আর্মেনিয়ান কবি ডানিয়েল ভারুজানের কবিতা

ভাষান্তর : মঈনুস সুলতান
কবি-পরিচিতি
আন্তর্জাতিক পরিসরে কাব্য-সমঝদাররা আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি ডানিয়েল ভারুজানকে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁকে তানিয়েল ভারুজান বলেও ডাকা হয়) বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। তাঁর জন্ম ১৮৮৪ সালে তুরস্কের সেবাসটিয়া গ্রামে। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে আর্মেনিয়ান এ-কবি তারুণ্যে পড়াশোনা করেন প্রথমে ইতালির ভেনিস এবং পরবর্তীকালে বেলজিয়ামে। তাঁর পেশাগত জীবনের সূত্রপাত হয় জন্মগ্রাম সেবাসটিয়ার একটি স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। কিছুদিন পর তিনি ইস্তাম্বুলের আর্মেনিয়ান স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন।
১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই দ্য ট্রাম্বলিং। কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত অন্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে : ১৯০৯ সালে প্রকাশিত দ্য হার্ট অব অ্যা নেশন এবং ১৯১২ সালে প্যাগান সংস। ১৯১৫ সালে একত্রিশ বছর বয়সে কবি নিহত হন। মৃত্যুর ছয় বছর পর ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ দ্য সংস অব ব্রেড।
তুরস্কের তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রজন্মগতভাবে নাগরিক হিসেবে বসবাস করে আসছিল আর্মেনিয়ান ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কবির জীবদ্দশায় (১৮৮৪-১৯১৫) তারা তুর্কি শাসকদের ক্রমাগত নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। এ-জনগোষ্ঠীকে বসতবাড়ি থেকে উৎখাত, বিনাবিচারে অন্তরীণ, ধর্ষণ, হত্যা প্রভৃতি নিপীড়নের অত্যন্ত নেতিবাচক পরিবেশে কবির জন্ম হয়। শৈশবে কবি মোকাবিলা করেন ভয়াবহ দুঃখ, দুর্দশা ও সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ। কবি যখন বালক, তখন মিথ্যা অভিযোগে তাঁর পিতাকে ইস্তাম্বুলে কারারুদ্ধ করা হয়।
তারুণ্যে কবি ভারুজান যখন তাঁর কাব্যকলায় আবেগের অভিব্যক্তিকে অতিক্রম করে কেবলমাত্র পরিশীলনের ছোঁয়া পাচ্ছেন, বিষয়বস্তুতে সৃষ্টি করছেন বৈচিত্র্য, ঠিক সে-সময় তুরস্কে বসবাসরত আর্মেনিয়ান সংখ্যলঘু জনগোষ্ঠী শিকার হয় গণহত্যার; যা ঐতিহাসিকভাবে ‘আর্মেনিয়ান জেনোসাইড’, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘আর্মেনিয়ান হলোকাস্ট’ নামেও উল্লিখিত।
১৯১৫ সালে তুরস্কের ‘তরুণ তুর্কি’ বলে পরিচিত তৎকালীন প্রশাসন ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসরত জাতিসত্তার পরিচয়ে আর্মেনিয়ান, ধর্মের নিরিখে অর্থডক্স খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বহিষ্কার ও হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে। কোনো কোনো সূত্র অনুযায়ী, ঐতিহাসিক এ-গণহত্যার প্রাক্কালে অটোমান সাম্রাজ্যে বাস করত দুই মিলিয়ন বা বিশ লাখের মতো আর্মেনিয়ান মানুষ। ১৯১৫ থেকে ১৯২০ সাল অবধি তুর্কি সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিটের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে নিপীড়ন, গৃহচ্যুত করে দেশ থেকে বহিষ্কার, ধর্ষণ ও খুনের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এতে নিহত হয় দেড় মিলিয়ন বা পনেরো লাখ আর্মেনিয়ান মানুষ।
১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল – রোববার, (এ-দিনটি ইতিহাসে রেড সানডে বলে পরিচিত), তরুণ তুর্কি নেতৃত্বের নির্দেশে সেনানীরা কোনো অভিযোগ ছাড়াই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় ২৭০ জন (মতান্তরে ২৩৫ জন) আর্মেনিয়ান বুদ্ধিজীবী ও সম্প্রদায়ের নেতাদের। তাঁদের শীতবস্ত্রহীনভাবে খালি পায়ে হেঁটে তুষারের ওপর দিয়ে বিপুল এলাকা পাড়ি দিতে বাধ্য করা হয়, এবং এক পর্যায়ে অমানুষিক নির্যাতন করে প্রত্যেককে হত্যা করা হয়। একই প্রক্রিয়ায় কবি ডানিয়েল ভারুজানও অপহৃত হন নিজ গ্রামে। তাঁকে অন্য আর্মেনিয়ান কয়েদিদের সঙ্গে হেঁটে একটি জংলা জায়গায় যেতে বাধ্য করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, অতঃপর বন্দিদের বিবস্ত্র করে গাছের সঙ্গে বেঁধে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। কবি আহত হয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
কবি ডানিয়েল ভারুজানের কবিতার প্রেক্ষাপট অনুধাবনের ক্ষেত্রে সে-সময়কার তুরস্কের আর্মেনিয়ান জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা আবশ্যক। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুতে প্রধানত প্রতিফলিত হয়েছে আর্মেনিয়ান জেনোসাইডের সামাজিক প্রেক্ষাপট। কোনো কোনো কবিতায় তিনি প্রতীকীভাবে বয়ান করেছেন তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে সংঘটিত চরম অত্যাচার, একই সঙ্গে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর অসহায়ত্ব। কিছু কবিতায় থিম হিসেবে ফিরে ফিরে এসেছে গৃহচ্যুত হালতে একটি জনগোষ্ঠীর অন্যায়ভাবে নির্বাসনের বিষাদ। কবি ভারুজানের কবিতার অন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা হচ্ছে – বিপন্ন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আশাবাদ। বিরল কিছু কবিতায় বিধৃত হয়েছে প্রেমানুভূতি এবং নিখাদ সৌন্দর্যের বেদিতে কবির শব্দাঞ্জলি।
এখানে কবির সাতটি কবিতা মূলত ভাবের দিকে নজর রেখে ভাষান্তরে উপস্থাপিত হচ্ছে। কবিতাগুলো আর্মেনিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যালিস স্টোন ব্ল্যাকওয়েল। কবিতা ও কবির জীবনসংক্রান্ত প্রাসঙ্গিক তথ্য আর্মেনিয়ান পোয়েমস : রেনডার্ড ইনটু ইংলিশ ভার্সসহ অন্তর্জালের একাধিক ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত হয়েছে।

