আমিনুল ইসলাম : পথিকৃৎ এবং নিরীক্ষাধর্মী শিল্পী

শিল্পী আমিনুল ইসলামের জন্ম ১৯৩১ সালে, তিনি পরলোকগমন করেন ২০১১ সালে। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হয়েছিলেন তিনি। সংখ্যায় বেশি না হলেও নানা দৃষ্টিতে দেখে, বিভিন্ন মানদণ্ডে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আশি বছরের জীবন স্মরণ করা হয়েছে তাঁর জীবদ্দশায় অর্জিত সাফল্যের নিরিখে।

প্রথমত, তিনি বাংলাদেশের চিত্রকলায় আধুনিকতার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। বলা যায়, নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে তিনিই আধুনিকতার প্রধান প্রবক্তা এবং প্রথম থেকেই দ্বিধাহীন মনে আধুনিকতার অনুসন্ধান ও চর্চা করেছেন। আধুনিকতার বিষয় এখন যেমন সহজ ও স্বাভাবিক মনে হয়, ১৯৪৮ সালে তিনি যখন ঢাকা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন, সেই সময় তা ছিল অপরিচিত এবং রীতিবিরুদ্ধ, যেমন ছিল কলকাতা আর্ট স্কুলে প্রথমদিকে। ই হ্যাভেল কলকাতা আর্ট স্কুলের প্রধান নিযুক্ত হয়ে যোগদানের পর সেখানে অবনীন্দ্রনাথের সহযোগিতায় প্রাচ্য শিল্পরীতি শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ঢাকা আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির শিল্পশিক্ষাই প্রাধান্য পেয়েছিল, যদিও কোনো কোনো শিক্ষক ক্লাসে প্রাচ্যরীতির দৃষ্টান্ত হিসেবে অজন্তার চিত্ররীতি অনুসরণ করে ছবি এঁকে ছাত্রদের দেখাতেন। পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পরীতি ঢাকা আর্ট স্কুলের শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যেমন ছিল না কলকাতা আর্ট স্কুলে। পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পরীতি শুরু হয় হয় ইম্প্রেশনিজম দিয়ে, যা ছিল প্রচলিত শিল্পরীতি থেকে পৃথক। এরপর এসেছে পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, সুররিয়ালিজম ইত্যাদি আধুনিক শিল্পরীতি, যেসব ধারা আধুনিকতাকে আরো সামনে নিয়ে যায়। অ্যাকাডেমিক শিল্পরীতিও পাশ্চাত্যের শিল্প ট্র্যাডিশন, কিন্তু বাস্তবতা ঘরানার, যেখানে আঙ্গিক (পারসপেক্টিভ) এবং আলোছায়ার খেলা (রং) নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো স্থান ছিল না। স্টুডিওর বাইরে গিয়ে ছবি আঁকাও ছিল অভাবনীয়। ইম্প্রেশনিস্ট এবং পরবর্তী শিল্পরীতি এই ধরাবাঁধা নিয়মের নিগর ভেঙে স্টুডিওর বাইরে  এসে নিত্যনতুন নিরীক্ষায়  অভিনিবেশ  করে। আমিনুল ইসলাম ছাত্র অবস্থায় বই পড়ে এবং ছবি দেখে এসব আধুনিক শিল্পরীতি সম্বন্ধে জেনেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ঢাকা আর্ট স্কুলে পড়া শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে ফ্লোরেন্সে শিল্পশিক্ষার জন্য যাওয়ার পর তাঁর কাছে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পরীতি ক্লাসে শিক্ষার বিষয় হয়ে দেখা দিলো। