উনিশ শতকের মিথ ও বিদ্যাসাগর পাঠ

আহমেদ মাওলা

উনিশ শতক আমাদের বর্তমানতার মধ্যে কীভাবে, কতটা তাজাভাবে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভাব-প্রভাব নিয়ে হাজির হয়েছে, সেটা একটু দেখা দরকার। উনিশ শতক সম্পর্কে যে মেটান্যারেটিভস প্রচারিত-প্রতিষ্ঠিত, তা নিয়ে ঢাকার বাঙালি সমাজে কোনো ক্রিটিক্যাল রিডিং চোখে পড়ে না। কাণ্ডজ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তিক অভিনিবেশ দিয়েও যে পাঠ বা চর্চা করা হয়েছে, তা নয়। কলকাতায় বরং উপনিবেশ-উত্তর সময়ে কিছু জিজ্ঞাসা, আত্মসমীক্ষার সন্দর্ভ রচিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে। উনিশ শতক মানেই বাঙালি রেনেসাঁস, আধুনিকতা, সমাজসংস্কার, প্রগতি – এই বিষয়গুলোর বয়ান জারি আছে। ইতিহাসের এই বয়ানগুলো  কতটা কার্যকরভাবে  আমাদের বর্তমানময়তার মধ্যে খুঁজে পাই? এই জিজ্ঞাসাকে সামনে রেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে (১৮২০-৯১) পাঠ এবং তাঁর দ্বিশতজন্মবার্ষিকীতে স্মরণ করা হবে আমাদের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উনিশ শতকে নবজাগরণ বা রেনেসাঁস হয়েছে কি হয়নি, এই বেহুদা আলাপে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখি না। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), ডিরোজিও (১৮০৯-৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-৯৮), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-৯১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-৭৩), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬-৮৬), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪), প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) প্রমুখ রেনেসাঁসের পুনর্জাত সন্তান। এঁরা কলকাতার আরবান জনগোষ্ঠী, উচ্চবর্ণ হিন্দু, ভদ্রলোক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, দেবেশ রায় বলেছেন, নবজাগরণ বলে যদি কিছু ঘটেও থাকে, তা এই গোষ্ঠীর মধ্যেই ঘটেছে, ইতিহাসের আকার পায়নি, মিথ আকারে থেকে গেছে। (দেবেশ ১৯৯০ : ৪৩) এই রেনেসাঁস প্রকল্পের মধ্যে ‘আদারিং’ রয়েছে। বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণি ইংরেজদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছে এবং নিশ্ছিদ্র কলোনিয়াল প্রসেসের মধ্যে এরা বিকশিত হয়েছে। এর বাইরে বিপুলসংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দু, সাধারণ মানুষ, কৃষক সমাজ, মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষকে তারা জাগাতে পারেনি। নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং মুসলমান সমাজের জন্য নবজাগরণের কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি ছিল না। শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন – ‘মানবেন্দ্র রায়ই প্রথম ভারতীয় ভাবুক যিনি স্পষ্ট করে বলেন যে পশ্চিমী রেনেসাঁসের সদৃশ আদৌ কিছু এদেশে এযাবৎ ঘটেনি। ‘… পশ্চিমে খৃস্টধর্ম বহু শতাব্দী ধরে অনুসন্ধিৎসা ও মুক্তির স্পৃহাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল; সেই জড় এবং মোহগ্রস্ত দশা থেকে ইউরোপের উদ্ধার ঘটে রেনেসাঁসের ভিতর দিয়ে। কিন্তু ভারতবর্ষে ইসলাম অথবা ইংরেজ কোনো শক্তিই সমাজ-বিপ্লবের সহায়ক হয়নি।’ (শিবনারায়ণ ১৯৯২ : ৯-১০) কলোনিয়াল প্রসেসের মধ্যে অ্যাংলোসাইস হিন্দুধর্ম নিরাকার ব্রাহ্মধর্মে রূপলাভ করার মধ্য দিয়ে একটা আপসরফা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানেরা আদারিংয়ের শিকার হয়েছে। তারা বিদেশি, যবন নামে অভিহিত হয়ে রেনেসাঁস প্রকল্পের বাইরে থেকে যায়। ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাভাষী মুসলমান একজনও ছিল না। শাসক ইংরেজ আর রাজ্যচ্যুত মুসলমানদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধই মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ – প্রচলিত এই মতের ভিন্নতা দেখিয়েছেন আনিসুজ্জামান (২০০১) ও আহমদ শরীফ (১৯৯২)। ধর্মীয় গোঁড়ামি বা ইংরেজ-বিদ্বেষের কারণে মুসলমান সমাজ ইংরেজি শিক্ষা থেকে বিরত ছিল, এই প্রতিষ্ঠিত মতও সঠিক নয়। আহমদ শরীফ (১৯৯২ : ১৬৬-১৭৯) নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণ ‘ব্রিটিশ-হিন্দুর’ ষড়যন্ত্র নয়, বরং অবস্থা ও  অবস্থানগত কারণে উপনিবেশ নির্মিত নয়া আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় মুসলমানেরা নিজেদের হাজির করতে পারেনি।  ‘উনিশ শতকে উদ্ভূত ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যতন্ত্রের তল্পিদার-মাত্র, … সম্প্রসারণশীল ব্যবসা-বাণিজ্য কলকারখানা, উদ্যোগ-উদ্ভাবনা বা প্রযুক্তিবিদ্যার সহায়ক না হয়ে এই শ্রেণির সদস্যারা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা এবং জাতিভেদনির্ভর সমাজ-সংগঠনের সহায়তায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন জমিদার, নিযুক্তক, চাকুরে অথবা পেশাজীবী হিসেবে। … অধিকাশংই এসেছেন হিন্দু সমাজের পরম্পরাস্বীকৃত উঁচুজাতের কোঠা থেকে। ফলে এঁরা রক্ষণশীল, উপযোজন এদের ব্রত, সামাজিক উল্লম্ব গতি অথবা মৌলিক রূপান্তরের না এঁরা প্রবর্তক, না প্রতিভূ।’ (বি. বি. মিশ্র ১৯৬১ : ৫৫) আঠারো শতকের শেষার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বোধ কাজ করেছিল যে, ভারতীয় সভ্যতার চাইতে ইংরেজ সভ্যতা উন্নত, ভালো, ইতিবাচক। এই মানসিকতা থেকেই তারা পুরনো আচার, ভাষা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা পালটে কলোনিয়াল কাঠামোর নয়া জামানার মানুষ হয়ে ওঠে। কলকাতার বাবু কালচার, ইয়ং বেঙ্গলদের ব্যাপক দ্রোহের মধ্যে তা দৃশ্যমান। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর আত্মঘাতী বাঙালি (১৯৮৮) ও বাঙালি জীবনে রমণী (১৯৬৮) দুটো বইতে সেই সূক্ষ্ম পরিবর্তনের দিকগুলো বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন। এই শ্রেণির ভেতর থেকে উঠে আসা সমাজসংস্কারের উদ্যোগ যেমন – রামমোহনের সতীদাহপ্রথা বিলোপ আইন (১৮২৯), বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন (১৮৫৬), বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ, নারীশিক্ষার উদ্যোগ, ইয়ং বেঙ্গলদের দ্রোহ, তত্ত্ববোধিনী সভা, ব্রাহ্ম আন্দোলন, ইংরেজ প্রশ্রয়ে, আনুকূল্যে হয়েছে, ভারতীয়দের স্বার্থে নয়, কলোনিয়াল প্রসেসের অংশ হিসেবে। এ-বাবদ রামমোহনকে বা বিদ্যাসাগরকে যে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, সেটা অনেকটাই মিথ। বরং তাঁদের ভূমিকা ইংরেজ শাসনকে সহায়তা করার শামিল। এইসব ঘটনা ঔনিবেশিতের অভিজাত অংশের মনস্তাত্ত্বিক সান্ত্বনার কারণ হয়েছিল। এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, প্রাচ্যতত্ত্ব