ভিক্ষা

দুর্ভিক্ষ এখানে; চাই রুটি … রুটি!
দীর্ঘশ্বাস ফেলছে কে আমার কুটিরের চৌকাঠে
অদৃশ্য কেউ যেন চেপে ধরেছে তার টুঁটি।

চুল্লির আগুন নিভে যাওয়ার সাথে সাথে
নির্বাপিত হয়েছে শিখা – অনিকেত ভালোবাসার
জমেছে ছাই আমার মাঝে
ছাইয়ে মিশেছে চোখের জলের ফোঁটা ফোঁটা নোনা ক্ষার।
কী হবে ছাইভস্মে করে অশ্রুপাত
কিছু তো নেই আমার কাছে
একেবারে সর্বস্বান্ত … আমি যেন এক জলহীন প্রপাত।

পকেটের সর্বশেষ সিকিটি খরচ করে বিষ করেছি ক্রয়
আমার সত্তায় মেশাবো বিষ, মৃত্যুর সাথে হবে পরিণয়।
হে ক্ষুধার্তজন – আগামীকাল এসো আমার কবরে
ঝড়-তুফানের মাঝে পথ করে এসো
এসো অনাথ শিশুটির হাত ধরে।

খুব ভোরে এসো
গ্রামে যখন ঘুরে বেড়াবে নেকড়ে বাঘ
আকাশে সূর্য ছড়াবে অরুণিম ফাগ
এসো আগামীকাল
কবর থেকে তোমার ঝুলিতে ছুড়ে দেবো রুটি
ছুড়ে দেবো কবির হৃৎপিণ্ড ও কংকাল।
এ-চারণের হৃদয় হবে তোমার শোণিত
পিতৃমাতৃহীন শিশুদের রক্ত
আমার রুদ্ধ হওয়া সংগীত।
যতক্ষণ না অঙ্গারের আভায় জ্বলে তোমার দুঃখ
কবরখানায় এসো হে ক্ষুধার্তজন
এসো আগামীকাল
ওখানে মৃত্তিকায় ক্রমশ মিশছে কবির কংকাল।

সারসের মৃত্যু

নদীটির তীরে বসে একসারি সারস
একটি পাখির মাথা ঝুলে পড়ছে
তার চোখদুটি মুদে এসেছে
ঠোঁট ডানার নিচে
প্রতীক্ষা করছে সে তার অন্তিম মুহূর্তের।
তার সাথিরা উড্ডয়নে উদ্যোগী হয়
কিন্তু সে পারে না তাদের সাথে আকাশে ভাসতে।
কষ্টেসৃষ্টে সে চোখ খুলে দেখে
বাতাসে ভাসমান বলাকার পথরেখা
যাদের মাথার উপরে এখনো আছে ছাদ
তাদের দোলাচল, শুভেচ্ছা ও অশ্রুপাত
কী দিয়েছে নির্বাসিতের দিনযাপনে?

