতিকূল পরিবেশে আর্ট কলেজকে কীভাবে উন্নীত করে সরকারি ডিগ্রি কলেজে রূপ দেওয়া হয়। দেখেছি কীভাবে অভিমানী হয়ে নানা দুঃখ-কষ্ট নিয়ে আর্ট কলেজ ত্যাগ করে সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজে চাকরি নেওয়া যায়। দেখেছি আর্ট কলেজে চরমতম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় কীভাবে পুনরায় আর্ট কলেজের দায়িত্ব নেওয়া যায়। এই সময়ে আমি হাসি চক্রবর্তীর পাশে থাকিনি। তাঁকে নৈতিক বা মানসিক কোনো সহায়তা করিনি। কর্মস্থল হিসেবে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। আর্ট কলেজকে ডিগ্রি কলেজে প্রতিষ্ঠা করা। কলেজের অশান্ত পরিবেশ হাসি চক্রবর্তী যেভাবে দক্ষতার সঙ্গে শান্ত করেছে, তা ইতিহাস হয়ে থাকারই মতো।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার কারণে সম্ভবত আমাদের ছাত্রজীবনের বন্ধুত্বে চির ধরতে শুরু করে। বেশ কয়েক বছর আমরা অভিমানী হয়ে উঠি। কিন্তু নানা গভীর সংকটে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটে – আমরা একে অন্যকে বুঝতে চেষ্টা করি।

ঢাকা আর্ট কলেজে আমরা ছিলাম পথচলার সঙ্গী। নানা সংকটে যেমন পাশে পেয়েছি, তেমনি তার নানা সংকটে অভিযাত্রী হিসেবে সঙ্গে থেকেছি। আমরা বন্ধু ছিলাম আত্মার প্রশান্তিতে খুব কাছাকাছি। আবার আমরা হিংসাপ্রবণ ছিলাম। আমরা অতি গোপনে একে অন্যকে নানাভাবে ছবি অাঁকার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতাম। কষ্টও পেতাম। কখনো কখনো মনোকষ্টে কেঁদে বালিশ ভেজাতাম। এ-বিষয়গুলো আমার ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটত। অাঁকাঅাঁকিতে আমি চন্দ্রশেখর, হাসি, আসেম আনসারীর চেয়ে দুর্বল ছিলাম। একটা ভালো কাজ হলে হাসি খুবই অহংকারী ভাব দেখাত। তখন আমি যে তার বন্ধু, সে-কথাটা বেমালুম ভুলে যেত। প্রায়ই একসঙ্গে স্টাডির জন্য আউটডোরে যেতাম – ছবি আঁকতে। চন্দ্রশেখর আমাদের মাঝে অসাধারণ মেধাসম্পন্ন। হাসি ও শেখর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাকে ছবি অাঁকার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। আমি ছাত্রজীবনের প্রথম দিকে ছবি অাঁকায় দুর্বল ছিলাম। অনেক সময় হাসি আমাকে বলত – ‘শেখ  শেখ, আমার কাছ থেকে শেখ।’ আমি খুব কষ্ট পেতাম। এসবের পরও হাসি রাতে ‘পরীর খানা’ (একটি বিশেষ দোকানে মিষ্টি খাওয়ানো, পরীবিবির ঝুপরিতে খানা) আমাকে বাদ দিয়ে খেত না বা কমলাপুর রেলস্টেশনে ফিগার স্টাডির জন্য না নিয়ে থাকতে পারত না। আবার কারণে-অকারণে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আমাকে খুন করার জন্য তাড়া করে সারা হোস্টেলে তোলপাড় করত সে। পরক্ষণেই গভীর রাতে জোর করে মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খাওয়াতে নিয়ে যেত। প্রতিপক্ষ না হলে এমন কেউ করে! প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এই মহৌষধই তাঁর সত্যিকারের অন্তরের যে অবস্থান ছিল না, তা আমি ছাড়া আর কে বুঝবে।

