আমার বন্ধু হেলাল

লোকটি যে হেলাল, সে-বিষয়ে আমার মোটেই সন্দেহ ছিল না। কারণ পৃথিবীর আর কারো পক্ষেই এমন অভিনব কায়দায় বিড়ি টানা সম্ভব নয়। হেলাল আমার বন্ধু, আমার মন্দ স্বভাবের গুরু।

ময়মনসিংহে এসে হাওড়ের চাকার সঙ্গে যখন পথের সংঘর্ষ বন্ধ হলো রাত তখন প্রায় পৌনে ২টা। এই একটি জায়গায় এসে প্রতিবারই আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে ফুসফুসে ধোঁয়া নিতে না পারলে নির্ঘাত মরে যাবো। বগির অ্যাটেনডেন্স কামরুলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ট্রেন কত সময় দাঁড়াবে?’ কামরুল আমার এই প্রশ্নের সঙ্গে পরিচিত। মুচকি হেসে বলল, ‘টাইনা আহেন। আপনে ফিরা না আইলে ট্রেনের বাপের সাধ্যি নাই লড়ে।’ কামরুলের সঙ্গে আমার বিশেষ খাতির রয়েছে। তার একটি কারণ, আমি হাওড় এক্সপ্রেসের রেগুলার প্যাসেঞ্জার আর অন্যতম কারণ ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব বলতে হোমরাচোমরা গুরুগম্ভীর কেউ নই, কোনো এক মুখোপাধ্যয়ের সেই গল্পের মতো আর কি, থালার তলের টিপস। পয়সাই পার্সোনালিটি!

ময়মনসিংহ জংশনের মাথার ওপর যে ব্রিজ রয়েছে তার অবস্থান, রং, ঢংঢাং সবই লাস্যময়ী প্রেমিকার মতো। অসংখ্যবার তার ওপরে চড়েছি কিন্তু প্রতিবারই যেন নতুন। আজো দ্রুত তার শরীর বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। তৃতীয় ব্রিজের মধ্যভাগে আমার প্রিয় সিগারেট কর্নার, যেখানে কেউ লিখে রেখেছে, ‘মানুষ মানুষ হয়, ব্যবহারের গুণে।’ আমি বরাবরের মতো লেখাটির গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াই। ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে বাতাস আড়াল করে হাতের মুঠোয় লাইটার জ্বালানোর চেষ্টা করছি। হলে কী হবে? চৈত্র দিনের তোড়ের বাতাস। বারবার নিভে যাচ্ছে। উল্টো পাশের রেলিংয়ের ওপর দুই হাত ছড়িয়ে একজন লোক বিড়ি ফুঁকছে। আমাদের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। আমি আওয়াজ দিলাম, ‘ভাই ম্যাচ হবে?’ লোকটি সম্ভবত জাগতিক সবকিছু থেকে বিচ্যুত। মনে হলো না আমার কথা তার কানে ঢুকেছে। বহুত কসরত শেষে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে সমর্থ হলাম। হেলালের ভাবনা তখনো আমার মাথায় আসেনি।

নিশুতি রাত।  বিশাল অজগরের মতো হাওড় আঁকাবাঁকা হয়ে লাইনের বুকে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘড়ঘড় আওয়াজে মুমূর্ষু রোগীর শ্বাস অথবা শৃঙ্গার। এই রাতেও প্ল্যাটফর্মের বেশ কয়েকটা চায়ের দোকান খোলা। দু-একজন যাত্রী সেখানে ভিড় জমিয়েছে। সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমি লোকটির দিকে আরেক নজর তাকাই। উচ্চতায় আমার থেকে আধা হাত বেশি হবে। মাঝারি গড়নের পেটা শরীর। দাঁড়ি-মোচে মুখের পুরোটাই প্রায় ঢাকা। আমি আমার মোবাইলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। আমার বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে বেনসন লাইট ধীরে ধীরে পুড়ছে। আচমকা এক ঝলকের জন্য মনে হলো, লোকটিকে আমি চিনি।

স্টেশনের নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্রিজে বেশ ঝলমলে আলো। মানুষ চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আবার যেহেতু একই ট্রেনের যাত্রী, একই গন্তব্য হতে পারে, চেনা মানুষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হেলালকে চিনলাম আমি অন্য আরেকটি কারণে। সেটি ওর বিড়ি টানার অনন্যসাধারণ স্টাইল। মূলত ওর ধূমপানের স্টাইল দেখেই আমি বিড়ির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। হেলাল ছিল বিড়িখোরদের মধ্যে আমার আইডল। এমন স্মার্টভাবে এতোটা আয়েশ করে কখনো কাউকে ধূমপান করতে দেখিনি আমি। হেলালের ভাষ্যমতে, বিড়ি টানার সময়টুকুতেই শুধু পৃথিবী শান্তির আর সুন্দর। বাকি সময়  একটা অশ্লীল আর নোংরাতম জায়গা দুনিয়া। যদিও এই দুনিয়ার বাইরে আর কোনো সুন্দর বা নোংরা জগৎ আছে কি না জানা নেই।

হেলালের দু-হাত রেলিংয়ের দুপাশে ছড়িয়ে আছে। ওর দুই ঠোঁটের ফাঁকে সরু চিকন একটা বিড়ি নিভৃতে পুড়ছে। ওর চোখ বন্ধ, মুখ ঊর্ধ্বমুখী। ঠোঁটে ঝুলন্ত বিড়ির এক মাথা অনির্দিষ্ট সময় পরপর জ্বলছে, নিভছে। অল্পস্বল্প ছাই ওর ঠোঁটের চারপাশে আলগোছে ভেঙে পড়ছে। আমি হেলালের বিড়ি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় চুপ করে আছি। স্বভাবতই ও ঠোঁটে বিড়ি দেওয়ার পর কখনো হাত দিয়ে সেটি স্পর্শ করে না। বিড়ি শেষ হয়ে এলে হেলাল সেটি ফুঁ করে ছুড়ে ফেলে। আজো তাই করলো। বিড়ির শেষ অংশ ছুটে ব্রিজের ছাদে লেগে প্রায় নিঃশব্দে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আমি ঝুঁকে সেটি তুলে নিয়ে নাম পড়লাম। যা ভেবেছিলাম তাই, ‘ইন্তাজ বিড়ি’। এই বিড়ি ও এখনো খায়?