হচ্ছে মূলত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ক্ষমতা, আধিপত্য ও কর্তৃত্বের এক জটিল সম্পর্ক, যে-সম্পর্ক নিয়ত বদল হয়, নিয়ত যার বিন্যাস পরিবর্তিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ‘সেলফ’ এবং ‘আদারিং’-এর ধারণা প্রতিষ্ঠা পায়। প্রাচ্যের মানুষ হীন, দুর্বল, অলস, বর্বর, অশিক্ষিত, খুনখারাবি-দাঙ্গাহাঙ্গামা করে, প্রাচ্যের মানুষ কালো, তারা নিকৃষ্ট, অনুমাননির্ভর কথা বলে ইত্যাদি, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের লোকেরা সাদা, সুশৃঙ্খল, পরিশ্রমী, তারা নিখুঁতভাবে কথা বলে। এই স্টেরিওটাইপ তৈরি হওয়ার ফলে যে-সংজ্ঞা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, প্রাচ্যকে জানা, প্রাচ্যকে হীন হিসেবে উপস্থাপন করা, সে হীন-দুর্বলকে দখল করা, শাসন করা, কব্জা করার একটা সাংস্কৃতিক প্রণোদনার নাম হচ্ছে ‘ওরিয়েন্টালিজম’। ওরিয়েন্টালিস্ট এবং মিশনারিদের তৎপরতায় কথিত ‘এনলাইটেনমেন্ট’ ‘রেনেসাঁসে’র পর ভারতীয় শাসন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে রানির অধীনে গেলে, ভারত শাসনের নীতি পরিবর্তিত হয়। তখন ওরিয়েন্টালিস্ট এবং অ্যাংলোসাইসদের মধ্যে  মতপার্থক্য দেখা দেয়। ওরিয়েন্টালিস্টদের অভিমত ছিল যে, ভারতীদের নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার নিয়ে থাকতে দেওয়া উচিত, অ্যাংলোসাইসদের মত ছিল, ভারতীয়দের শিক্ষায়-সভ্যতায় ইউরোপিয়ান ধারায় বদলে দিতে হবে। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতায় বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য ‘পণ্ডিত-সাহেবে’র যৌথতায় পাঠ্যপুস্তক রচনা, কথোপকথন, ইতিহাস, অনুবাদের গদ্যগ্রন্থাদি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাভাষার উপনিবেশায়ন যেমন ঘটেছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যেরও  ভাব-প্রভাবের দিক দিয়ে পশ্চিমায়ন, ইংরেজায়ন  ঘটেছে। গ্রামসির ভাষায় সাংস্কৃতিক এই  আরোপণ, আধিপত্যকে ‘হেজিমনি’ বলা যায়।  বিশ শতকের তৃতীয় দশকে কল্লোল, কালি-কলম, বিচিত্রা, প্রগতি, পরিচয়, কবিতা পত্রিকা এবং  তিরিশি পঞ্চ কবির রচনার মধ্যে যে ‘আধুনিকতার’ প্রতিফলন দেখি, রবীন্দ্র-দ্রোহ নামে তা ইউরোপীয় ভাব-রূপকের কাঠামোয় ‘আধুনিকতা’র  উচ্চ তকমা পেয়ে যায়; যা ‘মধ্যযুগীয়’ আখ্যা থেকে তিরিশি কবিদের পরিত্রাণ দেয় এবং পরবর্তীকালে ‘আধুনিক’ পরিচয় সূত্রে গ্রাহ্য ও গুরুত্ব পেয়ে আসছে। এই ‘আধুনিক কবিতা’ নগরজীবন, কলাকৌশল, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ অর্জন, রবীন্দ্র-উত্তর আগন্তুক ঋতুর মতোই কাজ করেছে।  ‘আধুনিকতাবাদী কবিতার’ বিশেষ অর্জনের দিক যেমন আছে, তেমনি বিসর্জনের বেদনাও কম নয়। যেমন ‘আধুনিক কবিতা’ আমজনতা, মাটিলগ্ন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নাগরিক, শিক্ষিত, উচ্চকোটি মানুষের উৎপাদন ও উপভোগের সামগ্রী হয়ে গেছে, এটাই ‘আধুনিক কবিতার’ জনবিচ্ছিন্নতার ইতিহাস। তিরিশি কাব্যপ্রকল্প তাই বিস্তারিত অর্থে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, সামাজিক সংকট এড়িয়ে অ-এশীয়, অ-দেশীয় থেকে গেছে। এটাই মূলত ‘আধুনিকতা’ নামে পশ্চিমায়ন বা বাংলা সাহিত্যের উপনিবেশায়ণেরই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।