হায়! কী অসহায় জীবন একটি পাখির
নীরবতার ধূসর পরিসরে মৃত্যু হচ্ছে তার ক্রমশ
দূরাগত বসন্তের স্বপ্ন দেখে কী আর হবে
আকাশে চলমান ডানার নিচে ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত
অথবা স্রোতস্বিনীর পাঁকে পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে
সবুজ নলখাগড়ার ঝোপে ঠোঁট ডুবানো
স্বপ্ন দেখা স্রেফ বৃথা আর।

আর্মেনিয়ার সারসের ডানা এখন ভ্রমণে অবসন্ন
তার প্রান্তর চেরা বিষণ্ন ডাক
যাতে ঝরেছে অযুত অশ্রু
তা স্তব্ধ আজ।
কতজন যুবতী স্ত্রী সারসের নিজ ডানাতলে মাথা গোঁজার মতো
নতমুখী হয়ে মুখ ডেকেছে আঁচলে
আতঙ্কে তড়পাচ্ছে তাদের হৃৎপিণ্ড
কত শিশু বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাদের জননীর স্নেহডোর থেকে
তাদের চোখমুখ উষ্ণ হবে না আর নিবিড় চুম্বনে
এখন একটি মরে যাওয়া দিনের কাঁপন থেকে
সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে চায়
নির্বাসিত হওয়া একটি জাতিসত্তার দুঃখ-বেদনা
তাদের অঙ্গীকার ও সঙ্গোপন দীর্ঘশ্বাস।

যে কনেবউয়ের চোখের সামনে
পাপড়ি মিইয়ে গেছে তার সর্বশেষ গোলাপের
পায়নি সে অন্তিম চুম্বনের স্পর্শ
জননীর ব্যথিত আশীর্বাদ
তার ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রতীক্ষা
সবকিছু অবশেষে ঝরে পড়ছে তাদের কাঁধ থেকে
আর কুয়াশা-মোড়া নদীতীরে
সারস তার ক্লান্ত ডানা ঝাড়ে শেষবারের মতো।

আর্মেনিয়ার পাহাড়
প্রায় বিরান-হয়ে-যাওয়া গ্রামগুলো
মরে যাওয়া দিবসের মলিন কণ্ঠস্বর
অভিশাপ দেয় অভিবাসনে
এবং এ-অভিশাপ ঝরে পড়ে নদীতীরের বালুকাময় মৌনতায়
সারস খুঁজে নেয় তার কবর বালিয়াড়িতে
বেগুনি ঠোঁটের বাড়ি মেরে মেরে
পাথর উলটিয়ে – তলায় গিরগিটির বাসা তছনছ করে দিয়ে
তার গ্রীবা ও কণ্ঠনালিকে ছড়িয়ে দিয়ে
তটে ভেঙে-পড়া তরঙ্গের শব্দরাজির ভেতর
একবার সারাদেহ সজোরে কাঁপিয়ে সমাপ্তি টানে সে।

সরীসৃপ এক – যে পর্যবেক্ষণ করছে এতক্ষণ সারসের মৃত্যু
অতীত দিনের ঈর্ষা ও দ্বন্দ্ব-বিরোধের প্রতিশোধে
নীরবে নিথর হয়ে যাওয়া সারসের গ্রীবা ঘিরে
কুণ্ডলী পাকায়।

মাঠের দাওয়াত

দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা গ্রামগুলো
হালকা তুষারে ছাওয়া আমাদের রাজ্যপাট,
সম্প্রদায়ের সমবেত মাতৃত্ব থেকে
সম্প্রসারিত হয়েছে যে-মাঠ,
পল্লবিত হচ্ছে বসন্ত – এসেছে ঋতু এক অনন্য
তুষারের মিহি নেকাব যথেষ্ট নয়
সারেজলে সমৃদ্ধ এ-যৌবন ঢাকার জন্য;

ফিরে এসো আমাদের কাছে হে কৃষক
প্রভাত এপ্রিল মাসের সৌরভে হয়েছে ভরপুর
পাখিগুলো ফিরে এসেছে – আলে বসেছে বক,
তুষার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে ঝোরার জল
ক্ষেতের উষ্ণ হয়ে ওঠা এলাকায়
ফুটে উঠেছে অংকুর – স্রোত হচ্ছে প্রবল;

