কুতুবিয়া গার্ডেনের খাসমহলে

মরক্কোর মারাকেশ নগরীর জেমা এল ফিনা নামক পর্যটকনন্দিত বিরাট এক চকে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে দেখা হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত পর্যটক ব্রিয়নার সঙ্গে। এই তরুণীর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কাসাব্লাংকায়। একই হোটেলে আমরা বসবাস করেছি সপ্তাদিন। মেয়েটি তার ভ্রমণভিত্তিক অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি রেডিও চ্যানেলের জন্য নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে। যেহেতু আমি একই বিষয়ে আগ্রহী, আমাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠতে বিশেষ দেরি হয় না। মারাকেশেও আমরা একটি-দুটি অ্যাক্টিভিটি একত্রে করছি। আজ দেখা হতেই সে প্রস্তাব করে, কাছাকাছি কুতুবিয়া
মসজিদ-সংলগ্ন বাগানে বিকালটা কাটানোর। গতকাল আমি ঐতিহাসিক মসজিদটি ঘুরেফিরে দেখেছি, তবে ওর কম্পাউন্ডের বিরাট বাগানটি দেখা হয়নি।

দ্বাদশ শতকে আলমোহাদ বংশের সুলতান ইয়াকুভ আর মনসুর মসজিদটি নির্মাণ করান। কালে কালে এ-উপাসনালয়টি বইপুস্তক বিকিকিনির জন্য আফ্রিকার মাগরেব অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এক যুগে মসজিদের বারান্দাসংলগ্ন দালানে গড়ে উঠেছিল বইপত্রের ১০০টি দোকান। সমুদ্রের ওপারে – আন্দুলুশিয়া থেকেও নাকি বিরল বইপুস্তকের তালাশে এখানে আসতেন, ‘আল বাহিতু-ওয়াল বাহিছিনা’ বা  মননশীল স্কলার ও গবেষকরা। যেহেতু মসজিদের সংলগ্ন বাগানটি আমি দেখিনি, তাই ব্রিয়নার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে রওনা হই ওই দিকে।

জেমা এল ফিনার ভিড়ভাট্টা সম্পূর্ণ অ্যাভোয়েড করে, ব্রিয়না আমাকে নিয়ে আসে পেল্লায় সব পাম বৃক্ষে ছায়া সুশীতল সরণিতে। গাছপালার সবুজ বিস্তারে চোখের সামনের সীমিত আকাশ এমন ঝুপসি হয়ে আছে যে, কুতুবিয়া মসজিদের মিনারটি নিমিষে চলে যায় দৃষ্টির অন্তরালে। সড়ক অতিক্রম করার আগে সাবধানতাবশত আমি একটু দাঁড়াই, কিছু একটা মনে পড়তে গিয়েও ঠিক মনে পড়ে না; চিন্তিতভাবে ঘাড় ফেরাতে দেখি, রাজপথটির বাঁকানো মোড়ে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদায় সবুজের বার্নিস দেওয়া ঘোড়ার গাড়িগুলি। এ দৃশ্যপট চকিতে আমাকে নিয়ে যায় গেল শতাব্দীর ছয়ের দশকের বাদশাহী নগর লাহোরে। ঠিক এভাবে, শাহদারাবাগ কিংবা শাহি-কেল্লার চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকতো ঘুড়ি কা বাডি বা টাঙ্গাগুলি। গোটা তিনেক হর্স-বাগি চাবুক হিসহিসিয়ে পাশ দিয়ে এমন ভঙ্গিতে ছুটে যায় যে, মনে হয়, পর্যটনী বাবুরা কব্জিতে গোড়ে বেলফুলের মালা জড়িয়ে, তকী মীরের সুনির্বাচিত শেরটি স্মরণ করতে করতে মেলা দিচ্ছেন হীরামন্ডির দিকে।

চত্বরে ঢুকতেই ফের সবুজ ফুঁড়ে উঁকি দেয় কুতুবিয়ার মিনার। ওইদিকে তাকিয়ে আমি ভাবি, ইসলামিক স্থাপত্যকলায় হরেক কিসিমের মিনারের তো কমতি নেই, কিন্তু কুতুবিয়ার এ-মিনারটিকে প্রতিটি পর্যটক-পুস্তকে কেন বলা হয় ইউনিক? এ-প্রশ্ন ব্রিয়নার সঙ্গে শেয়ার করলে সে জানায়, মিনারটি গোলাকার নয়, এই প্রথম আফ্রিকার মাগরেব অঞ্চলে আলমোহাদ খানদানের এক আমিরের নির্দেশে তৈরি হয়েছিল চতুষ্কোণাকৃতির মিনার। কারণ, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে আলমোহাদরাও ছিলেন আমোরাভিদদের মতো আফ্রিকার ব্যারব্যার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এদের সঙ্গে বসরা-বাগদাদ থেকে আগত আরবদের শুধু সাংস্কৃতিক সংঘাতই ছিল না, রাজ্যক্ষমতার লড়াইয়ে আমোরাভিদ ও তাঁদের উত্তর-প্রজন্ম আলমোহাদরা ছিলেন আরবদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীও। তাই সচেতনভাবে তাঁরা খানিকটা ভিন্ন ধরনের স্থাপত্যকীর্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কুতুবিয়া থেকেই নাকি সূত্রপাত হয়েছিল, মিনারের স্থাপত্যকলায় গোলাকৃতির পরিবর্তে চতুষ্কোণের ব্যবহার, যা কালে কালে মাগরেব অঞ্চল অতিক্রম করে স্পেনের আন্দুলিশিয়ায়ও বিস্তৃত হয়েছিল।

ব্রিয়নার তথ্যসংগ্রহের দক্ষতায় আমি ইমপ্রেস্ড হই। আন্দাজ করি, রেডিওতে ট্রাভেল রিপোর্ট উপস্থাপন করার আগে সে হোমটাস্ক বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে সেরেছে। বলি, ‘ব্রাভো সুইট পারসন, ইউ শিওর কালেক্টেড্ সাম ইউজফুল ইনফরমেশন।’

প্রশংসায় খুশি হয় ব্রিয়না, বলে, ‘নানা সূত্র থেকে মারাকেশ সংক্রান্ত প্রচুর হিস্টোরিক্যাল ইনফরমেশন আমি জোগাড় করেছি। সামারি করে ফাইলে সেভও করে রেখেছি, তুমি চাইলে আমি ফাইলটি শেয়ার করতে পারি।’

একটু চিন্তা করি, অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে, অন্যের সংগ্রহ করা ইনফরমেশন ব্যবহারে ভুলভ্রান্তির ঝুঁকি থাকে, তাই সতর্কভাবে তাকে বলি, ‘পুরো ফাইল ঘাঁটতে চাচ্ছি না, তবে শুধু সোর্সগুলির রেফারেন্স আমাকে কপি অ্যান্ড পেস্ট করে পাঠাও। ওটা ব্যবহার করে আমার নিজের লেখার জন্য আমি নিজেই প্রসঙ্গিক তথ্য খোঁজাখুঁজি করে নেবো।’

