ইতিহাসের যমজ ভাইবোন

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

তোমার কথাটা মনে পড়ে : মরে গেলে তোমার পাশে আমাকে শুয়ে থাকতে দিও।

এ হচ্ছে এক ধরনের দোয়া : ভাষা থেকে এই শব্দ কটি আলাদা করা, একটা দীর্ঘ সম্পর্ক কখনো যেন শেষ না হয়। এই সম্পর্ক থেকে বাড়িঘর হয়, গাছপালা হয়, সন্তান-সন্ততি হয়। সেজন্য মরে যাবার পরও তোমার পাশে শুয়ে থাকতে চাই। তোমার কি ইচ্ছা করে না আমার পাশে শুয়ে থাকতে।

এই বাড়িটা আমার মা নিজে বানিয়েছিলেন। বাবা চাকরির সুবাদে ঘুরে বেড়াতেন। মা কিছু টাকা পেয়েছিলেন বাবা-মায়ের কাছ থেকে। সেই টাকায় এই বাড়ি বানানো। অনেকখানি জমির ভেতর একটা শাদা বাড়ি, একটা জাহাজ যেন। বাড়িটার সামনে তার শাকসবজির বাগান। পেছনে ধু-ধু ধানি জমি। এই শাদা জাহাজের মধ্যে তিনি আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে থাকতেন, ঘরের কাজ শেষ করে তিনি গল্প বলতেন চাঁদপুরের, তার বাড়ির, তার দেখা মেঘনা নদীর, মেঘনা নদীর ভাঙনের গল্প। তোরা অতবড়ো নদী দেখিসনি, নদীর ভাঙনের শব্দ শুনিসনি। নানা রঙিন নৌকোর পাল দেখিসনি। এই বাড়িটি আমার সেই ধু-ধু আকাঙ্ক্ষা।

বাবা মারা যাওয়ার পর কতবার বলেছি মাকে, আমাদের কাছে এসে থাকো। তিনি যাব যাব করতেন। কখনো যাননি। হয়তো বাবাকে ছেড়ে আসতে চাইতেন না। মুখে বলতেন না অবশ্য। শেষ পর্যন্ত বাবার পাশে থেকে গেলেন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন ধু-ধু ধানি জমি, সবজির বাগান, গাছপালা আর শাদা একটা বাড়ি, তার শৈশবের শাদা জাহাজ। আমার বোন পরে সেটেল করেছে ইংল্যান্ডে, আর আমি আধা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে ডেরা বেঁধেছি কানাডায়, উত্তরপ্রান্তে, প্রায় নর্থ পোলের কাছে। কতবার আমি আর বোন ঠিক করেছি দেশে ফিরে যাব, মা-বাবার কবর জিয়ারত করব। যাওয়া হয়নি। শুধু স্মৃতি নিয়ে বাস করি। দেশের জমিজমা দেখাশোনা করে আমাদের চাচাতো ভাইরা। বাড়িটা তালা দেওয়া থাকে। বাড়িটা ঘিরে, শাদা জাহাজটা, ঘিরে থাকে মায়ের জায়গা-জমি, বাতাসে ঘিরে থাকে মা-বাবার কবর, আর আমাদের দুই ভাইবোনের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা।

মধ্যে মধ্যে আমার বোনের কথা মনে পড়ে। আমার পাঁচ বছরের বড়ো, বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। বোনের একটি চিঠি আমার স্ত্রীকে প্রায়ই পড়ে শোনাই : জানো তো আমার বইপড়ার নেশা। বই কিনেছি, স্টাডি সাজিয়েছি, বইভর্তি সেলফ। এখন সেলফের নিচের বই বার করতে পারি না। কষ্ট হয়। যৌবন হারানোর মতো।

আমার স্ত্রী জানালা দিয়ে দূর দেখে এবং নর্থ পোলের বিস্তার দেখে, শাদা বরফের ছড়িয়ে থাকা দেখে এবং বলে, তোমার একবার বাড়ি ফেরা দরকার।

আমি কিছু বলি না।

আমি কোথায় ফিরে যাব। বাবা-মা নেই। বাড়িঘর থেকেও নেই। একবার ভাবি, বোনের কাছে গিয়ে সেটেল করি। একবার ভবি জমিজমা চাচাতো ভাইদের থেকে ফিরিয়ে আনি। জমিজমা তো বিক্রি করব না। আমাদের ভাইবোনের স্মৃতি। আর কিছু না থাক, একটা শাদা জাহাজ থাক। যে-জাহাজটা, সবসময়, আমাদের দিকে ভেসে আসে। কিন্তু ভেড়ে না।

