আলাপে-আলাপনে সোনার ফসল

আখতার হুসেন
সাজ্জাদ শরিফের এ-বইয়ের আলোচনা ‘প্রবেশের আগে’ শিরোনামধৃত তাঁর ভূমিকা দিয়েই শুরু করা যাক। তা-হলেই বোঝা যাবে এ-বইয়ের জন্মের নেপথ্য-কাহিনি, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী হিসেবে তাঁর উদ্দেশ্যের স্বরূপটিকে। তিনি কোনোরকম রাখঢাক না করেই আমাদের জানাচ্ছেন, ‘প্রায় তিন দশকের এই সাংবাদিকতাজীবনে অনেকেরই সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছে। সংবাদপত্রের সাক্ষাৎকারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাৎক্ষণিকতা। অনেক ক্ষেত্রেই সে-দায় মেটানোর দরকার পড়েছে। তবু কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম কেবলই সেই ব্যক্তিটির প্রবল টানে। কারণ, তাঁরা নিছক ব্যক্তি ছিলেন না। তাঁদের কেউ কেউ খুবই নিয়তি-নির্ধারক ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। ইতিহাস তাঁদের জীবনে চিহ্ন রেখে গেছে। আবার ইতিহাসেও তাঁদের ভূমিকা আছে। কেউ কেউ আবার তাঁদের অনন্য প্রতিভায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুনতর পথ রচনা করেছেন বা দীর্ঘস্থায়ী চিহ্ন রেখেছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির খোঁজ নিতে কৌতূহলী ছিলাম।’ সেই কৌতূহলেরই আদ্যন্ত ফসল এ-বই।
আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতে, সাক্ষাৎকার জাতীয় রচনার ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ভূমিকা কোনোভাবেই তুচ্ছ নয়। বরং তাঁর প্রশ্নের প্রকৃতি, যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তাঁর সম্পর্কে প্রশ্নকর্তার গভীর জানাশোনাই একটি সাক্ষাৎকারকে অতুলনীয় করে তুলতে পারে। এ-বইয়ের মোট ১৯টি সাক্ষাৎকারের পরতে পরতে ধরা আছে তার অত্যুজ্জল স্বাক্ষর। এবং সেই কৃতিত্বের অধিকারী প্রশ্নকর্তা কবি, অনুবাদক, অনুসন্ধিৎসু পাঠক সাজ্জাদ শরিফ।
মোট পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে এ-বইয়ের অন্তর্ভুক্ত সাক্ষাৎদানকারী ব্যক্তিবর্গকে। ‘সাহিত্য’ বিভাগে পাঁচজন Ñ শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আদোনিস, ক্লিন্টন বি সিলি ও উইলিয়াম রাঁদিচে। ‘চিত্রকলা’ বিভাগে তিনজন Ñ কাইয়ুম চৌধুরী, মনিরুল ইসলাম ও শাহাবুদ্দিন আহমেদ। ‘অভিনয়’ বিভাগে তিনজন Ñ জয়া আহসান, শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাস। ‘সংগীত’ বিভাগে তিনজন Ñ কবীর সুমন, জাকির হোসেন ও এ আর রহমান।
‘সংস্কৃতি ও সমাজ’ বিভাগে পাঁচজন Ñ সুফিয়া কামাল, আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, তপন রায়চৌধুরী ও মার্ক ট্যালি। উল্লি­খিত সূচিপত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, সাজ্জাদ শরিফের আগ্রহের কোনো সীমানা নেই, ঘেরাটোপ নেই। নেই দেশ ও বিদেশগত কোনো সংস্কার। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের মধ্যে আছেন যেমন বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, তেমনি আছেন ভারতীয় সাহিত্যিক, শিল্পী ও চলচ্চিত্র-নির্মাতা। আছেন মার্কিন সাহিত্যপ্রেমী অনুবাদক, প্যারিস প্রবাসী সিরিয়ার বিখ্যাত কবি, যুক্তরাজ্যের রবীন্দ্র ও মধুসূদন-গবেষক। আছেন ব্রিটেনের বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁর ভূমিকা আমাদের ইতিহাসেরই অংশ।
‘বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষার কাব্যিক রূপকার’ কবি শামসুর রাহমানকে এ-বইয়ে প্রথম হাজির করেন সাজ্জাদ এবং তাঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে তিনি শুরু থেকে তাঁর একেবারে পরিণতকালের কবিজীবনের কথা তাঁর মুখ থেকে যেভাবে বের করে আনছেন, তার পাঠ সত্যিই কৌতূহলজাগানিয়া। তাঁর কবিজীবনের ক্রমবিকাশের রূপটিও চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর কবিজীবনের দর্শনটিও আড়াল থাকার সুযোগ পায় না। শেষত সাজ্জাদের প্রশ্নের জবাবে শামসুর রাহমান মৃত্যু সম্পর্কে যা উচ্চারণ করেন, সেটা তাঁর গভীর অনুভবজাত হাহাকার-দীর্ণতারই নামান্তর।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েও সাজ্জাদ শরিফ তাঁর অকপটতাকে বিসর্জন দেননি। ফলে সুনীলের বাল্য-কৈশোর, দেশত্যাগ, দেশভাগজনিত দুর্ভোগ, সাহিত্যজগতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, রাজনীতি, তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কথা, সর্বোপরি আরো মজাদার যেসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, তারও মূলে সাজ্জাদ। ফলে আমরা প্রায় পূর্ণাঙ্গ এক সুনীলকে পাচ্ছি। এই পাওয়া মনকে উদ্বেলিত করে।