হেলাল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও চুপ করে থাকি। দেখি আমাকে চিনতে পারে কি না। পনেরো বছর খুব অল্প সময় নয়। কিন্তু না আমার মুখের ওপর থেকে ওর দৃষ্টি অন্যত্র সরে গেছে। কিছুটা উদাস বিক্ষিপ্ত। আমি এক পা এগিয়ে ওর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি,

‘হেলাল?’

দাড়ি-গোঁফের ঝোপের মধ্যে ওর চোখ চট করে জ্বলে ওঠে। পরক্ষণে বেশ রূঢ়ভাবে জবাব দেয়, ‘ইয়েস। তো?’

আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। খানিকটা লজ্জাও লাগে হয়তো বা। কিন্তু যেহেতু ওর সম্পর্কে আমি আগে থেকেই জানি তাই সবকিছু ঝেড়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলি,

‘তো মানে? আমাকে চিনতে পারিসনি?’

‘না পারিনি। পৃথিবীর সব মানুষকে কি আমার চেনার কথা?’

‘পৃথিবীর সব মানুষকে চেনার কথা নয়, কিন্তু আয়ানকে চিনবি না?’

‘ওহ, তুই আয়ান? সরি দোস্ত চিনতে পারিনি। কেমন আছিস, ভালো? আচ্ছা ট্রেন মনে হয় ছেড়ে দেবে। যাই, পরে কথা হবে।’

হেলাল দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাচ্ছে। আমি স্ট্যাচুর মতো কিছু সময় হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ওর চরিত্র বরাবরই আলাদা, রহস্যময়। আর দশজন মানুষের সঙ্গে ওকে মেলানো যাবে না। তাই বলে পনেরো বছর পর প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে এই বিহেভ করবে? ট্রেন হুইসেল দিয়ে দিয়েছে। আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পড়িমরি করে ছুটে গেলাম। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে গালি বেরিয়ে আসে, ‘শালা বন্ধু মারাইছে। আরেকটু হইলেই ট্রেন হাতছাড়া হয়ে যেতো। তারপর রাত দুটো থেকে সকাল পর্যন্ত ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকো।’ 

আমার সিট এক্সট্রা থ্রি বগিতে। হেলাল কোন বগিতে কে জানে! যাকগে, যেখানে পারে থাকুক। নিজেকে যে লুকিয়ে রাখতে চায় তাকে টেনে বের করার দরকারই বা কি? আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। ঠাকরোকোনা জংশনে পৌঁছাতে এখনো ঘণ্টা-দুই দেরি। তার পরের স্টেশন আমার গন্তব্য। কিন্তু ঘুম তো আসে না। ভাবছি, হেলালের এই আচরণের কারণ কী? মধ্যরাত কেটে কেটে ট্রেন বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু মনের মধ্যে অস্বস্তির চোরাকাঁটা খচখচ করে বিঁধতে থাকে।

সানরাইজ প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড হাইস্কুলে ক্লাস ফোরে যেদিন হেলাল প্রথম ভর্তি হয় সেদিন থেকেই আমরা সকলে জেনে গিয়েছিলাম ও গরিব পরিবারের সন্তান। গণিত ক্লাসে মৃণাল স্যারের ক্লাস চলছিল তখন। মৃণাল স্যার খুবই রাগী। অংক না পারলে পিঠে আস্ত বেত ভাঙতে দ্বিধা করেন না। তিনি বোর্ডে অংক বুঝিয়ে দিচ্ছেন আর আমরা হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে আছি, যদিও মাথায় অংক মোটেই নেই। এমন সময় হেডস্যার আমাদের থেকে প্রায় এক বিঘত লম্বা ঢ্যাঙামতো একটি ছেলেকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। আমরা ক্লাসের সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সুর করে টেনে টেনে বললাম, ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’ এমনটিই আমাদের শেখানো হয়েছিল। স্যার সালামের জবাব না দিয়ে হাত ইশারায় আমাদের বসতে বললে আমরা ঝুপ করে বসে পড়লাম। সবার নজর ছেলেটির দিকে। শুকনো লিকলিকে ছেলেটির পোশাক-আশাকে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। হাফ প্যান্টের ভেতর থেকে দুইখানা পা বকের ঠ্যাঙের মতো বেরিয়ে আছে।

মাথায় সজারুর কাঁটার মতো খাড়া খাড়া চুল।

হেডস্যার মৃণাল স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মৃণাল বাবু, এই ছেলেটি আজ ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছে।’

মৃণাল স্যার একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘ক্লাস ফোরে? কিন্তু এতো বড় ছেলে …’

স্যার সম্ভবত ওর উচ্চতা বিবেচনা করে কিছু বলতে চেয়েছিলেন; কিন্তু হেডস্যার থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে গরিব মানুষের বাচ্চারা কি আর ছোটবেলা থেকে পড়তে পারে? ওই যে চাওয়ালা ল্যাংড়া শহিদুল আছে না, ওর ভাগনে। বাপ ভ্যাগাবন্ড। আরেকটা বিয়ে করেছে। এখন এরা মামার ঘাড়ের বোঝা। ওর মামা স্কুলে চায়ের জোগান দেয়। ফ্রিতে পড়াতে হবে আর কী।’

ওকে রেখে হেডস্যার বেরিয়ে গেলে মৃণাল স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম তোমার?’