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি শিল্পকলায় পাশ্চাত্যের আধুনিকতায় যুক্ত হয়েছিল পিকাসো-মাতিসের  কিউবিজম। পাশ্চাত্যে নবীন-প্রবীণ সব জীবিত শিল্পীকে প্রভাবান্বিত করেছিল সেই নতুন শিল্পধারা। আমিনুল ফ্লোরেন্স থেকে ফিরলেন কিউবিজমের প্রভাব আত্মস্থ করে। পঞ্চাশের দশকের বাকি বছর তাঁর কাটল কিউবিজমের আদলে ছবি এঁকে, যেখানে মানুষের অবয়ব দেখা গেল জ্যামিতিক ফর্মের ভেতর। এরপর ষাটের দশকে তিনি অবয়ব ত্যাগ করে শুধুই জ্যামিতিক ফর্ম নিয়ে তৈরি করেছেন ছবি। সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত তাঁকে অর্ধবিমূর্ত ছবিতে ফিরিয়ে এনেছে। এই সময় এবং আশির দশকে তিনি তৈরি করেছেন স্টেইন গ্লাসে এবং দেয়ালে মিউরাল আর্ট, যেখানে বাস্তব হয়েছে স্টাইলাইজড অর্থাৎ অর্ধবিমূর্ত। এই পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য ছবি ‘টাইম অ্যান্ড বিয়ন্ড’,  যেখানে একটা ঘড়ির পেন্ডুলাম অস্থির হয়ে আছে, পেছনে স্টেইন গ্লাসে একাত্তরের সূচক নানা মোটিফ। তাঁর সমস্ত শিল্পীজীবনে আমিনুল এভাবে অর্ধবিমূর্ত আর বিমূর্ত ছবি তৈরি করে আধুনিকতার চর্চা করেছেন। শেষ জীবনে যখন শুধুই ড্রয়িং এঁকেছেন। সেখানেও ছিল আধুনিকতার প্রতি নিবেদন। তিনি শুধু আধুনিকতার পথিকৃৎ ছিলেন না, আজীবন তার চর্চা করে গিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, আমিনুল ইসলামকে স্মরণ করা যায় একজন লেখক হিসেবে। শিল্পীরা সাধারণত শিল্প নিয়ে লেখেন না, কিন্তু তিনি লিখেছেন। তাঁর লেখার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে আধুনিক শিল্প, এশিয়ান শিল্প, বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাস এবং ড্রয়িং। আধুনিক শিল্প সম্পর্কে তিনি প্রথমে বলেছেন, এই ধারা পাঁচ হাজার বছরের শিল্প-ঐতিহ্যকে পেছনে রেখে, তা অপ্রাসঙ্গিক করে সামনে অগ্রসর  হয়েছে। পরে তিনি আধুনিকতা সম্পর্কে তাঁর মতো কিছুটা বদলে বলেছেন, শিল্পকলায় একটি নতুন দৃষ্টিকোণ যুক্ত করেছে আধুনিক শিল্প। কলকাতার দেশ পত্রিকার শিল্পবিষয়ক প্রচ্ছদ কাহিনির ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছেন : ট্র্যাডিশনকে অতিক্রম করে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমের আধুনিক ধারায় শিল্পচর্চা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও শান্তিনিকেতনে শিল্পচর্চা বেঙ্গল স্কুলের রীতি অনুসরণেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এশিয়ান শিল্প সম্পর্কে তাঁর নিরাবেগ, নিস্পৃহ মত হলো, এটি কোনো শিল্পধারা নয়, একটি আঞ্চলিক ধারণা মাত্র। বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্দোলনের ইতিহাস আমিনুল ইসলামই প্রথম লেখেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৯৫ – এই পঁচিশ বছরের শিল্প ইতিহাস লেখার পর তাঁর দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছা ছিল, যা করাল ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার জন্য শেষ হয়নি। তাঁর শিল্পকলার ইতিহাস লেখার বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইতিহাস লিখেছেন স্মৃতিকথার মোড়কে। তিনি সবচেয়ে বেশি লিখেছেন ড্রয়িং নিয়ে। ড্রয়িংয়ের ওপর ইংরেজিতে লেখা তাঁর একটি বই আছে, যেখানে তিনি শিল্পকলার এই শাখা সম্পর্কে তাঁর নিজের চিন্তাভাবনা এবং ধারণার বিশদ বক্তব্য রেখেছেন। ড্রয়িং সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, মানুষের শরীরের গঠন-কাঠামোতেই আছে জ্যামিতিক রেখা, যা তাকে আদিম যুগ থেকেই আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতিতে নানা দৃশ্য এবং পশুপাখির অবয়বে রেখার উপস্থিতি। তিনি বলতে চেয়েছেন, ড্রয়িং মানবজাতির এক আদিম সৃজন অভীপ্সা। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন চিন্তক এবং শিল্পী।