আদোনিস সিরিয়ার কবি। আধুনিক আরবি কবিতার অগ্রদূত বলে তাঁকে অভিহিত করা হয়। নোবেল পুরস্কারের শর্টলিস্টে বারবার তাঁর নাম উঠেছে। সাজ্জাদ তাঁকে এমন প্রশ্ন করেন, মনে হয় প্রশ্নদাতার সঙ্গে তাঁর বহুকালের জানাশোনা। আদোনিসকে সাজ্জাদের প্রশ্ন, ‘আপনি কবি ও ভাবুক। রাজনীতি নিয়েও খুবই সোচ্চার। আপনি কি মনে করেন কবিতা পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে?’ এর জবাবে আদোনিস যখন বলেন, ‘একটি তুচ্ছ গ্রেনেড বা গুলি কবিতার চেয়ে অনেক প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে। ফলে পরিবর্তন কথাটাও উপলব্ধি করার দরকার আছে। কবিতা এমন কিছু বিষয়কে পাল্টে দেয়, যা কবিতা ছাড়া আর অন্য কিছু দিয়ে পাল্টানো সম্ভব নয়’, তখন তাঁর দার্শনিক-মনের পরিচয় পেয়ে পাঠকের মন নিশ্চিতই দ্যুতিময় হয়ে উঠবে।
ক্লিন্টন বি সিলিরও সাক্ষাৎকার পাঠককে আপ্লুুত করবে। কীভাবে তিনি জীবনানন্দ দাশের প্রেমে পড়লেন, কীভাবে তাঁর কাব্যজগতের সঙ্গে পরিচিত হলেন, তাঁর অন্তরঙ্গ জীবনী লিখলেন, আকৃষ্ট হলেন মাইকেল মধুসূদনের মেদনাদবধ কাব্যের অনুবাদে Ñ প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সিলির জবানীতে তাঁর এসব কাজের যে-বিবরণ সাজ্জাদ শরিফ বের করে এনেছেন, তার পাঠ রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা।
যুক্তরাজ্যের উইলিয়াম রাঁদিচে রবীন্দ্রনাথ ও মাইকেল মধুসূদনের রচনার অনুবাদক ও গবেষক। তাঁর দেওয়া এই গ্রন্থের ছোট্ট সাক্ষাৎকারে সাজ্জাদ তাঁকে অকপটে জিজ্ঞেস করেন, ‘গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে ইউরোপের সংস্কৃতি যেভাবে পাল্টেছে, যেরকম বদলে গেছে তার সার্বিক রুচি, নতুন অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবেন সেখানে? তখন তার জবাবে রাঁদিচে বলেন, ‘খুবই সুন্দর এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথ বিপুল এক তরঙ্গের মতো। সব সময়ই তাঁর কাছ থেকে কিছু না কিছু নেওয়ার মতো আছে। ইংরেজি ভাষায় তেমন একজন কবি হলেন শেক্্সপিয়র। আমার ধারণা, রবীন্দ্রনাথ সব সময় একটা কাউন্টার কালচারের মতো থেকে যাবেন। কোনো ফ্যাশনেবল লেখকের মতো তিনি নন। কোনো বড় লেখক তা হন না।’
এরপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। সাজ্জাদ মনে হয় রাঁদিচের কাছ থেকে এরকম মন্তব্য শোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এ-ধরনের মন্তব্য করেছিলেন। পরিশেষে এই সাক্ষাৎকারে রাঁদিচে শামসুর রাহমান সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেন, তা সত্যিই মনে প্রগাঢ় ছাপ রেখে যায়।
সাজ্জাদ শরিফের সাক্ষাৎকারে কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পীজীবনের প্রায় আদ্যোপান্ত উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বাংলাদেশের চিত্রকলা শিল্পের রূপান্তরের ইতিহাস, সেইসঙ্গে তাঁর নিজের জীবনের বেড়ে ওঠা ও সুখ-দুঃখের কথা, তাঁর কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষকদের কথাও। গ্রন্থজগতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা, প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে গড়ে ওঠা তার যে নিবিড় শৈল্পিক সম্পর্ক Ñ সাজ্জাদ তাও তুলে এনেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
শিল্পী মনিরুল ইসলাম ও শাহবুদ্দিন আহমেদও এ-বইয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। দুজনেরই পরিচিতি দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে কম নয়। দুজনই তাঁদের সৃজনশীলতা, কাজের ধরন, দেশ ও বিদেশে শিল্পচর্চার প্রকৃতি সম্পর্কে বলেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে করা সাজ্জাদের প্রশ্নের পর প্রশ্নও একজন গভীর শিল্পবোদ্ধার মতোই।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসানের সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে টিভি নাটক থেকে তাঁর চলচ্চিত্রজগতের কুশীলব হওয়ার