ছেলেটি উদাস হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। সেদিকে চোখ রেখে নিস্পৃহভাবে বলল, ‘হেলালউদ্দিন মোহাম্মদ জহির।’

‘ওরে বাপরে! নামের তো বাহার ভালো, হা-হা-হা।’ স্যারের হাসির সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসসুদ্ধ হি-হি করে হেসে উঠলো। স্যার ওকে রবিনের পাশে নিয়ে বসালেন। রবিন খানিকটা সরে চাপা স্বরে বলে ওঠে, ‘ইস্! হালার শইলে কিয়ের জানি গন্ধ। ইয়াক্!’

শুধু রবিন নয়, আমাদের সবারই মনে হতে লাগলো, ওর গায়ে গন্ধ।

আমাদের ওই স্কুলটিই ছিল উপজেলার মধ্যে সব থেকে নামি এবং দামি। এই স্কুলে দরিদ্র পরিবারের তেমন কেউ পড়তো না। সরকারি প্রাইমারি স্কুল বাদ দিয়ে হেলালের মামা কেন এই স্কুলে ওকে ভর্তি করিয়েছিলেন আমি আজো বুঝতে পারি না। হয়তোবা ফ্রিতে ভালো স্কুলে পড়নোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। যাই হোক, একই ক্লাসে পড়লেও আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন কোনো হৃদ্যতা তৈরি হয়নি। এর মূল কারণ ছিল ডিসক্রিমিনেশন। প্রকৃতিগতভাবে অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই হয়তো ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার ফারাক শিশুদের মনোজগতে ঢুকে পড়ে। আমার বাবা ভালো ব্যবসায়ী, যথেষ্ট টাকা-পয়সার মালিক। পোশাক-আশাক, আচারে আমার মধ্যে সচ্ছলতার প্রমাণ প্রকট ছিল এবং সে-বিষয়ে শিশুবেলা থেকেই আমি যথেষ্ট সচেতন। সেটি নিশ্চয় এমনিতে তৈরি হয়নি। আমার পরিবার, শিক্ষালয় অথবা পরিবেশ থেকে হয়েছে। পক্ষান্তরে হেলালের পুরো অবয়ব জুড়ে ছিল দারিদ্র্য। বিশেষ করে প্রথমদিন থেকেই আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওর বাবা ভালো নয়, ওরা উদ্বাস্তু, ওরা গরিব, ল্যাংড়া মামার ঘাড়ের বোঝা।

তবে হেলাল এসবের থোড়াই কেয়ার করে। ও কারো সঙ্গেই খুব একটা মিশত না, বরং একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করতো। প্রায়ই স্কুল কামাই করতো। পড়ালেখাও তথৈবচ। শিক্ষকদের বেদম মার খেয়েও নির্বিকার। সপাং সপাং করে বেত ওর শরীরে নেমে এলে আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে যেতাম; কিন্তু ও ঘাড় গুঁজে প্রতিটা বাড়ি হজম করতো। ওর মুখের একটা পেশির পরিবর্তনও কখনো আমার চোখে পড়েনি। মৃণাল স্যার এই আচরণকে জিদ মনে করে একদিন জোড়া বেত ওর পিঠে ভেঙেছিলেন। স্যার হাঁপিয়ে উঠলেন। আমরা ভয়ে ছটফট করছি; কিন্তু হেলাল যথারীতি মূর্তি। স্যার ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘ভগবান তোকে কী দিয়ে বানিয়েছেরে?’

বেশ নাটকীয়ভাবেই হেলালের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। ক্লাস এইটে ওঠার পর আমাদের ক্লাসের কয়েকজনকে নিয়ে তখন বৃত্তির বিশেষ কোচিং ক্লাস চলছে। বাড়ি ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। একদিন সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছি, পেছনে রবিন। বড় রাস্তা থেকে আমাদের বাড়ির রাস্তার বাঁক যেখানে সেখানেই নবার চায়ের দোকান। আমি দ্রুতগতিতে মোড় ঘুরতে যাবো তখন রবিন ফিসফিস করে বলে, ‘আয়ান থাম থাম, দেখ আমাদের নবাব স্যার হেলালউদ্দীন মোহাম্মদ জহির উল্টাইয়া হুইতা আছে।’ ওর কথার চমৎকারিত্বে আমি হো-হো করে হেসে থেমে গেলাম। সত্যি তো, উল্টো পাশের রাস্তায় পেতে রাখা বেঞ্চে টানটান হয়ে শুয়ে আছে হেলাল। ওর দু-হাত দুদিকে টাইটানিক পোজে ছড়ানো। মুখে জ্বলন্ত বিড়ি। বিড়ি থেকে ক্রমাগত ধোঁয়ার উদ্গিরণ হচ্ছে। ওর কাছে গিয়ে আমরা দুজনেই হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকি। হেলাল কিছু সময় ফুকফুক করে বিড়ি টেনে অবশিষ্ট অংশ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। ওর চোখ বন্ধ। হেলালের মুখাবয়ব দেখে মনে হচ্ছে, ও আর ইহজগতে নেই। তাই আমাদের উপস্থিতি টের পায়নি। আমরাও বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে না পেয়ে সাইকেলে চড়ে গন্তব্যে রওনা দিলাম। রবিন বলে উঠলো, ‘শালা একটা মাল মাইরি!’