 

দুই

আমার বোনের একটা হবি কখনো আমি ভুলি না। খবরের কাগজের ক্লিপিং ও ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করা। বোনটা বলত : এসব হচ্ছে সমসাময়িক পৃথিবী সম্বন্ধে একটা ধারণা রাখা, একটা থিওরি তৈরি করা। যা-কিছু ঘটেছে আমাদের জীবনে তার একটা প্রমাণ বংশধরদের উপহার দেওয়া।

এই উপহার শব্দটা এক ধরনের পাগলামি, বোনকে বলতে গিয়েও বলতে পারি না।

কখনো-কখনো একটা খবর কাগজের ফটোগ্রাফ বোনটা আমার চোখের সামনে তুলে ধরত।

কিছু মনে পড়ে? বোন জিগ্গেস করত আমাকে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোনো ডিসপ্লেসড বাচ্চা?

না রে, না। ১৯৪৮ সালের একটা প্যালেস্টানিয়ান রিফিউজি বাচ্চা।

বোন আর একটা ক্লিপিং দেখাত, অবিকল প্রথমটির মতো। এটা?

আর একটা প্যালেস্টানিয়ান বাচ্চা।

না। এটা হচ্ছে একটা ইহুদি ছেলে। জার্মানির একটা রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ইসরায়েলে এসেছে।

বোন আমাকে ফটোগ্রাফের পর ফটোগ্রাফ দেখাত। এই বাচ্চাগুলিকে একটা ধর্ম লাথি মেরে বার করে দিয়েছে। এই বাচ্চাগুলিকে একটা রাষ্ট্র লাথি মেরে বার করে দিয়েছে, এরা উদ্বাস্ত্ত, এরা রিফিউজি, এরা মুসলমান ইহুদি খ্রিষ্টান হিন্দু : দ্যাখ দ্যাখ এদের মুখ অবিকল একই রকম, এরা যমজ, ইতিহাসের যমজ ভাইবোন, এই যমজদের দেখেই আমি ফটোগ্রাফ সংগ্রহ শুরু করি।

 

তিন

এ হচ্ছে এক ধরনের মৃত্যুনামা। আমি বোনের সঙ্গে একত্রে এই মৃত্যুনামা দেখি। অজানা রিফিউজিদের ফটোগ্রাফ। এদের মধ্যে কেউ একজন মারা গেছে। কেউ একজন কবর পেয়েছে। কোনো একজনের হাড়গোড় পচে গেছে। এরা রিফিউজি, এরা যমজ, হিন্দু মুসলমান ইহুদি খ্রিষ্টান; পরস্পরের যমজ, অবিকল একই মুখ। এদের নাম দিয়ে কোনো লাভ নেই। কেউ একজন মারা গেলে রিফিউজি মারা যায়। একটা সংখ্যা কমে। একজন ধর্মবিশ্বাসীর সংখ্যা কমে।

এরা গুলি খেয়ে মারা যায়। আগুনে পুড়ে মারা যায়। না খেয়ে মারা যায়। মারা যায় মারা যায় মারা যায়। সব মিলিয়ে একটা ধ্বনি একটা শব্দ একটা হাহাকার। তাকে ফটোগ্রাফ করে রেখেছে আমার বোন। আমি বোনের মুখোমুখি চুপচাপ বসে থাকি। আমি বোনকে শুনিয়ে বলি কিংবা বোন আমাকে শুনিয়ে বলে : আমরা দুজনই একটা ধর্ম খুঁজে পেয়েছি, ধর্মের শূন্যতা। এই ধর্ম আমাদের সর্বনাশ করবে।

 

চার

আমার বোন ফিসফিস করে কানের কাছে ইতিহাসের কথা বলতে থাকে। ইতিহাস সগর্জনে বললে ইতিহাস থাকে না, ইতিহাস হয়ে যায় বোমা বন্দুক বারুদ। ইতিহাসের জোর নম্রতায়। আমার বোন সব সময় একথা মনে করিয়ে দেয়।

দেখো না এই ফটোটা। এই ছেলেটার হাতে স্যুটকেস, ভারী, টানতে পারছে না। খুব সম্ভব ছেলেটার সব সম্বল এখানে।

জার্মানি থেকে বিতাড়িত ইমিগ্র্যান্ট?

না।

তাহলে?