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাঙালিরা স্বাধীনতা চায়। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। দেশের আপামর জনগণ একজোট, একাত্মা। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, সত্তরের গণভোট, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কোনোটাতে ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ নেই। চন্দ্রশেখর নেই, হাসি চক্রবর্তী নেই, মনসুর উল করিম  নেই, সিরাজ উদ্দিন নেই, কলেজের অগণিত ছাত্রছাত্রী নেই। যেসব বরেণ্য শিল্পী দেশের হয়ে পোস্টার, ফেস্টুন, কার্টুন করেছেন, উত্তাল সময়ে আর্ট কলেজের হয়ে স্বাধীনতার ব্যানার নিয়ে রাজপথে নেমেছেন, সেখানেও তো হাসি, শেখর, সিরাজ, মনসুর হরিহর আত্মার মতো কখনো সম্মুখে, কখনো সঙ্গে থেকে বরেণ্য শিল্পীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হাতেগোনা যে-কজন তরুণ শিল্পী এদেশের শিল্পচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, হাসি চক্রবর্তী তাঁদের অন্যতম। দেশ, মাটি ও শেকড়ের সন্ধানে যাঁদের চিন্তা-ভাবনা, দেশ যাঁদের চিত্রশিল্পের অন্যতম বিষয় হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে, হাতেগোনা সেই কজন শিল্পীর কাতারে পেয়েছি আমার বন্ধু হাসি চক্রবর্তীকে। কী প্রগাঢ় বিশ্বাস নিয়ে হাসি কথা বলেছে এদেশের প্রকৃতির সঙ্গে। আমি মুগ্ধ হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি, গর্ববোধ করেছি জ্যোৎস্নাস্নাত আলোর মতো। হাসি চক্রবর্তী নেই, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য আর বিধৌত হবে না তার স্ত্রী ‘ছায়া দে’কে নিয়ে। খন্ড খন্ড রূপক দৃশ্য, খন্ড খন্ড আলোছায়া আর ছায়া দেখে নিয়ে নিবিড় কোনো মেলবন্ধ হবে না কোনো চিত্রভাষ্যে। আমি আর পাব না পাহাড়ের গলে পড়ার সঙ্গে হাসি চক্রবর্তীর আত্মীয়তা।

আর্ট কলেজের শেষের দিকে ছাত্রাবস্থায় আমরা অনেকেই বড়-বড় শিল্পী ছিলাম। কেউ ছিলাম পিকাসো, সেঁজা, কেউ মাতিস, কেউ ছিল দালি, আবার কেউ ছিল পল গঁগা। হাসির কম্পোজিশনের  চতুরতায় পল গঁগা ভর করেছিল। তাহিতি দ্বীপের আদিবাসী যেমন গঁগাকে দিয়েছিল চিত্র-নির্মাণের আদি স্বাদ, হাসি চক্রবর্তীও দিয়েছিল তেমনি পল গঁগার আদি স্বাদ। আর আমার ছিল পিকাসো, সেঁজা নির্ভরশীলতা। তখন কী যে স্বাদ পেতাম পশ্চিমা শিল্পের এসব চিত্রীকে অনুকরণ-অনুসরণ করে।

১৯৭৩ সালে ‘পেইন্টার্স গ্রুপ’ নামে ঢাকায় আমরা একটি শিল্পীদল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। হাসি চক্রবর্তী ছিল সে-দলের মূল উদ্যোক্তা। দলের অন্য সদস্যরা হলো – চন্দ্রশেখর দে, মনসুর উল করিম, বনিজুল হক, অলক নাথ, খাজা কাইয়ুম ও নজরুল ইসলাম। সে-সময়ে বিশ্বখ্যাত নন্দিত শিল্পী পাবলো পিকাসো না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। আমরা তাঁকে উদ্দেশ করে পেইন্টার্স গ্রুপের প্রদর্শনী উদ্বোধন করলাম। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন ঢাকা আর্ট কলেজের জয়নুল গ্যালারিতে।