সেই কিশোর বয়সে যেখানে আমরা বাবা-মায়ের কঠিন অভিভাবকত্বে শিশুদের মতো দিনযাপন করছি সেখানে এই দৃশ্য ছিল অবিশ্বাস্য। উফ্! কী সাহস! এই ঘটনা আমার এবং আরো কারো কারো দৃষ্টিতে হেলালকে হিরো বানিয়ে দিয়েছিল। এর মাসখানেকের মাথায় অনেকেই আমাকে হেলালের সঙ্গে এখানে-সেখানে আবিষ্কার করতে থাকে। এমনকি বিড়ি হাতেও। ধীরে ধীরে আমি আর হেলাল হয়ে উঠেছিলাম হরিহর আত্মা। প্রতিবন্ধকতা তো ছিলই। বাবা-মা, কাকা সকলে যেন একনাগাড়ে কানের কাছে কোরাস গাইতে শুরু করলো, হেলাল গরিব, হেলাল বখাটে, ওর বাবার দুই বিয়ে, খবরদার, ওর সঙ্গে মিশতে দেখলে ঠ্যাং কিন্তু ভেঙে দেবো।

কিন্তু যে যাই বলুক, হেলালের সম্মোহনী শক্তি আমাকে চুম্বকের মতো ওর দিকে টেনে নিয়ে যেত। ও সারাদিন এখানে-সেখানে টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুলতি দিয়ে জঙ্গলে একা একা পাখি শিকার করছে, ঘাটে বেঁধে রাখা নৌকা নিয়ে বহুদূর চলে যাচ্ছে, এসব অহম, সাহস হেলালকে আমার কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। অবশ্য ওর মধ্যকার বিষণ্নতার খোঁজও আমি ক্রমে পেয়ে গিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যেই ও আনমনা আর বিষণ্ন হয়ে উঠতো। মুখটা অসুখী ছায়ায় কালচে বরন ধারণ করতো।

অবশ্য সচেতন অবস্থায় কখনোই হেলাল আমাকে ওর মনের গভীরে পুষে রাখা যন্ত্রণা, কষ্ট বা ক্ষোভের কথা বলেনি। বরং অন্যমনস্কভাবে এমনসব কথা বলে ফেলতো যেটি স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ কখনো বলে না। যেমন মাটিতে আঁক কষতে কষতে হয়তো একদিন বলে ওঠে, ‘আজ মামি আবিদাকে বেদম মেরেছে। কেন জানিস?’

আমার জবাবের অপেক্ষা ও কখনো করে না। যেন নিজেকে নিজেই শোনাচ্ছে এমনভাবে বলে যায়। ‘মামির পাতিল থেকে ভাত চুরি করে খেয়েছে আবিদা। আমাদের ঘরে তো দুপুরে রান্না হয় না। রাতের রান্না করা বাসি ভাত সকালেই শেষ হয়ে যায়।’

আবিদা ওর ছোট বোন। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওর মুখ তখন নিচু। মাটিতে আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত।

অন্য আরেকদিন গুলতি নিয়ে পাখির দিকে তাক করে আছে হেলাল। দৃষ্টি সজনে গাছের মগডালে। যেখানে একটা ঘুঘু পাখি বসে আছে। আমিও সেদিকে আমার গুলতির লক্ষ্য স্থির করে রেখেছি। হেলাল বলে ওঠে, ‘শালার বাপ নাকি কখনো খারাপ হয় না। আমার বাপে তো বড় চুদির ভাই।’

খুব অবাক হয়েছিলাম। বেশ ধমকের সঙ্গে বলি, ‘ছি! নিজের বাবা সম্পর্কে এসব কী বলছিস?’

প্রচণ্ড রেগে যায় হেলাল। চট করে গুলতিটা আমার দিকে ফিরিয়ে ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘নিজের বাপ? তোর বাপে তোর মাকে মেরে ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে? তোর খালাকে বিয়ে করেছে? বাপেরাও যে হারামি হয় সেটা তুই বুঝবি কীভাবে?’

হনহন করে হেঁটে চলে যায় হেলাল। আমি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। ওর মায়ের এক পায়ে সমস্যা আছে, আমি জানি। সে তো ওর মামারও রয়েছে। সবাই ডাকে ল্যাংড়া শহিদুল। ওর মা এক পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কিন্তু সেটা ওর বাবার কারণে?

ঠাকরোকোণা স্টেশন ছাড়ার পর কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মৃদু শোরগোল হাঁটাচলায় জেগে দেখলাম ট্রেন বারহাট্টার আউটারে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘুমঘুম চোখে টলোমলো পায়ে নামলাম। আগেপিছে আরো কয়েকজন নামলো। আমাদের রেখে হাওড় এক্সপ্রেস হুইসেল বাজিয়ে হেলেদুলে তার শেষ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল। প্রায় ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম। একে একে সব যাত্রী বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতের নিঃসঙ্গতা আরো বেড়ে গেল। সঙ্গে বেশকিছু টাকা আছে। এই সময়ে একা রিকশা করে বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না।