সবশেষে যেজন্যে আমিনুল ইসলামকে স্মরণ করা যায় তা হলো, তাঁর শিল্পচর্চায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আধুনিক শিল্পচর্চা মানেই নিরীক্ষাধর্মী কাজ, যা তিনি করেছেন পেইন্টিং, স্টেইন গ্লাস আর্ট এবং মিউরাল শিল্পে। কিন্তু তাঁর নিরীক্ষার পরাকাষ্ঠা ঘটেছে ড্রয়িংয়ের ক্ষেত্রে।

সব শিল্পীকেই বাস্তবধর্মী ড্রয়িং  দিয়ে শুরু করতে হয়, আমিনুলও তাই করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন অর্ধবিমূর্ত শ্রেণির ড্রয়িং। এই অর্ধবিমূর্ত শ্রেণির ড্রয়িং আঁকতে গিয়ে তিনি অনুভব করেছেন এক ধরনের টেনশন, ক্যানভাসের/ কাগজের স্পেসে এবং নিজের ভেতর। মুক্তি আর শৃঙ্খলার টানাপড়েনের ভেতরে থেকে ড্রয়িং যেন এক প্রান্তে গিয়ে স্থির হতে চেয়েছে। অবচেতনে তাঁর পক্ষপাত ছিল মুক্তির দিকে। তিনি শেষমেশ বিমূর্ততার মুক্তিকেই বেছে নিয়েছেন। আধুনিকতার প্রতি তাঁর প্রবণতা তাঁকে এই দিকেই ঝুঁকতে বলেছে অবধারিতভাবে। এর ফলে তাঁর সমস্ত  ড্রয়িংয়ের মধ্যে বিমূর্ত ড্রয়িংয়ের সংখ্যাই সর্বাধিক। আশির দশক থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কেবল বিমূর্ত ড্রয়িং এঁকেছেন।

আমিনুল ইসলাম বিমূর্ত ড্রয়িং এঁকেছেন কলম, পেনসিল এবং মোটা ব্রাশ ব্যবহার করে। কাগজে কলম বা পেনসিল ঘষে কিংবা কালো কালি দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন আলো-ছায়া। একে তো বিমূর্ত তার ওপর  মোটা ব্রাশের টান আর আলো-ছায়া যা তৈরি করেছে তাঁকে ড্রয়িং বলা হবে, না ডিজাইন – সে-প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ড্রয়িংয়ের প্রাণ হলো রেখা, যা গতি এনে দেয়। রেখা দিয়ে যখন ফর্ম বা আকৃতি তৈরি হয় সেখানে ছন্দ সৃষ্টি হয়। ছন্দ আর গতি ছাড়া কলম বা ব্রাশের কাজ হয়ে যায় ডিজাইন। ডিজাইনে গতি থাকে না, ছন্দ সেখানে অনুপস্থিত। ডিজাইন কেবলই দৃষ্টিনন্দন। আমিনুলের বিমূর্ত ড্রয়িংয়ে আপাতদৃষ্টিতে ছন্দ এবং গতি নেই। ফলে, আপাতদৃষ্টিতে সেসব ড্রয়িং মনে না হয়ে ডিজাইন হিসেবে দেখা দিয়েছে।