ফিরে এসেছে সুসময় বীজ বোনার
নারীর সঙ্গোপন বাসনাকে নিয়ে তাকিয়ে আছি
শেষ হবে আমাদের প্রতীক্ষার,
প্রসন্নতা ছড়াবে সমবেত ঘামের ফসল
আমাদের হৃদয় স্পর্শ করবে সূর্যরশ্মি
মাঠে প্রস্ফুটিত হবে সবুজের শতদল,
লাঙলপ্রিয় মানুষের মেহনতের সারাৎসার
আলোয় ছড়াবে সবজি সবুজের মহিমা অপার।

শ্রমজীবী মেয়ে

প্রতিদিন ভোরে আমার জানালার নিচে তাকিয়ে দেখি
তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছো ভুতুড়ে ছায়ার মতো
শুকিয়ে নিষ্পত্র আমার গোলাপের কুঞ্জলতা – একি
ঝরে পড়ে অশ্রু – আমি হই বেজায় বিব্রত।

জনহীন নীরব সরণিতে আমি শুনি তোমার পদশব্দ
হঠাৎ জেগে কুকুরটি খেঁকিয়ে ওঠে তোমার দিকে
নিদ্রার মধ্যে শুনি ক্রমাগত কাশিতে হচ্ছো তুমি জব্দ
বুক তোমার হাঁপরের মতো তড়পায় – আঁধার হয় ফিকে।

শীতের তীব্র জাড়ে কাঁপছে তোমার শরীর
মনে হয় ক্ষুধার্ত তুমি – কাটাচ্ছো বিনিদ্র প্রহর
অলক গুচ্ছে ঝলসায় রত্নের আভায় শিশিরের নীড়
হে আমার সহোদরা – বলো কোথায় তোমার ঘর।

তোমার ছেঁড়া জুতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে
ঢুকে পড়ছে গলিপথের ময়লা জল
আনমনে হাঁটো তুমি কাঁধে বোঝা নিয়ে
বদমাশ তুর্কি এক শিস কেটে ছড়ায় দূষিত গরল।

ফুরিয়ে গেছে তেল তাই তোমার ঘরে জ্বলছে না আলো
মনে হয় নিজ গৃহে জননী তোমার রুগ্‌ণ শয্যায়
কারখানার শ্রমে তোমার ধমনী থেকে রক্ত শুকালো
তোমাকে নিয়ে ভাবি সতত – গুমরে ওঠে দীর্ঘশ্বাস – হায়।
তোমার কথা ভাবি, ক্ষুব্ধ হই আমি
ইচ্ছা হয় চলে আসি তোমার নিবিড় সন্নিকটে
আমার বাসনা জানেন শুধু অন্তর্যামী
নীরবে তোমাকে আঁকি মানসপটে
হে আমার ভারাক্রান্ত সহোদরা
চুমো খাই তোমার শীর্ণ হাতে
বলি মৃদুস্বরে ‘ভালোবাসি’ থেকো না অধরা।

উৎসর্গ করতে চাই এ-জীবনে
আমি যা করেছি অর্জন
একসাথে লড়ে যাবো সংসারের বিপুল রণে
এসো যুগলে করি এ-পণ
প্রতিদিন সূর্যোদয়ে শিশিরভেজা সকালে
পরাতে চাই আমার বিজয়ের পাপড়ি-টিপ
তোমার কপালে।

কারখানায় যেতে হবে না তোমাকে
গৃহে তোমার ধুঁকবে না জননী
কুপিতে ফুরাবে না তেল
জ্বলবে আলোর সঞ্জীবনী
থাকবে না অভুক্ত
ক্রমাগত কাশিতে হবে না তুমি বিপন্ন
আমার এ অঞ্জলি হে সহোদরা শুধু তোমার জন্য।

বাড়ি ফেরা

সমবেত সংগীতে মশগুল হয়ে বাড়ি ফিরছি
আমরা আজ পূর্ণিমা রাতে
গ্রামের হে ঘরবাড়ি – জেগে ওঠো তোমরা সবাই
প্রস্তুত হও – উৎসবে মাতবো আমরা কাল প্রভাতে;
আঙিনায় ছোটাছুটি করে খেকুরে কুকুরগুলোকে
ঘেউ ঘেউ করতে দাও
পুকুরে যেন মাছ তুলে ঘাই
জাগিয়ে তুলো গাঁয়ের পাতকুয়া ও ঝরনাকে
সুপেয় জলের সফেন বুদ্বুদে
তারা যেন ভরিয়ে তোলে আমাদের সোরাই।