ভাবছি কী করা যায়! গরম ছাপিয়ে হিমহিম হাওয়া বইছে। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। বারহাট্টা স্টেশন ছোট, ছিমছাম। পিলারের সঙ্গে বসার চমৎকার বাঁধাই করা বেদিতে অনায়াসে শুয়ে থাকতে পারি বা একটু সামনে পুকুরধারের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা যেতে পারে। ঘুমের চেয়ে হাঁটাটাই শ্রেয় মনে হলো। ঘুমুলে টাকাসমেত ব্যাগটাই হাপিস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নব্বই ভাগ। পুকুরের দিকে এগোচ্ছিলাম। কোথা থেকে হুট করে হেলাল সামনে এসে হাজির। কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘চল দোস্ত কোথাও বসি। তোর সঙ্গে কথা আছে।’ ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় নেশা করেছে। আমি একটু ইতস্তত করছিলাম কিন্তু ও আবার তাগাদা দেয়। ‘কিরে দাঁড়ালি কেন? ওদিকে চল।’

‘তুই নেশা করেছিস?’

‘আরে ধ্যাৎ নেশা বলে নাকি? এই একটু …। নিবি নাকি? আগে তো বস ছিলি।’

‘না, নেবো না। সব ছেড়ে দিয়েছি। তুই এখনো এসব গিলছিস?’

‘হে-হে-হে তুই তাইলে ভদ্দরনোক হয়ে গেছিস বল? আরে আমি তো আজীবন মাতারির পোলা। আমার আবার অভ্যাস। চল চল …’

পুকুরের পাশ দিয়ে চওড়া ঢালাইয়ের রাস্তা। রাস্তার পাশের গাছগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। বাতাসে পাতায় পাতায় বাড়ি খেয়ে এক ধরনের বাজনার মতো শোনা যাচ্ছে। আমি আর হেলাল পাশাপাশি হাঁটছি। বহুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলছি না। আমি বুঝতে চেষ্টা করছি আসলে ও কী বলতে চায়। ও হয়তো এমনকিছু ভেবে চুপ করে আছে। একসময় হেলালই নীরবতা ভাঙে।

‘শোন বন্ধু আমি সরি, খুব সরি, আমারে তুই মাফ করে দে।’

হাঁটা থামিয়ে আচমকা আমার হাত ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে থাকে হেলাল। আমি ভয় পেয়ে যাই।

‘আরে কী করছিস? লাগছে। হাত ছাড়। মাফ চাইছিস কেন?’

‘ওই যে তখন তোকে চিনতে পারলাম না। তুই আমার এতো কাছের ইয়ার। কলিজার কলিজা। ছোটবেলা কত খাইয়েছিস। কত সাইকেলে চড়িয়েছিস। বাপের টাকায় সিনেমা দেখিয়েছিস। মাফ করে দে বন্ধু।’

নেশার প্রভাবে হেলাল প্রগলভ হয়ে উঠেছে। ওকে শান্ত করতে না পারলে কী ঘটাবে ঠিক নেই। আমি পিঠে হাত বুলিয়ে বলি,

‘আরে কী বলছিস এসব? আমি কিছু মনে করিনি। বাদ দে।’

হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন থেকে বেশ সামনে চলে এসেছি আমরা। রেললাইনের পাশে পরপর অনেক সোনালু গাছ। কে লাগিয়েছে কে জানে? অথবা সরকার লাগাতে পারে। রাস্তায় সোনালু ফুলের হলুদাভ বিছানা। রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আবছা আলোর আভাস সে-কথাই বলছে। 

ঝরেপড়া ফুলের ওপরেই আমরা সেসব দিনের মতো ল্যাটা মেরে বসে পড়লাম। বেশ অনেক সময় ধরে মাথা নিচু করে ঝিম মেরে থাকে হেলাল। আমি আমাদের কৈশোরের দিনগুলোর কথা ভাবছি। জীবনের বেশিরভাগ মন্দ কাজের শুরু আমি হেলালের সঙ্গেই করেছি। সে বিড়ি খাওয়া হোক, হলে প্রথম সিনেমা দেখা বা লুকিয়ে নীলছবি দেখা হোক। উপজেলার একমাত্র হল জোনাকিতে নতুন সিনেমা এলেই হেলাল আমাকে খবর দিত। বাড়িতে প্রাইভেট পড়ার কথা বলে আমি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। হেলাল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি এলে সাইকেল চালানোর দায়িত্ব ছিল ওর। আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে ও বেশি খাতির রাখতো সাইকেল চালানোর নেশায়।

আমার প্রথম অ্যাডাল্ট ফিল্ম দেখার অভিজ্ঞতাও ছিল চমকপ্রদ। একদিন হেলাল আমাকে বলল, ‘রাত এগারোটার দিকে একবার বের হতে পারবি? দারুণ জিনিস দেখাবো।’ আমি ঝেড়ে না করলাম, ‘অসম্ভব, বাবা টের পেলে কচুকাটা করবে। রাতে তো আর টিউশনি নেই।’ ও বলল, ‘আরে ধুর, তোরে দিয়ে কিছু হবে না। বাজারে বুলু আসছে, চল যাই। হেব্বি চিজ!’ ব্লু ফিল্মকে বড়রা সংকেতে বুলু বলতো – এই বিষয়ে হেলাল আগেই আমাকে কিঞ্চিৎ জ্ঞান দিয়েছিল। বুলু দেখার উত্তেজনায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। এগারোটা মানে গ্রামে গভীরতম রাত। বাড়ি থেকে বাজারে  হেঁটে যেতে দশ মিনিট লাগে। বাজারের সব দোকান বন্ধ। কোথাও লোকজন নেই। কেমন ভয়ভয় লাগছে। ফিসফিস করে বললাম, ‘হেলালরে চল ফিরে যাই, আমার ভয় করছে।’