আমার রেসপন্সে ঠিক যেন খুশি হয় না ব্রিয়না। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ‘হোয়াটএভার … ঠিক আছে, আমি রেফারেন্স পাঠিয়ে দেবো।’ পুষ্পিত ডালিমের কুঞ্জবীথিকার পাশ ঘেঁষে, নীরবে হাঁটতে হাঁটতে আমি সহযাত্রীর সহসা নারাজ হয়ে ওঠার কারণটি বোঝার চেষ্টা করি। ক্লাসাব্লাংকায় ঘুরপাকের দিনে সে তার একটি ট্রাভেল স্টোরির স্ক্রিপ্ট আমার সঙ্গে শেয়ার করে জানতে চেয়েছিল, রচনাটির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। সেটি পড়ে আমি ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ইতিহাসভিত্তিক তথ্য অ্যাড করতে সুপারিশ করেছিলাম, আর কীভাবে নানা সূত্র ঘেঁটে জরুরি তথ্যগুলি সামারি করে রাখলে, লেখার সময় বারবার থেমে বইপত্র ঘাঁটার ঝামেলা পোহাতে হয় না, এ-ধরনের চটি-লেকচারও দিয়েছিলাম। আন্দাজ করি, ব্রিয়না চাচ্ছে আমি তার সামারিটি রিভিউ করি, আমি আগ্রহ না দেখানোতে সে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে, সহযাত্রীর মনমেজাজ সমঝে চলার উপকারিতা সম্পর্কে আমি বিলক্ষণ অবগত। ভাবি, কৌশলে বিষয়টা মিটিয়ে ফেলতে হবে।

বাগিচার এদিকটায় বোগেনভেলিয়ার অনেকগুলি বয়স্ক-বৃক্ষ জড়িয়ে-মড়িয়ে কুঁকড়ো হয়ে, লতিয়ে একে অপরকে জাপটে ধরে তৈরি করেছে হরেক রঙে ছায়াচ্ছন্ন একটি টানেল। এগুলির ফাঁকফোকরে লুকোচুরি খেলতে খেলতে, একটি-দুটি মরোক্কান দম্পতি শরাশরিয়তের চোখ এড়িয়ে চাপলিশে পরস্পরকে চুমো খাচ্ছে। আমি বর্ণবহুল বৃক্ষগুলির দিকে তারিফের দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে ভাবি, কেন এ কুঞ্জবীথিকাকে শরিয়তের পাবন্দরা আখ্যায়িত করেন ‘জাহান্নামিয়া’ অভিধায়। সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনপুঁথিতে পড়া একটি তথ্য স্মৃতিতে ঝিলিক পাড়ে। মারাকেশের যেসব তরুণ-তরুণী প্রচলিত প্রথার বিপরীত স্রোতে গা ভাসাতে আগ্রহী, তারা কিন্তু বাগানবিলাসের বর্ণাঢ্য কুঞ্জকে কদর করে নাম দিয়েছেন ‘এল মাজজুনা’।

বর্ণের বিপুল বিভ্রমে বোধ করি খানিকটা অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, কিংবা রঙের ঝলসানিতে নিজের অজান্তে আমারই মুখমণ্ডলে ফুটে উঠেছিল মনজুন-খ্যাত অভিব্যক্তি। ব্রিয়না কাঁধে হাত রেখে সহমর্মী-স্বরে জানতে চায়, ‘তোমাকে কী রকম অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে, সামথিং ট্রাবলিং ইউ?’ জবাবে আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করি, বলি, ‘দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছি ব্রিয়না, তোমার
রেডিও-রিপোর্টের স্ক্রিপ্ট দেখতে চাচ্ছি। যদি ড্রাফ্টটা শেয়ার করো, তাহলে তোমার উপস্থাপনার ভঙ্গি স্টাডি করে আমার নিজের লেখার জন্য হয়তো কোনো আইডিয়া পেয়ে যাবো।’

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, বোধ করি আমি যা বলছি, তা সত্য কি-না যাচাই করে নিয়ে সে রিয়েক্ট করে, ‘বাট হোয়াই হেজিটেশন? দ্বিধাদ্বন্দ্বের কী আছে, ঠিক ধরতে পারছি না যে।’

জবাব দিই, ‘তুমি নিজেই তো বলেছো, লেখা সাবমিট করার আগে অন্য কোনো লেখকের সঙ্গে তুমি ড্রাফ্ট শেয়ার করো না। আই ফিল লাইক আই মাস্ট রেসপেক্ট দিস।’

চোখমুখে চটুল কৌতুক ফুটিয়ে তুলে ব্রিয়না জানায়, ‘ও-কে, নো প্রবলেম, আমি না হয় আমার নিজের গড়া নিয়ম তোমার জন্য আজ একটু পরিবর্তন করলাম। ড্রাফ্টটি এখনই শেয়ার করছি, হ্যাপি নাউ?’

‘ইউ জাস্ট মেড মাই ডে সুইট পারসন’, বলে আমি হাত বাড়াই, তার কব্জি মুঠো করে ধরে অতঃপর ঢুকে পড়ি, অর্ধবৃত্তের আকৃতিতে বেঁকে যাওয়া বাগানবিলাসের বর্ণাঢ্য ছাউনিতে।

অপরাহ্ণের আলোছায়ায় কিছু অদৃশ্য পতঙ্গ বোধ করি দিশেহারা হয়ে তৈরি করছে কেমন যেন রহস্যময় মিউজিক্যাল দ্যোতনা। আমরা বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, ক্যানোপিতে ঝুলছে রেশমগুটির মতো বাদামি-ধূসর কিছু, তার ছিদ্র গলে নীল-সবুজের আভা ছড়ানো পতঙ্গের ডানাও খানিকটা দেখা যাচ্ছে। রঙিন এ-ছায়াশীতল পরিসর ছেড়ে ইচ্ছা হয় না রোদে বেরিয়ে পড়তে। একাধিক রঙের বিকিরণ ছড়ানো জৌলুসে ব্রিয়নাও বোধ করি বিগলিতভাবে বিহ্বল হয়েছে, সে চোখেমুখে সংশয়মিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘দিস কালার বার্স্ট … আই মাস্ট সে .. পিওর বিউটি, এ সৌন্দর্যকে ভিডিওতে সহজভাবে ধরা যায়, কিন্তু ভ্রমণলেখায় এটা ফুটিয়ে তোলা কঠিন?’

লেখাজোখাতে এ-ধরনের বর্ণনার সীমাদ্ধতা সম্পর্কে আমি সচেতন কিন্তু উৎকণ্ঠিত নই, বলি, ‘চেষ্টা করো, তোমার অভিজ্ঞতাকে কবিতার ভাষায় প্রকাশ করতে।’ আমার মন্তব্য নিয়ে সে ভাবে, কিন্তু সাজেশনটি সম্পর্কে একমত হতে পারে না, বলে, ‘গিভ মি অ্যান এগজামপল।’

মন্তব্য করে আমি ফেঁসেছি, তাই দৃষ্টান্তের চ্যালেঞ্জ আমাকে গ্রহণ করতে হয়। আমি একটি রঙিন ঝোপের দিকে ফের তাকাই। অপরাহ্ণের রোদ মৃদু হয়ে আসাতে চোখের সামনে তিন-চারটি রঙের সমাহারকে স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে দেখি, আর বলি, ‘এ মুহূর্তে বর্ণ ছাড়া নেই ভিন্ন কোনো উপাস্য …।’ দ্বিতীয় ছত্রটি তৈরি করার আগে আমি ব্রিয়নার দিকে তাকাই। সে বলে ওঠে, ‘দিস সাউন্ডস সো মাচ লাইক সুফি পোয়েম …, না, এটা ট্রাভেল রাইটআপে চলবে না। … আচ্ছা তুমি সুফি-কবি শিরিন মাগরেবির যে কবিতাগুলি পাঠিয়েছিলে, আমি তা পড়েছি। বাট স্টিল নট ক্লিয়ার … ঠিক বুঝতে পারছি না, কীভাবে ভ্রমণলেখায় কবিতার ছত্র ব্যবহার করা যায়।’