‘আধুনিকতা’ এবং ‘প্রগতি’ চেতনার মধ্যে প্রবলভাবে যে ওয়েস্টার্নাইজেশন ঘটেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখায় – ‘হিন্দু কলেজ হইতে নবোত্তীর্ণ যুবকদল সর্ব্বান্তঃকরণের সহিত মেকলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। … বলিতে লাগিলেন যে – এক সেলফ্ ইংরাজী গ্রন্থে যে জ্ঞান আছে, সমগ্র ভারতবর্ষ বা আরবদেশের সাহিত্যে তাহা নাই। তদবধি ইঁহাদের দল হইতে কালিদাস সরিয়া পড়িলেন, সেক্সপিয়ার সে স্থানে প্রতিষ্ঠিত হইলেন; মহাভারত রামায়ণাদির নীতির উপদেশ অধঃকৃত হইয়া Edgeworth’s Tales সেই স্থানে আসিল, বাইবেলের সমক্ষে বেদ বেদান্ত গীতা প্রভৃতি দাঁড়াইতে পারিল না।’ (শিবনাথ ১৯৫৭ : ১৪২) এটা উপনিবেশায়ণের একটা গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নায়ন। মিশনারিরা ১৯৩০ সালের মধ্যে ভারতের অন্তত দুই শতাংশ লোককে ধর্মান্তরিত করেছে (Spear 2004 : 280) ‘আধুনিকায়নের’ ভূমিকায়, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, নারীশিক্ষার ব্যবস্থা, ভারতীয় সমাজের ‘কুপ্রথা’র বিরুদ্ধে প্রচারণা ও নিরসনের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টধর্ম ও উপনিবেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল, ইতিবাচক ও প্রগতি রূপ ধারণ করে। এভাবে উপনিবেশের সুবিধাভোগীদের ‘সম্মতি’ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে ইংরেজ শাসন ভারতে দীর্ঘস্থায়ী হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্ম-তৎপরতাকে প্রধানত চার শ্রেণিতে চিহ্নিত করা যায় –

১. সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে রচনা : বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫), বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব – দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার – দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৭৩), বাল্যবিবাহে দোষ বেনামিতে প্রকাশিত : অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), বিধবাবিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা (১৮৮৪)।

২. শিক্ষার প্রয়োজনে রচিত পাঠ্যপুস্তক : বর্ণপরিচয় – প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৫), ঋজুপাঠ – প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাগ (১৮৫১, ১৮৫২), সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১), সংস্কৃত ভাষা সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৪), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬), মহাভারত-উপক্রমণিকা ভাগ (১৮৬০), আখ্যানমঞ্জুরী (১৮৬৩), শব্দমঞ্জুরী (১৮৬৪), বোধোদয় (১৮৫১)।

৩. অনুবাদমূলক গদ্য সাহিত্য : বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৮), শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯), বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮), জীবনচরিত (১৮৪৯)।

৪. আত্মজীবনী ও ব্যক্তিগত গদ্য-পদ্য রচনা : বিদ্যাসাগরচরিত – স্বরচিত (১৮৯১), নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস (১৮৮৮), সংস্কৃত রচনা (১৮৮৯), শ্লোকমঞ্জুরী (১৮৯০), পদ্যসংগ্রহ – প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৮, ১৮৯০) বিদ্যাসাগরের উইল (১৮৭৫) চিঠিপত্র।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিদ্যাসাগরকে আমরা পড়বো কীভাবে? কারণ, প্রায় দুশো বছর ধরে বিদ্যাসাগরকে কেন্দ্র করে যে নরমেটিক এবং ডোমিনেটিং ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে, তাকে এড়িয়ে বিদ্যাসাগর পাঠের আলাদা একটা তরিকা বা পাঠপদ্ধতি আবিষ্কার করা দরকার। আমি মনে করি বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর সমাজবাস্তবতায় বসে বিদ্যাসাগরকে পাঠ করতে হবে তাঁর সম্পর্কে প্রচারিত যে ডোমিনেটিং ডিসকোর্স চাউর আছে, সেগুলো পুনর্বিচার করে দেখার মাধ্যমে অথবা উপনিবেশিত সোশিও কালচারাল স্টাডিজের আলোকে, এটা আমার একটা পাঠপ্রস্তাব। অন্য আরো অনেকভাবে বিদ্যাসাগরকে পাঠ করা যেতে পারে; কিন্তু আমি যেহেতু একজন রিডিংয়ের লোক, আমি পড়তে চাই গ্রান্ডন্যারেটিভসের ওই ওই দিকগুলো, যেগুলো আমার বর্তমানতার মধ্যে হাজির হয়, আমাকে উসকে দেয় নতুন ন্যারেটিভস তৈরি করতে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি মনে বারংবার উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড় লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে, তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবনীতে এই অনন্যসুলভ মনুষ্যত্বের প্রাচুর্যই সর্বোচ্চ গৌরবের বিষয়।’ (রবীন্দ্রনাথ ১৯০৯ : ৭) এই ‘মনুষ্যহিত’ ‘দয়া’ উপনিবেশের ‘লিবারেল হিউম্যানিজমের’ প্রভাব। এছাড়া জেদ, দৃঢ়তা, সাহস, সংকল্প, আত্মমর্যাদাবোধ তাঁর চরিত্রকে মহৎ করেছে। নিঃস্ব ব্যক্তির অভাব, বিপন্ন ব্যক্তির বিপদ, তিনি একাই ঘুচাতে চাইতেন। সেটা তাঁর নিঃসন্দেহে মহৎ গুণ। কিন্তু উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক জীবনে যেসব গুরুতর সংকট বিরাজমান ছিল, যেমন – বর্ণপ্রথা, কৃষক-শ্রমিক শোষণ, ভূ-রাজস্বের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, নীলবিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। টুলো ব্রাহ্মণের সন্তান যখন শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ করলেন, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত – শাস্ত্রের এই পুনর্বিচার, শাস্ত্রবিধিরক্ষিত হিন্দুসমাজের ওপর একটা বড় ধরনের আঘাত হয়ে আসে। এই বৈপ্লবিক আঘাত আরোপণমূলক নয়, বিদ্যাসাগরের আঘাত ছিল ভেতর থেকে। তখন গোঁড়া ব্রাহ্মণরা গোপনে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-গালি কিছুই তাঁকে দৃঢ় সংকল্প থেকে টলাতে পারেনি। বহুবিবাহবিরোধী পুস্তিকায় তিনি ব্রাহ্মসমাজের কৌলীণ্যপ্রথার ইতিহাস উদ্ঘাটন করে প্রমাণ করেন, তা অশাস্ত্রীয়। কায়স্থ সমাজের আচারও তিনি বিচারে আনেন। দুর্ভাগ্যবশত লোকাচারের সঙ্গে তাঁর মৌলিক বিরোধিতা ঘটে। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ রোধ, নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান, কোনোটাই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। চটিজুতা ও মোটাধুতি পরে তিনি সকলের কাছে সম্মান লাভ করেছিলেন। তবু উনিশ শতকের কলকাতায় বিদ্যাসাগর একা, নিঃসঙ্গ, স্বজাতি সোদর, সহযোগী, তাঁর মহৎ কাজের কোনো উত্তরাধিকারী কেউ ছিল না। তিনি পরোপকার করে কৃতঘ্নতা পেয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকালে যা করতে চেয়েছেন, সহায়তা পাননি, পদে পদে বাধা পেয়েছেন। সংস্কৃত কলেজে রসময় দত্তের সঙ্গে মতান্তরে (১৮৫০) পদত্যাগ করেন, শিক্ষাবিভাগের ময়ট সাহেবের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে (১৮৫৮) চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন, ‘আত্মীয়-বান্ধবেরা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তোমার চলিবে কী করিয়া। তিনি বলিলেন ‘আলু-পটল বেচিয়া, মুদির দোকান করিয়া দিন চালাইব।” (রবীন্দ্রনাথ ১৯০৯ : ৩১)। হ্যালিডে সাহেব বিদ্যাসাগরকে পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু বিদ্যাসাগর পদত্যাগপত্র সংশোধন করতে রাজি হননি। তিনি লিখেছেন –

I thought it possible you might be asked to explain the cause of your dissatisfaction with the administration of the depertment and as you expressed an insuperable objected to do this in a public form I suggested that it must be better to omit what you were unwilling to account for and merely allude to your illness which though not the sole was certainly a sufficient reason for resignation.

কারণ, ‘বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ইংরেজের রাষ্ট্রশক্তিকে, যাতে বাঙালি সমাজে নতুন গতিবেগের ধাক্কা লাগাতে পারেন। সে-উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকারের ওপর তিনি ভরসা করেছিলেন। সরকার বলতে প্রথম দিকে হয়তো লাটসাহেবের ব্যক্তিগত শাসন, সুতরাং বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত বন্ধুতাই সে-সরকারে অনেকটা প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে তো সরকার তার নিজের অনিবার্য চেহারাটি পাচ্ছে আর বিদ্যাসাগর সেই ব্যুরোক্রেসির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে গেছেন। তার ভরসাস্থল হয়ে উঠছে প্রতিপক্ষ।’ (দেবেশ ২০২০ : ৬০) বিদ্যাসাগরের কণ্ঠস্বর ক্রমেই অভিমানী হয়ে ওঠে এবং এই অভিমান সত্য হয়। ইংরেজ সমর্থনে বাংলার শিক্ষা, স্ত্রীশিক্ষা, সমাজসংস্কারের যে-স্বপ্ন তিনি  দেখেছিলেন, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতাকে কেন্দ্র করে, মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে তাকে সে কর্মক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়াতে হলো? এটা কি বিদ্যাসাগরের দুর্ভাগ্য? নাকি বাংলার রেনেসাঁসের নিয়তি? এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