‘আরে চুপ কর বাল। এগো।’ ও আমাকে শাসায়।

হিরু ইলেকট্রনিক্সের দোকানের সামনে এসে হেলাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে। দোকানের শাটার বন্ধ। কিন্তু একটু খেয়াল করতেই মনে হলো বন্ধ দোকানের ভেতরে মানুষ রয়েছে। হেলাল বিড়ালের মতো ধীর পায়ে এগোচ্ছে আমাকেও এগোতে বলে। শাটারে বেশ বড় বড় কয়েকটা ছিদ্র তার একটাতে ও চোখ রাখে। ওর দেখাদেখি আমিও আরেকটা ছিদ্রে চোখ রেখে দৃষ্টি ভেতরে চালান করে দিই। প্রথমে আলোর নাচ ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনি, পরে যখন চোখে আলো সয়ে এলো আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নারী-পুরুষের সঙ্গম সংক্রান্ত বিষয়ে তখনো আমি মোটামুটি অজ্ঞ। বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে আবছা কিছু ধারণা ছিল। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখছি! ছি! কী ভীষণ অশ্লীল! টিভির সামনে আমাদের পরিচিত কয়েকজন বড়ভাই গাদাগাদি করে দেখছে। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার আমার কাকাও আছে।  কাকাকে দেখে আমার কান ভোঁ-ভোঁ করতে লাগলো। যে-কোনো সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো। আমি ছিটকে এসে সোজা বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কখনোই ওমুখো হবো না। কিন্তু নিষিদ্ধের নেশা কি এতো সহজে কাটে? দ্রুতই আমি হেলালের সঙ্গে সেখানে নিয়মিত যাওয়া রপ্ত করে ফেলেছিলাম। কাকা কখনো বুঝতেই পারেনি শাটারের ওপাশে তার ভাতিজাও তার মতো একই অপকর্ম করছে। আর তখন থেকে আমার হস্তমৈথুনের অভ্যাসটা তৈরি হয়।

‘আয়ান আমার স্কুলের প্রথম দিনের কথা মনে আছে তোর?’

হেলালের কণ্ঠে কোনো জড়তা নেই এখন। সম্ভবত নেশা কেটে যাচ্ছে। ওর প্রশ্ন শুনে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই, ‘বলি, আছে তো, কেন?’

‘হেডস্যার ক্লাসে তোদের সকলের সামনে আমাকে গরিবের বাচ্চা বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে?’

হেলাল একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে বলি, ‘হুম। আমাদেরকে নয়, মৃণাল স্যারকে।’

‘শালার মাস্টার চুদাইছে। কেউ প্রথম দিন এভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়? শালার গরিবের বাচ্চা? থু!’

ওর লাল টকটকে চোখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরুচ্ছে। আমার ভয় ভয় লাগাটা বাড়ছে। বড়লোকের ওপর হেলালের ক্ষোভ বরাবরই। বড়লোক শুধু নয়, পৃথিবীর সব মানুষের ওপরেই যেন ওর চরম ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ আজ আমার ওপর ঝেড়ে না দেয়!

‘তারপর থেকে আর কোনোদিন আমি তোদের কারো চোখে মানুষ হতে পারলাম না রে আয়ান, গরিবই রয়ে গেলাম। মাতারির পুত।’

খুব শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে হেলাল। ওর চোখে আগের সেই হলকার লেশমাত্র নেই! আমি কিছুটা স্বস্তিবোধ করতে থাকি। খুবই নরম আর প্রশ্রয়ের সুরে বলে, ‘আচ্ছা বাদ দে বন্ধু! কবেকার সেসব কথা অতীতের গর্ভে চলে গেছে। মনে রেখে আর কি হবে বল!’

‘হুম বাদ তো দিয়েছিই। বাদ না দিয়ে উপায়ও তো নেই।’

হেলাল মুখ নিচু করে থাকে। আশেপাশে কোথাও হাস্নাহেনা ফুলের গাছ আছে। বাতাসে তার তীব্র ঘ্রাণ। আমি চুপচাপ সেই ঘ্রাণ উপভোগ করতে থাকি। হয়তোবা হেলালও। এরপর ধীরে ধীরে বলি, ‘আজকাল কী করছিস? সেই যে এসএসসির পর সিলেট চলে গেলি আর দেখাই হলো না।’

হেলাল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে, ‘আরেকদিনের কথা মনে আছে? তোর টাকায় চা খেতাম বলে বাদল কী বলেছিল?’

‘আরে এতোদিন পর এসব কথা কেন? তুই আমার বন্ধু, আমি তোর বন্ধু ছিলাম। তারা কে কী বলত সেসব কথায় কী জন্য কান দিতে হবে?’

‘হা-হা-হা-হা, বন্ধু? আমি তোর বন্ধু ছিলাম নাকি? কী জানি! তোর চাচা তো বলতেন ফকিরনির পুত।’

আমার মুখে কোনো জবাব আসছে না। ও যা বলছে সবই সত্যি, কিন্তু কারো কথা কেউ আটকে তো রাখতে পারে না।

‘উফ বন্ধ কর এসব। চাচা বললেও আমি কখনো তার কথা শুনেছি?’