আমি মাথা থেকে হ্যাটটি খুলে তা দেখিয়ে বলি, ‘মনে করো এটি তোমার ভ্রমণলেখার স্ক্রিপ্ট, এতে একটি-দুটি পালক গোঁজার মতো তুমি প্রাসঙ্গিক কবিতার ছত্র ব্যবহার করতে পারো।’

রূপকটি নিয়ে স্পষ্টত ভাবে ব্রিয়না, কিন্তু তার সংশয় কাটে না, বলে, ‘আই উইল থিং অ্যাবাউট দিস।’ তখনই ঝোপঝাড় আচ্ছন্ন করে অদৃশ্য পতঙ্গগুলি একসঙ্গে গুঞ্জন করে ওঠে। ব্রিয়না ইশারায় আমাকে চুপ করতে বলে ছোট্ট একটি সেনসেটিভ রেকর্ডারে ধারণ করতে শুরু করে ধ্বনিপুঞ্জ।

হাঠৎ করে তার সেলে একটি টেক্সট আসতেই উদ্বিগ্ন-মুখে সে বলে, ‘আই অ্যাম স্যরি, আমার রেডিও প্রোগ্রামের সম্পাদক চাচ্ছেন, এখনই রিপোর্টটি পাঠাতে। ডু ইউ মাইন্ড সিটিং হিয়ার ফর অ্যা বিট, আমার একটু নির্জনতা দরকার। আমি খানিক দূরে বসে কাজটা সেরে নেই। তারপর ফিরে এসে কুতুবিয়ার গার্ডেনে একটু ঘুরবো।’

– ‘নো প্রবলেম, ব্রিয়না, রিল্যাক্সভাবে কাজটি সেরে নাও। বাগানটি দারুণ, আই উইল বি ফাইন হিয়ার অ্যালোন।’

কুতুবিয়ার বোগেনভেলিয়ায় ছায়াচ্ছন্ন নিবিড় এক কুঞ্জে তন্ময় হয়ে বসেছিলাম। ব্রিয়নার কাছ থেকে টেক্সট আসে, রেডিওতে পাঠানোর জন্য ট্রাভেল-রিপোর্ট এডিট করতে তার আরো মিনিট তিরিশেক লাগবে। অ্যাপোলজি চেয়ে মেয়েটি অনুরোধ করেছে, আমি যেন কুতুবিয়ার আঙিনা ছেড়ে না যাই, কাজ সারা হলে পর সে আমাকে খুঁজে নেবে। তো আমি উঠে পড়ি।

বেঞ্চে বসে বসে বিরক্ত হয়ে এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছি। ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পড়ে কাউবয় কেতার হ্যাট ও হাইবুট পরে ঘাস মাড়িয়ে কাদাখোঁচা পাখিটির মতো হাঁটছেন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ মিউজিশিয়ান ডানকান ক্যাম্পবেল। তাঁর সতর্ক চাহনিতে সাবধানতার সঙ্গে মিশে আছে গোয়েন্দাখ্যাত অনুসন্ধিৎসা। কী খুঁজছেন ডানকান? তাঁর আচরণে খেলা করছে এমন একরকমের রহস্যময় সতর্কতা যে মনে হয়, তিনি জড়িত আছেন ভয়ংকর কোনো স্মাগলিং রিংয়ের সঙ্গে, অথবা গোপন তথ্য পাচার করার চেষ্টা করছেন কুতুবিয়া কম্পাউন্ডের পার্কপ্রতিম বাগানে বেড়াতে আসা কোনো ছদ্মবেশী ইনফরমারের কাছে। এ ভদ্রসন্তান যেভাবে পোশাকআশাক পরেছেন, তাতে তাঁর আলোকচিত্র দিয়ে কাউবয় মুভির পোস্টার করা যায়। ডানকানের হাতে ধরা সোনালি রিবনে জড়ানো সুন্দর একটি ছোট্টমোট্ট ক্যাসকেটও।

ডানকান ক্যাম্পবেল ঝোপের আড়াল হতেই ভাবি, বিষয়টা ব্রিয়নাকে টেক্সট করে জানালে জবর রকমের রগড় হতো। কিন্তু মেয়েটি এ মুহূর্তে ট্রাভেল-রিপোর্ট এডিট করা নিয়ে ব্যস্ত। ঘটনা হচ্ছে, আমি ও ব্রিয়না বেশ কিছুদিন ধরে ট্রাভেল রাইটিংয়ের চরিত্র হিসেবে ডানকানের আচার-আচরণের খুঁটিনাটি নোট নিচ্ছি। আজকে তাঁর সতর্ক চাহনি দেখে মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, এবং আমি হয়তো ডানকানের চরিত্র বিশ্লেষণের জরুরি চাবিকাঠিটি পেয়ে যাবো।

কাসাব্লাংকার একই হোটেলে আমরা তিনজন একত্রে বসবাস করেছি কিছুদিন। তানজানিয়ার দারুস সালাম থেকে বিশাল আকারের একটি বেস-গিটার নিয়ে ডানকান ক্যাম্পবেল এসে হোটেলে উঠেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল গোটা চারেক সু্যুটকেস ও বেশকিছু বাক্স-পেঁটরা। ভদ্রসন্তান বলে বেড়ান যে, তিনি পেশায় কাউবয় হলেও নেশার নিরিখে একজন মিউজিশিয়ান। মাসখানেক কাটিয়েছেন তানজানিয়া কিলিমানজারো সংলগ্ন পার্বত্যাঞ্চলে। কিলিমানজারো পর্বতের চূড়ায় হাজার বছর ধরে জমে থাকা তুষার আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে দ্রুত গলে যাচ্ছে। বিষয়টি ডানকানকে এতোই উদ্বিগ্ন করেছে যে, তুষারের শুভ্রতার নির্মল শোভাটি মুছে যাওয়ার আগে, এই থিমকে কেন্দ্র করে তিনি সংগীত কম্পোজ করতে চান। মরক্কোতে ডানকান এসেছেন অনুপ্রেরণার সন্ধানে। তাঁর এ-বক্তব্যে আমি ও ব্রিয়না ঠিক কনভিন্স হইনি। আমাদের ধারণা, তানজানিয়ায় কিলিমানজারোর সংলগ্ন-শহর মোশিতে বসবাস করে হোটেলের জানালা দিয়ে পর্বতের দিকে ধুন ধরে তাকালেই তিনি পেয়ে যেতেন তাঁর কাক্সিক্ষত প্রেরণা, এমন কী হয়তো জুটে যেতো সৃজনশীলতার ইন্ধনও।

ডানকান আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে ঘুরেছেন বিস্তর, নানা জায়গা থেকে ক্রয় করেছেন হরেকরকম বাদ্যযন্ত্র। কোনো কোনো সন্ধ্যায় এগুলি হোটেল-লাউঞ্জের সুপরিসর এক কোণে ডিসপ্লে করে চুপচাপ বসে নিঃসঙ্গ এক বালিকার একাকী পুতুল খেলার মতো নাড়াচাড়া করেন। মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখা যায়, গন্ধমাদনের মতো বিশাল একটি বেস-গিটার জাপটে ধরে কাসাব্লাংকার মরক্কো-মল কিংবা ট্রামওয়েতে ঘুরপাক করছেন। প্রথাগত পর্যটকরা এরকম বেজায় ভারি লটবহর নিয়ে চলাফেরা করেন না। তাঁর আচরণ আমাদের সন্ধিগ্ন করে তুলেছে! ব্রিয়নার ধারণা, ডানকান সংগীত কলাকারের ছদ্মবেশে কাজ করছেন পাশ্চাত্যের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে!