আমরা ছুটির দিনের কথা ভেবে
নিয়ে আসছি কিছু তাজা ফুল
গান গাইছি আমরা
ভালোবাসার গানে মন মাতিয়ে ফিরে আসছি
আমাদের অন্তরে পাখা ঝাপটাচ্ছে বুলবুল;
পাহাড়ি পথ ধরে – ঠেলেঠুলে কিছুটা হেঁটে হেঁটে
গরুগাড়িতে চড়ে আমরা আসছি
শরীর আমাদের ক্লান্ত সড়কের গোলকধাঁধা ঘেঁটে;
গ্রামের হে ঘরবাড়ি
তোমাদের তোরণগুলো হাট করে খুলে রাখো
লম্বা শিংওয়ালা ষাঁড়গুলোর যাতে
শকট টেনে নিতে কোনো অসুবিধা না হয়
চৌকাঠে সৌভাগ্যের প্রতীক আঁকো।

রান্না চড়ানোর চুল্লি থেকে উত্থিত হচ্ছে যে-ধোঁয়া
তাকে মিশে যেতে দাও চিমনির নীলচে ধোঁয়ার সাথে
ছোট্ট শিশু কোলে হে লাজুক গৃহবধূ
খেতে দিও আমাদের উষ্ণ খাবার কিছুকাল প্রাতে;
পোড়ামাটির নীলাভ মৃৎপাত্রে ঢেলে রেখো তপ্ত দুধ
সাক্ষাতের সম্ভাবনায় উন্মুখ হয়ে আছে আমাদের বোধ
তেলহীন চাকায় শব্দ তুলে গরুগাড়িতে
আমরা ফিরে আসছি আজ নিজস্ব ঘরবাড়িতে।

নিভু নিভু প্রদীপ

আজ বিজয়ের উৎসব
আয়োজন হোক ভোজের
হে কনেবউ – তেল ভরো কুপিতে
বিজয়ী ছেলে আমার ফিরে আসছে ঘরে
পরিষ্কার করো সলতে
যাতে ভোজের আসরে আলোর কমতি না হয়।

পাতকুয়ার পাশে ঘরের দেয়ালঘেঁষে
গরুগাড়িটি এইমাত্র এসে থামলো
কুপি জ্বালো, সলতে উস্কে দাও হে কনেবউ
ভুরুতে তেজপাতা জড়িয়ে আমার ছেলেটি ফিরে এলো
পিদিমটি তুলে ধরো আরেকটু উঁচুতে হে কনেবউ।

অনেক রক্ত, অশ্রু ও বিষাদ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে
পাহাড়ি পথ ভেঙে গরুগাড়িটি এসে দেয়ালে ঠেকেছে
সলতে উস্কিয়ে পিদিমটি তুলে ধরো আরেকটু উঁচুতে।

চেয়ে দ্যাখো কনেবউ
এখানে শুয়ে আছে পুত্র আমার
তার হৃৎপিণ্ড গুলিতে হয়েছে বিদীর্ণ
বাতি নেভাও – তাড়াতাড়ি বাতি নেভাও হে কনেবউ।

সুন্দরের প্রতিমূর্তি

অলিম্পাস পর্বতের সুগভীর খনি থেকে
উত্তোলন করতে দাও মর্মর পাথর
আর তাকে ছেনি দিয়ে কেটে-কুঁদে নির্মাণ করা হোক
রমণীর প্রতিমূর্তি – যা থেকে বিচ্ছুরিত হবে
তপ্ত জ্বরের মতো আলোর রেণুকা।

তোমার জোড়া চোখে সৃজিত হোক
আঁধারের কুয়াশায় আচ্ছন্ন প্রগাঢ় গভীরতা
যার অতলে ডোবার আকাঙ্ক্ষায়
মানুষ খুঁজে পাবে অমরতা।

তোমার অঙ্গসৌষ্ঠব হোক নিটোল
স্তনযুগলের মূর্ছনায় প্রবাহিত হোক সঞ্জীবনী।
মৃৎপাত্রের আত্মার মতো নগ্ন হও তুমি
এবং তোমার অবিশ্বাসী পৌত্তলিক নগ্নতা যেন হয়
মানুষের স্পর্শ সম্ভাবনা রহিত।

আর যদি তুমি নির্দেশ দাও উৎসর্গের
তোমার পাষাণ বেদিতে আমি হবো প্রথম বলি
এবং পান করবো আমার শোণিত।