জবাবে হেলাল চুপ করে থাকে। ওর ঝুঁকেপড়া মুখটাতে কোনো অভিব্যক্তি নেই। দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বলি না আমরা। রেললাইনের ওপাশে সারি সারি কলাগাছ। বাতাসে শনশন আওয়াজ কেবল এপারে ভেসে আসছে। একটু একটু দিনের আলোও ফুটতে শুরু করেছে। বহুক্ষণ ধরে আমি একটা বিষয়ে আলাপ ওঠাতে চাচ্ছি কিন্তু ওর ভাবভঙ্গি দেখে সাহস হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির পথ ধরতে হবে। আমি ইতস্তত করে বলেই ফেলি, ‘খালাম্মা কেমন আছে রে?’

যা ভেবেছিলাম তাই। তীব্র দৃষ্টিতে যেন আমাকে ভস্ম করে ফেলবে। এক খাবলা থুতু ফেলে বিস্বাদ মুখে দূরে চেয়ে বলে, ‘কতবার তোকে এই নামটি উচ্চারণ করতে নিষেধ করেছি?’

আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে কাউনাই নদী। মাঝেমধ্যে আমি আর হেলাল সেখানে গোসল করতে যেতাম। তেমন একদিন আমরাসহ অনেকেই নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করছি। নদীর পাশ দিয়ে সরু একটা রাস্তা চলে গেছে। ডুবডুব খেলার মধ্যে আমরা শুনতে পেলাম মাইকিং হচ্ছে। শোক সংবাদ। সোহেল মারা গেছে। সোহেলকে আমরা সবাই চিনি। সকলেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। বালকেরা দুঃখ প্রকাশ হয়তো করতে পারে না; কিন্তু এক বালকের মৃত্যুতে অন্যদের বুকে নিভৃতে ক্ষত তৈরি হয়, সেটা বুঝি।  সোহেলের ক্যান্সার হয়েছিল। গরিব বাবা-মা, চিকিৎসা করার সামর্থ্য ছিল না। আমরা স্কুল থেকে চাঁদা তুলে দিয়েছিলাম। আরো অনেকে অনেকভাবে সাহায্য করেছিল; কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমি আনমনে বলি, ‘আহা, সোহেলটা মারা গেল!’

খেয়াল করলাম হেলাল দূরের আজুইরার দিকে তাকিয়ে আছে। গ্রামে একটা কুসংস্কার আছে ভুল করেও আজুইরার মধ্যে যে যায়, নদী তাকে টেনে নেয়। আর কেউ কোনোদিন তার খোঁজ পায় না। যদিও বাস্তবে এখানে লোক হারিয়ে যাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। হেলালের মুখ পাংশু, রক্তহীন। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কী হয়েছে রে হেলাল? ওদিকে কী দেখিস? কেউ ডুবলো নাকি?’

হেলাল আনমনে বলে, ‘রাতে যে লোকটা আমাদের ঘরে আসতো সে আসলে আমার বাবা ছিল না।’

আমি ওর কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি না। ‘কী বলছিস? বাবা না মানে কী? তাহলে কে?’

‘সোহেলের মায়ের কাছেও কি রাতে কেউ আসত রে আয়ান? আমি শুনেছি ওর মা আমার মায়ের মতো খানকি।’

‘ছি! কিসব আবোলতাবোল বলছিস?’

‘শোন। আমি তখন ছোট। আবিদা আরো ছোট। বাবা তার চাচাতো শালিকে  বিয়ে করে জামালপুরে থাকে। সেখান থেকে পনেরো দিন, মাস অন্তর বাড়ি আসতো। কিন্তু আমি দেখেছি বাবা অন্যদিনও আসতো। অথচ সকালে তাকে খুঁজে পেতাম না।’

‘মানে কী? খুঁজে পেতিস না কেন? ভোরে হয়তো তোর বাবা ফিরে যেতেন।’’

‘উঁহু। বাবা এলে দুদিন থেকে পরে যেতো। ছোট ছিলাম। ঘুমাতাম। গভীর রাতে কখনো কখনো দেখতাম বাবা আসছে। দড়িতে শার্ট ঝুলিয়ে রাখছে। বিছানায় বসে মাকে জড়ায়ে ধরতেছে। গল্প করতেছে। বাবা থাকলে রাতে যেমন আমাদের চৌকিটা দোলে সেরকম করে দুলতেছে। সকালে উঠে বাবাকে খুঁজতাম, পেতাম না। মাকে জিজ্ঞেস করলে ধমক দিত। বলতে, ‘তর বাবা কই থেইকা আইব? খোয়াব দেখছস।’ আসলে ওটা স্বপ্ন ছিল না। বাবা নয়, পুরুষটা বাবার জায়গায় অন্য কেউ ছিল।’

‘আরে ধুর, স্বপ্ন দেখেছিস। আজগুবি সব গল্প, চুপ থাক।’ আমি ধমকে উঠেছিলাম। কিন্তু হেলাল নিজের মনে বলতে থাকে, ‘লোকটা এখনো আসে। কাল রাতেও আমার মায়ের কাছে এসেছিল আয়ান।’

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে

থাকি। হেলাল স্বগতোক্তি করে, ‘তুই তো তোর মাকে ভালোবাসিস, তাই না? কিন্তু পৃথিবীতে আমি আমার মাকে সব থেকে বেশি ঘৃণা করি।’

হেলাল থু করে নদীর পানিতেই থুতু ফেলে। আমি নির্বাক হয়ে দেখি পানির ওপর একরাশ থুতু স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ওই একবারই। তারপর আর কখনো ও মায়ের কথা মুখে আনেনি। আমি কখনো জিজ্ঞেস করলে জবাব তো দিতই না থু করে থুতু ফেলতো। যেন মায়ের কথা শুনলের ওর ঘৃণায় মুখ কুঁচকে আসে।

যাকগে আমি প্রসঙ্গ বদলাই। বলি, ‘সকাল হয়ে আসছেরে। বাড়ি যেতে হবে। আচ্ছা, বললি না তো কী করছিস আজকাল?’