আমি ও ব্রিয়না একদিন হলিউডের একটি ক্লাসিক ফিল্ম কাসাব্লাংকা দেখার জন্য রিক ক্যাফেতে যাই। সিনেমার সেটিংয়ের কায়দায় ক্যাফেটি সাজানো হয়েছে পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার জন্য। জানতে পারি যে, কফিপানের শৌখিন রেস্তোরাঁয় আজকাল আর ফিল্মটি দেখানো হচ্ছে না, তবে চাইলে এটির সিডি-প্রিন্ট কিনে নিয়ে নিজ রুমে বসে কম্পিউটারে দেখা যেতে পারে। ওখানে সাক্ষাৎ হয় ডানকান ক্যাম্পবেলের সঙ্গে। তাঁর টেবিলে বসে আমরা ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চের মিশ্রণে প্রস্তত ব্রাঞ্চের আয়োজনে শরিক হই। ফরাসি কেতার মাশরুম-এগ অমলেটের সঙ্গে ব্লাডিমেরি পান করতে করতে ডানকানের সঙ্গে খানিক ঘনিষ্ঠতাও গড়ে ওঠে। পানীয়তে আমেজ কিঞ্চিত গাঢ় হতেই ইসাম শাবা নামে একজন পিয়ানোবাদক দারুণ দক্ষতায় বাজাতে শুরু করেন পঞ্চাশ দশকের লোকপ্রিয় কিছু জ্যাজ-লিরিকের টিউন। ইসাম শাবা যখন ‘নো ম্যাটার হোয়াট ফিউচার ব্রিংস্/ অ্যাজ টাইম গোজ বাই …’-এর সুর বাজাতে শুরু করেন, ডানকান সাহেবের চোখেমুখে ফুটে ওঠে সত্যিকারের বিরহ-বিধুর অভিব্যক্তি। মানুষটি যে জীবনে বার কয়েক দাগা খেয়েছেন, এ নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ থাকে না। পিয়ানো রিসাইটেলের পরপর ডানকান কাসাব্লাংকা ফিল্মের একটি সিডি কিনে নিয়ে আমাদের তাঁর রুমে বসে সিনেমাটি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান।

ডানকানের সুপরিসর সুইটে এসে নীরবে একটু চমকাই! আমরা যেখানে একই হোটেলের অত্যন্ত ছোট্ট পরিসরের সস্তা সিঙ্গেল রুমে কায়ক্লেশে দিন কাটাচ্ছি, সে তুলনায় ডানকানের দু-কামরার সুইটের সিটিং-রুমটি রীতিমতো সনাতনী কায়দায় সাজানো বিলাসবহুল এক পরিসর। ভরদুপুরে আমরা ওখানে বৈঠকি মেজাজে হামফ্রি বোগার্ড ও ইনগ্রিড বার্গম্যান-অভিনীত কাসাব্লাংকা ফিল্মটি দেখে দারুণ আমোদ পাই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ডানকান নানাদেশের ভিন্ন ভিন্ন এয়ারপোর্টের ট্যাক্সফ্রি-শপ থেকে সস্তায় খরিদ করে এনেছেন হরেক কিসিমের সুরা। ফিল্ম পর্যবেক্ষণের সময় হোস্ট হিসেবে দরাজ হাতে তিনি পানীয়ও পরিবেশন করেন। ছায়াছবি দেখে খোশমেজাজে লাউঞ্জে বেরিয়ে এসে আমি ও ব্রিয়না পরচর্চায় মেতে উঠি।

বলি, ‘ডানকান ইজ অ্যা ফ্ল্যাটআউট অ্যালকোহলিক।’ ব্রিয়নার সন্দেহ চূড়ান্তে পৌঁছায়, সে বারবার বলতে থাকে, ‘ডানকান মাস্ট বি ক্যারিং ইউরেনিয়াম অর সামথিং টেরিবোল ইন হিজ বিগ ফ্যাট স্যুটকেইসেস।’  আমি না বলে পারি না, ‘লিসেন সুইট পারসন, তোমার ভ্রমণলেখায় বোঁচকায় করে তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ক্যারি করার কথা লিখলে পাঠকরা তোমাকে নিয়ে বিলা করবে তো।’

ততক্ষণে ডানকানের বিলানো অ্যালকোহল সম্ভবত ব্রিয়নার মস্তিষ্কে চড়ে বসেছে, সে বিরক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়, ‘ফর গডস্ সেইক, ডোন্ট অ্যাডভাইস মিস্টার। আই নো হাউ টু হ্যান্ডল মাই রাইটিং।’ তারপর জড়ানো কণ্ঠস্বরে সে ফিসফিসিয়ে যোগ করে, ‘হি হ্যাজ দ্য পারফেক্ট ব্লু আইজ অব অ্যা ওয়াইল্ড ওয়েস্ট কাউবয়, হিজ লুকস্ সাচ অ্যা রাফ অ্যান্ড টাফ গাই, একে বিবস্ত্র করে ছবি তুলে কাউগার্ল পত্রিকার প্রচ্ছদ করলে, আই অ্যাম টেলিং ইউ … পত্রিকার বিক্রিবাট্টা বেড়ে যেত।’

ঝোপঝাড় মাড়িয়ে হন্যে হয়ে কিছু খুঁজতে থাকা ডানকান ক্যাম্পবেলকে ফের দেখতে পাই। তাঁর সিরিয়াস দৃষ্টিপাতে মনে হয়, ঘোড়ায় চড়ে পর্বতের অত্যন্ত রাফ টেরেইন ধরে রিভলভারটি বাগিয়ে তিনি তালাশ করছেন তাঁর কোনো জানি-দুশমনকে। আমি হাত নাড়ি, মনে হয় আমাকে দেখতে পাননি, নাকি দেখেও ডানকান না দেখার ভান করলেন? সূর্যালোকে ঝলসানো তাঁর মুখটি আমি স্টাডি করি, চকিতে একটি ভাবনা খেলে যায়, তবে কী ব্রিয়নার আন্দাজ সঠিক, ডানকান এ-মুহূর্তে কোনো গুপ্ত গোয়েন্দা সংস্থার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যতিব্যস্ত আছেন, আমাকে হ্যালো বলার ফুরসতটুকুও তাঁর নেই? ঘটনা যাই হোক, দৃষ্টির আড়াল হতেই ‘গো টু হেল ইউ ব্লাডি ডানকান’ বলে ইংরেজিতে বিরক্তি প্রকাশ করি।