সদ্য স্বাধীন দেশে বিশেষ করে শিল্পী পাবলো পিকাসো স্মরণে এ-প্রদর্শনী এক নবমাত্রা তৈরি করল। দেশের প্রায় সব পত্রিকায়  এ-প্রদর্শনীর প্রচার হলো। ভারতের দেশ পত্রিকায় শিল্পবিষয়ক নিবন্ধে এ-প্রদর্শনীর ভূয়সী প্রশংসা করা হলো। দেশের প্রখ্যাত শিল্পী রশিদ চৌধুরী প্রদর্শনীতে এলেন, দেখলেন, জাদুমন্ত্রের মতো আমাদের মুগ্ধ করলেন। আমরা তাঁর পিছু নিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণের জন্য। চট্টগ্রামে আগমন, অবস্থান, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের ফলে আমার, হাসি ও শেখরের আত্মিক সম্পর্ক আরো নিবিড় হলো। নতুন শহর, নতুন এলাকা, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাচ্যের রানী আমাদের বন্ধুত্বের বুনিয়াদ আরো শক্ত করল।

চট্টগ্রামে এসে নানা সস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ি। আবাসন সমস্যা, অর্থের সমস্যা, সবচেয়ে বড় – ছবি অাঁকার সমস্যা। আমরা পেলাম শিক্ষক রশিদ চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর, মিজানুর রহিম ও জিয়া হায়দারকে।

শিল্পী রশিদ চৌধুরী আবাসন সমস্যার সাময়িক সমাধান করলেন চট্টগ্রাম অলিয়ঁস ফ্রঁসেজের দোতলার একটি কক্ষে অস্থায়ী থাকার ব্যবস্থা করে। হাসি আর আমি বাসিন্দা হলাম সেখানে। অর্থসংস্থান হলে আমরা খাই চকবাজারের একটি হোটেলে, না হলে উপোস করি। কখনো একবেলা কখনো একাধিক। চন্দ্রশেখর জুবলি রোডের তিনপোলের মাথায় নিজ বাড়িতে থাকে। আমি ও হাসি মাঝে মাঝে যাই। মাসিমা খুবই আদর করতেন। না খেয়ে আসতে দিতেন না। শেখরের বড় বোন মায়া দেও নানাভাবে আর্থিক সহায়তা করেন আমাদের প্রয়োজনমতো। শেখরের বাড়িতে আমার যাওয়া হয় কম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করি। হাসি ও শেখরও করে, তবে তুলনায় কম। হাসি অসুস্থতার ভান করে বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে থেকে যায়। আমি বুঝি তার নতুন বান্ধবী হয়েছে। সে-কারণে টুকটাক অসুখ তো হবেই। বান্ধবীর সঙ্গে সখ্য যে নিবিড় হয়েছে, তা বুঝতে পেলাম যেদিন দেখলাম আমার আস্ত চিরুনির সবকটি খিল একটি একটি করে ভাঙা অবস্থায় বিছানার পাশে পড়ে আছে। আমার অনুমান সত্যি হলো। হাসি নির্দ্বিধায় স্বীকার করল, ছায়া দে-র সঙ্গে তার সখ্য হয়েছে। আমি তাদের দুজনের বন্ধুত্বকে স্বাগত জানালাম।

কোনো এক বিশেষ কারণে আমাদের আর অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে থাকা হলো না। আবারো শিল্পী রশিদ চৌধুরী এগিয়ে এলেন। আমার জায়গা হলো কলাভবনের একটি রুমে। দামপাড়া মহম্মদ আলী সড়কে। সঙ্গে হাসিও থাকল। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শিল্পী রশিদ চৌধুরীর স্বপ্ন সফল হয়েছে। বাংলাদেশে আরেকটি ছবি অাঁকার প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে রূপলাভ করেছে চট্টগ্রামে। এরই মধ্যে ছাত্রছাত্রী ভর্তিও শুরু হয়েছে সেখানে। কলেজের একটি জরাজীর্ণ পুরনো একতলা দালান। তিন-চারটি রুম। অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সবিহ উল আলম।