১৯৪৮-এ মিশর থেকে বিতাড়িত আরব ইহুদি এই ছেলেটা।

 

পাঁচ

আবার দ্যাখো এই ফটোটা। কেনিয়ার একটা রিফিউজি ক্যাম্পে উদ্বাস্ত্তর মতো বসে আছে একটা যুগোশ্লাভ ছেলে। আর একটা বাচ্চা ছেলে আল সাতের একটা মরুভূমিতে ক্যাম্পে বসে আছে। আর এই ফটোটা দ্যাখো। একটা গ্রিক ছেলে গাজার কাছে একটা ক্যাম্পে সব হারিয়ে বসে আছে। সব ছেলে দেখতে একই রকম। সর্বস্ব খোয়ানো, সর্বস্ব হারানো, জগৎসংসারের কাছে হাত পাতা একটা ছেলে, হাত বাড়িয়ে বসে আছে। যদি কেউ তাকে ভিক্ষা দেয়, সাহায্য করে, বাঁচার পথ দেখায়। এরা সবাই যমজ। সবদিক থেকেই রিফিউজি।

এদের দেখে মনে হয়, এরা শেষবারের মতো খাবার খেয়েছে। এদের মা মারা যাওয়ার পর কেউ তাদের খাবার রান্না করে দেয়নি। তারা কাঁদতে কাঁদতে খেয়েছে। তারা কৃতজ্ঞ পৃথিবীর কাছে। তারা খেতে খেতে কেঁদেছে।

তারা ইতিহাসের কাছে হাত বাড়িয়ে লাস্ট সাপার খেয়ে চলেছে।

সেজন্য আমার কানে ফিসফিস করে কথা বলো। সত্য কথা, নির্মম কথা, নিষ্ঠুর কথা, ফটোগুলি দেখে বলতে থাকো। ফিসফিস করে ইতিহাসের কথা বলতে থাকো।

 

ছয়

আমি অনেক আগে ইভাকুয়েশনের ওপর একটা বই পড়েছিলাম। মা এবং মেয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। তারা পাশাপাশি দুটি গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছে। মেয়ের বিয়ের পর, মেয়ের গ্রামে মাঝে মাঝে মা বেড়াতে যায়। হেঁটেই যাওয়া যায়। মেয়ে মায়ের বাড়িতে ক্বচিৎ কখনো বেড়াতে আসে। তার সংসারে নানা ঝক্কি-ঝামেলা। স্বামী মেজাজি, শ্বশুরের নানান খেদমত করতে হয়। মায়ের সংসারে এখন কেউ নেই। স্বামী মারা গেছে। একমাত্র ছেলে খার্তুমে চাকরি করে। মা-ই মেয়েকে দেখতে আসে। পাশাপাশি দুই গ্রাম, কিন্তু দুই রাষ্ট্রের মধ্যে। মরুভূমির মধ্যেখানে অদৃশ্য দুই গ্রাম, দুই রাষ্ট্রের দুই গ্রাম, পাশাপাশি হওয়া সত্ত্বেও একটা রাষ্ট্রের নাম সুদান, অন্য রাষ্ট্রের নাম মিশর। মা সুদান রাষ্ট্রের বাসিন্দা, মেয়ে মিশর রাষ্ট্রের বাসিন্দা। হাত তুলে মেয়ে তার রাষ্ট্রের সীমান্ত দেখায়। আবার হাত তুলে মা তার রাষ্ট্রের সীমান্ত দেখায়। তারপর দুজনই হাসতে থাকে। হাসির আওয়াজে কয়েকটা পাখি এদিক-ওদিক উড়ে যায়। তাদের দুজনের পায়ের নিচে বালি, মরুভূমির হলুদ ও সাদা বালি।

 

সাত

মরুভূমির মধ্যে সীমারেখা, সেই সীমারেখা উড়ে যায়, কখনো কখনো। তখন মায়ের বাড়িঘর পড়ে মিশর রাষ্ট্রে, আর মেয়ের বাড়িঘর পড়ে সুদান রাষ্ট্রে। আবার সীমারেখা লোপ পায়। মা শুধু চেনে পাশের গ্রামে তার মেয়ের বসত, আর বসত ওইখানে। এই পর্যন্তই। মেয়ের গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন। এই লাইন মরুভূমির মধ্য দিয়ে কায়রো গেছে। মা কখনো কখনো খাবার দিতে আসে মেয়েকে, মেয়ে সন্তানসম্ভবা। ট্রেন আস্তে আস্তে চলা শুরু করে। কখনো কখনো মা খাবার হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ট্রেন সুদানের দিকে যায় না। এই ট্রেন যায় মিশরের দিকে। সুদান কাকে বলে মা জানে না। মিশর কাকে বলে মা জানে না। মা তাকিয়ে থাকে দূরের পাহাড়ের দিকে। সবটা ঘিরে অন্ধকার, ঘন অন্ধকার। তারপর আলোর নিচে সীমাহীন বালির বিস্তার। মা ও মেয়ে এভাবে বিদায় নেয় দুই রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থেকে।