পদার্থবিদ্যায় কাইনেটিক এনার্জি বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ হলো, আকারবিহীন সধংং বা ভর এমন হতে পারে যার ভেতরকার এনার্জি গতি এনে দেয়। আমিনুলের আঁকা মোটা ব্রাশের দাগে এবং আলোছায়া দিয়ে আঁকা  বিমূর্ত ড্রয়িং যদি এমন হয়, যার ‘মাস’ বা ‘ভর’-এর ভেতর গতি সঞ্চরমান, তাহলে তা ডিজাইন না হয়ে ড্রয়িং বিবেচিত হতে পারে। আমিনুলের নিরীক্ষায় যে বিমূর্ত শিল্প আঁকা হয়েছে তা ড্রয়িং  কি না – তার বিচারের ভার তিনি ছেড়ে দিয়েছেন দর্শক-সমালোচকের ওপর।

দর্শক-সমালোচককে দেখে বলতে হবে  মোটা ব্রাশের টানে আর আলো-ছায়ার বিন্যাসে যে-ভর সেখানে কাইনেটিক এনার্জি আছে কি নেই।

দুই

শিল্পরসিক আবুল খায়ের লিটুর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা আমিনুল ইসলামের ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আঁকা যে ড্রয়িং সমগ্রের প্রদর্শনী বেঙ্গল শিল্পালয়ে আয়োজন করা হয়েছে (১৬ই মে-৮ই জুলাই, ২০২৩) সেখানে মূর্ত, অর্ধবিমূর্ত ড্রয়িংয়ের সঙ্গে বিমূর্ত বেশকিছু ড্রয়িং রয়েছে। প্রদর্শনীতে দর্শক প্রথাসিদ্ধ  মূর্ত ড্রয়িংয়ের (কিছুসংখ্যক) গতি এবং ছন্দ দেখে তৃপ্ত হবে, অর্ধবিমূর্ত ড্রয়িংগুলির (সংখ্যায় স্বল্প) স্পেসে যে টেনশন, তা তাদের চোখে পড়বে। সর্বোপরি, বিমূর্ত ড্রয়িং (অন্য দুটির তুলনায় সংখ্যায় অধিক) দেখে তারা বুঝতে সচেষ্ট হবে, সেগুলি আকৃতিহীন অনড়, অচল, জড় ফর্ম, নাকি এমন মাস বা ভর বিশিষ্ট যার ভেতর কাইনেটিক এনার্জি আছে। অর্থাৎ সেসব ড্রয়িং না ডিজাইন, সে-বিষয়ে তাদেরই সিদ্ধান্ত দিতে হবে। তাঁর শিল্পপ্রতিভার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না।

প্রদর্শনীতে আয়োজিত ১৯৭০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত আমিনুল ইসলামের এই তিরিশ বছরের ড্রয়িং দর্শককে শিল্পকলার এক প্রায় উপেক্ষিত জগতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। খুব কম শিল্পীই ড্রয়িংয়ের মতো এলিমেন্টারি মাধ্যমে এত বিচিত্র কাজ করেছেন এবং একে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় করেছেন। আমিনুল ইসলাম এক্ষেত্রেও পথিকৃৎ।

বেঙ্গল শিল্পালয়ের বর্তমান প্রদর্শনী কিউরেট করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। প্রদর্শনীর ড্রইং সম্পর্কে তিনি যে মতপ্রকাশ করেছেন এবং ব্রোশিওরে ছাপা হয়েছে, তার কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে :

আমিনুল ইসলামের চিত্রকর্ম খাড়া ও  আনুভূমিক রেখার ছন্দোময় সমন্বয়। এসব রেখা কখনো ওপর থেকে নিচ বরাবর, আবার কখনো ডান থেকে বাঁয়ে প্রসারিত হয়ে চিত্রতল জুড়ে প্রবহমানতা সৃষ্টি করে। চিত্রের জমিনে অনিয়মিতভাবে দণ্ডায়মান এসব রেখার  মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে এক ধরনের জৈবিকতা, যা আমাদের শেকড়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নানা পুরুত্বের রেখাগুলি কখনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মৌলিকতার  নিরীক্ষামূলক বিস্তার, আবার কখনো গতিশীল ছন্দোময় অবয়ব হয়ে ধরা দেয় আমাদের দৃষ্টিসীমায়।