উঠে কদম কয়েক সামনে বেড়ে অন্য একটি বেঞ্চে ফের বসেছি। তখনই চোখে পড়ে, মরোক্কান কেতার বেশ কতগুলি কয়েন দিয়ে গাঁথা টিকলি পরা একটি মেয়ে। সে বসেছে বোগেনভেলিয়া ঝোপের ঈষৎ আড়ালে। তার সবুজ চোখে ফুটে উঠেছে বেজায় অস্থির এক কৌতূহল। কেন জানি তাকে চেনা মনে হয়। তখনই গ্রীবা বাঁকিয়ে সেলফোনের স্ক্রিনের দিকে সে তাকায়, আর বর্ণাঢ্য আইশেডে তেরছা হয়ে পড়া আলোর প্রতিফলনে তার চোখ দুটি হয়ে ওঠে রীতিমতো সোনালি। আমার হৃৎপিণ্ডে কী যেন চমক দিয়ে ওঠে, এবং আমি তাকে এবার স্পষ্টভাবে আইডেনটিফাই করতে পারি। ভাবি, এটা শুধু কোইনসিডেন্টই না, রীতিমতো স্ট্রেঞ্জও! মাত্র সপ্তাখানেক আগে আমি তাকে দেখেছি, কাসাব্লাংকার নটর ডেম ক্যাথিড্রাল নামক বিশাল এক গির্জায় চেলো বাজাতে। না, পরিচয় হয়নি, তবে হ্যাট ও গাউন পরে সে সংগীত উপস্থাপন করেছিল, তাই আন্দাজ করেছিলাম, মেয়েটি হয়তো ইউরোপিয়ান। বলতে দ্বিধা নেই যে, মরোক্কান কেতার কাফতান পরায় যুবতীটিকে দেখাচ্ছে ভারি কিউটও।

কাসাব্লাংকার রাজপ্রাসাদের সংলগ্ন ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম। চোখে পড়ে, উত্তরাধুনিক স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত জায়গানটিক সাইজের একটি গির্জা। একই সরলরেখায় সামান্য দূরে, মৌলে ইউসেফের বুনিয়াদী কেতার মসজিদের স্থাপত্যটি থাকায়, ভিন্ন দুটি সংস্কৃতি তথা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কনট্রাস্ট এতো প্রবল যে, ইচ্ছা হয় নটর ডেম ক্যাথিড্রাল নামক বিরাট গির্জাটি ঘুরেফিরে একটু দেখে নিতে। দেখি, মসজিদের চকমিলান দেউড়ি থেকে ফুলের তাজা একটি তোড়া কিনে নিয়ে হেঁটে আসছেন ডানকান ক্যাম্পবেল। আজ তাঁর সঙ্গে বেস-গিটারটি নেই, তবে পুষ্পস্তবকের সঙ্গে তিনি ক্যারি করছেন বেগুনি রিবনে জড়ানো কাঠের একটি ফুলদানি। বলেন, ‘প্লিজ কাম উইথ মি, ক্যাথিড্রালের ভেতর চলছে মিউজিক্যাল ম্যাজিক।’

টাওয়ারের ফ্রেমের মতো ক্যাথিড্রালের সদর-দরজার চৌকাঠটি শুধু প্রশস্ত ও উঁচুই নয়, ক্যালিগ্রাফির মতো দেখতে – জ্যামিতিক প্যাটার্নের কারুকাজে স্মৃতিযোগ্যও। ফ্লোর থেকে ছাদ বরাবর স্টেইন গ্লাস বা রঙিন কাচের জানালাগুলির দিকে তাকিয়ে ডানকান ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘ম্যান, নেভার সিন সাচ অ্যা রো অফ ইমপোজিং কালারফুল উইন্ডোজ।’

একজন ধর্মযাজক কুর্নিশী কায়দায় বাও করে জানান, ফরাসি দেশের নামজাদা শিল্পী গাবরিয়েল লয়ারি মরক্কোর বনেদি লাল ও নীল রঙের টাইলের কায়দায় স্টেইন-গ্লাস উইন্ডোগুলি এমনভাবে নির্মাণ করেছেন যে, পবিত্র পরিসরে প্রভাত কিংবা অপরাহ্ণের প্রকৃত আলো যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, বাইবেলে সদাপ্রভু তো পরিষ্কারভাবে তাঁর প্রতিনিধি পয়গম্বরদের বারবার নির্দেশ দিয়েছেন – লেট দেয়ার বি লাইট। ডানকান একটি খ্রিষ্টীয় আইকনের সামনে নতজানু হয়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেন, ‘প্রেইজ দ্য লর্ড।’

শ্রুতিনন্দন ঝংকারের তুমুল নিনাদে বেজে ওঠে অর্গান। পুরো গির্জাটিতে ছড়িয়ে পড়ে সপ্তদশ শতকের জার্মান কম্পোজার সেবাসটিয়ান বাখের (১৬৮৫ -১৭৫০) ধ্রুপদী অঙ্গের সুরলহরী। অর্গানবাদনের পর মঞ্চে শিল্পীরা এসে পরিবেশন করতে শুরু করেন সংগীত। সুরমূর্চ্ছনায় বিমুগ্ধ হয়ে আমরা বসে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। শেষ সংগীতকার হিসেবে ক্রিম কালারের
ক্লাসি-গাউন ও বাহারি হ্যাট পরে এক তরুণী চেলো হাতে নিতেই, ডানকান  উত্তেজিত হয়ে বলেন,  ‘দ্যাটস ইট, লর্ড, আই অ্যাম ওয়েটিং ফর দিস মেডিটোরিয়ান মিউজিক্যাল ম্যাজিক।’

ডানকানের মতো আমি অভিভূত হই না বটে, তবে ভূমধ্যসাগরের মহীসোপান ফুঁড়ে জেগে ওঠা সবুজাভ চরের মতো তার নওল যৌবনঋদ্ধ দেহবল্লরীকে ঠিক অবজ্ঞাও করতে পারি না। ভাবি, গির্জার পবিত্র পরিসরে বসে ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় সময় কিন্তু একেবারে খারাপ কাটছে না। পাশ থেকে ডানকান ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘লুক অ্যাট হার স্ট্রাইকিং গ্রিন আইজ!’ আফ্রিকার মাগরেগ অঞ্চলে এরকমের সবুজাভ চোখ দেখা যায় কদাচিৎ-ক্বচিৎ, দরিয়ার ওপারে আল আন্দালুশ বা সামগ্রিকভাবে আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় স্প্যানিশ কিংবা পর্তুগিজ নারী-পুরুষের মধ্যে একটি দুটি গ্রিন-আই বিউটি ঠিক বিরল নয়, সুতরাং বিহ্বল হতে পারি না। তখনই মঞ্চের যুবতীটি একটু ঝুঁকে গ্রীবা বাঁকিয়ে চেলোর ছড় টানলে, তার চোখেমুখে এসে পড়ে জানালার রঙিন কাচে প্রতিসরিত দিব্য আলো, আর মুহূর্তের জন্য তার আঁখি-যুগলকে সম্পূর্ণ সোনালি হয়ে উঠতে দেখি; আর সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করি, দিস গার্ল ডিজার্ভস সাম অ্যাটেনশন। আমি তার অনবদ্য বাদনে এবার মনোযোগ দিই।