‘যা করছি মন্দ না। শরীর টাকা দুটোর অভাবই পূরণ হচ্ছে।’

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ও নির্বিকার। বলল, ‘জিগোলো কী জানিস?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম, ‘হুম জানি। পুরুষ বেশ্যা।’

‘আমি জিগোলো। টাকাওয়ালা নারীদের মনোরঞ্জন করি।’

‘শিট! কী বলছিস? বিয়ে করিসনি? ফাইজলামি রাখ।’

‘হা-হা-হা-হা, কি ঘৃণা হচ্ছে? মা ছিল খানকি, ছেলে মেল এসকর্ট বা তোদের ভাষায় পুরুষ বেশ্যা। সমস্যা কোথায়?’

‘ধুর!’

‘শোন, ধুর না। তুই ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যা আয় করিস আমি তার থেকে ঢের বেশি পাই। আসবি এই লাইনে? তোর ফিগার তো হেব্বি হট প্রচুর আয় করতে পারবি।’

আমি হতবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। এতোটা তরল তো ছিল না। এতোটাই নিচে নেমেছে? ও মুচকি হেসে আবারো বলে,

‘কী কিছু বলছিস না যে! আসবি? যদি আসিস তোর দারুণ একটা প্রোফাইল ক্রিয়েট করে দেবো।’

‘কত বছর বয়স পর্যন্ত করবি এসব? ত্রিশ, পঁয়ত্রিশ, ধরলাম চল্লিশ? তারপর?’

হেলালের চেহারায় সেই কৈশোরে দেখা বিষণ্নতার ঘনায়মান ছায়া। খুব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো, ‘তারপর কী হবে কখনো ভেবেছি? এখনো ভাবিনে। আচ্ছা যাচ্ছি।’

হেলাল দ্রুতপায়ে চলে যাচ্ছে। হেলালকে পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না কখনো। এসকর্ট, পুরুষপতিতা, জিগোলো, হোয়াটএভার – ইদানীং ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে এই ব্যবসার অবস্থা রমরমা। কিন্তু ওর প্রতি আমার ঘৃণা হচ্ছে না কেন বুঝতে পারছি না।

বারহাট্টা মফস্বল জেগে ওঠা শুরু করেছে। আমিও একটা রিকশা ডেকে বাড়ির দিকে রওনা দিই। বাড়িতে জমিজমা নিয়ে বিশাল ফ্যাকড়া বেঁধেছে। সেসব মেটাতে দুদিন খুবই ব্যস্ততায় কেটে গেল। ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে হেলালের একটা কথা বারবার মাথায় বাজছে, ‘আমি জিগোলো।’ কত নির্দ্বিধায় বলে ফেললো। হেলাল বলেই পারলো। ভাবছি ঢাকা ফেরার আগে ওর সঙ্গে দেখা করে যাবো। এই রাস্তা থেকে ওকে ফিরিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দেবো। ফোন নম্বর নেওয়া হয়নি। ও তো নেবে না জানা কথা। ওর মামার বাসা আমি চিনি। শহরতলিতে দুটো ঘর ছিল। একটায় হেলালের পুরো পরিবার থাকতো, আরেকটায় ওর মামার পরিবার। শুনেছি সেখানেই এখনো ওরা আছে।

আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি রিকশায় পনেরো-বিশ মিনিটের পথ। রিকশা থেকে নেমে ওর বাড়ির সামনে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। বাহ! সত্যি তো হেলাল বাড়ির চেহারা বদলে ফেলেছে। আগে যেখানে ভাঙাচোরা চাটাইয়ের বেড়া আর শতছিদ্রের টিনে ছাওয়া ঘর ছিল, এখন সেখানে ইটের দালানের ওপর চকচকে টিনের ছাউনি। আগে রাস্তা থেকেই বাড়ির দৈন্য পথচারীর চোখের সামনে হাঁ করে দাঁত মেলে থাকতো। এখন সেটি বেশ ভদ্র হয়ে টিনের বেড়ার আব্রুর মধ্যে ঢুকে গেছে। সামনে বড় শিশু গাছটা না থাকলে চিনতেই পারতাম না। রাস্তার সঙ্গেই একটা কাঠের ছোট গেট। সেটিতে ধাক্কা দিতে আলগোছে খুলে গেল।

চৈত্রের কড়া দুপুরের পর রোদ বেশ আগেই পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। শেষ বিকেলের স্নিগ্ধ আলোতে গাছপালা-ঘরবাড়ি সবকিছুর প্রতিবিম্ব দীর্ঘ আর আবছায়া। সেই আলোতেই এক চিলতে উঠোনে আমার চোখ আটকে যায়। উঠোনের মাটিতে বিছানো শীতল পাটিতে হেলালের মা শুয়ে আছেন। তার মাথার একঢাল সফেদ চুল বালিশে ছড়ানো। হেলাল মায়ের মাথার কাছে বসে পরম যত্নে সেই চুলে আঙুল ঘষে ঘষে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে থাকি। ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপে মশগুল, যার কারণে গেটে কে দাঁড়িয়ে আছে দেখার ফুরসত নেই। হেলালের কি একটা কথায় বৃদ্ধা খিলখিল করে হেসে ওঠেন। কী আশ্চর্য! হেলালের মায়ের হাসি অবিকল আমার মায়ের হাসির মতো।