সাদা জমিতে কালো রেখার টান কাগজে ফুটিয়ে তোলে জ্যামিতিক মাত্রা। উল্লম্ব রেখাগুলিকে লতার মতো জড়িয়ে থাকা অন্যান্য রেখার বিন্যাস একধরনের ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত করে। ছবি আঁকার বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যবহারে সমস্ত ছবিতে দেখা যায় প্রশস্ত, লম্বা, বাঁকানো, মোটা, ছন্দোময়, গতিশীল, অনিয়মিত, খণ্ডিত, স্বতঃস্ফূর্ত, কৌণিক, প্রতিসম, ঝাপসা, ঘন এবং ছোট ছোট রেখা। তুলির আঁচড়, বৃত্ত এবং রঙের আস্তরণ ইত্যাদিও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। দেখে মনে হতে পারে, এসব রেখা আটকে আছে তাদের আলোহীন উদ্দীপনার মধ্যে। ক্ষেত্রবিশেষে তারা ভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে সংযুক্ততা অথবা একই উদ্দীপনার প্রতিনিধিত্বকারী। চিত্রতলে ছড়িয়ে থাকা প্রতিটি উপাদান পূর্ববর্তী উপাদানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নানা আঙ্গিকের রেখা-টানের মধ্য দিয়ে ক্রমশ ফুটে ওঠে  বিশালাকার বৃক্ষ অথবা বয়ে যাওয়া নদী। যদিও এসব উদ্ভাসন সব সময়ই দর্শকের সামনে ভিন্ন ভাবনার  সুযোগ উন্মুক্ত রাখে।

বিমূর্ত শিল্পের একটা সুবিধা হলো, দর্শক-সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার ভিত্তিতে ব্যাখ্যার উপযোগিতা। নিজের উপলব্ধি এবং বিবেচনার ওপর নির্ভর করে ওপরে যে-ব্যাখ্যা দিয়েছেন ওয়াকিলুর রহমান তা সর্বজনগ্রাহ্য না হলেও অনেকের কাছে অর্থবহ মনে হবে।

তিন

আমিনুল ইসলামের ড্রয়িংয়ের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এবং তথ্যগত বিশ্লেষণ দিয়েছেন ওসমান জামাল, যা আমিনুলের Drawings (২০০২) বইয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। এখানে তিনি সময়ক্রম এবং বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আমিনুলের ড্রইংয়ের ছয়টি শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। প্রথম পর্বের সময়কাল ১৯৪৭-৪৮, যখন ড্রইং জ্যামিতিক ফর্ম অনুসরণে অর্ধবিমূর্ততার শ্রেণি সৃষ্টি করেছে। পরবর্তী শ্রেণি অ্যাকাডেমিক পদ্ধতির বাস্তবতার প্রতি বিশ^স্ততা দেখিয়েছে। এর সময়কাল ছিল চল্লিশের দশকের শেষ থেকে পঞ্চাশের দশকের  প্রথম ভাগ। ওসমান জামাল দেখিয়েছেন এই পর্বে আমিনুল জ্যামিতি ব্যবহার করেছেন ড্রইংয়ের কম্পোজিশনে।