অজস্র হাততালির ভেতর ঘোষিত হয় সংগীত মাইফেলের সমাপ্তি। পাশ থেকে ডানকান কেন জানি হায় হায় করে ওঠেন। ‘লর্ড ইজ রিয়েলি কাইন্ড টু মি’, বলে তিনি রিবনে জড়ানো ফুলদানিটি দেখিয়ে জানান, কাঠের সূক্ষ্ম কারুকাজ করা এই আর্টপিস মোম্বাসার বাজার থেকে সংগ্রহ করেছেন; কিন্তু এটি কাউকে উপহার হিসেবে অর্পণ করার মওকা পাচ্ছিলেন না, প্রভু আজ তাকে সে-সুযোগ দিয়েছেন। তো ডানকান তাজা ফুল ও ফুলদানিসহ গ্রিনরুমের দিকে আচ্ছন্নের মতো ধাওয়া করেন। আমি যেহেতু ঝোলায় করে উপহার দেওয়ার মতো ঘটিবাটি কিছু ক্যারি করছি না, তাই তাঁকে অনুসরণের কোনো প্রয়োজন দেখি না। অযথা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসি পেল্লায় আকারের ক্যাথিড্রাল থেকে।

চেলো-বাজানো মেয়েটি এই মুহূর্তে মরোক্কান যুবতীদের মতো সাজগোজ করে কুতুবিয়ার বাগিচায় বসে আছে। ভাবি, সে হয়তো মারাকেশে ট্যুর করতে এসেছে। তখনই হাসি হাসি মুখ করে সে উঠে দাঁড়ায়, আর প্রাঙ্গণের সবুজ ঘাসে ছায়া ফেলে অত্যন্ত কনফিডেন্টলি তার কাছে এসে দাঁড়ান ডানকান। ঘটনার নাটকীয়তায় চমকিত হই!

তারা কিন্তু আমার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, পরস্পরের শরীর সংলগ্ন হয়ে সামান্য হেঁটে এসে ঢুকে বোগেনভেলিয়ার কুঞ্জবিথানে। খিলখিল হাসির সঙ্গে লুকোচুরি মতোও কিছু ঘটে। কাসকেটের বেগুনি রিবন টেনে ছড়াতে ছড়াতে মেয়েটি ছিটকে বেরিয়ে আসে প্রায়-খোলা পরিসরে। প্রত্যাশিতভাবে ডানকান তাকে অনুসরণ করে দ্রুত তার কাঁধ স্পর্শ করেন। অতঃপর বাঁ-হাতে কটি জড়িয়ে ধরে তিনি চুমো খেলে, আমি রীতিমতো ধন্ধে পড়ি, বিষয়টি অনুরাগসঞ্জাত নাকি গোয়েন্দা তৎপরতা সংক্রান্ত লেনদেনের কাভারআপ?

তখনই মেয়েটি কাসকেটের ভেতর থেকে বের করে বড়সড় একটি নেকলেস। বেশ দূরে বসেও আমি পরিষ্কারভাবে শুনতে পাই, অস্ফুট আওয়াজে সে বলছে, ‘গুড গড, হোয়াট অ্যা গর্জিয়াস টারকুইজ নেকলেস, লর্ড অলমাইটি, দিস গ্রিনিশ-ব্লু স্টোনস আর রিয়েল!’ বলেই ক্ষান্ত হয় না, প্রতিদানে নারীটি ডানকানের গণ্ডদেশও চুমোয় রঞ্জিত করে দেয়।

তুমুল কৌতূহলে রীতিমতো জর জর হয়ে ভাবি, হোয়াট ইজ দ্য ম্যাটার? ডানকানের চেনাজন আমি, কাছেই তো বসে আছি, চাইলে তো তিনি মেয়েটিকে নিয়ে আরো খানিক আবডালে যেতে পারতেন, সামাজিক আব্রু বহাল রেখে লিপ্ত হতে পারতেন রোমান্টিক ক্রিয়াকলাপে? তবে কী ব্রিয়নার ধারণাই সঠিক? কাসাব্লাংকার ক্যাথিড্রালে কাকতালীয়ভাবে তাদের দেখা হয়ে যাওয়াটা ছিল সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত। কুতুবিয়ার প্রাঙ্গণে তারা পরস্পরের কাছাকাছি আসছেন, যাতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কোনো গুপ্তচর তাদের ওপর নজরদারি করলে, তথাকথিত তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়টিকে দেখাবে স্রেফ নারী-পুরুষের প্রেমে পড়ে ডেটিং করার মতো?

অবচেতনের রোয়া ওঠা লেপ-তোশক থেকে সন্দেহের ছারপোকাটি বেরিয়ে এসে আমাকে কুটকুটিয়ে কামড়ায়। ভাবি, ডানকান ক্যাম্পবেল নামক আমেরিকার এক অখ্যাত কাউবয়ের বেজায় বিলাসবহুল সফর-বাখানির পেছনে হয়তো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা জোগাচ্ছে তহবিল? ব্রিয়না কিংবা আমার অনুমান যদি সঠিক হয়েই থাকে, তাহলেও এ-জুটি অপাত অন্তরঙ্গতার আড়ালে কী আদান-প্রদান করছেন, তার কোনো হদিস করতে পারি না।

আদতে ঘটনা যাই হোক, ফের ঘটে প্রকাশ্য দিবালোকে দৈহিক অন্তরঙ্গতা। আমি আর অধিক কিছু দেখার প্রয়োজন বোধ করি না। উঠে পড়ে অন্যদিকে যেতে যেতে ভাবি, কপালগুণে মরক্কোতে ‘মুতাওয়া বা নৈতিকতা রক্ষা-বিষয়ক’ কোনো
পুলিশ-ফোর্স নেই, ঘটনাটি সৌদি আরবের কোনো মরূদ্যানে ঘটলে, ডানকানকে হয়তো চ্যাংদোলা করে বেঁধে দোররা মারার বন্দোবস্ত করা হতো। এ বাবদে অধিক বিশ্লেষণ পরচর্চার পর্যায়ে পড়ে, তাই এবার বেফজুল ভাবনাকে সংযত করার প্রয়োজন বোধ করি।

এই মুহূর্তে আমার ঘোরাফেরার সাথি ব্রিয়না কুতুবিয়া কম্পাউন্ডে কোনো ঝোপের আড়ালে বসে তার রেডিও-রিপোর্টে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে। লেখক হিসেবে সহযাত্রী মেয়েটির শৃঙ্খলাঋদ্ধ কেজো স্বভাবের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল, তারপরও একা একা খামোকা বসে থাকতে দিগদারি লাগে।

ফুটপাতের কাছেই পামবীথিকার আড়ালে নোনাধরা একটি বুরুজ। সিঁড়ি ধরে খানিক ওপরে উঠতেই, ঝরোকার দৃষ্টিকোণ থেকে কুতুবিয়া মসজিদের ফুল-ভিউ পাওয়া যায়; এবং সঙ্গে সঙ্গে অনুধাবন করি, স্থাপত্যকলার সমঝদাররা কেন উপাসনার এই স্থাপনাকে সুসামঞ্জস্যময় ইমারত বলে বর্ণনা করে থাকেন। ঝরোকায় দাঁড়িয়ে খানিক এদিক-ওদিক তাকাই, তারপর নেমে পড়ে আনমনা হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়ি কুতুবিয়া গার্ডেনের রীতিমতো খাসমহলে। এ-বাগিচায় বোধ করি চৌবাচ্চাঘেরা ফোয়ারার কোনো কমতি নেই। এখানকার শুভ্র ফোয়ারাটির দিকে নজর দিতেই, মনে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ফিরে আসে মোগল আমলে সুবে-বাংলায় আবে-রওয়ান বা চলমান জল নামে এক ধরনের সূক্ষ্ম মসলিনের কথা। অত্যন্ত সফেদ এই বস্ত্রের বুননে নাকি ধরা পড়তো প্রবহমান জলের সদা সঞ্চালনপ্রিয় প্রকৃতি। আমি একটি বেঞ্চে বসে পড়তেই অজ্ঞাত কোনো উৎস থেকে আচমকা ছুটে আসে লু-হাওয়া, তাতে উৎসারিত জলের স্তম্ভটি পয়লা প্রেমের উন্মাতাল আবেগের মতো বেসামাল হয়ে ওঠে।