কথা। এবং ক্রমশ দেশ ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রের জগতে জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী হওয়ার বিবরণ তাঁর সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে সাজ্জাদ শরিফ যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা যেন নিটোল এক প্রবন্ধ হয়ে উঠেছে।
শাবানা আজমি ভারতের এক কিংবদন্তিতুল্য অভিনেত্রী। কোন পরিবেশে তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর অভিনয়জীবনে মা-বাবা ও পরিবারের প্রভাব, সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনসহ বিখ্যাত সব পরিচালকের সংস্পর্শে আসা, অভিনয় করে খ্যাতির শীর্ষচূড়ায় ওঠা, প্রায় চুলচেরাভাবে তা উঠে এসেছে এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। শাবানা আজমির সাক্ষাৎকার এই বইয়ের এক অন্যতম অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার।
পথনাটক দিয়ে তাঁর অভিনয়জীবনের সূচনা। নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, নিজে অভিনয়ও করেছেন। অন্য নামকরা পরিচালকদের পরিচালিত ছবিতেও অভিনয় করেছেন। এবং এখন নিজেই চলচ্চিত্র-পরিচালক। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে এসেছে নন্দিতা দাসের সৃজনশীল জীবনের বিবরণ। প্রায় সবিস্তারে।
কবীর সুমন তাঁর সাক্ষাৎকারের শুরুতেই বলেছেন, ‘দেয়াল ভাঙব এমন কোনো পণ নিয়ে আমি গান শুরু করিনি। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আধুনিক বাংলা গান আমার সব কথা বলছে না। আধুনিক বাংলা গান আমার সময়ের কথা, আমার জীবনের কথা বলছে না। একটা অতৃপ্তি সব সময় ছিল।’ এই অতৃপ্তি থেকে নতুন ধাঁচের ছক-বাঁধাহীন রীতির গান রচনা, সুর দেওয়া ও সেই গান গাওয়া। লুফে নেন তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের শ্রোতারা। সুমন বলেছেন, তাঁর জনপ্রিয়তার, সংগীতশিল্পী হিসেবে নিজের সক্রিয়বাদিতার কথা।
একইভাবে তবলাবাদক ও সংগীত প্রযোজক জাকির হোসেন এবং এ আর রহমানের সঙ্গে কথা বলে সাহিত্যের নিখাদ মানুষ হয়েও সাজ্জাদ শরিফ সংগীতাঙ্গনের দুই ব্যক্তিত্বের জীবনসাধনার কথা যেভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বের করে এনেছেন, সেটা রীতিমতো বিস্ময়জাগানিয়া।
‘সাহিত্য’ বিভাগে পাঁচ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজ্জাদ। এখানে আছেন বেগম সুফিয়া কামাল, আনিসুজ্জামান, আহমদ ছফা, তপন রায়চৌধুরী ও মার্ক ট্যালি। সুফিয়া কামাল বলেছেন সমাজসৃষ্ট নারী ও পুরুষের মধ্যকার অসমতার কথা, তার থেকে মুক্তির কথা, নারীমুক্তির পথে বড় বাধা আমাদের সমাজের ফতোয়ার কথা, ভাষা-আন্দোলনে নারীর অসম সাহসী ভূমিকার কথা, সর্বোপরি নারীর অগ্রযাত্রার পথে অন্তরায়গুলো ও তার থেকে মুক্তির এমন সব কথা, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ভাবাবে।
লেখক, গবেষক, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে উঠে এসেছে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগ থেকে শুরু করে ভাষা-আন্দোলন, তার পরের নানা পর্বের গণসংগ্রাম, শেষত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। আছে তাঁর নিজের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা বা অংশগ্রহণের কথা। কীভাবে তিনি একটি নির্দিষ্ট কালপরিসরের দিব্য সাক্ষী হয়ে আছেন, তার বিবরণ পাঠ আমাদের কাছে এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতার শামিল। পরিশেষে তিনি তাঁর সাক্ষাৎকার শেষ করেছেন এই বলে, ‘আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাঙালিত্বকে প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ শতকে যেসব উন্নয়ন ঘটেছে Ñ এই শতক তো সবেমাত্র শুরু হলো Ñ তার ফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটা খুব সহজ কাজ নয়; কিন্তু এটা আমাদের করতে হবে। পশ্চাদপদ যেসব ভাবনাচিন্তা সমাজে আছে, তার সঙ্গে আরো কিছুদিন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।’
কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক আহমদ ছফা নিজের সাক্ষাৎকারে তিনি বাঙালি মুসলমানের অগ্রগতির পথের অন্তরায়গুলো তুলে ধরেছেন শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকালের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। এবং একসময় তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, মুসলমান সমাজের বিশ্বব্যাপী পিছিয়ে থাকার কারণ হচ্ছে তাদের মানসজগতে এখনো মধ্যযুগ টিকে আছে। ইহুদিরা মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি ধর্মান্ধ এবং গোঁড়া। কিন্তু তাদের উন্নতি ঠেকে থাকেনি। ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়েও তারা আধুনিক যুগ এবং জীবনকে গ্রহণ করতে পেরেছে।’ পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়েও যেসব কথা বলেছেন ছফা, তার পাঠ গভীর চিন্তার খোরাক জোগাবে।
ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার এ-বইয়ের অন্যতম সুচারু সাক্ষাৎকার। তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সাজ্জাদ শরিফ একেবারে শুরুতেই তাঁকে লক্ষ করে যে-প্রশ্নটি ছুড়ে দিচ্ছেন, এবং তার যে-উত্তর তিনি পাচ্ছেন, যে-যুক্তি তপন রায়চৌধুরী দেখাচ্ছেন, তা নিশ্চিতই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনি গবেষণা করেছেন মোগল আমলের বা ব্রিটিশ উপনিবেশের বাংলা নিয়ে। কিন্তু স্মৃতিকথা লিখতে এসে আপনি ফিরে গেছেন ১৯৪০-এর দশকের দুর্ভিক্ষ আর দেশভাগের সময়টায়। আপনার জীবনে এ-সময়ের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। এ-সময়টা নিয়ে আপনি গবেষণা করলেন না কেন?’
এর জবাবে তপন রায়চৌধুরী যে-যুক্তি উত্থাপন করেছেন, তাকে ঠেলে ফেলা যাবে না। তার মোদ্দা কথা, ‘যে-সময়টার সঙ্গে নিজের জীবনের ভালোমন্দ এতটা জড়িত, কতটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে সে-সময়ের ইতিহাস লেখা সম্ভব, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’ তাই দূর মোগল আমল বা ব্রিটিশ উপনিবেশ তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে।
তাঁর শেষ দুটো বই স্মৃতিকথানির্ভর। তাতে এমনসব অভিজ্ঞতার কথা তিনি সরস ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন, এমন অজানা সব তথ্য পরিবেশন করেছেন, বিশেষ করে দেশভাগের বিষয়টি নিয়ে, পাঠককে তা গভীরভাবে ভাবাবে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে যে-দুটি ঘটনার উল্লে­খ তিনি করেছেন এই সাক্ষাৎকারে, তাও পাঠককে সেই মহৎ মানুষটিকে নতুন করে চিনতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক ট্যালির সাক্ষাৎকার, যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পালন করেছিলেন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চালিয়েছিলেন তিনি উৎসাহসঞ্চারী তৎপরতা বিবিসির মাধ্যমে। সেই মার্ক ট্যালির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সাজ্জাদ শরিফ জানছেন তাঁর পাঁচ পুরুষের ইতিহাস, যাদের ভাগ্য কোনো-না-কোনোভাবে বৃহত্তর ভারতবর্ষের সঙ্গে জড়িত। তাঁর মায়ের জš§ বাংলাদেশের আখাউড়ায়। এই অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে ভারত-ভাগের ফলাফল বা পরিণতি সম্পর্কে যে-উক্তি তিনি করেছেন, তা নতুন করে মূল্যায়নের দাবি রাখে। বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পক্ষে তার প্রবল যুক্তির কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ-স্মৃতির কথা অবিস্মরণীয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
যে-উনিশটি সাক্ষাৎকার নিয়ে এ-বইয়ের জš§, আগেই বলা হয়েছে, তার মূল কারিগর সাজ্জাদ শরিফ। কথায় বলে, সবাই সাক্ষাৎকার নিতে জানেন না। যাঁরা জানেন, তাঁরা সোনার ফসল ঘরে তোলেন। সেই সামর্থ্যরে জোরে সাজ্জাদ শরিফ এ-বইয়ের ভাঁড়ারে সোনার পর সোনা তুলেছেন, আমাদের সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যা স্থায়ী সম্পদ হয়ে থাকবে। তাঁর জন্য অনেক ভালোবাসা। এ-বইয়ের বহুল প্রচার কামনা করি।