আট

কখনো কখনো আমি বোনের বাড়িতে রাত্রে থেকে যেতাম। আবার কখনো কখনো আমার বোন আমার বাড়িতে রাত্রে থেকে যেত। আমরা কথা বলতাম কৈশোরকালের কিংবা ইংল্যান্ডের প্রবাস জীবনের কিংবা আত্মীয়স্বজনদের।

নয়

আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকতাম, মাটি ও তারাদের দিকে চেয়ে। আমরা বলতাম সেইসব ছেলেমেয়ের কথা, যারা একই গ্রামের বাসিন্দা হয়েও, গ্রামের বাইরে কখনো যায়নি, কিংবা সেইসব ছেলেমেয়ের কথা, যারা ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকায় সেটেল করেছে। যারা কখনো আমাদের ছোট গ্রামটিতে আর ফিরে যাবে না।

দশ

আমরা কি ফিরে গেছি। তারা তাদের যৌবনকালে, বিকেলের ঘুম থেকে উঠে, চা কিংবা কফি খেতে খেতে, নিজেদের অতীতকালের কথা ভাবতে ভাবতে কিংবা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, বাংলাদেশের কবেকার পেছনে ফেলা গ্রামটিতে ফিরে যাবে।

আমার বোন বলত, মানুষকে ধ্বংস করা যায়, টুকরো টুকরো করা যায়, ছেড়ে আসা গ্রামের কথা মনে করিয়ে দিয়ে। মনে করিয়ে দেওয়া একটা দগদগে ক্ষতের মতো, কিছুতেই শুকায় না।

আমি বোনকে বললাম, সন্ধ্যা হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের চারপাশে একটা পৃথিবী তৈরি করেছি, যার ভেতরে আছে স্পেসের ডেসপেয়ার। শূন্য স্পেস যার মধ্যে আমরা রোজই ছুড়ে ফেলছি নোংরা আবর্জনা, কারপার্ক থেকে রাস্তা পর্যন্ত অন্ধকার, অন্ধকার। আমাদের চারপাশে আছে শিল্পকারখানার রাবিশ বিন, স্পেসকে আমরা কয়েদ করে রেখেছি আমাদের বিভিন্ন নির্মাণের মধ্যে, ব্যর্থতার বীজ আমরা বপন করছি আমাদের চারপাশে।

আমার বোন আস্তে আস্তে বলত, আমার ভয় করে। রিফিউজি ছেলেদের মতো আমার ভয় করে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিছু বুঝি না।

এগারো

আমি কিছুদিন মরুভূমিতে কাটিয়েছি। নুবিয়ান মরুভূমিতে। বাড়িগুলি তিনকোনা। সূর্যের আলো এবং চাদের আলো তিনকোনা বাড়িগুলিকে অপার্থিব করে তুলত। সূর্যের আলো এবং চাঁদের আলো বালির দেয়ালগুলিকে জাদুমন্ত্রে মাইলের পর মাইল মরুভূমির মধ্যে উড়িয়ে নিয়ে যেত। ছাদের নিচে খুপরি জানালা কাটা, বাতাস যাতে চলাফেরা করতে পারে, আর রোদের তাপ এবং বালির ঝড় ঠেকাতে পারে। আমি বাতাসের ছোঁয়া পেতাম কিন্তু রোদের তাপ পেতাম না, আর বালির ঝড় পেতাম না। ঝড় ওইখানে, বালি ওইখানে, আমার চোখের পরপারে।

নুবিয়াতে আমি গিয়েছিলাম নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য। কিন্তু ফিরে এসেছি নিজের ভেতরে অজস্র কান্না নিয়ে। মানুষ মানুষকে বিতাড়িত করেছে গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, এক ভূগোল থেকে অন্য ভূগোলে।

সন্ধ্যাবেলা বালির ঢিবির আড়ালে বসে থাকতাম। বাতাস ভারী হয়ে আসত চারপাশে। তারপর নক্ষত্র উঠত, নিজেদের বিছিয়ে দিত আকাশ থেকে আকাশে। বালি ঠান্ডা হতো। মরুভূমির হাজার হাজার কিলোমিটারের ঠান্ডা আমার চারপাশ ঘিরে ধরত। এই ঠান্ডার শেষ নেই, অনিঃশেষ বালি থেকে উত্থিত ঠান্ডা।