ফোয়ারার আঙিনায় মিনিট কয়েক জারি থাকে বহতা বাতাসের কবোষ্ণ ছোঁয়া। পরিসর ভরে ওঠে কমলাফুলের সুগন্ধে। একটি গাছে বোধ করি সময়েরই আগেই ফুলের স্তর পেরিয়ে তৈরি হয়েছে গোটা কতক ফল। চৌবাচ্চার তীব্র নীল টাইলসে প্রতিফলিত হয় সবুজ পত্রালির ঘেরাটোপে ক্রিমসন বর্ণের জোড়া বৃত্ত, তিন-তিনটি রঙের সমাহারে তৈরি কম্পোজিশনের দিকে তাকিয়ে ভাবি, অপ্রত্যাশিতভাবে স্মৃতিময় হয়ে উঠছে আজকের অপরাহ্ণ।

ব্রিয়নার জন্য প্রতীক্ষা আমাকে অস্থির করে তোলে। ততক্ষণে কুতুবিয়ার প্রাঙ্গণ নাগরিকদের বৈকালিক প্রমানাদে ভরপুর হয়ে উঠছে। বেঞ্চে বসেছেন বয়স্ক এক দম্পতি। গুঁফো পুরুষটি বসে বসেই সেরে নিচ্ছেন আসরের নামাজ। পাশে বসে তাঁর স্ত্রী ঝুড়ি থেকে বের করছেন ব্লাডপ্রেশার মাপার মেশিন। খানিক দূরে, শিরে চেককাটা কুফিয়া বা স্কার্ফ প্যাঁচানো এক প্রৌঢ় কানের কাছে ট্রানজিস্টার লাগিয়ে শুনছেন সম্ভবত ইভেনিং নিউজ। কোমরে পিস্তল ঝোলানো একজন পুলিশ জলপাই রঙের কিট-ব্যাগ বেঞ্চে রেখে হ্যাটটি খুলে গুছিয়ে বসেন। কিটব্যাগের জিপার টেনে তিনি অতঃপর বের করেন ছোট্ট এক রেহাল ও অজিফা। অনুচ্চ-স্বরে কিরাতের কায়দায় তিলাওয়াত করতে শুরু করলে তাঁর মৃদু উচ্চারণের শিরিন ঝংকারে আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। ভাবি, এ-ইমেজটি ক্যামেরায় ধারণ করতে পারলে হয়তো ভবিষ্যতে লেখাজোখার হিল্লা ধরে অন্যদের সঙ্গে আমার পর্যবেক্ষণকে শেয়ার করা যাবে।

ক্যামেরা বাগাতেই পুলিশ-পুরুষটি খতবর বা বুকমার্কার দিয়ে অজিফা বন্ধ করে বাইফোকাল চশমার লেন্সের ওপর দিয়ে তাকান। তাঁর রোষকষায়িত নজরে নার্ভাস হয়ে আমি সবিনয়ে সালাম দিতে যাই, কিন্তু প্রখর রোদে ফেটে যাওয়া শিমুলের ফলটির মতো বিস্ফোরিত হয় তাঁর ক্রোধ। শাহাদত আঙুল তুলে, ‘লা লা’ বা ‘নো নো’ বলে ধাতিয়ে ওঠেন, ‘সির বালাক’, বা ‘গো অ্যাওয়ে’, আওয়াজে। ভড়কে গিয়ে পিছু হটতে হটতে ভাবি, কপালদোষে ‘পরহেজগার পুলিশের পাবন্দি’, শিরোনামে ভ্রমণগল্প লেখার সম্ভাবনা পকেটের ফুটো দিয়ে পড়ে যাওয়া আধুলিটির মতো হারিয়ে গেল।

ভারি হতাশ হয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিলাম। ব্রিয়না এসে সামনে দাঁড়াতে কিঞ্চিৎ চমকাই। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মতো তার চোখমুখ থেকে টেনশন দূরীভূত হয়ে ফিরে এসেছে রিল্যাক্স প্রফুল্লভাব। সে চটুলভাবে আমার কাঁধে চাটি মেরে জানতে চায়, ‘হোয়াটস্আপ, ইউ আর লুকিং লাইক … লস্ট ইন অ্যা ডিপ থট।’ আমি কাজের কথায় আসার আগে আমাদের আলোচ্য কাউবয় ডানকানের চেলোবাদক এক নারীর সঙ্গে বোগেনভেলিয়া ঝোপের আবডালে অভিসারের বিষয়টি রিপোর্ট করি।

অবাক না হয়ে ব্রিয়না জানায়, ‘আই অলসো সো দেম ওভার দেয়ার। খুব চুটিয়ে চুমো খাচ্ছে। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড … রাজ্যের লোকজনের চোখের সামনে এ রকম ঘনিষ্ঠ হওয়া, দিস অ্যাজ অ্যা পিওর সেটআপ।’

শুনে আমি ‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই সেটআপ?’ বলে প্রশ্ন তুলি। তার ব্যাখ্যা থেকে বুঝতে পারি, ব্রিয়নার বিশ্বাস, চেলোবাদক মেয়েটি কোনো গুপ্তচর সংস্থার অপারেটিভ, তারা ডেটিংয়ের অভিনয় করে কুতুবিয়ার খোলামেলা পার্কে আদান-প্রদান করছে গোপন তথ্য কিংবা এ-ধরনের কিছু।

আমি এবার খোলাখুলি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি, ‘ব্রিয়না, ইউ আর রং ফ্রম দি বিগিনিং। নিজের চোখে দেখেছি, কাসাব্লাংকার বিরাট একটি ক্যাথিড্রালে চেলোবাদক নারীটি যখন সংগীত উপস্থাপন করছিল, তখন ডানকান ক্যাম্পবেল কী রকম গদগদ হয়ে উঠেছিলেন। আমার ধারণা, ওইদিন ওরা পরস্পরের প্রেমে পড়ে। তারপর পরিকল্পনা করে মারাকেশে বেড়াতে এসেছে, নাউ দে আর ডেটিং, প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল।’

উত্ত্যক্ত হয় ব্রিয়না, ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া ইউ আর সাচ অ্যা নাইভ … সাচ অ্যা সিম্পলটন … ম্যান!’ প্রতিক্রিয়ায় আমি নীরব থেকে নাইভ ও সিম্পলটন শব্দ দুটি নিয়ে ভাবি। এগুলির সাদামাটা বঙ্গানুবাদ হতে পারে যুগপৎ বোকাচাঁদ ও চুকুমবোদাই। খেপে গিয়ে তাকে আমি চ্যালেঞ্জ করি, ‘ডানকান ও তাঁর নারীসঙ্গী যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থার অপারেটিভ,
এ-ধারণার সমর্থনে তুমি কি কোনো যুক্তি-প্রমাণ হাজির করতে পারবে?’