তৃতীয় শ্রেণির (১৯৫৫-৫৯) ড্রইংয়ে  বিষয়ের তুলনায় আঁকার উপকরণ মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে বলে তাঁর ধারণা। এই প্রসঙ্গে ১৯৫৮ সালে খবরের কাগজে আঁকা মুর্তজা বশীরের প্রতিকৃতির উল্লেখ করা হয়েছে। ষাটের দশকে ‘খাজুরাহো’  শীর্ষক  অন্তত একশটি ড্রইং রেখাভিত্তিক মূর্ত শ্রেণির যেখানে অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন ও শিক্ষার প্রভাব স্পষ্ট। পঞ্চম শ্রেণিতে রয়েছে সাদা কাগজে কলম এবং পেনসিলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। হাসপাতালে শায়িত ধর্ষিত রমণীর সরল ভঙ্গিতে আঁকা লাইন ড্রইংয়ের সরলতায় আর্তনাদ এবং প্রতিবাদ তীব্র হয়ে উঠেছে। ওসমান জামালের ষষ্ঠ শ্রেণি আশির দশকের পর থেকে যখন তিনি বিমূর্ত ধারার ড্রইং এঁকেছেন। এখানে তিনি বলেছেন, ১৯৬৭ সালের পর ড্রইং আঁকায় অবচেতন কাজ করেছে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে। কিন্তু ১৯৯৪-এ ‘কালারফোর্স’ সিরিজের ড্রইং আঁকার সময় অবচেতনও বিদায় নেয়  সম্পূর্ণভাবে। এই মতের সঙ্গে আমিনুল ইসলামের নিজের দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ দেখা যায়। তাঁর মতে, বিমূর্ত ধারার ড্রইং বা পেইন্টিং শুরু হয় অবচেতনে। কিন্তু কাগজে বা ক্যানভাসে প্রথম রেখার টান বা তুলির রঙের ছোপ জেগে ওঠার পর শিল্পীর সজ্ঞা বা ইনটিউশন সক্রিয় হয় এবং বলে – এরপর কী করতে হবে। এভাবে সজ্ঞার অধীনে কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর শিল্পীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং শিল্পবোধ তাঁকে পরিচালিত করে। আমিনুলের এই ব্যাখ্যা বেশ সরল এবং খুবই যুক্তিসংগত। সর্বসাধারণের জন্য বিমূর্ত শিল্পের  বোধগম্য  এমন  সহজ ও সরল ব্যাখ্যা বেশ বিরল।

ওসমান জামাল Drawings বইয়ের ভূমিকায় তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য দার্শনিক Dasein
(being, being there) তত্ত্বের উল্লেখ করে  বলেছেন, আমিনুলের বিমূর্ত ড্রইংয়ে শিল্পী তাঁর সত্তাকে বিস্মৃত হয়ে   বস্তুজগতে প্রবেশ করার যে অভিজ্ঞতা বিধৃত, সেখানে subject-object-এর দ্বৈত (duality) অবস্থান নেই। দুইয়ের মধ্যে সীমারেখা অদৃশ্যকারী শিল্পসৃষ্টিই বিমূর্ততা। এই তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়ার পর ওসমান জামাল ছয়টি বিমূর্ত ড্রইংয়ের দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টি বিশদ করেছেন। ওসমান জামালের এই ব্যাখ্যা সবার কাছে  গ্রহণযোগ্য না হলেও এখানে যে বিমূর্ত ড্রইং বোঝার জন্য মৌলিক প্রয়াস আছে, তা স্বীকার করবেন অনেকে।

বিমূর্ত ড্রইং তথা বিমূর্ত শিল্পকে উপমহাদেশের রাগসংগীতের সঙ্গে তুলনা করে আমিনুল ইসলাম যে বক্তব্য রেখেছেন
সে-প্রসঙ্গে ওসমান জামাল বলেছেন, রাগসংগীতে  improvisation করা হলেও তা রাগের পূর্বপরিচিত স্টাইলের অনুসরণেই করা হয়ে থাকে, সম্পূর্ণ নতুন কোনো রূপ সৃষ্টি নয়।

আমিনুল ইসলাম শুধু বিপুলসংখ্যক ড্রইং সৃষ্টি করেননি, বিশেষ করে বিমূর্ত ধারার, সে-সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাও ছিল, যা তিনি বিশদভাবে  লিপিবদ্ধ করেছেন। এইসব চিন্তাভাবনার অনেকটাই যে ছিল মৌলিক, সেই উপলব্ধি তাঁকে একজন শিল্প-দার্শনিকের স্বীকৃতি দিতে পারে।