আমি কারো হাত ধরতে চাইতাম, যে-হাত আমাকে মরুভূমি থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, আমার চোখের পানি আমার চোখ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে।

আমার পক্ষে গবেষণা করা সম্ভব হয়নি। আমি ফিরে এসেছি ইংল্যান্ডে, আমার চেনাজানা ঘরগৃহস্থালিতে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরামে।

বারো

যমজ ভাইবোন ইতিহাস ভর্তি করে রেখেছে। তাদের চোখে-মুখে ভয়। আমরা একপাশে তাদের টেনে রাখি, ভাবটা হচ্ছে তাদের সরলতা আমাদের যেন ঘিরে ধরে। আসলে আমরা তো সরল নই। এরা কি শেষ পর্যন্ত সরল থাকবে? যমজ ভাইবোন বিষণ্ণতার মধ্যে বেঁচে থাকে। রূপকথায় যা কিছু থাকে, তারা সবই জানে। তারা জানে জঙ্গলের ভয়, ডাইনি বুড়ির কথা, মাটির নিচে পুঁতে রাখা কংকালের কাহিনি। বাচ্চাদের ভয়ের মধ্যে তাদের কথা                   লুকানো থাকে, যাদের তারা সবচেয়ে ভালোবাসে। যমজ ভাইবোন কি দুই রাষ্ট্র দুই ধর্ম দুই জাতির ফসল।

তেরো

এসব যমজ ভাইবোনের ইতিহাসটা কী। তারা যেসব দেশ থেকে এসেছে যেখানে তারা নিজেদের জীবনের জন্য হাত পেতে থাকে। তারা হাত পাতে তাদের যেন তাদের ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে হত্যা না করা হয়।

প্যালেস্টাইনের মুসলমান বাচ্চা, ইসরায়েলের ইহুদি বাচ্চা, মিশরের খ্রিষ্টান বাচ্চা, শ্রীলংকার তামিল বাচ্চা নিজেদের চোখ বুজতে ভয় পায়, আবার চোখ খুলতে ভয় পায়।

আতঙ্ক দেখে দেখে তারা বড়ো হয়েছে, আবার আতঙ্কের মধ্যে তাদের জীবন কাটছে। তারা বাংলাদেশের হিন্দু, তারা ভারতের মুসলমান। তারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। তারা আর একটা মুহূর্ত বেশি বেঁচে থাকতে চায়। যদি বেঁচে থাকা যায়।

চৌদ্দ

আমি আমার বোনকে বলি আর বোন আমাকে বলে : বিভিন্ন জায়গার দুঃখকষ্ট নিয়ে আমরা জন্মাই। ইতিহাস তার প্রমাণ।

মুখোমুখি বসে আমরা কথা বলি। বোনের গলা আমার গলার খুব কাছে। মনে হয়, বোনকে বলি, আমার কথাগুলি তোমার সারা শরীরে বিছিয়ে রাখো। বোনও আমাকে বলে, যা বলি তা তো সারাজীবনের ঘটনা। স্মৃতিগুলি ছাড়া আমাদের কিছু নেই। তোমাকে আমার দরকার এসব স্মৃতি শোনাবার জন্য। তোমার কি তাই মনে হয় না?

 

পনেরো

খবরের কাগজের এই ক্লিপিংগুলি, এই ফটোগুলি আমাদের দরকার। এই ফটোগুলি হচ্ছে শেষবারের মতো আমাদের বাবা-মাকে যেখানে দেখেছি।

আমাদের চারপাশের আকাশটা, আমাদের চারপাশের বাতাসটা, মনে হয় পাথরের তৈরি, স্মৃতিগুলি ভেঙে পড়েছে, ভারতে বাংলাদেশে শ্রীলংকায় মিয়ানমারে।

 

ষোলো

আমি আমার বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। চোখ থেকে আতঙ্ক ছিটিয়ে পড়ছে।

অনিঃশেষ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের চলাফেরা। যদি একে চলাফেরা বলা যায়।

 

সতেরো

অনেক আগে, কৈশোরকালে, একটা গল্প পড়েছিলাম। কিসনচন্দের লেখা : পেশোয়ার এক্সপ্রেস।

লাশভর্তি ট্রেন ছুটে চলেছে পেশোয়ার থেকে দিল্লির দিকে। আমাদের বাবা-মায়ের লাশ শেষবারের মতো দেখে আমরা পালিয়ে যাচ্ছি পেশোয়ার থেকে লাহোর থেকে অমৃতসর থেকে দিল্লির দিকে।

মৃতরাই কিংবা লাশরাই আমাদের ইতিহাসের শেষ  সম্বল।