নিরাসক্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ব্রিয়না বলে,  ‘লিসেন কেয়ারফুলি …,’ বলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে কতটুকু আমাকে বলবে তা নিয়ে ভাবে, তারপর চাপাস্বরে বলে, ‘ডানকানের সুইটে বসে মুভি দেখার সময় আমি তার ওয়াশরুমে যাই। তখন আমার চোখ পড়ে, খোলা ওয়ার্ডরোবে ঝুলে থাকা ত্রিপিস স্যুট ও বো-টাই এসবের দিকে। আশা করি তুমি একমত হবে যে, স্যুট-মুট নিয়ে কেউ মরুদেশে ট্রাভেল করতে আসে না! শুধু কী তাই, স্যুটের নিচে কুঁচকানো ডিনার জ্যাকেটের তলায় পড়ে ছিল রেডিও ইকুইপমেন্টও। ’

নীরবে আমি শুনি, কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় কিছু বলি না। বিদেশ ভ্রমণের সময় একসেট ফর্মাল স্যুট-জাতীয় পোশাক কখনোসখনো আমিও ক্যারি করেছি। এবং নানা দেশ, যেমন কম্বোডিয়া কিংবা সিয়েরালিওনে পেশাদারি প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে রেডিও। কেনিয়ায় ক্যামেল সাফারি করার সময় আমিও ভাড়া করেছিলাম ওয়াকিটকি। ডানকানের কামরায় শুধু
এ-ধরনের মালপত্র দেখে তাঁকে স্পাই ভাবাটা আমার বিবেচনায় অনুচিত। কিন্তু এ বাবদে কিছু না বলে জানতে চাই, ‘অ্যানিথিং এলস, ব্রিয়না? বাথরুমে আর কিছু তোমার নজরে পড়েনি?’

হাসি চাপতে চাপতে ব্রিয়না জবাব দেয়, ‘দ্যাট ইজ দ্য ফান পার্ট, এটা নিয়ে আমি লেখার কথা ভাবছি। আয়নার তলায়,
ট্র্যাশ-বিনটির কাছে রাখা ছিল একটি কিটবক্স, তার ভেতরে … ক্যান ইউ গেজ হোয়াট?’

আমি জবাব দিই, ‘ডানকানের ওয়াশরুমে রাখা কিটবক্সে কী আছে, সেটা অনুমান করার মতো কল্পনাশক্তি আমার নেই, ব্রিয়না।’ কানের কাছে মুখ এনে সে বলে, ‘ইট ওয়াজ ফুল অফ সেক্স টয়েজ লাইক ভাইব্রেটর অ্যান্ড অল, এবং এগুলি ব্যবহারের ম্যানুয়েল টাইপ হ্যান্ডবুকও।’

অধৈর্য হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, ‘কাম-অন ব্রিয়না, ডানকান হয় হ্যান্ডবুক পড়ে সঙ্গমে সহায়ক হাতিয়ারপত্রে ছবক নিচ্ছেন, অথবা ভাবছেন উপযুক্ত পাত্রী পেলে এসব ইস্তেমাল করে দেখবেন; তোমার পর্যবেক্ষণে তাঁর চরিত্রের একটা দিক খানিক উন্মোচিত হয় বটে, কিন্তু এতেও প্রমাণিত হয় না তিনি কাজ করছেন কোনো গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে।’

উত্ত্যক্ত হয়ে ব্রিয়না, ‘ম্যান, ইউ আর সাচ অ্যান ইপসিবোল …’, বলে বাক্যটি পুরো না করে অন্যদিকে মুখ ফেরায়। বুঝতে পারি, বিরূপ মন্তব্যের জন্য আমাকে গুনাহগারি দিতে হবে। কাকতালীয়ভাবে প্রসন্ন হন অদৃষ্ট, ব্রিয়না আমার দিকে ফিরে বলে, ‘আর ইউ স্টিল ইন্টারেস্টেড টু লিসেন মাই রেডিও-রিপোর্ট?’

‘প্লিজ গো অ্যাহেড’, বলে আমি তার দিকে তাকাই, দেখি, ডাস্টার দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে চকের দাগ মুছে ফেলার মতো তার অভিব্যক্তি থেকে উবে গেছে মাত্র আধ-মিনিট আগে আমাদের ডানকান বিষয়ক দ্বন্দ্বের ছাপ। ব্রিয়না রেকর্ডেড রিপোর্টটি অন করে। পরিসর ভরে ওঠে, কুতুবিয়ার মক্তবে আগত বালক-বালিকার কলধ্বনিতে, তা ছাপিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হয় পবিত্র কালামের বাণী : ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল লাজি খালাক …।’ সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে ইংরেজিতে তর্জমাও, ‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে …।’

শুনতে শুনতে চোখের ইশারায় আমি ব্যক্ত করি তারিফ। কুতুবিয়ায় বংশগতভাবে বইপত্রের বনেদি ব্যবসা চালানোর মানুষজনের বর্ণনায় সে যুক্ত করে সনাতনী ধারার শ্যাবি মিউজিশিয়ানদের বিষয়-আশয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে মৃদুলয়ে বাজে শ্যাবি সংগীতকার ওমর এল হিক্কার সংগীত। মাত্র দু-তিনটি ছত্রে মসজিদের বিবরণ পেশ করে রেডিও-রিপোর্টে এবার বর্ণিত হয় কুতুবিয়ার আইকনিক চতুষ্কোণ মিনারটি। আমি চোখ তুলি, সরণির লম্বালম্বি রেখা অতিক্রম করে দৃষ্টিপথে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে অভ্রচূর্ণের আভা ছাড়ানো চূড়া। শুনতে পাই শত শত বছর ধরে জবলে আটলাসের মরুপল্লিতে বসবাসরত ব্যারব্যার গোত্রের কথা। তারা নাকি প্রতিবছর আটলাস পর্বতের শীর্ষে জমে থাকা লবণের চাকলা খুঁড়ে তা নিয়ে মিছিল করে আসে মারাকাশে এবং মিনার-চূড়ার ছিদ্র ছিদ্র ধাতব ক্রাউনে তা মহাসমারোহে স্থাপনও করে। আমি খনিজ লবণে প্রতিফলিত ঝলমলে দ্যুতির দিকে ফের তাকাই। রেডিও-রিপোর্টটি শেষ হয়, কিন্তু তার রেশ লেগে থাকে আমার হৃদয়-মনে।

ডিভাইসটি টার্নড অফ করে কেমন যেন ঘোরলাগা চোখে সে আমার দিকে তাকায়। ‘দিস ইজ ট্রুলি অ্যা মার্ভেলাস ট্রাভেল রাইটআপ, ব্রিয়না’, বলে আমি আমার তারিফ পেশ করি।

সে ‘থ্যাংকস অ্যা লট, আই অ্যাম সো গ্ল্যাড দ্যাট ইউ লাইক দিস রেডিও-রিপোর্ট’, বলে শিষ্টাচারসম্মতভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তখনই নিজের অজান্তে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘আশা করি ডানকানকে নিয়ে লেখার সময় তাঁকে জেমস বন্ডের চেলা বলে চালাবে না, ব্রিয়না।’ কপট ক্রোধে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে বলে, ‘দ্যাট ইজ নান অফ ইয়োর বিজনেস।’ মৃদু ধাতানিতে কাহিল হওয়ার ভান করে আমি কুতুবিয়ার রশ্মিবিচ্ছুরিত মিনারের দিকে চোখ ফেরাই।