আমি বুঝতে পারি, আমাকে না বলে হাসি ও শেখর কোথায় যেন যায় গোপনে গোপনে। তারা কিছু একটা করছে এটা আমার অনুমান হয়। আমার অনুমান সঠিক হলো সেদিন, যেদিন এক সন্ধ্যায় আমাকে এসে বলল, তারা দুজনই শিক্ষক হিসেবে আর্ট কলেজে নিয়োগ পেয়েছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম। কষ্টও পেলাম। এ-কষ্টটা আমাকে ধাক্কা দিলো। আমি সিরিয়াস হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার প্রতি। আরো যত্নবান হলাম নিজের কাজের প্রতি।

কলাভবনে আমি আর হাসি থাকি। একই সঙ্গে একই বিছানায়। একই চুলায় রান্না করি। অর্থ সংকুলান হলে খাওয়া হয়, না হলে হয় না।

হাসি চক্রবর্তী আমাদের মাঝে নেই। তার তিরোধানে আমার বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করছি। কিন্তু আমি লেখক নই। তার সম্পর্কে কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হবো।               স্মৃতি-জাগানিয়া বিষয়গুলি লিখতে খুব কষ্ট হয়। তাছাড়া অকৃত্রিম বন্ধু সম্পর্কে লিখতে গেলে স্মৃতি পেয়ে বসে। আর আমার শব্দ, বাক্যচয়ন, বাক্য-গঠন তেমন করায়ত্ত নেই। নিয়মিত লেখকরা অনেক বিস্তারিত লিখতে পারেন। আমি সে দলের নই।

হাসির মৃত্যুসংবাদ প্রথম শুনলাম আমার সহকারী স্নেহভাজন জসিমউদ্দিনের কাছে। সে আমাকে ফোনে বলল, স্যার কেউ আপনাকে ফোন করেছে। আমি বললাম, কী ব্যাপারে? সে বলল, হাসি স্যার দুপুর আড়াইটায় মারা গেছেন। আপনি তৈরি হন, আমি আপনাকে তার বাসায় নিয়ে যাব। জসিমের ধারণা, সংবাদ শোনার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। আমি অবশ্য আগে থেকেই অসুস্থ ছিলাম। জসিম এসে আমাকে হাসির নন্দনকানন বাসায় নিয়ে গেল। আমি এতবেশি বিহবল হয়ে পড়েছিলাম যে, হাসিকে দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না সে নেই। সাধারণত আমি মৃত্যুসংবাদ সহ্য করতে পারি না। আর দীর্ঘদিনের বন্ধু হাসির মৃত্যু আমি কীভাবে সহ্য করি! মাত্র কয়েকদিন আগে আমি তাকে দেখেছিলাম তিনপুলের মাথায় হেঁটে যেতে। আমি ফিরছিলাম ইনস্টিটিউট থেকে। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হাসি ভালো আছিস? উত্তরে সে মাথা নেড়ে হাত উঁচিয়ে ইশারা করল, ভালো আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল হাসি হেঁটে যাচ্ছে অতি কষ্টে, পা দুটি টেনে টেনে। মনে হচ্ছিল, এমন করেই তো এক পা এক পা করে আমরা এগিয়েছি, হাঁটতে শিখেছি – বরিশালের হাসি চক্রবর্তী আর রাজবাড়ীর মনসুর উল করিম। ছবির জগতে আমরা অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হয়েছি। কোনো আড়ম্বর বা বাগ্ময়তা আমাদের মধ্যে কাজ করেনি।