উনিশ শতকের রেনেসাঁস, সমাজসংস্কার আসলে মিথ, কলকাতার ভদ্রলোক শ্রেণিতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসি ততদিনে নখ-দন্ত বিস্তার করে বসেছিল, অপরদিকে বিদ্যাসাগরের সংস্কারের নিড়ানো মাটিতে জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সংস্কারের ধারা থেকে জাতি সরে গেছে, শিক্ষা বিস্তারের সরকারি ব্যবস্থা থেকে তিনি সরে এলেন, এভাবে সমাজ, জাতি, নগর কলকাতা, বীরসিংহ দেশের-গ্রাম থেকে বিদ্যাসাগর শারীরিক-মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সমাজের মূলধারার পত্তনি, মনুষ্যত্ব, জীবনের শ্রমের সঙ্গে ফলের বিয়োজন ঘটিয়ে বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত) কর্মাটাঁড়ে অনাড়ম্বর, অবহেলিত সাঁওতালদের সঙ্গে অবশিষ্ট জীবন কাটিয়েছেন। জাতির বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো রাস্তা রাখেননি, রেনেসাঁসের ভেতরের মানুষটি ইতিহাস থেকে ছিটকে পড়লেন?  ‘করুণার সাগর’ এই লোকটি নিয়ে গত দেড়শো বছর ধরে কত কাহিনি, কত গল্প, লোককল্পনার বিষয় হয়ে ওঠে তাঁর সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব। উনিশ শতকে বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা ছেড়ে কেন তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গেলেন? তবে কি তাঁর চেতনা ও মূল্যবোধের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তাই এই অন্তরাল? বাঙালি জীবন যাপনে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগর! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সেই সময় (১৯৯১) উপন্যাসে নবীন চরিত্রের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের যে-প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেছেন, পাঠকদের সামনে হাজির করেছেন, তাঁর অজেয় পৌরুষ, অক্ষয় মনুষ্যত্ব, ইতিবাচক চরিত্র হয়ে আমাদের স্মরণে ভেসে থাক। মিথ আর ইতিহাসে বিদ্যাসাগরকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল, বিদ্যাসাগর উপনিবেশের ‘অপর নির্মাণ’ এবং মহৎ প্রাণের বৃহৎ ট্র্যাজেডির মতো বেঁচে থাকবেন বাঙালি জীবনে চিরদিন।

উল্লেখপঞ্জি

১. আহমদ শরীফ ১৯৯২, বাঙলা, বাঙালি বাঙালিত্ব, সাহিত্যলোক, কলকাতা।

২. আনিসুজ্জামান ২০০১, মুসলিম-মানস বাংলা সাহিত্য, প্যাপিরাস, কলকাতা।

৩. দেবেশ রায় ১৯৯০, উপনিবেশের সমাজ বাংলা সাংবাদিক গদ্য, প্যাপিরাস, কলকাতা।

৪. দেবেশ রায় ২০২০, দ্বিতীয় চেতনার নির্বাসনে, স্পার্ক বুক কোম্পানি, ইন্ডিয়া।

৫. নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৯৮৮, আত্মঘাতী বাঙালী, মিত্র ও ঘোষ প্রা. লি., কলকাতা।

৬. নীরদচন্দ্র চৌধুরী ১৯৬৮, বাঙালী জীবনে রমণী, মিত্র ও ঘোষ প্রা. লি., কলকাতা।

৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৯, বিদ্যাসাগরচরিত, বিশ্বভারতী, কলকাতা।

৮. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯১, সেই সময়, অখণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৯. শিবনারায়ণ রায় ১৯৯২, রেনেসাঁস, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা।

১০. শিবনাথ শাস্ত্রী ১৯৫৭, রামতনু লাহিড়ী তৎকালীন সমাজ, দ্বিতীয় সংস্করণ, নিউ এজ পাবলিকেশন প্রা. লি., কলকাতা।

১১. B.B. Misra 1961, The Indian Middle Classes.

১২. Said, Edward 1978, Orientalism, Penguin Books. ১৩. Spear, Percval 2004, The Oxford History of Modern India 1740-1975, 2nd edition, Oxford University press, New Delhi.