সম্প্রতি হাসির সঙ্গে আমার দুবার দীর্ঘসময় কথা হয়। চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসেছিল আমার কাছে। বলেছিল তার অাঁকা ছবি দিয়ে একটি বেশ বড় বই প্রকাশ হবে। বন্ধু হিসেবে আমার একটা লেখা বা অনুভূতি যেন লিখে দিই। আমি লিখেছি। ফোনে তাকে বলেছিলাম, আমার লেখা শেষ। ছুটে এসেছিল আমার কক্ষে, এক কাপ কফিও খেয়েছিল আমার সঙ্গে। চেয়ারে বসে তৎক্ষণাৎ লেখাটি পড়েছিল সে। তারপর  কেঁদে ফেলেছিল অঝোরে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমি অনেকের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করেছি, সকলেই আমার ও আমার ছবির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। তুই শুধু আমাকে লিখেছিস, আমাকে চিনেছিস। আমি যা তা-ই বলেছিস। এত স্পষ্ট লেখা আমি আজো কারো কাছ থেকে পাইনি।

দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল আমার বাসায় দক্ষিণ নালাপাড়ায়। শিল্পী হাসি চক্রবর্তী গিয়েছিল তাঁর লেখা বইটি আমাকে দিতে। আমার বাসায় সে কিছুই মুখে দেয়নি। এমনকি পানিটুকুও না। বলেছিল, পানি খেলে প্রস্রাবের বেগ পাবে, বাসায় ফিরতে পারব না। রাস্তায় কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে। বলেছিল, দোস্ত তুই ভালো থাকিস। আমি বলেছি, হাসি আমি ভালো আছি। এতক্ষণ হাসিকে নিয়ে কলম চালাতে পারলাম, দুকথা লিখতে পারলাম। আমারও শরীর ভালো নেই। যদি সুস্থ থাকি তাহলে আরো লিখব, আমাদের অনেক অজানা কথা।

যে-কথাটা অনেকেই জানে না, এমনকি হাসির স্ত্রী ছায়াও জানে না। একবার আমাদের একজন শিক্ষক আমার কাছে এসে বললেন, ‘আজ তো ব্যাংক বন্ধ। জরুরিভিত্তিতে দুই হাজার টাকা প্রয়োজন। ঠান্ডু তুমি আমাকে দুই হাজার টাকা দাও।’ আমি হতবাক। কিছুই বলতে পারছিলাম না – টাকা দিতে পারব কী পারব না। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়েছিলাম। স্যার একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘গত পরশু তোমাদের তিনজনের প্রদর্শনীতে অনেক টাকার ছবি বিক্রি হলো। তোমারও তো অনেক হলো।’ আমি স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘স্যার আমি আর শেখর সব টাকা হাসিকে দিয়েছি। কারণ আমাদের প্রদর্শনী করার উদ্দেশ্যই ছিল বিক্রীত ছবির অর্থ হাসিকে দিয়ে দেওয়া। হাসির মা কলকাতা থেকে চিঠি লিখেছেন, হাসির বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। অনেক টাকা দরকার। চিঠি পড়ে হাসি তিনদিন শুধু কেঁদেছে। আমি আর শেখর অসহায়ের মতো তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি – যে-কোনোভাবে আমরা তিনজনে একটা প্রদর্শনী করব। স্যার, আপনারা ও ডা. কামাল এ খান আমাদের ছবি বিক্রিতে সহায়তা করেছেন। প্রকারান্তরে হাসিকে সহায়তা করেছেন। আমরা আপনাদের  কাছে কৃতজ্ঞ।’ স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে দুফোঁটা চোখের পানি ফেলে আস্তে আস্তে  সিঁড়ি দিয়ে নেমে সবুজ ঘাসের লন পার হয়ে মহম্মদ আলী সড়কে ইট-বিছানো রাস্তায় হেঁটে গেলেন। এটা ১৯৭৩ সালের কথা। কলাভবনে আমরা তিন বন্ধু প্রদর্শনী করেছিলাম।

২৮ জুলাই বিকেল ৩টায় আমি আমার বন্ধুর মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ। কেমন ছিলাম জানি না। ডা. চন্দন এসে আমাকে ধরে নিয়ে পাশের ঘরে বসিয়ে দিয়েছিল। বসে বসে ভাবছিলাম, হাসি কি আমার জীবনের হাসিটুকু নিয়ে গেল!